ধারাবাহিক উপন্যাস এক দুই তিন (তৃতীয় পর্ব) অদিতি ভট্টাচার্য বর্ষা ২০২০

এপিসোড ১, এপিসোড ২

শান্তনুর মুখ শুকিয়ে গেল, কিন্তু সামলেও নিল তাড়াতাড়ি, বলল,“কাকার মাথা খারাপ হয়ে গেছিল, সবাইকে সন্দেহ করতেন ইদানীং। তা এত কথা যখন বলেছেন এটা বলেছেন কি যে আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম মূর্তিটা বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা সমান তিন ভাগে ভাগ করে দিতে? তাহলে কেউই বঞ্চিত হবে না?”

নীলু পিসিমণির দিকে তাকাল, পিসিমণি চুপ। এ কথাটা সমরবাবু গোপন করলেন কেন? অবশ্য শান্তনুও যে সত্যি কথা বলছে তারও কোনও প্রমাণ নেই।

“বলেননি তো? তা বলবেন কেন?” শান্তনুর মুখে বিদ্রুপের হাসি, “এরকম একখানা মূর্তি বাড়িতে রেখে লাভ কী? শুধু চোর ডাকাতকে নেমন্তন্ন করে ডেকে আনা। মূর্তির কথা কি কম লোক জানে? কাকা নিজেই বলেছেন। আমি যা বলেছিলাম তাতে তো তবু ভালো একটা ব্যবস্থা হত।”

“তা কী করে হবে ভাই? ও মূর্তি কী করে বিক্রি করবেন? ও তো লকারে রাখাও বারণ শুনলাম, আপনার দাদুর নাকি সেরকমই নির্দেশ ছিল।”

“দাদুর নির্দেশ? হুঃ! বাবা আর ঠাকুমা মারা যেতে দাদু পাগলের মতো হয়ে গেছিলেন, নেশা করতে শুরু করেছিলেন, সেই সময়ে নেশার ঘোরে কয়েকজনকে মূর্তির কথাও বলেছিলেন, দেখিয়েওছিলেন। এত দিন যে কিছু হয়নি এই অনেক, বুঝলেন? আবার যখন গোলমাল শুরু হল, তখনই আমি বলেছিলাম মূর্তি বিক্রি করার কথা, কী খারাপ কথা বলেছিলাম?”

 “এসব কথা আপনি কী করে জানলেন ভাই? আপনি তো তখন একেবারেই ছোটো শুনেছি।”

“আমার মার কাছে শুনেছি। আমার কথা আপনার বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে, বুঝতে পারছি, কাকা আপনার মগজে যা ঢুকিয়ে গেছে আপনি তাই সত্যি বলে ভেবে বসে আছেন! কিন্তু কাকাই কী আপনাকে সব সত্যি কথা বলেছেন? আমার খুড়তুতো ভাইটি যে মূর্তির হীরের কত দাম হতে পারে এসব খোঁজখবর করতে শুরু করেছেন তা জানেন? তিনি যে নিজের বাবাকেই শাসিয়েছিলেন মূর্তিটা তাঁকে না দেওয়া হলে তিনি নিজেই নিয়ে নেবেন, মূর্তিটা আমার প্রাপ্য শুনে আমাকে মারতে এসেছিলেন – জানেন সে কথা? বলেছেন এসব কথা কাকা আপনাকে? জানি কিচ্ছু বলেননি!” শান্তনু আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে চলে গেল।

“শান্তনুবাবু এসব কী বলে গেলেন পিসিমণি? এসব সত্যি বলে মনে হয় তোমার?” নীলু জিজ্ঞেস করল।

পিসিমণি কোনও উত্তর দিলেন না, গম্ভীর মুখে চুপ করে রইলেন।

সীতাংশুর কাছে নতুন কিছু জানা গেল না, তার ওই একই কথা, সে রাতে সে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছিল, রাতে সন্দেহজনক কিছুই দেখেনি বা শোনেনি।

“আপনি শুনলাম মূর্তির গলার হারে যে হীরেটা আছে তার কত দাম হতে পারে সে সম্পর্কে খোঁজখবর করতে শুরু করেছিলেন?” পিসিমণি জিজ্ঞেস করলেন, “স্যাকরার দোকানে গেছিলেন নিশ্চয়ই। আপনার বাবা তো মনে হয় না মূর্তি নিয়ে যেতে দিয়েছিলেন বলে, আপনি নিশ্চয়ই ফটো তুলে নিয়ে গেছিলেন, সেটাই দেখান না ভাই, যে জিনিসটা নিয়ে এত কাণ্ড এখনও অবধি সেটা চোখে দেখা তো দূরের কথা, তার একটা ছবি অবধি দেখলাম না!”

সীতাংশু কটমট করে পিসিমণির দিকে তাকাল, পিসিমণির কথা ভুল সে কথা যেমন বলল না তেমন ফটো দেখানোরও কোনও ইচ্ছে প্রকাশ করল না।

দেখেশুনে পিসিমণি শুধু বললেন, “সমরবাবুর অংশের সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। যে দরজা খোলা ছিল সেটা এইটা মানে আপনার আর আপনার বাবার অংশর বৈঠকখানার মাঝের দরজাটা। দারোগাবাবু কি সন্দেহ করছেন তা নিশ্চয়ই আর আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না ভাই।”

সীতাংশুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, দু হাতে কপালের রগ টিপে ধরে সে সেখানেই বসে রইল। নীলুকে নিয়ে পিসিমণি নীচে নেমে এলেন।

গেটের সামনে তখনও কয়েকজন দাঁড়িয়ে, অতনু রয়েছে সেখানে। বলা বাহুল্য, এরকম খুনের ঘটনা এলাকায় যথেষ্ট চাঞ্চল্যর সৃষ্টি করেছে।

“সমরবাবুকে তো আজ চিনি না, অনেক বছর ধরেই দেখছি, কিন্তু নিজের কাছে যে এরকম একখানা দামি জিনিস রেখে দিয়েছেন তা কোনওদিন জানতাম না। যা শুনলাম তাতে তো মনে হচ্ছে ওই মূর্তির জন্যেই এত কাণ্ড!” এক ভদ্রলোক অতনুকে বললেন।

“আর বলবেন না! সেই ভোর থেকে যা চলছে! থানা পুলিশ! আর পারা যাচ্ছে না! যা মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে! তার ওপর আবার আরেক গোয়েন্দা এসে হাজির, কাকা নাকি তার কাছে গেছিলেন! এই যে ইনি,” চোখ মুখ বিকৃত করে অতনু পিসিমণিকে দেখিয়ে বলল।

যে ভদ্রলোককে কথাটা বলে হল তিনি পিসিমণির দিকে তাকালেন, বেশ অবাক হয়েছেন পিসিমণিকে দেখে বোঝা গেল, বললেন, “আপনার কাছে গেছিলেন সমরবাবু?”

পিসিমণি কিন্তু বেশ সপ্রতিভভাবেই উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ ভাই, সমরবাবু আশঙ্কা করছিলেন মূর্তিটা চুরি যেতে পারে, কিন্তু এ যা হল!”

“সত্যিই! বাড়িতে ঢুকে এভাবে খুন করে গেল!” ভদ্রলোক শিউরে উঠে চুপ করে গেলেন, তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, “সমরবাবু কিন্তু ওষুধ ভালো দিতেন, আমার পাশের বাড়ির বিশ্বাসদার আঙুলের গাঁটের ব্যথাটা তো উনিই সারালেন দেখলাম।”

“ভালো না মন্দ জানি না! আমার কখনও দরকার হয়নি, কোনও দিন খাইনি, তাই বলতে পারব না! সেই ভোর থেকে ঝামেলা চলছে আর আপনি পড়লেন হোমিওপ্যাথি ওষুধ নিয়ে!” বলল অতনু, বেশ বিরক্ত হয়েই।

যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা এবার চলে গেলেন।

পিসিমণি অতনুর দিকে তাকাতেই সে তেরিয়া হয়ে বলল, “এবার আপনি বলুন কী জানতে চান?”

“জানতে আর কী চাইব ভাই? মূর্তি নিয়ে অশান্তি তো লেগেই ছিল, সমরবাবু চেষ্টা করেও আটকাতে পারলেন না, যা দুর্ঘটনা ঘটার তা তো হয়েই গেল। যান ভাই, আপনি যান, যা ধকল যাচ্ছে আপনাদের ওপর!”

অতনু আর দাঁড়াল না, ঢুকে গেল বাড়ির ভেতর।

“ও নীলু, মেজাজ দেখছি এ বাড়ির কারুরই তেমন সুবিধের নয় বাবা!” পিসিমণি মন্তব্য করলেন।

একটি অল্প বয়সী ছেলে গেটের বাইরে একটু দূরে তখনও দাঁড়িয়ে। বছর কুড়ি একুশ বয়স, একেবারে সাধারণ জামাকাপড়, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, তার মুখ চোখ দেখে মনে হয় আকস্মিক এই ঘটনার ধাক্কা সে এখনও সামলে উঠতে পারেনি। পিসিমণিকে বেরিয়ে আসতে দেখে এগিয়ে গেল।

পিসিমণি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে বলল, “আমি মানস, জেঠুর গাড়ি চালাতাম। গতকাল আমিই জেঠুকে আপনার বাড়িতে নিয়ে গেছিলাম, আপনার ফোন নম্বরও আমিই জোগাড় করে দিয়েছিলাম।”

“তাই ভাবছি কোথায় দেখেছি তোমাকে, সমরবাবু গাড়িতে ওঠার সময়ে তুমিই তো দরজাটা খুলে দিলে,” পিসিমণি বললেন।

মানস ঘাড় কাত করল।

“সমরবাবু গাড়িতে কোথাও গেলে তুমিই কি সব সময় নিয়ে যেতে নাকি অন্য কাউকেও ডাকতেন?”

“না না সব সময় আমিই নিয়ে যেতাম। তবে ইদানীং বাড়ি ছেড়ে প্রায় বেরোতেই চাইতেন না, কী জানি কী হয়েছিল, যেন মনে হত খুব ভয়ে ভয়ে আছেন, আগে কিন্তু এরকম ছিলেন না, জানেন? হঠাৎ একদিন গ্রিল দিয়ে বারান্দাটা ঘিরলেন, আমিই তো মিস্ত্রি ডেকে আনলাম। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। অনেক সময়ে টুকটাক জিনিসপত্রও কিনে আনতে বলতেন, ফোনে বলে দিতেন, আমি বাড়িতে এনে দিতাম। আজ শুনছি কীসব মূর্তি টূর্তির ব্যাপার!”

পিসিমণি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশ দেখলেন, তারপর বললেন, “এখানে নয়, চলো ওদিকে কোথাও যাই, কথা বলতে সুবিধে হবে।”

সমরের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বড়ো রাস্তাটা থেকে যেখানে একটা গলি বেরিয়ে বাঁ দিকে ঢুকে গেছে, ঠিক সেই মুখে একটা বড়ো, ঝাঁকড়া বট গাছ, তার গোড়াটা বেদীর মতো করে গোল করে বাঁধানো, দিব্যি বসা যায়।

“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে গেল! বুড়ো বয়সে যা খাটা খাটনি হচ্ছে বাছা তা আর বলার নয়,” পিসিমণি সেখানেই বসে পড়ে বললেন, “বোসো, তুমিও বোসো, সমরবাবুর ছেলে, ভাইপোদের সঙ্গে কথা বললাম, তোমার সঙ্গেও বলি। হ্যাঁ রে নীলু, তোকে কি চোদ্দবার ‘বোসো বোসো’ করতে হবে, তবে বসবি? এই বেলা একটু জিরিয়ে নাও, বাড়ি ফিরতে কত দেরি হবে কে জানে!”

“দেখো বাছা, এ খুনের ব্যাপার,” পিসিমণি মানসকে বললেন, “যা জিজ্ঞেস করি তার ঠিক ঠিক জবাব দাও তো। তুমিই তো আমার ফোন নম্বর জোগাড় করে এনে দিয়েছিলে, তাহলে বুঝতেই তো পারছ সমরবাবু কোনও কারণে চিন্তিত ছিলেন।”

“আমি যা জানি সব আপনাকে বলব বড়দি, জেঠুর খুনী ধরা পড়ুক এ আমি সব সময় চাই,” মানস দৃঢ় কন্ঠে বলল।

“বেশ। এখন মনে করে বলো দেখি, কিছু দিন আগে সমরবাবু বেরোচ্ছিলেন, তুমি গাড়ি বার করেছিলেন, এমন সময় সমরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে দুজন ভদ্রলোক আসেন? তাদের মধ্যে একজন এখানকারই? গেটের সামনে দাঁড়িয়েই সমরবাবু তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, একজনের হাতে খবরের কাগজে মোড়া কী একটা জিনিস ছিল বড়দি, সেটা খুলে জেঠুকে দেখিয়েছিলেন, বেশ বড়ো, বাঁধানো ছবির মতো,” মানসের মনে পড়তে বিন্দু মাত্র সময় লাগল না, “আরও কেন মনে আছে জানেন? জেঠু খুব উত্তেজিত হয়ে গেছিলেন সেদিন। মনে হল যেন ভদ্রলোক দুজনকে গেট থেকেই তাড়িয়ে দিলেন। গাড়িতে উঠতে উঠতেও রাগে গজগজ করছিলেন!”

“তুমি কিছু জিজ্ঞেস করোনি?”

“আমি শুধু একবার বলেছিলাম, ‘কিছু হয়েছে জেঠু?’ তাতে উনি বললেন, ‘না না কিছু হয়নি,’ এরপর আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমি ওনার ড্রাইভার, বেশি কিছু জানতে চাওয়া কি আমার উচিত? আপনিই বলুন বড়দি?”

“তা তো বটেই! ওঁর কাছে কারা কারা আসতেন, মানে বন্ধু বান্ধব তো নিশ্চয়ই ছিল কিছু, কারা জানো?”

“এদিককার কয়েকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে ভালোই আলাপ ছিল, সবাই ওই জেঠুর মতোই হবেন, কয়েকজন একটু বড়োও বা ছোটোও হতে পারেন, মানে আমি বলতে চাইছি যে সবাই বয়স্ক। সবার নাম তো বলতে পারব না, যাঁদের জানি বলছি। যেমন সিদ্ধার্থবাবু, এ পাড়াতেই থাকেন, তাছাড়া দিলীপ পাত্র, ধীমান সামন্ত, জয়ন্তবাবু বলে আরও একজন। আরও কয়েকজন ছিলেন। ধীমানবাবু তো এই ছিলেন, কথা বলছিলেন।”

“এঁদের সঙ্গে যাওয়া আসা ছিল বলছ?”

“এই তো এখানে বসেই সবাই গল্প করতেন, আবার কখনও কখনও স্টেশনের ওদিককার একটা চায়ের দোকানেও বসতেন। চাটা খেতেন, গল্প গুজবও হত। তবে সেসব আগে, ইদানীং জেঠু বাড়ি ছেড়ে বেরোতেন না বললেই চলে। এঁরা বসেন এখনও, জেঠু আসতেন না।”

“ও নীলু, তার মানে এঁদের সঙ্গে তো দেখা করতেই হয় বাবা, অন্তত দু একজনের সঙ্গে তো বটেই।”

“আমি নিয়ে যেতে পারি বড়দি, আমি বাড়ি চিনি।”

“সমরবাবু তো হোমিওপ্যাথির নেশা ছিল শুনেছিলাম, অনেককে নাকি ওষুধ দিতেন, তুমি জানো?”

“শুধু দিতেন না, অনেকের কাছ থেকে একটা পয়সা অবধি নিতেন না জেঠু, নিলেও শুধু ওষুধের দামটুকু। আমিই তো কিছু হলে আগে ওঁর কাছেই আসি, আমার মাকেও ওষুধ দিয়েছেন, কোনোদিন একটা পয়সাও নেননি। অনেক লোক আসত দেখাতে। ওঁর বাড়ির লোকজন, ভাইপোরা, ছেলে তো খেতই। রাত বিরেতে কেউ এলেও বিরক্ত হতেন না।”

“শান্তনু মানে সমরবাবুর বড়ো ভাইপোর তো দোকান আছে, হার্ডওয়ারের, কোথায় দোকান, কেমন চলে, জানো কিছু তুমি?”

“হ্যাঁ, জানব না কেন? রেল গেট বাজারে দোকান, শ্রীকৃষ্ণ হার্ডওয়ার,” মানস বলল, “খুব বড়ো দোকান, সব রকম মাল থাকে, দারুণ চলে বড়দি।”

“এই শ্রীকৃষ্ণ  হার্ডওয়ারে বল্টু বলে একজন কাজ করে, তাকে চেনো নাকি?”

বল্টুর নাম শুনে মানস খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল, “কেন চিনব না বড়দি? বল্টু তো আমাদের পাড়াতেই থাকে। বেশ কয়েক বছর হল শ্রীকৃষ্ণ হার্ডওয়ারে কাজ করছে।”

“এখন কি দোকান খোলা না দুপুরে বন্ধ থাকে? ওর সঙ্গেও কথা বলতে পারলে ভালো হত, তুমি নিয়ে যেতে পারবে?”

“সে তো হবে না বড়দি, বল্টু তো নেই এখানে।”

“নেই এখানে? কবে থেকে?”

“তা এক সপ্তাহ তো হবে মনে হয়।”

“ওরকম মনে হয় টনে হয় বললে চলবে না বাছা, ঠিক করে বলো,” পিসিমণি যেন একটু বিরক্ত, “আজকাল দেখি সবাই সব কিছুতেই খালি মনে হয় বলে, ঠিক করে কিছু বলতে খুব অসুবিধে? কবে গেল?”

বকুনি খেয়ে মানস দাঁতে ঠোঁট কামড়ে খুব মনে করার চেষ্টা করতে লাগল।

পিসিমণি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা গত বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার ছিল ও এখানে?”

“গত বেস্পতিবার বা শুক্রবার? না না বড়দি বেস্পতিবারের আগেই চলে গেছে,” মানস বলল, “সোমবার বড়দি, মনে পড়েছে, সোমবার রাতের বাসে গেছে।”

“রাতের বাসে? দূরে কোথাও গেল নাকি বাছা?”

“শিলিগুড়ি। ওর এক দিদির বিয়ে হয়েছে ওখানে, জামাইবাবু ওদিককার কোন একটা রুটে যেন বেশ বাস চালায়। ও কোনও দিন যায়নি, এই গেল, বলল ‘দার্জিলিং ঘুরে আসব, এই সুযোগ, জামাইবাবু নিয়ে যাবে বলেছে।’ পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে গেছে বড়দি, তবে আমাকে বলল, ‘কোত্থাও যাই না, ছুটি নিই না, অ্যাদ্দিন বাদে বেরোচ্ছি, কুড়ি দিন হলেও পরোয়া নেই!’ আমি আপনাকে বললাম বড়দি,আপনি আবার বলে দেবেন না যেন। আসলে কী জানেন তো, জেঠুর ছেলে বা ভাইপোরা কেউই জেঠুর মতো নয়, সব কীরকম যেন!”

“না বাছা আমি নিজের দরকারে জানছি, কাউকে বলে দেওয়ার জন্যে নয়। তার মানে তুমি নিশ্চিত যে গত বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার বল্টু এখানে ছিল না?”

“না না বড়দি, আমি তো বললামই সোমবার গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়েছে, এই দেখুন আমাকে একটা ফটোও পাঠিয়েছে ওর জামাইবাবুর সঙ্গে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে। দাঁড়ান দেখাচ্ছি,” মানস ফোন বার করল, এই দেখুন ফটো।”

পিসিমণি তো দেখলেনই, নীলুও দেখল।

“একটা দোকানের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে পিসিমণি দেখো, শিলিগুড়িই,” নীলু বলল, ফটোটাকে জুম করে দেখতে দেখতে।

“হুঁ, দেখলাম,” পিসিমণির সংক্ষিপ্ত উত্তর।

“তার মানে পিসিমণি…” নীলু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পিসিমণি বলতে দিলেন না, ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তার মানে কী তাও কি ব্যাখ্যা করে বলতে হবে বাছা?” তারপর মানসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরেকটা কথা বলো। গতকাল আমাদের ওখান থেকে ফেরার পর তোমার সঙ্গে আর দেখা হয়েছিল সমরবাবুর? বা ফোনে কথা হয়েছিল?”

“না আর দেখা হয়নি, আমি জেঠুকে নামিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেছিলাম। তবে রাত ন’টা নাগাদ একবার ফোন করেছিলেন। বললেন যে সোমবার সাড়ে ন’টা পৌনে দশটার মধ্যেই চলে আসতে, কোথাও যাবেন, নিয়ে যেতে হবে।”

“কোথায় যাবেন বলেননি? তুমি জিজ্ঞেসও করোনি?”

“আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। আসলে আমার তো এই কাজ, ড্রাইভারি, বি এ পরীক্ষা দিয়েছি, এখনও রেজাল্ট বেরোয়নি। গাড়ি চালানো শিখেছিলাম, কয়েকটা বাড়ির গাড়ি চালাই, যার যখন দরকার ডাকে। তাই জেঠুকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবেন, অনেক দেরি হবে কীনা, বারোটার সময়ে আমার আবার আরেকজনকে নিয়ে যাওয়ার কথা। বললেন কাছেই যাবেন, দেরিও হবে না, খুব বেশী হলে এক ঘন্টা।”

“ব্যাঙ্কেই যেতেন মনে হয় পিসিমণি। মূর্তিটা বাড়িতে রাখা যে বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরেছিলেন যদিও শেষ রক্ষা হল না!” বলল নীলু।

“সবাই কী মূর্তি মূর্তি বলছে বড়দি? কীসের মূর্তি? খুব দামি কিছু? ওই জন্যেই জেঠুকে মেরে ফেলল?” মানস জিজ্ঞেস করল, শেষ দিকে ওর গলা ধরে গেল।

“হ্যাঁ বাছা তাই তো মনে হচ্ছে, ওই মূর্তির জন্যেই এত কাণ্ড! তবে তোমাকে একটা কথা বলি। নেহাত কাজের সময় অকাজের কথা বলতে আমার মোটে ভালো লাগে না, তাই এতক্ষণ বলিনি, কিন্তু আর না বলেও পারছি না। বলি তুমি কোন আক্কেলে আমাকে তখন থেকে বড়দি বড়দি করে যাচ্ছ? এদিকে আমার নীলুর থেকেও ছোটো!”

মানস অপ্রস্তুত হয়ে মাথা টাথা চুলকে বলল, “আপনাকে সবাই ওই নামেই ডাকে বলে শুনেছি, জেঠুও তাই বললেন, তাই আর কী…। আমি তাহলে কী বলব? এই দাদা যা বলে মানে পিসিমণি?”

“হায় রে আমার পোড়া কপাল! এও কি একটা জিজ্ঞেস করার মতো কথা বাছা! ওসব যাক, এখনও অনেক কাজ বাকি, কিন্তু ও নীলু, পেটে যে ছুঁচোর কেত্তন চলছে বাবা! অনেক বেলা হল, কিছু না খেলেই যে নয়। একটা হোটেল টোটেল দেখ না!”

সত্যি কথা বেলা আড়াইটে বাজে, সেই সাড়ে সাতটার সময়ে অল্প কিছু খেয়ে বেরিয়েছিলেন পিসিমণিরা, তারপর থেকে আর পেটে দানাপানি পড়েনি, খিদে পাওয়া তো স্বাভাবিক।

একখানা ফাস্ট ফুডের দোকানে পিসিমণিকে নিয়ে ঢুকল নীলু, মানসই বলে দিয়েছিল।            

“এই ভালো। এখন অনেক কাজ আছে। একগাদা ভাত খেলে শরীর ঢিসঢিস করবে, তার থেকে হালকা কিছু খাওয়া যাক,” বললেন পিসিমণি।

ভেজ পিৎজার অর্ডার দিল নীলু। নীলুর তো বটেই, পিসিমণিও খুব ভালোবাসেন পিৎজা খেতে।

“এখন আবার কী কাজ পিসিমণি? বাড়ি যাবে না এখন?” খেতে খেতে নীলু বলল।

পিসিমণি কিন্তু উত্তর দিলেন না, এক মনে খেয়ে যেতে লাগলেন।

“ও পিসিমণি বললে না তো কী কাজ আছে?”

“তুই নাকি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে চাস নীলু? আর এটুকুও বুঝছিস না যে এই এত লোকের ভিড়ভাড়ে এসব কথা না বলাই ভালো। খুনের রহস্য বলে কথা!”

এরপর আর নীলুরও চুপচাপ খেয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও গতি রইল না।

 অদিতি ভট্টাচার্যের আরো লেখা               জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s