প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
পর্ব – ৩
১
দেবদত্ত ও সিদ্ধার্থের প্রথম শত্রুতাঃ
এইসময় একদিন একটি ঘটনা ঘটল। কপিলাবস্তুর উপর দিয়ে বয়ে গেছে রোহিনী নদী। নদীর অপর পাড়ে আছে দেবদহ নগর। সেখানে থাকেন কোলিতরা। বহু যুগ ধরে শাক্য ও কোলিতদের শত্রুতা প্রতিষ্ঠিত। রোহিনীর তীরে শাক্য রাজকুমারেরা প্রায়ই খেলাধূলা করতে আসেন। মাঝে মাঝে সকলে নৌকা নিয়ে নদী পারাপার করে। বহুদিন আগে রাজা শুদ্ধোদন দেবদহের রাজকুমারী দুজনকে বিবাহ করে দুই নগরের দীর্ঘ শত্রুতার অবসান ঘটাতে চাইলেও এখনও কপিলাবস্তু ও দেবদহ নগরের অধিবাসীদের মধ্যে শত্রুতার মনোভাব যায়নি। তারা নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে পরস্পর বিবাদমান হয়।
শাক্য রাজপুত্রদের দলপতি হলেন রাজকুমার সিদ্ধার্থ। তার ব্যক্তিত্ব এমনই যে সহজেই তাঁর প্রতি সকলে আকৃষ্ট হয়। সিদ্ধার্থ মাছ ধরা, বা পাখি শিকার একেবারেই পছন্দ করেন না। ছোট ছোট কীট পতঙ্গের প্রতিও তার মনে অসীম করুণা। রাজপুত্ররা বিকেল হলেই রোহিনীর তীর থেকে দেবদহ পর্যন্ত নৌকাবিহার করে। সেইসময় নদীবক্ষ তাদের কলহাস্যে মুখর হয়ে ওঠে। অপর পাড় থেকে দেবদহের রাজপুত্ররা প্রায় প্রতিদিন নৌকায় চড়ে নদীতে মাছ ধরে থাকে এবং নানা রকমের পাখি শিকার করে। শাক্য রাজপুত্ররা তাদের উপেক্ষা করে না, তবে খানিকটা এড়িয়ে চলে।
একদিন সিদ্ধার্থ অন্যান্য শাক্য কুমারদের সঙ্গে রোহিনীর তীরে বসেছিলেন। সেইখানে রোহিনী নদীর পাড়ের গা ঘেঁসে একটি সুবিশাল কল্যাণসার বৃক্ষ আছে। লোকে বলে এই বৃক্ষটিও নাকি সিদ্ধার্থের সঙ্গে একই শুভদিনে জন্মেছে অর্থাৎ গাছটি রাজকুমারের সহজাত। গাছটি বড় হয়ে এক সুবিশাল আকার ধারণ করেছে। তারই ছায়ায় আনমনা হয়ে বসেছিলেন সিদ্ধার্থ। তাঁর নজর তখন দেবদহ থেকে উড়ে আসা একঝাঁক সাদা হাঁসের দিকে। হাঁসগুলি একই সারিতে সারিবদ্ধভাবে অপরূপ ভঙ্গিতে উড়ে আসছিল। এমন সময় অপর পাড় থেকে সহসা ছুটে এল একটি তির এবং তা হংসবলাকাদের মধ্যে একটিকে বিদ্ধ করল। হাঁসটি আর্তনাদ করে ছটফট করতে করতে উড়ে এল নদীর অপর তীরে এবং ঠিক সেখানেই সিদ্ধার্থ বসেছিলেন। হাঁসটির একটি ডানায় তির আটকে আছে। আহত হাঁসটি উড়ে এসে সিদ্ধার্থের সামনে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
অসহায় হাঁসটির ব্যথায় সিদ্ধার্থের মুখ বেদনায় করুণ হয়ে গেল। তিনি আহত হাঁসটিকে তক্ষুণি তাঁর কোলে তুলে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে তিরটি বের করে দূর্বাঘাস থেঁতো করে আঘাত পাওয়া জায়গায় লাগিয়ে দিলেন এবং নিজের উত্তরীয়র প্রান্ত ছিঁড়ে ক্ষতস্থানে একটি পটি বেঁধে দিলেন। হাঁসটি সিদ্ধার্থের কোলে পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেল। এমন সময় অপর পাড় থেকে একটি নৌকা কপিলাবস্তুর দিকে এগিয়ে এল। তাতে দেবদহের কিছু কুমার বসে ছিল।
তারা নৌকা থেকে নেমে সিদ্ধার্থের দিকে এগিয়ে এল। তাদের মধ্যে একজন বলল, ”দেবদহের রাজা সুপ্রবুদ্ধের পুত্র দেবদত্ত এই হাঁসটি শিকার করেছেন। তাঁর নামাঙ্কিত তির দিয়েই বিদ্ধ করেছেন হাঁসটিকে। তাই হাঁসটিকে এই মুহূর্তে আমাদের হাতে তুলে দিন। কারণ হাঁসটি আমাদেরই প্রাপ্য।”
সিদ্ধার্থ হাঁসটিকে তাঁর কোলে নিয়ে বসেছিলেন। তিনি কুমারদের কথার উত্তর দিলেন মধুর স্বরে। বললেন, “হাঁসটি প্রকৃতির নিজস্ব সম্পদ। কেউ এর মালিক নয়। তাছাড়া হাঁসটি যে কুমার দেবদত্তের তাও প্রমাণ সাপেক্ষ। এখন আমার কাছে আশ্রয় গ্রহণকারী এই হাঁসটিকে আমি কিছুতেই তাঁর হাতে তুলে দেব না। এ কথা তোমরা সকলে তোমাদের রাজপুত্র দেবদত্তকে গিয়ে জানিয়ে দিতে পারো।”
এ কথা শুনে কোলিত কুমারেরা রাগে অন্ধ হয়ে নৌকায় উঠে আবার দেবদহ নগরে ফিরে গেল। তখনকার মতো বিষয়টার নিষ্পত্তি হল, কিন্তু ব্যাপারটার অত সহজে সমাধান হল না। দেবদত্ত দেবদহের রাজার বিচার সভায় কথাটি তুলে বিচার চাইল। সে সিদ্ধার্থকে সর্বসমক্ষে দোষী সাব্যস্ত করতে চায়।
কয়েকটি দিন পরেই কপিলাবস্তুর রাজ দরবারে কুমার সিদ্ধার্থের নামে একটি আদেশনামা এসে পৌঁছাল। সেখানে হাঁসসহ সিদ্ধার্থকে বিচারসভায় ডেকে পাঠানো হয়েছে। রাজা শুদ্ধোদন আদেশনামা পেয়ে বিস্মিত হয়ে রাজপুত্রের কাছে ছুটে এলেন। সিদ্ধার্থ তার নবতল বিশিষ্ট প্রাসাদ সুরম্যের ভেতর তখন সেই হাঁসটিকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। হাঁসটি এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে এবং সে এখন সিদ্ধার্থের নিতান্ত অনুগতও হয়েছে। হাঁসটি পা টেনে টেনে প্রাসাদের অলিন্দে তখন নির্ভয়ে চলাফেরা করছিল। এমন সময় সেখানে মহারাজ শুদ্ধোদন এসে উপস্থিত হলেন।
“একী শুনছি পুত্র? তুমি নাকি এক সামান্য হাঁসের জন্য কোলিতদের সঙ্গে বিবাদ করেছ? যদি বিচারে তুমি দণ্ডাজ্ঞা পাও, এতে আমার যে চরম অপমান হবে! শেষে এই কি তুমি চাও? তার চেয়ে এই সামান্য হাঁসটি দেবদত্তকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে নাও। এই কাজই সবদিক থেকে শ্রেয় হবে কুমার।”
রাজার সমস্ত কথা শুনে সিদ্ধার্থ শান্ত স্বরে পিতাকে বললেন, “আপনি অযথা চিন্তা করবেন না। কোনও অন্যায় আমি করিনি। দেখবেন, বিচার সভায় সত্যেরই জয় হবে। কিছুতেই আপনার কোনও অসম্মান হবে না। আমার কাছে আশ্রিতের রক্ষাই হল সর্বাপেক্ষা শ্রেয় কর্ম। এই হাঁসটিকে আমি ছাড়তে পারব না। ও আমার কাছে আশ্রয় চেয়েছে, এর জন্য আমাকে যদি দণ্ড ভোগ করতে হয়, তাও আমি সহ্য করব।”
যথারীতি সকাল হতেই সিদ্ধার্থ দেবদহের বিচার সভায় এসে উপস্থিত হল। তার পরনে সুদৃঢ় বক্ষ বন্ধনীর উপর সাদা উত্তরীয়। গলায় মুক্তার মালা। কপালে ও বুকে অঙ্কিত চিত্রবিচিত্র সুগন্ধী চন্দন। কানে সোনার কর্ণকুণ্ডল। নিম্নার্ধে সরু সোনার পাড় বসানো কাশীর বস্ত্র। কোমর বন্ধনে উজ্জ্বল সোনার বন্ধনী। সবে কোমল গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে তাঁর সুকুমার মুখে। সোনার মতো উজ্জ্বল, দীর্ঘ আর সুঠাম তাঁর শরীর। চোখদুটি উজ্জ্বল আর অপূর্ব সুন্দর। যেন এক অপরূপ মায়া দিয়ে গড়া তাঁর দুটি চোখ। সিদ্ধার্থ লোক মুখে শুনেছে তাঁর মুখের গড়ন অনেকটা নাকি তাঁর মা মায়াদেবীর মতো। তিনিও নাকি এমনই তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা ও অপরূপ সুন্দর ছিলেন।
সিদ্ধার্থের হাতের মধ্যে ধরা আছে সেই হাঁসটি। তিনি সভায় তাঁর আসনে এসে বসলেন। বিপরীত দিকের আসনে বসে আছে দেবদত্ত। সে বয়সে সিদ্ধার্থের থেকে বছর দুয়েকের বড়। তার চেহারা দীর্ঘ ও সুন্দর হলেও মুখে সারল্যের পরিবর্তে এক ধরণের উদ্ধত ও অহঙ্কারী ভঙ্গিমা আছে আর আছে একরকম নিষ্ঠুরতার চিহ্ন ও ক্রুঢ়তা, যা তার মুখশ্রীকে একধরণের বিশিষ্টতা দিয়েছে।
রাজপুত্র সিদ্ধার্থর দৃষ্টি দূরের দিকে নিবদ্ধ। তিনি সভায় বসেও আনমনে কী যেন এক চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। তাঁর চোখদুটি যেন কোন সুদূরের পানে হারিয়ে গেছে। দেবদত্ত রোষ কষায়িত নয়নে একবার সিদ্ধার্থের মুখের দিকে চেয়ে দেখল। পরক্ষণেই সে তার চোখ ফিরিয়ে নিল। সিদ্ধার্থকে দেখে তার মুখে চোখে একধরণের অবজ্ঞার ভঙ্গী ফুটে উঠল।
বিচার সভা বসে গেল। বিচারক দুজনের বক্তব্যই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর সিদ্ধার্থকে তিনি হাঁসটি সভার মাঝখানে ছেড়ে দিতে বললেন। সভা তখন লোকে লোকারণ্য। হাঁসটি এত লোক সমাগম দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে, হঠাৎ পাখা ঝাপটে আবার সিদ্ধার্থের কাঁধের উপর উড়ে এসে বসল। হাঁসটি কী করে যেন সিদ্ধার্থকে তার রক্ষাকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছে। সিদ্ধার্থ সঙ্গে সঙ্গে পরম যত্নে হাঁসটিকে তাঁর দুহাতে ধরে নিলেন।
বিচারক বললেন, “আমার বিচার শেষ। এই হাঁসটির যথার্থ অধিকারী হলেন একমাত্র কুমার সিদ্ধার্থ। আমরা সকলেই দেখলাম এই অবোধ প্রাণীটিও তার জীবনদাতাকে নিজের পরম আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাছাড়া প্রাণ কেড়ে নেওয়ার চেয়ে জীবন ফিরিয়ে দেওয়া অনেক অনেক বড়, আর তা হল এক অতি সুমহান কাজ। অতএব এই বিবাদে জয় হয়েছে কুমার সিদ্ধার্থের।”
বিচারকের কথা শেষ হওয়া মাত্রই সিদ্ধার্থর সঙ্গে আসা শাক্য কুমারগণ একত্রে উল্লাসে ফেটে পড়ল। অথচ সিদ্ধার্থের মুখে আনন্দের চিহ্নই নেই। যেন এই জয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপই নেই। তিনি নিজের আসন থেকে উঠে, ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন দেবদত্তর দিকে। তারপর বাড়িয়ে দিল তাঁর সবন্ধুত্বের হাতখানি। তিনি দেবদত্তকে আলিঙ্গন করতে গেলেন, কিন্তু দেবদত্ত সিদ্ধার্থকে গ্রাহ্যই করল না। সে রাগে অপমানে অন্ধ হয়ে বিচারকের উদ্দেশ্যে গালি বর্ষণ করতে করতে সভা ছেড়ে চলে গেল।
সিদ্ধার্থ গমনোদ্যত দেবদত্তর দিকে বিষণ্ণভাবে চেয়ে রইলেন। তাঁর মনে হতে লাগল, এই দেবদত্তকে তিনি যেন কোথায় দেখেছেন! দেবদত্তর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হওয়ার কোনও উপায় নেই। যেন বহু বহু যুগ ধরে তিনি আর দেবদত্ত পরস্পর পরস্পরের শত্রু। এমন মনে হওয়ার কোনও কারণ সিদ্ধার্থ খুঁজে পেলেন না। কেবল কোন এক ধুসর স্মৃতির অস্পষ্ট আভাস তাঁর মনকে বিষণ্নতার মধ্যে আচ্ছন্ন করে রাখল।
ফেরার পথে নৌকাবক্ষ থেকে সিদ্ধার্থ হাঁসটিকে সুনীল আকাশে মুক্ত করে দিলেন। তাঁর মুখে তখন এক ধরণের সার্থকতার হাসি ফুটে উঠল।
একদিন এক প্রবল ঝড়ে রোহিনী তীরবর্তী কল্যাণগর্ভ বা কল্যাণসার বৃক্ষটি মাটিতে উপড়ে পড়ল। গাছটি এমনভাবে মাটিতে পড়েছিল, যে তাতে কপিলাবস্তু ও দেবদহের মধ্যে একটি বাঁধ রচনা করেছিল। তবে এতে রোহিনীর জলধারা বিভক্ত হয়ে বেশি অংশ কপিলাবস্তুর উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করল। দেবদহের দিকের জলধারা হয়ে গেল অতি ক্ষীণ। এর ফলে কপিলাবস্তুর অধিবাসীদের বিশেষ কোনও অসুবিধা না হলেও দেবদহের কৃষকদের চাষ আবাদে অসুবিধার সৃষ্টি হল। দেবদহের রাজা সুপ্রবুদ্ধ কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদনকে অনুরোধ জানালেন, তিনি যেন তাদের এই অসুবিধার কথা তাঁর উপযুক্ত ও কৃতী পুত্র সিদ্ধার্থকে বলেন।
কিন্তু শুদ্ধোদন দেবদহের অধিবাসীদের অসুবিধার কথা এবং দেবদহের রাজার অনুরোধের কথা তাঁর পুত্রকে জানালেন না। সিদ্ধার্থ সারথী ছন্নর কাছ থেকে এই খবর পেলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি রোহিনী নদীর তীরে ছুটে এলেন। সেই সুবিশাল কল্যাণসার বৃক্ষকে এতদিন কেউ কিছুতেই সরাতে পারেনি। সিদ্ধার্থ সেই গাছের কাণ্ডটিকে সমান দুটি ভাগে টুকরো করে কেটে ফেললেন, তারপর তাকে রোহিনীর দুই তীরে ফেলে দিলেন। এতদিনে দেবদহের অধিবাসীদের সমস্যার সুরাহা হল। তারা সকলে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের জয়জয়কার করতে লাগল। এই ঘটনায় দেবদত্তের সিদ্ধার্থের প্রতি হিংসা আরও বেড়ে গেল।
২
সিদ্ধার্থের বিবাহঃ
এরপর ধীরে ধীরে দীর্ঘ আট বছর কেটে গেল। কুমার সিদ্ধার্থের বয়স এখন প্রায় ষোলো। তিনি মাঝে মাঝে একাকী সারথী ছন্নকে নিয়ে রথে চড়ে নগরের পথে পরিভ্রমণ করে বেড়ান। তাঁর প্রিয় অশ্বের নাম কন্থক। সিদ্ধার্থের প্রতিটি যাত্রায় বেশিরভাগ সময় কন্থক হয় তাঁর বাহন। রাজকুমার এখন যৌবনে পদার্পণ করেছেন। তবে রাজকুমার অন্যান্য রাজপুত্রদের মতো আমোদপ্রিয় নন, সাজসজ্জা ও পশু শিকার তিনি অপছন্দ করেন। তিনি শরীরে চন্দনচর্চা করেন না, সচরাচর পরেন না মালা এবং কোনো স্বর্ণালঙ্কার। তিনি বেশি ভালোবাসেন কোনও নির্জন অরণ্যে কিংবা কোনও নদীর ধারে একাকী বিচরণ করতে।
কুমার একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহারাজ তাঁর জন্য তিনটি পৃথক প্রাসাদ তৈরি করে দিয়েছেন। সেই প্রাসাদগুলির নাম হলো সুরম্য, রম্য ও শুভ। এই তিনটি প্রাসাদ তিনটি পৃথক ঋতুতে বসবাসের জন্য উপযুক্ত। এই তিনটি প্রাসাদের একটি নবম তল বিশিষ্ট এবং অপর দুটি যথাক্রমে পঞ্চম তল ও সপ্তম তল বিশিষ্ট। বেশ কিছুদিন ধরে, কুমার রাজার হুকুমে দিনের বেশিরভাগ সময়েই এই তিনটি প্রাসাদগুলির কোনো একটিতে বন্দী হয়ে সময় কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ শুদ্ধোদনের মনে সারাক্ষণ কুমারকে নিয়ে একধরণের আশংকা। তিনি জ্যোতিষীদের ভবিষ্যতবাণী ভুলে যাননি। কুমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনের এই আশংকা যেন এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। তিনি কুমারকে তাই প্রাসাদের বাইরে আসতেই দিতে চান না। কুমারের সর্বক্ষণের অনুচর হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে ছন্ন। সে সর্বক্ষণ সিদ্ধার্থের সঙ্গেই থাকে এবং তাঁর প্রতিটি গতিবিধির প্রতি নজর রাখে।
কুমার কখনও বাইরে রাজপুরীর উদ্যানের সরোবরের কাছে এসে দাঁড়াতে চাইলেও তাঁর মাথায় শ্বেত ছত্র ধরে দাস দাসীরা কেউ না কেউ তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আসে, যাতে তাঁর মাথায় রাতের হিম বা সকালের রোদের তাপ না লাগে। প্রাসাদগুলিতে এখন মহারাজের নির্দেশে নিযুক্ত হয়েছে বহুসংখ্যক সুন্দরী নৃত্য ও সঙ্গীত পটীয়সী দাসী। তারা নানাভাবে কুমারের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় সদা ব্যস্ত। সিদ্ধার্থ কিন্তু তাদের গান ও নাচ মোটেই উপভোগ করেন না। এমনকি তিনি তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে পর্যন্ত পছন্দ করেন না। তারা সিদ্ধার্থের কক্ষে প্রবেশ করলেই, সিদ্ধার্থ তাদের দিকে হাত তুলে বলে ওঠেন, “একান্ত!”
সঙ্গে সঙ্গে সেইসব নাচ ও গান জানা দাসীরা মাথা নীচু করে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এই সমস্ত কথাই পল্লবিত হয়ে মহারাজের কানে এসে পৌঁছাতে থাকে। এর ফলে মহারাজ আরও আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, “কুমারের নাচ, গান পর্যন্ত পছন্দ নয়? এ তো স্বাভাবিক নয়! তবে সে কী চায়? সে কি প্রব্রজ্যা নিতে চায় তবে?”
মহারাজ জরুরি একটি গোপন মন্ত্রণা সভায় তাঁর পরম হিতৈষী মন্ত্রীদের আলোচনার জন্য ডেকে পাঠালেন। একজন বয়স্ক ও প্রাজ্ঞ মন্ত্রীর কথা মহারাজের পছন্দ হল। তিনি বললেন, “মহারাজ! কুমার কী চান? তা আপনাকে প্রথমে জানতে হবে। তিনি কি বিবাহ করতে চান না? আগে সে কথা জানুন। যদি তিনি বিবাহ করতে চান, তাহলে তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, কেমন নারী তাঁর পছন্দ। আপনি তাঁর মনোমত পাত্রীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিন। অল্প বয়সে সংসারে একবার প্রবেশ করলে কুমার আর গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে চাইবেন না।”
মহারাজ কুমারের সঙ্গে একাকী বিবাহের কথা বলতে যেতে প্রমাদ গুনলেন। তিনি ভাবলেন, এতে কুমার হয়তো তাঁর প্রতি বিরক্ত হতে পারে। তিনি রানি গৌতমী ও কয়েকজন অনুগত পারিষদবর্গদের সঙ্গে কুমারের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর প্রাসাদে গেলেন।
কিন্তু তাদের সবাইকে অবাক করে কুমার বলে উঠলেন, “আমার বিবাহে কোনও আপত্তি নেই।”
এ কথা শুনে মহারাজ আনন্দে আত্মহারা হলেন। তিনি জানতে চাইলেন, “কুমার তোমার কেমন কন্যা পছন্দ? আমাকে জানাও। আমি যেখান থেকে পারি তেমন কন্যা তোমার জন্য আনবো দরকার হলে আমার দূতগণ সমগ্র জম্বুদ্বীপ পরিভ্রমণ করবে।”
সিদ্ধার্থ বললেন, “আমার কেমন কন্যা পছন্দ তা আমি আপনাদের জানাব, তবে তা আজ থেকে ঠিক সাতদিন পরে।”
সাতদিন পরে সিদ্ধার্থ সবাইকে জানালেন, কেমন ভার্যা তার পছন্দ।
“আমি এমন গুণ বিশিষ্ট নারীকে আমার স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করি, যিনি হবেন সুশিক্ষিতা, সত্যবাদী, ও ত্যাগপরায়ণ। হিংসা, ছলনা, শঠতা যেন তাঁর চরিত্রে না থাকে। তাঁর চরিত্র যেন হয় নির্মল এবং পূত-পবিত্র। তাঁর কোনও অহংকার থাকবে না। তিনি বসনে ভূষণে লজ্জাশীল হবেন এবং স্বামীর প্রতি তিনি মা ও বোনের মতোই মমতাময়ী হবেন। তাঁর মধ্যে কোনও অলসতা থাকবে না এবং তিনি তাঁর শ্বশুর ও শাশুড়ির প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবেন। তিনি যেন হন সকল প্রাণীর প্রতি মমত্বপূর্ণ ও মমতার প্রতীক স্বরূপ। দাসী ও তাঁর পরিজনদের তিনি যেন নিজের মতো ভালোবাসেন। তাঁর অবশ্যই নীতিজ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞান থাকতে হবে। এইসব গুণ বিশিষ্টা নারী যে কোনও গোত্র বা কূলেই থাকুক না কেন, তাঁকে বিবাহ করতে আমার আপত্তি হবে না। আমি জাতিভেদ প্রথায় বিশ্বাসী নই। তবে তাঁকে অবশ্যই সৎ ও পুণ্য চরিত্রের হতে হবে।”
এ কথা শুনে মহারাজ শুদ্ধোদন কয়েকজন ব্রাহ্মণদের সিদ্ধার্থের উপযুক্ত কন্যা খুঁজে আনতে নিযুক্ত করলেন। তারা প্রাথমিকভাবে কপিলাবস্তুর ঘরে ঘরে ঘুরে সিদ্ধার্থের মনোমত পাত্রীর খোঁজ করতে লাগলেন। রাজা ব্রাহ্মণদের প্রেরণের আগে বললেন,
“ব্রাহ্মণীং ক্ষত্রিয়াং কন্যাং বৈশ্যাং শূদ্রীং তথৈবচ।
যস্যা এতে গুণাঃ সন্তি তাং কন্যাং মে প্রবেদয়।।
ন কূলেন না গোত্রেণ কুমারো মম বিস্মিতঃ।
গুণে সত্যে চ ধর্মে চ তত্রাস্য রমতে মনঃ।।”
অর্থাৎ এমন কন্যার অন্বেষণ করুন যিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য কিংবা শূদ্র যে কোনও কূল বা গোত্রের হলেও তাতে কুমারের কোনও আপত্তি নেই। তবে তিনি যেন সদা সত্য ও ধর্মে অবিচল থাকেন।
মহারাজের কথা শুনে একদল ব্রাহ্মণ কপিলাবস্তু ও সন্নিহিত স্থানগুলিতে পাত্রীর খোঁজে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। সহসা তাঁরা একটি সূত্রে খবর পেয়ে দেবদহ নগরে ছুটে গেলেন।
দেবদহের রাজা হলেন সুপ্রবুদ্ধ। তার ভ্রাতা হলেন দণ্ডপাণি শাক্য, তাঁর নাকি এক অপরূপা কন্যা আছে। তাঁর সেই কন্যার নাম যশোধরা। তাঁর অপরূপ মুখশ্রী বলে তাঁর অন্য আর একটি নাম হল বিম্বা। এছাড়া গোপাও তাঁর আরও একটি নাম। (ঐতিহাসিকদের মতে যশোধরা হলেন দণ্ডপাণি শাক্যের কন্যা বা মতান্তরে সুপ্রবুদ্ধের কন্যা।) ব্রাহ্মণেরা শুনেছিলেন যশোধরার গায়ের রঙ নাকি অতি উজ্জ্বল। তাঁরা রাজপুরীর উদ্যানে গিয়ে একদিন সচক্ষে দেখে বুঝলেন, যশোধরার গায়ের রঙ কাঁচা সোনার মতোই উজ্জ্বল স্বর্ণালী। দেখেই তো তাঁরা তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
এবার রাজকুমারীর গুণ বিচার করা দরকার। রাজকুমারী অন্তঃপুরবাসিনী। তাঁর গুণ বিচার করা দুষ্কর হলেও তা একেবারে অসম্ভব নয়। রাজবাড়ির দাসীদের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে জানা যেতে পারে। তাঁরা সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকলেন।
যশোধরার সহচর দাসীর সংখ্যা অসংখ্য, যাইহোক তাদের একজনের মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারলেন, যশোধরা খুবই দয়ালু স্বভাবের। তিনি পাখি ও মাছদের খাবার দিতে সাতদিনে একবার নদীর তীরে আসেন। শাক্যকুমারীকে ব্রাহ্মণেরা নির্ধারিত সেইদিনে দেখতে পেলেন, একেবারে সামনে থেকে। তাঁর হাতে তখন নানা রকম শস্য ও বীজ। তিনি একটি ঝুড়ি থেকে সেগুলিকে জলে ও মাটিতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, এবং তা খেতে দলে দলে আকাশ থেকে উড়ে আসছে বিভিন্ন পাখি ও মাটিতে অসংখ্য বেজি ও কাঠবিড়ালী। এরপর একটি মাটির পাত্র থেকে রাজকুমারী তরল গুড় ঢেলে দিতে লাগলেন মাটিতে। জিজ্ঞাসা করে ব্রাহ্মণরা জানতে পারলেন, এই গুড় মাটিতে বসবাসকারী পোকা মাকড় ও পিঁপড়েদের জন্য দেওয়া হচ্ছে।
এরপর যশোধরা গেলেন বিষ্ণু মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য। তাঁকে অনুসরণ করে ব্রাহ্মণরাও সেখানে গিয়ে পৌঁছালেন। রাজকুমারী মন্দিরে দেবার্চনার পর দরিদ্রদের যথেচ্ছ দান দিলেন। ফেরার পথে তিনি তাঁর রথে উঠে বসতেই, সারথী ঘোড়ার পিঠে সজোরে একবার চাবুক মারল। ঘোড়াটি একটা তীব্র চীৎকার করেই ছুটতে শুরু করল। সেই চীৎকার শুনে শিহরিত হয়ে উঠলেন রাজকুমারী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রথ থামাতে বললেন, এবং তক্ষুণি তিনি নেমে এলেন মাটিতে। তারপর আঘাত পাওয়া ঘোড়ার গায়ে তাঁর কোমল হাতখানা বারবার বুলিয়ে দিয়ে, তাকে ছোলা ও সবুজ ঘাস খেতে দিয়ে, তবে রাজকুমারীর মনে শান্তি এল।
এরপর ব্রাহ্মণরা আরও খবর পেলেন রাজকুমারী কেবল কোমল মনেরই নন, তিনি শাস্ত্র এবং সঙ্গীত বিশারদ এবং তাঁর স্বভাবও অত্যন্ত মধুর। সেই সঙ্গে রাজকুমারীর জন্মক্ষণও খুবই শুভ। তিনি হলেন সিদ্ধার্থের সহজাতা। অর্থাৎ তাঁরা দুজনেই সমবয়স্ক।
যশোধরাকে মনোনীত করে ব্রাহ্মণরা কপিলাবস্তুতে ফিরে গেলেন। শুদ্ধোদনও তাদের মনোনীত পাত্রী যশোধরার রূপ ও গুণের কথা শুনলেন। রাজা তারপর চিন্তা করলেন, এই কন্যা উপযুক্ত হলেও, একেই যদি কুমারও মনোনীত করেন, তবেই এর সঙ্গে কুমারের বিবাহ হবে। মহারাজ এরপর এক অভিনব উপায় চিন্তা করলেন। তিনি এক সন্ধ্যায় রাজবাড়ির উদ্যানে এক বিশাল সভার আয়োজন করলেন। রাজা সিদ্ধার্থকে ডেকে বললেন, “এই সভায় তোমার উপযুক্ত সমস্ত কুমারী কন্যারা উপস্থিত হবেন। আমি নিজে তাঁদের সবাইকে নিমন্ত্রণ জানাব। এদের সকলকে তুমি উপহার দান করবে। সেই অবসরে তুমি তোমার ভার্যা পছন্দ করে নেবে। আমি চাই, তোমার ভাবী স্ত্রীকে তুমি নিজেই পছন্দ করে নাও।”
কথা মতো উপযুক্ত সব কন্যাদের জন্য এল রাশি রাশি উপহার। নানা রকম চন্দন কাঠের দারুমূর্তি, পাথরের প্রতিরূপ, বহুমূল্য অলঙ্কার, শৌখিন বস্ত্র ইত্যাদি। সিদ্ধার্থ সেই সন্ধ্যায় নিজে তাঁদের হাতে উপহারগুলি তুলে দিতে লাগলেন। ভিড়ের মধ্যে সবার শেষে দাঁড়িয়ে আছেন যশোধরা। তাঁর উপহার নেওয়ার কোনও আগ্রহই নেই। তিনি গোপন সূত্রে শুনেছেন, এই সভা হল, প্রকৃতপক্ষে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের স্বয়ম্বরসভা। যদিও এই কথা নিমন্ত্রিত কন্যাদের কাউকে কিছুই জানানো হয়নি, তবুও যশোধরা হলেন রাজপরিবারের আত্মীয়া। রাজা সুপ্রবুদ্ধ দূতের কাছ থেকে এই খবর পেয়েছেন। এক বিশ্বস্ত দাসীর কাছ থেকে সেই খবর জেনেছেন যশোধরাও। তিনি শুনেছেন, এই সভায় নাকি রাজপুত্র সিদ্ধার্থ এই কুমারীদের মধ্যে থেকে নিজের পত্নী নির্বাচন করবেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! রাজপুত্র উপহার দেওয়ার সময় তো কোনও মেয়ের দিকেই চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না! তাহলে তিনি কী করে পত্নী নির্বাচন করবেন? নাকি রাজপুত্র শেষ পর্যন্ত বিবাহই করবেন না? যশোধরার বড় কৌতূহল হল। তিনি কেবলই ভাবতে লাগলেন, না দেখে কীভাবে তবে রাজপুত্র তাঁর ভাবী স্ত্রীকে নির্বাচন করবেন?
অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ভাবতেই একসময় সিদ্ধার্থর একেবার সামনে চলে এলেন তিনি। এবারে তাঁর উপহার নেওয়ার পালা। সেই সময় সিদ্ধার্থ তাকিয়ে দেখলেন, উপহারের থালাটি একেবারে শূন্য, আর একটিও উপহার সেখানে অবশিষ্ট নেই। তিনি তখন তাঁর সামনে দাঁড়ানো যশোধরার দিকে তাকালেন। এতক্ষণ পরে প্রথম সিদ্ধার্থ একজন কুমারীর দিকে তাকালেন, কারণ উপহার দিতে না পেরে তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সামনে যেন কী এক অস্পষ্ট অতীত এসে দাঁড়াল। তার প্রবলভাবে মনে হল, এই নারী তাঁর বহুকালের পূর্বপরিচিত। বহু বহু কাল আগে এই নারীর সঙ্গে তাঁর পরম মৈত্রীর সম্পর্ক ছিল। তাঁর সামনে সহসা যেন বহু যুগের বিস্মৃত নানা কাহিনী একসঙ্গে ভীড় করে এসে দাঁড়াল। সেই কাহিনী পরম ভালোবাসার আর নির্ভরতার কাহিনী। সিদ্ধার্থ তাঁর শূন্য উপহারের থালার দিকে এবার করুণ চোখে তাকিয়ে বললেন, “এখানে আর কোনও উপহার নেই! আপনাকে একটু সময় অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না নতুন উপহার সামগ্রীগুলি আবার এখানে এসে পৌঁছাচ্ছে।”
যশোধরা হেসে বললেন, “আমার উপহারের কোনও প্রয়োজন নেই রাজপুত্র!”
“তা কী করে হয়! কিছু একটা উপহার তো নিতেই হবে রাজকুমারী!” তবুও যশোধরা চলে যেতে উদ্যত হতেই, সিদ্ধার্থ হঠাৎ তাঁর গলার অমূল্য মুক্তোর মালাটি খুলে যশোধরাকে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “তবে এই নাও তোমার উপহার রাজকুমারী!”
সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে একসঙ্গে অনেক শাঁখ বেজে উঠল। দাসী সহচরীরা উলুধ্বনি দিতে লাগল। এমনটাই আগে থেকে ঠিক ছিল। যাকে রাজপুত্র মনোনয়ন করবেন, তাঁর গলাতেই নিজের মালাটি দান করবেন।
সিদ্ধার্থ যশোধরাকে মনোনয়ন করলেও, যশোধরার পিতা দণ্ডপাণিশাক্য দূত মুখে বলে পাঠালেন, “আমি শিল্প জ্ঞানহীন পাত্রের সঙ্গে আমার মেয়ের বিবাহ দিতে চাই না। আমি শুনেছি, রাজপুত্র সিদ্ধার্থ রাজপুরীরতে তিনটি পৃথক প্রাসাদের ভেতর ছোট থেকে বন্দি অবস্থায় বড় হয়ে উঠেছেন। এমন গৃহবন্দি ব্যক্তির কোনও প্রকার শিল্পজ্ঞান কীভাবে থাকতে পারে? এমন ব্যক্তি আমার কন্যার স্বামী হওয়ার যোগ্যই নয়। কলাবিদ্যায় দক্ষ ব্যক্তির সঙ্গেই আমাদের পরিবারের কন্যাদের বিবাহ হয়। এটিই আমাদের পারিবারিক রীতি। রাজপুত্র তেমন নন। তিনি হস্তী আরোহণ, কুস্তী, ধনুক ব্যবহার কোনোটিতেই সম্ভবতঃ দক্ষ নন। এইসব বিদ্যায় দক্ষ জনকেই আমি আমার কন্যা দান করব।”
এ-কথায় মহারাজ শুদ্ধোদন অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। তিনি সিদ্ধার্থকে তাঁর বিবেচনা পুনর্বিচার করে দেখতে বললেন। সিদ্ধার্থ কিন্তু দণ্ডপাণি শাক্যের কথায় বিরক্ত হলেন না। তিনি বললেন,
“আমার মতে আমার মতো শিল্পোজ্ঞ এই সমগ্র জম্বুদ্বীপে নেই। তবে এই কথা অবশ্যই পরীক্ষা সাপেক্ষ। আমি সমস্ত শাক্যবর্গের সামনে আমার শিল্পজ্ঞানের পরীক্ষা দিতে চাই। এই পরীক্ষায় উপযুক্ত মনে করলেই যশোধরা যেন আমাকে তাঁর পতি হিসাবে নির্বাচন করেন।”
কপিলাবস্তুর সর্বত্র ঘোষিত হল রাজপুত্র তাঁর শিল্পজ্ঞানের পরিচয় দেবেন আজ থেকে ঠিক সাতদিন পরে। নির্দিষ্ট দিনে দলে দলে প্রজারা এক বিশাল উদ্যানে এসে সমবেত হল। ইতিমধ্যে অন্যান্য শাক্য রাজপুত্ররাও শিল্পজ্ঞানের পরীক্ষা দিতে সকলে সেখানে চলে এসেছেন। উদ্যানের শেষ প্রান্তে বিজয়পতাকা হাতে অপেক্ষা করছেন যশোধরা। যিনি অসিযুদ্ধ, মল্লযুদ্ধ এবং ধনুষ্কলাপ যুদ্ধে জয়ী হবেন, দিনের শেষে তাঁর হাতে তিনি বিজয় পতাকা তুলে দেবেন।
উদ্যানের একপাশে একটি সুসজ্জিত হাতি দাঁড়িয়ে আছে। এই হাতিটিকে বৈশালী রাজ্য থেকে উপহার হিসেবে রাজকুমার সিদ্ধার্থের বিবাহ উৎসব উপলক্ষে কপিলাবস্তুতে পাঠানো হয়েছে। হাতিটি বহুমূল্য নানা অলঙ্কারে ভূষিত। তার শুঁড়ে, পিঠে ও গলায় আছে সোনার কারুকার্যময় অলঙ্কার। দেবদত্তও শিল্পজ্ঞানের পরীক্ষা দিতে ময়দানে এসেছিল। সে আগত জনতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই হাতিটি এখানে কেন? এটি কার?” প্রজারা উত্তর দিল, “হাতিটি রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্য বৈশালী রাজপরিবারের উপহার।”
তখন সে পরম ঘৃণায় হাতিটির মাথায় লোহার দস্তানা পরা হাত দিয়ে ক্রমাগত প্রবল আঘাত করতে লাগল। হাতিটি ছিল রাজপরিবারের প্রশিক্ষিত এক পরম মঙ্গলহস্তী। সে প্রাণান্তেও মানুষের অনিষ্ট করে না। আঘাতে আঘাতে একসময় হাতিটি মারা গেল, তবুও সে একবারও দেবদত্তর ক্ষতি করতে উদ্যত হল না।
এই নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখে সমবেত প্রজারা হায় হায় করতে লাগল।
এমন সময় ময়দানে এল সিদ্ধার্থের ভাই রাজকুমার নন্দ। সে মৃত হাতিটিকে দেখে বলল, “এই হাতিটিকে কে হত্যা করেছে?”
সমবেত জনতা উত্তেজিত স্বরে উত্তর দিল, “কুমার দেবদত্ত।”
“এ অতি অন্যায় কাজ হয়েছে।” এই কথার পরেই সে তার ভীষণ শক্তির পরিচয় দিল। সে হাতিটিকে নগরদ্বারের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ঠিক এমন সময়, সুবর্ণ-খচিত অপূর্ব একখানি রথে চড়ে ময়দানে এসে পৌঁছালেন রাজকুমার সিদ্ধার্থ। তাঁর উর্ধ্বাঙ্গে আজ কেবল একটি স্বচ্ছ ও শ্বেত উত্তরীয়। তাঁর উন্মুক্ত বক্ষস্থল চন্দন চর্চিত। গলায় মুক্তার মালা। কোমরবন্ধনীতেও মুক্তার আভরণ। নিম্নাঙ্গে ঘন নীল রঙের অধোবাস। তাঁর উজ্বল স্বর্ণাভ গৌরবর্ণ সকালের রোদে যেন ঝলমল করছে। তাঁর সুকুমার সুগঠিত শরীর এবং সরল ও পবিত্র মুখটি দেখে যশোধরাসহ সকল প্রজাগণ মনে মনে তাঁরই জয় প্রার্থনা করতে লাগলেন।
রথ থেকে নেমে হাতিটিকে পর্যবেক্ষণ করলেন সিদ্ধার্থ। তিনি বললেন, “এই হাতিটিকে এখান থেকে এখনই অপসারণ করা প্রয়োজন। নাহলে এর মৃত ও গলিত দেহ থেকে নগরে দুর্গন্ধ ছড়াবে।”
তিনি এরপর হাতিটিকে বহুদূরে নিক্ষেপ করলেন। প্রজারা আশ্চর্য হয়ে চেয়ে দেখল, যেখানে হাতিটি গিয়ে পড়ল সেখানে একটি বিরাট গর্তের সৃষ্টি হল। পরে কপিলাবস্তুতে এই গর্তটি হস্তীগর্ত নামে বিখ্যাত হয়।
এরপর শুরু হল মল্লযুদ্ধ। বেশিরভাগ শাক্য কুমারেরা মল্লযুদ্ধে সিদ্ধার্থের কাছে পরাজিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। এরপর দাম্ভিক দেবদত্ত এগিয়ে গেল সিদ্ধার্থের দিকে। তার মুখে উপেক্ষা ও অবজ্ঞার হাসি। সিদ্ধার্থ ভাবলেন, দেবদত্তকে তার অহংকারের উপযুক্ত শাস্তি দেবেন। তিনি দেবদত্তকে ডান হাতে ধরে সজোরে ঘুরিয়ে দিলেন। দেবদত্ত হয়তো কয়েকটি পাক ঘুরে যেতেন তাতে, কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন একটু দূরে দাঁড়ানো রাজকুমারী যশোধরা মিনতি ভরা চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। তক্ষুণি সিদ্ধার্থের মনে পড়ে গেল, দেবদত্ত সম্পর্কে যশোধরার নিকটজন ও তাঁর জ্ঞাতি ভাই হয়। সিদ্ধার্থ তখন দেবদত্তকে ধরে ফেললেন এবং আর আঘাত না করে সজোরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। মল্ল যুদ্ধেও সিদ্ধার্থ বিজয়ী হলেন।
এরপরে শুরু হল ধনু্র্বিদ্যার পরীক্ষা। আনন্দ, নন্দ, দণ্ডপাণি, দেবদত্ত সকলেই ধনুকে শর যোজনা করে তাদের পরীক্ষা দিল। এদিকে সিদ্ধার্থ যে ধনুকে শর যোজনা করেন তা-ই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। শেষে মহারাজ বললেন, মহান শক্তিধর পিতামহ সিংহহনুর সুবিশাল ধনুক এনে সিদ্ধার্থকে দেওয়া হোক। সিদ্ধার্থকে অবশেষে সেই সুবিশাল ধনুক এনে দেওয়া হল। তার টঙ্কারের শব্দে চতু্র্দিক মুখরিত হল। সিদ্ধার্থ সশব্দে শর নিক্ষেপ করলেন। সেই শর সামনে লৌহময় সাতটি তালবৃক্ষ যন্ত্রযুক্ত একটি বরাহ মূর্তিকে ভেদ করল এবং চারিদিকে লৌহময় প্রাকার বিশিষ্ট চর্মের ভেরী ভেদ করে বহুদূরে এগিয়ে মাটির তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রজারা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে দেখলেন, যেখানে শরটি মাটিতে প্রবেশ করেছিল, সেখান থেকে একটি জলধারার উৎপত্তি হয়েছে। জলধারা থেকে জল উর্ধ্বমুখে ছড়িয়ে পড়ছে। চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। সেই জলধারাকে মহারাজ শুদ্ধোদন পাথর দিয়ে ঘিরে দিলেন। সেখানে একটি কুয়ো বা কূপের সৃষ্টি হল। এরপর থেকে ওই জায়গার নাম হয়ে গেল শরকূপ (বর্তমান নাম শর কূইয়াঁ)।
এরপর কুমারের লিপিজ্ঞান ও সংখ্যাজ্ঞানের পরীক্ষা করার জন্য এলেন একজন বিখ্যাত গণক। তার নাম অর্জুন। তিনি কুমারকে নানা প্রশ্নের পর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কুমার নিমেষের মধ্যে এক থেকে কোটির বেশি সংখ্যা গণনা করতে সক্ষম। এরপর লিপিজ্ঞান পরীক্ষা করার আগেই তাঁর আচার্য বিশ্বামিত্র এসে বললেন, “আমি কুমারের পরীক্ষা কীভাবে নেব? ক্ষণজন্মা কুমার যতরকম লিপি জানেন, তা জানা তো দূরের কথা, সেই বেশিরভাগ লিপির আজও আমি নাম পর্যন্ত জানি না।”
এই কথা শুনে সকলে বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। তারা সমস্মরে বলতে লাগল, “এই কুমার প্রকৃতপক্ষেই সর্বার্থসিদ্ধ! জয়! কুমার সিদ্ধার্থের জয়! মহারাজ আপনি ধন্য! আপনি অতি ভাগ্যবান! এমন পুত্রের জনক আপনি!” এরপর তারা সমবেতভাবে আসন ছেড়ে এসে কুমারের পদতলে প্রণাম জানালেন। সেই সময় আকাশবাণী হল,
“এষ ধরণীমণ্ডে পূর্ববুদ্ধাসনস্থঃ
শমথধনু গৃহীত্বা শূন্যনৈরাত্মবাণৈঃ।
ক্লেশরিপু নিহত্বা দৃষ্টিজালং চ ভিত্ত্বা
শিববিরজম শোকাং প্রাপ্যস্যতে বোধিম অগ্রম্।।”
অর্থাৎ “কুমার ধরণীতে পূর্ব বুদ্ধগণের আসনে সমাসীন হবেন এবং শমথধনুতে শূন্যনৈরাত্ম বাণ আরোপিত করে ক্লেশরিপূ নিধন করে মোহজাল ছিন্ন করে শিব(শান্ত), বিরজ(নির্মল), অশোক(শোকহীন) হয়ে বোধিজ্ঞান লাভ করবেন।”
এই আকাশবাণীর অর্থ বোধগম্য হল না কারুর। কারণ আকাশবাণীর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিদ্যুত চমকের সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তখন। সকলে দৈববাণীকে বজ্রেরই শব্দ বলে ভুল করল। এদিকে সিদ্ধার্থের জয়ের আনন্দে ময়দানের একধারে তখন প্রজারা সমবেত হয়ে নাচ গান শুরু করে দিয়েছে। ময়দানের শেষ প্রান্ত থেকে বিজয় পতাকাটি হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন, রাজকুমারী যশোধরা। তিনি এরপর বিজয় পতাকাটি সিদ্ধার্থের হাতে তুলে দিলেন। রাজকুমারী লজ্জায় অধোবদন হয়ে আছেন, তবে তাঁর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। বিজয়ী বীর সিদ্ধার্থ তাঁর মন জয় করে নিয়েছেন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই মালা বদল হল দুজনের। অন্যদিকে তখন দেবদত্তের মুখ অপমানে আর রাগে লাল হয়ে গেছে। দেবদত্ত শুনেছিল, জ্যোতিষীরা বলেছিলেন,
“যশোধরা যাঁকে বিবাহ করবেন, তিনি কালে এই সমগ্র শশধরা পৃথিবীর রাজা হবেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর প্রভুত্ব করবেন। হাজার হাজার বছর পরেও তাঁর যশ হবে অমলিন। যশোধরার স্বামীই হবেন আগামী পৃথিবীর এক পরম কল্যাণকামী অধিপতি।”
দেবদত্ত তাই মনেপ্রাণে যশোধরাকেই বিবাহের স্বপ্ন দেখত এতদিন। তার স্বপ্ন এবার একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেল। দেবদত্ত যশোধরার জ্ঞাতি ভাই হলেও, তখন শাক্যদের মধ্যে জ্ঞাতি ভাইবোনের বিবাহ সিদ্ধ ছিল, অর্থাৎ জ্ঞাতিদের মধ্যে বিয়ের প্রচলন ছিল। দেবদত্ত আজ সবদিক থেকে পরাজিত হয়েছে। তার মুখে অপমান ও বিষাদের ছায়া। সে ময়দান ছেড়ে সবার অলক্ষ্যে বিদায় নিল।
এরপর শুভদিনে সিদ্ধার্থ ও যশোধরার বিবাহ হয়ে গেল। কপিলাবস্তুর মানুষ ও দেবদহের মানুষ একত্রে আনন্দে মেতে উঠল। দণ্ডপাণি শাক্য যশোধরার সঙ্গে তাঁর দাসী ও সহচরীদেরও রাজকুমারীর পরিচর্য্যার জন্য কপিলাবস্তুর রাজবাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
বিয়ের দিনে কত যে ফুল এল, কত যে ঝাড়বাতি জ্বলল, কত রকম যে খাবার রান্না হল তার ইয়ত্তা নেই। কত নট ও নটী এল। শত শত নর্তকী ও সঙ্গীত শিল্পীর দল এসে তাদের শিল্পের পরিচয় দিতে কপিলাবস্তুতে ভিড় জমালেন। রাজ্যজুড়ে শত শত অস্থায়ী তাঁবু পড়ল, সেখানে দূর দূরান্ত থেকে নাট্যশিল্পী, চিত্রকর এবং সঙ্গীতজ্ঞগণ এসে ভিড় জমালেন, এবং তাদের নাচে গানে, আলোর রোশনাইতে গোটা রাজ্য জমজমাট হয়ে রইল।
তিনদিন ধরে ক্রমাগত গান শুনে শুনে আর উৎকৃষ্ট ঘি মোদক ও খাবারের গন্ধে রাজপুত্রের মনে বিরক্তি ধরে গেল। এতটুকু নির্জনতার জন্য তাঁর মনের ভেতরটা কাঁদতে লাগল। তাঁর প্রাসাদের সর্বত্র দেবদহ থেকে আগত শত শত সুন্দরী দাসী সহচরীদের ভীড়। কোথাও এতটুকু চিন্তা করার আর একা থাকার জায়গা নেই, উপায়ও নেই। তাঁর নিজের ঘরটিতেও এখন রাজকুমারী যশোধরাই বেশি থাকেন। সেখানে এখন আর সিদ্ধার্থের স্বচ্ছন্দে বিচরণ প্রায় অসম্ভব। সুগন্ধী চন্দন চর্চায় সজ্জিত নববধূ তাঁকে দেখলেই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। চন্দন ও কুমকুম চর্চা এবং সেইসঙ্গে মাথায় ও গলায় ফুলের গয়নায় সজ্জিত হওয়া শাক্যবধূদের একটি জনপ্রিয় ও প্রচলিত সজ্জারীতি। পুষ্প ও চন্দনচর্চা বিলাসী নারী ও পুরুষ উভয়েই করে থাকেন। এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থার শিকার হলেন রাজপুত্র। এত কোলাহলে তাঁর নিজেকে বিপর্যস্ত মনে হতে লাগল। কোথায় গেলে একটু নির্জনতা পাবেন? পাবেন একাকী মনে শান্তির পরশ? ভাবতে ভাবতে এই অসহায় মানসিক অবস্থায় সিদ্ধার্থ বিবাহের তৃতীয়দিনে এক ফাঁকে একাকী কাউকে কিছু না বলে রাজপুরী থেকে একদিন বেরিয়ে গেলেন।
কোথায় যাবেন জানেন না, তবু যেন তাঁকে যেতে হবে। সিদ্ধার্থ সন্মোহিতের মতো তাঁর প্রিয় ঘোড়া কন্থকের পিঠে চড়ে কোন অজানা পথে ছুটে চললেন। বহুদূর পথ পেরিয়ে এক আমের বাগানে এসে ক্লান্ত ঘোড়াটিকে বিশ্রাম দিলেন। সামনে একটি ব্রাহ্মণের আশ্রম। সিদ্ধার্থ আশ্রমের ভেতরে প্রবেশ করলেন। একজন তাঁকে বললেন এটি অনুপ্রিয় বন। এখানে আম ছাড়াও আরও বহু বৃক্ষের বন আছে। গভীর বনের সামনে অংশ কিছুদূর পরিস্কার করে কয়েকটি কূটীর তৈরী করে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আশ্রমের মাটির নিকানো মেঝে এবং সামনে ফল ও ফুলের গাছ। সবে বিকেল হয়েছে। সুন্দর বাতাস বইছে। সামনে একটি টলটলে জলের সরোবর। কন্থক সেই সরোবরে জল খেতে গেল। সিদ্ধার্থ আশ্রমের সামনে একটি পাথরের বেদীতে এসে বসলেন। ঝাঁকে ঝাঁকে বন্য টিয়া তাঁর মাথার উপর থেকে বনের দিকে উড়ে গেল। সিদ্ধার্থ মনোযোগ দিয়ে তাই দেখতে লাগলেন। এমন সময় একজন পরিব্রাজক তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। পরিব্রাজক বয়সে প্রৌঢ়। তাঁর চোখে মুখে গভীর প্রজ্ঞার চিহ্ন। তিনি সিদ্ধার্থকে চিনতে পেরে চমকে উঠলেন।
“একী! রাজপুত্র আপনি? এই অসময়ে একাকী এখানে কেন এসেছেন?”
সিদ্ধার্থ বললেন, “এই আশ্রম বড় সুন্দর। বড় শান্ত। প্রভু আপনি কে?”
“আপনার কি আমাকে মনে পড়বে রাজপুত্র? আমি কৌণ্ডণ্য। আমি আরও আটজন প্রাজ্ঞ ব্রাহ্মণের সঙ্গে আপনার জন্মের সাতদিন পর রাজপুরীতে গিয়ে আপনার ভাগ্য গণনা করেছিলাম। সেই ব্রাহ্মণদের মধ্যে একমাত্র আমিই এখনও জীবিত আছি। আমারও বয়স হয়েছে। জ্যোতিষ চর্চা আমি এখন ছেড়েই দিয়েছি। এখন পরকালের চিন্তা এসে উপস্থিত হয়েছে, তাই এই আশ্রমবাসী হয়েছি। কুমার এতদিন আমি বৃথাই গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে ভবিষ্যত গণনার চেষ্টা করেছিলাম। এখন জানি এই সবই ভ্রান্ত। যিনি সাধনায় পরম শক্তিমান একমাত্র তিনিই জ্যোতিতে স্থির থেকে গণনা সঠিক করতে পারেন। আমরা সেই শক্তি লাভ করিনি। আমাদের কারুর বিচারও সঠিক নয়। ভবিষ্যত জেনেও বা কী হবে? যা হবার তা হবেই। তাকে কেউ প্রতিহত করতে পারবে না। একমাত্র তিনিই চাইলে এমনকী কালের গতিকেও রোধ করতে পারেন।”
“কে সেই সর্বশক্তিমান?”
“যিনি সাধনা করে বোধিজ্ঞান বা পরম জ্ঞান লাভ করেছেন।”
“সাধনায় কেমন করে উন্নতিলাভ করা যায়?”
“এখন তার সময় নয়। আপনি তিনদিন হয়েছে মাত্র সংসারে প্রবেশ করেছেন। এখন সংসারেই মনোনিবেশ করুন। একদিন রাজকুমারীকে নিয়ে এই আশ্রমে অবশ্যই আসবেন।”
“আসব।” সিদ্ধার্থ উজ্জ্বল মুখে হেসে বললেন।
রাজপুত্র দেখলেন তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে রাজপুরী থেকে লোকজন এখানেও চলে এসেছে। তিনি তাদের সঙ্গে বিরস মনে রাজপুরীর দিকে ফিরে চললেন।
এরপর এইভাবে বহু বছর কেটে গেল। সিদ্ধার্থ ধীরে ধীরে সংসারে মনোনিবেশ করলেন। রাজকুমারী যশোধরার সঙ্গে গড়ে উঠল তাঁর চমৎকার সখ্যতা। তবু সংসারে থেকেও যেন কুমার ঠিক আসক্ত হননি। তাঁর মন পদ্মপাতার মতো অকলুষ ও নির্মল। তিনি মাঝে মাঝেই মনমরা হয়ে থাকেন। কেবলই তাঁর মনে হতে থাকে তাঁর যেন কী এক বিরাট কাজ বাকি পড়ে আছে। যেন কী এক গুরুদায়িত্ব এখনও সম্পাদন করা হয়নি। স্বপ্নের মধ্যে, ঘুমের ঘোরে তিনি মাঝে মাঝেই এক অপূর্ব জ্যোতির ছটা দেখতে পান। তাঁর মনে হতে থাকে, তাঁর এক সুস্পষ্ট অতীত আছে এবং একটি অভূতপূর্ব ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য। যার এখন কেবল ছায়াটুকু তিনি দেখতে পাচ্ছেন। এমন করে বিবাহের পর দীর্ঘ তেরো বছর সংসার জীবন কেটে গেল সিদ্ধার্থের।
সংসার যাপনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এখনও মাঝে মাঝে কৌণ্ডণ্যর আশ্রমে যান। যশোধরা তাঁর যোগ্য সহধর্মিনী। তাঁর এই আশ্রমে আসা যাওয়া দেখে যশোধরাও তাঁর অনুবর্তিনী হয়েছেন বহুবার। যশোধরা দরিদ্রদের দান করতে ভালোবাসেন আর তাঁর বড় প্রিয় হল প্রাণীদের ভোজন করানো। সিদ্ধার্থও তাঁকে এই কাজে সাহায্য করেছেন অনেকবার। তাঁরা দুজনে একসঙ্গে বিষ্ণু মন্দিরে দেবার্চনা করেছেন। উপাসকদের বস্ত্রদান করেছেন। যজ্ঞের হোমের উপাচার একত্রে একত্রিত করেছেন। বিকেলের নরম আলোয় সোনার রথে চড়ে তাঁরা কতবার কৌণ্ডণ্যের আশ্রমের অতিথি হয়েছেন। আশ্রমে যশোধরা যখনই আসেন সঙ্গে প্রচুর ফল, মোদক ও সকলের জন্য অন্ন নিয়ে আসেন। সিদ্ধার্থ আশ্রমে এলেই আর প্রাসাদে ফিরতে যেতে চান না। বলেন এক-দুটি রাত তিনি এই আশ্রমেই থেকে যেতে চান। প্রাসাদের ভোগ এবং ঐশ্বর্য্য তাঁর বড় অপ্রিয়। এই নীবিড় অরণ্যের মাঝে সদ্য প্রস্ফুটিত শাল ফুলের ঘ্রাণ, উদার আকাশের বুকে সুমহান হিমালয় পর্বত আর সন্ধ্যার অন্ধকারে আকাশের বুকে ফুটে ওঠা রাশি রাশি উজ্জ্বল নক্ষত্রমালা তাঁর মনকে নিয়ে কোন সুদূরলোকে যাত্রা করে।
সিদ্ধার্থের এই অত্যধিক উপাসক ও আশ্রমপ্রীতি শুদ্ধোদনের একেবারেই পছন্দ নয়, পুত্র বিরক্ত হতে পারে ভেবে তিনি তাঁকে কিছু বলতে পারেন না। হঠাৎ একদিন আশ্রমে এসে সিদ্ধার্থ দেখলেন কৌণ্ডণ্যের আশ্রমটি শূন্য। কৌণ্ডণ্য আশ্রম ছেড়ে নির্জন সাধনার উদ্দেশ্যে কোথায় যেন চলে গেছেন। তা দেখে রাজকুমার সিদ্ধার্থের মন একেবারে ভেঙে গেল। কৌণ্ডণ্য যেন তাঁকে কী এক গভীর সংকেত দিয়ে চলে গেছেন!
তবে কি এবার তাঁরও গৃহত্যাগ করা উচিৎ? কিন্তু তাহলে যশোধরার কি হবে? সে যে এখন সন্তানসম্ভবা! সেকী এই ভয়ানক শোক সহ্য করতে পারবে? তাছাড়া স্ত্রী হিসেবে সে অনন্যা, তাঁর পতিপ্রেমও অতুলনীয়। সিদ্ধার্থ কৌণ্ডণ্যের অন্বেষণ করলেন না। যশোধরার মুখটি স্মরণ করে হঠাৎ দ্রুত প্রাসাদে ফিরে এলেন। এই বিষয়টি নিয়ে তিনি দিবারাত্রি চিন্তা শুরু করলেন। তাঁর মনোভাব তিনি কাউকে প্রকাশ করলেন না। এক্ষেত্রে তাঁকে উপর থেকে দেখলে কেউ চিন্তাও করতে পারবে না, যে তিনি অন্তরে কী গভীর চিন্তা করে চলেছেন। বরং কৌণ্ডণ্য চলে যাওয়ার পরে সিদ্ধার্থকে হঠাৎ যেন এতদিন পরে সংসারে একটু বেশিই আসক্ত হয়েছেন বলে তাঁর পরিজনেরা মনে করলেন।
সন্তানসম্ভবা যশোধরার সঙ্গে বেশ আনন্দে সময় কাটাতে লাগলেন সিদ্ধার্থ। রাজা শুদ্ধোদন এতদিনে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হলেন। মহারানি গৌতমী বললেন, “দেরিতে হলেও গৌতম এখন সংসারমুখি হয়েছে। সন্তানের পিতা হতে চলেছে সে! যতই হোক সন্তানের মায়ায় এতদিনে সে আবদ্ধ হল! যত দোষ ছিল সেই ব্রাহ্মণ কৌণ্ডণ্যের! সে দূর হতেই গৌতম আবার সংসারী হয়েছে। মহারাজ! অবিলম্বে এই রাজ্যের পরিসীমায় পরিব্রাজক এবং সাধু সন্ন্যাসীদের নিষিদ্ধ করে দিন! তাহলেই গৌতমের সম্পর্কে জ্যোতিষীদের ভবিষ্যতবাণী মিথ্যে হয়ে যাবে!”
ক্রমশ
অলঙ্করণঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য