বাড়ির কুকুরের সব স্মৃতিই অনেকসময় খুব মিষ্টি হয় না। তবে, তাদের বিভিন্ন দুষ্টুমি ও খেয়ালিপনার স্মৃতিগুলোই মনে দাগ রেখে যায়। হয়ত এই ঘটনাগুলোই তাদের আসল চরিত্র তুলে ধরে। প্রভুভক্ত কিম্বা প্রভু-আসক্ত জীবগুলির মনের ভিতরে আসলে কী চলে তা এই নষ্টামিগুলো থেকেই বেরিয়ে আসে। তখন তারা নিছক পোষা জানোয়ার থেকে পরিবারের একজন সদস্য হয়ে ওঠে, যে দোষে-গুণে মেশানো একজন আত্মীয়-হেন জীব।
গুপীর কথা লিখতে গিয়ে বার বার মনে হয় কোন গুপীর কথা লিখব? একটি নিরীহ পোষা প্রাণী , না নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে, ভালো অভ্যাস বদ অভ্যাস সমেত একটি পরিবারের সদস্য । দ্বিতীয় রূপটাতেই মন সায় দেয়।
গুপীর জীবনের চাওয়া-পাওয়াগুলো সীমিত হলেও ঠিক সাধারণ ছিল না। গুপী তার মানুষ মায়ের প্রথম কুকুর ছিল। তাই সে বড় হয়েছিল বে-হিসেবি আদর পেয়ে। ভয় সে প্রায় কাউকেই পেত না। যা চাই তা না পেলে নিয়ম বহির্ভূত পদ্ধতিতে সেগুলো হাসিল করতে সে কখনই পিছপা হত না। ভয় ঠিক নয়, তবে তার মানুষ দাদা গামাকে ঈষৎ সমীহ করে চলত। কারণ তার গর্হিত কাজকর্মগুলো ধরা পড়লে উচ্চৈঃস্বরে বকুনি বা মেঝেতে হাওয়াই চটির আওয়াজ দিয়ে শাসন ,সেই দাদা ই করত।
তার প্রবল আসক্তির জিনিসগুলির মধ্যে একটা ছি্ল ইলিশ মাছ। ইলিশের অসংখ্য কাঁটা ও প্রচুর চর্বির কারণে ওটা ছিল ওর পক্ষে দুষ্পাচ্য, প্রায় বিষবত। আসক্তির দ্বিতীয় বস্তুটি ছিল চকলেট। চকলেটে যে Theobromine থাকে তা ওর দ্বারা হজম করা একেবারেই অসম্ভব,অর্থাৎ ওটাও গুপীর জন্য সাক্ষাত বিষ। কিন্তু না! চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। এই দুই খাবারের গন্ধের রেশ মাত্র পেলেই গুপী চেয়ে, কেড়ে বা চুরি করে তা হাসিল করবেই।
কম্মা (ওরফে কমলা) অর্থাৎ গুপী ও গামার পালিকা একবার ছয় টুকরো ইলিশ মাছ বেশ করে সরষে, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে রেঁধে, খাবার টেবিলে রেখেছিল। গুপীর গুণপনা যেহেতু কমলার অজানা নয় , সেহেতু সে টেবিলের ওপরের খাবার বেশ করে ঢাকা দিয়ে, আশপাশ থেকে চেয়ার সরিয়ে রেখেছিল। চেয়ার কাছে থাকলে, টেবিলে ওঠা গুপীর কাছে নস্যি। এক লাফে চেয়ারে তারপর দ্বিতীয় লাফে টেবিলে! কিন্ত এবার গুপী কিন্তু সেই আসাধ্য সাধন করেছিল। আজ পর্যন্ত জানা যায়নি ওই হার্মাদ কুকুর কী করে টেবিলে চড়ে ছয় টুকরো মাছ ঝোল সমেত চেটেপুটে খেয়েছিল। কমলার মত স্নেহশীল মানুষ পর্যন্ত রুটি বেলার বেলন নিয়ে তাড়া করেছিল গুপীকে। গুপী আবশ্য থোরাই কেয়ার করত কমলা আর তার বেলনকে। তক্কে তক্কে থাকত কখন আবার সুযোগ আশে ।
সেবার আমাদের ভাগ্নে, রব্বু , কানাডা থেকে ফেরার সময় , এক বাক্স লিকার চকলেট নিয়ে এল, সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত গামার জন্য। সেদিন যেন কী এক উপলক্ষে বাড়িতে খাওয়াদাওয়া। ভাইফোঁটা হবে হয়ত। এমনিতেই আমরা বাড়িতে দশ এগার জন। তার ওপর নিমন্ত্রিত তুতো ভাইবোন মিলে খানেওআলা জনা পঁচিশ লোক। দোতলায় টুটিমার বসার ঘরে খাওয়ার ব্যবস্থা।
গুপীর তিনতলা বাড়িতে এমনিতে অবাধ বিচরণ। কিন্তু নিমন্ত্রিতদের মধ্যে কয়েকজনের কুকুরে ভয় থাকার দরুন ওকে খানিকক্ষণ আমাদের একতলার ঘরে একা রাখা হয়েছিল । গামার হাত খালি হলে , চেন-এ বেঁধে তাকে এনে দোতলায় সবার মাঝখানে রাখা হল। গুপী শান্ত সুবোধ ছবির কুকুরের মত লম্বা কান ও সদ্য আঁচড়ান রোঁয়া ছড়িয়ে, রাজপুত্তুরের মত বসল। মাথার ওপর দিয়ে সুগন্ধ ছড়ান খাবারের প্লেট যাওয়া আসা করছে , নানান পরিচিত, অপরিচিত, অর্ধপরিচিত লোক যাতায়াত করছে , গুপী তার দাদার পায়ের কাছটিতে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে, একটা হইচই-এর পরিবেশ চারদিকে!
এই অবস্থায়, কোন আগাম জানান না দিয়ে, গুপী উগড়ে দিল একরাশ না হজম হওয়া চকলেট যা তখন গলে গিয়ে ক্বাথে পরিণত হয়েছে। তা থেকে বের হওয়া চকলেট আর বিভিন্ন মদের গন্ধে সারা ঘর ভরে গেল। কুকুর-প্রেমি কুকুর-ভীত নির্বিশেষে নিমন্ত্রিতরা খাওয়ার জায়গা ছেড়ে এদিক-ওদিকের ঘরে আশ্রয় নিলেন। সেই গা গুলনো গন্ধে কার কার খাওয়া নষ্ট হয়েছিল সেই দিন, আমরা ভয়ে তার আর খোঁজ করিনি।
গামা কোনরকমে খাবার প্লেট সরিয়ে ঝাঁটা-বালতি নিয়ে সেই জায়গা পরিষ্কার করে, কুকুর-সমেত একতলায় পালিয়ে বাঁচল। সেখানে গিয়ে দেখে, সারা ঘর চকলেট-এর মোড়কের কাগজে ভর্তি। গুপী টুলে উঠে সেখান থেকে চেয়ারে চড়ে, পড়ার টেবিল-এর ওপর রাখা চকলেট-এর বাক্স পেড়ে গুনে গুনে চব্বিশটা লিকার চকলেট খেয়েছে। Theobromine যেহেতু কুকুরে হজম করতে পারে না, সেহেতু গুপী তা স্বাভাবিকভাবে বের করে ফেলেছে। তাতে যে জনা পঁচিশ নিমন্ত্রিতের খাওয়ার বারোটা বেজেছে, তার জন্য গুপী নাচার।
গুপীর গুণপনার নানা গল্প মনে পড়ে। আজ চার বছর হল সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু তার নানা কীর্তি-কাহিনি পরিবারের সদস্যদের মুখে মুখে ফেরে, আজও।
বা:, স্নিগ্ধ সুন্দর লেখা
LikeLike