ধারাবাহিক উপন্যাস তথাগত নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী বসন্ত ২০২০

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব , চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব

নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

আগের পর্বের পর

গভীর রাতে যশোধরার ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের ভেতর হু হু করে বাতাস বইছে, সেই বাতাসে দূরের গাছগুলোর মাথা দুলছে আর সেই শনশন শব্দ নিস্তব্ধ রাত্রিকে যেন মুখর করে তুলেছে। ঘরের জানলা দিয়ে দুধ সাদা জ্যোৎস্না এসে সমস্ত ঘরটিকে এক মায়াবী আলোয় ভরে তুলেছে। দূর হিমালয়ের শিখরগুলি জ্যোৎস্নার আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। ঘরে যশোধরা একা। রাহুল কয়েক বছর হয়েছে তার বড়ো মাতা প্রজাপতি গৌতমীর কাছেই বেশি থাকে। সে মহারাজ শুদ্ধোদনের চোখের মণি। মহারাজ রাহুলকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না।

যশোধরা এখন রাজপ্রাসাদ থেকে কিছুটা দূরে সিদ্ধার্থের জন্য নির্মিত এই প্রাসাদে একা থাকেন। প্রাসাদটির নাম শুভ। এই পঞ্চতল বিশিষ্ট প্রাসাদে তাঁকে সাহায্য করতে থাকেন আরও দশজন দাসী। তারা কেউ যশোধরার নির্জনে থাকায় ব্যাঘাত ঘটায় না। কেবল প্রয়োজন হলে সামনে এসে দাঁড়ায়। যশোধরা বিগত এই বছরগুলিতে ক্রমাগত জ্যোতিষচর্চা করেছেন আচার্যদের কাছে এবং ন্যায় ও সাংখ্যবেদ অধ্যয়ন করেছেন। তিনি গণনা করে নিজেই জেনেছেন তাঁর স্বামী সিদ্ধার্থ আর কখনোই সংসারে ফিরে আসবেন না। তবুও এই অদৃষ্টচর্চা তাঁর অশান্ত মনকে শান্ত করে। কখন কিছুটা সময় দ্রুত কেটে যায়, টের পাওয়া যায় না। সিদ্ধার্থ সংসার ত্যাগ করে চলে যাবার পর নিজের ভেঙে পড়া সত্তাকে তিনি বিদ্যাচর্চা মাধ্যমেই উপশমন করার চেষ্টা করে গেছেন। সবসময় সফল হননি। বেদনা ও হতাশার করাল আক্রমনে বারবার যশোধরা বিপর্যস্ত হয়েছেন। তবু থেমে থাকলে চলে না, তাঁর দিনগুলি একঘেয়েমি আর বিষণ্ণতায় ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে।

বসন্তকাল চলছে। প্রকৃতি অপরূপা হয়ে সেজে উঠেছে। পাখির কূজন, ফুলের সৌরভের ডালি নিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে। সকাল হলেই বৈশাখী পূর্ণিমা। কুমার সিদ্ধার্থের জন্মের শুভতিথি। প্রতিবছর এই দিনটিতে যশোধরা সমস্ত দিন উপবাস করে দেবতাকে অর্ঘ্য দেন। এই বছর সিদ্ধার্থ ছত্রিশ বছরে পদার্পণ করবেন।

যশোধরা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁরও এই একই দিনে জন্ম। সেই হিসেবে আজ তাঁরও জন্মদিন! তবে তিনি প্রতিবারেই কেবল সিদ্ধার্থের জন্যই দেবতার কাছে অর্ঘ্য নিবেদন করেন। সিদ্ধার্থের মঙ্গল কামনাতেই তাঁর সুখ, স্বামীর অস্তিত্ব ছাড়া তাঁর কাছে নিজের পৃথক কোনো অস্তিত্ব নেই। নিজের কথা তিনি কখনও ভাবেন না। এই কয়েকটি বছর সারাদিনে একবারই সামান্য ফল বা দুধ খেয়ে থেকেছেন তিনি। যশোধরার পরনে শ্বেত বস্ত্র। তাঁকে দেখতে তপস্বিনীদের মত লাগছে। গায়ে  গয়না নেই, চুল পরিব্রাজিকাদের মত উঁচু করে গুটিয়ে বাঁধা এবং তাঁর মুখটি অপূর্ব লাবন্যমাখা ও পবিত্র।

একটু পরে যশোধরা ঘরের বাইরে এলেন। তাঁর পরনে স্নানবস্ত্র। রাত আর নেই, তবে ভোরের আলোও এখনও ভালো করে ফোটেনি, পাখিদের কাকলিও শোনা যাচ্ছে না। তিনি ঘরের বাইরে আসতেই একজন পরিচারিকা তাঁর সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। দাসীটির নাম মল্লিকা। যশোধরার সঙ্গে সে-ও প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগল, মুখে একটিও কথা না বলে। প্রাসাদ সংলগ্ন একটি উদ্যানে আছে একটি বিরাট সরোবর। এই সরোবরে কেবলমাত্র নীলপদ্ম ফোটে। যশোধরা আলো ফোটার আগেই রোজ স্নান করে নেন। আজও তিনি স্নান সেরে রাজবাড়ির মন্দিরের পুজোর জন্য ফুল তুলবেন। মল্লিকা তাঁকে রোজই ফুল তোলায় সাহায্য করে। স্নান করতে করতে একটা কাঠ পোড়ার কটু গন্ধ নাকে পেলেন যশোধরা। ”কী পুড়ছে বলো তো?” জানতে চাইলেন তিনি। মল্লিকা বলল,

”মহারাজ পরিব্রাজকদের জন্য পাহাড়ের গায়ে স্থায়ী গুহাঘর বানাচ্ছেন। ওখানে প্রাকৃতিক গুহাগুলির ভেতর একসঙ্গে অনেক শালের খুঁটি জ্বলছে রাজকুমারী!”

পাহাড়ি প্রাকৃতিক গুহাগুলোকে স্থায়ী করার জন্য এর ভেতর কাঠের গাদা জড়ো করে আগুন দেওয়া হয়। কাঠ জ্বলার সময় গুহার ভেতর কোনো অস্থায়ী অংশ থাকলে তা ভেঙে পড়ে। থেকে যাওয়া বাকি অংশটা আরও মজবুত হয়ে ওঠে। তারপর চুন ও পলি দিয়ে ভেতরটা পাথর গেঁথে সমান করা হয়। এক একটি গুহাঘরে তখন বহু তির্থীকেরা আশ্রয় নিতে পারে। মহারাজ শুদ্ধোদনের মন সিদ্ধার্থ চলে যাওয়ার পর থেকেই তির্থীকদের প্রতি অত্যন্ত সদয়। হয়তো তিনি এঁদের মধ্যেই তাঁর গৃহত্যাগী পুত্রের ছায়া দেখতে পান! তিনি রোজই তাদের এক একটি দলকে রাজবাড়িতে ডেকে আনেন। তারপর পেট ভরে খাওয়ান। তাদের ভ্রাম্যমান জীবনের মান উন্নত করতে গুহাগুলিকে সংস্কার করান, রাস্তার ধারে ছায়াদায়ী গাছ লাগান, কূপ খনন করান, কারণ পরিব্রাজকেরা কোনো গৃহস্থের আতিথ্য স্বীকার করেন না।

মাস ছয়েক আগেই সিদ্ধার্থকে দেখে ফিরে এসেছেন কলুদায়ী। মহারাজ চিত্রকরদের দিয়ে কলুদায়ীর কথামত সিদ্ধার্থের প্রতিকৃতি আঁকিয়েছিলেন। সেই ভয়ানক ছবিটি চিরদিনের জন্য যশোধরার মানসপটে মুদ্রিত হয়ে গেছে। ক্লান্ত, বিশীর্ণ, কুৎসিত! গালের হনুর হাড়দুটি উঁচু হয়ে উঠেছে। কোটরাগত চোখদুটি কেবল তীব্র উজ্জ্বল। এ কি সত্যিই তাঁর স্বামী? নাকি তাঁর প্রেত? নিজেকে এভাবে কেন মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন কুমার? কীসের এত দুঃখ তাঁর? তিনি কী খুঁজছেন? কেন এমন বেদনাবোধ জেগে উঠল কেবল তাঁর ভেতর? কই আর কেউ তো জগতের দুঃখে আগে এমন করে কাতর হননি! চিত্রে সিদ্ধার্থের দেহটি ছিল অস্থিচর্মসার, তাতে প্রতিটি দেহের হাড় যেন জেগে উঠেছিল। তা দেখে মহারাজ পর্যন্ত সশব্দে কেঁদে উঠেছিলেন।

এখন সিদ্ধার্থ কেমন আছেন? সেখানে কেউ কি তাঁকে সেবা যত্ন করে? কুমার কি সেই ভয়ানক বনে এখনও একাকী বাস করেন? যশোধরার দু চোখ বেয়ে জলধারা নামল। তিনি সরোবরের জল দুহাতে নিয়ে অঞ্জলি দিয়ে প্রণাম করলেন। ‘হে জগতের ত্রাতা! সর্বশক্তিমান! তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন! তাঁর অন্বেষণ যেন কখনও ব্যর্থ না হয়!’

শুদ্ধোদন ঘরের বাইরে অলিন্দে এসে দাঁড়িয়েছেন। রাজবাড়ির মঙ্গলাচরণ শুরু হয়েছে। আজ সিদ্ধার্থের জন্মদিন। সিদ্ধার্থ পায়েস খেতে ভালোবাসেন। গৃহদেবতার পূজায় আজ পায়েস নিবেদন করা হবে। আজ দুপুরে একশো তির্থীক সন্ন্যাসী রাজবাড়িতে অন্ন গ্রহন করবেন। পুত্রের মঙ্গল কামনায় শুদ্ধোদন বার বার দেবতাদের উদ্দেশ্যে হোম ও যজ্ঞ করেছেন। সিদ্ধার্থের কথা ভেবে কত যে বিনিদ্র রাত তাঁর কেটেছে তাঁর হিসেব নেই। কলুদায়ীর ফিরে আসার পর তিনি সিদ্ধার্থের কথা শুনে অন্তরে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছেন। তারপর থেকে আরও বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। মহারাজ মনের গভীরে বিশ্বাস করেন সিদ্ধার্থ সফল হবে। ঋষি কালদেবলের বাক্য মিথ্যে হবে না। তবুও পিতার মন মাঝে মাঝে প্রবোধ মানতে চায় না। তখন মনে কেবল দুশ্চিন্তার ঝড় ওঠে। রাতে ঘুমিয়ে শুদ্ধোদন আজ একটি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। তিনি তা বিশ্বাস না করলেও স্বপ্নটা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।

তিনি দেখেছেন নক্ষত্রভরা কালো আকাশ। সেই আকাশের বুকে অজস্র তারা ফুটলেও চাঁদ নেই। সেই মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় তিনি এক দেবতাকে দেখতে পেলেন। দেবতা ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলেন। নিদ্রিত শুদ্ধোদনের সামনে এসে দাঁড়ালেন সেই দেবতা। তাঁর শরীর থেকে জ্যোতিপুঞ্জ সাদা আলোর মত বিচ্ছুরিত হতে লাগল। শুদ্ধোদনের ঘুম ভেঙে গেল তিনি চোখ মেলে চাইলেন। দেবতা তাঁকে বললেন, এক ভয়ানক দুঃসংবাদ দিতে তিনি এখানে এসেছেন।

”কুমার সিদ্ধার্থ আর বেঁচে নেই। কিছুক্ষণ আগেই তিনি পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বোধিজ্ঞান লাভ করতে পারেননি। তাঁর প্রাণহীন শরীরটা এখনও নৈরঞ্জনার তীরে পড়ে আছে। এই সংবাদ আপনাকে সর্বাগ্রে দিতে আমি বহুদূর পথ অতিক্রম করে এসেছি।”

দেবতার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নে শুদ্ধোদন ভীষণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।

”সিদ্ধার্থ অসফল হতেই পারে না! আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। সফল হবার পর সিদ্ধার্থ আমাকে নিজে এসে দর্শন দেবে, আমি তারই অপেক্ষায় আছি।”

ঠিক এই সময় শুদ্ধোদনের ঘুম ভেঙে গেল এবং তিনি নিজেকে বিছানায় শুয়ে আছেন দেখতে পেলেন। তিনি চমকে উঠে বসলেন। রাতে তাঁর ঘুম হল না। দেবতার কথা তিনি স্বপ্নে যেমন বিশ্বাস করেননি, জাগ্রত অবস্থায়ও অবিশ্বাস করেন। তবুও স্বপ্নে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পিতা হিসেবে তিনি অত্যন্ত ব্যাকুল চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি গোপনে অশ্রু মুছে ফেললেন। এই ভয়ানক স্বপ্নের কথা তিনি কাউকে জানালেন না। 


সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্বলাভ

ঘাসের গুছিগুলো হাতে নিয়ে তাঁর সাধনবেদী সেই অশ্বত্থ গাছতলায় এসে বসলেন তথাগত। ভাবতে লাগলেন, বোধিলাভের শুভদিন এসেছে। আজকেই সমস্ত বিপর্যয় কাটিয়ে বোধিজ্ঞান লাভ করতে হবে তাঁকে। আজ যত বাধা বিপত্তিই আসুক না কেন আজ তিনি পিছিয়ে আসবেন না। তিনি পশ্চিম, দক্ষিণ, উত্তর কোনোদিকে তাকিয়েই সেইদিকটিকে তাঁর ধ্যানে বসার উপযুক্ত দিক মনে করলেন না। অবশেষে পুবমুখে তাকিয়ে তিনি সেই দিকটিকে সঠিক দিক মনে করে সেইদিকে ঘাসের গুচ্ছগুলিকে ছুঁড়ে দিলেন। দৈব কৃপায় ঘাসের গুচ্ছগুলি পরস্পর জুড়ে ঠিক একটি ঘাসের আসনের মত করে সংযুক্ত অবস্থায় বিছিয়ে রইল। সিদ্ধার্থ সেই ঘাসের গদির উপর পূর্বদিকে মুখ করে বসলেন। তাঁর পেছনে ছিল বোধিবৃক্ষের কাণ্ড। ঘনসংবদ্ধ বোধিবৃক্ষের ডাল ও পাতাগুলি যেন ছাতার মত তথাগতের মাথাকে শীতাতপ থেকে রক্ষা করছে। তিনি সংকল্প করে অপরাজেয় সেই আসনে বসে বললেন,

”ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ জাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পর্দুভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিস্যতে-”   (ললিতবিস্তার)

অর্থাৎ          ”এই আসনে আমার দেহ শুকিয়ে যাক।
                 চামড়া মাংস, হাড় প্রলয়ে ঢুবে যাক,
                জগতের দুর্লভ বোধিজ্ঞান লাভ না করে
                কিছুতেই আমি এই আসন ত্যাগ করব না।”

তারপর তথাগত গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে গেলেন। সেই আশ্চর্য ধ্যানের সময় তাঁর মনের ভেতর থেকে উঠে এল বিঘ্নরূপী তাঁর অপর মন। বুদ্ধ রূপকের ছলে তাকেই বলেছেন মার। এই সংগ্রাম কোনো বাইরের শত্রুর সঙ্গে নয়, প্রতিটি সাধককে তাঁর অন্তরের মার রূপী এই প্রবল রিপু সকলকে জয় করে তবেই সাধন সমরে জয়ী হতে হয়। বুদ্ধ সুত্তপিটকে বলেছেন মারের দশটি সৈন্য। প্রথম সেনা হল কামনা, রাগ হল দ্বিতীয় সেনা, খিদে ও তৃষ্ণা হল তৃতীয় সেনা। চতুর্থ হল তীব্র আকাঙ্খা, আলস্য, ও তন্দ্রা হল পঞ্চম সেনা, ভীরুতা হল ষষ্ঠ। সংশয় হল সপ্তম, অষ্টম হল জড়তা ও অকৃতজ্ঞতা। বাকি সেনা হল লাভ ও উচ্চ প্রশংসার মোহ, মান ও জনপ্রিয়তার আশা, গর্ব এবং অপরের প্রতি ঘৃণা। এই সবগুলিই জীবদেহে বর্তমান, তাই মার হল সাধকের অন্তরের শত্রু। বুদ্ধ বলেছেন, কোনো কাপুরুষ ব্যক্তি এই সেনাদের দমন করতে পারেন না। যিনি এদের দমন করতে পারেন তিনিই হলেন প্রকৃত সাহসী ও বিজয়ী।

সুতরাং মার কোনো বাইরের শত্রু নয়, বরং প্রতিটি জীবের প্রবৃত্তি ও মনের নিজস্ব দুর্বলতা, যা ব্যক্তি বিশেষে পৃথক হয়ে থাকে। এই রিপুদের যিনি বশীভূত করতে পারেন তিনিই বোধিরূপ পরমজ্ঞান লাভ করে হন বুদ্ধ।  

ধ্যানের সোপান উত্তীর্ণ হতে হতে সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করলেন জগতের সকল জীবের লোভ, ক্রোধ, কাম, হিংসা, শোক এই সবকিছু মিলিত হয়ে এক মানবদেহের সৃষ্টি হয়েছে। সে এক কালো ভীষণাকৃতির মানব। সে সত্য, প্রেম, দয়া সবকিছুকে ধ্বংস করে। জগতে আনে হিংসা, বিপদ, শোক, জরা, রোগ ও মারি। সে-ই হল মার। মার তথাগতকে বলল,

”চেয়ে দেখো সিদ্ধার্থ! দেবদত্ত কপিলাবস্তু জয় করতে সেনা নিয়ে নগরে প্রবেশ করেছে। তার উদ্দেশ্য হল যশোধরাকে অপহরণ করা ও নগরের ধনসম্পদ লুঠ করা। দেবদত্তের সেনারা কপিলাবস্তু অবরোধ করে রেখেছে। তোমার ভাই ভীরু ও মদ্যপ নন্দ তাদের প্রতিহত করতে পারছে না। যশোধরা মাটিতে পড়ে লুটিয়ে কাঁদছে। তার কাছে এখন দুটিমাত্র পথ খোলা আছে। এক আজীবন দেবদত্তের দাসী হয়ে থাকা অথবা মৃত্যুবরণ করা। যশোধরা মৃত্যুবরণ করবে ঠিক করেছে। শেষবারের মত বাতায়নের দিকে তাকিয়ে ওই দেখো সে কেমন অসহায়ভাবে কাঁদছে!”

তথাগত তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সূক্ষ্ম শরীরে যশোধরার প্রাসাদে প্রবেশ করেছেন। তথাগত চেয়ে দেখলেন, সত্যিই যশোধরা কাঁদছেন! তাঁর চোখদুটি জলে ভেজা দুটি পদ্মের মত দেখাচ্ছে। সেই পরম পবিত্র ও কল্যাণময়ী নারীর শরীর থেকে সাদা আলোর মত একরকম জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তিনি অন্তরে উপলব্ধি করলেন, যশোধরা চিরপবিত্রতার প্রতীক। দুর্জন কখনও তাঁর এতটুকু ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি এরপর চাইলেন কপিলাবস্তু নগরের রাজপুরীর দিকে। তক্ষুণি তাঁর দৃষ্টিপথে প্রতিভাত হল রাজপুরীর অন্দরমহল। শুদ্ধোদন রাত্রের আহারে বসেছেন। মহারানি গৌতমী তাঁকে নানা ধরণের সুখাদ্য পরিবেশন করছেন। রাজার মুখ বিষণ্ণ। তিনি তাঁর পুত্র সিদ্ধার্থের কথা ভাবতে ভাবতে কেবল সামান্য পরিমাণ পায়েস মুখে দিলেন। এই পায়েস দেবতার মন্দিরের প্রসাদ হয়ে রাজপুরীতে এসেছে। নগরের কোথাও এতটুকু অস্বাভাবিকতা নেই। দেবদত্ত ও তার সেনার চিহ্নমাত্র নেই।

তথাগত বুঝলেন, এই অঘটনের কথাগুলি মারের মিথ্যা রটনা। যাতে মোহিত হয়ে তথাগত তাঁর লক্ষ্যপূরণ করতে না পারেন। তিনি আবার ধ্যানে মনোনিবেশ করলেন।

আবার মার এসে উপস্থিত হল তাঁর সামনে। চিৎকার করে বলল, ”সিদ্ধার্থ! এই মুহূর্তে আসন ছেড়ে উঠে যাও! নাহলে এখনই আমি তোমার হৃৎপিন্ড টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।” মারের ভয়াবহ সেই গর্জনে অতি সাহসীও জ্ঞান হারাবে।

এর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল অকাল বর্ষণ ও ভীষণ কালবৈশাখী ঝড়। বনের গাছপালা উপড়ে পড়তে লাগল। বসন্তে যে সব পাখির বাসাগুলি গাছে গাছে গড়ে উঠেছিল সেইসব ভেঙে কোথায় উড়ে পড়ে গেল! ভীত পাখির দল কিচমিচ করতে লাগল। চাঁদ মেঘের আড়ালে ডুবে গেল। মেঘের আচ্ছাদনে তারাদের দলও যেন কোথায় হারিয়ে গেল। এক ঘন অন্ধকার যেন সমস্ত চরাচরকে একটা কালো পর্দার আড়ালে ঢেকে ফেলল। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়তে লাগল। জগতের শুভ কামনাকারী দেবতারাও যেন এই অবস্থায় ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁরাও ভাবতে লাগলেন তথাগত কি শেষরক্ষা করতে পারবেন? তিনি কি এই কঠিন যুদ্ধে জয়ী হতে পারবেন? ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাবেন না তো?

এত বিপর্যয়ের পরে তথাগত তবুও তাঁর আসন ছেড়ে উঠে গেলেন না। বোধিমণ্ডপের সেই অশ্বত্থ গাছটি ছাতার মত তাঁর মাথা পাতার আচ্ছাদনে ঢেকে রাখল, তাই তথাগতর মাথায় ঝড় জল কিছুই স্পর্শ করল না। তথাগত সফলতার দিকে এগিয়ে চলেছেন দেখে মার আরও বিঘ্ন দিয়ে তাঁকে প্রতিহত করতে চাইল।

এবার কড়কড় শব্দে বাজ পড়ে বনের গাছের মাথায় হঠাৎ ভয়ানক আগুন ধরে গেল। প্রবল বেগে সেই আগুন বনের ভেতর ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আগুনের আভায় অন্ধকার বনের প্রান্ত হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠল। বনের পশুপাখিরা আর্তনাদ করে উঠল। তথাগতর দিকে আগুনের সন্মিলীত কনাগুলি ফোয়ারার মত ছিটকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু সেই আগুন তথাগতকে স্পর্শ করতে পারল না।

মার অবাক হয়ে গেল। অন্তরের বাধা এবং বাহ্যিক বাধা ও সেইসঙ্গে ভীতি প্রদর্শন কোনোভাবেই তথাগতকে পরাভূত করতে পারল না সে!

তথাগত শান্ত স্বরে তখন মারকে বললেন, ”আমি জগতে বিশেষ প্রয়োজনে জন্মলাভ করেছি। আমি এখানে এসেছি বহু প্রাণীকে এই ভবসাগর উত্তীর্ণ করানোর জন্য। তোমার দুর্লঙ্ঘ্য বাধা বহু প্রাণী ভেদ করতে পারেনি। আমি এরপর থেকে তাদের সেই বাধা জয় করার শক্তি, কৌশল ও সাহস দেব। আমি আমার প্রজ্ঞাবলে তোমার সমস্ত বাধাকে ভেঙে চুরমার করে দেব। যেমন একখণ্ড পাথর দিয়ে সহজেই মাটির পাত্রকে ভাঙা যায়, ঠিক তেমন।”

মার বলল, ”সিদ্ধার্থ তুমি এই বোধিমণ্ডপে বসার একেবারেই অযোগ্য। তুমি এক্ষুণি এই আসন ত্যাগ কর। এই আসনে কেবল আমার অধিকার। তুমি বোধিজ্ঞান লাভের জন্য কী কী পারমী পূর্ণ করেছ?”

তথাগত বললেন, ”আমি পূর্বাপর জন্মগুলিতে দশ উপপারমী, দশ পারমী ও দশ পরমার্থ পারমী পূর্ণ করেছি। উপপারমী হল বাহ্যিক বস্তুদান– যেমন ধনরত্ন, ভূমি ও খাদ্য ইত্যাদি দান। পারমী হল অঙ্গদান এবং পরমার্থ পারমী হল পরের জন্য নিজের জীবন দান। পৃথিবীতে পাঁচটি মহান দান আছে, তা হল রাজ্য দান, স্ত্রী দান, পুত্র দান এবং জীবন দান। আমি সেই পাঁচ মহান দান কার্যও পূর্ণ করেছি। এ ছাড়া জ্ঞান সাধন, লোকহিত এবং পরমার্থ লাভের জন্যও বহুবার সাধনা সম্পন্ন করেছি, কিন্তু অমঙ্গলের মূর্ত প্রতীক মার! তুমি কী হিতসাধন করেছ? তোমার এই আসনে বসার কোনো অধিকার নেই।”‌

তথাগতর বাক্য শুনে ক্রুদ্ধ মার তাঁর উদ্দেশ্যে একটি চক্রায়ুধ ছুঁড়ে মারল। তথাগত ধ্যানে মগ্ন থাকায় চক্রায়ুধ তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারল না। তা এসে তাঁর মাথার উপর চন্দ্রাতপ রচনা করল।

তথাগত বললেন, ” মার তোমার দানের সাক্ষী কে আছে?”

মার সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে উঠল। তার অনুচর ও সৈন্যদল তার সপক্ষে একসঙ্গে সাক্ষী দিয়ে গর্জে উঠল। মার বলল, ”সিদ্ধার্থ! এবার তোমার দানের সাক্ষী কে আছে বলো! নাহলে এই মুহূর্তে এই আসন ত্যাগ করো।”

উত্তরে তথাগত বললেন, ”অন্যান্য জন্মে আমি কী করেছি তা বাদ দিলেও বেস্বান্তর জন্মে আমি সাতবার যে মহান দান করেছিলাম, এই পৃথিবী তার সাক্ষী দেবে।”

তিনি কাষায় বস্ত্রের ভেতর আচ্ছাদিত তাঁর ডানহাতটি বের করে ভূমি স্পর্শ করে বললেন, ”বেস্বান্তর জাতকে আমি যদি সত্যিই সাতবার মহান দান করে থাকি, হে পৃথিবী তুমি তার সাক্ষী হও।”

তখন বোধিমন্ডপের সেই ভূমির মাটি প্রবল শব্দে গর্জন করে বলে উঠল, ”আমি তোমার সাক্ষী!”

তথাগত তখন তাঁর বেস্বান্তর জন্মের সমস্ত দানের বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন, আর পাপী মার পরাজিত হয়ে তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে সেই স্থান ছেড়ে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অন্তরীক্ষ থেকে দুন্দুভী বেজে উঠল। দিব্য সুগন্ধে সমস্ত বনভূমি ভরে উঠল। বন আলো করে আবার আকাশে চাঁদ উদিত হল। নক্ষত্রলোকে জেগে উঠলেন শত শত দেবতাগণ। তথাগতের বোধিলাভের আনন্দে তাঁরা বিভোর। এতদিনে এক প্রকৃত বীর মানব সন্তান মার বিজয়ী হয়েছেন। তাঁরা আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। চারিদিক দেবতাদের বন্দনা গানে ভরে উঠল।

সমস্ত বাধা অপসৃত হতে তথাগত ধ্যানে বিভোর হয়ে গেলেন। তিনি প্রীতিসুখে প্রথম ধ্যান, ও পরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধ্যান উত্তীর্ণ হলেন। এরপর চতুর্থ ধ্যানে পৌঁছে সকল অন্ধকার তিরোহিত ও জ্ঞানালোক প্রজ্জ্বলিত হল। তিনি জীবের দুঃখ উপলব্ধি করলেন। তারপর তার কারণ, দুঃখ নিরোধ ও অবশেষে দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় উপলব্ধি করলেন। এইভাবে তিনি বৈশাখী পূর্ণিমার উষালগ্নে আনন্দময় বোধিজ্ঞান লাভ করলেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ছত্রিশ বছর।

তথাগত চোখ মেলে চাইলেন। তাঁর চোখে মুখে এক অপূর্ব আনন্দ। গভীর উল্লাসে উরুবিল্ব গ্রামের সেই বোধিমন্ডপে বসে তিনি জগতের এই কালচক্রের সর্বশক্তিমান সৃষ্টার উদ্দেশ্যে একটি গাথা আবৃত্তি করলেন। সেই গাথাটিতে বুদ্ধ যেন ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন করেছেন!

” অনেকজাতিসংসারং সন্ধাবিস্সং অনিব্বিসং।
  গহকারং গবেসন্তো দুকখা জাতি পুনপ্পুনং।।
  গহকারক! দিটঠোসি পুন গেহং ন কাহসি।
  সব্বা তে ফাসুকা ভগগা গহকূটং বিসঙ্খিতং।
  বিসঙ্খারগতং চিত্তং তনহানং খয়মজ্ঝগা।।”

”বহুবার এই সংসারে আমি জন্মলাভ করেছি এবং এই দেহরূপ গৃহের নির্মাতার অনুসন্ধান করেছি। বার বার জন্মে আমি বহুবার দুঃখসাগরে নিমজ্জিত হয়েছি। হে গৃহকারক! ( হে দেহঘটের নির্মাতা!) এবার আমি তোমায় দেখেছি! আর তুমি নতুন করে গৃহ নির্মাণ করতে পারবে না। তোমার ঘর তৈরির উপাদান কাঠের খণ্ডগুলি সব ভেঙে গেছে। গৃহকূটও (ঘরের ভিত) নষ্ট হয়েছে। নির্বাণলাভ করে (ইচ্ছার নাশ করে) আমার চিত্ত সমস্ত তৃষ্ণাকে ক্ষয় করেছে।”    

জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s