সপ্তর্ষী চ্যাটার্জির আগের গল্প ঝন্টুর ঝঞ্ঝাট
বিষ্ণুপুর সাহিত্য প্রতিযোগিতা- তৃতীয় সেরা গল্প
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
১৬৭০ খ্রিস্টাব্দ, মল্লভূম
দিল্লীর মসনদে তখন আসীন পরম প্রতাপশালী মুঘল সম্রাট ঔরংজেব। ভারতভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁর একছত্র আধিপত্য। কিন্তু মল্লভূমের মত প্রাচীন রাজবংশের আঙ্গিনায় তাঁরা অনুপ্রবেশ করতেন না। হ্যাঁ, রাজস্ব আদায় করতেন ঠিকই, কিন্তু সুপ্রাচীন এই রাজবংশের রাজত্ব, যা বঙ্গদেশের পশ্চিম প্রান্ত থেকে অঙ্গ এমনকি কলিঙ্গেরও কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত, সেখানে হস্তক্ষেপ করতেন না।বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলটিকেই অতীতে মল্লভূম বলা হত। মল্লভূম রাজ্যের কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বর্তমান বাঁকুড়া,ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর ও ইন্দাস।তবে প্রাচীন বিষ্ণুপুর রাজ্যের আয়তন আরও বড়ো ছিল। উত্তরে সাঁওতাল পরগনার দামিন-ই-কোহ থেকে এই রাজ্য দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পূর্বে বর্ধমানের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে ছোটোনাগপুরের কিছু অঞ্চলও এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই মল্লভূমের রাজা বীর সিংহ মল্ল রাজবংশের ৫২তম শাসক। তাঁর বড়রানি শিরোমণি দেবী রাধা লাল জীউ মন্দিরে পুজোয় বসেছেন।বীর সিংহএই মন্দির বানিয়েছিলেন সিংহাসনে বসার কিছুদিন পরেই, তা প্রায় একযুগ হয়ে গেছে। সেখানে আছে নহবতখানা। রোজ নিত্যপূজা হয়। পশুপাখির মূর্তি আঁকা সারা মন্দিরগাত্রে। চৌকো একটা বেদীর ওপর অবস্থিত মন্দির।ভক্তিমতী রানি একমনে অর্চনায় রত। হঠাৎ দ্বারে প্রহরারত রক্ষীর কণ্ঠ তাঁর কানে এলো ‘ না! এখন রানিমার সঙ্গে দেখা হবে না। পুজো শেষ না হলে কিছুতেই দেখা হবে না।’
এক নারী কণ্ঠের কাতর আহ্বান কানে আসে তার মধ্যেই ‘একটিবার দেখা করতে দাও না গো, খুব জরুরি দরকার।’
কী ব্যাপার? এভাবে কে বলছে? রানি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন – ‘হীরা সিং , ওকে আসতে দাও।‘
এক ছুটে প্রবেশ করে এক উপজাতি রমণী। কৃষ্ণকায়া কিন্তু মুখখানি যেন অদ্ভুত জ্যোতির্ময়ী। আগে কখনও দেখেছেন বলে মনে পড়ল না শিরোমণির। ‘ কে তুমি? কী হয়েছে? কী বলতে চাও?’
‘রানিমা আমি শ্যামা। একটু গোপন কথা ছিল, এখানে বলব?’
‘নিশ্চিন্তে বল, এখানে কেউ আসবে না এখন।’
‘সামনে বড় বিপদ রানিমা, মল্লরাজ্যে ঘোর অমঙ্গল নেমে আসছে। রাজকুমারদের প্রাণহানির সম্ভাবনা আছে। তাঁদের যে রক্ষা করতে হবে রানি মা!’
‘কী? কী বলছ এসব! কে তুমি? তুমি জানো যা বলছ তা কতটা ভয়ানক? কীসের ভিত্তিতে এমন আশঙ্কা তোমার?’
‘সেটা বলতে পারব না রানি মা! তবে আমার বাবা একজন তন্ত্রসাধক। তিনি গণনা করে বলেছেন এই কথা। আমি তাই এক মুহূর্তও দেরি না করে সেই বার্তা আপনাকে দিতে ছুটে এসেছি। আর বাবা এইটা দিয়েছেন আপনাকে দেওয়ার জন্য!’
‘কী এটা?’
‘এই লাল সুতো মা বিপত্তারিণীর মন্ত্রপূত রক্ষাকবচ। রাজকুমারদের হাতে পরিয়ে দিন, তাঁরা বিপন্মুক্ত হবেন।’
রানি হতভম্বের মত হাত বাড়িয়ে নেন কয়েক গাছি লাল সুতো। মনে ভেসে ওঠে এক ঝাঁক কথা! বিপত্তারিণী? মানে সেই অলৌকিক দেবী শক্তি? যার কথা এখনো ঘুরে বেড়ায় লোক মুখে মল্লভূমের বুকে। মল্লভূমেরই এক রানির এক সহচরী ছিল মুচির ঘরের মেয়ে। নিম্নবর্গীয় হওয়ায়তাদের মধ্যে গোমাংস খাওয়ার চল ছিল। অথচ হিন্দুধর্মে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। তৎকালীন রানি কথায় কথায় এটা জেনে যেমন ভয়ও পান আবার প্রবল কৌতূহলীও হয়ে ওঠেন। গোমাংস কেমন হয় তা একবার স্বচক্ষে দেখতে একদিন তিনি সহচরীকে এই ইচ্ছার কথা জানান। তার তো শুনে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
‘না না এ কিছুতেই সম্ভব না রানিমা! রাজামশাই জানতে পারলে কী হবে ভেবে দেখেছেন? তিনি যে ঘোর ধর্মপ্রাণ!’
কিন্তু রানি নাছোড়। ‘ কিচ্ছু হবে না। তুই লুকিয়ে নিয়ে আসিস। কেউ জানতে পারবে না দেখিস।’
রানি সাহেবার ইচ্ছে! বিপদ থাকলেও না মেনে আর উপায় কী! অগত্যা নিমরাজি হয় মেয়েটি। কিন্তু বিধি বাম! কথায় বলে দেওয়ালেরও কান থাকে। রাজবাড়ির অন্দর মহলেও ছিল। পাঁচ কান না হোক, খোদ রাজার কানেই পৌঁছে গেল এই ভয়ঙ্কর সংবাদ। রাজা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চান না। কিন্তু গুপ্তচর রীতিমত শপথ নিয়ে জানায় এ খবর মিথ্যে হতেই পারেনা। রাজা ক্রোধে অন্ধ হয়ে ওঠেন। রানিকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন তাঁর মহলের দিকে। রানির সামনে খোলা তলোয়ার নিয়ে যেই রাজা হাজির হলেন, ভয়ে আতঙ্কে রানি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিজের কাপড়ের তলাতেই চট করে গোমাংসটা লুকিয়ে ফেললেন।
বাঁচার কোন উপায় নেই বুঝে তিনি দেবী দুর্গার কাছে প্রাণপণে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকেন। রাজা দেখে ফেলেছিলেন রানি কাপড়ের ভিতর কিছু একটা লুকালেন। তাই সামনে এসেই তিনি তাঁর কাপড় ছিঁড়ে দেখতে চান ভিতরে কী আছে!অলৌকিক কাণ্ড! তিনি দেখেন, সেখানে আর কিচ্ছু নেই, কেবল একটি লাল জবা ফুল রাখা আছে! রানি বেঁচে যান প্রমাণাভাবে। বিপদ থেকে এমন অকল্পনীয় পরিত্রাণ মেলায় দেবীর নাম হয় বিপত্তারিণী।
‘রানিমা, রানিমা!’
হঠাৎ হীরা সিং এর ডাকে সম্বিৎ ফেরে শিরোমণি দেবীর।
‘কী ভাবছেন এত রানিমা? সেই মেয়েটা কোথায় গেল?’
মেয়ে! তাই তো! বিপত্তারিণীর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিলেন শিরোমণি। হীরা সিং এর কথায় চমক ভাঙ্গতে তিনি চেয়ে দেখেন চারপাশে। সত্যিই তো! মেয়েটা গেল কোথায়? উবে গেল নাকি? নাকি সবটাই মনের ভুল? কিন্তু রানির হাতে তখনও ধরা সেই লাল সুতো! কানে তখনও বাজছে শ্যামার কথা গুলো ‘সামনে বড় বিপদ রানিমা, মল্লরাজ্যে ঘোর অমঙ্গল…!’
***
স্বমাময়ী দেবী মল্লভূমের রাজা বীর সিংহের দ্বিতীয় রানি। ঠাকুমার ঝুলি কিংবা ক্ষীরের পুতুলের সুয়োরানি দুয়োরানির গল্পের মতোই এই রানির চরিত্রও যেন শিরোমণি দেবীর ঠিক বিপরীত! শিরোমণি যেমন সৎ, ভক্তিমতী উদার মহিলা, স্বমাময়ী তেমনই কুটিলা এবং সংকীর্ণমনা। তাঁর একটি মাত্র ছেলে। তার নাম বল দেব সিংহ। ওদিকে শিরোমণির তিন ছেলে ছিল আগেই। দুর্জন সিংহ দেব, সুর সিংহ দেব আর কৃষ্ণ সিংহ দেব। স্বমাময়ী চাইতেন তাঁর ছেলেই মল্লরাজ্যের সিংহাসন পান। এ যেন ঠিক সেই রামায়ণের কৈকেয়ীর মত! নাকি তার চেয়েও ভয়ানক? বড় ছেলেরা বেঁচে থাকতে বল দেবের সিংহাসন লাভ সম্ভব নয়, এটা ছোট রানি বুঝতেন। তাহলে উপায়? উপায় একটাই। যদি রাজা বীর সিংহের মগজ ধোলাই করা যায় কোন ভাবে! যেমন ভাবা তেমন কাজ। কাজটা নিতান্তই গর্হিত সন্দেহ নেই, কিন্তু আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বমাময়ীর মত মানুষেরা যুগে যুগে এভাবেই এমন কাজ করে এসেছে। তিনি বীর সিংহকে কুমন্ত্রণা দিলেন বড় রানির তিন ছেলের নামে। এমন কিছু বললেন যাতে রাজার মন বিষিয়ে ওঠে তাদের প্রতি। আর বলদেব হন সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী। রাজা বীর সিংহ হয়তো বীর ছিলেন, কিন্তু সেইসঙ্গে ছিলেন অবিবেচক এবং নৃশংস। ছোট রানির কথায় তিনি এমনভাবেই প্রভাবিত হলেন যে নিজেই আপন সন্তানদের হত্যা করতে উদ্যত হলেন। পরদিন রাজসভাতেই ঘোষিত হল তিন রাজকুমারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ!সভায় হাহাকার রব উঠল। কেউ বলল রাজামশাইয়ের মতিভ্রম হয়েছে। কেউ বা বিশ্বাস করতে শুরু করল রাজপুত্ররা সত্যিই দোষী! তাই তাদের অপরাধ শাস্তির যোগ্য। কিন্তু এমন চরম শাস্তি?তবে মনে মনে বা আড়ালে যে যাই বলুক, দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকের সম্মুখে মুখ ফুটে কেউ কিছুই বলতে সাহস পেলো না। চারদিকেদাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল এই সংবাদ।
পূর্ব রাতে
শিরোমণি দেবী প্রথমে ভেবেছিলেন শ্যামা নামের মেয়েটার কথাগুলোতে খুব বেশি আমল না দিলেও চলবে। কিন্তু একে তিনি প্রবল ধর্মপ্রাণা, তায় এমন একটা গুরুতর আশঙ্কা! যদিও অতর্কিত আঘাত আসলে তা কোন দিক থেকে আর কীভাবে আসবে সেটাই তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবু নিজের কক্ষে চুপিসারে ডেকে পাঠালেন তিন কুমারকে , মধ্য রাতে।
সুর সিংহ আর কৃষ্ণ সিংহ , ছোট দুই ভাই একটু অস্থির প্রকৃতির। বড়ভাই দুর্জন সিংহ কে তারা জিজ্ঞেস করে ‘ কী ব্যাপার বলো তো দাদা? এতরাতে মা আমাদের তিনজনকেই একসঙ্গে ডেকে পাঠালেন? এত গোপনীয়তায় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছ না কিছু?’
দুর্জন সিংহ অপেক্ষাকৃত ধীর স্থির এবং বুদ্ধিমানও। সে বলে ওঠে –‘জানিনা ভাইরা। তোমরাও যে তিমিরে আমিও সেই তিমিরে। তবে মল্লরাজ্যের বিষয়ে কিছু গুরুতর কথা আছে, আমার ধারণা এই। নইলে আমাদের তিন জনকেই একসঙ্গে ডাকতেন না। এবং এমন কিছু কথা,যা আমাদের পিতা মহারাজ বীর সিংহকেও জানাতে দিতে চান না মা।’
‘ঠিকই বলেছ দাদা! ঐ যে মা আসছেন, দেখি কী বলেন!’
রানি শিরোমণি দেবী ধীর পদক্ষেপে প্রবেশ করেন নির্দিষ্ট কক্ষে। তাঁর চোখমুখ চিন্তাক্লিষ্ট। কম্পিতকন্ঠে তিনি বলেন , ‘শোন বাছারা, আজ এখানে তোমাদের ডাকার পিছনে গুরুতর একটা কারণ রয়েছে। গোপন সূত্রে এক ভয়াবহ বার্তা আমি পেয়েছি।তার সত্যি মিথ্যে যাচাই করার আমার কাছে সময় বা সুযোগ কোনটাই এই মুহূর্তে নেই, শুধু যা বলছি, খুব মন দিয়ে শুনবে…’
এই বলে তিনি সংক্ষেপে বলেন সেই সন্ধ্যের কথা। কিন্তু সুর আর কৃষ্ণ সব শুনে ভয় পাওয়ার বদলে প্রায় হেসে গড়িয়ে পড়ল। কেবল দুর্জন সিংহের মুখ কিছুটা গম্ভীর হল। রানি তাও মরিয়া হয়ে বের করলেন সেই লাল সুতোর গাছি। তিন জনের হাতেই পরিয়ে দিতে গেলেন কিন্তু মেজ আর ছোট কুমার পরতে অস্বীকার করলেন তা। ‘না মা, শুধুমাত্র একটা অমূলক সন্দেহের বশে এই আশঙ্কা করা তোমাকে বা আমাদের শোভা পায় না। আর আমরা রাজকুমার। কার এত সাহস হবে আমাদের হত্যা করার ? নিদেনপক্ষে আমাদের আঘাত করার প্রচেষ্টা করবে এমন মানুষ কে আছে এই মল্লভূমে? এমন বেয়াদপি কেউ করলেও তার সমুচিত সাজা আমরা নিজেরাই দেব, এইসব সুতো টুতো আমাদের জন্য নয়।’
শিরোমণি দেবীর কাতর অনুনয়েও তারা সবেগে মহল ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
দুর্জন সিংহও যে খুব একটা বিশ্বাস করেছে এমন নয়, কিন্তু সে প্রবল মাতৃভক্ত। তাই কব্জিতে লাল সুতো বেঁধে মাকে প্রণাম করে প্রস্থান করল। যাওয়ার আগে বলে গেল ‘চিন্তা কোর না মা। শুধু আশীর্বাদ করো। তাহলেই কেউ আমার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। এ নিশ্চিত!’
তিন কুমার রানির মহল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই অদূরে কোথাও একটা রাতচরা পাখি কর্কশ শব্দে ডেকে উঠল আচমকা। রানি শিহরিত হলেন অজান্তেই। কপালে দু হাত ঠেকিয়ে বললেন ‘ রক্ষা কোর মা বিপত্তারিণী!’
***
সূর্যদেব উঠে পড়েছেন অনেকক্ষণ আগেই। রাজসভা বসে গেছে। শোনানো হয়েছে চরম দণ্ডাদেশ! সারা রাজ্যে শোরগোল। সুর সিংহ আর কৃষ্ণ সিংহ তখনো নিদ্রামগ্ন । প্রহরীরা এসে যখন তাদের বন্দী করে নিয়ে গেল বধ্যভূমিতে, তারা বুঝেও উঠতে পারল না কী ঘটছে আর কেনই বা ঘটছে। তাদের শত অনুনয়েও কিছুই হল না। হায়! অন্তিম মুহূর্তে হয়তো তাদের মনে ভেসে উঠেছিল মায়ের সাবধান বাণী। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে অনেক। রাজাজ্ঞা পালিত হয়ে গেল মসৃণ ভাবে। স্বমাময়ী অলক্ষ্যে হাসলেন। পৈশাচিক সে হাসি। কিন্তু বড় কুমার? দুর্জন সিংহ! সে কোথায়? তার মৃত্যু সংবাদ এখনো এসে পৌঁছল না কেন? তবেই তো নিষ্কণ্টক হবে বল দেবের পথ!
***
গত রাতে মায়ের মহল থেকে বেরিয়ে দুর্জন সিংহ নিজের মহলে ফিরেছিল ঠিকই, কিন্তু ঘুম আসে নি তার। নিজের সর্বক্ষণের সঙ্গী অসিটি, কিছু স্বর্ণমুদ্রা আর প্রিয় ঘোড়াটিকে অশ্বশালা থেকে বের করে সাধারণ পোশাক পরে ঘোড়া ছুটিয়ে সেই রাতেই সে চলে গেল শুশুনিয়া পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা দুর্গম অরণ্যপ্রদেশের লক্ষ্যে। কিছুদিন এখানেই গা ঢাকা দিয়ে থাকা যাবে আত্মপরিচয় গোপন করে। এখানকার আদিম উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামে ঠিক একটা না একটা আস্তানা জোগাড় করে ফেলা যাবে। এবং হলও তাই। সরল মানুষগুলো অচেনা আগন্তুককে রীতিমত খাতির যত্ন করেই রাখল তাদের মাঝে। মাঝেমধ্যে খাওয়া দাওয়া বাবদ দু একটা স্বর্ণমুদ্রা দেয় তাদের দুর্জন সিংহ। তারা অবাক হয়, বোঝে এই অতিথি সাধারণ কোন মানুষ নন, সম্ভ্রমের চোখে তাকায়। কিন্তু অধিক কৌতূহলী হয় না। ইতিমধ্যে রাজধানীর খবর কানাঘুষোয় চলে আসে এই পাহাড়ি গ্রামেও। রাজা বীর সিংহ দেব নাকি তাঁর তিন ছেলে কে হত্যা করিয়েছেন নৃশংস ভাবে! তিন ছেলেকেই? দুর্জন সিংহ মনে মনে শিহরিত হয়। না, তিন জন নয়, দুজন। এই দুর্জন সিংহ এখনো বেঁচে। এবং বেঁচে তাকে থাকতেই হবে, এর পিছনে কে বা কারা আছে আন্দাজ করা শক্ত নয়, কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে সঠিক সময়ের।
***
রানি শিরোমণির শারীরিক অবস্থা ক্রমে খারাপ হচ্ছে। এত বড় শোক তিনি সইতে পারেন না।এ সব ঐ দুরাত্মা স্বমাময়ীর ষড়যন্ত্র। বল দেবকে সিংহাসনে বসানোর জন্যই এই নীচতার আশ্রয় নিয়েছে সে নির্ঘাত। রাজা মশাইয়ের যে কি হল! এত বড় ফাঁদে তিনি কীভাবে পা দিলেন! বিপদটা যে ঠিক এইদিক থেকে আসবে এটা কল্পনাতেও ছিল না । তবু আফশোস হয় বিপদের আভাস পাওয়া সত্ত্বেও শেষরক্ষা হল না বলে। সত্যিই কি তাই? তবে যে শোনা যায়, বড়কুমার আসলে মারা যায়নি? প্রহরীরা তাকে নাকি খুঁজেই পায়নি মহলে গিয়ে! কিন্তু রাজার ভয়ে বলেছে তাকেও মেরে ফেলেছে। তাই যেন হয়! এই গুজব যেন সত্যি হয়। নইলে মা বিপত্তারিণীর মায়া যে বিফলে যাবে! তাঁর দেওয়া লাল সুতো নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছি আমি বাছা দুর্জনের হাতে। দেবীমা নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করবেন। জোড়হাত কপালে ঠেকান শিরোমণি।
***
১৬৮০ খ্রিস্টাব্দ, মল্লভূম
দশ বছর অতিক্রান্ত। গঙ্গা যমুনা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়ে গেছে। আর মল্লভূমের ইতিহাসের পাতাও উল্টে গেছে বেশ কয়েকটা। স্বমাময়ীর একমাত্র সন্তান, বল সিংহ দেব সাম্রাজ্যের একমাত্র উত্তরসুরী , হঠাৎ আক্রান্ত হন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে। হাজার ডাক্তার বদ্যি কবিরাজ ও সারাতে পারলেন না সেই রোগ। পাগলপারা ছোট রানি স্বমাময়ী দেবীর চোখের জলের তোয়াক্কা না করে সে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করল অল্প বয়সেই। রাজা শোকে প্রায় পাথর হয়ে গেলেন। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করতে লাগলেন। আরও তিন ছেলে থাকা সত্ত্বেও তিনি আজ পুত্রহারা, রাজত্ব উত্তরাধিকারহীন।
অনর্থক রক্তপাতে আজ রাজরক্তের প্রবাহ রুদ্ধ হতে বসেছে। এর কোন সমাধানসূত্রই দেখতে পাওয়াযাচ্ছে নাআর। সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ল স্বমাময়ীদেবীর উপরে। তাঁকে কারারুদ্ধ করা হল।
ঠিক এই সময়ে রাজসভায় একদিন হাজির হল এক আগন্তুক। দীর্ঘদেহী সুঠাম চেহারার এক যুবক। মুখটা বড় চেনা। একজনের সঙ্গে বড্ড মিল। কিন্তু তা কী করে সম্ভব! এইসব সাতপাঁচ ভাবছেন যখন তিনি, সেই যুবক রাজা বীর সিংহকে আরও চমকে দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে সম্বোধন করল – ‘পিতা’!
‘কে? কে তুমি? কী নামে ডাকলে আমায়?’
‘আমি পিতা। আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র। কুমার দুর্জন সিংহ দেব!’
‘দু – র – জ – ন! তুমি? তুমি বেঁচে আছ? হা ঈশ্বর! হে মদনমোহন! এ আমি কী শুনছি প্রভু!’
তারপর সবকিছু খুলে বলে দুর্জন। বিস্ময়ে হতবাক রাজার চোখ থেকে বেরিয়ে আসে আনন্দাশ্রু। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বীর সিংহ ভাবেন, তাহলে প্রভু আমার মহাপাপেও অন্তত এটুকু সান্ত্বনা দিলেন! আমার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী দুর্জন সিংহ আমার কুকর্মের আঁচ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল তবে! আজ যেন আমার পাপের খানিকটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত হল!
তারপর আর কী! রূপকথার মতোই মধুরেন সমাপয়েৎ হল এই কাহিনীর! দুর্জন সিংহ দেব পরবর্তী মল্ল রাজার পদে আসীন হন ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে, বীর সিংহের মৃত্যুর পর। আর তারপর মা শিরোমণি দেবীর জন্য বানিয়ে দেন বিখ্যাত মদন মোহন মন্দির। শিরোমণি দেবীর ইচ্ছায় দুর্জন সিংহ ১৬৯৪ সালে আর একটি বিষ্ণু মন্দির বানিয়ে দেন। মদন গোপাল মন্দির। দুটিই বিষ্ণুপুরে।১৭০২ অবধি রাজত্ব করেন দুর্জন সিংহ দেব। শিরোমণি দেবী শুধু গোপনে আরাধনা করে চলেন বিপত্তারিণী দেবীর। নিয়মিত রাজকুমারের মণিবন্ধে বেঁধে দেন সেই রক্তবর্ণ সূত্র, যার কৃপায় মল্ল রাজবংশের দুর্যোগের মেঘ কেটে গেছিল বলে তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। সেই ঘটনা তিনি আর কাউকে বলেননি কখনও। শ্যামাকেও আর কখনও দেখতে পাননি। হয়তো মনে মনে তাঁর স্বরূপ তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।
অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
ঐতিহাসিক গল্প পড়ার আলাদা একটা নেশা আছে। এ গল্পেও বড় সুন্দর করে সেই আমেজটা ধরেছ!
LikeLike