বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়
আলাদিনের গুহা
এ মার্ভিন স্মিথ অনুবাদ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
পথ চলতে চলতে পুবের দিকে উঁচু হয়ে যাওয়া একটা এলাকার দিকে দেখিয়ে পেরমল বলে, “ওইদিকে যেতে হবে দাভারু। এখানে কয়েক মাইল জুড়ে অনেক পুরনো খাদান, তবে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়োগুলো আছে ওইদিকে।
সেদিকে কিছুদূর এগোতেই একে একে গভীর খাদানগুলো নজরে এল। এমনিতে চোখে পড়ে না। ঘন কাঁটাঝোপে তাদের কুয়োর মুখের মত মুখগুলো ঢাকা। শুধু পাশে উঁচু হয়ে থাকা মাটির ঢিপি দেখলে বোঝা যায় সেখানটায় খাদান খোঁড়া হয়েছিল কখনো। সেগুলো খেয়াল করে সাবধানে না চললে ঝোপঝাড়ে ঢাকা গর্তে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটবারও সম্ভাবনা থাকে। এদের মধ্যে বড়োসড়ো একটা গর্ত বেছে নিয়ে চেঞ্চুরা কুড়ুল চালিয়ে তার মুখটা চটপট সাফ করে ফেলল। দেখা গেল একটা ফানেলের মত নিচের দিকে বেশ খানিক ঢালু হয়ে এগিয়ে গিয়ে তারপর খাড়াই সুরঙ্গের রূপ নিয়েছে কুয়োটা। অনেকটা ফ্লোরেন্টাইন ফ্লাস্কের মত গড়ন তার।
এইবার তার ভেতরে নামবার পালা। শক্তপোক্ত, হালকা দড়ি আমার সঙ্গে থাকে। তাই বের করে একটা গাছের কাটা গুঁড়ির সঙ্গে ভাল করে বেঁধে দড়ি নামিয়ে দিলাম গর্তের ভেতর।
এইসব পুরোনো কুয়োয় অনেক সময় বিষাক্ত গ্যাস জমে থাকে। তাই কুয়োয় পা দেবার আগে একটুকরো ঘাসে আগুন দিয়ে তার ভেতরে ফেলে দিয়েছিলাম। সেইটে তিরিশ ফুট নিচে তার একেবারে তলায় গিয়ে পড়েও দিব্যি জ্বলতে লাগল। দেখে বুঝলাম এখানে নামলে বিপদের ভয় নেই। একদলা ভেজা মাটিতে একটা মোমবাতি গেঁথে নিলাম আমি এবারে। তারপর মাটির দলাটা খনিকর্মীদের ঢং-এ টুপিতে বসিয়ে নিয়ে দড়ি ধরে খাদানের ভেতর নামা শুরু করলাম।
নিচে পৌঁছে দেখি খাদানের মুখ থেকে ঝরে পড়া মাটিতে তার মাঝখানটা একটা ঢিপিমত হয়ে আছে। তার থেকে চারপাশের জমি ঢালু হয়ে নেমে হারিয়ে গেছে বিশাল খনিগর্ভের অন্ধকারে। সেটা ঠিক কতবড়ো সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। টুপিতে আঁটা মোমবাতির মিটমিটে আলোর সে-আন্দাজ দেওয়ার সাধ্যও ছিল না।
অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিয়ে খানিক বাদে আমি খনিগর্ভটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। সেটা আদৌ হিরের খনি, নাকি অন্য কোনো খনিজের খাদান সেইটা আগে বোঝা প্রয়োজন।
খানিক বাদে খনিগর্ভের একদিকের দেওয়ালের কাছাকাছি আসতে খেয়াল হল, মোমবাতির আলো পড়ে সেখানে সোনালি আর সবুজ রঙের ঝিলিক মারছে। যেন দেওয়ালটা দামি রত্ন বসিয়ে গাঁথা। একটু অবাক হয়ে আমি এইবার অন্য দেওয়ালগুলোর দিকে আলোটা ধরে ঘুরে দেখলাম। এতক্ষণে অন্ধকারে আমার চোখ সম্পূর্ণ অভ্যস্ত হয়েছে। মোমবাতির যেটুকু ক্ষীণ আলো খনির অন্যান্য দেওয়ালগুলোতে গিয়ে পড়েছে তাতেই চোখে পড়ছিল, প্রত্যেকটা দেওয়ালেই সেই নানা রঙের চিকিমিকি। কোথাও সাদা, কোথাও লাল আবার কোথাও তা সবুজ। যেন নানারঙের জোনাকির একটা ঝাঁক এসে দেওয়ালগুলো জুড়ে বসে আছে। যেন আলাদিনের রত্নগুহা! তার দেওয়ালে দেওয়ালে থরে থরে সাজানো রয়েছে সাদা হিরে, লাল চুনি আর সবুজ পান্নার দল।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আমার সে-দিনটা জুড়ে আরব্য উপন্যাসের নানান অধ্যায় বাস্তবে ঘটে চলেছে। দিনের শুরুতে সিন্ধবাদের অভিযান আর তারপর এখন এই আলাদিনের গুহা!
কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে উঠল খনির অন্ধকার থেকে। অনেকটা বেড়ালের গরগরানির মত শব্দ। আর তারপর দূরের দেওয়ালের কাছে অন্ধকার থেকে ভেসে উঠল একটা বিরাট বেড়ালের গাঢ় অন্ধকার ছায়া! ধুকপুকে বুকে আমি তাড়াতাড়ি খনির মাঝখানের সেই উঁচু জায়গাটাতে সরে এলাম প্রথমে। তারপর মাথা উঁচিয়ে পেরমলকে ডেকে বললাম, “আমার বন্দুকটা নিয়ে এইখানে নেমে এস তো! আর, কয়েকটা মোম। তাড়াতাড়ি।”
কুয়োর খাড়াই সুরঙ্গের ঠিক নিচের উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে এইবার একটু নিরাপদ বোধ করছিলাম আমি। ছায়াটা যারই হোক, এইখানে উঠে এসে আক্রমণ করাটা তার পক্ষে খুব সহজ হবে না। দড়ি বেয়ে পেরমলকে বন্দুক হাতে নেমে আসতে দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম, কোনো খনিতেই হিরে, চুণি আর পান্না একসঙ্গে থাকা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ। তাছাড়া, না-কাটা রত্ন থেকে এভাবে কখনো আলো ঠিকরাবার কথাও নয়। তাছাড়া নড়াচড়া করলেই আলোর ছটাগুলোর ঔজ্জ্বল্য বদলে যাচ্ছিল বারবার। সব মিলিয়ে অনুমান করছিলাম, যা দেখছি তা সম্ভবত অভ্রের চাঙড়ের গায়ে বিভিন্ন কোণে আলো ঠিকরোবার ফল।
ততক্ষণে পেরমল নেমে এসেছে। ওদিকে খানিক দূরের অন্ধকার থেকে গরগরানির তখনও কমতি নেই। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে শব্দটা খানিক শুনল পেরমল। তারপর সাবধানে বাতাস শুঁকে নিয়ে বলে, “উলি দাভারু!! উলি!!” (বাঘ, সাহেব, বাঘ!!)
হিরেমোতির আলোর দিকে তখন আর নজর নেই আমাদের। তাড়াতাড়ি পেরমলের নিয়ে আসা মোমগুলোকে টুকরো টুকরো করে চারপাশে জ্বালিয়ে দিতে জায়গাটা তখন আলোয় আলো হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছিল খনিগর্ভটা লম্বাটে। পুব-পশ্চিমে ফুটতিরিশেক আর উত্তর-দক্ষিণে তার চাইতে খানিক বেশি লম্বা। ওর অন্ধকার উত্তরের কোণ থেকেই শব্দটা আসছিল। সেদিকে চোখ কুঁচকে খানিক তাকিয়ে পেরমল ঘোষণা করল, বাঘটাকে সে দেখতে পাচ্ছে। একটা বড়ো পাথরের আড়ালে উবু হয়ে বসে আছে। কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। হলে বিশ পা দূরে বসে গরগর করবে কেন? তেড়ে এসে হামলাই তো করতে পারে? জীবটার বাঘের বদলে হায়না হবার সম্ভাবনাই বেশি।
তবে শুধু অনুমানের ভরসায় পায়ে হেঁটে তার দিকে এগোনোটা বোকামি হবে। অতএব রাইফেলের দুটো ব্যারেলেই গুলি ভরে নিয়ে পেরমলকে বললাম, “ক’টা ঢিল মারো দেখি। যদি বাইরে বেরোয়!”
কিন্তু পেরমলের ঢিল খেয়েও তার নড়বার কোন লক্ষণ নেই। এইবার আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল এ পশুরাজ হতে পারে না। বন্দুক তুলে ধরে গুটি গুটী সেদিকে এগিয়ে গিয়ে যেই না অন্ধকারের মধ্যে পাথরের পেছনে তার আধালুকোনো শরীরটা দেখা অমনি তার জ্বলজ্বলে চোখদুটোকে নিশানা করে একটা ব্যারেল দেগে দিয়েছি তার দিকে।
গুলিটা চালিয়েই আমি তাড়াতাড়ি পিছু হটে এসে অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ। তা দেখা গেল তার গরগরানি একেবারে থেমে গেছে। বন্দুকের ধোঁয়া কেটে যেতে ফের কয়েকটা বড়ো বড়ো পাথরের টুকরো তার দিকে ছুঁড়ে মেরে পরীক্ষা করা হল। কোনো সাড়াশব্দ নেই। খালি ব্যারেলে ফের টোটা পুরে নিয়ে এইবার আমরা সাবধানে তার দিকে রওনা দিলাম। খানিক এগোতেই অন্ধকারের মধ্যে ফের তার শরীরটার আবছা অবয়ব নজরে এল। একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে তা। এবারে শরীরটার দিকে ফের একটা গুলি দেগে দিয়ে আরো একবার পিছিয়ে আসা।
খানিক বাদে যখন নিশ্চিত হলাম যে জীবটা আর বেঁচে নেই, তখন সাবধানে তার একেবারে কাছে গিয়ে দেখা গেল পেরমল ভুল বলেনি। জন্তুটা সত্যিই একটা বড়োসড়ো পূর্ণবয়স্ক বাঘ। তবে না খেয়ে তার চেহারা তখন একেবারে অস্থিচর্মসার হয়ে গেছে।
দেখে পেরমল বলল, “নির্ঘাত শিকার তাড়া করতে গিয়ে লুকোনো কুয়োর মুখে আছড়ে পড়েছিল দাভারু। কদিন ধরে খেতে না পেয়ে মরোমরো হয়ে গিয়েছে একেবারে!”
কথাটা ভুল নয়। গোপন ফাঁদের মত এই খনির ভেতরে একবার পড়লে ওঠা কঠিন। নিচে আছড়ে পড়বার পর বেরোবার চেষ্টা হয়ত করেছে সে! কিন্তু খাড়াই চিমনির প্রায় পনেরো ফিটের উচ্চতা এক লাফে ডিঙিয়ে তার ঢালু ফানেলের গায়ে নখ বিঁধিয়ে নিজেকে বের করে নিয়ে যাওয়া অতবড়ো প্রাণীটার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
তবে না খেয়ে রোগাভোগা হয়ে গেলেও তার ওজন নেহাত মন্দ ছিল না। তার লুকোবার জায়গা থেকে খনির মাঝখানের ঢিবি অবধি টেনে আনতেই আমার আর পেরমলের জিভ বের হবার দশা। অতএব গোটা শরীরটাকে ওপরে বয়ে নিয়ে যাবার উপায় না দেখে পেরমল সেখানেই ছুরি বের করে বসে পড়ল তার ছাল ছাড়াতে। তাকে সেখানে রেখে আমি চললাম গুহার দেওয়ালের তদন্ত করতে।
কাছে গিয়ে আলো ধরে দেখি দেওয়ালের গায়ে এদিক-ওদিক ফার্ন, লিচেন আর মসের ভিড়। মূল পাথরের গায়ের ফিটতিনেক পুরু কংগ্লোমারেটের আস্তরের গায়ে ছেয়ে আছে তারা। পাথরের স্তরের বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝতে পারছিলাম, এরা ‘কুরনুল সিরিজ’–এর পরিবারভুক্ত। দক্ষিণের অনেক এলাকাতেই এই পাথরের স্তরে হিরে পাওয়া যায়। তবে সেই মুহূর্তে সেখানে দাঁড়িয়ে পাথর খুঁড়ে হিরে বের করবার চেষ্টা করার কোনো অর্থ নেই। তার বদলে আমি সেই কংগ্লোমারেটের খানিক নমুনা সঙ্গে নিলাম। শহরে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করে দেখলেই হবে। আমাদের চারপাশের ঝিকিমিক আলোর দল ততক্ষণে একেবারে মিলিয়ে গেছে। হাজার খুঁজেও তাদের উৎস বের করা গেল না। পাথরের স্তরে এক গ্রাম অভ্রও ছিল না। আজ এতদিন পরেও সেই অলৌকিক ঝিকিমিকির কারণ আমি খুঁজে পাইনি। কোন বিশেষজ্ঞ বন্ধুও তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি আমাকে। নিতান্ত পেরমলও সাক্ষি ছিল। তা না হলে হয়ত আমি নিজেই ভাবতাম চোখে ভুল দেখেছি সেই খনির অন্ধকারে।
ছালটা তুলে এনে মেপে দেখেছিলাম নাক থেকে লেজ অবধি প্রায় দশ ফিট লম্বা। বিরাট বড়ো ছিল বাঘটা। অথচ কী অসহায়ভাবেই না মরতে হয়েছিল তাকে।
তবে এক দিনে দুই শঙ্খচূড় আর একখানা বাঘের মুখোমুখি হয়েও প্রাণে বেঁচে ঘরে ফিরতে পারা; কজনের ভাগ্যে তা হয়?