এপিসোড ১
এক দুই তিন
এপিসোড ২
অদিতি ভট্টাচার্য
৩
“কী ভাবছ পিসিমণি?” পিসিমণির গম্ভীর মুখ দেখে নীলু বলল।
পিসিমণি নিরুত্তর, নীলুও অত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়, তাই আবার বলল, “ও পিসিমণি বলো না কী ভাবছ?”
“আমি কী ভাবছি সে কথা থাক বাছা, ভদ্রলোককে দেখে তুমি কী বুঝলে তাই বরং শুনি, তুমি না আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?” বললেন পিসিমণি।
“আমি? বলছি,” নীলু সোজা হয়ে বসল, “ভদ্রলোক খুব চিন্তিত, উনি যেন ধরেই নিয়েছেন যে কোনও দুর্ঘটনা কিছু ঘটবে মানে মূর্তিটা চুরি হবে।”
“এ আর এমন কী বোঝার কথা বাছা? চুরি হবে অনুমান করেই তো উনি আমার কাছে এসেছেন। আর কী বুঝলি?”
“ওঁর কাছে একজন এলেন মূর্তিটার ছবি নিয়ে, মূর্তিটার কথা জানতেনও বললেন, অথচ উনি তাঁর নাম, ধাম কিছুই জানেন না। জানেন না মানে শুনেছিলেন তো নিশ্চয়ই কিন্তু মনে রাখেননি। বর্ধমান বললেন বটে কিন্তু সেও নিশ্চিত হয়ে নয়,” নীলু বলল একটু ভেবে, “এইটা বেশ আশ্চর্যের, তাই না পিসিমণি? কিচ্ছু মনে নেই?”
“মনে রাখার মতো মানসিক অবস্থায় থাকলে তো মনে থাকবে! উনি ধরেই নিয়েছেন দেবব্রত সেনগুপ্ত লোক সুবিধের নয়, তাই ওঁর সঙ্গে যে আসবে সেও মন্দ লোক! ভয় পেয়ে মাথাই গেছে খারাপ হয়ে, খোলা মনে চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতাটুকুও আর নেই!”
“ওদিকে দেখো সেদিন ওই প্রদীপ রাহারা কীরকম বাড়িতে ঢুকে পড়ল। কী জানি কী মতলবে এসেছিল! তোমার কি মনে হয় পিসিমণি, সত্যিই মূর্তি কিনত না অন্য কিছু?”
“সমরবাবু রাজি হলে কিনেই নিত হয়তো, একা ছিলেন এটা জেনেই এসেছিল মনে হয়, ভয় পাওয়ানোর সুবিধে, তবে তক্ষুণি কিছু করত বলে মনে হয় না।”
“নেহাত ওঁর প্রতিবেশি ভদ্রলোক এসে গেলেন ওষুধ নিতে তাই ব্যাপারটা আর বেশিদূর গড়ায়নি তাই না? তবে শুনেছি এসব লোকজনও কম বিপজ্জনক হয় না, সোজা পথে না পেলে বাঁকা পথেও চলতে ছাড়ে না!”
“হুঁ। কিন্তু ও নীলু তুই তো আসল জিনিসই লক্ষ করলি না বাবা!”
“কী পিসিমণি?”
“সমরবাবু তো মন হল সব কিছু খুলে বললেন না, কিছু চেপে গেলেন।”
“চেপে গেলেন? কিন্তু তোমার কাছে চেপে যাবেন কেন? উনি তো তোমার কাছে এসেছেনই সাহায্য চাইতে, মানে কিছু হলে তুমি যেন দেখো, তাহলে চেপে যাবেন কেন?” নীলু বেশ অবাক।
“কেন গেলেন তা জানি না বাছা। তবে গেছেন। বলি বলি করেও যে বললেন না এ আমি বেশ বুঝেছি, নিভারানি বামনীর চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়!”
“আশ্চর্য তো!”
“খবরটা আমিও পড়েছিলাম, ওই উল্কাপিণ্ড থেকে তৈরি মূর্তির কথা। তা বোধহয় প্রায় সপ্তাহতিনেক হল সে-খবর বেরিয়েছে। একটা শনিবার ছিল সেটা। খবরের কাগজটা পেলে ভালো হত, আরেকবার পড়তাম,” আপন মনেই বললেন পিসিমণি।
নীলু চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে পড়ল, “সে আর এমন কী, পুরোনো খবরের কাগজ তো রাখাই আছে, আমি এক্ষুণি খুঁজে নিয়ে আসছি।”
দোতলায় ওঠার সিঁড়ির নীচে ডাঁই করে পুরোনো খবরের কাগজ রাখা আছে। যে ছেলেটা পুরোনো কাগজ কেনে, তাকে কিছু দিন থেকেই আসতে বলা হচ্ছে, অনেক কাগজ জমে গেছে বলে কিন্তু তার পাত্তা নেই। কাল আসব, পরশু আসব করছে, কিন্তু আসছে আর না!
“মেমরি বটে তোমার পিসিমণি!” খবরের কাগজ খুঁজে এনে নীলু বলল, “ঠিক তিন সপ্তাহ আগেই বেরিয়েছিল আর শনিবারেই! কী করে এত মনে রাখো বলো তো?”
“জানি না বাছা। মনে থাকবে এটাই স্বাভাবিক বলে জানি। বরং তোমাদের কেন মনে থাকে না সেটাই তো বুঝি না!” পড়তে পড়তেই পিসিমণি বললেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে।
“সমরবাবু আশঙ্কা করছেন মূর্তিটা চুরি যেতে পারে, কিন্তু তাও সেটা ব্যাঙ্কের লকারে রাখবেন না! আশ্চর্য, না পিসিমণি?” বলল নীলু, ততক্ষণে খবরটা পিসিমণির পড়া হয়ে গেছে, নীলুরও।
“এ হল মানুষের মনের বদ্ধমূল বিশ্বাস, বুঝলি? অন্ধবিশ্বাসও বলতে পারিস। বাবা বলে গেছেন মূর্তি লকারে না রাখতে, বাড়িতেই রাখতে, ঠাকুরদার ধারণা ছিল ও মূর্তি পয়া, অতএব তা বাড়িতেই রাখতে হবে, তার জন্যে যদি বিপদ হয় তো তাও হোক! বলিহারি!” পিসিমণি বললেন।
পয়া অপয়া এসব বিশ্বাস যে পিসিমণি একদম পছন্দ করেন না তা নীলু খুব ভালো করেই জানে।
“তাছাড়া পয়া হলই বা কী করে? পয়া হলে কি আর ওঁর দাদা অল্প বয়সে মারা যেতেন? কেন যে লোকে এসব বোঝে না তা জানি না,” পিসিমণি আবার বললেন, তারপর নীলুর দিকে ফিরে বললেন, “ও নীলু আমার ফোনে সমরবাবুর ফোনটা একটু ধরে দে না বাবা। একটা কথা বলতে বড়ো ভুল হয়ে গেছে।”
পিসিমণি ফোন নিয়ে উঠে গেলেন, দু মিনিট পড়ে এসেই বললেন, “মূর্তিটার একটা ছবি দেখতে চাইছিলাম, বললেন কোনও ছবি নাকি নেই! বলিহারি! বললাম একটা তুলে আমাকে পাঠিয়ে দিতে। দেখি যদি দেন।”
বিকেলবেলা পিসিমণি নিজে থেকেই বললেন, “ভাবছি মূর্তিটা একবার দেখে আসি। সমরবাবু ফটো তো পাঠালেন না, কে জানে যেমন ব্যাঙ্কের লকারে রাখা বারণ, তেমনি ফটো তোলাও বারণ নাকি! উল্কাপিণ্ড দিয়ে তৈরি মূর্তি – এরকম তো কখনও দেখিনি, এসব জিনিস সত্যিই মিউজিয়ামে রাখার মতোই। সমরবাবুর ছেলে আর ভাইপোদের সঙ্গে আলাপও করা যাবে।”
“আমার তো শুনে থেকে অবধি মূর্তিটা দেখতে ইচ্ছে করছে, নেহাত তুমি কিছু বলছিলে না বলে তাই!” নীলু বলল, “তুমি সমরবাবুকে এক্ষুণি ফোন করো পিসিমণি, কাল রবিবার আছে, চলো কালই ঘুরে আসি।”
“তুমি যে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েই আছ সে কি আমি জানি না বাছা। ফোন করা হয়ে গেছে, কাল বিকেলে যাব বলেছি। তবে একটা ব্যাপার ভালো হয়েছে। সমরবাবু আর তাঁর বাবার নিষেধ মানবেন না মনে হচ্ছে, সোমবারই ওটা ব্যাঙ্কের লকারে রেখে আসবেন। আমাকে বললেন, ‘এত টেনশন আর সহ্য হচ্ছে না দিদি, যা হবে হোক, আগে ওটাকে লকারে রেখে আসি, তারপর ধীরে সুস্থে বসে ভাবব কাকে দেব। আপনি ঠিকই বলেছেন, ওটা আর বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না।’ বুঝেছেন যে এই অনেক ভাগ্যি! একবার লকারে চলে গেলে আর দেখা হবে না, যাই দেখেই আসি।”
তবে বিকেল অবধি আর অপেক্ষা করতে হল না। রবিবার সাধারণত নীলু বেশ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। আজ কিন্তু পিসিমণি তার ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, “ওঠ নীলু, আর শুয়ে থাকিস না। তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে কিছু খেয়ে নে। আদি সপ্তগ্রামে যেতে হবে।”
নীলু ধড়ফড় করে উঠে পড়ল, পিসিমণির মুখ গম্ভীর।
“কী হয়েছে পিসিমণি?”
“তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, সময় নেই এখন, গাড়িতে যেতে যেতে বলব,” পিসিমণি এর বেশি আর তখন কিছুই বললেন না।
পিসিমণি সাতটা বাজতে না বাজতেই ফোন করেছিলেন সমরকে, সব ঠিকঠাক আছে কীনা জানতে, গত কাল উনি অত চিন্তিত ছিলেন মূর্তিটা নিয়ে, সেই জন্যেই। ফোন সমরবাবু তোলেননি, অন্য কেউ তুলেছিল, সেই পিসিমণিকে খবর দেয় যে সমর মারা গেছেন। এর বেশি কিছু সে আর বলেনি, ফোন কেটে দিয়েছে।
“কে তাও জানতে পারলে না?” নীলু গাড়ি চালাতে চালাতে বলল।
“না। জিজ্ঞেস করতে পারলাম কই, ফোন কেটে দিল তো।”
“কালই সকালবেলা আমার কাছে এলেন ভদ্রলোক আর কাল রাতেই মারা গেলেন! আশ্চর্য! এরকম হঠাৎ করে যে মানুষ মারা যায় না তা নয়, তবে……। মূর্তিটা ঠিক থাকলেই বাঁচি!” পিসিমণি নিজের মনেই বললেন।
৪
আদি সপ্তগ্রামে সমরবাবুর বাড়ি খুঁজে পেতে একেবারেই ঝামেলা হল না। রাস্তাতেই নীলুরা জানতে পারল যে সমর রায়ের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, তাঁকে খুন করা হয়েছে।
বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি, পাড়ার লোকও ভিড় করে রয়েছে। তবে এখন আর পুলিশ কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। পিসিমণিরাও ঢুকলেন আর সমরবাবুর মৃতদেহ ময়না তদন্তর জন্যে নিয়ে যাওয়া হল।
বাড়ির সদর দরজার সামনে ইন্সপেক্টর পল্লব হাজরা দাঁড়িয়ে। পিসিমণি আর নীলুকে দেখে কপাল কুঁচকে বিরক্তি মাখা মুখে তাকালেন। কিন্তু নীলু পিসিমণির পরিচয় দেওয়ার পর সে বিরক্তি বেমালুম উধাও হয়ে গেল। বরং বেশ হাসি হাসি মুখে বললেন, “আরে আপনিই নিভারানি দেবী মানে বড়দি! আপনাকে তো শুনেছি সবাই এই নামেই ডাকে। আপনি চিনতেন নাকি সমরবাবুকে?”
“গতকালই পরিচয় হয়েছিল। উনি একটা কারণে আমার কাছে এসেছিলেন। তা এসব হল কখন?”
“আসুন আসুন ওপরে আসুন, সব দেখাচ্ছি আপনাকে, বলছিও,” পল্লব হাজরা বললেন, “আর আপনি যখন এসেই পড়েছেন এ ব্যাপারে যদি কিছু করতে চান করতে পারেন, আমি বাধা দেব না। তবে যদি আপনিও যা জানেন তা আমাকে বলেন তবে ভালো হয়। একসঙ্গে কাজ করলে তো ভালোই কী বলেন? হেঁহেঁহেঁ……”
পিসিমণিরা ততক্ষণে দোতলায় উঠে এসেছেন। পল্লব হাজরাই সমরের ঘরে নিয়ে এলেন। বেশ বড়ো ঘর, ঘরের মাঝখানে ডবল বেডের খাট। খাটের ঠিক পাশেই মেঝের ওপর চিত হয়ে পড়েছিলেন সমর।
“মাথার পেছনে কোনও ভারি জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, তার ফলেই মারা গেছেন ভদ্রলোক, এখনও অন্তত তাই মনে হচ্ছে। শরীরে আর কোনও আঘাতের চিহ্ন তো নেই,” বললেন ইন্সপেক্টর হাজরা।
“ভারি জিনিস? কী সেটা ভাই?” পিসিমণি জিজ্ঞেস করলেন।
“জানি না।”
পিসিমণি আর নীলু অবাক হয়ে হাজরার দিকে তাকাল।
“মানে এখনও জানি না, মানে মার্ডার ওয়েপন এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি, বুঝলেন? সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, সঙ্গে করেই নিয়ে গেছে মনে হচ্ছে।”
খাটের মাথার দিকে বড়ো স্টিলের আলমারি, সে আলমারি খোলা ছিল, অর্থাৎ মূর্তি চুরি হয়ে গেছে।
“যা মনে হচ্ছে ওটা চুরি করতেই এসেছিল। যা শুনলাম সে নাকি দামি জিনিস। এরকম দামি জিনিস বাড়িতে রাখার কী দরকার তাই তো বুঝি না! ভদ্রলোক নিজে তো বেঘোরে প্রাণটা খোয়ালেন, আমাদেরও কী ঝামেলা বলুন তো!” হাজরা যেন বিরক্তই।
“যা ভয় পাচ্ছিলেন তাই হল!” পিসিমণি বললেন, “খুনী বা চোর একজন না অনেকজন সে-সব তো কিছুই জানি না, কী দিয়ে মারল তাও জানা যাচ্ছে না, ঢুকলই বা কী করে বাড়িতে?”
“সে আরও আশ্চর্যের ব্যাপার বড়দি। যা মনে হচ্ছে খুনী খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে কাজ সেরে বেরিয়ে গেছে!”
“মানে?” নীলু না জিজ্ঞেস করে পারল না।
“মানে সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধই ছিল! জানলা টানলার গ্রিল ট্রিলও একেবারে অক্ষত আছে।”
পিসিমণি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনতলা বাড়ি। একতলা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে চারতলার ছাদ অবধি। দোতলায় সিঁড়ির সামনের ল্যাণ্ডিংএ পাশাপাশি দুটো দরজা। বাঁদিকেরটা দিয়ে ঢুকলে প্রথমে বৈঠকখানা পড়ে, তার লাগোয়া ডাইনিং স্পেস, তার পর আরও দুটো ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম। এদিকটায় থাকতেন সমর। ডান দিকের দরজা দিয়ে ঢুকলেও একটা বৈঠকখানা পড়ে, তবে সেটা সীতাংশুর অংশর। অবশ্য সমর থাকতেনই শুধু ওদিকে, খাওয়াদাওয়া সীতাংশুদের সঙ্গেই করতেন, রান্নাবান্নার পাট এদিকে ছিল না, বড়ো জোর কখনও সখনও এক কাপ চা বা কফি নিজের জন্যে করে নিতেন, ওইটুকু ব্যবস্থা ছিল। দুi অংশের বৈঠকখানার মাঝে একটা দরজা আছে, অর্থাৎ ল্যাণ্ডিংএ না এসেও ভেতর দিয়েও এক অংশ থেকে অপর অংশে যাতায়াত করা যায়, এ দরজাটা সব সময় ভেজানোই থাকে, কোনও দিক থেকেই কখনও বন্ধ করা হয় না। সমরের শোওয়ার ঘর একেবারে পেছনে, ঘরের লাগোয়া গ্রিল ঘেরা বারান্দা।
“সিঁড়ি থেকে ঘরে ঢোকার মুখের এই দরজায় তালা লাগানো থাকত না?” পিসিমণি জিজ্ঞেস করলেন।
“থাকত। আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। সবাই ওই একই কথা বলেছে। শুধু সমরের শোয়ার ঘরের দরজা ভেজানো থাকত, উনি ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকাতেন না, ছেলেই নাকি বারণ করেছিল। সমরবাবু নাকি খুব ভোর ভোর উঠতেন, পুজোর ব্যাপার ছিল। আজ পাঁচটা নাগাদ সীতাংশুবাবু এই ভেতরের দরজা দিয়ে এদিকে আসেন, সদর দরজা বন্ধই ছিল, যেরকম বন্ধ রোজ রাতে থাকে। তাই ওঁর কিছু সন্দেহ হয়নি, সমরবাবুর কোনও সাড়াশব্দও পাননি, ভেবেছেন পুজো টুজো করছেন। উনি তখন আর সমরবাবুর ঘরে না গিয়ে আবার নিজের ঘরেই চলে যান, আধ ঘন্টা পরে সমরবাবুর ঘরে গিয়ে দেখেন এই কাণ্ড!” বললেন পল্লব হাজরা।
“সে না হয় হল, কিন্তু সদর দরজার কী ব্যাপার, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ হল কী করে?” নিজের মনেই বললেন পিসিমণি।
“আপনি তো আমার কথাটা বুঝতেই পারলেন না দেখছি বড়দি!” হাজরা বললেন।
“কোন কথা ভাই?”
“আপনাকে বললাম না খুনী খোলা দরজা দিয়ে ঢুকেছিল এদিকে?” পল্লব হাজরা প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “কোন দরজা খোলা থাকে? সীতাংশুবাবু আর সমরবাবুর অংশর মাঝের এই দরজাটা। এদিক দিয়ে কেউ ঢুকলে তার আর সদর দরজায় কী দরকার বড়দি? কী বলছি বুঝতে পারছেন তো?”
পিসিমণি কিছু না বলে গম্ভীর মুখে সদর দরজার কাছে এলেন, খুঁটিয়ে দেখলেন, তারপর আবার সমরের ঘরে গেলেন।
ঘরে দেখার মতো বিশেষ কিছু নেই। আসল জিনিস অর্থাৎ মূর্তিই তো চুরি হয়ে গেছে। তাও পিসিমণি একবার সব কিছুর ওপর ভালো করে চোখ বোলালেন। ঘরে আলমারি ছাড়া আলনা, ড্রেসিং টেবিল আছে আর আছে ঠাকুরের সিংহাসন, সিংহাসনের পাশে ঠাকুরের বাসন কোসন ইত্যাদি, ছোটো একটা খাটও রয়েছে। সমর আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই কৃষ্ণভক্ত ছিলেন, সিংহাসনে অবশ্য কৃষ্ণর মূর্তি ছাড়াও লক্ষ্মীর মূর্তি আছে, দুজন সাধকের ছবি আছে আর শিব লিঙ্গও আছে। সমরের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে পুজোর নিয়মকানুন প্রতিদিন নিষ্ঠাভরে সমরই পালন করে আসছেন। ঘরের একদিকে দেওয়ালে লাগানো তাকে হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স। সমরের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করার নেশা ছিল।
“আলমারিতে তো নিশ্চয়ই তালা দেওয়া থাকত, তার চাবি কোথায় রাখতেন সমরবাবু?” হাজরাকে জিজ্ঞেস করলেন পিসিমণি।
“নিজের মাথার বালিশের তলায় রাখতেন। ওঁর ছেলেই বললেন। আপনিও ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন ঘরের কোনও কিছু এদিক ওদিক হয়নি, ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়নি, শুধু আলমারিটাই খুলেছে, মূর্তিটা বার করেছে, তারপর আর আলমারিটা বন্ধ করেনি, চাবি যে ঝুলছে সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমি আলাদা আলাদা করে সমরবাবুর দুই ভাইপো আর ওঁর ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছি চাবির কথা। ভাইপোরা কিছু বলতে পারল না, শুধু ছেলেই একবারে সব বলে দিল। অপরাধী যতই চালাকি করুক না কেন, যতই সাবধানে কাজ সারুক না কেন, কিছু না কিছু গোলমাল তো করবেই!”
হাজরা চলে যাচ্ছিলেন, পিসিমণি তাঁকে ডাকলেন, ঘরে কেউ নেই তাও গলা নামিয়ে বললেন, “আপনি তখন বললেন না আমি যা জানি আপনাকে যেন বলি, আমি বিশেষ কিছুই জানি না ভাই। তবে সমরবাবু সন্দেহ করেছিলেন কিছু হতে পারে। এ পাড়ায় দেবব্রত সেনগুপ্ত বলে এক ভদ্রলোক থাকেন, এসব পুরোনো মূর্তি টূর্তির ব্যাপারে তিনি অনেক কিছু জানেন, সমরবাবুর কাছে এসেওছিলেন মূর্তিটা দেখতে। সমরবাবুকে বলেছিলেন এসব জিনিস মিউজিয়ামে থাকার কথা। ভদ্রলোককে সমরবাবুর ভালো লাগেনি, আপনি একটু খোঁজ খবর নেবেন তো ভাই। দেবব্রতবাবু আরও একজনকে……”
পিসিমণির কথা শেষ হল না, ইন্সপেক্টর হাজরা খুব অবাক হয়ে বললেন, “খারাপ কথা তো কিছু বলেননি ভদ্রলোক। ঠিকই তো, এসব জিনিস মিউজিয়ামে থাকারই কথা। তাছাড়া এরকম কত লোক মূর্তি দেখে কত কিছু বলে থাকতে পারে, আমি কি এখন তাদের সকলের পেছনে ধাওয়া করব নাকি! আমি তো শুনলাম মূর্তিটা নাকি সমরবাবুর ঠাকুরদা এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে পেয়েছিলেন। তা সেটা উনি নিয়ে চলে এলেন কী করে? তা তো ওঁর সম্পত্তি নয়। তখন কিছু হয়নি, কিন্তু এখন হল, সমরবাবু খুন হলেন। পাপের ফল বড়দি, বুঝলেন পাপের ফল। একটা মূর্তি পেলাম আর অমনি সেটা নিয়ে চলে আসব! মার্ডার ওয়েপন পাইনি, এখনও তেমন নিশ্চিত করে কিছু বলছি না, প্রমাণ পেলে তবেই বলব, তবে একেবারে যে কিছু বোঝাও যাচ্ছে না তাও কিন্তু নয় বরং আমার কাছে তো খুনী কে তা একরকম পরিষ্কারই। আপনি একটু ভাবলে আপনিও বুঝতে পারবেন। তবে আমার কথা যদি শোনেন খামোখা চিন্তা করবেন না, সত্যি কথা বলতে গেলে চিন্তা করার মতো তেমন কিছু নেইও এই কেসে। পয়সা বড়ো ভয়ঙ্কর জিনিস বড়দি, তার কাছে বাপ ছেলের সম্পর্কও তুচ্ছ হয়ে যায়, বুঝলেন?”
“সে আর বলতে!” বললেন পিসিমণি, “আপনার জেরা টেরা যা করার সে সব হয়ে গেছে ভাই?”
“বিশেষ কিছু তো জানার নেই, রাত্তিরের ঘটনা, কে আর কী দেখেছে বা বুঝেছে? তাছাড়া বুঝলেও কি চট করে বলবে? তাও যেটুকু যা করার সব কমপ্লিট। আপনি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে স্বচ্ছন্দে করতে পারেন, তবে নতুন কোনও ইনফরমেশন পাবেন বলে তো মনে হয় না,” বলে হাজরা চলে গেলেন।
“হায় রে আমার পোড়া কপাল! কী বলতে চাইলাম আর কী বুঝল!” বললেন পিসিমণি, “ও নীলু একে সব কিছু বলেও কি কিছু লাভ হবে বাবা! চল বরং সীতাংশুদের সঙ্গে কথা বলে নিই।”
সমরের বৈঠকখানায় সীতাংশু আর শান্তনু ছিল, পিসিমণি সীতাংশুকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল রাতে আপনি বাড়িতেই ছিলেন তো? এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে গেল, কিচ্ছু বুঝতে পারলেন না?”
“একই কথা কত বার বলব বলুন তো? এই তো পুলিশকেও বললাম,” সীতাংশু ঝাঁঝিয়ে উঠল, “কাল রাতে আমি বাড়িতেই ছিলাম, তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। আমার স্ত্রী, ছেলে নেই, আমার শ্বশুরবাড়িতে গেছে।”
সীতাংশুর মেজাজ দেখে পিসিমণি আর তক্ষুণি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, বোঝা গেল সমর তাঁর ছেলের সম্পর্কে ভুল কিছু বলেননি।
“কিন্তু আপনি হঠাৎ এখানে উপস্থিত হলেন যে? হাজরার সঙ্গেও তো অনেকক্ষণ থেকে ফিসফিস করছেন দেখছি। আপনি কাকাকে চিনলেন কী করে? আর জানলেনই বা কী করে যে কাকা খুন হয়েছেন?” শান্তনু জিজ্ঞেস করল।
“আপনার কাকাই গত কাল আমার কাছে গেছিলেন, উনি আশঙ্কা করছিলেন যে কিছু ঘটতে পারে। সে রকম কিছু যদি ঘটে তাহলে যেন আমি দেখি সেই অনুরোধও করেছিলেন। উনি ভেবেছিলেন হয়তো মূর্তি চুরি হতে পারে, কিন্তু এ তো তার থেকেও গুরুতর ব্যাপার, তাই……”
“তাই? তাই কী? তাই আপনি গোয়েন্দাগিরি চালাবেন নাকি?” পিসিমণির কথার মাঝেই সীতাংশু চেঁচিয়ে উঠল, “হাজরা তো মনে হল আপনাকে চেনে। তা চিনুক, আমার কিছু যায় আসে না। শুনুন, আমি পুলিশ খবর দিয়েছি, যা করার পুলিশ করবে, যে কেউ এসে গোয়েন্দাগিরি চালাবে তা আমি সহ্য করব না। আমার বাবাকে খুন করা হয়েছে, আমি যা ভালো বুঝব করব। এবার আপনি আসুন।”
পিসিমণির সঙ্গে এরকমভাবে কথা বলা! নীলু কিছু বলতে যাচ্ছিল, পিসিমণিই আটকালেন।
“না চালিয়ে যে কোনও উপায় নেই ভাই, আপনার বাবাই সে অনুরোধ আমাকে করে গেছিলেন, তার পর চব্বিশ ঘন্টাও কাটল না মানুষটা এভাবে মারা গেলেন। এখন পিছু হঠার পাত্রী নিভারানি বামনী নয় ভাই, যতক্ষণ না সব পরিষ্কার হচ্ছে ততক্ষণ আমার শান্তি নেই।”
“কাকা যে আপনার কাছে গেছিলেন তার কী প্রমাণ আছে?” শান্তনুর পরের প্রশ্ন ধেয়ে এল পিসিমণির দিকে।
“হায় রে আমার পোড়া কপাল! এও বুঝলেন না! আপনার কাকা যদি নাই যেতেন আমার কাছে তাহলে আমি জানব কী করে যে ওঁর কাছে এরকম একটা মূর্তি আছে আর সেটা চুরি যাওয়ার আশঙ্কা করছেন উনি?”
“মূর্তির কথা অনেকেই জানে, ওসব বলে কোনও লাভ নেই,” শান্তনু পিসিমণির কথাকে পাত্তাই দিল না।
“সমরবাবু গাড়ি করে গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি, গাড়ি উনি চালাচ্ছিলেন না, ওঁর ড্রাইভার চালাচ্ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলেও জানতে পারবেন,” নীলু খুব বিরক্ত, এরা যেন পিসিমণিকে বিশ্বাসই করতে চাইছে না, “তা না হলে সাত সকালে সমরবাবুর মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আমরা এখানে আসব কেন বলুন তো? তাছাড়া পিসিমণির কথা ইন্সপেক্টর হাজরাকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তিনি ভালোই বলতে পারবেন।”
“এমন কিছু কথা বলতে পারি যা সমরবাবু না বললে আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তা সে সব এখন থাক। বরং ঠাণ্ডা মাথায় বসে দুটো কথা বললে হয় না? জানতে তো হবে এসবের পেছনে কারা?” পিসিমণি বললেন।
সীতাংশু আর শান্তনু এবার চুপ, কারুর মুখেই কোনও কথা নেই, শুধু দুজন দুজনকে আড়চোখে একবার দেখল।
ইতিমধ্যে সীতাংশুর স্ত্রী, ছেলে ফিরে এসেছে, এসেই তারাও এদিকেই এসেছে, সীতাংশু তাদের নিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে যাওয়ার উপক্রম করল।
“আগে এঁর সঙ্গে কথা বলে নিই, তারপর আপনার কাছে যাচ্ছি,” বললেন পিসিমণি, “মূর্তির একটা ছবি দেখতে পারলে ভালো হত, আছে কি কোনও ছবি? দেখাতে পারবেন?”
“না, ছবি টবি কিছু নেই,” যেতে যেতে বলল সীতাংশু।
পিসিমণি শান্তনুর দিকে তাকাল, সেও মাথা নাড়ল।
“তাহলে আর কী করা যাবে! কোনও ছবি যখন নেইই! যাই হোক, মূর্তিটা তো আপনারও নেওয়ার ইচ্ছে ছিল, আপনার কাকাকে অনেকবার সে কথা বলেওছেন, তাই না?”
“অবশ্যই ইচ্ছে ছিল। আমার বাবা বেঁচে থাকলে ও মূর্তি বাবাই পেতেন, দাদু কখনওই কাকাকে দিতেন না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই এখন ও মূর্তি আমার পাওয়া উচিত।”
“আপনি তো সমরবাবুকে ভয়ও দেখিয়েছিলেন, বলেছিলেন যে আপনি না পেলে ও মূর্তি অন্য কেউই পাবে না, অনেকবার ভালো কথায় বলেছেন, এবার যা করার তাই করবেন – এসব বলেছিলেন তো?”
“কী বলতে চাইছেন আপনি?” শান্তনু উঠে দাঁড়াল, রাগে চোখ মুখ লাল।
“কিছুই বলতে চাইছি না ভাই, শুধু জানতে চাইছি এসব সত্যি কথা তো? তাছাড়া একটি লোক বাড়ির সামনে ইদানীং ঘুরঘুর করত, সমরবাবু তার সঙ্গে আপনাকে কথাও বলতে দেখেছেন। উনি জানতে চাইলে আপনি বলেছেন যে সে আপনার দোকানে কর্মচারী, কী যেন বেশ নাম, হ্যাঁ মনে পড়েছে, বল্টু। কিন্তু সমরবাবু এক রকম নিশ্চিতই ছিলেন যে সে বল্টু নয়?”
ক্রমশ