আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না
পাখি দেখা – ৬
বুলবুল
অলোক গাঙ্গুলী
‘বুলবুল পাখি, ময়না, টিয়ে, আয়না যায়না গান শুনিয়ে’, ছোটোদের জন্য এই গান রচনা করেছিলেন স্বনামধন্য সুরকার স্বর্গীয় সলিল চৌধুরি এবং আজও এই গান যথেষ্ট জনপ্রিয় সকলের কাছে। এই গান থেকেই জানা যায় যে বুলবুল আর সব শিল্পী পাখিদের পর্যায়ে পড়ে। এবং অন্য এক বাঙলা গানে জানা যায় যে পাখিদের গানের পাঠশালায় বিজয়ী কিন্তু হয়েছিল বুলবুল পাখি। আর বলে রাখি যে পাখিদের পাঠশালার গুরু হল কোকিল। এবার এই বুলবুল পাখিকে নিয়ে আমাদের এই ষষ্ঠ পর্ব আরম্ভ করছি।
বুলবুল পাখি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয় পাখি। এই এলাকার বাইরে চীনেও এদের দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, মায়ানমার ও ভিয়েতনাম বুলবুলের স্থায়ী আবাস। এছাড়া আরও বিভিন্ন দেশে পাখিটি অবমুক্ত করা হয়েছে। ১৯০৩ সালে ফিজিতে চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে পাখিটি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৩ সালে সামোয়ায় পাখিটির bengalensis উপপ্রজাতি অবমুক্ত করা হয়েছে। ১৯১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে পাখিটি অবমুক্ত করা হলেও ১৯৪২-এর পরে এখানে আর তাদের দেখা যায়নি। অকল্যান্ডে ১৯৫০ সালে এদের ছাড়া হয়। অকল্যান্ডে এদের বিলোপ ঘটানো হলেও নিউজিল্যান্ডের বহু জায়গায় এরা ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া বাহরাইন, ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, নিউ ক্যালিডোনিয়া, ওমান, কাতার, টোঙ্গা ও যুক্তরাষ্ট্রেও এদের অবমুক্ত করা হয়েছে।
বুলবুল পাখি সাধরণত ঝুঁটিওয়ালা পাখি হয়। এদের মাথার ওপরে ঝুঁটি দেখে এদের চিহ্নিত করা যায়। সব থেকে সাধরণ বুলবুল যা আমাদের আশপাশে প্রায়ই দেখা যায় তা হল গিয়ে ছোট ঝুঁটিওয়ালা, লেজের তলার দিকে লাল ও গায়ের রঙ কালচে বাদামি। একে আমরা বুলবুল বলেই ডাকি এবং ইংরেজিতে বলা হয় রেড ভেন্টেড বুলবুল (Red Vented Bulbul)। কীটপতঙ্গ, ছোট ফল প্রভৃতি এদের খাদ্য। বসন্ত কালে সরু কাঠি দিয়ে গাছের ডালে গোল বাটির মতন বাসা বানায়। সাধরণত জোড়ায় অথবা ছোট দলে দেখা যায়। এদের কে আমাদের রাজ্যে প্রায় সর্বত্র দেখা যায়।
সাধরণ বুলবুলের আকারেই আরেক ধরণের বুলবুল, নাম সিপাই বুলবুল আর ইংরেজিতে বলে রেড হুইস্কারড বুলবুল (Red Whiskered Bulbul)। এদের চোখের নিচের রঙ লাল, মাথা আর ঘাড় কালচে বাদামি। গলা, পেট ও বুক ধবধবে সাদা। এরাও পঃবঙ্গের প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। ডাক সাধরণ বুলবুলের মতই, একটু সরু। এদের মাথায়ও ছোট কালো ঝুঁটি। জোড়ায় বা কখনো ছোট দলেও দেখা যায়। খাবারের মধ্যে পোকামাকড়, ফল ইত্যাদি। বোধহয় কিছুটা ইংরেজ সিপাইদের মতন দেখতে তাই হয়ত এদের সিপাই বুলবুল বলা হয়, অবশ্য এই তথ্য আমি অনুমান থেকেই দিলাম, সঠিক কারণ আমারও জানা নেই। এদের এক জোড়া আমি প্রথম দেখি আমার বাড়ির পেছনে একটা বেল গাছের মগ ডালে। অনেকক্ষণ ওরা ওখানে বসে বেশ মেজাজে গল্প করে গেলো। আমাকেও যথেষ্ঠ সুযোগ দিলো ওদের প্রাণ ভরে ছবি তোলার। সাধারণ বুলবুল এবং সিপাই বুলবুল মাঝে মধ্যে এক সঙ্গে দেখা যায় একই গাছের ডালে বসে। সেই ছবি কিন্তু দেখতে ভীষণ ভাল লাগে।
বেশীরভাগ প্রজাতির বুলবুলি আমরা হিমালয় অঞ্চলেই দেখতে পাই। এই সব বুলবুলিদের সমতল ভুমিতে বলতে গেলে দেখাই যায়না। তাদের দেখতে হলে একমাত্র আমাদের দেশের উত্তর প্রান্তরে হিমালয় পর্বতমালায় গিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই। নানা রঙের, বিভিন্ন রকমের এই বুলবুলিদের আবাস এই হিমালয় সংলগ্ন বন্যাঞ্চলে। তবে এখানে বলে রাখি যে প্রায় সব বুলবুলিদের একটা সাদৃশ্য আছে আর সেটা হল গিয়ে ওদের মাথার ওপর ঝুঁটি। আরো অনেক পাখিদেরই মাথায় ঝুঁটি আছে, তাদেরকে বুলবুলিদের সঙ্গে এক করে ফেললে ভুল হবে। বুলবুলিদের আকার প্রায় এক রকমের, কেবল রঙ আলাদা, আবাসস্থল আলাদা।
পাহাড়ি বুলবুলিদের মধ্যে প্রথমে বেছে নিলাম হিম বুলবুলিকে। হিম বুলবুলি অথবা হিমালয়ান বুলবুল (Himalayan Bulbul) হিমালয় অঞ্চল ছাড়া দেখা মেলেনা। এদের মাথার ওপর ঝুঁটিটা দেখার মতন হয়। ঠিক মনে হয় যেনো চিরুনি দিয়ে আঁচড়ান। দেখলে পরে বেশ ফিটফাট মনে হয়। লেজের তলায় হলুদ রঙ্গও বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। সাধরণত জোড়ায় বা ছোট দলেও দেখা যায়। আমার দেখা হিম বুলবুলি প্রথম ডুয়ার্সের জঙ্গলে, গোরুমারা আর জলদাপাড়ায়, দুটি অঞ্চলই হিমালয় পর্বতমালা বলয়ের মধ্যে পড়ে। অবশ্য পরে জিম করবেট টাইগার রিজার্ভে প্রাণ ভরে উপভোগ করেছিলাম এই পাখিদের ওখানকার ঘাসভুমি অঞ্চলে। এরা দেখতে যেমন মিষ্টি, এদের ডাকও তেমন মধুর।
এরপর স্থান পাবে আমার তালিকায় স্থান পাবে পাহাড়ি বুলবুলি (Black Bulbul)। এদের মাথার ঝুঁটি আবার ঠিক হিম বুলবুলির বিপরীত। দেখলে মনে হবে অপরিচ্ছন্ন, মাথার চুল আঁচড়ায়না, উস্কোখুস্কো। ইংরেজিতে অক্সিমোরোন (Oxymoron) শব্দাবলি তে একে ‘কেয়ারলেস ব্ল্যাক বিউটি (Careless black beauty)’ বলা যেতে পারে। তবে যেরকমই হোকনা কেনো, ভাল না লেগে উপায় নেই। ভীষণ রকমের ছটফটে আর ডাকাডাকি করে বেড়ায়। উড়ন্ত অবস্থায় কীটপতঙ্গ ধরে খায়। এদের গায়ের রঙ ধুসর থেকে পুরোপুরি কালোও হয়। পা আর ঠোঁট টকটকে লাল রঙের।
আরো এক ধরণের বুলবুল আমরা দেখতে পাই এই হিমালয় অঞ্চলে, সেটা কে বলা হয় রেখা বুলবুলি (Striated Bulbul)। মাথায় ঝুঁটি ও পিঠের রঙ জলপাই-বাদামি এবং সাদা রঙের সুক্ষ্ম ছিটে। সেই জন্যেই নাম দেওয়া হয়েছে রেখা বুলবুলি। তলপেট থেকে লেজের গোড়া পুরোপুরি হলুদ। এদের ডাকও অন্যান্য বুলবুলিদের মতনই খুব মিষ্টি। হিম বুলবুলিদের মতন রেখা বুলবুলিকেও সমতল ভুমিতে দেখা যায়না। এরা বোধহয় পাহাড়ের শীতল পরিষ্কার পরিবেশ ছেড়ে বেরোতে চায়না।
রাজ বুলবুলি, সত্যিই রাজকীয় এর হাবভাব (Black Crested Bulbul)। বক্সা পাহাড়ে ট্রেক করার সময় এর দেখা পাই কিন্তু ক্যামেরা তাক করেতে করতেই উড়ে যায় আর ওকে ধরে রাখতে পারলামনা। সাধরণত এরা একটু লাজুক প্রকারের হয়, তাই বোধহয় আমার কাছে আর ধরা দেয়নি। গায়ের রঙ সোনালি, মাথা থেকে গলা পর্য্যন্ত পুরোপুরি কালো আর মাথায় সুন্দর ছোট ঝুঁটি। কি অপুর্ব দেখতে এই বুলবুলি। চোখ সরাতেই ইচ্ছে হবেনা। এরপর আবার কখন হিমালয়ের দিকে গেলে একে অবশ্যই বন্দি করে নিয়ে আসব – আমার লেন্সে।
আরো দু ধরণের বুলবুলির বিবরণ দিচ্ছি, এদের দেখা আমি আজ পর্য্যন্ত পায়নি। তাই এদের বিশ্লেষণ করতে কিছু বই ও পত্রিকার সাহায্য নিলাম। প্রথমটি হল চশমা বুলবুলি আর অন্যটি সাদা গলা বুলবুলি। প্রথমটি আমাদের রাজ্যের দঃ পশ্চিমাংশের জেলাগুলিতে দেখতে পাওয়া যায় আর পরেরটি পাহাড়ি অঞ্চলের।
চশমা বুলবুলি (White Browed Bulbul) – সাদা তুষারযুক্ত বুলবুল প্রায় ২0 সেন্টিমিটার (7.9 ইঞ্চি) লম্বা, মাঝারি লম্বা (8 সেন্টিমিটার বা 3 ইঞ্চি) লেজ। এর পিঠের ওপর জলপাই ধূসর এবং পেটের দিকে হালকা ময়লা সাদা রঙ। চোখের ওপর ও নিচে সাদা ক্রিসেন্ট দ্বারা সনাক্ত করা যায়। এই প্রজাতিগুলি দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলংকাতে পাওয়া যায়। উত্তর সীমানা গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ এবং দঃ পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গ পাওয়া যায়। মাঝে-মাঝে এদের বীরভুম ও বর্ধমানেও দেখা গেছে। এই বুলবুলগুলি সাধারণত একক বা জোড়ায় দেখা যায়। তারা ফল, এবং পোকামাকড় খেয়ে থাকে। প্রজনন ঋতু মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং সম্ভবত বছরে দুইবার প্রজনন করতে পারে। প্রজনন ফেব্রুয়ারী এবং আবার সেপ্টেম্বর ঘটে। এরাও লাজুক প্রকৃতির, তাই এদের ডাক পাওয়া যায় বেশি দেখা পাওয়ার থেকে।
বুলবুলিদের তালিকায় শেষ পাখি সাদা গলা বুলবুলি (White throated Bulbul) – প্রধাণত হিমালয়ের বাসিন্দা। তবে শীতকালে মাঝে-মধ্যে সমতল ভুমিতেও নেমে আসে। পাহাড়ি বুলবুলির মতন এর ঝুঁটিও উস্কোখুস্কো, অর্থাৎ একেও ‘কেয়ারলেস বিউটির’ পর্য্যায়ে ফেলা যায়। পিঠের ওপর জলপাইরঙা, ডানা ও লেজ মরচে বাদামি, চিবুক, গলা সাদা আর বাকি অংশ হলুদ। ঝোপঝাড় আর জঙ্গলেই থাকতে বেশি পছন্দ করে। জোড়ায় অথবা দলেও থাকে।
এছাড়াও অন্যান্য কিছু বুলবুলি যেমন ‘ব্ল্যাক ক্যাপড্ বুলবুল’, অনেকটা রাজ বুলবুলির মতন দেখতে, কিন্তু এরা শ্রীলঙ্কার স্থায়ী বাসিন্দা। সঠিক বাংলা নাম জানা নেই। ‘ফ্লেম থ্রোটেড বুলবুল (Flame throated Bulbul)’, ভারতের পশ্চিম ঘাটে, কেরালা ও কর্ণাটক অঞ্চলে দেখা মেলে। এদের স্বর খুব মিষ্টি। ‘Yellow Eared Bulbul (ইয়েলো ইয়ারড্ বুলবুলি), প্রধাণত শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা, উচ্চ মিষ্টি স্বরে ডাকে। চোখের পেছনে হলুদ গোছার দাগ থেকেই বোধহয় এই নাম।
প্রথমেই জানিয়েছি পাখিদের গানের প্রতিযোগিতায় বুলবুলি বিজয়ী। অর্থাৎ এর থেকে বোঝা যায় যে কোকিলের পরে সব থেকে মধুর গলার অধিকারি এই বুলবুল পাখি। এর পর অবশ্যই এদের দেখা পেলে কেবল ছবি তুলে লেন্স বন্দি করে স্বস্তি পেলে চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের মোবাইল এ্যাপের ভয়েস রেকর্ডারে ওর স্বরকেও বন্দি করে ফেলতে হবে। তাই পরবর্তী কালে এটাই হবে নিজের সংগ্রহে এক অমুল্য সম্পদ।
আলোকচিত্রঃ লেখক