তখন আমার ক্লাস ফাইভ। আমরা তখন বেহালার জেমস লঙ-এ থাকতাম। কিছুদিন আগেই বাবা বলছিল এক বন্ধুর বাড়িতে একটা কুকুর পোষার কথা। সেই প্রসঙ্গে কথা উঠল বাবাদের ছোটোবেলার কুকুর সিজারের কথা। সেটা ছিল একটা অ্যালসেশিয়ান। বাবারা চার ভাইবোন তাকে নিয়ে সারাদিন খেলত, সিজার কী কী করত তার কত গল্প শুনলাম। যদিও ছোটোবেলা থেকে সিজারকে নিয়ে অজস্র গল্প শুনে শুনে আমাদের প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির পুরনো অ্যালবামে সিজারের ব্ল্যাক এন হোয়াইট ছবিও দেখেছি। আমি বললাম “আমরাও তো একটা পুষতে পারি, অত বড়ো না হলেও ছোটোখাটো একটা কুকুর।” তা মা আর দিদিভাইয়ের সমবেত প্রতিবাদে সে আর্জি মোটেও পাত্তা পেল না। যাই হোক, আমিও ভুলে গেলাম সেই কথা।
এর কিছুদিন পর, দিনটা ছিল ১১ই জুন, ভরা গরমের সন্ধে। বিকেলে আমি নিয়মমতো বন্ধুদের সঙ্গে ছাতে খেলাধুলা করে বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খাচ্ছি। বসার ঘরে সকলেই আছি, বাবা তখনো ফেরেনি। ওই সময়টায় প্রতিদিন আমাদের নিয়ম করে কারেন্ট যেত। তাই বিকেল থেকেই মা সামনের টেবিলে হ্যারিকেন, দেয়ালগিরি, মোমবাতি সব গুছিয়ে রেখে দিত। সেদিনও অন্ধকারেই জলখাবার খাচ্ছিলাম। এমন সময়ে বাবা ফিরল, দরজায় টকটক। দিদিভাই উঠে দরজা খুলে কী যেন দেখে লাফিয়ে সরে এল। কী ব্যাপার? ওমা একি! বাবার কোলে ওটা কী? ছোট্ট সাদা একটা তুলোর বল যেন। বাবার এক বন্ধুর কুকুরের অনেকগুলো ছানা হয়েছে, এটা নাকি তারই একটা। জাতে জার্মান স্পিতজ। জন্মেছে মে মাসের ২১ তারিখে। তার মানে এর বয়স সবে একুশ দিন! কী মিষ্টি যে দেখতে, কিন্তু নতুন জায়গায় এসে ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
বাবা তো এসেই সোফায় দিদিভাইয়ের পাশে বসিয়ে দিল ওটাকে। মা প্রথমে খুব রাগারাগি করলেও শেষে তাকে থালায় করে দুধ খেতে দিল। ও বাবা, কীভাবে খেতে হয় এ তো তাও জানে না। শেষে বাবা নিজেই ঝিনুকে করে দুধ খাইয়ে দিল ওকে। কিন্তু নাম? কী বলে ডাকা হবে ওকে? এটা সেটা অনেকরকম নাম নিয়ে আলোচনা হলেও কোনটাই সকলের মনঃপূত হয় না। শেষে ঠাম্মা বলল, “তাহলে এর নামও সিজার হোক। এর আগে দুটো কুকুরের নাম আমাদের বাড়িতে ‘সিজার’ রাখা হয়েছিল।” এবার সবার পছন্দ হলো নামটা। সিজারই ভাল। সেদিন সারা সন্ধে ধরে তাকে ওই নামে ডেকে ডেকে পাগল করে ফেলা হল, নাম চেনাবার মহৎ উদ্দ্যেশ্যে আর কি। শেষে রাতের দিকে সে ‘সিজার’ ডাকে দৌড়ে আসতে আমরা দুই বোন যুদ্ধ জয়ের আনন্দে হইহই করে উঠলাম।
কয়েকদিন বাদে ওপরের ফ্ল্যাটের অ্যালসেশিয়ান চিকু আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে যাবার সময় দরজা খোলা পেয়ে হঠাৎ উর্ধশ্বাসে ছুটে সোজা পড়ার ঘরের সামনে হাজির, নির্ঘাত গন্ধ পেয়েছে। কী ভাগ্যিশ সিজারকে নিয়ে আমরা দুই বোন তখন প্রাত্যহিক ট্রেনিং সেশনে ব্যস্ত ছিলাম, তাই দরজা বন্ধ ছিল। চিকু ব্যর্থ মনোরথ হয়ে দু-তিনবার হাঁকডাক করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে ফিরে গেল, ওদিকে সিজার ভয়ে কাঠ, কিন্তু আমরা উল্লসিত! কেন? কারণ সেই প্রথম ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে সিজার তার গলা দিয়ে কুঁই কুঁইয়ের মতো শব্দের সঙ্গে একটু ভৌ ভৌও করেছে! এ কী কম বড় কথা! তেনার প্রথম কথা বলার খুশিতে বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল সেদিন।
তো এইভাবেই বড়ো হয়ে উঠলেন তিনি একটু একটু করে। বিকেলে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার দায়িত্ব ছিল দিদিভাইয়ের। তার ততদিনে প্রাথমিক অভক্তি কেটে গিয়ে সিজারের প্রতি এক অদম্য টান জন্মেছে। ও ব্যাটাও একটু বেশি যেন বড়দি ন্যাওটা। মানে দিদিভাই ওর বড়দি আর আমি ওর ছোড়দি হব এটা আমিই ঠিক করেছিলাম আরকি, বাড়িতে কেউ একজন তো আমার চেয়ে ছোটো আছে এখন।
কিন্তু ছোড়দি হলেও আমাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না সে। বোধহয় আমার কোলে উঠে ঠিক আরাম পায় না, পড়ে যাবে ভাবে। আসলে আমিও তো তখন ছোটো। আর সিজার যেন বড়ো হচ্ছিল তরতর করে।
যা বলছিলাম, বিকেল হলেই তার হাবভাব বদলে যেত। দিদিভাই স্কুল থেকে ফিরে জামাকাপড় পাল্টাবে, খেতে বসবে এই অবধি তিনি ধৈর্য ধরে হাঁটু মুড়ে ভদ্রভাবে বসে দেখতেন। অবশ্য জিভ বার করে, ল্যাজ নেড়ে, হাসি হাসি মুখ করে নিজের উৎসাহ জানাতে ভুলতেন না। কিন্তু খাওয়া যেই শেষ হল আর তাকে ধরে রাখা যাবে না। দৌড়ে একবার দরজার কাছে তো একবার দিদিভাইয়ের সামনে, এই ওর জামা ধরে টানে তো এই জুতো নিয়ে চলে আসে। কে বলে ওরা অবোলা? সিজার যেভাবে ওর সব কথা আমাদের বুঝিয়ে দিত আর আমাদের সব ধমক, আদর, বকুনি, প্রশ্রয়কে বুঝে নিত তাতে কখনো মনে হয়নি কথা বলতে পারে না বলে ওর কোন অসুবিধা হয় বলে। ঠাম্মা বলত ও আগের জন্মে মানুষ ছিল, সব কথা নাহলে বুঝে নেয় কী করে? আমরা বলতাম ও পরের জন্মেও মানুষ হয়েই জন্মাবে, আমাদের ভাই যে! ওর একটা ভাল নামও আমরা দিয়েছিলাম, সিজারিয়ান চ্যাটার্জী। আর সিজার হলো ডাকনাম।
সিজারকে বাথরুম ম্যানার্স শেখাতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি। খুব ছোটো থেকেই শেখানো হয়েছিল ছোটো কাজের জন্য তাকে বাথরুমে যেতে হবে, বড়র জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো দু’বেলা। এত সুন্দর করে রপ্ত করেছিল সেটা, যে কেউ যদি বাথরুমে থাকত ও বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত। দাঁত ওঠার সময় খুব দুষ্টুমি করত। হয়তো দাঁত সুরসুর করতো বলেই, বাড়ির এমন কোন চটি ছিল না যেটাকে উনি ছিঁড়ে কুটিকুটি করেননি। মেজাজ ছিল ষোল আনা। বাড়ির সবাই মিলে কোথাও গেলে সিজারকে একা রেখে যাওয়া ছাড়া গতি ছিল না। হয়তো কয়েক ঘন্টার জন্য গেছি। ফিরে এসে দেখতাম আলনা থেকে সবার জামাকাপড় টেনে ফেলে দেওয়া হয়েছে মাটিতে, সোফার একটা কুশন দাঁতে কেটে ছেঁড়া হয়েছে, খবরের কাগজের দশা তথৈবচ, যদিও তেনার টিকিটি নেই। গেট খোলার আওয়াজ পেয়েই ব্যাটা খাটের তলায় সেঁধিয়েছে। জানে আজ কপালে বকুনি আছে। অনেক সাধ্য-সাধনা করে, বকে, বুঝিয়ে তাকে বাইরে আনা যদি বা হলো এবার তিনি গুটিশুটি মেরে এক কোণে অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন, ল্যাজ দুই পায়ের ফাঁকে, কান খাড়া, মুখ কাঁচুমাচু।
বাবা মায়ের বকা হয়ে গেলে আমরাও ছোট্ট করে বকুনি দিয়ে দিতাম একটু। তাতে আবার তার অভিমান হতো। আর সেটা তিনি দেখাতেন খাবার দেবার পর। সামনে খাবারের থালা ফেলে রেখে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে তিনি তখন গোঁসা করে বসে আছেন। এদিকে খাবারের কাছে হাত নিয়ে যাও, তখন দাঁত খিঁচিয়ে রাগ দেখাবে। অর্থাৎ বাবা এসে না খাওয়ালে তিনি খাবেন না। তবে ভারী শান্তিপ্রিয় কুকুর ছিল সিজার। সেটা বুঝতে পারতাম আমাদের দুই বোনের মারপিট হলে। আমরা দুজনে চিৎকার করছি আর সিজার লাফিয়ে লাফিয়ে একবার দিদিভাইকে বকছে আর একবার আমাকে বকছে। খুব চেষ্টা করতো ঝগড়া থামাবার।
চান করতে ছিল প্রবল অনীহা। বাবা প্রতি রবিবারে চান করাত ওকে। রবিবার সকালে দুধ রুটি খাওয়া হয়ে গেলেই সোফা কিংবা খাটের নীচে ঢুকে বসে থাকত, জানে আজ রেহাই নেই। মা কোনদিনই কুকুর পছন্দ করত না। যদিও সকলের উৎসাহ দেখে সিজারকে মেনে নিয়েছিল। তবে ও বাড়িতে আসা ইস্তক কোনদিন গায়ে হাত দিয়ে আদরও করেনি। সেটা কিন্তু সিজার খুব ভাল বুঝত। কখনোই মায়ের কাছে গিয়ে বিরক্ত করত না। শুধু খাবার সময় হলে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বসে থাকত। বুঝতো এটা এই বাড়িতে একমাত্র ইনিই দিতে পারেন।
এমনিতে বাড়িতে লোক এলে সিজারের চিৎকারে কথা বলা যেত না। কিন্তু যেদিন ঠাম্মা মারা গেল, বাড়িতে সেদিন কত লোক। সিজার একবারও কাউকে বিরক্ত করেনি। শুধু ঠাম্মাকে যখন নিয়ে যাচ্ছে একবার এসে ঘরটা ঘুরে চলে গেল। কী বুঝেছিল কে জানে।
ওর প্রিয় খাবার ছিল মাংস ভাত। কিন্তু শনিবারে নিরামিষের দিন বলে একটা দিন ওকে দই ভাত দেওয়া হতো। সেদিন তার খিদেই পেত না সারাদিন। মায়ের বকুনি খেয়ে বিকেলে অতি কষ্টে আধ প্লেট খেয়ে আমাদের উদ্ধার করত। আর একটা জিনিসে তার লোভ ছিল আমাদের চেয়েও বেশি। সেটা হলো ডেয়ারি মিল্ক চকলেট। কারোর হাতে থাকলে হলো, তার সঙ্গে সিজার চুম্বকের মতো আটকে যেত। অনেক চেষ্টা করে দেখছি, লুকিয়ে নিয়ে এসেছি, ও কীভাবে যেন ঠিক টের পেয়ে যেত। আর যতক্ষণ না ওকে দেয়া হবে এমন করে ঘাড় বেকিয়ে জিভ বার করে তাকিয়ে থাকবে যে ওকে না দিয়ে খাওয়াই যাবে না।
দিদিভাইয়ের যেদিন বিয়ে হয়ে গেল সেদিন দিদিভাই চলে যাবার আগে ওকে কত ডাকল, সে তো কাছেই আসতে চায় না। অনেক ডাকার পর একবার এসে একটু আদর খেয়ে চলে গেছিল। বোধহয় বুঝেছিল ওর অধিকার কমে গেল। তবে পরে দিদিভাইয়ের যমজ দুই মেয়ে যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ি এল তখন সিজারের কাজ ছিল সারাদিন ওদের ঘরের দরজায় বসে পাহারা দেওয়া। ছোটোবেলায় আমাকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও বড়ো হয়ে সিজার আমার খুব ভাল বন্ধু হয়েছিল। তবে বয়স হয়ে গিয়েছিল, পেরে উঠত না তেমন আর। ২০০১ সালের ২০শে জুন চোদ্দ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল সিজার, চিরকালের জন্য। আমি শেষ দেখাটাও দেখতে পাইনি। বাড়ি ফিরে শুনলাম ও মায়ের পায়ের কাছে শুয়ে ঘুমের দেশে চলে গেছে। তারপরে আর কখনো কুকুর পোষার ইচ্ছে হয়নি আমার। সিজারকে ভুলতে পারব না যে। বড়ো তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল আমাদের ছেড়ে। কিন্তু এখনো সিজারের কথা উঠলে কত অজস্র স্মৃতি যে ভিড় করে আসে, ওকে ভেবেই মন ভাল হয়ে যায়। আসলে সিজার চিরকাল থাকবে আমাদের মধ্যে, পরিবারের সদস্যকে কি ভোলা যায়?
মন ভরে গেল।
LikeLike
খুব সুন্দর লিখেছিস
LikeLike