বিভাবসু দে-র আগের গল্পঃ পাতালপুরীর দরজা, ছায়ার কায়া, ভেম্পিগড়ের রূপকথা
বিষ্ণুপুর সাহিত্য প্রতিযোগিতা- সেরা গল্প
বিভাবসু দে
মাথা তুলতে গিয়েই তীব্র যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে গেল সৌমিত্রের। প্রচণ্ড ব্যথা। সারাটা শরীর টনটন করছে, নড়বার শক্তিটুকুও নেই। কতক্ষণ যে এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল কে জানে !
চারপাশে শুধুই গাঢ় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার; গুমোট নীরবতা আর পায়ের কাছে দুর্গন্ধময় পচা জলের অস্বস্তিকর অনুভূতি। এই অতল অন্ধকারে চোখ থাকা আর না-থাকা দুইই সমান। দিন না রাত তাও বোঝবার যো নেই এখানে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার আস্তে আস্তে চোখ বুজল সৌমিত্র।
কে জানে এভাবে আর কদিন টিকে থাকতে পারবে ও! ব্যাগের সামান্য জল-খাবার ফুরিয়ে গেছে অনেকদিন হল। মোবাইল অফ হয়ে গেছে, টর্চের আলোও মিইয়ে মিইয়ে প্রায় শেষের পথে। হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই ওর দশাও এই সুড়ঙ্গপথের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা ওই কঙ্কালগুলোর মতোই হবে। কয়েকশো বছর আগে ওই জীবন্ত মানুষগুলোও হয়তো ঠিক এভাবেই খিদে আর তেষ্টায় ধুঁকতে ধুঁকতে একসময় কঙ্কাল হয়ে মিশে গেছিল এই নিরেট অন্ধকারে। কেউ জানতেও পারেনি।
প্রদীপ এতদিনে নিশ্চয়ই পুলিশে মিসিং ডাইরি করে দিয়েছে। কিন্তু কী লাভ ! যুগ যুগ ধরে মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা এই মারণ-রহস্যের খোঁজ পুলিশ কোনওদিনও পাবে না। সেই অন্ধকার রহস্য, যার পিছু-ধাওয়া করতে গিয়ে আজ নিজের জীবনটাই খোয়াতে বসেছে সৌমিত্র।
ওর ঝাপসা হয়ে আসা চোখের সামনে গতজন্মের কোনও স্বপ্নের মতো ভেসে উঠতে লাগল একমাস আগের সেই সন্ধেটা।
একটি বছর পঁচিশের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সৌমিত্রের কাছে এসেছিলেন ছেলেটির বাবা। মনোরোগবিশেষজ্ঞ হিসেবে কলকাতায় ভালোই নামডাক আছে ওর, তাই মেদিনীপুর হাসপাতাল থেকেই রেফার করা হয়েছিল ছেলেটিকে। হ্যাঁ, সেই ছেলেটিই। চিনতে অসুবিধে হয়নি সৌমিত্রের। এর ছবিই সপ্তাহখানেক আগে কাগজে ছাপা হয়েছিল, সঙ্গে একটা ছোটখাটো আর্টিক্যাল।
ওদের বাড়ি মেদিনীপুরে, একদিনের জন্যে বিষ্ণুপুর ঘুরতে গেছিলেন, আর সেখানেই সেই বিপত্তি। পুরো ব্যাপারটাই একটু একটু করে খুলে বলতে লাগলেন ছেলেটির বাবা। “বাবুন মোবাইলে ভিডিও করতে করতে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছিল, আমি আর ওর মা পেছন পেছন আসছিলাম। সোজা লালমাটির রাস্তা বরাবর কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে কয়েক কদমেই সেই গুমঘর। সেদিকেই যাচ্ছিলাম আমরা। মাত্র একমিনিট ডাক্তারবাবু, কিংবা হয়তো তার চেয়েও কম। আমরা যখন সেই গুমঘরের কাছে গেলাম, বাবুন কোত্থাও নেই।” বলতে বলতে হঠাৎ ডুকরে উঠলেন ভদ্রলোক। “তন্নতন্ন করে খুঁজেছিলাম আমরা, কোত্থাও কোনও হদিশ পাইনি ওর। পুলিশে মিসিং রিপোর্ট করি। তারপর আরও প্রায় দেড়মাস কেটে যায়, কোনও খবর নেই। হঠাৎ একদিন বিষ্ণুপুর থানা থেকে ফোন আসে যে ওকে ছাতনার কাছাকাছি একজায়গায় খুঁজে পাওয়া গেছে। বুঝতেই পারছেন, মনের অবস্থা ! ছুটে গেছিলাম বিষ্ণুপুর থানায়, সেখান থেকে পুলিশের গাড়িতেই ছাতনা। কিন্তু সেদিন কি জানতাম যে ছেলেটাকে আজ এই অবস্থায় দেখতে হবে !” গলাটা আবার ভারী হয়ে উঠল ভদ্রলোকের। “ও আমাদের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আমাদের চেনেই না। কারও সঙ্গে কথা বলে না, মাঝে মাঝে অচেনা কোনও এক ভাষায় কী যেন বিড়বিড় করে। বড় ভয় হয় ডাক্তারবাবু, ছেলেটা কি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবে ?”
“আহা, কাঁদবেন না। আমি দেখছি। ভালো হয়ে যাবে আপনার ছেলে।” জলের গ্লাসটা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলেছিল সৌমিত্র। “আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন, আমি ওর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই।”
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বাংলা বা অন্য কোনও পরিচিত ভাষায় একটি শব্দও ছেলেটির মুখ দিয়ে বের করতে পারেনি সে। এক্ষেত্রে অন্য যে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের মতো সেও হয়তো ব্যাপারটাকে একটা সোজাসাপ্টা মানসিক রোগ ধরে নিয়েই ওষুধ লিখে দিত, কিন্তু একটা ঘটনা চমকে দিয়েছিল ওকে। ছেলেটি হঠাৎ টেবিলে রাখা নোটপ্যাডটা টেনে নিয়ে তাতে কিছু লিখতে লাগল। ভাষাটা অজানা, কিন্তু ঠিক যেন অচেনা ঠেকল না সৌমিত্রের কাছে। হ্যাঁ, অনেকটা যেন সেই শঙ্খলিপির মতো। গতবছর শুশুনিয়া ট্রিপের সময় দেখেছিল সৌমিত্র, ছবিও তুলেছিল, স্পষ্ট মনে আছে ওর। শুশুনিয়া পাহাড়ের উত্তরদিকের একটা জায়গায় পাথরে খোদাই করা চক্রের নিচে বাঁদিকে এরকমই শঙ্খের মতো কিছু অক্ষরে একটা লাইন লেখা ছিল।
ছেলেটি এমনভাবে লিখে যাচ্ছে যেন ওর নিজের ভাষা। ও যেন কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। কিন্তু এ যে অসম্ভব ! এই লিপি তো আজ অবধি ডেসিফার করা যায়নি, কেউ জানেও না এর অর্থ কী। তাহলে এই ছেলেটি কীভাবে…
সৌমিত্রের মাথায় চিন্তার সুতোগুলো যেন জট পাকিয়ে উঠতে লাগল।
হঠাৎ অনেকবছর আগের একটা ঘটনা ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর মনে। সালটা ২০০০; সৌমিত্র তখন এম.ডি করছে। একদিন কাগজে প্রায় এমনই একটা খবর চোখে পড়েছিল, বেশ আলোচনাও হয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে। গুমঘরের সামনে থেকে নিখোঁজ এক জার্মান ট্যুরিস্ট। প্রায় তিনমাস পরে লাপুরিয়ার কাছাকাছি উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। কাগজে যদিও স্মৃতিশক্তি হারানোর কথাই লেখা হয়েছিল, কিন্তু এখন এই ছেলেটিকে দেখার পর কেমন যেন খচখচ করছে সৌমিত্রের মনটা।
গুমঘর। স্থানীয় বিশ্বাসও তো তাই বলে। সেখানে নাকি মল্লরাজারা বন্দীদের গুম করে দিতেন। ভাবতে গিয়েও যেন গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল ওর। যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তবে… । বুকের শব্দটা যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল সৌমিত্র।
এ কি শুধুই এক অকারণ অতিকল্পনা না ইতিহাসের কোনও ধূসর পাণ্ডুলিপির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক না-বলা রহস্যের হাতছানি ?
হাওড়া-পুরুলিয়া এক্সপ্রেস যখন এসে বিষ্ণুপুর স্টেশনে থামল তখন ঘড়িতে রাত আটটা। প্রদীপকে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিল সৌমিত্র। স্টেশনের বাইরেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল সে। প্রদীপ, মানে ডাঃ প্রদীপ মাইতি, সৌমিত্রের কলেজজীবনের বন্ধু। বিষ্ণুপুরে যে দুয়েকবারই এসেছে সৌমিত্র, প্রদীপের বাড়িতেই থেকেছে। ওর বাড়ি এখানেই, মারুই বাজার দুর্গামন্দিরের পাশে। স্টেশন থেকে গাড়িতে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিটের ড্রাইভ।
বিষ্ণুপুর মানেই লালমাটির ধুলা-ওড়া রাস্তা, হাজার বছরের মল্লরাজত্বের জীবন্ত ইতিহাস আর টেরাকোটার অপূর্ব সব মন্দির। লালমাটির বুকে চাপচাপ ঘাসের গালিচা, ছোট ছোট ঝোপঝাড় আর দূরে দূরে শাল, অর্জুন, গামার, ছাতিম, কাঠবেল, মাদার ও আরও কত সব নাম-না-জানা গাছের সারি।
এখানে আগেও এসেছে সৌমিত্র, তাই নতুন করে দেখার মতো কিছু না থাকলেও এবার কিছু জায়গা একটু অন্য চোখে খুঁজে দেখতে হবে ওকে। তাই পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়ল সে। ছুটির দিন হওয়ায় প্রদীপও সঙ্গে ছিল।
মারুই বাজার থেকে বড়রাস্তা ধরে বিবেকানন্দ স্ট্যাচুর ডানপাশের রাস্তা বরাবর এগোতে লাগল ওরা। সৌমিত্রই ড্রাইভ করছিল।
“এবারও কি এদিকেই যাবি ?” একটু হেসেই জিগ্যেস করল প্রদীপ। “ওদিকেও কিন্তু বেশ কিছু মন্দির আছে, যেগুলো তুই গতবার দেখিসনি।”
“হুম। ওগুলো কাল দেখব ভাবছি। আসলে মেইন পুরোনো মন্দিরগুলো তো সব এই লাইনেই, তাই আরকি।” এবারে হঠাৎ বিষ্ণুপুর আসার আসল কারণটা প্রদীপকে বলেনি সৌমিত্র, তাই একটু এড়িয়ে যাবারই চেষ্টা করল।
আরও কিছুদূর গিয়ে দক্ষিণের রাস্তা ধরল ওরা। লালমাটির কাঁচা রাস্তা, দুপাশে অল্প ঝোপঝাড়। প্রথমে ছোট পাথর-দরজা পেরিয়ে তারপর গড়-দরজা। পুরোটাই মাকড়া পাথরে তৈরী। এই গড়-দরজা পেরোলেই হাতের বাঁদিকে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে একটা খোলা মাঠ। আর তারই শেষ মাথায় লালজী মন্দির। যদিও এখানে নামবার ইচ্ছে ছিল না সৌমিত্রর, কিন্তু সোজা গুমঘরের দিকে এগোলে হয়তো প্রদীপ একটু সন্দেহ করতে পারে তাই অগত্যা মাঠে গাড়ি পার্ক করে নামতে হল।
লালজী মন্দিরের পর সোজা রাস্তা ধরে চললে পথে পড়ে রাধাশ্যাম আর মৃন্ময়ী মন্দির। সেগুলোও চটপট দেখে নিয়ে ডানদিকের রাস্তা বরাবর স্টিয়ারিং ঘোরালো সৌমিত্র। এদিকে মহাপ্রভু মন্দির পড়ে, আর তারপরই সেই গুমঘর, যার জন্যে এখানে আসা।
রাস্তার মোড়ে একটু পাশ কাটিয়ে গাড়িটা রেখে নেমে পড়ল সৌমিত্র। সঙ্গে প্রদীপ। মাটির কাঁচা রাস্তা। জুতোর ঘায়ে লালধুলো উড়ে উড়ে পড়ছে। ছেলেটির বাবার কথামতো সেদিন এদিক দিয়েই এগিয়েছিল ওরা। কয়েক পা যেতেই চোখে পড়ল ঝোপঝাড়ে ঢাকা পোড়ামাটির ইটের সেই গুমঘর। দেখতে অনেকটা উঁচু চারকোণা ট্যাঙ্কের মতো; সপ্তদশ শতকে মল্লরাজ বীরসিংহের আমলে গড়া।
সৌমিত্রের মন বলছে এখানেই লুকিয়ে আছে সেই অজানা রহস্যের উৎস। প্রায় মিনিট পনেরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গুমঘরের চারপাশটা দেখল সে।
কিন্তু না, তেমন কিছুই পেল না। চারদিকে শুধুই অযত্নে বেড়ে ওঠা ঝোপ আর ইটের খাঁজে খাঁজে শিকড় গেঁথে বসা লতাগুল্ম, আর মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা এই নিশ্ছিদ্র গুমঘর।
“কী খুজঁছিস বল তো ?” ভুরু কুঁচকে তাকাল প্রদীপ।
“না, এমনি একটু দেখছিলাম আরকি।” সৌমিত্র যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় হেসেই জবাব দিল। “আচ্ছা, এর ভেতরে ঢোকার কি কোনও রাস্তা নেই ?”
“আমি যদ্দূর জানি, না, তেমন কোনও দরজা নেই।” কী একটু ভেবে প্রদীপ আবার বলল, “তবে ছোটবেলায় শুনেছি, ঠাকুমা বলত, ‘গড়ের আলো ঘরে, মরণদুয়ার নড়ে’। এখানে ঘর মানে গুমঘর, তবে এই আঞ্চলিক প্রবাদের মানে ঠিক কী, তা জানি না।”
“হুম।” আর কথা বাড়াল না সৌমিত্র। বেলাও তখন বেশ হয়ে এসেছে, ফিরতে হবে। যেতে যেতে আরেকবার ফিরে তাকাল সে। ওই ইটের আড়াল থেকে শতাব্দীর জমে থাকা অন্ধকার যেন বারবার পিছু ডাকছে ওকে।
না, কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। দু-দুজন মানুষ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল গুমঘরের সামনে থেকে, আর যখন পাওয়া গেল তখন দুজনেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। একজনকে ছাতনায়, আরেকজনকে লাপুরিয়ায়। কিছু একটা তো গোলমাল হচ্ছে। আর সেই ছেলেটি, সে কীভাবে এমন এক লিপি জানল যা প্রায় হাজার বছর আগে রাজা চন্দ্রবর্মনের আমলে শুশুনিয়া অঞ্চলে প্রচলিত ছিল ? আরেকটা জিনিস, ছাতনা আর লাপুরিয়া, দুটো অঞ্চলই কিন্তু শুশুনিয়ার কাছাকাছি। কাকতালীয় ? না, কোথায় একটা মিসিং লিংক রয়েছে এসবের মধ্যে। গুমঘর, ছাতনা, লাপুরিয়া, শুশুনিয়া, হাজার বছর আগের শঙ্খলিপি, গুমঘরের ইতিহাস আর…একটা অদৃশ্য সুতো, একটা মিসিং লিংক যা দিয়ে এই সব ঘটনাগুলো পরস্পর জুড়ে আছে।
রাতে শুতে গিয়েও এগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল সৌমিত্রের মাথায়। হঠাৎ যেন ওর বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। মাথার ভেতর যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
“উফ, এই জিনিসটা এতক্ষণ কেন মাথায় আসেনি !” বিছানায় একটা চাপড় মেরে উঠে বসল সৌমিত্র। “পেয়ে গেছি। গড়ের আলো ঘরে, মরণদুয়ার নড়ে। এই তো সেই মিসিং লিংক।”
রাতে আর দু’চোখের পাতা এক হল না ওর। উত্তেজনায় শুধু বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল। পুবের আকাশ সামান্য ফর্সা হতেই নিজের ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে প্রদীপের পুরোনো সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সৌমিত্র। থামল গিয়ে সোজা গড়-দরজার সামনে। থাকলে এখানেই থাকবে। সিঁড়ি বেয়ে যতটা ওঠা যায়, গেল। প্রায় তিনঘন্টা ধরে গড়-দরজার প্রতিটা কোণায় গিয়ে গিয়ে দেখল সে। কিন্তু না, সে যা ভাবছিল তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না। দেয়ালগুলোও একেবারে নিরেট, কোনও ফাঁপা জায়গা বা চোরকুঠুরি নেই।
তবে কি পুরোটাই ওর বোঝার ভুল ? যেটাকে রহস্যের সূত্র ধরে এগোতে চাইছিল, সেটা শুধুই একটা গ্রাম্য প্রবাদ ? কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নিচে নেমে গড়-দরজার বাইরের বোর্ডটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সৌমিত্র। নীল রঙের একটা বোর্ড, তাতে সাদা রঙে, ওপরে ইংরেজি আর নিচে বাংলায় এই গড়-দরজা বা দুর্গ-তোরণের ব্যাপারে লেখা রয়েছে। আনমনে সেটাই দেখছিল সৌমিত্র, হঠাৎ শেষ লাইনটায় গিয়ে থমকে গেল। তাতে লেখা সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে মল্লরাজ বীরসিংহ দুর্গ নির্মাণের সময় এই তোরণটি নির্মাণ করেছিলেন। মানে একটা দুর্গও রয়েছে, অর্থাৎ গড়। এটা তো শুধুই গড়-দরজা ! আর কী আশ্চর্য, গুমঘরও এই বীরসিংহই তৈরী করেছিলেন।
না, আর দেরি করলে চলবে না। পথে স্থানীয় একজনকে জিগ্যেস করতেই পুরোনো দুর্গের রাস্তা বলে দিল। খুব একটা দূরে নয়, তবে এলাকাটা জঙ্গল-ঘেরা। মৃন্ময়ী মন্দিরের প্রায় উল্টোদিকে। সাইকেল ছুটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেল সৌমিত্র। ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা ইট আর ল্যাটেরাইট পাথরের একটা ভগ্নাবশেষ। জরাজীর্ণ কঙ্কালের মতো যেটুকু টিকে আছে, তাতেও গায়ে গায়ে প্রচুর আগাছা গজিয়ে গেছে।
সাইকেলটা বাইরে রেখে ভেতরে ঢুকল সৌমিত্র। ভেতরের অবস্থা আরও খারাপ, সবই প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কি কোনও সূত্র খুঁজে পাবার আদৌ কোনও আশা করা যায় ! তবু যতটা সম্ভব চোখে মেপে দেখার চেষ্টা করল সে। দেয়ালে দেয়ালে দাঁত বের করে থাকা ইট আর নাগপাশের মতো জড়িয়ে থাকা আগাছা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। কিন্তু ঠিক তখনই একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল সৌমিত্রর। আগাছার আড়ালে একটা পাথরের নলের মতো কী যেন, আর তার বাইরের মুখে একটা কিছু চকচক করছে। জিনিসটা বেশ ওপরে থাকায় বাইনোকুলার দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সে। আরেকটু ফোকাস করল, তারপর আরেকটু। আস্তে আস্তে ওর ঠোঁটের হাসিটা চওড়া হয়ে উঠতে লাগল। এটাই তো সে খুঁজছিল। আকাশের দিকে মুখ করে থাকা নলের বাকি অংশটা যেই অ্যাঙ্গেলে আছে, তাতে আনুমানিক বারোটা থেকে একটার মধ্যেই যা হবার হবে। ও যেটা ভাবছে, যদি সেটাই হয় তবে একটা বিরাট রহস্যের পর্দা খসতে চলেছে আজ।
ঘড়িতে এখন এগারোটা। হাতে আর একঘন্টা সময়। সাইকেল নিয়ে সোজা গুমঘরের দিকে বেরিয়ে পড়ল সৌমিত্র।
ওর মাথার ভেতর শিরাগুলো যেন উত্তেজনায় দপদপ করছে। বারবার ঘড়ি দেখছে সৌমিত্র। বারোটা পঁচিশ। কিছু হবার হলে এদিকেই হবে। গুমঘরের এদিকটাই দুর্গের দিকে মুখ-করা।
হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠল সৌমিত্র। এপাশ-ওপাশ তাকাতেই চোখে পড়ে গেল জিনিসটা। ঝোপের আড়ালে গুমঘরের গায়ে একটা ছোট্ট সুড়ঙ্গ খুলে গেছে, হামাগুড়ি দিয়ে অনায়াসে ভেতরে ঢোকা যাবে। এই সেই ‘মরণদুয়ার’ !
দুর্গের নলের ভেতর আঁতশ কাঁচের এমন এক জটিল সিস্টেম বসানো যা খুব সহজেই সূর্যের আলোকে এতটা ফোকাসড করে দেয় যে এতদূরে এই গুমঘরের দেয়াল অবধি এসে পড়ে। আর সেটা হয় ঠিক সাড়ে বারোটায়। গুমঘরের যে জায়গায় সেই আলো পড়ে সেখানে নিশ্চয়ই কোনও ফোটোসেনসিং ইউনিট লুকোনো আছে, যা আলোর তীব্রতায় সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই গোপন সুড়ঙ্গপথ খুলে যায়।
কিন্তু কী আছে এই সুড়ঙ্গের ভেতরে ? ঢোকা কি ঠিক হবে ? বুকটা দুরদুর করছিল সৌমিত্রের। এদিকে শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে অ্যাড্রিন্যালিনের নেশা। রহস্যের এতো কাছে এসেও কি একবার সাহস করে পা বাড়াবে না সে ? যারা এখানে হারিয়ে যায়, তারা কীভাবে বিষ্ণুপুর থেকে অতদূরে গিয়ে পৌঁছয় ? না, ওকে জানতেই হবে। জানতেই হবে কী আছে গুমঘরের আড়ালে।
মাটিতে শুয়ে বুকে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে পড়ল সৌমিত্র। কিছুই দেখা যায় না। চারপাশে শুধুই জমাট-বাঁধা অন্ধকার। হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে জ্বালতেই চোখে পড়ল ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পোড়ামাটির বেদীটা। কী আছে ওখানে ? কিন্তু সেদিকে দুয়েক পা এগোতেই যেন মাটিটা কেঁপে উঠে সরে গেল ওর পায়ের নিচ থেকে। হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল সৌমিত্র। আর সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল ওপরে যেন কিছু একটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত সেই চোরা-মেঝে যা খুলে গিয়ে নিচে পড়ে গেছে সে। কিন্তু এ কোন জায়গা ? টর্চটা হাতেই ধরা ছিল। জ্বালাতেই যা চোখে পড়ল, বুক কেঁপে উঠল সৌমিত্রর। সে একটা সুড়ঙ্গের মুখে বসে আছে। ডান, বাম আর ওপরে মজবুত পাথরের দেয়াল, শুধু সামনে রাস্তা খোলা। পায়ের নিচে স্যাঁতসেতে কাদাগোলা জল আর চারপাশে দমবন্ধকরা বীভৎস অন্ধকার।
বেশ কিছুটা সময় লাগল ওর এই ঘটনার আকস্মিকতা সামলে উঠতে। এখন শুধু একটাই রাস্তা খোলা। সামনে। একটু একটু করে ভয়টা বাড়ছে, তবু বসে থাকলে তো মৃত্যু নিশ্চিত। তার চেয়ে বরং সামনে এগিয়ে দেখাই ভালো।
হাঁটতে শুরু করল সৌমিত্র। কিছুদূর যাবার পরই ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল। নরকঙ্কাল। সুড়ঙ্গের এখানে সেখানে প্রচুর কঙ্কাল পড়ে আছে। এরা হয়তো সেই বন্দী যাদের গুম করে দেওয়া হত গুমঘরের অন্ধকারে। তারপর একসময় খিদেয়, তেষ্টায় আর ভয়ে মৃত্যুর অতলে হারিয়ে যেত ওরা।
সেদিনের পর থেকে কতদিন ধরে যে হেঁটেই চলেছে তা সৌমিত্র নিজেও জানে না। যত দিন গেছে, শরীর অবশ হয়েছে, মৃত্যুভয় আরও জাঁকিয়ে বসেছে, তবু পা থামেনি ওর। কিন্তু জল-খাবার ছাড়া কতক্ষণ ! হঠাৎ একসময় মাথাটা কেমন যেন পাক খেয়ে উঠেছিল।
এখন শরীরটা একটু ভালো ঠেকছে। পাথরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসল সৌমিত্র। টর্চে এখনও অল্প দম বাকি আছে; জ্বালিয়ে একবার দেখার চেষ্টা করল চারপাশটা। সে কি তবে সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এসে পৌঁছেছে ? সামনে যে দেয়াল। কিন্তু এ কী ! দেয়ালের গায়ে কী লেখা ওগুলো ? শঙ্খলিপি ! হ্যাঁ, ওই তো সেই চক্র যা শুশুনিয়া পাহাড়ের গায়ে দেখেছিল। তবে কি এই সুড়ঙ্গ গুমঘর থেকে শুশুনিয়া পাহাড় অবধি আসে ? মানে প্রায় ষাট কিলোমিটারের ওপরে ! তাহলে এভাবেই ওই ছেলেটি এখানে এসেছিল, আর সেই জার্মান ট্যুরিস্টও। তবে কি এখানে বেরোবার কোনও রাস্তা আছে ? নিশ্চয়ই আছে, থাকতেই হবে।
সারা গায়ের জোরে নিজেকে ঠেলে উঠে দাঁড়াল সৌমিত্র। প্রতিটা দেয়ালে টোকা মেরে দেখতে লাগল যদি কোথাও ফাঁপা আওয়াজ দেয়।
এমনসময় হঠাৎ একটা ঘড়ঘড় শব্দে সুড়ঙ্গের ভেতরটা কেঁপে উঠল। চমকে পেছন ফিরতেই যা দেখল সৌমিত্র, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। পাথরের গায়ে একটা দরজা খুলে গেছে, আর একটা তীব্র সাদা আলো ঠিকরে পড়ছে তার মুখ থেকে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল সে। কী একটা নেশার ঘোরে যেন আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল সৌমিত্র।
এ কী ! কে দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওদিকে ? এ কি ওরই প্রতিবিম্ব, না কি…
সৌমিত্রের চিন্তাগুলো থেমে যাচ্ছিল, অবশ হয়ে আসছিল সারাটা শরীর। পা-দুটো যেন আপনা-আপনি এগিয়ে যাচ্ছিল কী এক অজানা টানে। আর ঠিক একইভাবে ওপার থেকেও এগিয়ে আসছিল সেই ছায়ামূর্তি। অবিকল যেন সৌমিত্র নিজেই। যেন আয়নার এপিঠ ওপিঠ।
নিজের সেই প্রতিরূপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সৌমিত্র। ওর সারাটা শরীর থিরথির করে কাঁপছিল। আর সেই প্রতিরূপও একইভাবে এগিয়ে আসতে লাগল সৌমিত্রের মধ্য দিয়ে। দুই সৌমিত্র যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্যে একশরীর হয়ে গেল। আর সেই অপার্থিব সংস্পর্শের মুহূর্তে আপনা থেকেই একটা শব্দ যেন চাবুকের মতো বেজে উঠল সৌমিত্রের মনে, সমান্তরাল অস্তিত্ব। এই তবে রহস্যের শেষ উত্তর ! গুমঘরের অন্ধকারে যারা হারিয়ে যায় তারা আর ফিরে আসে না, ফিরে আসে তাদের সমান্তরাল অস্তিত্ব।
শরীরদুটো আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে গেল। এপারের সৌমিত্র এগিয়ে যেতে লাগল ওপারের পথে আর ওপারের সৌমিত্র এগিয়ে আসতে লাগল এপারে।
আলোটা আরও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে। সেই অতিজাগতিক আলোয় একটু একটু করে মিশে যেতে যেতে সৌমিত্র শুনতে পেল, পেছনে বহুদূর কোনও জগৎ থেকে ভেসে আসা এক অস্পষ্ট আওয়াজ।
একটু একটু করে বন্ধ হয়ে গেল দুই সমান্তরাল বিশ্বের সন্ধি-দরজা।
অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
ভাল লিখেছ বিভাবসু। ভালো লাগলো।
LikeLike
একটানে সকল দৃশ্য সরিয়ে নেওয়ার মতো।
দারুণ
LikeLike
সুন্দর গল্প
LikeLike
কল্প বিজ্ঞানের দারুণ গল্প।
LikeLike
চমৎকার লেখা।
LikeLike