জয়দীপ চক্রবর্তীর আগের লেখাঃ নিবারণ চক্কোত্তির হাতঘড়ি, গোলমেলে গন্ধ, আলোর কাছে ফেরা
পরিদাদুর সঙ্গে বহরমপুরে
জয়দীপ চক্রবর্তী
ট্রেন বহরমপুরে ঢুকল যখন তখন বেশ রাত হয়েছে। শাওনদের অবশ্য চিন্তা ছিল না। বিমানদাদু বলেই দিয়েছিলেন, একবার বহরমপুরে এসে নামলেই হল, বাকি চিন্তা তাঁর। বিমান ঘোষাল অরুণাংশুর মামা। বেহালার বনেদি পরিবারে জন্ম। সে বাড়ি গমগম করত একসময়ে। কলকাতার বহু বিখ্যাত মানুষের পায়ের ধুলোয় ধন্য হয়েছে সেই একান্নবর্তী পরিবারের মস্ত দোতলা বাড়ি। বিমানদাদুর সঙ্গে যে কয়েকবার কথা হয়েছে এর আগে, সেইসব পুরনো দিনের কথাই ফলাও করে গল্প শুনিয়েছেন তিনি শাওনকে। কলকাতার অনেক বনেদি বাড়ির মতনই সে বাড়ির এখন আর অস্তিত্ব নেই। শরিকি বিবাদ, প্রোমোটারের লোভ, পরিবারের মানুষজনের রুজির জন্যে নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়া—এই সবকিছুর জন্যেই ঘোষালবাড়িও বিক্রি হয়ে, ভেঙেচুরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অনেক আগেই। পৈতৃক বাড়ি বিক্রি হয়ে যাবার পরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এখন বহরমপুর থেকে খানিক দূরে, কাশিমবাজারের কাছাকাছি একটা গ্রামে অনেকখানি জায়গা কিনে থিতু হয়েছেন বিমানদাদুরা। বিমানদাদুরা মানে দাদু এবং দিদা। ওঁদের সন্তান নেই। বহরমপুরে থিতু হবার এটাও একটা কারণ। বিমানদাদুর শ্বশুরবাড়ি যেহেতু ওইখানে, তাঁর আশা শেষ জীবনে দরকারে-অদরকারে ওদের সাহায্য পাবেন তিনি এবং তা তিনি পানও। কয়েকমাস ধরেই প্রায়ই ফোন করে তিনি বাবাকে বলছিলেন পরিদাদুকে নিয়ে একবার তাঁর ওখানে যেতে। পরিদাদু নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন, অরুণাংশুরও অফিসে সবসময় ছুটি মেলে না। অথচ বিমানদাদু তাড়া দিয়েই চলেছেন ক্রমাগত। অরুণাংশু একাধিকবার জিজ্ঞেস করেছেন, “তুমি যে পরিকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলছ এত করে, কোনও বিশেষ কারণ আছে কি?”
“তা একটা আছে।” তিনি অস্বীকার করেননি। তবে কারণটা যে ঠিক কী, তাও খোলসা করতে চাননি কিছুতেই।
সুছন্দা কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছেন অরুণাংশুকে, “কী ব্যাপার, বলো তো?”
“আমি কী করে জানব বলো দেখি!” দু’দিকে অসহায়ের মতন মাথা নেড়ে বলেন অরুণাংশু, “জানোই তো, মেজোমামা খেয়ালি মানুষ। কী ব্যাপার নিজে থেকে না বললে বোঝা তো মুশকিলই।”
“এমনিতে ঠিকই ছিল।” সুছন্দা চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলেন, “পরিকাকুকে নিয়ে যেতে বলছে যখন কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপার তো নিশ্চিত আছে। আমার বাপু শানুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে ভয় করছে।”
শানু বিছানায় বসে অঙ্ক কষছিল। মা-র কথা শুনেই বলে উঠল, “আমি কি ছেলেমানুষ নাকি? পরিদাদুর সঙ্গে কত ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটই তো সামলে এলাম এতদিন। এখনও আমাকে নিয়ে তোমার এত ভয়! পরিদাদু সঙ্গে থাকলে আমরা অজেয়, এই কথাটা সবসময় মনে রাখবে।”
শেষ কথাটা বুক ফুলিয়ে এমনভাবে বলল শানু যে অরুণাংশু আর সুছন্দা দু’জনেই হো হো করে হেসে উঠলেন।
পরিদাদুই শেষপর্যন্ত দিনক্ষণ ঠিক করলেন নিজের কাজকর্ম, শাওনের স্কুল, অরুণাংশুর অফিস সবকিছু মাথায় রেখে। শনি-রবি সঙ্গে নিয়ে দিন চারেকের জন্যে একটা প্রোগ্রাম শিডিউল করা হল। পরিদাদু বললেন, “এই যথেষ্ট। প্রয়োজন যাই হোক, এর চেয়ে বেশিদিন ওখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না বাপু।”
“আমিও পারব না।” অরুণাংশু মাথা নেড়ে বললেন।
সুছন্দাও তাঁদের কথায় সায় দিয়ে বললেন, “পাগল নাকি? হুট বলতে এককাঁড়ি দিন স্কুল কামাই করে বহরমপুরে বসে থাকলে শাওনের পড়াশুনো এক্কেবারে লাটে উঠে যাবে। ছেলেটার নিজের তো মনেই থাকে না যে ক্রমশ উঁচু ক্লাসে উঠে যাচ্ছে ও।”
অতএব বিমানদাদু অন্তত সপ্তাহখানেকের ছুটি নিয়ে যাবার বায়না করলেও ওখানে বেড়ানোর জন্যে ওই চারদিনই স্থির হল।
বহরমপুর ঢোকার মিনিট পনেরো আগেই অরুণাংশু বিমান ঘোষালকে ফোন করেছিলেন। তিনি অভয় দিয়েছেন, অতি উৎসাহে তখনই তিনি স্টেশনে পৌঁছে গেছেন।
পরিদাদুরা ট্রেন থেকে নামতেই বিমান ঘোষাল এগিয়ে এলেন। তিনি রিটায়ার করেছেন বছর পনেরো, কিন্তু তাঁর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েনি। বেশ ঋজু, বলিষ্ঠ চেহারা। মুখে মৃদু হাসি। দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা সরল এবং আমুদে। একগাল হাসি নিয়ে পরিদাদুর দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। “বাকি তিনজনকেই যেহেতু চিনি, পরিচয় করিয়ে দেবার আর দরকার নেই। নিশ্চিত আপনিই পরিমলবাবু?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।” পরিদাদুও হাসলেন।
“আসুন, আসুন।” বিমানদাদু পরিদাদুর দিকে হাত বাড়িয়ে এগোতে বললেন। বাকিদের উদ্দেশ্যেও বললেন, “আমি একটা টুকটুক নিয়ে এসেছি। স্টেশনের বাইরেই রাখা আছে। বেশ হাওয়া খেতে খেতে চলে যাওয়া যাবে। বেশি নয়, এখান থেকে আমার বাড়ি টুকটুকে গেলে বড়োজোর মিনিট চল্লিশের পথ।”
“এমন করে আমাকে যদি আপনি-আজ্ঞে করতে থাকেন তাহলে যাই কী করে বলুন?” পরিদাদু হালকা হেসে বললেন বিমানদাদুকে।
বিমানদাদুও হাসলেন। “হাজার হোক, আপনার সঙ্গে প্রথম আলাপ। শুরুতেই তুমি করে কথা বললে আপনিই হয়তো অভদ্র ভাবতেন আমাকে।”
“আবার আপনি?’ পরিদাদু ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বললেন, “আমি কিন্তু আপনার অরুণের বন্ধু। তার মানে হল আপনি আমারও মামা। কাজে-কাজেই…”
“বেশ বেশ,” বিমানদাদু মাথা নাড়েন, ‘তাই হল নাহয়। এখন চলো তো হে। আমার টুকটুকের ড্রাইভার মইদুল এবার চিন্তায় পড়ে যাবে। ট্রেন অনেকক্ষণ প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গেছে। বেচারা ভাববে আমি তোমাদের খুঁজেই পাইনি হয়তো।”
শাওন নিচু গলায় অরুণাংশুকে জিজ্ঞেস করল, “টুকটুক আবার কী গাড়ি বাবা?”
বিমান ঘোষাল তার প্রশ্ন শুনতে পেয়েই বোধহয় শাওনের দিকে চাইলেন। “গাড়িটার নাম শুনে অবাক হচ্ছ তো?”
“এমন নাম আগে কখনও শুনিনি।” লাজুক গলায় বলে শাওন।
“তোমাদের ওখানে যাকে টোটো বলো, আমরা এখানে তাকেই টুকটুক বলি। বুঝলে শানুবাবু?”
“ও!” অবাক হয়ে বলে শানু।
হেঁটে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াতেই মইদুলকে দেখতে পেয়ে গেল ওরা। ওদের জন্যে বেচারা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এসে অপেক্ষা করছিল। এখন তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সুছন্দার হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় কেড়েই নিল মইদুল। বলল, “ব্যাগটা তো বেশ ভারি। আমাকে দিন বউদি।”
মইদুলের টুকটুক চলতে শুরু করল।
পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশে বেশ বড়ো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় রাতের শহর ঘুমিয়ে পড়ার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে এখন। মিনিট পনেরোর মধ্যেই শহর ছেড়ে শাওনরা ফাঁকা গ্রামের রাস্তা ধরল। রাস্তার দু’ধারে বেশ গাছপালা রয়েছে। কোথাও ঘন ঝোপঝাড়। মইদুল শাওনকে বলল, “প্রায়ই শেয়ালের দল এসে দাঁড়িয়ে থাকে এই রাস্তায়।”
“তাই নাকি?” উৎসাহিত গলায় বলে শাওন, “আজও দেখতে পাব?”
“তা তো বলতে পারি না বাবু,” মইদুল হাসে, “দেখা যাক।”
দুই
বিমানদাদুর বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় রাত্তির সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। ঠাকুরমা দরজা খুলে দিয়েই দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন শাওনকে। তার থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বললেন, “কতদিন পরে তোমায় আবার দেখলাম দাদুভাই!”
অরুণাংশু সুছন্দা নিচু হয়ে প্রণাম করলেন তাঁকে। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “বেঁচে থাকো বাবা তোমরা। সুখে থাকো।” পরিদাদুর দিকে চেয়ে একগাল হেসে বললেন, “তুমিই তাহলে আমাদের পরিবাবু? অনেক কথা শুনেছি তোমার নামে। বড্ড গুণী ছেলে তুমি আমার। দেখা যাক, অনেক আশা নিয়ে তোমার মামা তোমাকে ডেকে এনেছেন। নিশ্চিত একটা কিছু সুরাহা হবে এইবার।”
শাওন মনে মনে চমকে উঠল। ঠাকুরমার কথায় একটা জিনিস পরিষ্কার। পরিদাদুকে নিয়ে এখানে আসার জন্যে বিমানদাদু যে বারবার বাবাকে, মাকে তাড়া লাগাচ্ছিলেন, তা নিছক এখানে এসে ক’দিন বেড়িয়ে যাবার জন্যে নয়। এখানে কিছু একটা রহস্যের গন্ধ আছে। একটা কিছু সমাধান না হওয়া জটিল অঙ্ক। এখন পরিদাদুর সাহায্যে সেই সমাধান না হওয়া অঙ্কের উত্তর খুঁজতে চাইছেন এঁরা। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে আনন্দে লাফিয়ে উঠল শাওন।
পরিদাদুর চোখ সরু হয়ে গেল। ঠাকুরমার দিকে চেয়ে কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কীসের সুরাহা মামি?”
“আচ্ছা আচ্ছা, সেসব কথা কাল হবে’খন।” বিমানদাদু তাড়া দিলেন, “যাও যাও, হাতমুখ ধুয়ে রাস্তার জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হও দিকিনি আগে। তারপর চলো এক রাউন্ড চা খাই সবাই মিলে।”
“এই রাত বারোটার সময় চা? তাহলে ডিনার হবে কখন?” সুছন্দা বলে ওঠেন।
“তা অবশ্য ঠিক।” দাদু একবার দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলেন, “রাত অবিশ্যি সত্যিই অনেক হয়েছে।”
“তবুও চা এক কাপ হলে মন্দ হত না কিন্তু মামা।” পরিদাদু হেসে বলেন, “আপনি আমারই মতন চাতাল দেখছি।”
“ওই এক বায়না তোমার মামার।” ঠাকুরমা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে পরিদাদুর দিকে চেয়ে বললেন, “এক-দু’ঘণ্টা অন্তর-অন্তরই চা বানানোর অর্ডার।”
“আমি চিনি ছাড়া লিকার।” বিমানদাদু পরিদাদুর দিকে চেয়ে বলেন, “তোমার দুধ-চিনি চলবে তো?”
“আজ্ঞে না, আমিও আপনারই দলে।”
“সুগার আছে নাকি?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“প্রিকশান।” পরিদাদু হাসেন। “আমাদের বংশে টাইপ টু ডায়াবেটিসের হিস্ট্রি আছে। তাছাড়া চায়ের সঙ্গে চিনি বা দুধ কোনোটাই ভালো জিনিস নয়। স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকরই বলা যেতে পারে।”
“এমন ভাব করছ পরিকাকু, যেন শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কতই না সচেতন তুমি।” সুছন্দা হাসেন।
“নাও নাও, এখন তর্কের সময় নয়। তৈরি হয়ে নাও। একসঙ্গে টেবিলে গোল হয়ে বসে আমরা আড্ডা মারব আজ।” বিমানদাদু হাসতে হাসতে বলে উঠলেন।
প্রসঙ্গটা উঠল চায়ের টেবিলেই। চায়ের কাপে আরাম করে গোটা দুই-তিন চুমুক মারার পরপরই বিমানদাদুর চোখের ওপরে চোখ রাখলেন পরিদাদু। “বলুন, আমাকে এমন করে তলব করলেন কেন? কী সমস্যার সুরাহার কথা বলছিলেন মামি?”
“তেমন কিছু নয়।” বিমানদাদু একটু অপ্রস্তুত মুখে বললেন, “একটা অনুমানই বলতে পারো। তোমার মামির বাপের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা পারিবারিক গল্প। গল্প বলছি এইজন্যেই যে আমার নিজের এ ব্যাপারটা তেমন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি কোনোদিনই। বরং মনে হয়েছে পুরো ব্যাপারটাই নিছক একটা মজা। একটা খেয়াল। কিন্তু আমার শালাবাবু আর তার ছেলে তা মানে না। এমনকি তোমাদের মামিও বিশ্বাস করেন কথাগুলো আজগুবি খেয়ালখুশির প্রলাপ নয়। ওর আপাত অর্থহীন দেহের ভেতরে অন্য কিছু মানে আছে। ইদানীং আমার শালার শরীর বড়ো একটা ভালো যাচ্ছে না। তোমাকে বলতে আপত্তি নেই, ক্যানসার ডিটেকটেড হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন আয়ু বড়োজোর আর মাস ছয়েক। মূলত ওর মানসিক তৃপ্তির জন্যেই তোমাকে এখানে আনার প্রস্তাব দিই।
“যাই হোক, আবার বলছি, আমি নিজে এসব পাত্তা দেবার মতন বিষয় বলে মনে করি না। তাই গুরুত্ব দিতেও চাই না। তোমরা এসেছ, চেষ্টা করেছ এবং বুঝেছ ওটা নিছকই একটা মজা—এটাই ওর সামনে এস্টাব্লিশ করতে চাইছি। আর কিছু নয়।”
“অদ্ভুত ব্যাপার তো।” পরিদাদু কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে চা শেষ করেন। “কিন্তু বারবার যে বিষয়টাকে গল্প বা খেয়াল বলে হালকা করতে চাইছেন আপনি, সেটা কী?”
“একটা লেখা।”
“কার লেখা?”
“আমার শ্বশুরমশাই ঈশ্বর দিলীপকুমার সেনের। একটা খাতার পাতায় লেখা কয়েকটা মাত্র পঙক্তি। রহস্যটা তার মধ্যেই।”
“লেখাটা কী বিষয়ে?” পরিদাদুর চোখে মুখে গভীর আগ্রহ। শাওন লক্ষ করছিল আড়চোখে।
“আজ অনেক রাত হয়েছে। আজ আর এ নিয়ে কথা নয়। কাল ওদের বাড়ি দশটা-সাড়ে দশটার দিকে আমরা যাব এমনই বলে রেখেছি। ওখানে গিয়েই বাকি কথা বলা যাবে’খন।”
বিমানদাদু একটু থামলেন। তারপর খুক খুক করে দু’বার কেশে নিয়ে বললেন, “আবারও বলছি, বিষয়টা খুব সিরিয়াসলি নেবার দরকার নেই। দু-তিনদিনের জন্যে এসেছ, চারদিকটা ঘুরে-টুরে দেখো ভালো করে। তার ফাঁকে একটু মাথা খাটিয়ে দেখতে পারো আদৌ ব্যাপারটার কোনও মানে-টানে আছে কি না।”
“বেশ।” পরিদাদু হাসলেন। “তবে কী জানেন তো, যত আগে জানতে পারি তত আগে থেকেই মাথাটাকে খাটাতে পারি, এই আর কী। ওইজন্যেই জানার জন্যে তাড়াহুড়ো। সত্যি বলতে কী, আমি তো গোয়েন্দা নই। পুলিশ-টুলিশেও চাকরি করিনি কোনোদিন। সেনাবাহিনীতে ছিলাম। তাও টেকনিক্যাল উইং-এ। বলতে পারেন মিসট্রি সলভ করাটা আমার একটা হবি। একটা ভালোলাগা। কাজেই আজই যদি লেখাটা কী তা জানতে পারতাম…”
“সেটা হবার নয় পরি।” বিমানদাদু দু’দিকে মাথা নাড়লেন। “আমার লেখাটা মনে নেই। আসলে এমনই পারস্পরিক সম্পর্করহিত কয়েকটা বাক্য… ওটা ওদের ওখানে গিয়েই দেখতে হবে কাল।”
“এতসব ব্যাপার-স্যাপার এখানে! আমিও তো কিছুই জানতাম না গো এতদিন।” এতক্ষণ চুপ করে সব শুনে অরুণাংশু বলে ওঠেন।
“আমিও জানতাম না কিচ্ছু।” সুছন্দাও চোখ গোল গোল করে বলেন, “এ যে একেবারে গোয়েন্দা গল্পের মতনই ব্যাপার গো পরিকাকু।” তারপর শাওনের দিকে ফিরে বলেন, “শাওন, দেখ তোর পরিদাদু কী করতে পারে এইবার। মামার কাছে আমাদের মানসম্মান এখন তোর পরিদাদুরই হাতে।”
সুছন্দা এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সকলে হই হই করে হেসে উঠল। পরিদাদুও। শুধু শাওন হাসল না। পরিদাদুর দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠল শাওন, “রহস্য সহজ হোক বা জটিল, পরিদাদু তার সমাধান করতে ঠিক পারবেন। আমি নিশ্চিত।”
“বলছিস?” অরুণাংশু হালকা গলায় বলেন শাওনের সঙ্গে মজা করার ঢঙে।
“বলছি।” আবার বলে শাওন।
“পরি, তোমার এমন অন্ধ ভক্ত আর কোথাও পাবে না হে।” অরুণাংশু হেসে বলেন, “আচ্ছা চ্যালা তৈরি করেছ তুমি।”
সকলে আবার একবার হেসে ওঠে অরুণাংশুর কথা শুনে।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না শাওনের। আবার একটা রহস্যের হাতছানি। কখন যে রাতটা শেষ হয়ে কালকের দিনটা আসবে? মনে মনে একেবারে ছটফট করছিল শাওন।
তিন
বিমানদাদুর বাড়ি থেকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। হেঁটে গেলে বড়োজোর মিনিট কুড়ি-পঁচিশ। বিমানদাদু বলছিলেন, “এই চত্বরে সেনবাবুদের দালানবাড়ি বললে যে কেউ চোখ বুজে দেখিয়ে দেবে। একসময় এই সেনরা মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে অত্যন্ত বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। এত নিখুঁত এবং অব্যর্থ কবিরাজি চিকিৎসা আশেপাশের আর কোনও জনপদে কেউ করেছেন কি না সন্দেহ। তাছাড়া আমার শ্বশুরমশাই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন মধ্য তিরিশে। মাত্র বেয়াল্লিশ বছর বয়েসে দুই ছেলেমেয়ে আর আমার শাশুড়ি মাকে রেখে সেই যে নিরুদ্দেশ হলেন, আর ফিরে এলেন না কোনোদিন। কেউ বলে পুলিশের গুলিতে মারা যান তিনি। আবার কেউ বলেন আন্দামানে ছিলেন দীর্ঘদিন দেশান্তরের শাস্তি মাথায় নিয়ে। পরে ওখানেই মারা যান জেলে অথবা মেয়াদ শেষে ভারতবর্ষে ফিরে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যান হিমালয়ে।”
“ইন্টারেস্টিং।” পরিদাদু বলেন।
“তিনি চলে যাবার পরে মামির মা একা হাতে সামলালেন কী করে সব!” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন অবাক হয়ে।
“সেন পরিবার বিত্তে আর সম্মানে এই এলাকার রহিস আদমিদের মধ্যেই পড়তেন সেই নবাবের আমল থেকেই। বাবা যখন নিরুদ্দেশ হলেন, তখন সেই বিত্তে টান পড়েছে অনেকটাই। সামান্য সম্বলের ওপরে ভরসা করে মাকে খুবই কষ্ট করতে হয়েছিল ছেলেমেয়েকে নিয়ে। অবশিষ্ট জমিজিরেত বিক্রিবাটা করে, বাগান-পুকুর লিজ দিয়ে চালিয়ে নিতে হয়েছে কায়ক্লেশে। আর সেই করতে গিয়ে এখন পুরনো বসতবাড়িটি ছাড়া সেন-পরিবারের সবই গেছে। একসময়কার ধন্বন্তরি বিদ্যার অধিকারীও কেউ নেই, সে জৌলুসেরও অবশিষ্ট নেই কিচ্ছুটি।”
“ইশ!” সুছন্দা বলে উঠলেন।
পরিদাদু বললেন, “এইটুকু পথ হেঁটেই যাই চলুন। গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগবে আমাদের।”
“তা যাওয়া যেতেই পারে।” অরুণাংশু মাথার ওপরে দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সায় দেন পরিদাদুর কথায়, “যেরকম জম্পেশ খাওয়াচ্ছ সকাল থেকে, একটু হাঁটাহাঁটি হলে সত্যিই বড়ো উপকার হয়।”
বিমানদাদু হাঁ হাঁ করে প্রতিবাদ করে উঠলেন, “বলো কী হে? আমার শানুদাদু এই রোদ্দুরে অতটা পথ হেঁটে যাবে তা আবার হয় নাকি?”
শাওন বলে উঠল, “খুব পারব দাদু। তুমি তো জানোই না পরিদাদুর সঙ্গে কত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি আমি। এইটুকু হাঁটা কোনও ব্যাপারই নয়। আমি কি ছোটো আছি নাকি এখনও?”
“তুমি খুব বড়ো হয়েছ। মস্ত বড়ো হয়েছ।” ঠাকুরমা এসে শাওনের গাল টিপে আদর করে বলেন, “তবু হেঁটে যাবার দরকার নেই। মইদুলকে বলাই আছে। টুকটুক নিয়ে এসে যাবে এক্ষুনি। আমি আর সুছন্দা থাকছি। রান্নাবান্না সব সামলে নেব’খন দু’জনে মিলে। তোমরা গাড়ি চেপেই চলে যাও। কষ্ট কম হবে, সময়ও বাঁচবে।”
দু-এক কথা হতে না হতেই সত্যিই মইদুল এসে পড়ল গাড়ি নিয়ে। বিমানদাদু বললেন, “ব্যস, আর চিন্তা নেই। আমার রথ এসে গেছে। দেরি না করে চটপট উঠে পড়ো সব্বাই।”
সেনেদের বাড়ি পৌঁছতে ঠিক মিনিট কুড়িই লাগল। বাড়িটা বড়সড়ই। এককালে যে এ-বাড়ির জৌলুস ছিল, বড়ো বড়ো থাম আর কারুকার্য করা খিলানগুলোর দিকে চাইলেই বোঝা যায়। কিন্তু এখন বাড়িটার একেবারেই ভগ্নদশা। একদিকের পাঁচিল ধসে পড়েছে। পলেস্তারা খসে পড়েছে অধিকাংশ জায়গায়। ছাদের ওপরে পাঁচিলের গা ফাটিয়ে অশ্বত্থগাছ মাথা তুলেছে আকাশের দিকে।
বাড়িতে ঢোকার মুখে গাড়িবারান্দা। সেখানেই মইদুল তার টোটো রেখে দিল। বলল, “আপনারা ভেতরে যান। আমি এখানেই আছি।”
“ওমা, এখানে থাকবে কেন? তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো। তোমাকে তো আমরা পর ভাবি না। তুমি আমাদের পরিবারেরই একজন।” বিমানদাদু প্রতিবাদ করে উঠলেন।
“সে তো বটেই।” মইদুল মাথা নাড়ে, “সেসব ভেবে বলিনি দাদা। আসলে বাইরে থাকতে ভালো লাগছে।”
“না না, তা হবে না।” বলতে বলতে একজন সৌম্যদর্শন যুবক সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। পরনে জিন্স এবং পাঞ্জাবি।
মইদুল হেসে ফেলল। “জিষ্ণুদা, তুমি বললে আমাকে ভেতরে যেতেই হবে জানি। তোমাকে অমান্য করার সাধ্য আমার নেই।”
বিমানদাদু হেসে বললেন, “আলাপ করিয়ে দিই, এই হচ্ছে আমাদের ফেমাস পরিমল, আর পরি, এই আমাদের জিষ্ণুবাবু, আমার একমাত্র শ্যালক চিত্তরঞ্জনের পুত্র। ভারি ভালো ছেলে। ইংরেজিতে এম.এ. করেছে। চাকরি-বাকরি পায়নি এখনও। টিউশন পড়ায় আর বাবার দোকান সামলায় মায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।”
“আমার প্রশস্তি গাইবার জন্যে কি পথের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি পিসো?” জিষ্ণু মিষ্টি করে হাসে। “ভেতরে এসো, বাবা অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্যে।”
জিষ্ণুর কথার সহজিয়া-ভাবে পরিদাদু হেসে উঠলেন, “ঠিক বলেছ। চলো আমরা ভিতরে যাই।”
চিত্তরঞ্জন সেন বিছানায় শুয়ে ছিলেন। পরিদাদুরা ঘরে ঢুকতেই উঠে বসলেন তিনি। দু’হাত জোড় করে পরিদাদুর দিকে নমস্কার করে বললেন, “আপনিই পরিমলবাবু তো?”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়লেন পরিদাদু।
“আপনার কথা অনেক শুনেছি।”
পরিদাদু মৃদু হাসলেন।
ঘরে আগে থেকেই চেয়ার এনে রাখা ছিল। জিষ্ণু আরও দু’খানা চেয়ার আনল পাশের ঘর থেকে। সকলের দিকে চেয়ে বলল, “বসুন।”
মইদুল বলল, “আপনারা কথা বলুন, সেই ফাঁকে আমি বরং টুক করে একটা কাজ সেরে আসি। চিন্তা করবেন না, আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসছি।”
“মা চা বসিয়েছে। খেয়ে যাও।” জিষ্ণু বলে।
“এসে খাচ্ছি।” মইদুল হাসে। চিত্তরঞ্জন বুঝতে পারছিলেন পারিবারিক কথাবার্তার মধ্যে মইদুল থাকতে চাইছে না। যদিও যে কথাটা বলতে চাইছেন তা এই অঞ্চলের লোকজনের কাছে অজানা নয়। তারা কেউই অবশ্য এ ব্যাপারটাকে আমল দিতে চায়নি কোনোদিন। তবুও একেবারে পারিবারিক যে সন্ধানসূত্র নিয়ে তিনি আলোচনা করতে চাইছেন আজ তা বাইরের লোকের কাছে অজানাই। কাজেই মনে মনে মইদুলের উপস্থিতিতে অস্বস্তিই হচ্ছিল তাঁর। সে নিজে থেকেই ঘুরে আসার প্রস্তাব দিতে চিত্তরঞ্জন আশ্বস্ত হলেন। বললেন, “সেই ভালো। এখানে খামোখা বসে থেকে কী বা করবি। তুই বরং ঘুরেই আয় খানিক।”
পিঠে বালিশ রেখে পা ছড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে চিত্তরঞ্জন সেন বললেন, “কিছু মনে করবেন না এইভাবে পা ছড়িয়ে বসলাম বলে। আসলে শুনেছেন বোধহয়, আমার শরীরটা ঠিক নেই।”
“হ্যাঁ, শুনেছি।” পরিদাদু বললেন, “আমাদের জন্যে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। চাইলে আপনি শুয়ে-শুয়েও কথা বলতেও পারেন।”
“না, ঠিক আছে। এটুকু পারব।” চিত্তরঞ্জন ম্লান হাসলেন।
জিষ্ণুর মা চা নিয়ে এলেন। চিত্তরঞ্জনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি খাবে?”
“দাও। হাফ কাপ। এখন আর কোনও কিছুই খেতে রুচি হয় না।”
তাঁর স্ত্রী চা দিয়ে গেলেন। বললেন, “তোমরা কথা বলো। আমি রান্নাঘরে আছি।”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কথা শুরু করলেন, “আপনাদের একটা বিশেষ কারণে আমি ডেকে পাঠাতে চেয়েছিলাম সেকথা বোধহয় আপনি শুনেছেন পরিমলবাবু।”
“শুনেছি।” পরিদাদু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন, “তবে সেই বিশেষ কারণটা যে কী, তা অবিশ্যি শোনা হয়নি এখনও।”
“সেটা আমি বলব।” বলে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন চিত্তরঞ্জন। বড়ো করে শ্বাস নিলেন বার কয়েক। তারপর অনুচ্চ স্বরে বলতে শুরু করলেন, “আমার পূর্বপুরুষেরা একসময় এই অঞ্চলের ডাকসাইটে চিকিৎসক ছিলেন সেকথা বিমানদার কাছে শুনেছেন হয়তো।”
“হ্যাঁ, শুনেছি।” এবারেও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন পরিদাদু।
“গাছ-পাতা-বাকল-শেকড়ের সঙ্গে আরও হাজারো উপাদান মিলিয়ে মিশিয়ে আশ্চর্য সব ওষুধ বানাতেন তাঁরা।” চিত্তরঞ্জন আবার বলতে শুরু করলেন, “কবিরাজ হিসেবে তাঁরা ছিলেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি।”
“আপনারা সেই বিদ্যা শেখেননি কিছু?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
“নাহ্।” দু’দিকে মাথা নাড়লেন চিত্তরঞ্জন। “ক্রমশ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার বাড়বাড়ন্ত শুরু হল। মানুষের কবিরাজি ওষুধবিষুধের ওপরে আস্থা কমল। তাছাড়া সেসব ওষুধ তৈরির অনুপানও কমতে শুরু করল এদিকের আরবানাইজেশনের সঙ্গে সঙ্গে। তাছাড়া…”
“তাছাড়া?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন কৌতূহলী হয়ে।
“বিমানদা বলেছেন কি না জানি না,” চিত্তরঞ্জনের কণ্ঠে একই সঙ্গে গর্ব ও বিষাদ মিশল, “আমার বাবা মনোরঞ্জন সেন এই পারিবারিক ধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরও বড়ো ও মহৎ কর্মযজ্ঞে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। শুনেছি অত্যন্ত মেধাবী মানুষ ছিলেন তিনি। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত নানান ভাষায় মারাত্মক পারদর্শিতা ছিল তাঁর। বাইরে থেকে বই আনাতেন। পড়াশোনাও করতেন প্রচুর। চাইলে ভালো চাকরি-বাকরি করতে পারতেন। কিন্তু খুব কম বয়েসেই ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। আমরা দুই ভাইবোন, বুঝলেন। কিন্তু বাবার স্মৃতি আমাদের দু’জনের কাছেই খুব কম। আমরা যখন খুবই ছোটো তখন থেকেই তিনি নিরুদ্দেশ। কখনোই এই সংসারে ফেরা হয়নি তাঁর।”
শাওন হাঁ করে সবকথা শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল, চিত্তরঞ্জনের গল্পের ডানায় বসে সে যেন অনেক আগের কোন সময়ে পৌঁছে গেছে।
বিমানদাদু অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। এই কথাটুকুর মধ্যেই বার দুই কবজি উলটে ঘড়ি দেখেছেন তিনি। চিত্তরঞ্জন থামতেই তিনি বলে উঠলেন, “এত কথা বলার কী দরকার, চিত্ত? এমনিতেই তোমার শরীর ভালো নেই। বেশি কথা বললে কষ্ট হবে তোমার। তুমি বরং আসল কথাটা সংক্ষেপে বলো এঁদের।”
“হ্যাঁ, তাই বলি বরং।” চায়ের কাপ এক চুমুকে শেষ করে দিয়ে বলেন চিত্তরঞ্জন, “আপনারা তো মীর জাফরের কথা সকলেই জানেন, মীর মুহম্মদ জাফর আলি খান? সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যিনি ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে সুবে বাংলার নবাব হয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, জানি তো।” শাওন বলে ওঠে, “তাঁকে হটিয়ে আবার নবাব হয়েছিলেন মীর কাশেম।”
“হয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিনের জন্যে নয়,” চিত্তরঞ্জন ম্লান হাসেন, “মাত্র বছর তিনেক। সন সতেরশো ষাট থেকে সন সতেরশো তেষট্টির জুলাই।”
“তারপর?” শাওন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“সন সতেরশো তেষট্টির পঁচিশে জুলাই আবার নবাবের সিংহাসনে ফিরে আসেন মীর জাফর। পঁয়ষট্টি সালের সতেরই জানুয়ারি মৃত্যু হয় তাঁর। সে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন নবাব।”
“বাপ রে!” অরুণাংশু বলে ওঠেন, “আপনার তো সাল তারিখ সব জলের মতন মুখস্থ দেখছি!”
“মুখস্থ এইজন্যেই যে আমাদের অজানা রহস্যের শুরু ওই মাঝের তিনটি বছরেই,” চিত্তরঞ্জন হাসলেন, “যে সময় মীর জাফর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বিমর্ষ এবং শারীরিক দিক থেকেও বিধ্বস্ত।”
“মানে!” পরিদাদু অবাক হয়ে বলেন।
“এতক্ষণ আমি যে কথাগুলো বললাম সে কথাগুলো ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে,” চিত্তরঞ্জন খানিকটা উদাস চোখে ছাদের সিলিংয়ের দিকে চেয়ে বলেন, “কিন্তু এইবার যে কথা বলব, তা কোথাও লেখা নেই। এ একেবারেই আমাদের পারিবারিক ইতিহাস, বংশপরম্পরায় যা আমরা শুনে এসেছি এতদিন।”
সকলেই নড়েচড়ে বসলেন। পরিদাদু চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কীরকম?”
চিত্তরঞ্জন বার কয়েক কাশলেন। জল খেলেন দু’ঢোঁক। তারপর আবার বলা শুরু করলেন, “তখন মীর জাফরের জামাই নবাবের মসনদে। সন সম্ভবত সতেরশো বাষট্টির শেষ অথবা তেষট্টির শুরু। মীর জাফর মানসিক ও শারীরিকভাবে খুবই বেকায়দায়। ইতিহাসে এর উল্লেখ নেই, কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে আমাদেরই পূর্বপুরুষ তারাপ্রসন্ন সেন তাঁর চিকিৎসা করেন এবং সুস্থ করে তোলেন তাঁকে।”
“বলেন কী! আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস তো মারাত্মক সমৃদ্ধ মশাই!” পরিদাদু উজ্জ্বল চোখে বলে উঠলেন।
“তারাপ্রসন্ন শুধু কবিরাজই ছিলেন না, তিনি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জ্যোতিষচর্চাও করতেন।”
“তাই নাকি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ,” মাথা নাড়লেন চিত্তরঞ্জন, “এবং যেটা আশ্চর্যের, তারাপ্রসন্ন তাঁকে গণনা করে আশ্বস্ত করেছিলেন, খুব শিগগির বাংলার মসনদ আবার ফিরে পেতে চলেছেন তিনি।”
“এবং তার পরে-পরেই মীর কাশিমের মৃত্যু এবং সত্যি-সত্যিই তাঁর নবাব হিসেবে ফিরে আসা।” অরুণাংশু বলেন।
“এগজ্যাক্টলি।” চিত্তরঞ্জন হাসেন, “দ্বিতীয়বার নবাব হবার পরে মীর জাফর খুশি হয়ে তারাপ্রসন্নকে একটি বহুমূল্য আংটি ও কিছু স্বর্ণমুদ্রা উপহার দেন।”
“সেগুলো কী হল?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করেন কৌতূহলী হয়ে।
“স্বর্ণমুদ্রাগুলি সম্ভবত আমাদের পূর্বপুরুষেরা খরচ করে ফেলেছিলেন। এই বিশাল বাড়ি বানিয়ে প্রায় জমিদারের মতনই জীবন কাটিয়েছেন তাঁরা বহুদিন। বংশপরম্পরায়।”
“রাজ অনুগ্রহও তো নিশ্চিত পেয়েছিলেন?” বিমানদাদুই বললেন এবার।
“না, তা বেশিদিন পাননি।” চিত্তরঞ্জন বলেন, “মীর জাফর তো পঁয়ষট্টিতে মারাই গেলেন। মারা যাবার আগে দু’হাতে সম্পদ উড়িয়েছেন। ইংরেজরাও তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর ওপরে।”
“আর সেই আংটিটা?” আলোচনা অন্যদিকে ঘুরে না যেতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন পরিদাদু।
“সেটা বেশ কিছুদিন এই পরিবারেই ছিল পারিবারিক সম্পত্তি হিসাবে। আমার বাবার আমল পর্যন্ত।” চিত্তরঞ্জন থামলেন।
“ছিল বলছেন, মানে এখন আর নেই?” পরিদাদুর ভুরু কুঁচকে উঠল।
“না, নেই। আমার বাবা সে আংটি বাড়িতে রাখতে রাজি হননি।”
“কেন!” শাওন জিজ্ঞেস করে অবাক হয়ে।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে চিত্তরঞ্জন হাঁপাচ্ছিলেন। অসুস্থ শরীরে একসঙ্গে এত কথা বলতে ধকল হচ্ছিল তাঁর। এতক্ষণ জিষ্ণু চুপ করে শুনছিল। এইবার চিত্তরঞ্জনের দিকে চেয়ে সে বলল, “তুমি একটু চুপ করো বাবা। তোমার কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে। আমি বলে দিচ্ছি বাকিটা।”
“সেই ভালো।” বিমানদাদুও সায় দিলেন তার কথায়।
জিষ্ণু ধীর গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করল, “আপনারা তো শুনেছেন আমার ঠাকুরদা বিপ্লবী ছিলেন। আন্দোলনের চরমপন্থায় বিশ্বাস করতেন তিনি।”
“দেশের কাজেই গৃহত্যাগ করেছিলেন তিনি।” অরুণাংশু বলে ওঠেন জিষ্ণুর কথার মাঝখানে।
“হ্যাঁ। আর ফেরেননি কোনোদিন।” জিষ্ণু মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বলে, “বাবা এবং পিসি খুবই ছোটো তখন। ঠাকুরমায়ের মুখেই আমাদের শোনা ওই আংটির কথা। তিনিই বলেছিলেন, ইংরেজের সঙ্গে হাত মেলানো বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের আংটি আমার ঠাকুরদা বাড়িতে রাখতে চাননি। তিনি ওই আংটিকে ঘৃণা করতেন। বলতেন, ওই পাপ আংটি বাড়িতে রাখা মানে অন্যায় আর বিশ্বাসঘাতকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া।”
“খুব কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন উনি। আমার শাশুড়ি প্রায়ই বলতেন।” চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী ডিশে করে মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন।
বিমানদাদু বললেন, “এসবের কী দরকার ছিল রানু? জানোই তো আজকাল মিষ্টি কেউই খেতে চায় না। অধিকাংশের সুগার, বাকিরা স্বাস্থ্য সচেতন…”
“তা হোক।” ভদ্রমহিলা মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর শাওনের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিয়ে বললেন, “আমার এই নাতিবাবু প্রথমবার আমার বাড়ি এল। সে কি শুধু মুখে চলে যাবে এখান থেকে?”
“তা ঠিক, তা ঠিক।” বিমানদাদু হাসলেন। “এ কথায় প্রতিবাদ করার উপায় নেই আমার।”
পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন, “সেই আংটি কী করলেন তিনি? আন্দোলনের কাজে ব্যয় করলেন?”
“ঠাকুরমা আমাদের তেমন কথাই বলেছিলেন। কিন্তু বছর কয়েক আগে পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে দাদুর একটা ছোট্ট নোট বই বেরোয়। সেটা পড়েই আমাদের হিসেব গোলমাল হয়ে গেল। এখন আমাদের বিশ্বাস, তেমন ইচ্ছেই হয়তো ছিল তাঁর, কিন্তু সে কাজ করে যাবার সময় সম্ভবত তিনি পাননি। কারণ, নোট বইতে লেখাটা যে সময়ে তিনি লিখেছেন, তার কিছুদিন পরেই বিশেষ মিশন নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় তাঁকে এবং আর তিনি ফেরেননি।”
“অদ্ভুত।” পরিদাদু বললেন, “কী লেখা ছিল সেই খাতায়?”
“সেই খাতার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,” বলে উঠে পড়ল জিষ্ণু। তারপর দেওয়াল আলমারির পাল্লা খুলে একটা ছোট্ট খাতা বের করে আনল। খাতায় কাগজ দিয়ে মার্কা করে রাখা একটা পৃষ্ঠা মেলে ধরল পরিদাদুর চোখের সামনে। শাওন আর অরুণাংশুও ঝুঁকে পড়ল সেই খাতার পাতার ওপরে।
অনেকটা দেবনাগরী অক্ষরের ধাঁচে অদ্ভুত সুন্দর হাতের লেখায় কালি-কলমে লেখা কয়েকটি পঙক্তি, ‘ফিরিয়া আসিয়া বন্দোবস্ত করা যাইবেক। আপাতত বিশ্বাসঘাতকের ধন রহিল ভালোবাসার পদতলে। বণিকের তুলাদণ্ড নহে, রাজমিস্ত্রীর রজ্জুই অধিকতর শ্রেয়…’
“এই কথাগুলোর কী মানে পরিদাদু?” শাওন জিজ্ঞেস করল।
“কিছু একটা মানে তো নিশ্চয়ই আছে শানুবাবু।” পরিদাদু হাসলেন।
বিমানদাদু বললেন, “ওই যে বাক্যগুলির মধ্যে এক জায়গায় লেখা আছে ‘বিশ্বাসঘাতকের ধন’, তার থেকেই এদের বিশ্বাস জন্মেছে যে আমার শ্বশুরমশাই ও-কথাটা বলে মীর জাফরের দেওয়া সেই আংটিটাকেই মিন করতে চেয়েছেন।”
“হতেও তো পারে।” পরিদাদু গম্ভীরভাবে বললেন।
“আপনিও বলছেন তাহলে?” চিত্তরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে উঠে বসলেন। “আমি, জিষ্ণু, আমার স্ত্রী, সবাই এটাই বিশ্বাস করি। কিন্তু বিমানদা কিছুতেই একথা মানতে চান না। তিনি বলেন, এ নাকি আমাদের পাগলামি।”
“আচ্ছা, তোমরাই বলো,” পরিদাদু এবং অরুণাংশুর দিকে চেয়ে বলেন বিমানদাদু, “যদি তিনি সত্যি-সত্যিই আংটিটাকে লুকিয়ে রেখেও দিয়ে থাকেন সেই সময়ে, আজ এতদিন পরে সে কি আছে আর?”
“থাকতেও তো পারে।” পরিদাদু আবার বললেন, “একবার খুঁজে দেখতে দোষ কী?”
“একেবারে গুপ্তধন অনুসন্ধানের রিয়েল স্টোরি, কী বলো জিষ্ণুদা?” মইদুল কাজ সেরে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে এতক্ষণে।
“তুমি এই ব্যাপারটা আগে থেকেই জানতে মইদুল?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“শুধু আমি কেন, এ অঞ্চলের অনেকেই জানে।” মইদুল হাসল। “এটা তো কিছু গোপন কথা নয়। তবে আমরা কেউই এ কথাগুলোর কোনও মানে বের করতে পারিনি, বিষয়টাকে তেমন আমলও দিইনি কোনোদিন।”
“আপনি সত্যিই যদি এই আংটি খুঁজে বের করতে পারেন, আমাদের পরিবার আপনার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে পরিমলবাবু।” চিত্তরঞ্জন দু’হাত দিয়ে পরিদাদুর দু’হাত চেপে ধরলেন।
“আমি তো গোয়েন্দা-টোয়েন্দা কিছু নই…” পরিদাদু বলার চেষ্টা করলেন।
জিষ্ণু এবং চিত্তরঞ্জন দু’জনেই থামিয়ে দিলেন তাঁকে। জিষ্ণু বলল, “আপনার বিষয়ে সবকথাই শুনেছি পিসোর কাছ থেকে। আমাদের মনে হয়েছে, এই কথা ক’টির অর্থ সত্যিই যদি কিছু থাকে, আপনি তা ঠিক খুঁজে বের করতে পারবেন।”
চিত্তরঞ্জন ধীরে ধীরে বললেন, “ভাববেন না পরিমলবাবু ওই আংটির জন্যে খুব লালায়িত আমরা। আমাদের সেদিন আর নেই ঠিকই। এটাই ঠিক যে দারিদ্র্য ক্রমশ থাবা বাড়াচ্ছে সংসারের দিকে। তবুও বিশ্বাস করুন, ওই আংটি বিক্রি করে টাকাপয়সা পেয়ে দিন ফেরাব, এমন বাসনা আমাদের কারও নেই।”
“তাহলে মেমেন্টো হিসেবে রেখে দেবেন ওটাকে?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করেন।
“জিনিসটা সত্যিই যদি থাকে, সেটা কিন্তু বহুমূল্য। পাঁচকান হবার পর জিনিসটা বাড়িতে রাখা বিপজ্জনকও হতে পারে।” পরিদাদু বললেন।
“আমরা এসব কিছুই ভাবিনি। শুধু একটা কৌতূহল থেকে জানতে চাইছি বাবার ওই লিখে রাখা কথাগুলো কি নিছক প্রলাপ, নাকি তার মানে আছে।”
“ব্যস?” পরিদাদু হাসলেন।
“হ্যাঁ, এইটুকুই।” চিত্তরঞ্জন এবং জিষ্ণুও হাসলেন। “ওটুকু জানতে পেলেই আমরা খুশি।”
পরিদাদু উঠে পড়লেন। খাতার পাতাটার একটা ছবি তুলে রাখলেন নিজের স্মার্ট ফোনে। তারপর জিষ্ণুর দিকে চেয়ে বললেন, “আজ আসি।”
পরিদাদুকে দেখে বিমানদাদুও এগিয়ে এলেন। “এইটে ভালো বুদ্ধি। সামান্য ক’টা কথা, তাও মনে রাখতে পারিনি। আসলে এতদিন বিষয়টায় গুরুত্বও তো দিইনি তেমন। আমিও বরং মোবাইলে ছবি তুলে রাখি একটা।”
“ক’দিন আছেন এখানে?” জিষ্ণু জিজ্ঞেস করল পরিদাদুকে।
“দু’দিন।” পরিদাদু তার কাঁধে হাত রাখলেন। “যদি এই বাক্য ক’টার মধ্যে কোনও যোগসূত্র বের করতে পারি, তাহলে ওই দু’দিনের মধ্যেই পারব। নইলে পারবই না।”
চার
বিকেলে মইদুল এসে গেল পাঁচটা বাজতে না বাজতেই। বিমানদাদু বললেন, “অরুণ, তোমরা মইদুলের সঙ্গে ঘুরে-টুরে এসো খানিক। বড়ো রাজবাড়ি, ছোটো রাজবাড়ি—অনেক কিছু দেখবার আছে এখানে। সাধারণত মুর্শিদাবাদ বেড়াতে এসে এদিকে মানুষজন বড়ো একটা আসে না। আশা করি তোমরাও ওগুলো দেখোনি আগে।”
“আপনি যাবেন না?” জিজ্ঞেস করে অরুণাংশু।
“নাহ্, আমি আর যাব না।” বিমানদাদু হাসলেন। “এবেলা তোমার মামি সঙ্গে যাবে তোমাদের গাইড হিসেবে।”
“আমিও যাব না।” মাথার ওপরে দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভেঙে বললেন পরিদাদু।
“সে কি! তোমার আবার কী হল?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
“বয়েস হচ্ছে তো, বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে আর ইচ্ছে করে না রে খুকু।” পরিদাদু হাসলেন। “তোরা ঘুরে আয়। আমি আগে এদিকে এসেছি। আমার দুই রাজবাড়িই ঘুরে দেখা। তোরা যা। ছোটো রাজবাড়ির ভিতরে ঢোকা যায় টিকিট কেটে। ঘুরে আসিস। শানুর ভালো লাগবে।”
পরিদাদু যাবে না শুনে শাওনের মনখারাপ হয়ে গেল। তার দিকে তাকিয়ে পরিদাদু হাসলেন। তারপর শাওনের কাছে এগিয়ে এসে তার কানের কাছে মুখ এনে নিচু গলায় বললেন, “ধাঁধাটার মানে খুঁজে বের করতে না পারলে তোর পরিদাদুর কি আর সম্মান থাকবে রে শানু? নাকি দাদুদের কাছে তোর সম্মানই থাকবে? কাজেই একলা শুয়ে আমাকে একটু ভাবতে দে জুত করে।”
সুছন্দা চোখ পাকিয়ে বললেন, “খুব বাজে। সকলের সামনে এমন ফিসফিস করে কথা বলার অভ্যাস খুব খারাপ। দাদু-নাতিতে কী কথা হচ্ছে রে শানু?”
“বলা যাবে না। সিক্রেট।” বলে ঘর থেকে একছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে মইদুলের টোটোতে উঠে বসল শাওন।
শাওনদের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। পরিদাদু তখন কড়িকাঠের দিকে মুখ করে চুপ করে শুয়ে আছেন বিছানার ওপরে। কপালে গভীর ভাঁজ। সুছন্দা তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েই খলবল করে একেবারে পঞ্চমুখে মইদুলের প্রশংসা শুরু করলেন। পরিদাদুর পাশে বসে ছেলেমানুষের মতন বলতে লাগলেন তিনি, “জানো তো পরিকাকু, আমি মন্দির-টন্দির পছন্দ করি শুনে মইদুল রাজবাড়ি দুটো ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেই আমাদের দুটো মন্দিরে নিয়ে গেল। একটা মা কালীর, আর একটা শিবের। কী যে সুন্দর মন্দির দুটো, তুমি ভাবতেই পারবে না। না গিয়ে সত্যিই মিস করলে কিন্তু।”
পরিদাদু তখনও একইরকমভাবে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে রইলেন। সুছন্দা খানিক বিরক্ত হয়ে বললেন, “আমি যে কিছু বলছিলাম সেকথা কি কানে গেল তোমার?”
পরিদাদুর চমক ভাঙল। তাড়াতাড়ি বিছানার ওপরে উঠে বসলেন তিনি। লাজুক গলায় বললেন, “কিছু বলছিলি?”
অরুণাংশু হেসে ফেললেন। সুছন্দার দিকে চেয়ে বললেন, “তুমিও যেমন! ও কি এখন নিজের মধ্যে আছে? দেখছ না কেমন শিবনেত্র হয়ে পাজল সলভ করছে মনে মনে।”
পরিদাদু এবারেও মুচকি হাসলেন। কিছু বললেন না।
অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর মিস্টার হোমস, কাজকর্ম কি কিছু এগোল, নাকি অমন হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকাই সার?”
“শুয়ে থাকাই সার।” পরিদাদু বললেন, “বুঝতে পারছি ব্যাপারটা মোটেও জটিল কিছু নয়, অথচ যেন ধরতে পারছি না কিছুতেই।”
“দাদাগিরির গুগলি রাউন্ডের প্রশ্নগুলোর মতন।” শাওন বলল।
“এক্কেবারে তাই।” পরিদাদু সমর্থন করলেন তাকে।
“আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর কাছে জিনিসটা গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন।” অরুণাংশু বললেন, “ভালোবাসার মানুষ বলতে প্রথমেই তো তাঁরই কথা মনে আসে।”
“কিন্তু উনি যে লিখেছেন ‘ভালোবাসার পদতলে’।” পরিদাদু মাথা চুলকে বললেন, “স্ত্রীকে দিয়ে গেলে কি ভালোবাসার পায়ে বলতেন? ভালোবাসার করকমলে-টমলে কিছু লিখতেন।”
“ওটা কাব্যি করার জন্যে বা অন্যদের বিভ্রান্ত করার জন্যেও তো লিখতে পারেন!” অরুণাংশু আবার বলেন।
“তা পারেন,” মাথা নেড়ে সায় দেন পরিদাদু। “কিন্তু জিষ্ণু বলল, মায়ের মুখে কখনও কোনোদিন এমন কোনও প্রসঙ্গ সে শোনেনি।”
“তুমি কি জিষ্ণুকাকুকে ফোন করেছিলে?” শাওন জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ।”
“ওর বাবা চিত্তমামার মা কতদিন আগে মারা গেছেন?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
“তা বছর দশ-বারো তো হবেই।” বিমানদাদু বললেন।
“তার মানে অনেকদিনই হয়ে গেল।” পরিদাদু মাথা নেড়ে বললেন।
“তা হল।” বিমানদাদু বললেন, “অতদিন আগের মানুষ হলে কী হবে, অসম্ভব পার্সোন্যালিটি ছিল। আর কথাবার্তাও ছিল খুব সুন্দর।”
“আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না,” অরুণাংশু খুব সিরিয়াস মুখ করে বললেন, “স্বামীর স্মৃতি হিসেবে তিনি আংটিটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন, কাউকে বলেননি? হয়তো তাঁর মনে আশঙ্কা ছিল আংটিটার কথা শুনলে তাঁর ছেলে সেটা নিয়ে বিক্কিরি-টিক্কিরি করে দিতে পারে। সংসারের অভাব তো তিনি দেখেই গিয়েছিলেন।”
“সেক্ষেত্রে আংটিটা ওই বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রাখা আছে হয়তো।” সুছন্দা বললেন।
“আশ্চর্য নয়। বাড়িটাতে ঘরদোর তো কম নেই। চোরা কুঠুরি-টুটুরিও থাকতে পারে।” বিমানদাদু সুছন্দার কথায় সায় দিলেন। “তবে থাকেও যদি, ওই লেখাটার সঙ্গে নিশ্চিত তার কোনও সম্পর্ক নেই। তুমি কী বলো হে পরিমল?”
“আমার মতটা একটু অন্যরকম। আমি ঠিক এইভাবে ভাবছিলাম না।” পরিদাদু অন্যমনস্ক গলায় বলেন।
“তোমার কী মনে হচ্ছে পরি?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
মামি ততক্ষণে চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে এসেছেন ঘরে। সকলের গম্ভীর মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী আলোচনা হচ্ছে এত?”
“আমরা আলোচনা করছিলাম যে অত বড়ো বাড়ি তোমাদের, সেই বাড়িতেই কোথাও হয়তো আংটিটা লুকিয়ে রাখা থাকতে পারে সকলের অজান্তে।” বিমানদাদু বললেন।
“উঁহু।” তিনি দু’দিকে মাথা নাড়লেন।
“এত শিওর হচ্ছ কী করে?”
“আমি আর জিষ্ণু মিলে বিভিন্ন সময়ে ওই বাড়ির প্রতি ইঞ্চি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।”
“কিন্তু যদি ধরো কোনও দেওয়ালের ভেতরে কিংবা মাটির নীচে রাখা থাকে?”
“মাটির নীচে, মাটির নীচে…” পরিদাদু বিড়বিড় করে উঠলেন, “পদতল, পদতল… হুঁ, মাটির নীচে হতেই পারে। কিন্তু সে তো এমনি পদতল নয়, ভালোবাসার পদতল।”
“তার সঙ্গে বণিকের তুলাদণ্ড আর রাজমিস্ত্রীর রজ্জুও আছে।” শাওন মনে করিয়ে দেয়।
“সেইটেই তো ভাবছি রে শানু,” পরিদাদু বললেন, “ওইটেই তো মূল খটকা।”
“ওরে বাপ রে, তুমি এর মধ্যেই লেখাগুলো মুখস্থ করে ফেলেছ দাদু?” বিমানদাদু শাওনকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বললেন।
“তা করবে না?” সুছন্দা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “এ তো আর স্কুলের পড়াশোনা নয় যে পাঁচবার পড়েও পরীক্ষার খাতায় লেখার সময় ভুলে মেরে ভুল লিখে দিয়ে আসবে।”
সকলে হেসে উঠলেন সুছন্দার কথায়। শাওনের রাগ হল খুব। মোটেই সে পরীক্ষায় খারাপ নম্বর পায় না। তবুও সকলের সামনে পড়াশুনোর ব্যাপারে মা তাকে এমন করে ছোটো করবেই।
রাতে খাবার টেবিলে সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা পরিকাকু, মীর জাফরের বংশধররা এখনও আছে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে?”
“নিশ্চয়ই আছে।” পরিদাদু বলেন, “আমি নাইন্টি এইট-নাইনে একবার মুর্শিদাবাদে এসেছিলাম। তখনই শুনেছিলাম মীর জাফরের বংশধরদের অধিকাংশেরই আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। বললে বিশ্বাস করবি না, তেমনই একজনের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে আলাপও হয়ে গিয়েছিল আমার। একটা পান-সিগারেটের দোকান চালিয়ে কায়ক্লেশে সংসার চলত তার।”
“সে কি গো!” অরুণাংশু বলেন অবাক হয়ে, “নবাবের বংশধরের এই হাল?”
“পাপ বাপকেও ছাড়ে না হে।” বিমানদাদু বলেন, “জানো তো, মুর্শিদাবাদ শহর থেকে খানিক তফাতে জাফরগঞ্জে মস্ত প্রাসাদ বানিয়েছিলেন মীর জাফর। জানো কি না জানি না, সেই প্রাসাদেরই একটা ঘরে বিশ্বাসঘাতক মীরণ নির্মমভাবে হত্যা করেছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে। মীর জাফর জাফরগঞ্জেই কাটিয়েছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। ওই জাফরগঞ্জের মাটিতেই মৃত্যুর পর দাফন হয় তাঁর। কিন্তু কী আশচর্য, অমন একটা ঐতিহাসিক প্রাসাদ আজ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। চিহ্ন পর্যন্ত নেই সেই পাপ-প্রাসাদের। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা মস্ত দেউড়ি। সে দেউড়ি কী নামে পরিচিত জানো?”
“কী, দাদু?” দু’চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে জিগ্যেস করে শাওন।
“নিমকহারাম দেউড়ি। বিশ্বাসঘাতকের দরজা।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বিমানদাদু। “কালের কাছে কারও ক্ষমা নেই।”
“একবার দেখে এলে হত।” সুছন্দা বললেন।
“ধুস, সাধ করে কেউ বিশ্বাসঘাতকের কাছে যেতে চায়?” অরুণাংশু মজা করে বললেন, “তার চেয়ে চলো কাল আরেকবার মুর্শিদাবাদ ঘুরে আসি। সেই কতদিন আগে গিয়েছিলাম। শানুরও দেখা হবে জায়গাটা আরও একবার।”
“সেই ভালো।” পরিদাদু মাথা নেড়ে অরুণাংশুর প্রস্তাবে সায় দিলেন। “তোমরা কাল ঘুরে-টুরেই এসো। হাতে সময় তো বেশি নেই।”
“তোমরা মানে?” সুছন্দা চোখ পাকিয়ে বললেন, “তার মানে কালও তুমি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছ না?”
“উঁহু।” পরিদাদু দু’দিকে মাথা নাড়লেন। “উপায় নেই রে খুকু। কাল অনেক কাজ। কয়েক জায়গায় যেতে হবে। কয়েকজন সম্পর্কে খবরাখবর করতে হবে। যোগাযোগ রাখতে হবে আরও কয়েকজনের সঙ্গে।”
“লম্বা লিস্টি তো!” অরুণাংশু বললেন।
“তা লিস্টি খানিক লম্বাই।” পরিদাদু হাসলেন, “হাতে সময় নেই, কাজ দ্রুত গুটিয়ে নিতে হবে।”
পাঁচ
মুর্শিদাবাদ ঘুরে আসার পরেরদিন সকালেও শাওন ঘুম থেকে উঠে দেখল পরিদাদু যথারীতি ভোরবেলা বেরিয়ে গেছেন একা-একাই। এ ঘটনা নতুন নয়। যখন যেখানেই গেছে পরিদাদুর সঙ্গে, শাওন দেখেছে গভীরভাবে কোনও রহস্য ভাবতে ভাবতে যখনই তিনি কিছু একটা সূত্র পান এমন হুট করে বেরিয়ে পড়েন। বাস্তবের সঙ্গে সম্ভাবনাকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন নিজের মতন। শাওনের কাল থেকেই মনে চিন্তা হচ্ছিল খুব। হাতে সময় বলতে শুধু কালকের দিনটা। পরশুই তাদের ফিরে যাবার দিন। কাল রাত পর্যন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন পরিদাদু। জিষ্ণুকাকুর দাদুর লেখা কথাগুলোর কোনও কিনারাই করতে পারেননি। পরিদাদুর সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়া দেখে এখন তার মনে হল পরিদাদু নিশ্চিত এগোতে পেরেছেন এই রহস্যের জট ছাড়ানোর কাজে।
ঠাকুরমা শাওনের জন্যে ব্রেকফাস্ট নিয়ে এলেন। সকাল থেকেই নানান লোকজন আসছেন। ফুলওয়ালি থেকে কলের মিস্ত্রী, স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রতিনিধি থেকে ব্যবসাদার। বিমানদাদুর সঙ্গে প্রত্যেকেরই খুবই খাতির। শাওন দেখল এখানে খুবই জনপ্রিয় তিনি। দাদুর বাড়ির কাজের দিদি কমলি খলবল করে কথা বলে খুব। সে সুছন্দাকে বলছিল, “আপনার মামার সঙ্গে সকলের ভাব। সকলেই ওঁর আপনজন। সংসারের সবকথাই সকলের কাছে না বলে বেড়ালে শান্তি নেই মানুষটার। এই করতে গিয়ে কোনদিন কী বিপদ বাধিয়ে বসবেন দেখবেন।”
বিমানদাদু হা হা করে হেসে উঠে বললেন, “হ্যাঁ রে বেটি, মানুষকে বিশ্বাস করব না তো কাকে বিশ্বাস করব বল দেখি?”
“যা পারো করো।” মুখ বেঁকিয়ে দাদুকে ভেংচি কাটে কমলি।
পরিদাদু ফিরলেন দশটা নাগাদ। কমলি রান্না করতে করতে ফুট কাটল, “কাকু কি একেবারে আংটি উদ্ধার করে নিয়ে ফিরলেন?”
পরিদাদু চমকে তাকালেন কমলির দিকে। বিমানদাদু হা হা করে হেসে উঠলেন পরিদাদুর দিকে চেয়ে। “ও আমার নিজের বেটি। ওর কাছে এ বাড়ির কোনোকিছুই গোপন নেই।”
“কার কাছে আছে শুনি?” কমলি মুখ ঝামটা দেয়, “সকলকেই তো সবকথা বলে বেড়াও তুমি।”
সুছন্দা প্রসঙ্গ পালটে পরিদাদুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা তুমি আজ কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে কোথায় গিয়েছিলে শুনি?”
“এই একটু ঘুরে-টুরে এলাম আর কি চারপাশটা।” পরিদাদু হাসলেন।
“সে তো বুঝলাম,” সুছন্দা তাঁর দিকে চেয়ে চোখ কোঁচকালেন, “কিন্তু সেই চারপাশটা কোথায়?”
“ওল্ড ইংলিশ সেমেটারি। রেসিডেন্সি কবরস্থান।” পরিদাদু থেমে থেমে বললেন, “পলাশির যুদ্ধের পরে যেসব ইংরেজ কর্মচারী কাশিমবাজারে বসবাস করতেন, এ কবরখানাটা তাঁদের।”
“সেখানে যাবার দরকার পড়ল কেন পরিমল?” বিমানদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“আপনি তো নিশ্চিত জানেন,” পরিদাদু বিমানদাদুর দিকে মুখ তুলে চাইলেন, “ওয়ারেন হেস্টিংস-এর প্রথমা স্ত্রী এবং কন্যা এলিজাবেথের এখানেই সমাহিত হন।”
“হ্যাঁ, শুনেছিলাম। খেয়াল ছিল না।” বিমানদাদু দু’দিকে মাথা নাড়লেন। “এইসব পুরনো কথা ক’জনই বা মনে রাখে। ওদিকে বার কয়েক গেছি। যাতায়াতের পথে রাস্তার পাশে পুরনো ইংরেজদের কবরখানাটা দেখেছি। ভারত সরকারের লাগানো একটা বোর্ডও আছে দেখেছি। কী লেখা আছে তাইতে পড়ে দেখিনি কখনও। এখানকার অধিকাংশ মানুষই পড়ে দেখেননি হলফ করে বলতে পারি।” বিমানদাদু হা হা করে হেসে উঠলেন। “এখানে টুরিস্ট-ফুরিস্টও তো আসে না তেমন। এসব স্পটের প্রচারও নেই তেমন। নিরিবিলি পরিত্যক্ত জায়গা হিসেবেই পড়ে আছে।”
“তুমি কি সংকেতটার অর্থের সঙ্গে ওই সেমেটারির কোনও যোগসূত্র আছে মনে করছ?” অরুণাংশু ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন পরিদাদুকে।
“করছি।” ওপর নীচে মাথা নাড়লেন পরিদাদু।
“কীরকম?”
“ওই এলিজাবেথ এবং তার মেয়ের ব্যাপারটা…”
“ওয়ারেন হেস্টিংস-এর ভালোবাসার জন হিসেবে ওদের কথা ভাবছ?”
“একদম।” পরিদাদুর চোখ চকচক করে উঠল। “দেখলে তো, তোমারও মনে ঝপ করে ব্যাপারটা চলে এল কেমন?”
“হুঁ।” অরুণাংশু সায় দিলেন।
“আংটিটা তাহলে ওই কবরখানাতেই লুকিয়ে রাখা আছে পরিদাদু?” শাওন উত্তেজিত হয়ে পড়ল। পরিদাদু একদিন হাতে থাকতেই আংটির ধাঁধা ধরে ফেলেছেন!
“তাই তো মনে হচ্ছে শানুবাবু।” বলে মৃদু হাসলেন পরিদাদু।
“তাহলে সত্যিই আজগুবি কথাগুলোর মধ্যে একটা অর্থ লুকিয়ে রাখা ছিল?” বিমানদাদু চোখ বড়ো বড়ো করলেন। “আমি তো চিরকাল ওটাকে জিব্বেরিশ বলে উড়িয়ে দিয়েছি হে!”
“আর জিষ্ণু এবং চিত্তবাবুর লুকোনো সম্পদ থাকা নিয়ে যে বিশ্বাস, তা নিয়ে পরিচিতি লোকজনের কাছে হাসি মশকরা করেছেন। তাই তো?” পরিদাদু মিটিমিটি হাসছেন এখন।
“তা করেছি।” বিমানদাদু লজ্জা পেয়ে গিয়ে বললেন, “মিথ্যে কথা বলব না। তবে এখন মনে হচ্ছে সকলের কাছে ওদের নিয়ে এমন করে না বললেই ভালো হত।”
“সত্যিই তাই।” পরিদাদু বললেন।
শাওন চমকে উঠল। পরিদাদুর এই কন্ঠস্বর তার চেনা। নিশ্চিত কিছু একটা গোলমাল আছে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে। পরিদাদুকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চুপ করে গেল শাওন। পরিদাদুর মুখে স্বাভাবিক হাসিটা ফিরে এসেছে আবার। খেয়েদেয়ে উঠে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে তিনি বললেন, “মামাবাবু, আমার বিশ্বাস ওই সমাধিস্থলে এলিজাবেথ অথবা তার মেয়ে যেকোনও একজনের পায়ের কাছে মাটি খুঁড়লেই আমরা যা খুঁজছি তা পেয়ে যাব।”
“নিশ্চিত?” বিমানদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“প্রায়।”
“তাহলে আজকেই মাটি খোঁড়া হবে?” কমলি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এইবার আর উত্তেজনা চেপে রাখতে পারল না সে।
“আজ নয়, কাল। বেলার দিকে বা বিকেলে। যখন সরকারি আধিকারিকরা সময় দিতে পারবেন।” পরিদাদু বললেন, “এই সমাধিস্থল ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীন। তাঁদের অনুমতি দরকার। তাঁদের উপস্থিতি দরকার।”
“সরকার এর মধ্যে ঢুকলে আংটিটা কি আর দাদারা পাবে?” ঠাকুরমা জিজ্ঞেস করলেন খানিক হতাশ গলায়।
“সম্ভবত না।” পরিদাদু বললেন, “মাটির নীচের যেকোনও সম্পত্তির অধিকার আমি যদ্দূর জানি সরকারেরই। তবুও তাঁদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে। তেমন হলে চিত্তবাবুর সঙ্গে আমি সরকারি লোকজনের কথা বলিয়ে দেব নাহয়।”
ঠাকুরমা চুপ করে গেলেন।
পরিদাদু সকলের মুখের ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “আমি ঘরে যাই এবার। বিকেলে একটু বেরোতে হবে আবার।”
“কোথায় যাবে?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করেন।
“বেশি দূরে নয়।” পরিদাদু হাসেন, “মইদুলের ফোন নম্বর নিয়ে নিয়েছিলাম কাল। ওকে বলে রেখেছি। একটু পরেই চলে আসবে।”
“তুমি একাই যাবে?” জিজ্ঞেস করল শাওন।
“তুই আমার সঙ্গে যেতে চাস?” শাওনের পিঠে আলতো চাপড় মেরে জিজ্ঞেস করেন পরিদাদু।
“সে তো সবসময়েই চাই।” অভিমানী গলায় বলে শাওন, “তুমিই তো দেখি আমাকে না নিয়েই হুটহাট কোথায় সব বেরিয়ে পড়ো একা-একাই!”
“আচ্ছা বেশ। তুই আর আমি যাব বিকেলবেলা। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
“কী?”
“চোখ-কান খোলা রেখে ঘুরতে হবে। কী দেখলাম আমরা ফিরে এসে প্রশ্ন করতে পারি। ঠিকঠাক উত্তর দেওয়া চাই।”
“বেশ।”
“রাজি তো?”
“হুঁ, রাজি।”
“শুধু শানু, আমরা বাদ?” সুছন্দা ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলে উঠলেন।
“হ্যাঁ, বাদ।” পরিদাদু গম্ভীর হবার চেষ্টা করলেন।
“আমাদের অপরাধ?”
“তোমরা তো কেউ আমার ওয়াটসন বা তোপসে নও।”
পরিদাদুর কথায় হো হো করে হেসে উঠলেন সক্কলে।
ছয়
টোটোতে বসে চাপা গলায় পরিদাদুকে জিজ্ঞেস করল শাওন, “আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি পরিদাদু? রেসিডেন্সি সেমেটারিতে?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“অন্য আরেকটা প্রাচীন গোরস্থানে।”
“কেন?”
“বেড়াতে।”
একটুক্ষণ চুপ করে থাকল শাওন। তারপর বলল, “তুমি নিছক বেড়ানোর জন্যে সেখানে যাচ্ছ না।”
“কী করে বুঝলি?”
শাওন মৃদু হাসল। পরিদাদুর কথার উত্তর দিল না। পরিদাদু তার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সে বলল, “আরেকটা কথা বলি?”
“বল।”
“আংটিটা মোটেই রেসিডেন্সি সেমেটারিতে নেই।”
পরিদাদু চমকে চাইলেন শাওনের দিকে, “এমন মনে হবার কারণ?”
“আংটিটা সত্যিই ওখানে থাকলে তুমি সকলের সামনে ব্যাপারটা এমন ফ্যাচকাতে না মোটেই। তোমাকে ভালোই চিনি আমি।”
পরিদাদু শাওনের পিঠে চাপড় মেরে চাপা স্বরে বলে উঠলেন, “সাবাশ তোপসে।”
“আংটিটা তাহলে কোথায়?”
“এখনও জানি না রে।”
“সত্যিই জানো না?”
“সত্যিই জানি না এখনও, বিশ্বাস কর।”
“কালকের মধ্যে তাহলে কী করে আংটিটা পাওয়া যাবে? পরশুই তো ফিরে যাওয়া আমাদের।”
“ফিরে যাবার আগে আংটিটা কোথায় আছে জেনে নিতে হবে।”
“তার মধ্যে জেনে যাবে?”
“জেনে না নিতে পারলে সকলের সামনে কি তোমার মান থাকবে শানুবাবু?” পরিদাদু আলতো হেসে হাত রাখলেন শাওনের মাথায়। “এই সমস্যা সমাধানে আমাকে লাগবারই কথা নয়। আমার বিশ্বাস, চোখ-কান এবং মাথা খোলা রাখলে তুই নিজেই মনোরঞ্জন সেনের হেঁয়ালি মনে হওয়া কথাগুলোর মানে বুঝে নিতে পারবি।”
“ধ্যাত।”
“সত্যি বলছি।” পরিদাদু বলেন, “বিপ্লবী মনোরঞ্জন আসলে জলের মতন সোজা একটা সূত্র লিখে রেখে গেছেন তাঁর ডায়েরিতে। আসলে জটিল ধাঁধা তৈরি করার তো কোনও প্রয়োজন ছিল না তাঁর। শুধু ভেবেছিলেন ফিরে এসে জিনিসটা দেশের কাজে লাগাবেন কোনোভাবে। বিশ্বাসঘাতকের ওই আংটি বাড়িতে রাখতে চাননি বলেই নিজের ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিলেন কথাটা।”
“তাহলে তো সরাসরিই লিখে রেখে যেতে পারতেন, অথবা স্ত্রীকে বলে যেতে পারতেন।”
“উঁহু। তাইতে অসুবিধে ছিল শানুবাবু।”
“কী অসুবিধে?”
“বিপ্লবীদের বাড়িতে যেকোনও সময় পুলিশ রেইড হবার সম্ভাবনা থাকে। সরাসরি ডায়েরিতে লিখলে তা পুলিশের চোখে পড়তে পারত। স্ত্রীকে বললে তিনি জেরার মুখে পড়ে পুলিশকে বলে ফেলতে পারতেন ওই আংটি দিয়ে কী করার পরিকল্পনা ছিল মনোরঞ্জনের।”
“সূত্র এতই যদি সহজ তাহলে কেউ বুঝতে পারল না কেন?”
“সহজ বলেই হয়তো বোঝেনি। জটিল করে ভাবার চেষ্টা করেছে সব্বাই।”
“তুমি তো বুঝেই ফেলেছ। তাহলে একটু আগে যে বললে বুঝতে পারোনি এখনও?”
“একটুখানি বাকি।” পরিদাদু হাসলেন, “আর শোন, এখন যা কথা হল সে বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকবি কাল পর্যন্ত।”
“আচ্ছা।”
মইদুল বলল, “এসে গেছি। নেমে একটু এগিয়েই বাঁদিকে। রাস্তার ওপরে। একটা রঙচটা বোর্ডও আছে দেখবেন।”
“তুমি ঢুকবে না?”
“নাহ্।” মইদুল হাসল, “আমি কালই ঢুকব একেবারে।”
“ওদিকে ঠিক আছে তো সব?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ,” মইদুল মাথা নাড়ল, “আমি একটু আগেও গিয়েছিলাম, সন্ধের পরেও যাব একবার।”
“সাবধানে।”
“কী ব্যাপার গো মইদুলদা?” শাওন জিজ্ঞেস করল অবাক হয়ে।
“ও কিছু নয়।” মইদুল হাসল। “দেরি কোরো না শানুভাই, ঘুরে এসো তাড়াতাড়ি।” মইদুল গাড়িতে উঠল।
সামনে লেভেল ক্রসিং দেখা যাচ্ছে। একটু দূরেই কাশিমবাজার রেল স্টেশন। কয়েক পা এগোতেই পাঁচিলের পাশে বোর্ডটা চোখে পড়ল। শাওন দেখল বোর্ডে লেখা রয়েছে, এটা একটা বহু প্রাচীন ডাচ সেমেটারি।
পরিদাদু বললেন, “আয়, ভেতরে ঢুকি।”
জায়গাটা পরিচ্ছন্ন এবং নিরিবিলি। পিরামিডের আকারে স্মৃতিসৌধ রয়েছে অনেকগুলো। কিছু সৌধ আবার খুব বড়ো নয়। স্মৃতিফলকে মৃত ব্যক্তির নাম খোদাই করা রয়েছে। একটা বাঁধানো সমাধির পাশে বসে কয়েকজন স্থানীয় ছেলে আড্ডা মারছিল। পরিদাদুদের দিকে তারা ফিরেও তাকাল না।
পরিদাদু প্রত্যেকটা সমাধির কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। হাঁটু মুড়ে বসে মলিন হয়ে যাওয়া নাম ফলকগুলো পড়তে লাগলেন মন দিয়ে। একটা সমাধি থেকে আরেকটার দিকে যেতে যেতে তিনি শাওনকে জায়গাটা সম্পর্কে ধারণা দিতে লাগলেন, “ষোলোশো ছেষট্টি সালের দিকে ওয়ারেন হেস্টিংসের এক ফরাসি বন্ধুর তত্ত্বাবধানে এখানকার কালকাপুরে একটি কারখানায় সাত-আটশো মানুষ কাজ করত। তাদের অধিকাংশই ছিল ডাচ। বুঝলি শানু, সে সময় এসব জায়গা একেবারে গমগম করত। কিন্তু কালের গ্রাসে কারখানা, ডাচ উপনিবেশ, সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একসময়। থাকার মধ্যে পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেল শুধু এই ডাচ সমাধিক্ষেত্রটি। সতেরোশো একুশ থেকে বিরানব্বই, এই সময়ের মধ্যে মারা যাওয়া তেতাল্লিশ জন শুয়ে আছেন এই সমাধিক্ষেত্রে।”
শুনতে শুনতে গা ছমছম করে উঠল শাওনের।
পরিদাদু কবজি ভাঁজ করে ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, “চল বেরিয়ে পড়ি। আর এখানে থাকলে দেরি হয়ে যাবে। রাতে অনেক কাজ।”
“রাতে আবার কী কাজ!” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শাওন।
পরিদাদু তার কথায় উত্তর না দিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন।
সাত
থমথম করছে রাত্রি। চারদিক শুনশান। আওয়াজ নেই কোত্থাও। মানুষের চিহ্নও নেই আশেপাশে। তবুও একজন স্থূল, দীর্ঘদেহী মানুষ হাতে একটা ছোটো ব্যাগ নিয়ে অত্যন্ত সাবধানী ভঙ্গিতে ঢুকে পড়ল রেসিডেন্সি সেমেটারির মধ্যে। চারপাশে আরও একবার তাকিয়ে দেখে নিয়ে সে নির্দিষ্ট একটা সমাধির সামনে পৌঁছল। একবার সমাধির চারদিকে ঘুরে নিয়ে সে এসে দাঁড়াল চির-ঘুমে শুয়ে থাকা মানুষটির পায়ের দিকে। হালকা চাঁদের আলোয় লোকটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। সমাধির পায়ের দিকে মাটির ওপরে উবু হয়ে বসে পড়ল লোকটা। হাতের ব্যাগ থেকে ছোটো ছোটো ছেনি-হাতুড়ি বের করল। বের করল ছোট্ট হাত শাবল, কোদাল। আর বের করল একটা ছোটো কিন্তু উজ্জ্বল টর্চ। সেই টর্চের আলো ফেলে সে জায়গাটা আরও একবার জরিপ করে নিল সাবধানে। তারপর গর্ত করতে শুরু করল। নিস্তব্ধ রাতে ছেনি-হাতুড়ির শব্দ উঠছে ঠক ঠক ঠক… সেই শব্দে রাত যেন চমকে চমকে উঠছে।
ঠিক সেই সময়েই ছিপছিপে চেহারার আরও একজন এসে ঢুকল সমাধিক্ষেত্রে। লঘু পায়ে সে এগিয়ে গেল ওই লোকটার কাছে। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “পাওয়া গেল?”
“না।” আগের জন বলল নীচু স্বরে, “মনে হচ্ছে এইটা নয়। এটা মেয়ের কবর। জিনিসটা আছে মায়ের জিম্মায়।”
“তাহলে চলুন ঐ কবরটাই খুঁড়ি আমরা।”
“আর একটু খুঁড়ে দেখি।”
“হাতে সময় বেশি নেই। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি কাউকে কিছু না বলে, বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।”
“এ ধরনের কাজে কি তাড়াহুড়ো করলে চলে?”
“আরও একটা চিন্তা হচ্ছে।”
“আবার কী?”
“ভদ্রলোক অত্যন্ত বুদ্ধিমান। দুম করে যদি এসে পড়েন?”
“তিনি এখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছেন। তিনি কাল এখানে আসবেন এবং দেখবেন সব ফাঁকা।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? সবাই মিলে মেনে নিলেই হল মীর জাফরের আংটি কোনোদিনই ছিল না!” লোকটা উঠে দাঁড়ায়। “সত্যিই এখানে কিছু নেই। চলো ওই কবরটাকেই টার্গেট করি।”
“চলুন।”
“দাঁড়াও, তার আগে একটা কাজ আছে।”
“আবার কী কাজ?”
“গর্তটা বুজিয়ে দিয়ে এ জায়গাটা আগের মতন করে রেখে যাই। কাল যাতে কেউ বুঝতে না পারে এখানে অন্য কেউ আগেই এসে জিনিসটা হাতিয়ে নিয়ে গেছে।”
“ঠিক বলেছেন।”
দু’জনেই হাত লাগায় মাটি দিয়ে জায়গাটা বুজিয়ে ফেলার জন্য। কাজ শেষ হলে তারা আবার ওঠে। এগিয়ে যায় ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রীর সমাধির দিকে।
আবার শুরু হল দু’জনের সঠিক জায়গা জরিপ করার কাজ। স্থূল ভদ্রলোককে বেশ পটু মনে হচ্ছে। হাত দিয়ে এবং হাতের দুয়েকটি যন্ত্র দিয়ে ঠুকে তিনি একটা জায়গা নির্দেশ করে বললেন, “এইখানে।”
দ্বিতীয়জন উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “সত্যিই জিনিসটা তাহলে আছে বলছেন!”
“মনে তো হচ্ছে।”
“চলুন তাহলে জায়গাটা খুঁড়ে দেখি।”
“চলো।”
তারা দু’জনে মিলে আবার সন্তর্পণে মাটি খুঁড়তে থাকে।
একটু পরেই প্রথমজন বলে ওঠেন, “পেয়েছি।”
“সত্যি?”
“দাঁড়াও, আগে মাটির নিচ থেকে ওপরে তুলি। মনে হচ্ছে পাথরের একটা ছোটো বাক্স।”
“সাবধানে। যেন বাক্সের গায়ে শাবলের ঘা না লাগে। বাক্সটাও নিশ্চিত দামিই হবে।”
“দেখা যাক।”
মাটির মধ্যে থেকে পাথরের ছোটো বাক্সটা ওপরে তুলে আনে লোকটা। বাক্সের ডালা খুলে ফেলে। টর্চের আলো পড়ে খানিক ঝকমক করে ওঠে ভেতরে থাকা আংটিটা। লোকটা হাতে তুলে নিয়ে খানিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সেটা। দ্বিতীয়জন বলে, “আমার টাকাটা…”
“এত তাড়া দেখালে চলবে কেন?” প্রথমজন হাসে। “জিনিসটা খাঁটি কি না আগে পরীক্ষা করে দেখি।”
“মানে?” দ্বিতীয়জনের গলায় বিরক্তি, “এমন তো কথা ছিল না। আপনি বলেছিলেন আংটিটা পেলেই…”
“আহ্, বলেছিলাম সেকথা অস্বীকার তো করছি না।” লোকটার গলা শীতল, “আমি তোমাকে একটা কানাকড়ি না দিয়েও এটা নিয়ে নিতে পারি। কিচ্ছুটি করতে পারবে না তুমি। এমনকি তোমাকে এখানে খুন করে পুঁতে রেখেও চলে যেতে পারি আমি। কেউ জানতেও পারবে না। এই ধরনের দুষ্প্রাপ্য জিনিস পেতে এসব আমাদের করতেই হয়।” লোকটা পকেটে হাত দিল।
তার থেকে হাত কয়েক তফাতে একটা পুরনো স্মৃতিসৌধের আড়ালে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে সমস্ত ঘটনা দেখছিল আরও একজোড়া চোখ। প্রথমজন পকেটে হাত ঢোকাতেই সে সতর্ক হল। দু’হাতের পেশি শক্ত হয়ে উঠল তার। প্রয়োজনে প্রথমজনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে মনে মনে প্রস্তুতি নিল সে।
অবশ্য তেমন গণ্ডগোলের কিছু ঘটল না। সেই স্থূল, দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করে দ্বিতীয়জনের দিকে বাড়িয়ে দিল। “তুমি আমার এলাকার ছেলে। আমার সঙ্গে তোমার শত্রুতা নেই। ভয় নেই, তোমাকে ঠকানোর ইচ্ছে আমার নেই। এখানে হাজার পাঁচ-ছয় টাকা আছে। আপাতত এইটুকুই রাখো। জিনিসটা পরখ করে দেখি, ভ্যালুয়েশন ক্যালকুলেশন হোক, তোমার প্রাপ্য নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে তুমি।”
মাটি দিয়ে একটু আগে খোঁড়া গর্ত বুজিয়ে দিয়ে হাত দিয়ে জায়গাটা আবার আগের মতন করে দিল দু’জনে মিলে। তারপর যেমন গেট টপকে সমাধিক্ষেত্রে ঢুকেছিল, তেমনই আবার চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে গেল তারা।
তৃতীয় ব্যক্তি আরও কিছুক্ষণ সমাধির আড়ালে তার আগের অবস্থানেই অপেক্ষা করল। তারপর ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এল সেও। দ্রুত নির্জন পথে হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল সে। রাত ক্রমশ ভোরের দিকে গড়াতে শুরু করেছে। তবুও খবরটা এখনই দিয়ে দেওয়া দরকার।
আট
চিত্তরঞ্জন সেনের বাড়িতে সকলেই উৎকন্ঠিত মুখে অপেক্ষা করছিলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। পরিদাদু বলেছিলেন ঠিক চারটেয় মিটিং। সকলের সামনে তিনি বিপ্লবী মনোরঞ্জন সেনের ধাঁধার মানে বুঝিয়ে দিতে চান। ব্যাপারটায় কারোরই এখন আর তেমন উৎসাহ নেই। কেননা আজ সকালে দশটার সময় বিমানদাদু, জিষ্ণু, অরুণাংশু, শাওন, মইদুল সকলকে সঙ্গে নিয়েই রেসিডেন্সি সেমেটারিতে গিয়ে এলিজাবেথের সমাধির সামনে মাটি খুঁড়িয়েছিলেন পরিদাদু। সঙ্গে আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটির আধিকারিক তমোঘ্ন ভট্টাচার্যও ছিলেন। ভদ্রলোক পরিদাদুর পূর্বপরিচিত এবং অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। পরিদাদুর ফোন পেয়ে গতকাল রাতেই বহরমপুরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। দুঃখের কথা, সেখানে কিছুই পাওয়া যায়নি। পরিদাদুকে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল। এতটাই হতাশ যে শাওনের সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। জিষ্ণু বলল, “কী আর করা যাবে। আমাদের একটা স্বপ্ন, একটা বিশ্বাসের আনুষ্ঠানিক মৃত্যু হল আজ। পিসো ঠিকই বলত। আমার দাদু মনোরঞ্জন সেনের ওই কথাগুলো সত্যি-সত্যিই নিছক হেঁয়ালি ছাড়া কিছু নয়। মীর জাফরের আংটি তখনও এ-বাড়িতে ছিল না, এখনও নেই।”
“অথবা তাঁর মৃত্যুর আগেই কাউকে হয়তো এই হেঁয়ালির অর্থ তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আগেই সেই আংটি এখান থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।” তমোঘ্ন ভট্টাচার্য বললেন।
“এর পরেও আমার কিছু কথা থেকে যায়।” পরিদাদু বললেন।
“আর কী?” বিমানদাদুও হাসলেন। “কথা তো ফুরলো হে, নটে গাছও মুড়লো।”
“আজ্ঞে না স্যার।” পরিদাদু বললেন, “কষ্ট করে যে ধাঁধাটার সমাধান করে এই মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করালাম আপনাদের দিয়ে, তার মানেটা বুঝিয়ে দিতে হবে না?”
“সে আপনি নিতান্তই যদি চান…” জিষ্ণু বলল।
“আমার চাওয়াটা বড়োই লেজিটিমেট জিষ্ণুবাবু।” পরিদাদু হাসলেন। “তাছাড়া চিত্তবাবুর সঙ্গে একটু কথা না বলে কাল যদি চলে যাই, খুব অন্যায় হবে। ভদ্রলোক বড্ড আশা করে আমাকে ডেকে আনিয়েছিলেন।”
“বেশ।” জিষ্ণু মাথা নেড়ে সায় দেয়।
“ঠিক চারটে।” পরিদাদু বলেন, “সকলে যেন উপস্থিত থাকেন। আমি তোমাদের এই এলাকার দুয়েকজন বিশিষ্ট মানুষকেও সঙ্গে চাইছি। তাঁদের উপস্থিতিও খুব জরুরি। তাঁদের অন্যভাবে খবর করে দিচ্ছি আমি।”
জিষ্ণু ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে থাকে পরিদাদুর দিকে।
পরিদাদু অরুণাংশুর দিকে চেয়ে বলেন, “তুমি শানুকে নিয়ে বাড়ি যাও। সময় মতন সকলকে নিয়ে চলে এসো সেন-বাড়িতে। অনেকদিন পরে দেখা হল, আমি আর তমোঘ্ন আজ একসঙ্গে লাঞ্চ করব। আমি ওর গেস্ট হাউজেই কাটাচ্ছি এই বেলাটা।”
বিকেলে সকলেই এসে পৌঁছে গেছে সময় মতন। এই বাড়ির ঠাকুরমা সকলকে চা-বিস্কিট দিয়ে গেছেন। সকলেই পরিদাদুর অপেক্ষায়। শাওন মনে মনে একটা অদ্ভুত ছটফটানি অনুভব করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, এক্কেবারে শেষ লগ্নে পরিদাদু একটা খেলা দেখাবেনই।
ঘরের মধ্যে বসে ব্রীজেশ পাল উসুখুসু করছিলেন। তাঁর সম্ভ্রান্ত চেহারার দিকে চাইলেই বোঝা যায় এলাকায় হাঁকডাক আছে ভদ্রলোকের। বিমানদাদু পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ব্রীজেশদা মস্ত ব্যবসায়ী। এই এলাকায় তাঁর দানধ্যানও প্রচুর।”
পঞ্চায়েত প্রধান মনসুর আলম তাঁকে বললেন, “কী দাদা, এত ছটফট করছেন কেন?”
“কাজ ছিল।” ব্রীজেশ ঘড়ি দেখেন। “আমাকে কেন যে তমোঘ্নবাবুরা আসতে বললেন জানি না। ফালতু সময় নষ্ট হলে বড্ড গায়ে লাগে।”
“যা বলেছেন।” মনসুর তাঁর কথায় সায় দেন। “আমিও তো কাজ ফেলে বসে আছি। পার্টির মিটিং আছে একটা কর্মীদের নিয়ে।”
বিমানদাদু ব্রীজেশের দিকে ইশারা করে অরুণাংশুর কানে কানে বললেন, “লোকটার আইনি, বেআইনি হাজার রকম ব্যাবসা। টাকার কুমির একেবারে।”
পরিদাদু আর তমোঘ্ন ভট্টাচার্য একসঙ্গেই ঢুকলেন পাঁচটার কাছাকাছি। ঢুকেই দু’হাত জোড় করে সকলের কাছে খুব একচোট ক্ষমা-টমা চেয়ে নিলেন পরিদাদু। তারপর তমোঘ্নর দিকে দেখিয়ে বললেন, “আধিকারিক মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে যা হয়। অন ডিউটি আছেন। কাজ ফেলে তো আসতে পারেন না, বলুন। ওর সঙ্গে আমারও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। সব মিটিয়ে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। যা বলার চটপট বলে ফেলুন এইবার। আমরা আপনার জন্যে কাজ ফেলে বসে আছি।” ব্রীজেশ বললেন বিরক্ত স্বরে।
“আপনার ব্যস্ততা আমি জানি ব্রীজেশবাবু।” পরিদাদু হাসলেন। “গত দু’দিনে আপনার সম্পর্কে বিস্তর খোঁজখবর নিয়েছি আমি।”
“আমার সম্পর্কে?” ব্রীজেশ অবাক।
“আজ্ঞে হ্যাঁ।” পরিদাদু যেন বিনয়ের অবতার।
“কী খোঁজ নিলেন আর কেনই বা নিলেন জানতে পার কি?”
“নিশ্চয়ই।” পরিদাদুর মুখে সেই হাসিটা লেগেই রয়েছে। “জানাব বলেই তো সকলকে ডেকেছি।”
চিত্তরঞ্জন বললেন, “পরিমলবাবু, আপনার কথা বলুন এইবার। আমি অসুস্থ। খুব বেশিক্ষণ বসে থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর।”
“আমি খুব বেশিক্ষণ নেব না।” পরিদাদু দু’বার কেশে গলাটাকে পরিষ্কার করে নিলেন। “আপনারা সকলেই জানেন, চিত্তবাবুদের একটা পারিবারিক মিস্ট্রি ছিল। তাঁর বাবা, বিপ্লবী মনোরঞ্জন সেনের লিখে রাখা কয়েকটা আপাত অর্থহীন বাক্যের অর্থ বুঝে ওঠা যায়নি এতদিন। তাঁদের ধারণা ছিল এই বাক্যগুলির মধ্যেই তাঁদের পূর্বপুরুষের কাছে থাকা নবাব মীর জাফর আলির দেওয়া একটি আংটির হদিশ দেওয়া ছিল, যে আংটি বিশ্বাসঘাতকের দেওয়া বলে বিপ্লবী মনোরঞ্জন নিজের বাড়িতে রাখতে চাননি।” পরিদাদু একটু থেমে দম নিলেন। “আমি এখানে আসার পরে আমাকে চিত্তবাবু সেই আংটি খুঁজে দেবার দায়িত্ব দেন।”
“সে আংটি তো পাওয়া যায়নি।” মনসুর বললেন, “আজ সকালে তো সবাই মিলে…”
“বলছি। একটু ধৈর্য ধরুন প্লিজ।” পরিদাদু তাঁকে থামিয়ে দিলেন। “আমি কাজ শুরু করার পরেই লক্ষ করলাম, আমাকে কেউ বা কারা ফলো করতে শুরু করেছে। আমি যেখানেই যাই না কেন, ছায়ার মতন আমাকে অনুসরণ করছে তারা। আমি সতর্ক হলাম, অবশ্যই তাদের বুঝতে না দিয়ে। এদেরই একজনকে আমি চিনে ফেলি। মইদুলের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি সে ব্রীজেশবাবুর বিল্ডিং মেটেরিয়ালসের দোকানের কর্মচারী। এরপরেই ব্রীজেশবাবু সম্পর্কে খোঁজখবর করতে শুরু করি আমি বিভিন্ন সূত্র থেকে। জানতে পারি ভদ্রলোকের নামে বেনামে নানাধরনের ব্যাবসার কথা। এই বেনামি ব্যাবসার মধ্যে নানাধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু পাচারও একটি। আর প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুর ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের গুরুত্ব নিশ্চিত অনুমান করতে পারছেন আপনারা?”
“কী ফালতু কথা বলছেন পরিমলবাবু?” ব্রীজেশ গর্জে উঠলেন, “ডেকে এনে অপমান করবেন ভেবেছেন নাকি আমাকে? আপনি আমাকে চেনেন না পরিমলবাবু। আপনার নামে মানহানির মামলা করতে পারি আমি জানেন?”
“করবেন’খন, কে বারণ করছে আপনাকে?” স্থির ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিলেন পরিদাদু, “আমার কথা শেষ হোক আগে।”
“আমি আপনার কোনও কথাই শুনতে চাই না আর।” ব্রীজেশ চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।
“কিন্তু আপনাকে যে শুনতে হবেই।” পরিদাদু তমোঘ্নর দিকে ইশারা করতেই তিনি দরজার দিকে চেয়ে বললেন, “আপনারা ভেতরে আসুন।”
জনা চারেক লম্বা পেটানো চেহারার কঠিন মুখের লোক তমোঘ্নবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ভারী গলায় পরিচয় দিয়ে বলল, “স্পেশাল ব্রাঞ্চ, কলকাতা।”
পরিদাদু ব্রীজেশের দিকে কড়া চোখে চেয়ে বললেন, “বসে পড়ুন। আমার কথা বলা হয়ে গেলে উঠবেন, তার আগে নয়।”
ব্রীজেশ ধপ করে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। কপালের ঘাম মুছলেন রুমাল দিয়ে।
পরিদাদু আবার বলতে শুরু করলেন, “এই ঐতিহাসিক আংটি খুঁজে বের করার পুরো ঘটনাটায় আসল কৃতিত্ব আমার নয়। এই ঘটনার হিরো মূলত মইদুল আর কমলি। কমলিই আমাকে প্রথম জানায় জিষ্ণুর ব্রীজেশের বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারটা। কমলি যে ও-বাড়িতেও ঠিকে কাজ করে এই হিসেবটা সম্ভবত জিষ্ণুর মাথায় ছিল না। জিষ্ণুর সঙ্গে ব্রীজেশের একটা আর্থিক অঙ্ক রফা হয়।”
“জিষ্ণু!” চিত্তরঞ্জন প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন, “আমি ভাবতেই পারছি না…”
“আপনি উত্তেজিত হবেন না প্লিজ।” পরিদাদু নরম গলায় বলেন, “জিষ্ণু বাচ্চা ছেলে। আপনার চিকিৎসার খরচ, সংসারের দায়িত্ব ঠিক মতন পালন করা—সত্যিই ওর টাকার প্রয়োজন। আর সেই জন্যেই…”
“আপনি কী যা তা বলছেন?” জিষ্ণু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে।
পরিদাদু তাকে থামিয়ে দেন। “কাল তুমি এবং ব্রীজেশবাবু যখন পুরনো ইংরেজ কবরখানায় গিয়ে এলিজাবেথের সমাধির পায়ের কাছ থেকে মাটি খুঁড়ে আংটিটা বের করে নিয়ে যাও, মইদুল ওখানেই ছিল জিষ্ণু। তোমাদের কথোপকথনের রেকর্ড আছে আমার কাছে। ছবিও আছে দুয়েকখানা। কম আলোর জন্যে অস্পষ্ট, তবুও একটু ভালো করে দেখলে চিনে নিতে অসুবিধা হবার কথা নয়।”
জিষ্ণুর মাথা বুকের ওপরে ঝুলে পড়ল।
চিত্তরঞ্জন জিষ্ণুর দিকে চেয়ে বললেন, “আংটি তাহলে সত্যিই ছিল?”
“ছিল।” জিষ্ণু বলে বিধ্বস্ত গলায়।
“সে আংটি তাহলে কোথায় গেল?”
“ওঁর কাছে।” জিষ্ণু ব্রীজেশের দিকে হাত তুলে দেখায়। “আমি ওঁর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি।”
“ওই অমূল্য আংটি কত টাকায় বিক্রি করেছিস হতভাগা?” বিমানদাদু জিজ্ঞেস করলেন বিরক্তির সঙ্গে, “তুই কি চিরকাল বোকাই থেকে যাবি?”
“পঞ্চাশ হাজার।” মাথা নিচু করে বলে জিষ্ণু।
“পঞ্চাশ লাখ দাম হতে পারে আংটিটার।” বিমানদাদু মাথা নাড়াতে থাকেন। “সব টাকা নিয়ে নিয়েছিস?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“পাঁচ হাজার দিয়েছেন উনি। বাকিটা আংটিটা খাঁটি কি না পরখ করে দেখে দেবেন বলেছিলেন।”
“বেশিই দিয়েছেন।” পরিদাদু বলেন, “কী বলো হে মইদুল? কত দিয়ে কিনেছিলে?”
“সাড়ে তিন হাজার স্যার।”
“মানে?” চিত্তরঞ্জন সোজা হয়ে বসলেন।
“ওটা ঝুটো আংটি। ওই আংটি দিয়ে আমি ফাঁদ পেতেছিলাম চোর ধরার জন্যে। আমার টার্গেট জিষ্ণু ছিল না অবশ্যই। কাল রাতে সে ওখানে গিয়ে পড়বে জানতামও না। তবে ব্রীজেশ যাবে জানতাম। ওকে ধরাটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল আমার। লোকটার এমন অনেক চোরাই মাল সমেত কলকাতার শো রুম সিল করা হয়েছে আজ।”
পরিদাদুর কথার মাঝখানেই স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা হেফাজত নিয়ে নিলেন ব্রীজেশের।
“ওই আংটি তাহলে রেসিডেন্সি সেমেটারিতে ছিল না?” আবার জিজ্ঞেস করলেন চিত্তরঞ্জন।
“থাকার তো কথাও নয়।” পরিদাদু হাসলেন। “মনোরঞ্জন যে লিখে গেছেন, ‘বণিকের তুলাদণ্ড নহে, রাজমিস্ত্রীর রজ্জুই অধিকতর শ্রেয়।’ তাহলে ইংরেজদের কবরখানায় তিনি তো কিছুতেই তাঁর জিনিস রাখবেন না। ইংরেজরা যে তাঁর জাতশত্রু।”
“তাহলে?” চিত্তরঞ্জন নয়, বিমানদাদুই জিজ্ঞেস করলেন অসীম কৌতূহলে।
“বণিকের তুলাদণ্ড বাতিল হয়ে গেল যখন, রাজমিস্ত্রীর রজ্জু নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। খানিক মাথা ঘামাতেই বিষয়টা জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল।” পরিদাদু হেসে উঠলেন।
“মানে?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
“রাজমিস্ত্রীর রজ্জুকে কী বলে খুকু?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
“ওলোন দড়ি।” সুছন্দার আগেই শাওন বলে ওঠে। আর বলেই নিজেই চমকে ওঠে, “ওলোন, মানে ওলন্দাজদের কথা মিন করতে চেয়েছেন উনি! তার মানে ওই ডাচ সেমেটারি, যেখানে কাল গিয়েছিলাম আমরা?”
“এগজ্যাক্টলি।” পরিদাদুর চোখ চকচক করে ওঠে। “তোর বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না শানু।”
“কিন্তু ওই যে ভালোবাসার পদতল? ডাচ গোরস্থানে সেই ভালোবাসার সন্ধান কোথায় পেলে পরি?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।
পরিদাদু হাসলেন। “ওইটুকু ধন্দ ছিল আমারও। তারপর কবরগুলো খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সে প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে গেলাম।”
“কীরকম?”
“ভালো করে লক্ষ করতে করতে একটা বহু প্রাচীন সমাধি চোখে পড়ল। সেনোটাফে খোদাই করা লেখাগুলো প্রায় পড়াই যায় না। তবুও দেখলাম গ্রেগরিয়াস হারক্লটস নামের লোকটার মৃত্যুদিন হিসেবে কালচে পাথরটার ওপরে লেখা রয়েছে চোদ্দই ফেব্রুয়ারি, সতেরোশো সাতাশি। সেইন্টস ভ্যালেন্টাইন’স ডে। যেদিনটাকে পশ্চিমের দেশের মানুষ বহুদিন আগে থেকেই ভালোবাসার দিন হিসেবে পালন করে আসছে।”
“স্প্লেনডিড!” চিত্তরঞ্জন সেন সোজা হয়ে উঠে বসলেন বিছানার ওপরে। “আর সেই আংটিটা?”
“ছিল।” পরিদাদু হাসলেন। “আমি আর তমোঘ্ন নিয়ম মেনেই সেটি তুলে এনেছি মাটির তলা থেকে। আজ দুপুরে।”
পরিদাদু তমোঘ্ন ভট্টাচার্যের দিকে চাইতেই তিনি পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করলেন। রুপোর। লাল শালুতে মুড়ে তার মধ্যেই রাখা ছিল আংটিটা। বাক্সের ঢাকনা খুলতেই ঝলমলিয়ে উঠল সেই নবাবি আংটি। একাধিক শতাব্দীর এত অন্ধকারও তার ঔজ্জ্বল্য ম্লান করতে পারেনি এতটুকু।
“এই আংটি সরকারি সম্পত্তি।” তমোঘ্ন বললেন, “আমি আমার উচ্চতর আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেছি কোনও একটি মিউজিয়ামে এই বহুমূল্য ঐতিহাসিক আংটিটি যদি সংরক্ষিত থাকে এবং সেখানে দাতা হিসেবে আপনার নাম যদি রেকর্ড হিসেবে রেখে দেওয়া যায়।” তমোঘ্ন বললেন চিত্তরঞ্জনকে, “এর বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে আপনাদের কতটুকু কী দেওয়া যায় আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করে দেখব।”
“লাগবে না।” চিত্তরঞ্জন সহজ স্বরে বললেন, “বিশ্বাসঘাতকের ওই আংটি আমার বাবা ছুঁয়ে দেখতেও ঘৃণা বোধ করতেন। ওই আংটি আমার জিষ্ণুকে পর্যন্ত লোভী করে তুলেছিল। ওই অভিশপ্ত আংটির বিনিময়ে একটা কানাকড়িও হাতে নিতে রাজি নই আমি। আমাদের যেমন চলে যাচ্ছে চলে যাবে ঠিকই। শুধু একটাই অনুরোধ…”
“বলুন।” নরম গলায় বলেন তমোঘ্ন।
“ডোনার হিসেবে আমি নই, জাদুঘরে জিষ্ণুর নামটা লিখে রাখার বন্দোবস্ত করবেন প্লিজ।”
“আমি অবশ্যই চেষ্টা করব।” তমোঘ্ন হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন। “আসি তাহলে। অনুমতি দিন।”
পরিদাদু বললেন, “আমার কাজও তো ফুরলো। আমাকেও যাবার অনুমতি দিন এইবার।”
চিত্তরঞ্জন কাঁপা কাঁপা হাত তুলে প্রতি নমস্কার জানালেন দু’জনকেই। বললেন, “আসুন।” জিষ্ণুকে বললেন, “যা, ওঁদের এগিয়ে দিয়ে আয় বাইরের গেট পর্যন্ত।”
পরিদাদু শাওন, অরুণাংশু, সুছন্দার দিকে চাইলেন। “চলো ফেরা যাক। কাল সক্কালবেলা ট্রেন। বাড়ি ফিরে গোছগাছ করতে হবে তো, নাকি?”
মইদুল এগিয়ে এসে হাসল। “আমি আছি তো। বললেই পৌঁছে দিয়ে আসব আপনাদের, যেখানে বলবেন।”
ছবি: শিমূল সরকার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
ভালো লাগলো।
LikeLike
আমারও ভালো লেগেছে গল্পটি। আমি এই গল্পটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করার অনুমতি চাই।
আমার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
জুনেদ আহমদ
প্রকাশক ও সম্পাদক
বৈচিত্রে বন্ধুত্ব
ঢাকা, বাংলাদেশ।
LikeLike
আপনার অনুরোধ লেখককে জানানো হল। তিনি প্রয়োজনে যোগাযোগ করবেন।
LikeLike
লেখকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁর উপদেশ মোতাবেক জানাই, আপনি আপনার প্রস্তাবটি সংক্্ষেপে joydhak@gmail.com ঠিকানায় পাঠান প্লিজ। আমরা লেখককে আপনার প্রস্তাব ও মেইল আইডি ফরওয়ার্ড করে দেব।
LikeLike
খুব ভাল লাগল।
LikeLike
ভালো
LikeLike