প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব , চতুর্থ পর্ব
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
আগের পর্বের পর
উপতিষ্যর কথা শুনে জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত মন্দিরে, গাছের তলায়, সিদ্ধার্থ দিনের পর দিন একাকী সাধনা করতে লাগলেন। তিনি জৈন তির্থঙ্করদের কাছ থেকেও শুনেছিলেন শারীরিক ভয়ানক কৃচ্ছ সাধন করলে তবেই মোক্ষ লাভ করা যায়। এই কথা শুনে তিনি শারীরিক কৃচ্ছ সাধনও করতে শুরু করলেন। তিনি আজীবক সম্প্রদায়ের উপতিষ্যকেও কৃচ্ছসাধন করতে দেখেছিলেন। এরপর তিনি তাঁর খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিলেন। সারাদিনে প্রথম প্রথম একবার খেতেন তিনি। এরপর তা পর্যন্ত তিনি ত্যাগ করলেন। সারাদিনে সিদ্ধার্থ একটি মটর বা একটি ধান খেয়ে থাকতে লাগলেন।
একদিন গভীর রাতে বনের মধ্যে সেই পরিত্যক্ত ভাঙা বিষ্ণু মন্দিরে তিনি সাধনায় বসলেন। ধ্যান করার প্রথম অবস্থায় তিনি একটি ময়ুরের কর্কশ ডাকে চমকে উঠলেন। তাঁর মনে হল তাঁর সামনে বীভৎস একটি দেহ এসে দাঁড়িয়েছে। তার সারা গায়ে দগদগে ঘা। মাথাটি কাটা। সেই দেহটি মুণ্ডু ছাড়াই তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তীব্র আতঙ্কে চোখ খুলে তাকালেন তিনি। কোথায় কী! নিস্তব্ধ রাত্রি। সমাহিত সুন্দর গভীর বনে কেবল বড় বড় বৃক্ষের বাতাসে মাথা নাড়ার শব্দ। কোথাও কিছু নেই। সিদ্ধার্থ বুঝলেন সবই তাঁর মনের বিভ্রম। নিজের মনের এই দুর্বলতা তাঁকে জয় করতেই হবে। তিনি দৃঢ় চিত্তে আবার ধ্যান শুরু করলেন।
খাওয়া প্রায় ছেড়ে দেওয়ার ফলে সিদ্ধার্থ খুব রোগা হয়ে গেলেন। তাঁর শরীরের হাড়গুলো উঁচু ও প্রকট হয়ে উঠল। তাঁর গায়ের চামড়া কুঁচকে ঝুলে পড়ল। তিনি এই অবস্থায় একদিন মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলেন।
এর আগে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি উৎকট ভোজন করেছেন। সদ্য হওয়া বাছুরের মল ভক্ষণ করেছেন। শুকনো পাতা খেয়েছেন, খেয়েছেন মাটি, তরকারির খোসা এবং উচ্ছিষ্ট। শরীরের প্রতি অবহেলার অঙ্গ হিসেবে দীর্ঘদিন স্নান না করে তাঁর শরীরে ময়লা জমে জট পাকিয়ে গেছে। গভীর বনের ভেতর লোকালয় বর্জিত স্থানে তিনি দিনের পরদিন থেকেছেন। এছাড়া তিনি কিছুদিন উদ্ভট কিছু ক্রিয়াকর্মও করেছেন। যেমন উদক অবতরণ, অর্থাৎ নদীর জলে ক্রমাগত নামা-ওঠা। এরপর উৎকুটিক, অর্থাৎ পায়ের গোড়ালীর উপর ভর রেখে দিবারাত্রি থাকা। এ ছাড়া উদভ্রষ্টিক, অর্থাৎ সারা দিনরাত নিস্পত্র বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা। এইসব অভ্যাসের ফলে তাঁর শরীর ভয়ানক দুর্বল হয়ে গেছে।এখন এক এক সময় তাঁর মনে হয়, তিনি উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। ধ্যানে বসে তিনি অবশ্য এখনও একই রকম প্রশান্তি লাভ করেন। তবে তিনি জানেন এই শান্তি চিরস্থায়ী নয়, ধ্যান শেষে এই শান্তি হারিয়ে যায়।
একজন পরিব্রাজকের কাছ থেকে তিনি নতুন এক পদ্ধতি, শ্বাসের ক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারলেন। সকালে সেদিনও সিদ্ধার্থ বনের ভেতর একটি বিরাট গাছের ছায়ায় বসে ছিলেন। তিনি হঠাৎ দেখলেন, একটি মানুষ। যেন একটি শুকনো বৃক্ষের শাখার মতো সেই মানুষটি! এত ক্ষীণ তাঁর শরীর যে দেখলে মনেই হয় না, সে জীবিত। লোকটির শরীর নিস্পন্দ, অর্থাৎ তাঁর শ্বাস পড়ছে না। সিদ্ধার্থ অবাক বিস্ময়ে মানুষটিকে দেখতে লাগলেন। এমন আশ্চর্য প্রক্রিয়া যে হয়, তা অবশ্য তাঁর অজানা নয়। রুদ্রকও তাঁকে এই পদ্ধতির কথা জানিয়েছিলেন। তবে এইভাবে ধ্যান অভ্যাস তিনি করেননি। কৃত্রিমভাবে শ্বাস বন্ধ করে ধ্যান করাকে তাঁর আরোপিত বলে মনে হয়েছিল, কারণ ধ্যান গভীর হলে স্বাভাবিকভাবেই শ্বাসের গতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হয়ে বন্ধ হয়ে যায় একেবারে। সিদ্ধার্থ লোকটির কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন লোকটির শ্বাস বাইরে আসছে না। সিদ্ধার্থের পায়ের শব্দে লোকটি চোখ খুলে তাকাল। এবার এতক্ষণ পরে তাঁর শ্বাস বাইরে এল। সিদ্ধার্থ বললেন,
”আপনি কে?”
”আমি একজন আজীবক সম্প্রদায়ের পরিব্রাজক। আমার নাম উপমন্যু। এই গ্রামে আমি আজ প্রথম এসেছি। থাকি রাজগৃহের ইসীগলি পর্বতের কন্দরে। এই জায়গাটি বড় শান্ত। মনে হচ্ছে এখানে কেউ নিয়মিত ধ্যান অভ্যাস করে। প্রকৃত সাধন-অভ্যাস ক্ষেত্র সাধারণতঃ এমনই হয়। এবং আমার মনে হয়, আপনিই সেই পুণ্যাত্মা ব্যক্তি।”
লোকটিকে সিদ্ধার্থের বেশ ভালো লাগল। তিনি বললেন,
”আমি যে ধ্যান অভ্যাস করি, তা সম্পূর্ণ মানসিক। এমন শ্বাসের ক্রিয়া আমি আগে অভ্যাস খুব কমই করেছি।”
”এবার আবার অভ্যাস করে দেখুন। একে বলে কুম্ভক। অসম্ভব দ্রুত ফলদায়ী এক পদ্ধতি। এই ক্রিয়ায় জন্ম জন্মান্তরের সব পাপ বিগলিত হয়ে যায়। সেইসবই তো সাধনকালে বিভ্রম আর বিঘ্নরূপে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, অগ্রসর হতে বাধা দেয়। এই পদ্ধতিতে মনোযোগ করাও অনেক সহজ হয়, তাই এর অপর নাম সহজাতক্রিয়া।”
লোকটি এরপর সিদ্ধার্থের সঙ্গে তাঁর সাধন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করল। সিদ্ধার্থ বুঝলেন, এই ক্রিয়াই তিনি অনেক আগে রুদ্রকের আশ্রমে অভ্যাস করেছিলেন। এটি একধরণের শ্বাস ধারণের পদ্ধতি। সিদ্ধার্থও তাঁকে নিজের ধ্যানের পদ্ধতি বললেন। বললেন, কেমনভাবে এখন তিনি আত্মপীড়নের পথ বেছে নিয়েছেন। লোকটি তা শুনে বললেন,
”এবার নিশ্চয়ই আপনি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন।”
লোকটি অন্য পথে চলে যাওয়ার পর সিদ্ধার্থ ঠিক করলেন, উপমন্যুর বলা নতুন এই পথে তিনি কিছুদিন চেষ্টা করে দেখবেন। এই সব পথই তাঁকে অর্থাৎ সেই পরমবোধিজ্ঞানকে পাওয়ার পথ। চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি নেই। অবশেষে সিদ্ধার্থ শুরু করলেন আবার এক নতুন সাধন পদ্ধতি, এবং শুরু হল তাঁর সেই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে পথ চলা।
সিদ্ধার্থ সেনানী গ্রামের কাছাকাছি একটি নির্জন বনে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে এখানে কিছুদিন একাকী থেকে সাধন অভ্যাস করতে হবে। একটি বিশাল বটবৃক্ষের নিচে তিনি এসে আশ্রয় নিলেন। গাছটি বহু পুরনো, গাছের অসংখ্য ঝুড়ি নেমেছে চারদিকে। সেখানে বটবৃক্ষের সারিবদ্ধ স্তম্ভমূলের সাহায্যে দিব্যি একটা নিভৃত কোণ রচনা হয়েছে। দিনের তাপের আঁচটুকুও সেখানে বসলে পাওয়া যায় না। সিদ্ধার্থ সেখানে সারাদিন ধরে ধ্যান করার এই নতুন পদ্ধতিটির অভ্যাস করতে লাগলেন।
শ্বাসরুদ্ধ করে তিনি দাঁতে দাঁত চেপে জিভটিকে তালুমূলে স্থাপন করলেন, এবং মনোসংযোগের চেষ্টা করতে লাগলেন। এতে তাঁর প্রবল শারীরিক ক্লেশ হল এবং তিনি ঘর্মাক্ত কলেবরে বিপর্যস্ত হলেন। পরদিন তিনি নাক ও মুখ দৃঢ়ভাবে বন্ধ করে শ্বাসবন্ধ রেখে ধ্যান করার চেষ্টা করতে লাগলেন, এর ফলে তাঁর কানের ভেতর দিয়ে প্রবল বেগে বাতাস বের হতে লাগল, এবং একধরণের বায়ু চলাচলের ভয়ানক প্রবল শব্দ তিনি শুনতে পেলেন, এতে তাঁর ধ্যান বাধাপ্রাপ্ত হল, মনোযোগ ব্যাহত হল। এরপরে সিদ্ধার্থ নাক, মুখ ও কান বন্ধ রেখে শ্বাস ধরে রাখার চেষ্টা করতে লাগলেন। ফলে বায়ু বাধা পেয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করতে লাগল। তিনি মাথায় অসহ্য ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তাঁর মনে হল, তাঁর মাথাটিকে কেউ যেন কঠিন চামড়ার বন্ধনী দিয়ে বেঁধে রেখেছে। সেই যন্ত্রণা সিদ্ধার্থ সহ্য করে নিলেন। তিনি শ্বাসরুদ্ধ করে সেই অবস্থায় ধ্যান করতে শুরু করলেন এবং পেটে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলেন। তাঁর মনে হল যেন এক নৃশংস কসাই তাঁর পেটটি কেটে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। এরপরেও শ্বাস বন্ধ রেখে ধ্যান করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন সিদ্ধার্থ, কিন্তু প্রচণ্ড শারীরিক ক্লেশ পেলেও এতটুকু মানসিক প্রশান্তিলাভ তাঁর হল না। তাঁর শরীরে তীব্র জ্বালার মতে একধরণের অনুভূতি হল।
এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। এর আগে থেকেই খাদ্যগ্রহন প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন সিদ্ধার্থ। তাঁর শরীরে এই শ্বাসরোধের ফলে এমন জ্বালাপোড়ার অনুভূতি হল যে তাঁর মনে হল কোনও শক্তিশালী ব্যক্তি তাঁকে জোর করে কোনো জ্বলন্ত অঙ্গারের কুণ্ডের ভেতর ঠেলে ফেলে দিয়েছে। সিদ্ধার্থ তবুও তাঁর চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। একদিন তিনি ধ্যান থেকে ওঠার সময় প্রচণ্ড দুর্বলতার কারণে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। সিদ্ধার্থকে সেদিনই সকালে দেখতে এসেছিলেন তাঁর সঙ্গীরা। তাঁর এই অবস্থা দেখে তাঁরা ভয়ে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। প্রথমে তাঁরা ভাবলেন সিদ্ধার্থর শরীরে বোধহয় প্রাণ নেই। সাধনায় তাঁর সিদ্ধিলাভ করা আর হল না। সকলে তাঁর দিকে তাকিয়ে হতাশায় মাথা নাড়তে লাগলেন।
ঠিক সেইসময় কপিলাবস্তু থেকে শুদ্ধোদনের বিশ্বস্ত অনুচর কালুদায়ী কয়েকজন পরিচারকদের সঙ্গে নিয়ে সেই বনে এসে উপস্থিত হলেন। কলুদায়ীকে মহারাজ শুদ্ধোদন বিশেষ অনুরোধ করে সিদ্ধার্থের খোঁজ করতে পাঠিয়েছেন। বহুদেশ ঘুরে, বহু খোঁজ খবর করার পর তিনি রাজকুমারের খোঁজ পেয়েছেন, সেনানী গ্রামে এসে। রাজকুমারের রূপের বর্ণনা করে সকলকে তিনি তাঁর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগিয়ে চলছিলেন। সেনানী গ্রামে এসে রাজকুমারের খোঁজ করে যখন তিনি বলেন,
”একজন সাধন অভিলাষী রাজপুত্র এখানে কি আগে এসেছেন? যার গায়ের রং কাচা সোনার মতো, এবং যার চোখদুটি পদ্মের মতো বিশাল ও গভীর?”
তখন গ্রামের সকলে তাঁকে জানায়
”ঠিক তেমন একজন এই গ্রামে এসেছেন, তিনি ভগবৎ সাধনা করেন, তার গায়ের রং এখন আর গৌর নয়, বরং তা কিছুটা শ্যামবর্ণই বলা যায়। এবং তাঁর শরীরে এখন কেবল কয়েকটা হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তিনি তীব্র তপস্যার ক্লেশকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছেন। তিনি এখন ভিক্ষান্নও গ্রহন করেন না, নিজেও কিছুই প্রায় খান না। কেবল কখনও কচ্চিত গাছ থেকে ঝরে পড়া ফল গ্রহন করতে তাঁকে অনেকে দেখেছে। এখন কিছুদিন হয়েছে তিনি গভীর বনের ভেতর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে চলে গেছেন। তবে হ্যাঁ, প্রথমদিকে তাঁর গায়ের রং সত্যিই গলিত স্বর্ণের মতোই উজ্জ্বল ও শোভনীয় ছিল।”
কলুদায়ী ব্যগ্র স্বরে বললেন,
”আমাকে বনের দিকের রাস্তাটি দয়া করে বলে দিন। আমি রাজপুত্রের সাক্ষাতপ্রার্থী। বহুদূর দেশ কপিলাবস্তু থেকে আমি এসেছি, কপিলাবস্তুর রাজার নির্দেশে। রাজকুমার আমাদের মহারাজের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পুত্রশোকে তিনি বড়ই কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। আমি এখনই রাজকুমারের কাছে যেতে চাই।”
কয়েকজন গ্রামবাসী কালুদায়ীকে পথ দেখিয়ে সিদ্ধার্থের কাছে নিয়ে গেলেন। বনের ভেতর একটি বটগাছের তলায় কলুদায়ী সিদ্ধার্থকে মৃতবৎ পড়ে থাকতে দেখতে পেলেন। তিনি প্রথমে রাজপুত্রকে দেখে চিনতে পারলেন না। তারপর সিদ্ধার্থের চেহারা দেখে তাঁর দু চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। কলুদায়ী রাজবাড়ির দাসীপুত্র। শুদ্ধোদন তাঁর পিতা। সিদ্ধার্থ তাঁর ভাই। কলুদায়ীকে সিদ্ধার্থ সর্বদা বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতেন, দাসীপুত্র বলে কখনও তাঁকে অপমান করেননি। জন্ম থেকেই কলুদায়ীর কথা বলার সময় বাক্যগুলি জড়িয়ে যায়, এবং তাঁর কথা বলার সময় মুখ থেকে লালা ঝরে পড়ে। এই জন্য অন্যান্য শাক্য কুমারেরা তাঁকে নিয়ে উপহাস করলেও সিদ্ধার্থ কখনও তাঁকে উপহাস করেননি। শাক্যকুমারেরা লালা পড়ার জন্য তাঁর নাম রেখেছিলেন লালুদায়ী। সিদ্ধার্থ কখনও তাঁকে এমন নামে ডাকেননি।
কালুদায়ী আর সহ্য করতে পারলেন না। ছুটে গিয়ে সিদ্ধার্থের মাথাটি তাঁর কোলের উপর নিলেন। আগত ভিক্ষুরা জল এনে সিদ্ধার্থের চোখে মুখে দিতে লাগলেন, কেউ কেউ বাতাস করতে লাগলেন। এক সময় সিদ্ধার্থ চোখ মেলে তাকালেন। এত কষ্টেও তাঁর চেহারায় এক আশ্চর্য অলৌকিক দীপ্তি। কলুদায়ীর সঙ্গী অনুচরেরা দুধ এনে রাজপুত্রকে খাইয়ে দিল। রাজপুত্র ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। স্বাভাবিক স্বরে কালুদায়ীর প্রতি কুশল সম্ভাষন করলেন। সকলের খোঁজ খবরও নিলেন। কালুদায়ী যশোধরার কথা বললেন। জানালেন কত ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্যে রাজকুমারী এখন দিন কাটচ্ছেন। যশোধরার প্রসঙ্গে সিদ্ধার্থ একটি কথাও বললেন না। রাজকুমারীর প্রসঙ্গ আসতেই তিনি আশ্চর্যভাবে নীরব হয়ে গেলেন। তবে কলুদায়ীর মনে হল, সিদ্ধার্থ মনের গভীরে ব্যথিত হয়েছেন, কিন্তু সেকথা তিনি প্রকাশ করতে চাইছেন না। কলুদায়ী অনুরোধ করলেন, সিদ্ধার্থকে দিনান্তে সামান্য কিছু খাদ্য গ্রহন করতে, যাতে অন্ততঃ তাঁর শরীর রক্ষা হয়।
পর্ব ৬
মায়াদেবীর দর্শনলাভ
১
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সিদ্ধার্থ নৈরঞ্জনা নদীর তীরে একটি চেটালো পাথরের উপর শুয়ে আছেন। বিকেলের এই মুহূর্তটি তাঁর বড় প্রিয়। নদীর কোল ঘেষে দলে দলে পাখিরা বাসায় ফিরছে। আকাশের রঙ লাল। যেন সমস্ত আকাশের বুকে মুঠো মুঠো আবির ছড়িয়ে আছে। সিদ্ধার্থর মনে অজস্র চিন্তাস্রোত। প্রায় ছয় বছর ধরে তিনি সাধন অভ্যাস করে যাচ্ছেন। তবুও যে নিরবিচ্ছিন্ন পরাশান্তির অন্বেষণ তিনি করছেন, তা এখনও তাঁর আয়ত্বে আসেনি। বিভিন্নভাবে তিনি ধ্যান করে দেখেছেন, যতক্ষণ ধ্যানে মগ্ন থাকেন, ততক্ষণই শান্তভাব বজায় থাকে, ধ্যান ভঙ্গের পর আবার শারীরিক ও মানসিক উপসর্গগুলি একইভাবে বর্তমান থাকছে।
যুগ যুগ ধরে মানুষ যে জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর আবর্তনে ঘুরছে তার থেকে মুক্তির উপায় কি তবে এইভাবে পাওয়া সম্ভব নয়? তাহলে কি দৈহিক ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে পরমজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়? উপায় তবে কি? কোনটি সঠিক পথ? নিজের সাংসারিক কর্তব্য পালন না করে, পরিবারের সকলকে দুঃখ দিয়ে এত ত্যাগ স্বীকার করেও তো কিছুই লাভ হল না? নিজের অস্থি সর্বস্ব শরীরে হাত বুলিয়ে বিস্মিত হলেন সিদ্ধার্থ। কবে তিনি এমন অস্থি সর্বস্ব হয়ে গেলেন? পিঠের হাড়গুলি এমন প্রকট হয়ে গেছে যে, পিঠে হাত দিলে হাত পেটে এসে ঠেকছে। দুর্বলতা ও অপুষ্টির জন্য মাথার চুলে হাত দিলেও তা পচা ঘাসের মতো হাতে উঠে আসছে। সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করলেন, তাঁর স্বাস্থ্যও শারীরিক সক্ষমতাও কবে যেন হারিয়ে গেছে। এই দুর্বল শরীর নিয়ে পথ চলার শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই তাঁর। সহায়ক ভিক্ষুরা না থাকলে তিনি হয়ত এতক্ষণে মৃত্যুমুখে পতিত হতেন। তাঁরা তাঁকে অনেক প্রকারে সাহায্য করছে। আজ দুপুরে যবাগু সংগ্রহ করে এনে দিয়েছেন সকলে। জল পরিষ্কারক এক প্রকার স্ফটিক সদৃশ্য পাথর এনে তাঁর জলপানের পাত্রে রেখে পানীয় জলকে পরিশ্রুত পর্যন্ত করে দিয়েছেন। এই স্ফটিক পাথরকে গ্রামের মানুষেরা বলেন মণি। তাঁরা অসুস্থ রুগীর জল এই স্ফটিক দিয়ে পরিষ্কার করার পর ব্যবহার করতে দেন। সিদ্ধার্থ ক্রমশঃ উপলব্ধি করলেন, এভাবে কিছুতেই বোধিজ্ঞান লাভ করা যাবে না। তাঁর মনে নেমে এল অন্ধকার। কীভাবে এগোবেন যেন সহসা দিশা পেলেন না। তিনি অবসন্ন দেহ ও মনে নদীর ধারের সেই পাথরটির উপর শুয়ে রইলেন। তাঁর মনে যশোধরার চিন্তা। গৃহত্যাগ তবে কি সফল হবে না? মনে মনে তিনি বললেন,
”রাজকুমারী আমাকে ক্ষমা কোরো। আমি পরাজিত হতে চলেছি। তবে তোমাকে আমার এই পরাজিত মুখটি ফিরে গিয়ে আর দেখাবো না। যদি সফল না হই সাধনা করতে করতেই এই প্রাণ আমি বিসর্জন দেব।”
ধীরে ধীরে রাত নেমে এল। অন্ধকার হতেই আকাশে আবির্ভূত হল, সোনালি থালার মতো চাঁদ। আকাশ থেকে যেন সোনালি ঝর্ণার মতো জ্যোৎস্না নেমে এল। নির্জন নদী বক্ষে কেবল নৈরঞ্জনার জল কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে। দূরে নদীর অপর পাড়ের বালুকণাগুলি চাঁদের আলোয় যেন সোনার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দুর্বলদেহী সিদ্ধার্থ একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি আধা জাগরণে দেখলেন একটুদূরে বসে আছেন এক অপরূপ সুন্দরী নারী। কী অনুপম রূপলাবণ্য তাঁর চোখে মুখে। তাকিয়ে থাকলে এক অনির্বচনীয় দিব্য শ্রদ্ধারভাব অন্তরে জেগে ওঠে। এমনই তাঁর মায়াভরা দুচোখের ভাষা! সহসা সিদ্ধার্থর মুখ থেকে কোনো স্বর বের হল না। মনে মনে তিনি এই অপরূপা মাতৃমূর্তিকে প্রণাম জানালেন। কিন্তু সেই নারী আকূল শোকে মাটিতে মাথা লুটিয়ে কেবল কাঁদতে লাগলেন। কী ভয়ানক হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য! কে এই মমতাময়ী নারী? আর কেনই বা তিনি এমন করে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কাঁদছেন? সিদ্ধার্থ বললেন,
”মাতা আপনি কে? এই মধ্যরাত্রে একাকী এমন করে কাঁদছেনও বা কেন? আপনার কীসের দুঃখ আমাকে বলুন!”
”পুত্র আমি যে তোমার মাতা! দশমাস আমার গর্ভে বাস করার পর হীরের টুকরোর মতো উজ্জ্বল আমার পুত্র হয়ে তুমি জন্মেছিলে। আজ তুমি শ্রীহীন! শক্তিহীন! একাকী মৃতবৎ উদ্যমহীন অবস্থায় পড়ে আছ! আমি তাই তোমার শোকেই এখানে কাঁদছি পুত্র! এখন কে তোমাকে তোমার আগেকার বলিষ্ঠ ও সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দেবে?
পুত্র! লুম্বিনী উদ্যানে জন্মের পরই তুমি সিংহের মতো বিরাট শৌর্যে সপ্তপদ হেঁটেছিলে। দিক দিগন্ত আলোকিত হয়ে উঠেছিল, তোমার আবির্ভাবে। তুমি জন্মলগ্নেই ঘোষণা করেছিলে, এটাই তোমার অন্তিম জন্ম। পুত্র তোমার সেই ঘোষণা আজও পূর্ণ হয়নি! অসিতদেবলের ভবিষ্যতবাণী ছিল যে, তুমি এই জীবনে বুদ্ধত্বলাভ করবে, তা-ও যে ব্যর্থ হতে চলেছে! জন্ম- মৃত্যুর চিরকাল হতে বয়ে চলা রহস্য তুমি এখনও ভেদ করতে পারোনি। পারোনি বোধিজ্ঞান লাভ করতে। অথচ সারা জীবন তুমি মিথ্যেই অসহ্য কষ্ট সহ্য করে গেলে পুত্র! না পারলে মহারাজাধিরাজ হয়ে ঐশ্বর্য্য ভোগ করতে! না পেলে সম্রাটের যশ! না পেলে স্ত্রী ও পুত্র সুখ। জীবনের মধুরকাল তোমার এই লোকালয় বর্জিত এই অন্ধকার বনেই কেটে গেল! তাই আমি আজ এখানে বসে বসে তোমার দুঃখে কাঁদছি পুত্র! আমার এই শোক কেউ নেই যে নিবারণ করবে?”
মায়াদেবীর কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ সিদ্ধার্থের ভেতর ঘটে গেল রূপান্তর। তিনি উঠে বসলেন। তাঁর ঘুমের ভাব সম্পূর্ণ কেটে গেল। তিনি জাগ্রত অবস্থায়ই মায়াদেবীকে দেখতে পেলেন। তবে সেই মূর্তি বড় স্বল্প স্থায়ী। ধীরে ধীরে মোমের মতো সেই সূক্ষ্ম ও অপরূপ মূর্তি যেন তাঁর সামনে থেকে অন্তর্হিত হল। সিদ্ধার্থ য়ায়াদেবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
”মাতা আপনি শোক করবেন না। আপনার পুত্র বুদ্ধত্ব লাভ করবেই। আপনার আমার জন্য জীবন দান আমি ব্যর্থ হতে দেব না। আমি অসিত দেবলের ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবায়িত করবোই। মনে রাখবেন মাতা! আজকের পর যদি পৃথিবী শত শত টুকরোও হয়ে যায়, সুমেরু পর্বতের চূড়া মণিসহ যদি জলে ভাসে এবং সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জ যদি মাটিতে পতিত হয়, তবুও আমি সফল না হয়ে মৃত্যুবরণ করবো না। এখনই আপনার কান্না থামান মাতা! অচিরেই আপনি আমার বোধিজ্ঞান লাভ দেখতে পাবেন।”
এ কথা শুনে মায়াদেবী আবার সিদ্ধার্থকে দর্শন দিয়ে বহু আশীর্বাদ করলেন। দিব্য সুগন্ধে বাতাস ভরে উঠল, মায়াদেবী সিদ্ধার্থকে সাধনায় উদ্বুদ্ধ করে আবার স্বর্গলোকের পথে যাত্রা করলেন। সমস্ত বনভূমি জুড়ে এক অপরূপ দিব্য সঙ্গীত ধ্বনিত হতে লাগল। আকাশের জ্যোৎস্নামাখা যে পথে মায়াদেবী আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেই পথেই আবার অন্তর্ধান করলেন। সিদ্ধার্থ দেখলেন অন্ধকারে কেটে যাচ্ছে, পুব আকাশে শুকতারা উদিত হচ্ছে। তিনি নদীতে নেমে স্নান সেরে নিলেন। আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হবে তাঁকে। আজ থেকে তিনি ঠিক করলেন, আবার ভিক্ষান্ন গ্রহন করবেন এবং শক্ত আহারও শুরু করবেন। দুর্বল শরীরে সাধনা করা যায় না। দুর্জয় সাধনার জন্য শরীরে বল থাকা একান্ত আবশ্যক। তা নিজের জীবন দিয়ে এখন উপলব্ধি করেছেন তিনি। সামনে আবার সুদীর্ঘ কঠিন পথ। তবে সিদ্ধার্থ কোনওভাবেই আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হবেন না।
সকাল হতেই সিদ্ধার্থ গ্রামে গিয়ে ভিক্ষা শুরু করলেন। নানা রকম পুষ্টিকর জীবন ধারণের উপযোগী খাদ্য আবার খেতে শুরু করলেন। সিদ্ধার্থকে ভিক্ষা করতে দেখে গ্রামবাসীরা বড় খুশি হলেন। ফিরে যাওয়ার কালুদায়ী সময় বারবার গ্রামের সম্পন্ন কৃষক গৃহপতিদের সিদ্ধার্থর স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে অনুরোধ করে গেছেন। কালুদায়ী কিছু পরিবারে বেশ কিছু রত্নালঙ্কারও দান করে গেছেন, যাতে তাঁরা সকলে সিদ্ধার্থের খবর নেয় এবং তাঁকে উচ্চমানের ভিক্ষান্ন দান করে।
এই গ্রামের গ্রামপ্রধানের নাম সেনানী। তিনি একসময় মগধরাজের সৈন্যদলের সেনা ছিলেন। সেই থেকে গ্রামের নামও হয়েছে সেনানী। কালুদায়ী তাকেই সিদ্ধার্থর দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন। কালুদায়ীর দান নিতে সেনানী অস্বীকার করেছেন। তিনি বিশেষ সম্পন্ন এবং ধনী গৃহস্থ। তাঁর সংসারে কোনো অভাব নেই। তাঁর গোয়ালে বহু দুগ্ধবতী গাভী আছে, ঘরে দাসদাসীরও অভাব নেই। গোলা ভরা ফসল আছে। একটিই চিন্তা তার মনে, আর তা হল একমাত্র মেয়ে সুজাতার বিবাহ যেন উপযুক্ত ঘরে দিতে পারেন তিনি। সুজাতাও বড় ধার্মিক প্রকৃতির। সাধু ও পরিব্রাজকদের সর্বদা দান করে সে। তাই একজন সাধক এবং সন্ন্যাসীকে ভিক্ষান্ন দিতে হবে বলে তিনি অগ্রিম দান নেন কী করে!
সিদ্ধার্থ ভিক্ষায় বের হয়েছেন খবর পেয়ে, সেনানী তাঁকে সমাদর করে তাঁর গৃহে নিয়ে গেলেন। নতুন মাটির পাত্রে অন্ন ব্যঞ্জন রান্না করা হল, কেবল সিদ্ধার্থের জন্য। শালিত ধানের তণ্ডুল, এবং উত্তম ঘি মিশ্রিত সুস্বাদু তরকারি তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পরিবেশন করালেন। কন্যা সুজাতা পরিবেশন করল। শেষ পাতে সুজাতা এনে দিল ঘরে বানানো ঘিয়ের মোদক ও মধু মিশ্রিত পায়স। সিদ্ধার্থ তৃপ্তি সহকারে সে সমস্ত অন্ন, পায়স ও মিষ্টান্ন খেলেন। সুজাতা মাটিতে মাথা রেখে তাঁকে প্রণাম জানাল। সিদ্ধার্থ স্মিত হেসে আশীর্বাদ করলেন,
”সুখি হও কল্যাণী। তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হোক।”
সুজাতা মনে মনে উপযুক্ত বর ও অনুকুল শ্বশুরালয় কামনা করেছিল। সে এ কথা শুনে লজ্জা পেয়ে স্মিত হাসিতে হেসে উঠল।
সিদ্ধার্থ একজন গৃহীর বাড়িতে ভিক্ষান্ন গ্রহন করেছেন এবং আগামীকালও সেখানে আসবেন বলে এসেছেন, একথা জানতে পারলেন তাঁর সঙ্গী ভিক্ষুরা। তাঁরা তখনও অরণ্য থেকে ফল এবং কন্দ সংগ্রহ করেই খান। কোনও গৃহীর ভিক্ষা গ্রহন করেন না। কৌণ্ডণ্য সিদ্ধার্থের গৃহীদের ভিক্ষা গ্রহন করায় অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। সিদ্ধার্থকে দেখতে পেয়ে তিনি বললেন,
”গৌতম তুমি নাকি আজ সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির উৎকৃষ্ট অন্ন গ্রহন করেছো? এ কথা কি সত্যি?”
”এ কথা সত্যি, মিত্র। আমি এখন থেকে ঠিক করেছি একবেলা ভিক্ষান্ন গ্রহন করবো। নইলে আগের মতো শরীরে জোর ফিরে পাব না। এমনকী রাত্রে পথ্য হিসেবে দুধও গ্রহন করবো। আমার মত হল, শারীরিক কৃচ্ছ সাধন করে অভীষ্ট লাভ করা যায় না। সাধনায় মনোনিবেশ করাই হল প্রকৃত প্রয়োজন। পেটে খিদে থাকলে বরং ধ্যানে মন বসতে বিলম্ব হবে। আপনারাও এখন থেকে ভিক্ষা করে সামান্য অন্ন গ্রহন করুন, তাতে সকলের শরীর সবল ও নীরোগ থাকবে।”
”না কুমার গৌতম! আপনি রাজপুত্র। আপনার কথা আমাদের থেকে ভিন্ন। তীব্র কৃচ্ছ সাধন আপনার শরীর নিতে না পারলেও, আমাদের মতো সাধারণ ব্রাহ্মণ অবশ্যই তা সহ্য করতে পারবে। আমরা আমাদের কৃচ্ছ সাধন চালিয়ে যাব, যতদিন আমাদের শরীরে প্রাণ আছে। তাছাড়া আমরা অনাহারে থাকি না। সকলে ফলাহার করি। এখানকার জঙ্গলে সব ঋতুতেই ফলের অভাব নেই। এমনকী শীতেও আমলকী না হলে হরীতকী মেলে। কিছু না পেলে তেঁতুল পাতার তো অভাব হয় না কখনও। আপনি এখন দুর্বল। ভিক্ষান্ন গ্রহন করবেন ভেবেছেন, তা একদিকে হয়ত আপনার জন্য মঙ্গলজনক।”
”ঠিক। এটিই মঙ্গলজনক। তবে কেবল আমার জন্য নয়, আপনাদের সকলের জন্য।”
কথা তখনকার মতো চাপা পড়ে গেল। সিদ্ধার্থ সন্ধ্যার পরে ধ্যানে মনোনিবেশ করলেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধ আলোচনা শুরু হল ভিক্ষুদের অন্দরে। পাঁচজন ভিক্ষুই এরপর থেকে সিদ্ধার্থকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন। এইভাবে প্রায় তিনমাস কেটে গেল।
অশ্বজিত ও বপ্প একদিন বলতে লাগলেন,
”দেখেছেন সকলে, সিদ্ধার্থ তাঁর হারানো গায়ের রঙ আবার ফিরে পেয়েছেন! তাঁর শরীরের বর্ণ আবার কাঁচা সোনার মতো লাগছে! তাঁর মাথায় কুঞ্চিত চুলগুলি কেমন ঘনসংবদ্ধ হয়ে গেছে তাই না!”
বাকি ভিক্ষুরা বললেন,
”আরে হবে নাই বা কেন! দু-বেলা ফল, দুধ, যবাগু পুষ্টিকর সবকিছুই তো সেনানী পরিবার তাঁকে যুগিয়ে চলেছে। একমাত্র কন্যা সুজাতার শুনেছি খুব ধনী গৃহে বিবাহ হয়েছে। সেনানী সেই আনন্দে সিদ্ধার্থকে প্রাণভরে ঘি আর ননী খাইয়ে চলেছেন।” সকলেই সেই কথায় সায় দিল। কৌণ্ডণ্য আরও একধাপ এগিয়ে বললেন,
”এরপর রাজপুত্র গৌতম হয়তো তাঁর পূর্বাশ্রমে ফিরেও যেতে পারেন! তাঁর গায়ের রঙ দেখে ভোগী সংসারী লোকের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এখন কে নির্ধারণ করবে? তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন জ্যোতি ঠিকরে বের হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে তিনি খেয়ালের বশে এতদিন ধর্মাচরণ করছিলেন। এখন ধীরে ধীরে তাঁর মোহভঙ্গ হয়েছে। এবার তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের কাছেই হয়ত ফিরে যাবেন। আমাদের সকলের উচিৎ এই মুহূর্ত থেকে সিদ্ধার্থকে বর্জন করে চলা। তাঁর সঙ্গ আমাদের সকলের কাছে বিষবৎ। আমি তাঁকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাব মনস্থির করে ফেলেছি। আপনারা সকলে আমার কথায় রাজি থাকলে চলুন। না থাকলে যারা যেতে চান আমার সঙ্গে চলুন। আমি বারাণসীর নিকটে ঋষিপত্তনের মৃগদাব বনে নির্জনে কঠোর সাধনা করতে চলে যেতে চাই।”
কৌণ্ডণ্যর কথা শুনে সকলেই তাঁকে সমর্থন করলেন। সকলেই তাঁদের সিদ্ধান্ত সিদ্ধার্থের কাছ থেকে গোপন করলেন। সিদ্ধার্থ ভিক্ষায় বের হলে তাঁরা সকলে একত্রে সেই গ্রাম ছেড়ে মৃগদাবের পথে বেরিয়ে পড়লেন।
সারাদিন পরে যে স্থানে সকলে রাত্রিবাস ও ধ্যানাভ্যাস করতেন, সেখানে ফিরে এলেন সিদ্ধার্থ। এক সুবিশাল ন্যগ্রোধ বৃক্ষের তলায় তাঁরা সকলে রাত্রিবাস করতেন। তৃণসজ্জায় অর্ধ্বরাত থেকে তাঁরা শুরু করে দিতেন ধ্যান। সেই বৃক্ষের তলা আজ শূন্য। সিদ্ধার্থ দেখলেন, সেখানে কেউ নেই। ভিক্ষুদের কারুর স্নানবস্ত্রও বৃক্ষশাখায় নেই, শয্যা রচনার তৃণের বোঝাটি পর্যন্ত কোথাও নেই। একত্রে কোথায় গেলেন সকলে? কেন চলে গেছেন? সিদ্ধার্থ শান্ত হয়ে ভাবতে বসলেন। তিনি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুধাবন করলেন। অনেকদিন ধরেই পাঁচজন ভিক্ষুই তাঁর সঙ্গে বিশেষ একটা বাক্যালাপ করছিলেন না। সিদ্ধার্থ বুঝলেন, তাঁরা সকলে তাঁর প্রতি বিরূপ হয়েছেন। একাকী হয়ে গেলেন সিদ্ধার্থ। বড় কঠিন সময় উপস্থিত হল। তিনি কিছুক্ষণের জন্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারপর নিজেই নিজেকে বলতে লাগলেন,
”আমার সঙ্গীরা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁরা সকলে আমাকে পথভ্রষ্ট ভেবেছেন। এতে আমার দুঃখিত হওয়ার কী আছে? এই বিরাট মহাবিশ্বে কে কার সঙ্গী! প্রত্যেকেই ভীষণ একা। প্রত্যেক জীবের বন্ধু কেবল একজন, তিনি পরমাত্মা, এবং তিনিই সকলের সবসময়ের প্রকৃত সঙ্গী।”
সিদ্ধার্থ নিজের একাকীত্ব এবং মনোবেদনা ভুলতে গভীর ধ্যানে ডুবে গেলেন। সমস্ত রাত তিনি ধ্যানে রত থাকলেন। তাঁর মন থেকে সব বিষাদ দূর হয়ে গেল। জেগে উঠল অনাবিল পরাশান্তি।
সিদ্ধার্থ ভেঙে পড়লেন না। শক্ত খাদ্য খেয়ে তাঁর শরীরে তিনি আবার জোর ফিরে পেয়েছেন। সিদ্ধার্থের শরীরে বত্রিশটি মহাপুরুষের লক্ষণ আবার পরিস্ফুট হয়েছে। এখন থেকে সারাদিনে একবার তিনি শক্ত খাবার খেয়ে থাকেন। দিনের বেশিরভাগ সময়টাতে তিনি এখন ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন। সেনানী পরিবারের দাসী পুণ্যা এসে মাঝে মাঝে তাঁর জন্য যবাগু এনে নগ্রোধমূলে রেখে চলে যায়। ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় সে খাদ্য বেশিরভাগ সময় বিড়াল বা কাকের খাদ্য হয়। সিদ্ধার্থের মন সাধনায় নিবিষ্ট থাকায় কোনো কিছুতেই তাঁর ভ্রূক্ষেপ থাকে না।
২
সুজাতার পায়সদান
উরুবেলা গ্রাম প্রধানের মেয়ে সুজাতা সিদ্ধার্থকে মাঝে মাঝে ভিক্ষা দিয়ে যায়। কিছুদিন পরে মেয়েটির এক ধনী শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। দেখতে দেখতে বছর পার হয়ে গেল। সুজাতার বিয়ের পরে একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। সে ছেলে কোলে পিতৃগৃহে এসেছে। সে যা চেয়েছিল, তা পেয়েছে। যোগ্য স্বামী এবং উপযুক্ত ঘর। তাঁর শ্বশুরবাড়িও মনমতো হয়েছে। এখন ধন সম্পদের অভাব নেই তার। সুজাতা তাদের বাড়ির দাসী পুণ্যাকে বলল,
”পুণ্যা! সেই গৌতম মুণিকে দেখেছিস! তিনি কি এখনও এই গ্রামেই আছেন?”
”বলতে পারবো না দেবী! তাঁকে বেশি দেখা যায় না এখন। তিনি গভীর বনে নাহলে শ্মশানে চলে যান। কখনও গরুর পাল আনতে গিয়ে তাঁকে মাঝে মধ্যে নদীর ধারেও দেখেছি। বনে যাওয়ার পথের ধারে এক বিরাট অশ্বত্থগাছের তলায় আগে তাঁর ঠিকানা ছিল। সারাদিন শুনেছি সেখানেই ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকতেন। তবে এখন আবার বেশ কয়েকদিন ধরে তাঁকে দেখতে পাইনি। কী জানি তিনি এখনও এই গ্রামেই আছেন কিনা! তিনি বড় পুণ্যাত্মা। তাঁর শরীর থেকে আলো বের হয় দেবী! সত্যি বলছি! আমি দেখেছি।” আমার বাবা বলেন ও হল সাধন-জ্যোতি। কথা বলতে বলতে উদ্দীপনায় পুণ্যার চোখে জল এসে গেল। সে মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল ভগবান গৌতম মুণির উদ্দেশ্যে। সুজাতা বলল,
”তাঁকে যদি একবার দেখতে পেতাম, আমি তাঁকে পায়স বানিয়ে খাওয়াতাম। বিয়ের আগে তাঁকে একদিন পায়স রেঁধে খাইয়েছিলাম। তিনি তখন বড় প্রীত হয়ে তা গ্রহন করেছিলেন। আমার খুব সাধ জেগেছে মনে। তুই যদি কখনও তাঁকে দেখতে পাস, সবার আগে এসে আমাকে খবর দিবি। আমি এই কয়েকদিন গরুদের খুব সেবা করবো, যাতে তারা মহাপুরুষের সেবার জন্য উত্তম দুধ দান করে। বাছুরগুলোকে এখন থেকে আর নিষ্ঠুরভাবে ওদের মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিস না। ওদের পেট ভরার পর যা দুধ পাওয়া যাবে, সেটুকুই কেবল নিবি। তাহলে মহাপুরুষ গৌতম আমার দান গ্রহন করবেন।”
সুজাতা এই কয়েকদিন ধরে তার বেছে নেওয়া আটটি গাভীকে প্রাণপণে যত্ন করতে লাগল। তাদের দেওয়া হল, নদীর ধার থেকে বাছাই করে আনা সবুজ আর কচি ঘাস এবং অন্য আটটি গরুর দুধ। গাভীগুলোকে নদীতে স্নান করিয়ে মধু চাল হলুদ ও সিঁদূর দিয়ে মঙ্গল তিলক এঁকে দেওয়া হল।
রাত গভীর হয়েছে। শ্মশানে একটা চিতা জ্বলছে। চিতার আগুনের আলোয় দেখা যাচ্ছে নদীর ধারে একটা চেটালো পাথরের উপর বসে আছেন এক শ্রমণ। প্রায় দিন পনেরো পরে গভীর বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। এই কয়েকদিন নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় সিদ্ধার্থ অভীষ্ট লাভের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছেন। তাঁর শরীর থেকে সূক্ষ্ম শরীর এখন সহজেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তাঁর ভেতর সামান্য ইচ্ছা জেগে উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
সূক্ষ্ম শরীরে তিনি কয়েকবার কপিলাবস্তু নগর ঘুরে এসেছেন। সেখানে শোকার্ত পিতা ছাড়াও বিপর্যস্ত মনে এখনও অপেক্ষায় আছেন তাঁর স্ত্রী যশোধরা। যশোধরাকে লাভের আশা আজও ছেড়ে দেয়নি দেবদত্ত। কুমার দেবদত্ত কোলিতদের রাজপুত্র। এখন সে ধনী এবং রাজ্যাভিষেকের ফলে আগামী রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সে মাঝে মাঝেই প্রেম প্রস্তাব দিচ্ছে যশোধরাকে, নানা অছিলায় উপহার সামগ্রীও পাঠাচ্ছে তাঁর প্রাসাদে। বিবাহিত ও সন্তানের পিতা হয়েও দেবদত্ত যশোধরার আকর্ষণ কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। যশোধরা সর্বদা অবিরত স্মরণ করছেন সিদ্ধার্থকে। তা সিদ্ধার্থ বুঝতে পারছেন। তাঁর প্রাণ এখন এমন সর্বব্যাপক ও সূক্ষ্ম হয়ে গেছে যে, সামান্য মনোনিবেশ করে কোথাও কেউ কিছু নিবেদন করলেই তা তাঁর প্রাণে এসে বাজছে। সিদ্ধার্থর প্রাণ এখন যেন সহস্র তন্ত্রীর এক বীণা। মানুষের হৃদয়ের আহ্বানে তা ঝঙ্কৃত হয়ে উঠছে, বারেবারে। তবুও এরই মাঝে এক অদ্ভুত নির্মোহ তাঁকে ঘিরে আছে। সেই মোহশূন্যতার কারণে কিছুই কোনোভাবে তাঁকে কখনও বিপর্যস্ত করে না। কারণ তিনি সকলের ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছেন। যশোধরার ভবিষ্যত তিনি দেখতে পাচ্ছেন, দেখতে পাচ্ছেন কীট পতঙ্গসহ জগতের সকল প্রাণীর অতীত ও ভবিষ্যত।
তিনি এখন জানতে পেরেছেন, তিনি কেবল কপিলাবস্তু নগরেরর রাজপুত্র সিদ্ধার্থ নন। তিনি তথাগত। অর্থাৎ যিনি যথাযথ পথে এ জগতে পরিভ্রমণ করেছেন। তথাগত রূপে পূর্বাপর পঁচিশটি জন্মে তিনি পরম বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন। জগতের মঙ্গলসাধন ও শ্রেয়চিন্তন উন্মেষের জন্য এই জন্মে তাঁর ধরাধামে আগমন। অচীরেই তিনি সেই মহাবোধিজ্ঞান লাভ করে জগতে তথাগতবুদ্ধ রূপে পরিচিত হবেন। আর সংশয় নেই, মনে আর দ্বিধার চিহ্নমাত্র নেই। তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য এখন আর মাত্র সামান্য কয়েকটি দণ্ডের অপেক্ষা। নদীর শীতল বাতাসে তাঁর শরীর জুড়িয়ে গেল। তাঁর দীর্ঘ ছয়বছরের সাধন জীবন আজ পূর্ণ হল। আগামীকাল বৈশাখি পূর্ণিমা। সেদিনের শুভক্ষণেই ঘটতে চলেছে তাঁর সিদ্ধিলাভ। প্রতিটি পূর্ণিমার রাত তাঁর বিশেষ অর্থবহ ও পবিত্র মনে হয়। চাঁদের কিরণ সেই রাতগুলিতে পৃথিবীকে অলৌকিক সুন্দর করে তোলে।
*এখন থেকে সিদ্ধার্থকে এই উপন্যাসে তথাগত অথবা বুদ্ধ সম্বোধন করা হবে।
তথাগত আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন আকাশে সোনালি থালার মতো চাঁদ উঠেছে। আগামিকাল পূর্ণিমা। আকাশে এখন থেকেই আলোর উৎসব শুরু হয়ে গেছে, আর সেই উৎসবে সমগ্র বনভূমি যেন মেতে উঠেছে। বুনো মল্লিকা লতার ঘ্রাণে মাতাল হয়ে উঠেছে বাতাস। একটি সাদা আর ফুলন্ত কুর্চিগাছ বেয়ে উঠেছে বন্য মধুমালতির ঝোপ। লতাটিতে মধুমালতি ফুটেছে রাশিরাশি। কী অপূর্ব তার সুগন্ধ! ফুটেছে লালচে রঙের পারুল ফুল। নিকটস্থ পাটলিগ্রামের নাম হয়েছে সেই পারুল থেকে। প্রথমে কথ্যভাষায় পারুলি এবং সেখান থেকে পাটলি। সন্ধ্যার ম্লান আলোকে প্রস্ফুটিত অরণ্যের শত শত শালগাছের সুগন্ধী ফুলগুলি ঝরে পড়ছে। এই অপরূপ সুগন্ধ যেন তাঁকে বলছে,— ‘বন্ধু! তোমার জীবনের শুভক্ষণের আর বিলম্ব নেই। তোমার দীর্ঘ সাধনার ক্লেশের আজ অন্ত হবে। কাল তুমি জগতের দুঃখের কারণের সমাধানরূপী বোধিজ্ঞান লাভ করবে।’
তথাগত অনেকদিন পরে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় নিমগ্ন হলেন। ঘুমিয়ে তিনি এক অভূতপূর্ব স্বপ্ন দেখলেন। সেই স্বপ্নে পাঁচটি বিষয় দেখতে পেলেন তথাগত।
*তিনি দেখলেন, তাঁর শরীর বিশাল আকৃতি ধারণ করেছে এবং তা যেন সমগ্র জগতকে ব্যাপ্ত করে ফেলেছে। সুমেরু পর্বত হয়েছে তাঁর মাথার বালিশ। পূর্বপ্রান্তের সমুদ্র তাঁর বাম বাহুকে ধরে রেখেছে। দক্ষিণ বাহু পশ্চিম সমুদ্রে রয়েছে। তাঁর দুটি পা দক্ষিণ মহাসাগরে প্রসারিত হয়েছে।
*তাঁর নাভি থেকে একটি তিরিয় বা বৃক্ষ জন্মেছে। বৃক্ষের অগ্রভাগে আকাশ ছুঁয়েছে।
*কালো মাথা যুক্ত একধরণের সাদা পিঁপড়ে তাঁর হাঁটু পর্যন্ত আচ্ছাদিত করেছে।
*চারটি দিক থেকে চারটি কালো পায়রা উড়ে এসে তাঁর পদতলে পতিত হল, এবং সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি সাদা রঙের পায়রায় পরিণত হল।
*বিষ্ঠাপূর্ণ একটি সুউচ্চ পর্বতের উপর থেকে তিনি নিজেকে হেঁটে যেতে দেখলেন, কিন্তু এতটুকু বিষ্ঠা তাঁর শরীর স্পর্শ করল না।
ভোর হওয়ার আগেই তথাগতর ঘুম ভেঙে গেল। সমগ্র চরাচরে তখন এক কোমল আভা ছড়িয়ে পড়েছে, পাখিরা তখনও জাগেনি। এক অপূর্ব আনন্দের অনুভূতি জেগে উঠল তাঁর ভেতর। তিনি ভাবতে লাগলেন এমন স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী হতে পারে? তথাগত অনেক আগে স্বপ্নব্যাখ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন। তবে এখন ধ্যানের অভ্যাস সাধন করে তাঁর ভেতর এমন এক বিশেষ প্রজ্ঞা এসেছে, যার সাহায্যে সহজেই তিনি এই স্বপ্নের অর্থ বুঝতে পারলেন।
প্রথম দৃশ্যের অর্থ তিনি পৃথিবীর সব থেকে মহান ও শ্রেষ্ঠজ্ঞান বোধিজ্ঞান লাভ করবেন। দ্বিতীয় দৃশ্যের অর্থ তিনি অষ্টাঙ্গিক মার্গ জগতে প্রচার করবেন। যা একটি উচ্চতম শ্রেষ্ঠ মার্গ, তাই তিরিয়টি আকাশ ছুঁয়েছে। তৃতীয় দৃশ্য, শ্বেত পিপীলিকার কালো মাথা। অর্থাৎ শ্বেত বস্ত্র পরিহিত সাধারণ মানুষ। শ্বেতবস্ত্র পরে তাঁরা সকলে বুদ্ধের অনুগমন করবেন। বুদ্ধের গৃহীভক্তগণ বা উপাসকগণ সকলে শ্বেতবস্ত্র ধারণ করতেন। চতুর্থ দৃশ্য চারটি কালো পাখি তাঁর চরণে প্রণত হয়। এর অর্থ চতুর্বর্ণ। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এরা সকলেই বৌদ্ধ সংঘে এসে শান্তির বাণী শ্রবণ করে মুক্তি উপলব্ধি করবে। পঞ্চম স্বপ্ন তথাগত বিষ্ঠার পর্বতের উপর দিয়ে অবলীলায় শুদ্ধ অবস্থায় হেঁটে যাচ্ছেন, অর্থাৎ বুদ্ধ জগতের যাবতীয় সম্মান ও দান বিনা আসক্তিতে গ্রহন করবেন।
তিনি উপলব্ধি করলেন এই বৈশাখি পূর্ণিমার শুভদিনেই তিনি বোধিজ্ঞান লাভ করবেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সাধনায় বসার আগে কিছু শক্ত খাদ্যগ্রহন প্রয়োজন। তিনি তখনই অনুভব করলেন। সেনানী পরিবারের কন্যা সুজাতা তাঁকে দান দেওয়ার জন্য অপেক্ষারত। তথাগত ভাবতে লাগলেন। সুজাতার দান গ্রহন করবেন। কারণ এই পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে আহার্য্য দিয়ে এসেছে। তিনি চান এদের সকলের মঙ্গল হোক। তাছাড়া সুজাতাও পূর্বাপর জন্মগুলি থেকে অত্যন্ত পুণ্যবতী। তিনি সুজাতার দান নেবেন বলে তাদের গৃহের নিকটস্থ ন্যগ্রোধবৃক্ষটির বেদীতে এসে বসলেন। তিনি দেখলেন, আগেই বেদীটিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। তাঁর মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। তিনি বেদীর উপর পদ্মাসনে বসলেন। তাঁর দেহ থেকে কাঁচাসোনার মতো উজ্জ্বল বিভা বের হতে লাগল। সমস্ত বেদীটা তাতে যেন স্বর্গীয় আলোকধারায় আলোকিত হয়ে উঠল।
পুণ্যা সকালে গরুর দুধ দোহন করতে এসে হতবাক। সে দেখল সেই আটটি সুলক্ষণা গাভীর বাট থেকে দোহন করার আগেই পাত্রে অবিরলধারায় দুধ পড়তে শুরু করেছে। সে এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে ছুটে গিয়ে সুজাতাকে খবর দিল। সুজাতা সেই দুধ দিয়েই পায়স বানাবে ঠিক করল। সে পুণ্যাকে পাঠাল, বটগাছতলায় তথাগত এসেছেন কিনা দেখতে। পুণ্যা বটগাছের তলায় তথাগতকে দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল,
”প্রভু! আজ আমার মাতা সুজাতাদেবী আপনাকে খাদ্যদান করতে চান! আপনি অপেক্ষা করুন।”
সে সেখান থেকে আনন্দে পুলকিত হয়ে ছুটে গেল সুজাতার কাছে।
”এসেছেন মাতা, তিনি এসেছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন ন্যগ্রোধবৃক্ষের দেবতা স্বয়ং প্রকটিত হয়েছেন, আপনার দান নেবেন বলে। আমি তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে এসেছি।”
”খুব ভালো কাজ করেছিস পুণ্যা! আমি তোকে আমার গলার এই অলঙ্কার উপহার দেব। আর আজ থেকে তুই আমাদের বাড়ির দাসী থেকে আমার কন্যা হয়েছিস। এমন ভাল খবর দেওয়ার জন্য তোকে আমি দাসীত্ব থেকে আজ চিরতরে মুক্তি দিলাম। আজকের দিনটিও বড় শুভদিন। দেখ পুণ্যা! দেবতার আজ বড় কৃপা হয়েছে আমাদের প্রতি। এই দুধের পাত্র থেকে এতটুকু দুধ উথলে পড়ছে না, আর এক অপূর্ব সুগন্ধ বের হচ্ছে, ফুটন্ত দুধ থেকে। দুধের বুদবুদ উঠছে আর সঙ্গে সঙ্গে তা ডানদিকে বেঁকে যাচ্ছে। এমন আশ্চর্য ঘটনা আমি জীবনে কখনও দেখিনি। তুই এগিয়ে যা। বেদীটা আবার ভাল করে মুছে আয়। আমিও তৈরি হয়ে নিচ্ছি, তারপর আমরা পায়স নিয়ে ন্যগ্রোধমূলে যাব।”
সুজাতার তথাগতকে একটি মূল্যবান পাত্রও দান করতে ইচ্ছে হল। সে পায়স একটি সুদৃশ্য সোনার পাত্রে ঢেলে তার উপর আর একটি পাত্র দিয়ে ঢাকা দিল। তারপর বস্ত্রখণ্ডের ভেতর পাত্রটি বসিয়ে সেটিকে মাথায় করে তথাগত’র কাছে নিয়ে চলল। তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলল পুণ্যা। আজ তার বড় আনন্দের দিন। সে দাসীত্বর যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেয়েছে।
সুজাতা কিছুটা পথ পার হয়ে বটবৃক্ষের নীচে বুদ্ধকে বসে থাকতে দেখতে পেল। সে বেদীমূলে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে পায়সের পাত্র ও জল তথাগতকে নিবেদন করল। তথাগত পায়সের পাত্রটি সোনার দেখে, তা গ্রহন না করে নিজের ভিক্ষাপাত্রটি হাতে নেওয়ার জন্য পাশে তাকালেন, কিন্তু ভিক্ষাপাত্র সেখানে ছিল না। পূর্বাপর বুদ্ধগণ বোধিজ্ঞানলাভের দিন স্বর্ণপাত্রে দান পেতেন। কথিত হয় যে, সেই ধারা অব্যাহত রাখতে ইন্দ্র তথাগতের ভিক্ষাপাত্রটি তখনকার জন্য লুকিয়ে রাখেন। সুজাতা বলল,
”প্রভু আমি এই পায়স আপনাকে স্বর্ণপাত্রের সঙ্গেই দান করতে চাই। দয়া করে দান গ্রহন করুন!” তথাগত বললেন,
”কন্যা সুজাতা! আমি ভিক্ষুক। এত মূল্যবান পাত্রের আমার প্রয়োজন নেই। তুমি অন্য কোনো মৃৎপাত্রে তোমার দান দাও।”
”না প্রভু! এই পাত্র আমি আপনাকে দেবার মানসেই এখানে এনেছি। এটি আর আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাব না।”
‘বেশ।’ তথাগত স্মিত হাসলেন। সুজাতা বলল,
”আমার মনোস্কামনা যেমন পূর্ণ হয়েছে। আপনার উচ্চাকাঙ্খাও তেমন পূর্ণ হোক।”
তথাগত পায়সের পাত্রটি হাতে নিলেন এবং ন্যগ্রোধ তরুমূল থেকে উঠে নৈরঞ্জনার তীরে এলেন। তিনি নদীতে স্নান করলেন এবং স্নানান্তে একটি পাথরের উপর বসে পায়সের পাত্র থেকে পায়সটুকু ঊনপঞ্চাশটি গ্রাসে বিভক্ত করে নিঃশেষে সবটা খেয়ে নিলেন।
আচমন করে সোনার পাত্রটিকে তিনি নদীর জলে বিসর্জন দিলেন। এমন বহুমূল্য পাত্রের তাঁর অনাড়ম্বর জীবনে কোনও প্রয়োজন নেই। তিনি মনে মনে বললেন,
”আজ যদি আমি সত্যিই বোধিলাভ করি, তাহলে এই পাত্রটি স্রোতের অনুকূলে না গিয়ে বরং প্রতিকূলে যাবে।”
এবং তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন জলের মধ্যে একটি ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়ে পাত্রটি স্রোতের প্রতিকূলে কিছুক্ষণ চলে অবশেষে জলে নিমজ্জিত হল। তিনি এরপর অরণ্যের দিকে এগিয়ে গেলেন।
সকালে পায়েস খাওয়ার পর তথাগত সারাটা দিন নদীর তীরে শাল গাছের জঙ্গলে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে তাঁর আশ্রয় স্থল সেই অশ্বত্থ গাছটির তলায় ফেরার উদ্যোগ করলেন। সোত্থিয় নামক এক ব্যক্তি এইসময় জঙ্গলে ঘাস কেটে বাড়ি ফিরছিল। সে ভাবী বুদ্ধকে দেখে চমকে উঠল। এমন দৈব আভায় উজ্জ্বল কোনও মানুষের মুখ সে আগে কখনও দেখেনি। সে তথাগতকে রাতে বিশ্রাম করার জন্য আটগুছি ঘাস দিল। বুদ্ধ ঘাসটুকু গ্রহন করলেন এবং তা নিয়ে চলতে লাগলেন।
সন্ধ্যা নেমেছে। নিস্তব্ধ বনভূমি জুড়ে বেজে উঠল অপূর্ব অনাহত নাদ। সেই নাদ বিষয়ী ব্যক্তিরা শুনতে পান না। কিংবা শুনলেও সহ্য করতে পারবেন না। কেবল ধ্যানের মাধ্যমে যাদের অন্তর শুদ্ধ হয়েছে, তাঁরা এই নাদ অর্থাৎ অনবরত একধরণের মহান ঘন্টা, ভৃঙ্গ, শঙ্খ, বীণা বা বেণুর ধ্বনি শুনতে পান, এবং তা অনেক সময় শোনায় ওঁমকার ধ্বনির মতো। তথাগত সেই নাদ শুনতে শুনতে আবিষ্ট হয়ে পড়লেন। তাঁর বাহ্য চেতনা একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল। তখন সেই বনভূমির শতশত শাল তরু তাদের প্রস্ফুটিত পুষ্প তাঁর মাথায় বর্ষণ করতে লাগল। যেন তারা এই মহান সাধকের প্রতি তাদের আশীর্বাদ বর্ষণ করল।
তথাগত গাছের তলায় ফিরে এলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন ঘাসটুকু কোনদিকে মুখ করে তিনি পাতবেন? বৈশাখী পূর্ণিমার এক অপূর্ব জ্যোৎস্নাভরা রাত।
অলঙ্করণঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য