অদিতি ভট্টাচার্য
১
বড়ো রাস্তার একেবারে ওপরেই সাদা রঙের বড়ো তিনতলা বাড়িটা। দোতলায় নিজের ঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক, বেশ চিন্তাক্লিষ্ট মুখে। ভদ্রলোকের নাম সময় রায়। হঠাৎ একটা আওয়াজে চমকে দেখলেন, বাড়ির গেটের সামনে একটা মোটর বাইক এসে থামল আর বাইক আরোহী নেমে গেট খুলে সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ঢুকছে। এ সেই লোকটা না? গতকালও এসেছিল আর এরকমই সন্তর্পনে চতুর্দিকে দৃষ্টি বোলাতে বোলাতে ঘোরাঘুরি করছিল। সমর বারান্দা থেকে গলা তুলে কে, কাকে চাই বলতেই সে ধাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে গেটের বাইরে রাখা তার লাল রঙের মোটর বাইকের ওপর চেপে হাওয়া হয়ে গেছিল। আজ আর সমর তাই তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, বরং জানলার পর্দার আড়ালে সরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন লোকটা কী করে তা দেখার জন্যে। এ বাড়ির কার সঙ্গে তার প্রয়োজন সেটাও তো জানার দরকার। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না সমরকে, দেখলেন শান্তনু নেমে এসেছে, কথা বলছে। কী কথা তা তো শোনা সমরের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে মনে হল লোকটা শান্তনুর পূর্ব পরিচিত। মিনিট দশেক পরে লোকটা চলে গেল, শান্তনুও বাড়িতে ঢুকল, সমরও আর দেরি করলেন না, এই সুযোগ, যা জিজ্ঞেস করার এখনই শান্তনুকে করতে হবে। তড়িঘড়ি করে বেরোতে গিয়ে দরজার কোণে ডান পায়ের কড়ে আঙুলটা সজোরে ধাক্কা খেল, কিন্তু সমর পাত্তা দিলেন না। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির মুখেই শান্তনুকে ধরলেন, সে তখন সবে তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়েছে।
“তুই কার সঙ্গে কথা বলছিলি? মানে লোকটা কে?” সমর জিজ্ঞেস করলেন।
সমরের গলা পেয়ে শান্তনু ফিরে তাকাল, সমরের প্রশ্নে যথেষ্ট বিরক্ত সে, “আশ্চর্য ব্যাপার তো! আমি কার সঙ্গে কথা বলছি তা তুমি জেনে কী করবে? আর তাছাড়া এ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এর মধ্যে তুমি নাক না গলালেই ভালো হয়।”
“কারণ আছে। এই লোকটাকে গত কাল আমি ঘুরঘুর করতে দেখেছি বাড়ির সামনে। কাকে চান বলতেই পালাল। লোকটা কে?” সমর আবার জিজ্ঞেস করলেন।
“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে কাকা। সবাইকে সন্দেহ করছ! জিজ্ঞেস করছ তাই বলছি, ও বল্টু। এবার আবার বোলো না যেন বল্টুকে তুমি চেনোই না, নামই শোনোনি কখনও! আমার দোকানের কর্মচারী, বল্টু, মনে পড়েছে?”
সমর চুপ করে রইলেন। তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন শান্তনু মিথ্যে কথা বলছে। বল্টুকে চিনতে সমরের ভুল হবে না, আজ তিন বছর ধরে দেখছেন, শান্তনুর দোকানে কাজ করে, মাঝে মধ্যে দরকার পড়লে বাড়িতেও আসে, খুব বিশ্বাসী, কিন্তু এ বল্টু ছিল না।
সমরকে চুপ করে থাকতে দেখে শান্তনু আবার বলল, “অন্যায় করলে এরকমই হয়। তুমিও নিজেও খুব ভালো করে জানো কাকা যে তুমি যা করছ তা মোটেই ঠিক নয়। অনেকবার ভালো কথায় বুঝিয়েছি তোমাকে, ওটা আমার প্রাপ্য, আমাকে দিয়ে দাও, কিন্তু তুমি আমার কথা কানেই তুলছ না। নেহাত বাবা অল্প বয়সে মারা গেছিলেন তাই দাদু ওটা তোমাকে দিয়েছিলেন, নাহলে তুমি ওটা কোনওদিন পেতে নাকি? কিন্তু এখন তো আমাকে দেবে। ভালো, দিও না, দেখি তুমিই বা ক’দিন ওটা নিজের কাছে রাখতে পারো। কী ভাবছ? তোমার ওই রগচটা সুপুত্তরকে দেবে ওটা? পারবে না। যদি আমি না পাই ওটা তাহলে কেউই পাবে না। ভালো করে শুনে রাখো আমার কথা। অনেকবার তোমাকে বুঝিয়েছি, আর বলব না, এবার যা করার তাই করব।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে শান্তনু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। শান্তনুর গলা ওঠেনি, বিন্দুমাত্র উত্তেজিতও নয় ও, কিন্তু ওর বক্তব্যে হুমকির সুরটাও স্পষ্ট।
সময় মিনিটখানেক ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর ধীর, ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। যে ভাইপোকে নিজের ছেলের মতো ছোটোবেলা থেকে মানুষ করেছেন, সে আজ এই স্বরে তাঁর সঙ্গে কথা বলছে, হুমকি দিচ্ছে! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সমরের! কী যে শুরু হয়েছে, বাড়িতে ঝগড়াঝাঁটি যেন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়য়েছে। সে অশান্তির সঙ্গে সমরের মনে বাসা বেঁধেছে আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা। সত্যিই যদি কিছু হয়! নিজের শোবার ঘরে ঢুকে জানলা, দরজা ভালো করে বন্ধ করলেন। তারপর আলমারিটা খুললেন। লকারের ভেতর থেকে জিনিসটা বার করে হাতে নিয়ে দেখলেন, তারপর আবার থাকে স্বস্থানে রেখে আলমারি বন্ধ করলেন। ড্রেসিং টেবিলের ওপর চিঠিটা পড়ে রয়েছে, উড়ো চিঠি। সেটাও আবার একবার পড়লেন। দরদর করে ঘামছেন, এই বয়সে এ কী সমস্যায় পড়লেন! শান্তনুকে ও জিনিস দেওয়া মানে ও আর বাড়িতে থাকবে না, টাকার লোভে তক্ষুণি বিক্রি করে দেবে। সেটা সমর চান না। ওঁর বাবা, ঠাকুরদাও চাননি, তাই তো এত বছর সেটা বাড়িতেই আছে।
সন্ধে হয়ে গেছে, মানস ফোন করল না কেন? পারল না নাকি ফোন নম্বরটা জোগাড় করতে? ঠাকুরের সন্ধ্যারতির সময় হয়ে যাচ্ছে, জোর করেই মন থেকে অন্য সব চিন্তা তাড়িয়ে সেদিকে মনে দিলেন। পুজো সেরে উঠে দেখলেন মানস মেসেজ পাঠিয়েছে, জোগাড় করেছে ফোন নম্বর, সেটাই দিয়েছে। সমর ফোন করে বা মেসেজ পাঠিয়ে জানাতেই বলেছিলেন, আসতে বারণ করেছিলেন। যতটা গোপনীয়তা বজায় রাখা যায়, কার মনে যে কী মতলব ঘুরছে তা তো বোঝা দায়!
সমর নম্বরটা ডায়াল করলেন, একবার কথা বলেই দেখা যাক, যদি কিছু উপায় বেরোয়, ভদ্রমহিলা খুব বুদ্ধিমতী বলেই শুনেছেন।
“হ্যালো……”
২
“তোর তো দেখছি বড়ো তাড়া নীলু! এমন করে খাচ্ছিস, এবার বিষম না খাস!” নীলুর খাওয়া দেখে বললেন পিসিমণি।
“ভদ্রলোকের আসার সময় হয়ে আসছে পিসিমণি। এসে বসে থাকবেন? তুমিই তো বলো কাউকে এরকম অপেক্ষা করানো ঠিক নয়। তাছাড়া নিশ্চয়ই জরুরি কিছু বলতেই আসছেন। সত্যি কথা বলতে, আমার তো মনে হল কাল রাতেই ভদ্রলোক এলেন না কেন! এতক্ষণ অপেক্ষা করা!” নীলু তেমনই গোগ্রাসে খেতে খেতে বলল।
“সে কী আর আমি বুঝছি না বাছা! আমার থেকে তোমার উৎসাহ যে অনেক বেশি তা আমি বিলক্ষণ জানি। ফোন আসারও শেষ নেই! আজকালকার দিনে দেখি সবাই সবার নাম ধাম, ফোন নম্বর সব জেনে বসে আছে!”
“সবার জানে কিনা জানি না, তবে তোমার জানে পিসিমণি। তুমি এখন বিখ্যাত গোয়েন্দা,” নীলুর খাওয়া হয়ে গেছে, টেবিল থেকে উঠে পড়ল ও।
ওর কথা শুনে ওর বাবা, মা হেসে ফেললেন, পিসিমণিও না হেসে পারলেন না, “একেবারে বিখ্যাত গোয়েন্দা! বলিহারি!”
“যাই বলো বড়দি, আমারও কিন্তু যথেষ্ট কৌতূহল আছে ভদ্রলোক কেন আসছেন জানতে,” নীলুর বাবা বললেন, “আমার মন বলছে আবার একখানা কিছু হল বলে।”
গত কাল রাতে নীলুকে ফোন করেছিলেন এক ভদ্রলোক, নাম সমর রায়। বললেন একটা দরকারি ব্যাপারে পিসিমণির পরামর্শ চান, পিসিমণির যদি আপত্তি না থাকে তো আগামী কাল সকালেই তিনি আসতে পারেন। নীলু পিসিমণিকে জিজ্ঞেস করে ওঁকে আসতে বলে দিল। আর তারপর থেকেই উত্তেজনায় নীলু স্থির হয়ে বসতেও পারছে না। ভদ্রলোকের বাড়ি আদি সপ্তগ্রামের ছোট খেজুরিয়ায়, সেখান থেকে আসছেন পিসিমণির সঙ্গে দেখা করতে, পরামর্শ নিতে তার মানে কিছু ব্যাপার তো বটেই।
দশটার মধ্যেই আসবেন বলেছিলেন সমর, এলেন ঠিক দশটা বেজে আট মিনিটে। বাড়ির সামনে সাদা অল্টোটা দাঁড়াতেই নীলু উঠে গিয়ে সদর দরজাটা খুলে দিল।
ভদ্রলোক গেটের পাশে শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা ঠিকানাটা একবার পড়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে যেভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “নিভারানি দেবী এখানেই থাকেন তো?” তাতে বোঝা গেল উনি পিসিমণির সঙ্গে দেখা করার জন্যে অত্যন্ত উদগ্রীব।
“হ্যাঁ, আসুন,” নীলু হাসিমুখে উত্তর দিল।
“তুমিই নিলাদ্রি? যার সঙ্গে কাল ফোনে কথা বলেছি?” সমর বললেন, যেন নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন।
“হ্যাঁ, ওই তো পিসিমণি এসে গেছেন।”
“ভেতরে আসুন ভাই, বসুন,” পিসিমণি অভ্যর্থনা জানালেন।
ভদ্রলোক নীলুদের বৈঠকখানায় ঢুকেই সোফার ওপর বসে পড়ে বললেন, “এক গ্লাস জল দেবেন?”
ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় কোনও কারণে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, রাত জাগার চিহ্ন মুখে চোখে স্পষ্ট।
নীলু জল এনে দিলে ঢক ঢক করে একবারে গ্লাসের আর্ধেকটা খালি করে ফেলে পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। বোধহয় কী বলবেন, কোথা থেকে শুরু করবেন – সেগুলো মনের মধ্যে একবার ঝালিয়ে নিতেই। পিসিমণিও চুপ, শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছেন ওঁকে।
“কাজের কথাতেই আসি, বেশিক্ষণ থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়,” বিনা ভূমিকায় ভদ্রলোক এবার বললেন, “আপনার কাছে সবাই আসে কোনও কিছু ঘটার পর, কিন্তু আমি আগেই এসেছি কারণ কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটবে।”
সত্যি কথা। দুর্ঘটনা ঘটবে এরকম অনুমান করে আজ অবধি পিসিমণির কাছে কেউ আসেননি। নীলু আড়চোখে একবার পিসিমণির দিকে তাকাল। পিসিমণি কিন্তু নির্বিকার, মুখের বিস্ময়ের চিহ্ন মাত্র নেই। বরং বললেন, “আগে কিছু মুখে দিন, সকালবেলায় এলেন। তারপর সব শুনছি।”
সমর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “না না দিদি, এখন কিচ্ছু খাব না, জলখাবার খেয়েই বেরিয়েছি। আপনাকে আমার সব বলা দরকার।”
“আচ্ছা বেশ, এক কাপ চা অন্তত খান, খেতে খেতেই বলুন। নিশ্চয়ই তেমন কিছু দরকার বুঝেছেন বলেই এসেছেন – সে কি আর আমি বুঝছি না ভাই? বিলক্ষণ বুঝছি। আপনি ইতস্তত করবেন না, ধীরে সুস্থে সব খুলে বলুন দেখি।”
সমর পিসিমণির কথায় বেশ আশ্বস্ত হলেন, বললেন, “ঠিক বলেছেন, সব খুলেই বলি। আমার দুশ্চিন্তার কারণ একটা মূর্তি। আজ নয়, সেটা আমার কাছে বহু বছর আছে। মূর্তিটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে অর্থাৎ আমার ঠাকুরদার কাছ থেকে। ঠাকুরদা সেটাকে পেয়েছিলেন রামগড়ের কাছে একটা মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের ভেতরে। রামগড় রাজস্থানে, জানেন তো? ঘুরতে ঘুরতে নাকি ওই ধ্বংসস্তূপের কাছে চলে গেছিলেন আর বলতে গেলে হঠাৎই মূর্তিটা পড়ে থাকতে দেখতে পান। মূর্তিটা দেখে ওঁর খুব ভালো লেগে গেছিল, তাই তুলে নিয়ে চলে আসেন। সে আজ অনেক বছর আগেকার কথা। এরপর নানা কারণে ওঁর মনে হয় মূর্তি ওঁর পক্ষে খুব পয়া। ওটা তিনি সব সময়ে নিজের কাছেই রাখতেন, মারা যাওয়ার আগে বাবাকে দিয়েও তাই বলে গেছিলেন মানে বাড়িতেই রাখতে। বাবাও তাই রেখেছেন বরাবর, আমিও তাই রাখি কিন্তু…..”
“মূর্তিটার কথা একটু ভালো করে বলুন না ভাই,” পিসিমণি বললেন, “মানে মূর্তিটা কীসের তৈরি, কার মূর্তি মানে কোনও ঠাকুর দেবতার কি?”
“সব বলছি। প্রথম থেকে যা যা হয়েছে সব এক এক করে বলছি। সত্যি কথা বলতে কী, মূর্তিটা যে কীসের তৈরি তা আমি এই কিছু দিন আগে অবধি জানতাম না। মূর্তিটা এক যক্ষিণীর, সেটা অবশ্য ঠাকুর্দাই বাবাকে বলেছিলেন। অদ্ভুত কালচে কালচে মতো দেখতে, সাত আট ইঞ্চি মতো লম্বা হবে, মূর্তির গায়ের কারুকাজ খুব সুন্দর। গলায় একটা লম্বা হার, তার লকেটে একটা পাথর বসানো। বাঁ পায়ের গোড়ালি থেকে ভাঙা, প্রথম থেকেই। গলার হারের পাথরটাও যে ঠিক কী তাও আমি আগে জানতাম না। কিন্তু এসব জানাই বোধহয় কাল হল। খুলেই বলি। কিছু দিন আগে খবরের কাগজে একটা লেখা বেরিয়েছিল, সঙ্গে একটা মূর্তির ছবি। আমার মূর্তিটার সঙ্গে সেটার অদ্ভুত মিল দেখেই লেখাটা আরও মন দিয়ে পড়ি। পড়ে জানলাম সেটা যক্ষ মূর্তি। অদ্ভুত ব্যাপার এই মূর্তি নাকি তৈরি উল্কা পিণ্ড দিয়ে। এক প্রত্নতত্ত্ববিদের মতামত নেওয়া হয়েছে দেখলাম, মানে উল্কাপিণ্ড কী, তাতে কী কী ধাতু মিশ্রিত থাকে ইত্যাদি। তা সে ভদ্রলোকের ছবি দেখেও খুব চেনা চেনা লাগছিল, মনে হচ্ছিল যেন দেখেছি দেখেছি। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম ভদ্রলোক আমাদের পাড়াতেই থাকেন। ফ্ল্যাটের ঠিকানা জেনে একদিন গেলাম দেবব্রতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। ওহ বলতেই ভুলে গেছি ভদ্রলোকের নাম দেবব্রত সেনগুপ্ত, আমার থেকে অনেক ছোটো, বড়ো জোর বছর পঞ্চাশ হবে। বললাম আমার মূর্তিটার কথা। শুনে উনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, দেখতেও চাইলেন সেটা। অনেক কিছু জানতেও পারলাম ওঁর কাছ থেকে। এরকম উল্কাপিণ্ড থেকে জিনিসপত্র তৈরি নাকি অন্যান্য দেশেও প্রাচীনকালে হয়েছে। বললেন মিশরের ফ্যারাও তুতেনখামেনের ছোরাও নাকি এই জিনিসের। যাই হোক, পরের দিনই ভদ্রলোক এলেন। সব দেখে শুনে বললেন যে ওঁর ধারণা দুটো মূর্তি একই জায়গার। এও বললেন এ জিনিস মিউজিয়ামে থাকাই উচিত। কথাটা আমার ভালো লাগেনি। আমাদের পারিবারিক জিনিস, সেটা মিউজিয়ামে দেব কেন? ভদ্রলোক তো সে কথা মানতেই চাইলেন না, উল্টে বললেন, ‘পারিবারিক জিনিস কী করে হয়? আপনার ঠাকুরদা তো ওটা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন, পেয়ে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন, সেটাও কি খুব উচিত কাজ?’ মনে হল যেন আমাকে ভয় পাওয়ানোরও চেষ্টা করলেন। বললেন এসব জিনিসের নাকি বিদেশে খুব দাম, অনেক চক্রই আছে যারা এইসব প্রাচীন মূর্তি চুরি করে পাচার করে। দরকারে মন্দিরের গা থেকে ভেঙে নিতেও পিছ পা হয় না। আমার কী মনে হল জানেন?” সমর থামলেন, বোধহয় দম নেওয়ার জন্যেই।
“কী মনে হল?” নীলু না জিজ্ঞেস করে পারল না।
“মনে হল ওইসব চক্রর সঙ্গে এই ভদ্রলোক মানে দেবব্রতবাবু নিজেই জড়িত। অস্বাভাবিক নয়, সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকে, বুঝলে? উনি মূর্তির গলায় হারের পাথরটাও খুব মন দিয়ে দেখছিলেন। সত্যি কথা বলতে গেলে মূর্তিটা আলমারিতে রাখা থাকত থাকত, এ নিয়ে আমি কোনোদিন মাথা ঘামাইনি। আমার বাপ, ঠাকুর্দাও ঘামিয়েছেন বলে মনে হয় না। যাই হোক দেবব্রতবাবু পাথরটার কথা কী বললেন জানেন? বললেন ওটা নাকি হীরে! বেশ ভাল কোয়ালিটির হীরে! বুঝুন! এত দিন জানতেও পারিনি! আমি অবশ্য একবার ওঁর কথা যাচাই করে দেখব ভেবেছিলাম, মানে উনি ঠিক বলছেন কীনা। আমাদের ওখানেই একটা সোনার দোকানে মূর্তিটা নিয়ে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু তা আর হল না,” সমর কীরকম যেন শিউরে উঠে চুপ করে গেলেন।”
নীলুর পক্ষে কৌতূহল দমন করা আর সম্ভব হল না, পিসিমণি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও বলে উঠল, “কেন, যাওয়া হল না কেন?”
“একখানা খাম পেলাম। কেউ আমার বাড়ির লেটার বক্সে রেখে গেছে। তাতে একটা চিঠি, তাতে স্পষ্ট লেখা দেবব্রত সেনগুপ্ত লোক নাকি মোটেই সুবিধের নয়, তাকে মূর্তি দেখিয়ে আমি ভালো কাজ করিনি, সে নাকি মূর্তি হাতানোর মতলবেই এসেছিল। এরকম সন্দেহ যে আমারও একেবারে হয়নি তা নয়, তবে এ চিঠি কে দিল তা বুঝতে পারিনি।”
“ও চিঠি কাউকে দেখাননি আপনি?” পিসিমণি এতক্ষণে কথা বললেন।
“না, কাকে আর দেখাব! বাড়িতে যা চলছে!” সমর কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে গেলেন।
“চিঠিটা সঙ্গে এনেছেন নাকি ভাই? তাহলে দেখতাম।”
“চিঠিটা? হ্যাঁ আনলাম যে!” সমর উঠে দাঁড়ালেন, প্রথমে প্যান্টের বাঁ পকেট হাতড়ালেন, পেলেন না, তারপর ডান পকেট, সেখানেও নেই, “নিলাম তো চিঠিটা, আপনাকে দেখাব বলে, কোথায় রাখলাম বলুন তো!”
ভদ্রলোক যে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। শেষ অবধি শার্টের বুক পকেট থেকে বেরোল চিঠিটা। পিসিমণিকে সেটা দিয়ে বললেন, “এই নিন, দেখুন কী দেখবেন।”
পিসিমণি গম্ভীর মুখে তাতে একবার চোখ বুলিয়ে সেটা নীলুর হাতে চালান করলেন।
“আপনার বাড়িতে কে কে আছেন সে সবও একটু বলুন ভাই।”
“এই দেখুন, এসেই মূর্তির কথা বলতে শুরু করে দিয়েছি, বাড়ির কথাই বলিনি,” সমর একটু অপ্রস্তুত, “আমার কথা তো বলেইছি, ব্যাঙ্কে চাকরি করতাম, তা সে সব পর্ব মিটে গেছে সেও বছর ছয়েক হল। তবে একেবারে যে সাদামাটা অবসর জীবন কাটাই তা নয়, হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করাটা আমার নেশা, বহু কালের, রীতিমতো পড়াশোনা করে শিখেছি, অনেকে উপকারও পেয়েছে আমার ওষুধে। অবসর নেওয়ার পর এদিকে আরও বেশি যে সময় দিতে পারছি তা তো বুঝতেই পারছেন। আমি বিপত্নীক, আমার নিজের একই সন্তান, সীতাংশু, তবে আমার দাদার দুই ছেলেকেও আমিই মানুষ করেছি। দাদা একেবারে অল্প বয়সে মারা গেছিলেন, দাদার দুই ছেলের একজন তখন সাড়ে তিন বছরের আর আরেকজন সবে চার মাসের। আমার বাবা, মা তখনও বেঁচে। বুঝতেই পারছেন কী অবস্থা গেছে তখন! মা তো সেই শোক সহ্যই করতে পারলেন না। দাদা মারা যাওয়ার ছ’মাসের মধ্যে উনিও চলে গেলেন। যাই হোক, আদি সপ্তগ্রামে আমাদের তিনতলা বাড়ি। বাড়িটা বাবার করা। উনি তিনতলা বাড়িই করেছিলেন, কিন্তু এখন যেরকম আছে সেরকম নয়, আমি অনেক রেনোভেশন করিয়েছি, ছেলেরা সব বড়ো হল, তাদের বিয়ে থা হল, ঠিক মতো ব্যবস্থা না করলে চলছিল না। তিনতলায় থাকে দাদার বড়ো ছেলে শান্তনু, তার স্ত্রী আর দুই ছেলে মেয়ে। বৌদিও থাকতেন, তিনি গত হয়েছেন পাঁচ বছর হল। দোতলায় আমি, সীতাংশু, সীতাংশুর স্ত্রী আর ছেলে। একতলায় থাকে আমার ছোটো ভাইপো অতনু, তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে। বাড়ি এক, তবে হাঁড়ি নয়, যার যার নিজের মতো ব্যবস্থা। আমার স্ত্রী মারা গেছেন দেড় বছর আগে। শান্তনুর হার্ডওয়ারের ব্যবসা, যথেষ্ট ভালো চলে। আমার ছেলে সরকারি চাকরি করে আর অতনু স্কুলে পড়ায়।
“কী আর বলি আপনাকে, এই মূর্তি নিয়ে বাড়িতেও অশান্তি কম নয়। বাবা বলে গেছেন মূর্তি বাড়ির যে কোনও একজনের কাছে থাকবে। ঠাকুর্দা বাবাকে দিয়ে গেছিলেন, আমার তিন কাকার কেউই তাতে আপত্তি করেননি। খুড়তুতো ভাই বোনেদেরও এ নিয়ে কোনও অসন্তোষ আছে বলে কোনও দিন শুনিনি। অবশ্য মূর্তিটা যে দামি বা দুষ্প্রাপ্য কিছু তাই কেউ জানত না। দাদা অল্প বয়সে মারা গেছেন, বাবা মূর্তিটা আমাকে দিয়ে দেন। আমার এক দিদি, দুই বোন আছে, তারাও কেউ এ নিয়ে আপত্তি করেনি, কারণ বাড়ির জিনিস বাড়িতেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ভাইপোরা আর আমার ছেলে – তারা প্রত্যেকেই মূর্তিটা চায়। কেউই নিজের দাবি ছাড়বে না। এ নিয়ে অশান্তি লেগেই আছে। মনে হচ্ছে মূর্তির সব ব্যাপারও তারা জেনে ফেলেছে। আমি বলিনি যদিও।”
“খবরের কাগজে বেরিয়েছিল তো, অনেকেরই চোখে পড়বে এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তাছাড়া আপনার ভাইপোরা বা আপনার ছেলে দেবব্রতবাবুকেও কিছু জিজ্ঞেস করে থাকতে পারে। আপনাদের পাড়াতেই তো থাকেন বলছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি আর কী করতে পারি ভাই? এ তো আপনাকেই ঠিক করতে হবে আপনি কী করবেন, মানে মূর্তি কাকে দেবেন,” বললেন পিসিমণি।
“দাদা বেঁচে থাকলে কী হত জানি না, বাবা কি তখনও আমাকে দিতেন মূর্তিটা না দাদাকে সেও এখন আর বলা সম্ভব নয়। ঠাকুরদা অবশ্য তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মানে আমার বাবাকেই দিয়েছেন। আমার তো একই সন্তান, সীতাংশু, আমার সব কিছুর উত্তারাধিকারী সেই, কিন্তু আমার ভাইপোরা মানবে না। তার মধ্যে আবার ওই দেবব্রতবাবু। আমি যে কী সমস্যায় পড়েছি! মুশকিল হচ্ছে ওটা ব্যাংকের লকারেও রাখতে পারব না, বাবার নিষেধ ছিল। এই নিয়ে একবার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার, তখন অবশ্য মূর্তির ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। বাবাকে বলেছিলাম, ‘এ তো পুরোনো মূর্তি, অনেক সময় এগুলো দামি টামিও হয় বলে শুনেছি, লকারে রেখে দিলে হয় না?’ বাবা শুনে বলেছিলেন, ‘কোথায় কোন ঢিবির ভেতর পড়ে ছিল, দেখতে পেয়ে বাবা তুলে এনেছিলেন। দামি হলে কি আর বাবা জানতেন না? বাড়িতেই তো আছে বরাবর। তাছাড়া বাবা বলতেন ওটা বাড়িতে এনে রাখার পর থেকেই বাবার ব্যবস্যায় এত উন্নতি, ওটা বাড়িতেই থাক, অন্য কোথাও সরাস না।’ এরপর আর ও নিয়ে কোনও কথা হয়নি, আগে তো বাবার ঘরে একটা তাকে এমনিই পড়ে থাকত, আমি পাওয়ার পর আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখা শুরু করলাম, ধুলো পড়ত, রোজ আর কে ঝাড়পোঁছ করে! ওহ বলতে ভুলে গেছি আমার ঠাকুরদার ব্যবসা ছিল, ওষুধের দোকান, রমরম করে চলত। তবে বাবা বা বড়োকাকা – কারুরই সেদিকে মন ছিল না। ওঁরা চাকরি করতেন। ও দোকান মেজকাকা আর ছোটোকাকা পেয়েছিলেন। তবে কয়েক বছর পরে বিক্রিও করে দিয়েছিলেন। যাই হোক, আমি আপনার কাছে এসেইছি এই জন্যে, যদি মূর্তিটা চুরি যায় আপনি খুঁজে বার করে দেবেন তো?” সমরের গলায় আকুতি।
“আপনি আগে থেকেই এসব ভাবছেন কেন? তাছাড়া পুলিশ আছে, এসব মূর্তি টূর্তি তারাই ভালো খুঁজে বার করতে পারবে। আপনি এখন থেকেই ওসব ভাববেন না। কিছুই হল না তাও তো হতে পারে,” পিসিমণি ওঁকে সান্ত্বনা দিলেন।
“না দিদি আমার ঠিক ভালো লাগছে না। অনেক কিছু হচ্ছে। আমার নিজের লোক, বাইরের লোক সবাই যেন ওই মূর্তি নিয়ে পড়েছে।”
“বাইরের লোক? মানে দেবব্রতবাবু ছাড়াও আর কেউ জানেন? কে কে জানেন ভাই?” সমর এক মনে বোধহয় কিছু চিন্তা করছিলেন, পিসিমণির এ প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে গেলেন, বললেন, “বাইরের লোক? বাইরের লোক বলতে তো ওই এক দেবব্রতবাবু আর আর……,” সমর চুপ করে গেলেন, তারপর আবার বললেন, “সত্যি কথা বলতে গেলে যে এই মূর্তিটা নিয়ে এত বছর আমরা কেউ মাথাই ঘামাইনি, কাউকে বলিওনি এটার কথা, এটা যে বলার মতো কোনও জিনিস তাই মনে হয়নি। আসলে জানতামই না তো ওটা কী জিনিস! আর যখন জানলাম, তখন থেকেই বাড়িতে অশান্তি শুরু হয়েছে আর আমার মনে ভয়ও ঢুকেছে। তড়িঘড়ি করে আমার দিকের খোলা বারান্দাটা গ্রিল দিয়ে ঘিরলাম।”
“দেবব্রতবাবুও কাউকে বলে থাকতে পারেন,” পিসিমণি বললেন।
“হতে পারে,” বললেন সমর, “বাইরের লোকের কথা বলছিলেন না? এসেছিল কয়েকজন।”
“কারা ভাই?” জিজ্ঞেস করলেন পিসিমণি।
“একজনকে তো দেবব্রতবাবু সঙ্গে করে নিয়ে এলেন,” সমর জিভ দিয়ে একবার ঠোঁট চাটলেন, ওঁর মুখও কীরকম যেন ফ্যাকাশে লাগল, বোঝাই যাচ্ছে উনি ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পেয়েছেন আর যে কোনও কারণেই হোক এই দেবব্রত সেনগুপ্ত ভদ্রলোকটিকেই উনি সবচেয়ে বেশি সন্দেহের চোখে দেখছেন, তারপর জোর করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “দুজনে মিলে এলেন, একখানা ছবি সঙ্গে নিয়ে। ছবি মানে হাতে আঁকা ছবি।”
“ছবি? কীসের ছবি?” পিসিমণি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, তারপর ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে বললেন, “জল খাবেন? ও নীলু এক গ্লাস জল নিয়ে আয় না বাবা। আপনি এত ভয় পাবেন না, দুশ্চিন্তাও করবেন না ভাই। ভয় পেলে কাজের কাজ তো কিছু হয়ই না, উলটে মাথাও গোলমাল হয়ে যায়, তখন আরও বিপদ।”
সমর জল খেয়ে কিছুটা সুস্থির হলেন, তারপর বললেন, “দেবব্রতবাবু আমার বাড়িতে এসে মূর্তি দেখে চলে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই আবার এসে হাজির হলেন। আমার বেশ মনে আছে আমি তখন বেরোচ্ছিলাম, মানস গাড়ি বার করেছে, মানস মানে আমার ড্রাইভার, বুঝেছেন তো? গেটের মুখে দেখা ওঁর সঙ্গে, সঙ্গে আরেকজন লোক। বললেন খবরের কাগজের ওই লেখা পড়ার পর আমি যেমন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তেমনি ইনিও নাকি করেছিলেন। আমি তো কোনও কথাই শুনতে চাইছিলাম না, কিন্তু ওঁরা দুজনে ছাড়লেন না।”
“কথাবার্তা কি সব ওই গেটের কাছে দাঁড়িয়েই হল না ওঁদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছিলেন?” প্রশ্ন করলেন পিসিমণি।
“না না ভেতরে নিয়ে যাইনি,” সমর যেন আঁতকে উঠলেন ভেতরে নিয়ে যাবার নামেই, “আর ওই দেবব্রতবাবুকে আমি বাড়ির ভেতরে ঢোকাই!”
নীলু একবার আড়চোখে পিসিমণিকে দেখল, ও খুব ভালোই জানে, পিসিমণি নিজের মনেই বলছেন, “হায় রে আমার পোড়া কপাল! দুটো কথা ধীরে সুস্থে বসে মন দিয়ে শুনতেও এত ভয়!”
“আশেপাশে কেউ ছিল? মানস তো গাড়ির কাছে ছিল বললেন, সে কিছু শুনেছে নাকি জানেন?”
“না না আপনি মানসকে সন্দেহ করবেন না, ও খুব ভালো ছেলে, ও কিছুর মধ্যে নেই। এই আপনার ফোন নম্বরও তো ওই জোগাড় করে এনে দিল।”
“আমি কিছুই সন্দেহ করছি না ভাই, আমি শুধু সব জানতে চাইছি,” পিসিমণি যেন একটু অধৈর্য হয়েই বললেন, “যাই হোক, আপনি বলুন।”
“হ্যাঁ যা বলছিলাম। আমি তো ওই দেবব্রতবাবুর সঙ্গে কথাই বলতে চাইছিলাম না, কিন্তু ওঁরা ছাড়লেন না, বলতে গেলে একরকম জোর করেই আমাকে অনেক কিছু বললেন। যা বললেন সেও ভারি অদ্ভুত। আমার কী মনে হয় জানেন দিদি, সব বানানো, পুরোটাই বানানো, মূর্তিটা হাতানোর জন্যে এসব ফন্দি ফিকির বার করেছে, বুঝলেন?”
“কী হয়েছিল, ওঁরা দুজন কী বলেছিলেন আপনাকে, ছবিই বা কীসের – এসব সব না জানলে কী করে বুঝব ভাই?”
নীলুর হাসি পেয়ে গেল পিসিমণির কথা শুনে, কিন্তু ও হাসল না, পিসিমণি সেটা মোটেই পছন্দ করবেন না যে তা ও ভালোই জানে।
“দেবব্রতবাবু বললেন ওঁর সঙ্গের ওই লোকটি নাকি আমার মূর্তির কথা জানে।”
“ভদ্রলোকের নাম কী? কোথায় থাকেন?” এবার নীলু জিজ্ঞেস করল।
“নাম! কোথায় থাকেন!” সমর কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে করে নীলুর দিকে তাকালেন, “থাকে তো বোধহয় বর্ধমানে, নাম নাম…… মানে দেবব্রতবাবু বলেছিলেন বোধহয় কিন্তু আমার আর এখন মনে নেই, বলেছিলেন বলেছিলেন, কিছু হালদার বোধহয়। আসলে আমি দেবব্রতবাবুকে আসতে দেখেই এত ঘাবড়ে গেছিলাম, তার ওপর আবার আরেকজন অপরিচিত লোক! আমি বরং ওই লোকটি কী বলেছিল তাই বলি আপনাদের। দেবব্রতবাবুর সঙ্গের এই লোকটিকে অল্প বয়সী বলেই মনে হল, আমার ছেলের মতোই হবে বোধহয়। তা সে বলল আমার ঠাকুরদার সঙ্গে নাকি তার বাবার ঠাকুরদার পরিচয় ছিল। তাঁরা নাকি বন্ধু ছিলেন। আমার ঠাকুরদার নাম ধাম, তিনি কী করতেন, এমন কী মূর্তিটা কোথা থেকে পেয়েছিলেন – এসবও বলল। আটঘাট বেঁধেই এসেছে বুঝলাম। বলল ঠাকুরদা নাকি মূর্তিটা তাঁর বন্ধুকে দেখিয়েছিলেন, তিনি নাকি আবার শখের আঁকিয়ে ছিলেন। মূর্তিটা দেখে একখানা ছবি এঁকেছিলেন। সে ছবি ওদের বাড়িতে এখনও টাঙানো আছে। সেটা নিয়েই এসেছিল। আমি একবার দেখেছি ছবিটা, ওঁরা খুব জোরাজুরি করছিলেন, আমার মূর্তির ছবি তাতে সন্দেহ নেই।”
“ওঁরা এসেছিলেন কেন? কী বললেন? শুধু মাত্র ছবিটা আপনাকে দেখাতে আর আপনার ঠাকুদার সঙ্গে ওঁর বাবার ঠাকুরদার চেনা পরিচয়ের কথা বলতে?” জিজ্ঞেস করল নীলু।
“ও নীলু তুই তো খুব ভালো অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছিস বাবা!” বললেন পিসিমণি, “আমিও ঠিক এই কথাটাই জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম। বলুন না ভাই, ওঁরা আর কী বললেন।”
“কী আর বলবেন! আপনি বুঝতে পারছেন না দিদি? মূর্তিটা দেখতে চাইলেন। বলল, একবার শুধু দেখবে। এত শুনেছে ওটার কথা, তাই দেখার ইচ্ছে! বুঝুন! ইচ্ছে হল আর অমনি চেনা নেই, শোনা নেই, চলে এলাম!”
“আপনি নিশ্চয়ই দেখাননি?” নীলু জিজ্ঞেস করল।
“মাথা খারাপ তোমার! কোনও প্রশ্নই ওঠে না, ওই গেট থেকেই বিদেয় করে দিয়েছিলাম দুজনকে। তবে শুধু এরা নয়, আরও দুজন লোক এসেছিল।”
“আরও দুজন! তারা আবার কারা?” নীলু আর পিসিমণি একসঙ্গে বলে উঠলেন।
“এরা প্রথমেই বলল মূর্তিটা কিনতে চায়, ভালো টাকা দেবে বলল। আমি বলছি না দিদি এ সব দেবব্রতবাবুর কাজ, নাহলে না দেখেশুনেই মূর্তিটা একেবারে কিনতে চাইল?”
“এদের সঙ্গে কোথায় কথা বলেছিলেন ভাই? আগের দিনের মতো বাড়ির বাইরেই?” পিসিমণি জানতে চাইলেন।
“না না, বাড়ির বাইরে নয়। সেদিন যা ভয় পেয়েছিলাম সে আর বলবেন না! এরা দুজন সোজা দোতলায় উঠে এসেছিল! সিঁড়ির দরজাটা খোলাই থাকে, বন্ধ থাকলে কে বারবার খুলবে? সিঁড়ি দিয়ে সোজা দোতলায় উঠে এসেছে! ক’টা হবে তখন? এই আটটা, সোয়া আটটা।”
“সন্ধেবেলা?”
“হ্যাঁ। সেদিন আবার কেউ বাড়িতে ছিল না। অত বড়ো বাড়িতে আমি একাই ছিলাম। আমার এক ভাগ্নীর বিয়ে ছিল, সবাই সেখানেই গেছিল, টালিগঞ্জে। এক আমিই যাইনি। আজকাল এই মূর্তিটার জন্যে বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার মোটেই ভরসা হয় না। ওদের তো ফিরতে রাত হবে, ভেবেছিলাম দরকার হলে মানসকে ডেকে নেব। সারা দিন ঘরের মধ্যে থেকে ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম, ভাবলাম একটু নীচে যাই, আমার লেটার বক্সটা গেটের ঠিক পাশেই, শুধু আমার নয়, আমাদের চারজনের আলাদা আলাদা, আমার বারান্দা থেকে দেখে মনে হল যেন কোনও চিঠি আছে, বিকেলে আর নামা হয়নি, ভাবলাম সেটাও নিয়ে আসি। তা সিঁড়ির দুটো ধাপ নেমেছি কী নামিনি, দেখি দুজন উঠে আসছে, চিনি না তাদের। ঠিক ওই সময়েই কী করে এল তা বুঝলাম না, তক্কে তক্কে ছিল নাকি কে জানে! তাদের দেখে আমি কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমিও ঘরে ঢুকলাম, তারাও ঢুকল আমার সঙ্গে, বলল দরকারি কথা আছে।”
“তারপর?” নীলু জিজ্ঞেস করল।
“দরকারি কথা মানে আর কী মূর্তি কেনা। ঘরে ঢুকেই সে কথা বলল। পরিষ্কার ভাষায় বলল যে আমার ঠাকুরদা যে এরকম একটা মূর্তি রাজস্থানে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তা তারা জানে, সেটা যে দামি জিনিস তাও, তাই সেটা কিনতে চায়। বলল দাম ভালোই দেবে। কথাবার্তা যে ভয় দেখিয়ে বলছিল বা হুমকি দিচ্ছিল তা মোটেই নয়, কিন্তু বলার ভঙ্গীতে এমন একটা ব্যাপার আছে যে আপনি ভয় পেতে বাধ্য। আমি পরিষ্কার বলে দিলাম যে ও মূর্তি বিক্রি করার প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু তারা শুনলে তো। আমাকে বলল, ‘ভেবে দেখুন মিস্টার রায়, এতে তো আপনার ক্ষতি কিছু নেই, বরং লাভই। মূর্তি নিয়ে আপনার ছেলে আর ভাইপোদের মধ্যে তো কম অশান্তি হচ্ছে না। বিক্রি করে দিলে সে সবও বন্ধ হয়ে যাবে। আপনার জিনিস, আপনি বিক্রি করতেই পারেন, কারুর তো কিছু বলার নেই।’ আমি আবার বললাম আমি মূর্তি বিক্রি করব না, তাতে কী বলল জানেন?”
“এবার নিশ্চয়ই ভয় দেখাতে শুরু করল?” নীলু বলল।
“ঠিক ভয় বলব না, তবে এমনভাবে বলছিল না! বলল, ‘কত লোক মূর্তির কথা জেনে গেছে সে তো বুঝতেই পারছেন, এদের মুখ থেকে আরও কত লোক জানবে তার কি কোনও ঠিক আছে? সবাই যে ভালো লোক হবে তারই বা কী মানে? এখন ভালো অফার পাচ্ছেন, এখন একটা ব্যবস্থা করে ফেললেই পারতেন, বুদ্ধিমানের কাজ হত সেটা।’ আমি বললাম, ‘আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি, এবার আপনারা আসুন,’ তাতেও তারা ওঠে না। যেন কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে হাসি হাসি মুখে বসে রইল! আমি তো চেঁচিয়েও উঠেছিলাম। কী ভাগ্যি ভালো ঠিক তখনই আমাদের পাড়ার এক ভদ্রলোক এসে পড়েছিলেন, ওঁর নাতনির জন্যে ওষুধ নিতে, নাতনির সর্দি হয়েছিল। তা তাঁকে দেখে এরা আর বেশি কিছু না করে চলে গেল, শুধু আমাকে আর একবার ভেবে দেখতে বলল,আমিও বাঁচলাম।”
“এই দুজনের নাম জেনেছিলেন?” পিসিমণি জিজ্ঞেস করলেন।
“নিজেই বলেছিল। প্রদীপ রাহা, এর মালিকের হয়ে এসেছিল আমার কাছে, মালিক নাকি এসব জিনিস কেনা বেচা করে, দেশে বিদেশে তার বড়ো বড়ো সব খদ্দের আছে। তবে এ মূর্তি নাকি সে কাউকে বিক্রি করবে না, নিজের কাছেই রাখবে। খবরের কাগজে ছবি দেখেছে তো ওরকম একটা মূর্তির, তাতেই নাকি তার খুব পছন্দ হয়ে গেছে। সত্যি মিথ্যে জানি না।”
“মালিকের নাম কী? বলেছিল কিছু?”
“পুরো নাম বলে থাকলেও আমার মনে নেই, আগরওয়াল এটুকু মনে আছে। নিজের নামটা বারবার বলছিল, তাই মনে আছে। বলল এ লাইনে প্রদীপ রাহার নাম নাকি সবাই জানে। ভালো জিনিসের সন্ধান অন্য কেউ পাওয়ার আগে নাকি সে পেয়ে যায়।”
“এই প্রদীপ রাহা একাই কথা বলছিল, অন্যজন কিছু বলেনি? তার নামই বা কী?”
“না। আরেকজন মুখ দিয়ে একটা টুঁ শব্দও খরচ করেনি, তার নামও জানি না। যতক্ষণ ছিল আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বসেছিল। একবারের জন্যেও নজর সরায়নি, এমন অস্বস্তিকর সে দৃষ্টি! আমার যে দেবব্রতবাবুর ওপর সন্দেহ তা বিনা কারণে নয় দিদি, এই প্রদীপ রাহাও ওঁর কথা জানে।”
“কেন কী বলল প্রদীপ রাহা?”
“বলল, ‘আপনি দেবব্রত সেনগুপ্তকেও দেখিয়েছেন মূর্তি, সব বলেছেন, উনিও কি ছাড়বেন? তাই বলছি আমি ভালো অফার দিচ্ছি, রাজি হয়ে যান।’ আমি বললাম দেবব্রতবাবু সেরকম কিছুই বলেননি, তাতে খুব হাসল, বলল, ‘ওনার কাজ করার তরিকা আর আমার তো এক নয়। আমি সামনাসামনি অফার দিচ্ছি, উনি তা নাও করতে পারেন। সবাই যে আপনাকে টাকা দিয়ে মূর্তি কিনবে তা তো নয়। আমার মালিকের ও মূর্তি চাই, তাই আপনাকে আমি অফার দিলাম, এর মধ্যে আনফেয়ার কিছু নেই, তবে সবাই তো এসব বোঝে না!’ খুব ভুল বলেনি বোধহয়।”
“আপনি দেবব্রতবাবুকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি ভাই? প্রদীপ রাহাকে চেনেন কীনা উনি? তাছাড়া দেবব্রতবাবু তো আপনার পাড়ার লোক, তার সম্পর্কে খবরাখবর পাওয়া তো খুব শক্ত কিছু নয়।”
“আমি আর এর পরে ওঁর সঙ্গে কথাই বলিনি কখনও। এ ওঁর জন্যেই হল, কোত্থেকে সব উলটো পালটা লোকজন নিয়ে আসছেন! ভুল অবশ্য আমারই দিদি, কেন যে গেছিলাম ওঁর কাছে!” সমর বললেন আক্ষেপ করেই, “তাছাড়া আজকাল কে কী করছে কেউ বুঝতেও পারে না, পরে যখন ধরা পড়ে তখন সব জানাজানি হয়।”
“পিসিমণি, এ তো দেখছি অনেকেই জানে মূর্তির কথা,” বলল নীলু, “দেবব্রতবাবু তো বটেই, যাঁকে সঙ্গে করে এনেছিলেন সেই ভদ্রলোক, তারপর প্রদীপ রাহা আর তার সঙ্গী, প্রদীপ রাহা যার হয়ে কাজ করে সেই মিস্টার আগরওয়াল তো জানেনই, আরও কতজন জানে কে জানে!”
“তাই তো দেখছি বাছা! আপনি বলুন তো ভাই এই প্রদীপ রাহা কত দিন আগে এসেছিলেন?”
“আজ হল শনিবার, টুলি মানে আমার ভাগ্নীর বিয়ে ছিল গত মঙ্গলবার, মঙ্গলবার এসেছিল।”
“মঙ্গলবার, তার মানে আজ চার দিন হল, এখনও তো কিছু হয়নি, কাজেই কোনও দুর্ঘটনা যে ঘটবেই তারও কোনও মানে নেই, আপনি অত ভাববেন না ভাই।”
সমর কিছু বললেন না, চুপ করেই রইলেন।
“প্রদীপ রাহা আপনাকে আর একবার ভেবে দেখতে বলেছিলেন, তা আপনি যদি মূর্তি বিক্রি করতে চান ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন কী করে? ফোন নম্বর বা ঠিকানা কিছু দিয়েছে?”
“না। বলেছিল সেই যোগাযোগ করে নেবে। বৃহস্পতিবার রাতে ফোন করল, আমার মোবাইল নম্বর দেখি জানে, কী করে জানল কে জানে! আমি সাফ বলে দিলাম মূর্তি আমি কোনওভাবেই বিক্রি করব না, তাতে ওই একই কথা বলল, ভালো অফার পাচ্ছি তাও কেন বিক্রি করছি না। আর কিছু না বলে ছেড়ে দিল। কিন্তু আজ ভোরে অন্য কথা বলল।”
“হুমকি দিল বা ভয় দেখাল?” নীলু জিজ্ঞেস না করে পারল না।
“মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলল, ‘আপনি তো খুব মুশকিলে ফেললেন মিস্টার রায়। মিস্টার আগরওয়ালের তো ও মূর্তি চাইই চাই। অ্যাট এনি কস্ট আমাকে তো ও মূর্তি ওনাকে এনে দিতে হবে। আমি আপনার সঙ্গে এত ভালো ডিল করতে চাইলাম, কিন্তু আপনি রাজি হলেন না!’ বলল, ‘আরও টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স সময় দিচ্ছি আপনাকে, তারপর আর নয়।’ এটা তো একরকম হুমকিই হল, তাই না?”
“আপনি পুলিশের কাছে যাননি?”
সমর মাথা নাড়লেন।
“এছাড়া আর কোনও ঘটনা ঘটেছে কি? বা আর কেউ মূর্তিটা দেখেছে বা দেখতে চেয়েছে?” পিসিমণি জিজ্ঞেস করলেন।
“গত পরশু একটা লোককে আমার বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতে দেখলাম, যেন কারুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আমি দোতলার বারান্দা থেকে “কাকে চাই” বলতেই সে দুম করে চলে গেল অথচ গত কাল সে আবার এসেছিল আর আমি শান্তনুকে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। লোকটা কে শান্তনুকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল বল্টু, ওর দোকানের এক কর্মচারী। কিন্তু বল্টুকে আমি চিনি, বল্টু ছিল না। এক তো এরকম ডাহা মিথ্যে কথা বলল তার ওপর আবার আমাকে হুমকিও দিল, মূর্তিটা যে তারই প্রাপ্য এবং তাকে তা না দিয়ে যে আমি অত্যন্ত অন্যায় করছি তা পরিষ্কার বলল। আমি ভালো বুঝছি না।”
“শান্তনু এত জোর দিয়ে কেন বলছে যে মূর্তিটা ওরই প্রাপ্য?” জিজ্ঞেস করলেন পিসিমণি।
“ঠাকুরদা ওঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মানে আমার বাবাকে মূর্তিটা দিয়েছিলেন, আমার দাদা অল্প বয়সে মারা না গেলে ও মূর্তি আমি কিছুতেই পেতাম না বলে ওর ধারণা। আমার আর আমার দাদার তিন ছেলের মধ্যে সেই বড়ো, তাই ও মূর্তি এখন ওর পাওয়া উচিত। এই হচ্ছে ওর যুক্তি, এসব ওর নিজের মাথা থেকে বেরিয়েছে, বাবা আমাকে এরকম কোনও নির্দেশই দিয়ে যাননি। এখন আমি পড়েছি মুশকিলে। আমার বয়স হয়েছে, এবার মূর্তির ব্যাপারে একটা কিছু সিদ্ধান্ত আমাকে নিতেই হবে, কিন্তু সে আর আমি নিয়ে উঠতে পারছি না। আমার ভাইপোদুটি, আমার ছেলে – সবারই মূর্তি চাই। আমার ছেলেটা আবার মারাত্মক বদরাগী। রাগের মাথায় কখন যে কী করে ফেলে সেই ভয়েই থাকি! আপনি কথা দিন দিদি, যদি কিছু হয় আপনি তার অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেবেন। আমি আর আসতে পারব না, এই যে এসেছি তাই যথেষ্ট দুশ্চিন্তা নিয়ে, মূর্তিটা তো বাড়িতেই আছে।”
“এত দামি জিনিস বাড়িতে না রাখাই বোধহয় ভালো। সেটা একটু ভেবে দেখবেন ভাই।”
ভদ্রলোক সে কথার উত্তরে তো কিছু বললেন না, চুপ করে বসে রইলেন।
সমর থেকে থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে যান, এখনও নিজের মনে কোনও ভাবনায় মগ্ন ছিলেন, হঠাৎ নিজের হাত ঘড়িটার দিকে নজর পড়তেই শশ ব্যস্তে উঠে পড়লেন, বললেন, “আর থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, ওদিকে কী হচ্ছে কে জানে!”
“আপনার চিঠিটা নেবেন না?” নীলু চিঠিটা দিতে গেল, ওর কাছেই ছিল।
“চিঠি? না না চিঠি নিয়ে আর কী করব?”
“হাতে লেখা চিঠি, দেখেছিলেন ভালো করে? হাতের লেখা কি চেনা কারুর মনে হয়?” পিসিমণি জানতে চাইলেন।
সমর মাথা নাড়লেন, পিসিমণিকে আর কিছু বলার কোনও সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে গাড়িতে উঠে বসলেন, শুধু কিছু হলে পিসিমণি যেন অবশ্যই সাহায্য করেন এ কথাই আবার বললেন।
ক্রমশ