নাটক চিচিং ফাঁক কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বসন্ত ২০২০

জয়ঢাকের নাট্যশালাঃ 
হাবুদের ডালকুকুরে , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরাতন ভৃত্য যোগীনদাদা –রবীন্দ্রনাথের কবিতার নাট্যরূপঃ (তাপস শঙ্কর ব্রহ্মচারী)  রাজপুত্তুর(কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)   সেলফিশ জায়েন্ট- (অনুপম চক্রবর্তী,) পুজোর প্রস্তুতি(আশুতোষ ভট্টাচার্য) , অমৃতযাত্রী(কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)

[আরব্য রজনীর কাহিনী অবলম্বনে অপেরা-নাটক]

চিচিং ফাঁক

মঞ্চনাট্য/সঙ্গীত/সুরারোপ – কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

[কয়েকটি কথাঃ নাটকটি নৃত্যনাট্য বা অপেরা–নাটক, দু’ভাবেই মঞ্চস্থ করা যায়। গানগুলিতে সুরারোপ করা আছে, আর তার জন্য লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ বাঞ্ছনীয়। যোগাযোগ – ৯৮৩০০-৭৫২২১]

————————————————————————————————

(প্রথম দৃশ্য। কাশেমের প্রাসাদ। বান্দা-বাঁদির দলের সমবেত নৃত্য)

গান–১ (বান্দা-বাঁদির দল)
———————————-
এই প্রাসাদের আমরা সবাই বান্দা-বাঁদির দল
দিনগুলি উচ্ছল আমাদের যৌবনে উচ্ছল।।
ঐ আকাশে খুশির তুফান উছলে ওঠে,
এই বাতাসে হাসির দোলা চলকে ওঠে,
এই দুনিয়ার দিল্লাগীতে দিল হল চঞ্চল।।
আমরা জনাব তোমাদেরই অনেককালের চেনা,
ইতিহাসের মানুষ মোরা মোহর দিয়ে কেনা
জনাব মোহর দিয়ে কেনা।।
ঐ দুনিয়ায় খুশির হাওয়া বয় যে বেগে,
এই প্রাসাদে হরদিন রই আমরা জেগে,
দুখের কাঁটায় জিন্দেগীটা মোদের টলমল।।
(গানের মধ্যেই হঠাৎ কাশেমের প্রবেশ। মুহূর্তে নাচগান স্তব্ধ)

কাশেমঃ
খামোশ! দিনদুপুরে কাজকাম ফেলে নাচা অউর গানা!
কে করবে রসুই সাফ, কে পাকাবে খানা?
এতগুলো বান্দা-বাঁদি, সবক’টা বজ্জাত।
ধারি না কারও ধাত।
যে হাটে কিনেছি সব, সেই হাটে গিয়ে
আসব বেচে দিয়ে।আবদাল্লা!

আবদাল্লাঃ       
জাঁহাপনা!

কাশেমঃ         
সন্ধেবেলা নাচা-গানা, খানা-পিনার আসর। রসুইঘরে গিয়ে
খোঁজ নিয়ে সব যা যা লাগে, রাখিস কিনে নিয়ে।
দেখিস, ওরা মশহুর আদমি,পায় যেন ঠিক কদর।
আর মর্জিনা!

মর্জিনাঃ          
হুজুর!

কাশেমঃ         
বহুৎ বড়া নাচিয়ে তুই, তাই না?
আজ বিকেলে সেজেগুজে থাকিস।
দেখব কেমন নাচিস।
সুরের নেশায়, সুরার নেশায় দিস মাতিয়ে—
কাজিকে আজ বেহুঁশ করে
সব জায়গীর নিই হাতিয়ে—
তারপর? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
এ মুল্‌ক থেকে সে মুল্‌ক,
পাহাড়, গঞ্জ, শহর—
ধন, রত্ন, হীরে, মুক্তো, মণি, মানিক, মোহর—
মোহর, আরও মোহর, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…

[আলো নিভে আসে ]


(দ্বিতীয় দৃশ্য। গানের সঙ্গে মূল চরিত্রদের ক্রমান্বয়ে প্রবেশ ও প্রস্থান)

গান–২ (সূত্রধার)
ও-ও-ও-ও
রূপকথা শোনো রূপকথা (২)
চুপ করে শুনে যাও, রূপকথা শুনে যাও, চুপ করে শুনে যাও রূপকথা।।
পারস্য নগরীতে ছিল এক ওমরাহ, কাশেম ছিল যে নাম তার।
তার এক ভাই ছিল, মনটা যে ভালো ছিল সেই ভাই আলিবাবার।
(সেই) আলি ছিল দিলদার।
(আলি) ছিল খুবই দিলদার।।
রূপকথা শোনো রূপকথা।।
কাশেমের বউ ছিল সাকিনা বেগম, তার শয়তানিটাই ছিল সার।
ওদিকে আলির বউ ফতিমা বিবি, তার সহজ সরল সংসার।
(সে যে) ছিল হদ্দ বোকার।
(সে যে) হদ্দ ছিল বোকার।।
রূপকথা শোনো রূপকথা।।
কাশেমের প্রাসাদে ছিল যে দাপট খুব, বলো দেখি সে কার?
মর্জিনা সুন্দরী সে, রূপেরই বাহার।
ছিল সেই প্রাসাদেই আরেক বান্দা, নাম আবদাল্লা ছিল যার।
খুব মজা সে করত ভাই, বলব কী সে আর।
সেই     মর্জিনা আর আবদাল্লা —
সেই দু’জনের গল্পটাই শোনাব আবার।
(সেই) চিরনতুন গল্পটাই শোনাচ্ছি আবার।।
আরবের দস্যুরা গোপন এক গুহাতে খুলেছিল এক ভাণ্ডার।
বনের মধ্যে সেই গুহাতেই রেখেছিল রত্নেরই সম্ভার।
চিচিং ফাঁক —    চিচিং ফাঁক —
খুলে গেল গুহার দ্বার —
এই মন্ত্রেই শুরু হল মোদের এ কিস্‌সার।।

[সূত্রধারের প্রস্থান। আলো নিভে যায়]

(তৃতীয় দৃশ্য। নির্জন পথ)

গান–৩ (হোসেন)
আ আ আ (আলাপ)
ঐ আসমানে আজ বাদশাহী খুশবু,
বাগিচায় ফুলের রোশনাই;
তবু পথে পথে ফেরে এক মুসাফির
তার দিলে আজ খুশ নাই (২)।।
বেহেস্তের আঙিনাতে
খোদার নিজের হাতে
লেখা আছে এই বিধান হায়,
কারও এতে দোষ নাই।।
ও আলামিন আল্লা–ও আল্লা—আ আ আ।।
দুনিয়ার দিকদারী
ভোলাও দুনিয়াদারী
পেয়ারের ফুলঝুরি জ্বালিয়ে আনো
পরির দেশের আসনাই।।                             

[প্রস্থান]

(চতুর্থ দৃশ্য। আলিবাবার ঘর)

ফতিমাঃ         
হোসেন! হোসেন!
পারি না আর ডেকে ডেকে।
এই সাতসবেরে পালিয়েছে ঘর থেকে।
বাছা আমার জানে তো—
খাবার মতো খুদকুঁড়ো নেই ঘরে।
সেই দুঃখে, ওরে
একা-একাই ঘুরিস পথে পথে!
মা হয়ে সেই দুঃখ সয়ে, থাকি বল কী মতে!

(আলির প্রবেশ)

আলিবাবা:       
বিবিজান গো বিবিজান! ও হোসেনের মা!
অমন করে দুঃখ কোরো না।
আল্লার যা হুকুম আছে তাই মানতে শেখো।
সুখের খোয়াব নাই বা এল,
জিন্দেগিভর সৎ হয়েই থেকো।

ফতিমাঃ         
চুপ করো গো, চুপ করো।
সৎ হবার বড়াই করো?
ও হোসেনের বাপ—
এই সমাজে সৎ হওয়া তো পাপ!

আলিবাবা:       
বিবিজান!

ফতিমাঃ         
কাশেম মিঞা, সেও তো তোমার ভাইজান
সবাই জানে দুশ্চরিত্র, বেইমান।
কাজী, উজির, যাদের হাতে দেশের শাসন—
ওর বাড়িতেই তাদের আসন,
তারাই ওর দোসর,
ওর বাড়িতেই খানাপিনা, নাচা-গানার আসর।
আর তুমি?
ভুখা পেটের সুখা রুটির জন্যে
কাঠ কাটতে ঘুরে বেড়াও জঙ্গলে অরণ্যে।
বলো হোসেনের বাপ,
সৎ হবার এই কি অভিশাপ?

আলিবাবা:       
বিবিজান গো বিবিজান,
সৎ হওয়াটা নয় গো অভিশাপ,
আসল কথা, হিংসে করাই পাপ।
আল্লা যদি চান, তবে
নসিব মোদের খুলে যাবে।
এসো বিবিজান—
দু’জন মিলে খোদাতালার করি জয়গান।

(দুজনে মঞ্চের সামনে এগিয়ে এসে নমাজ পড়ার ভঙ্গীতে বসে ও সুর করে গান ধরে)

আলি, ফতিমাঃ                     
ও খোদা তুমি মেহেরবান
সাফ করো অন্ধকার
দূর করো দর্দ হামার—
আলো ফুটুক জিন্দেগিতে,
জারি করো এই ফরমান।                    [আলো নিভে আসে]

(পঞ্চম দৃশ্য। কাশেমের প্রাসাদ। বান্দা-বাঁদির দল)

বান্দা-১          
দেখেছিস ভাই, দুনিয়ার এ কী দিল্লগি!
এমন খুবসুরৎ রং লেগেছে আসমানের গায়ে,
আজ যেন কোনও কাজেকামে দিল লাগে না।

বান্দা-২         
সত্যি ভাই,
রোশনাই ভরা ওই আসমান—
দেখে যেন দিল আজ আনচান।

বাঁদি-১          
আমাদের বাঁদিসম্রাজ্ঞী মর্জিনা—
ও রঙের ছোঁয়া আজ তারও গায়ে।
সুরের নূপুর তার পায়ে।

বাঁদি-২          
বাঁদিসাহেবা যেন আজ বেগমসাহেবা।
বিছিয়ে দিয়েছে রূপের গালিচা—
গানে তার মেতে ওঠে ফুলের বাগিচা।

(বান্দা-বাঁদি)-১           
আর আবদাল্লা! হায় আল্লা!
মর্জিনার রূপের জৌলুসে
দিল তার খানখান
জান তার হয়রান।

(বান্দা-বাঁদি)-২          
হায় হায়! তাই বুঝি আজ
খোজা কাক গায়ে দেবে ময়ূরের সাজ! (সমবেত হাস্য)

(মর্জিনা ও আবদাল্লার প্রবেশ ও নৃত্য। সঙ্গে বান্দা-বাঁদির দল)

গান–৪ (আবদাল্লা-মর্জিনা)

আবদাল্লাঃ                 
ওরে মর্জিনা বাঁদি—
(আয়) আজ করি শাদি, তোকে আজ করি শাদি।। (উঃ!)
বাদশা হব আমি, তোকে বেগম বানাই আয়।। (২)

মর্জিনাঃ          
কাকের পিঠে ময়ূর-পেখম কেমন লাগে হায়
(তুই) জানিস না তো তায়।।
(কথা)যা গিয়ে তুই মুখখানা তোর দেখ দেখি আয়নায়।
(তুই) দেখ দেখি আয়নায়।।

আবদাল্লাঃ                
না রে বাঁদি, ভাবিস না রে আমাকে শত্তুর
এই আমি তোর স্বপ্নে দেখা সেই রাজপুত্তুর।
তোকে নিয়ে রাজকুমারী
পক্ষীরাজে দেব পাড়ি—

মর্জিনাঃ (কথা)

এই ঝাঁটাতে চড়ে যা তুই পেরিয়ে সমুদ্দুর।
(যা রে) পেরিয়ে সমুদ্দুর।।

(MUSIC)

আবদাল্লাঃ       
(আমি) বাদশা বনেছি

মর্জিনাঃ                    
(আমি) বেগম হয়েছি
বাদশা বেগম দমদমাদম ঝগড়া করেছি।। (৩)

(ষষ্ঠ দৃশ্য। গভীর জঙ্গল)

গান–৫ (কাঠুরের দল)

হেঁইয়ো হোঃ! হেঁইয়ো হোঃ! (২)
হো –জঙ্গলে চল কাঠ কাটিতে যাই।। (২)
জঙ্গলে চল কাঠ কাটিতে
বন কেটে আজ সাফ করিতে
কাঠ বেচে চল পেটপুরে আজ খাই।।
পৌঁছেছি আজ এই যে বনের ধার—
চলবে এবার ঠকঠকাঠক কুঠার ক্ষুরধার
পড়বে গাছের সার।। (২)
তারপরে কে রাখবে ধরে—হে-এ-এ-এ হেঃ
তারপরে কে রাখবে ধরে
গাধার পিঠে বোঝাই করে
দল বেঁধে চল শহরপানে ধাই।।

(কাঠুরের দলের প্রস্থান। আলির প্রবেশ)

আলিবাবা:       
জিন্দেগিভর কুঠার হাতে কাটে,
তবুও খানা জোটে না এই পেটে।
রোজই ভাবি মনে,
যাব গভীর বনে।
ঠকঠকাঠক কুঠার মেরে বিরাট কাঠের বোঝা
একলা নিয়ে পাড়ি দেব সোজা।
এত অন্ধকার
সাহস পাই না আর।
আজ এসেছি বরাত ঠুকে গহিন বনের ধার—
যেথায় যত কাঠের রাজি করব সব সাবাড়।
খোদা মেহেরবান—সাহস দাও মনে, আলিবাবা চলে গভীর বনে।                           [প্রস্থান]

(গভীর জঙ্গল। গুহামুখ। গম্ভীর আবহ। আলির পুনরায় প্রবেশ)

গান–৬ (আলিবাবা)

এ কী             নিঃঝুম ঘন বন
হেথা              নেই কোনও লোকজন।।
এ কী             নিঃসীম এ আঁধার
ভয়ে              ছমছম করে মন।।
নেই               বাতাস, নেই শব্দ
শুধু                চারিদিক নিস্তব্ধ
হেথা              পাখি ডাকে না তো
শুধু                থমথম সারা বন।।

(হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসে অনেক ঘোড়ার খুরের শব্দ। দ্রুত আবহসঙ্গীত। আলিবাবা সচকিত)

আলিবাবা:       
এ কী! এই নির্জন বনে
কীসের শব্দ আসে কানে?
কারা যেন আসে ওই টগবগ টগবগ,
হাতে খোলা তলোয়ার লগবগ লগবগ?
দেখে প্রাণ উড়ে যায়, বাপরে!
এই গাছে চটপট
উঠে পড়ি ঝটপট,
মগডালে লুকিয়েই কাণ্ডটা দেখি চুপচাপ রে।

(আলিবাবা লুকিয়ে পড়ে। আবহ ক্রমশ জোর হতে থাকে। দস্যুদলের প্রবেশ)

গান–৭ (দস্যুদল)

হো—হা রে রে রে। (২)
আমরা আরবের দস্যুর দল, আমরা চল্লিশ জন।
এই জঙ্গলে লুকিয়ে রাখি মোদের গুপ্তধন।।
ঘোড়ায় চেপে মশাল জ্বেলে
শহর ও গ্রাম পিছে ফেলে
যাই পেরিয়ে উপত্যকা পাহাড়-জঙ্গল-বন।।
জিন্দেগিতে একটা কাজই আমরা জানি
রাতবিরেতে করি শুধু রাহাজানি। রাহাজানি।।
লুঠপাট করে মুক্তো হিরে
পিছনে আর চাই না ফিরে
এই গুহাতে নিয়ে এসে রাখি যে গোপন।।
গভীর বনের মধ্যে গোপন এই যে গুহার দ্বার
খোলার মন্ত্র আমরা ছাড়া কেউ জানে না আর
চিচিং ফাঁক, চিচিং ফাঁক, চিচিং ফাঁক।।

দস্যু সর্দারঃ     
চিচিং ফাঁক!

(গুহার দরজা খুলে যায়। দস্যুর দল একে একে বস্তা নিয়ে ঢোকে এবং রেখে বেরিয়ে আসে)

দস্যু সর্দারঃ     
চিচিং বন্ধ্‌!

(গুহার দরজা বন্ধ হয়। দস্যুদলের প্রস্থান। আলিবাবা বেরিয়ে আসে)

গান–৮ (আলিবাবা)

আরিব্বাস! এ কী কাণ্ড! (২)
আরিব্বাস, আরিব্বাস, আরিব্বাস।
আরিব্বাস! এ কী কান্ড!
(এই) বনের মধ্যে যেন আজ
লাগল লণ্ডভণ্ড।।
এই গোপন গুহা দেখে হই অবাক
খুলবে বুঝি আজ আমারই দিমাক
মন্ত্র শিখে আজ গেছি এ কী প্রকাণ্ড!
আরিব্বাস! এ কী কাণ্ড!
ওই গুহা আমি খুলব রে আবার
চুরির ধন সব করব রে সাবাড়
চিচিং ফাঁক বলে গুহার দ্বার খুলে
লুটব রত্নভাণ্ড!
আরিব্বাস! এ কী কাণ্ড!

আলিবাবা:       
চিচিং ফাঁক!

(গুহা খুলে যায়)

আলিবাবা:       
আরিব্বাস! এ কী কাণ্ড!

(আলিবাবা গুহায় প্রবেশ করে। আলো নিভে যায়)

(সপ্তম দৃশ্য। বাগিচা। মর্জিনা)

মর্জিনাঃ          

হায় আল্লা! আজ এই বাগিচার গাছে
কী খুবসুরৎ সব ফুল ফুটে আছে!
আসমান জুড়ে রঙিন শামিয়ানা—
বাতাসে যেন বেহেস্তের খুশবু!
তবুও আজ দিল কেন হয়রান!
যেন কোন অচিন মেহমান
ফুটে উঠবে আমার গুলবাগিচার ডালে।
আমি যেন সোনার খাঁচার কবুতরি।
কামনার ফুলপরি
কখন আসিবে আজি
রামধনু বেয়ে—
থাকি শুধু সেই পথ চেয়ে।
ও দর্দ মিটানেবালা—
আমার দু’আঁখি ভরে
আঁসু কেন পড়ে ঝরে।

গান–৯ (মর্জিনা)
ও দুনিয়ার মালিক—
আমি সোনার খাঁচার বাঁদি।
একলা এ আঁধারে কাঁদি।
আশারই ছলনাতে
আজি এ মধুরাতে
বেদনার সাথে করি শাদি।।

(হোসেনের প্রবেশ)

হোসেনঃ         
মর্জিনা!

মর্জিনাঃ          
হোসেন!

হোসেনঃ         
ও আমার গুলবাগিচার হুরী—
বাগিচায় ফুটেছে বসরার গোলাপ-কুঁড়ি।
আজ তবে কীসের তকলিফ তোমার?

মর্জিনাঃ          
হোসেন! আজ যেন কোন এক দর্দ
দিল ফুঁড়ে করল ছারখার।
গোলাপ যে শুকালো আমার।

হোসেনঃ         
সে কীসের দর্দ রানি,
যার ঘায়ে জখম আজ
আমার বেগমের জিন্দেগানি?

মর্জিনাঃ          
বোলো না, বোলো না মেরে রাজ।
সব আশা মেটাবার পথ কই আজ?
আমি তো সামান্য এক বাঁদি—

হোসেনঃ         
না রানি, না। নও তুমি সামান্য বাঁদি।
আমার বেগম তুমি, তোমায় করব আমি শাদি।

মর্জিনাঃ         
সত্যি, সে কি সত্যি!

হোসেনঃ         
হ্যাঁ রানি, হ্যাঁ।

মর্জিনাঃ          
হোসেন!

হোসেনঃ         
মর্জিনা!

গান–১০ (মর্জিনা-হোসেন)

ও-ও-ও-ও—
আজ দু’জনের মধুর চাওয়ায় আকাশ জুড়ে বৃষ্টি।
শাহাজাদির নয়নপাতে শাহেনশাহর দৃষ্টি।।
আজ কে খুশি আনে
ওই সুদূর আসমানে
এই ছোট দিল ভরে শবনম আজ ঝরে
জিন্দেগিতে উঠল তুফান, বাতাস লাগে মিষ্টি।।

[আলো নেভে]

(অষ্টম দৃশ্য। আলির বাড়ি। ফতিমা একা গান গায়)

গান–১১ (ফতিমা)

ও দীন-ই-ইলাহি আল্লা—
তোমার বিচার দেখে জানাই তোমায় সোভানাল্লা।।
 (এই) দীন-দুনিয়ার তুমি বাদশা,
তোমায় জানাই কেয়াবাত।
(আজ) আলোয় ভরা এই দুনিয়ায়
(শুধু) আমার ঘরেই আসে রাত।
 (দেখ) গুলাবি বেহেস্তে তোমার—ও খোদা,
ভারী আজ বেইমানি পাল্লা।।

(আলির প্রবেশ)

আলিবাবা:       
(ফিসফিস করে) বিবিজান! বিবিজান!

ফতিমাঃ         
কে? ও, তুমি? এত দেরি হল কেন?
দিল মোর করে আনচান।
পাকাব যে খানা—
ঘরে নেই গম একদানা।

আলিবাবা:       
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! খানা!
কী খাবে বিবিজান!
পোলাও, পরোটা, গোস্ত? সব হবে আনা।

ফতিমাঃ          
কী বলছ হোসেনের বাপ?
দিমাগ কি হয়েছে খারাপ?

আলিবাবা:       
না বিবিজান, না।
দিল ভালো, দিমাগ ভালো, ভালো তবিয়ত।
দুনিয়া আজ কী খুবসুরত।
ওই দ্যাখো, বাইরে আছে গাধা—
ওর পিঠে চার বস্তা বাঁধা!
ওতে আছে মোহর।
রত্ন, মানিক, মণি।
আজ আমি দুনিয়ার সেরা ধনী। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

ফতিমাঃ         
(চিৎকার) হায় হায় হায় হায়। এ কী হল আল্লা!

আলিবাবা:       
(দাবড়ায়) চুপ! কোরো নাকো হল্লা।
তোমায় বলব সব পরে।
এখন দৌড়ে যাও কাশেমের ঘরে।
মোহর মাপতে হবে, মোহর। চট করে গিয়ে
কুনকে একটা এসো চেয়ে নিয়ে।

[দ্রুত আবহ। আলো নেভে]

(নবম দৃশ্য। কাশেমের প্রাসাদ। কাঁদতে কাঁদতে সাকিনার প্রবেশ)


সাকিনাঃ         
(বিলাপ) হায় হায় হায় হায়! হায় আল্লা, হায় মেহেরবান!
এই যদি মনে ছিল তোমার,
বাঁচিয়ে রাখলে কেন সাকিনার জান?
হায় আল্লা, হায় আল্লা!                                         

(কাশেমের প্রবেশ)

কাশেমঃ         
কী হয়েছে বিবিজান, কাঁদো কীসের শোকে?

সাকিনাঃ         
দ্যাখো দ্যাখো, দ্যাখো নিজের চোখে।
আলি, তোমার ভাই
কোথা থেকে কী পেয়েছে, তাই
মাপবে বলে ফতিমা এক কুনকে চেয়েছিল।
বুদ্ধি করে আঠা দিলাম তলায়,
তাতেই এই মোহর লেগেছিল।
মোহর, মোহর, আলির কাছে মোহরের খনি—
এখন সে তোমার থেকে ধনী। হায় হায় হায় হায়!

কাশেমঃ         
খামোশ! এত মোহর পেয়েছে সে,
গুনে গুনে পায় না দিশে—
কুনকে দিয়ে মেপে নিতে হয়!
আর দেরি নয়,
এই মুহূর্তে যেতে হবে আলির বাড়িতে
মোহরের হদিশ জেনে নিতে।
কিন্তু… আলি যদি বলতে না চায়?
টুঁটি টিপে করব আদায়।
ঠিকঠাক বুঝে নিয়ে পথের নিশানা
খুঁজে নেব মোহরের আসল ঠিকানা। হাঃ হাঃ হাঃ…

[দ্রুত আবহ। আলো নেভে]

(দশম দৃশ্য। গভীর জঙ্গল। গুহার প্রবেশদ্বার দেখা যাচ্ছে। কাশেমের প্রবেশ ও নেপথ্য গানের সঙ্গে মূকাভিনয়)

গান–১২ (সূত্রধার)
ছুটল কাশেম, চলল কাশেম, ঘোড়ায় চেপে চলল
বোকা আলি যেই তাকে রাস্তা বলল—
সেই পথ ধরে কাশেম চলল।।
জঙ্গল, সেই জঙ্গল পেরিয়ে
মানুষজনের নজর এড়িয়ে
সেই গুহা, সেই গুহা, সেই গুহা খুঁজে বার করল,
চিচিং ফাঁক বলে গুহার দরজা খুলল—

(গানের শেষে কাশেম সেই গুহামুখের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘোড়া থেকে নামার ভঙ্গী)

কাশেমঃ         
চিচিং ফাঁক! (গুহা খুলে যায়)
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

(কাশেম হাসতে হাসতে গুহায় প্রবেশ করে)

কাশেমঃ         
(নেপথ্যে) চিচিং বন্ধ্‌!

(গুহার দরজা বন্ধ হয়। আলো নেভে। কাশেমের হাসি চলতেই থাকে। আলো জ্বললে দেখা যায় মঞ্চটা গুহার ভেতরের অংশ হয়ে গেছে। ইতস্তত ছড়ানো মণিমানিকের বস্তা। কাশেম হাসতে হাসতে প্রবেশ করে)

কাশেমঃ         
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। গুহা! গুহা! এই সেই গুহা!
অবশেষে পৌঁছে গেছি গুহার ভেতরে।
কত রত্ন, কত মোহর হেথায় থরে থরে।
সব, সব নিয়ে যাব থলি ভর্তি করে।
রত্ন নেব? না না, মোহর নেব।
না না, মোহর নিলে থলি হবে ভারি;
তার চেয়ে বরং মানিক
কুড়িয়ে নিই খানিক।
আর কী নেব? মুক্তো। হিরে। মণি।
হাঃ হাঃ হাঃ। এবার আমি সবার সেরা ধনী।
ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করে
ফিরে যাব নিজের ঘরে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
কিন্তু—কী যেন সেই গুহা খোলার মন্ত্র?
কী যেন সেই ডাক?
কী যেন বেশ ফাঁকা!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, গুহা ফাঁক! না না, মোহর ফাঁক! না না—হায় আল্লা!

(নেপথ্যে ঘোড়ার খুরের শব্দ)

আলু ফাঁক! পটল ফাঁক! বেগুন ফাঁক!

দস্যু সর্দার (নেপথ্যে)।            
চিচিং ফাঁক!!

(গুহার দরজা খোলে। দস্যুর দল প্রবেশ করে ও সকলে মিলে ঘিরে ধরে কাশেমকে হত্যা করে। দস্যুদের হাসি ও কাশেমের আর্তনাদ মিশে যায় আবহের সঙ্গে। আলো নেভে)

(একাদশ দৃশ্য। নেপথ্যে আজানের শব্দ। আলিবাবার প্রবেশ)

আলিঃ           
মর্জিনা! মর্জিনা!

(মর্জিনা প্রবেশ করে)

মর্জিনাঃ         
(সেলাম করে) হুকুম দিন হুজুর।

আলিঃ           
মালকিন কোথায় তোর? জলদি গিয়ে বল—
খারাপ খবর নিয়ে সাথে
আলি ভাই এসেছে এই রাতে।

মর্জিনাঃ         
কী খবর, মালিক?

আলিঃ           
মর্জিনা কেউ যেন না জানে—
কাশেমভাই গিয়েছিল রত্নের সন্ধানে।
ফিরবে না সে আর—
গাধার পিঠে ঝুলিয়ে আমি এনেছি লাশ তার।

মর্জিনাঃ         
(চমকে উঠে) হুজুর!

আলিঃ           
খবরদার! জানবে না কেউ আর।
টুকরো করে কাটা লাশ
যায় না দেওয়া গোর,
এবার খেল তোর।
মুস্তাফা যে মুচি আছে শাহীর বাজারে,
আনতে হবে তারে।
শুধু তুই পারবি মর্জিনাঃ

মর্জিনাঃ          
(সেলাম করে) যো হুকুম জাঁহাপনা।

[আলো নেভে]

(দ্বাদশ দৃশ্য। মুস্তাফার দোকান। মুস্তাফা বসে জুতো সেলাই করছে। মর্জিনার প্রবেশ)

মর্জিনাঃ         
বাবা মুস্তাফা!

মুস্তাফাঃ          
কে তুমি, বিবিজান?

মর্জিনাঃ          
আমি, বাবা মুস্তাফাঃ
তোমার জান পহচান।

মুস্তাফাঃ         
কে তুমি বেহেস্তের পরী ?

মর্জিনাঃ          
মর্জিনা আমি।

মুস্তাফাঃ         
আমার কাছে কী চাই, বিবিজান?

মর্জিনাঃ         
বাবা! মোর দিল হল হয়রান,
জান হল কুরবান।
শুনেছি দারুণ নাকি সেলাই-ফোঁড়াই তুমি করো—
ফাটা দিল জুড়ে দিতে পারো?

মুস্তাফাঃ         
অতটা পারি না। তবে হ্যাঁ,
ঠিকমতো ইনাম যদি পাই,
ছেঁড়া লাশ বিলকুল করে দি’ সেলাই।

মর্জিনাঃ          
তাই নাকি, বাবা? তাহলে… পাবে।

মুস্তাফাঃ         
(চমকে ওঠে) কী বলো, বিবি? সত্যি লাশ জুড়ে দিতে হবে?

মর্জিনাঃ          
একশো মোহর পাবে।

মুস্তাফাঃ         
অত ঝুঁকি একশো মোহরে? উঁহু।

মর্জিনাঃ          
দু’শো মোহর।

মুস্তাফাঃ         
উঁহু।

মর্জিনাঃ         
পাঁচশো মোহর পাবে।

মুস্তাফাঃ
(চোখ বিস্ফারিত) পাঁচশো মোহর!

মর্জিনাঃ         
(ওড়না খুলে হাতে নিয়ে) চোখ বাঁধো বাবা মুস্তাফাঃ
যেতে হবে শরিফ আদমির ঘরে।
চিনতে যেন না পারো পরে। (চোখ বাঁধে)

মুস্তাফাঃ         
এ কী, বিবিজান? করো কী? করো কী?              (মর্জিনার হাসি)

(ধীরে ধীরে দু’জনের প্রস্থান। আলো নেভে)

(ত্রয়োদশ দৃশ্য। জঙ্গলে গুহার সম্মুখ। ঘোড়ার শব্দ। দস্যুদলের প্রবেশ)

দস্যু সর্দারঃ     
চিচিং ফাঁক!

(গুহার দরজা খুলে যায়)

দস্যু সর্দারঃ     
রহমত! আরাফত! (দুটি দস্যু সামনে এগিয়ে আসে)
দেখে আয় গুহার অন্দরে
মাল সব ঠিকঠাক আছে নাকি পড়ে।

দুই দস্যুঃ                 
জী সর্দার।

(দুই দস্যু গুহার ভেতর প্রবেশ করে। সর্দার দলের সামনে পায়চারি করে)

দস্যু সর্দারঃ     
(স্বগত) বহুদিন ধরে এই গুপ্ত কোষাগার
এই ছিল আমাদের রত্নের ভাণ্ডার।
তামাম মুলুক জুড়ে কেউ যার পায়নি সন্ধান,
সে খোঁজ কেমন করে পেলি তুই কাফের শয়তান?
দ্যাখ তবে তোর সেই লোভের পরিণাম—
তোর লাশ নিয়ে গিয়ে টাঙাব শহরের মাঝে,
সে-ই হবে জব্বর ইনাম।

(চিৎকার করতে করতে দুই দস্যু গুহা থেকে বেরিয়ে আসে)

দুই দস্যুঃ                 
সর্দার! সর্দার! লাশ গায়েব!

দস্যু সর্দারঃ     
(চিৎকার) খামোশ! লাশ গায়েব?
তার মানে আরও কোন শয়তান
পেয়ে গেছে এ গুহার সন্ধান।
ভাইসব, তৈরি হও। লড়তে হবে দুশমনের সাথে।
কে সেই বেইমান? সন্ধান চাই আজ রাতে।
চার টুকরো করা লাশ—
সেলাই-ফোঁড়াই ছাড়া হবে না কবর।
তোলপাড় করো সারা শহর।
এ শহরে যত মুচি আছে
খোঁজ নাও সকলের কাছে।
সন্ধান পেলেই—

সকলেঃ
(সকলে তলোয়ার উঁচু করে একসঙ্গে মেলায়)       খতম!

[আলো নেভে]

(চতুর্দশ দৃশ্য। নেপথ্যে সূত্রধারের গান। গানের সঙ্গে এইরকম মূকাভিনয় হয়—একজন দস্যু মুস্তাফাকে মোহরের থলি দেখায়। মুস্তাফা প্রথমে রাজি হয় না, তারপর রাজি হয়। দস্যু তার চোখ বেঁধে তাকে নিয়ে চলা এবং এদিকে ওদিকে খোঁজার ভঙ্গী করে। অবশেষে মুস্তাফা একটা বাড়ি দেখালে দস্যু  তলোয়ার তুলে ইশারা করে। অন্য দস্যুরা এসে বাড়িটা ঘিরে ফেলে)

গান–১৩ (সূত্রধার)
তারপরে সেই রাতে চল্লিশ দস্যুতে যুক্তি করে
সেই ঘন বন থেকে বেরিয়ে একে একে যায় শহরে।
সারাটা শহর জুড়ে
তোলপাড় করে ফেরে দস্যুর দল —
শেষকালে খোঁজ পেয়ে পৌঁছোয় মুস্তাফা মুচির ঘরে।।
মুস্তাফা, বাবা মুস্তাফা, বুড়ো মুস্তাফা, মুচি মুস্তাফা—
মোহরের থলি দেখে বিবেক-টিবেক সব রইল চাপা।
লোভেতে হয়ে অন্ধ,       চোখদুটি করে বন্ধ,
আলির বাড়ি চেনায় সেই পথ ধরে।।
তারপরে ঘটল কী
বলো তবে করল কী দস্যুর দল—
সেই বাড়ি চিনে নিয়ে যায় চলে খড়ি দিয়ে মার্কা করে,
মার্কা করে, মার্কা করে।।

[আলো নেভে]

(পঞ্চদশ দৃশ্য। কাশেমের প্রাসাদ। ধনী আলিবাবার গানবাজনার আসর)

আরবী যন্ত্রসঙ্গীতের সঙ্গে বান্দা-বাঁদিদের জিপসি নৃত্য
(নাচের শেষে ছদ্মবেশী দস্যু সর্দারের প্রবেশ)

দস্যু সর্দারঃ     
সালামালেকুম! সালামালেকুম!

আলিবাবা:       
(উঠে দাঁড়িয়ে) আলাইকুম সালাম। (আলির ইশারায় বান্দা-বাঁদিদের প্রস্থান)

জনাব! আপনার পরিচয়?

দস্যু সর্দারঃ     
আমি এক ভিনদেশি সওদাগর,
আরব আমার ঘর।
এসেছিলাম এই শহরে তেলের সওদায়।
চল্লিশটা পিপে সঙ্গে আছে।
রাহাজানি হয় পাছে, আজ রাত্রে তাই
আপনার মেহমান হতে চাই।

আলিবাবা:       
জরুর! জরুর! আল্লা যদি চান
তবেই ঘরে আসেন মেহমান। মর্জিনা!

(মর্জিনার প্রবেশ)

মর্জিনাঃ         
হুজুর!

আলিবাবা:       
মর্জিনা, ঘরে আজ নয়া মেহমান—
এঁর সম্মানে আজ হবে নাচগান।
জ্বালা রোশনাই, পাকা খানা,
নিয়ে আয় বাদশাহী শরাব।

মর্জিনাঃ          
যো হুকুম, জনাব।

[আলো নেভে]

(ষোড়শ দৃশ্য। মঞ্চে মৃদু আলো। মর্জিনা প্রবেশ করে)

মর্জিনাঃ          
(চাপা উত্তেজিত স্বরে) আবদাল্লা! আবদাল্লা!

(আবদাল্লার প্রবেশ)

আবদাল্লাঃ         
হায় আল্লা! কী হয়েছে, মর্জিনা বেগম?
নফরকে আজ পড়ছে কেন ডাক?

মর্জিনাঃ          
আরে, তোর ইয়ার্কি রাখ।
এদিকে যে সাড়ে সর্বনাশ!
ভিনদেশি ওই যে ব্যাবসাদার
ও আসলে ডাকুর সর্দার।

আবদাল্লাঃ       
হায় আল্লা! বুঝলি কী করে?

মর্জিনাঃ         
বলছি শোন তোরে।
চল্লিশটা পিপে ওই রাখলি যে ঢুকিয়ে
ওর মধ্যে ডাকুরা সব আছে যে লুকিয়ে।
সময় সুযোগ এলেই
ইশারাটা পেলেই
বেরিয়ে ওরা সব্বাইকে করে দেবে খতম।

আবদাল্লাঃ       
হায় আল্লা! কী করবি তবে?

মর্জিনাঃ         
সাবাড় করতে হবে।
শোন বলি, রসুইঘরে গিয়ে
এক কড়া তেল গরম করে নিয়ে
পিপের মধ্যে ঢেলে দিয়ে নেব সবার জান—
তারপরে খেল দেখবে শুধু নতুন মেহমান।

(আলো নেভে। দ্রুত জোর আবহ বাজে। তারপরেই মঞ্চ জুড়ে রঙিন আলোর খেলা। নেপথ্যে আর্ত চিৎকার। ধীরে ধীরে চিৎকার কমে আসে। নাচের বাজনা শুরু হয়)

(সপ্তদশ দৃশ্য। মেহফিল। মর্জিনার ছোরাসহ নৃত্য)

গান–১৪ (মর্জিনা)
ধিকিধিকি—ধিকিধিকি—
ধিকিধিকি এই আগুন
ফাগুন হয়ে রাঙাল প্রাণ।
ঝিকিমিকি এই ছুরির ফলায় বিজলির তুফান।
(বুঝি) এই জান হল হয়রান (২)
বুঝি এই জান হল হয়রান—হয়রান।।
আঁখি চিকিমিকি চলকায়
আ আ আ—
এই আগুনের হল্কায়
দিল মোর হল খানখান (২)।
(বুঝি) এই জান দেবে কুরবান (২)
বুঝি এই জান দেবে কুরবান —কুরবান।।
এই ছুরি ঘোরে বনবন
জিন্দেগিটা হয় চনমন (২) — আ আ আ—
যত নফরত দুশমন
এই ছুরি নেবে জান (২)।
(হবে) খতম আজ যত বেইমান (২)
খতম হবে যত বেইমান—

(নাচতে নাচতেই মর্জিনা হঠাৎ ছুরি বসিয়ে দেয় দস্যু সর্দারের বুকে। এক মুহূর্তে সমস্ত গানবাজনা স্তব্ধ হয়ে যায়। আর্ত চিৎকার সহ দস্যু সর্দারের মৃত্যু। সকলেই হতচকিত)

আলিবাবা:       
একি! মর্জিনা! এ কী দুঃসাহস তোর?
যে ছিল আমার মেহমান—
নিলি তার জান!
নিমকহারাম! বেইমান!

মর্জিনাঃ          
জাঁহাপনা! জনাব!
গুস্তাখি করুন মাফ।
বিচার করুন কে আসল বেইমান।
আমি? নাকি এই ছদ্মবেশী শয়তান।
(টান মেরে গোঁফ-দাড়ি আর গায়ের আলখাল্লা খুলে দেয়। বেরিয়ে পড়ে ডাকাতের পোশাক)

সবাই।           
(বিস্ময়) এ কী! এ কে?

মর্জিনাঃ         
এই সেই ডাকুর সর্দার,
যার গুহা থেকে সব রত্নের পাহাড়
আমাদের মনিব করেছেন সাবাড়।
প্রতিশোধ নিতে আজ এসেছিল এই মেহফিলে।
সক্কলকে করত খতম
আমার এই ছুরি ওর জান না নিলে
ওর সঙ্গে ছিল আরও চল্লিশ ডাকাত,
পিপের মধ্যে গরম তেলে হয়েছে তারা কাত।

সবাইঃ           
সাবাশ মর্জিনা! সাবাশ!

আলিবাবা:       
মর্জিনা! বেটি!

মর্জিনাঃ        
জাঁহাপনা! এ কী বলে ডাকলেন আমায়?

আলিবাবা:       
হাঁ, বেটি। এই নামই আজ তোকে মানায়।
আজ থেকে তুই নয় বাঁদি—
হোসেনের সাথে আজ হবে তোর শাদি।
আর যত বান্দা-বাঁদি আমার প্রাসাদে
সবার মুক্তি আজ থেকে।
দুনিয়ায় বান্দা-বাঁদি আর কেউ নয়
মানুষ হিসেবে শুধু হোক পরিচয়।

সবাইঃ           
জয়, মর্জিনার জয়।

(সকলে ধীরে ধীরে মর্জিনা আর হোসেনের চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায়। আলিবাবার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন ফতিমা আর সাকিনাঃশুরু হয় নাচগান)

গান–১৫ (সমবেত)
ঐ গুলবাগিচায়—
ঐ গুলবাগিচায় ফুল ফুটেছে, দেখিস তোরা তা কি—
পেয়ার ভরা এই বেহেস্তে আজ ডাক পেয়েছে সাকি।।
আ—আ—আ—আ—
মর্জিনা সে ছিল বাঁদি
হোসেনকে আজ করল শাদি। (২)
তাই ওড়ে ওই আসমানে আজ স্বপ্নেরই ওড়না কি।
স্বপ্নেরই ওড়না কি।।
আ—আ—আ—আ—
(জয়) মর্জিনারই জয়,
দামাল মেয়ে আজ কাটাল দুশমনেরই ভয়।।
একলা মেয়ে করল কামাল
সবকিছু আজ দিল সামাল। (২)
বান্দা-বাঁদির দুঃখটা সে একাই দিল ঢাকি।
একাই দিল ঢাকি।।
আ—আ—আ—আ—

(সকলে মঞ্চের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। পর্দা নেমে আসে)

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s