বনের ডায়েরি বন বন্দুকের ডায়েরি-হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১) এ মার্ভিন স্মিথ, ভাষান্তরঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য শীত ২০১৯

বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ

মাদ্রাজ সরকারের কমিসারিয়েটের সবচেয়ে বড়ো হাতি ছিল পীর বক্স। ধনুকের মত বাঁকা পিঠটা তার ছিল দশ ফুট উঁচু। কাঁধ ছিল মাটি থেকে সাত ফুট উঁচুতে। বাঁকানো দাঁতগুলো সাড়ে তিন ফুট করে লম্বা। অজগরের মত শুঁড়। লাল সাদা ছিটছিট চামড়া ছিল মখমলের মত নরম, যেমনটা ভালো জাতের হাতির হয় আর কি। পিলারের মত সটান আর পেশিজড়ানো পা-গুলো দেখলেই টের পাওয়া যেত, চার-পাঁচটা সাধারণ হাতির শক্তি রয়েছে তাতে। তবে অমন শক্তিধর হলে কী হয়, পীর বক্স ছিল বেজায় শান্ত। ছোটো একটা বাচ্চাও তাকে স্বচ্ছন্দে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।

কিন্তু এত গুণ সত্ত্বেও, দেশি লোকজন তাকে এড়িয়েই চলত। তাদের কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানে পীর বক্সের আসা মানা। এর কারণটা ছিল তার লেজে। পীর বক্সের লেজটা ছিল চেরা। এদেশের প্রবাদে বলে, লেজ চেরা হাতি একদিন না একদিন মানুষের প্রাণ নেবেই। কোয়েম্বাত্তুরের মাইকেল উপত্যকায় যখন সে প্রথম ধরা পড়ে, তখন তার ইউরোপিয় মালিক ভেবেছিল এ-হাতির জন্য ভাল দাম পাবে সে। দাম পাবার মতই চেহারা ছিল তার। বাজারে অমন হাতির দাম কম করে পনেরো হাজার টাকা হওয়া উচিত। দাঁতগুলোর দামই তো কোন্‌ না হাজার টাকা হবে।

কিন্তু যখন ধরে আনা হাতিদের নীলাম হল তখন দেখা গেল, কেউ তার জন্য দর হাঁকতে রাজি নয়। শেষমেষ কোনো খদ্দের না মেলায় তাকে সরকারি কাজের জন্যই রেখে দিতে হয়।

সরকারি কাজে এসে পীর বক্সের খুবই সুনাম হয়েছিল। ছ-বছরের চাকরিজীবনে সরকারের হয়ে অনেক কঠিন কাজই সে উৎরে দিয়েছে। যে-বার বেলারির পথে যাবার সময় সেনাবাহিনীর ভারী ভারী সব কামান কাদায় গেঁথে আটকে গেল তখন এই পীর বক্সকেই পাঠানো হয় সে-সব উদ্ধারের জন্য। বিরাট মাথাটার গুঁতো মেরে মেরে সেইসব কামানকে কাদা থেকে তুলে এনেছিল সে। দক্ষিণের আঠালো কালোমাটির খপ্পর থেকে অত ভারী সব যন্ত্রকে ওভাবে হেলায় ছাড়িয়ে আনা কোনো যে সে হাতির কাজ ছিল না। মেরকারার উঁচু পাহাড়ি এলাকায় ভারী রসদপত্র তোলবার বেলায়ও সেই পীর বক্স। এক দেড় টন মালপত্র পিঠে তুলে সেই খাড়াই পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠে যাওয়াও তার কাছে ছেলেখেলা ছিল। এ-ছাড়া বনদফতরের ভারী ভারী কাঠের গুঁড়ি বইবার কাজেও তার জুড়ি ছিল না।

স্বভাব-চরিত্রেও তার কোনো ত্রুটি দেখা যায়নি কখনো। বছরে একবার মস্ত্‌ হবার ঋতুতে খানিক ক্ষেপে ওঠা ছাড়া অন্য সময়ে সে ছিল পরিবহন দফতরের আদর্শ একজন কর্মচারী। কাজেই তার চেরা লেজের কথা উঠলে হুনসুরের কমিসারিয়েট সার্জেন্ট যে খানিক হাসাহাসিই করবেন তাতে আর দোষ কী! দু-বছর ধরে পীর বক্সকে চেনেন তিনি। কথাটা কানে গেলেই বলতেন, “যত বাজে গালগল্প। মানুষ মারবে পীর বক্স! রেজিস্টার দেখুন, একটা মাছি অবধি ও মারেনি কখনো। লাইনের সমস্ত হাতির মধ্যে সেরা। ওই যে, ওই খুদে ভিখিরিটাকে দেখছেন? লম্বায় তো আমার হাতের এই ওয়াকিং স্টিকটার চেয়ে কম হবে। এখানকার এক মাহুতের ছেলে। ঐ একরত্তি ছেলে ওকে দু’বেলা জঙ্গলে চরাতে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে কথা না শুনলে বকাঝকাও করে দেদার। সেই পীর বক্স নাকি লেজ চেরা বলে মানুষ মারবে! নিগারগুলোর যত্তসব কুসংস্কার!”

তবে এর কিছুদিন বাদে একবার পীর বক্সের গল্পটা বদলে গিয়েছিল। সেবার তার মাহুত ফজল স্যান্ডারসনের সঙ্গে আসামের জঙ্গলে গেছে, এমন সময় পীর বক্সের মস্ত্‌ হবার সময় এল। যে বদলি মাহুত তখন পীর বক্সকে দেখে সে তার মেজাজমর্জির অত হালহদিশ জানত না। মস্ত্‌ হয়ে পীর বক্স মেজাজ গরম করতে একদিন সে তাকে মেরেছিল খানিক। তাইতে পীর বক্স হঠাৎ মেজাজ হারাল। প্রথমে তো মাহুতকে ধরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করল সে। তারপর শেকল ছিঁড়ে পালিয়ে গিয়ে হুনসুরের অমৃত-মহলে চরে বেড়ানো গোরুমোষের দলকে তছনছ করে গিয়ে হানা দিল সরকারি বুট ফ্যাক্টরিতে। বুট ফ্যাক্টরিকে গুঁড়িয়ে দিয়েও তার রাগ পড়ল না। এইবার সে উঠল মানানটোডির রাস্তায়। বড়ো বড়ো কফির গাড়িগুলোকে উলটে দিয়ে গাড়িওয়ালাদের আছড়ে মেরে রাস্তা ধরে দিল দৌড়। তারপর তো আশপাশের গ্রামগুলোয় সেই গুণ্ডা হাতির উপদ্রবে মানুষজনের টেকা দায় হয়ে উঠল। গ্রামের পর গ্রাম লুট করে, ঘরবাড়ি ভেঙেচূরে তাণ্ডব করে চলল সে।

আস্তে আস্তে পুরোদস্তুর একটা ধূর্ত খুনে হাতি হয়ে উঠছিল শান্ত পীর বক্স। জওয়ারের ক্ষেতে বাঁশের মাচান বেঁধে চাষিরা যখন রাত্রে পাহারা দিত, তখন নিঃশব্দে ক্ষেতের ভেতর ঢুকে আসত সে। তারপর শুঁড় দিয়ে মাচান টেনে ভেঙে মানুষগুলোকে পায়ে পিষে মাংসের তাল বানিয়ে দিত একেবারে। লোকে বলত, নাকি রাগের মাথায় কখনো কখনো মেরে ফেলা মানুষের টুকরোটাকরা শুঁড় দিয়ে তুলে মুখেও পুরে দিত সে।

এখানে একটা কথা বলে নিতে চাই। দিশি মানুষজনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল হাতি মাঝে মধ্যে মানুষখেকো হয়ে ওঠে। সে-বিশ্বাসের কারণও আছে। হাতি নিয়ে বাঘ শিকার করবার পর মাঝে মাঝে মাহুতরা বাঘের রক্ত দিয়ে গুড় মেখে সেই গুড় হাতিকে খাওয়ায়। তাদের ধারণা ওতে বাঘের সঙ্গে লড়াই দেবার সাহস বাড়বে হাতির। এই করে করে রক্তের স্বাদ হাতির স্মৃতিতে গেঁথে যায়। তারপর কখনো সে পাগল হয়ে গেলে, যখন মানুষ মারে, তখন তার রক্তের ছিটেফোঁটা তার মুখে গেলে তাতে তার সেই গুড়মাখা রক্তের স্বাদ মনে পড়ে যায়। তখন সে খুন হওয়া মানুষটার টুকরোটাকরা মুখে নিয়ে খেয়ে ফেলে।  

পীর বক্স কি শুধুই মস্ত্‌ হয়েছিল? নাকি একেবারে উন্মাদই হয়ে গিয়েছিল সে? হুনসুরের যে মাহুতরা তাকে ভালোভাবে জানত, তাদের বক্তব্য ছিল, পীর বক্স মস্ত্‌ হয়েছিল কেবল। ইউরোপিয়রা অনেক সময়েই মস্ত্‌ হাতি আর পাগল হাতিতে গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু মস্ত্‌ হাতি মানে পাগল হাতি নয়। মার্চ এপ্রিলে হাতিদের ছেলেপিলে হবার ঋতুতে পুরুষ হাতিরা কিছুদিনের জন্য ক্ষেপে ওঠে। একে বলে মস্ত্‌ হওয়া। এই সময় তাদের কষ বেয়ে ঘন রঙের একধরনের রস গড়ায়। যদি দিনে দুবার এই রস যত্ন করে মুছিয়ে দেওয়া যায় আর রোজ মস্ত্‌ হাতিকে খানিক আফিম খাইয়ে দিনে এক ঘন্টা করে জলে দাঁড় করিয়ে রাখা যায় তাহলে আর কোনো ভয় থাকে না। হাতি তখন সামান্য মেজাজ গরম করবে। একটু আধটু বেয়াড়াপনাও করবে, কিন্তু তার বাইরে অন্য কোনো ক্ষতি করবে না। তবে এই যত্নগুলো সে-সময় না করলে মস্ত্‌ হাতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তখন তার সামনে যাওয়া আত্মহত্যার সামিল। মস্ত্‌ অবস্থায় কোনো হাতি শেকল ছিঁড়ে পালিয়ে তাণ্ডব করলেও তাকে ফের ধরে এনে বশ করা যায়। মস্তির সময় পেরিয়ে গেলেই সে ফের আগের মত শান্তশিষ্টও হয়ে ওঠে ফের।

পাগল হাতির ক্ষেত্রে গল্পটা সম্পূর্ণ আলাদা। যে-হাতি একবার পাগল হয় সে কখনো আর সুস্থ হয়ে বশ মানে না। একমাত্র ভবলীলা সাঙ্গ করা ছাড়া এদের হাত থেকে মুক্তির আর কোন পথ নেই। সাধারণত সানস্ট্রোক থেকে অসুখটা ঘটে হাতিদের। এমনিতে হাতি দিনের বেলাটা জঙ্গলের ঘন ছায়ায় কাটায়। খোলা আকাশের নিচে তারা আসে রাতের অন্ধকারে। তখন তাদের খাওয়াদাওয়ার পালাও চলে। আবার  ভোর  হতেই  ভরা  পেট  নিয়ে  তারা ঢুকে যায় গভীর অরণ্যের ছায়ায়। ভরা দুপুরের রোদ তাদের শরীরে বেশি সয় না।

যাক সে কথা। পীর বক্স যেহেতু সরকারি সম্পত্তি, তাই এইবারে তাকে মারবার জন্য সরকারি অনুমতি চাওয়া হল। কমিসারিয়েট দফতর প্রথমেই তাতে রাজি হল না। তাদের মতে পীর বক্স খুব মূল্যবান জীব। প্রথমে তাই পোষা হাতি দিয়ে তাকে ধরবার একটা চেষ্টা করবার পরামর্শ এল সেখান থেকে।

সেইমত মহীশূর আর কোয়েম্বাত্তুর থেকে বেশ কিছু শিক্ষিত হাতি নিয়ে তাকে ধরবার জন্য কয়েকটা অভিযান চালানো হল। তবে কোনো কাজ হল না তাতে। অতিকায় সামনের পা-দুটোর কল্যাণে দৌড়বাজিতে পীর বক্সের জুড়ি মেলা ভার। তাকে তাড়া করে ধরবার সাধ্য কোনো পোষা হাতির ছিল না। আর যখন না পালিয়ে সে লড়াই দিতে ঘুরে দাঁড়াত, তখন কোনো হাতিরই তার মুখোমুখি হবার ক্ষমতা হত না। এমনকি মহীশূরের মহারাজার বিখ্যাত হাতি জং বাহাদুরও নয়।

ইতিমধ্যে তাড়া খেয়ে তার অত্যাচার তখন আরো বেড়ে উঠেছে। তার ভয়ে হুনসুর আর কুর্গের মধ্যে সব গাড়িঘোড়া বন্ধ।মহীশূর আর মানানটোডির রাস্তাও শুনশান হয়ে গেছে। তার শেকল ছেঁড়বার পর প্রায় দু-মাস কেটে গেছে তখন। তদ্দিনে চোদ্দোজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তার হাতে। দুটো গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। রাস্তার গাড়িঘোড়া আর মাঠের ফসলের যা ক্ষতি হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই।

সেই করতে করতেই একদিন সে তার নিজের মৃত্যুঘন্টা নিজেই বাজিয়ে দিল। ওয়াইনাদ সীমান্তে কালেক্টরের ক্যাম্প আক্রমণ করে বসল সে। ভাগ্যক্রমে কালেক্টর তখন মানানটোডিতে গিয়েছিলেন কোনো কাজে। ফলে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর তাঁবুটাবু সব ভাঙচূর হল সেই আক্রমণে। একজন কর্মচারীর প্রাণও গেল।

এইবার সরকারবাহাদুরের টনক নড়ল। রাতারাতি মত বদলে, পীর বক্সের মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানায় বসে গেল সরকারি মোহর। যে-কোনো উপায়ে তাকে শেষ করে দেবার জন্য মোটা পুরস্কারও ঘোষণা করা হল সরকারের তরফে।

পুরস্কারের লোভে ব্যাঙ্গালোর থেকে বেশ কয়েকটা শিকার অভিযান চালানো হল পীর বক্সের খোঁজে। কিন্তু শিকারিদের কেউই তার দেখা পেল না। আজ তাকে এখানে দেখা যায় তো কাল সে হাজির হয় বিশ মাইল দূরের কোনো গ্রামে।

ইউরোপিয়ানদের  কখনো আক্রমণ করত না পীর বক্স। রাস্তার যে এলাকায় লোকজনের চলাচল কম তেমন জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে থাকত সে। সন্দেহজনক কিছু দেখলে টুঁ শব্দটি করত না। কিন্তু যেই তার চোখে পড়ত, রাস্তা দিয়ে কোনো দিশি লোকজন বা দিশি গাড়িঘোড়া আসছে, অমনি হুঙ্কার ছেড়ে বেরিয়ে এসে তাদের দফারফা করে ছাড়ত চোখের পলকে।

পীর বক্সকে নিয়ে এইসব খোঁজখবর পেয়েছিলাম হুনসুরের ডাকবাংলোয় বসে। মহীশূর আর বৃটিশরাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা বরাবর যে জঙ্গল সেখানে শিকার করতে বেরিয়ে আমাদের চারজনের দলটা তখন সেই ডাকবাংলোয় এসে পৌঁছেছি। সে-যাত্রা তখনও শিকার ভাল মেলেনি। জোটবার মধ্যে গুটিকয় চিতল হরিণ আর পাখি। ডাকবাংলোয় এসেই ক্ষ্যাপা হাতি শিকারের সরকারি বিজ্ঞপ্তিটা দেখে তাই আমরা একরকম লাফিয়ে উঠেছিলাম। হাতি শিকারের জন্য সে-যাত্রা আমরা তৈরি হয়ে বের হইনি। তবে ভারী অস্ত্রশস্ত্র কিছু সঙ্গে ছিল। ভাবলাম, ওই নিয়েই পীর বক্স হেন শত্রুর সঙ্গে একটা মহড়া নিয়েই দেখা যাক।  

অতএব দিশি শিকারিদের ডাক পড়ল। তাদের সঙ্গে আলোচনা সেরে কার্কানকোটির সরকারি জঙ্গলের ভেতর ঐ নামেরই একটা ছোটো গ্রামের দিকে রওনা দিলাম।

গ্রামটা মানানটোডি যাবার বড়োরাস্তার ধার ঘেঁষে। গিয়ে দেখি সেখানকার ডাকবাংলো ভোঁ ভাঁ। নাকি পীর বক্স সেখানে বারদুয়েক হানা দিয়েছে। দ্বিতীয়বার বাংলোর সামনের দিকের অফিসঘরটা ভেঙে সে কর্মচারীদের নাগাল পাবার চেষ্টাও করেছিল। বাংলোর কর্মচারীরা অতএব প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র সরে পড়েছে। বাংলো ছেড়ে গ্রামে এসে দেখা গেল সেখানেও একই অবস্থা। কেউ কোথাও নেই। খুঁজেপেতে সেখানে কেবল একটা কুরামবা পরিবারের দেখা মিলল। গ্রামের প্যাটেল নাকি নিজে পালাবার আগে তাদের ওপর গ্রামের দেখভাল করবার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। পরিবারটা উঁচু একটা গাছের আগায় মাচান বেঁধে নিয়েছে। সন্ধে নামবার আগে তারা সেই মাচানে গিয়ে ওঠে। নামে একেবারে সূর্যোদয়ের পর।

গিয়ে যখন পৌঁছেছিলাম তখন সপ্তাহখানেক পীর বক্সের দেখা নেই এলাকায়। তাইতে লোকগুলো আরো ভয়ে আরো কাঁটা হয়ে আছে। বলে, গোটা এলাকা চক্কর দিয়ে সপ্তাহে একবার পীর বক্স এসে হানা দেয় সেখানে। এইবারে তার ফের আসবার সময় হয়েছে।

খবরটা  আমাদের  পক্ষে  দারুণ।  সময় নষ্ট না করে আমরা কাজে

নেমে পড়লাম। সবাই মোটামুটি একমত হলাম যে আট ড্রাম বারুদ (‘ড্রাম’ একটি ওজনের একক। প্রায় চার গ্রামের সমান)আর একটা ভারী টোটা দিয়েই কাজ হয়ে যাবে। আমাদের মিস্টার K… আবার ‘স্মুদ বোর’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, কুড়ি পা দূর থেকে হাঁস মারবার বন্দুক দিয়ে ওই গুলি চালালে হাতিকে আর মাথা তুলতে হবে না।

হাতি যে সে-রাত্রেই হানা দেবে এমন সম্ভাবনা কম। তবু কথায় বলে সাবধানের মার নেই। সঙ্গের ঘোড়া আর মাল বইবার বলদগুলোকে বাঁচাতে হবে। কাজেই ডাকবাংলোর বাইরের চত্বরে একটা জায়গাকে  শক্তপোক্ত করে ঘিরে নিয়ে তার ভেতর তাদের বেঁধে রাখা হল। সেখানেই একটা বড়োসড়ো আর মজবুত ঘরে গিয়ে আস্তানা নিল আমাদের দিশি চাকরবাকররা। বাংলোর সামনে একটা বড়োসড়ো আগুন জ্বালানো হল, যাতে হাতি এলে হঠাৎ করে আক্রমণ না করতে পারে।

সব প্রস্তুতি শেষ করে আমরা সেদিন তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলাম। পরদিন ভোর ভোর উঠে শিকারে বের হবার কথা। কুরামবারা জানিয়েছে সকালবেলা তারা এই এলাকায় হাতিটা যেখানে যেখানে যায় সে-সব জায়গায় আমাদের নিয়ে যাবে।

ডাকবাংলোর ভেতরবাড়িতে দুটো ঘর।তার একটার জানালা দিয়ে বাইরের অফিসবাড়িটা চোখে পড়ে। সেই ঘরটায় আমি আর মিস্টার O… আস্তানা গাড়লাম। পাশের ঘরে রইলেন মিস্টার F… আর মিস্টার K…।

আক্রমণটা এল ভোররাতের দিকে। পাশের ঘর থেকে হঠাৎ বন্দুকের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। পরক্ষণেই রাতের নৈঃশব্দকে ছিঁড়েখুঁড়ে জেগে উঠল হাতির রক্তজমানো হুঙ্কার। যার যার রাইফেল তুলে নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি মিস্টার F…  বন্দুক হাতে পায়ের কাছের ভাঙা জানালাটা দিয়ে বাইরে উঁকি দিচ্ছেন আর মিস্টার F…একটা আলো জ্বালাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন কাঁপা কাঁপা হাতে।

খানিক বাদে তাঁরা একটু সুস্থির হলে শোনা গেল, খানিক আগে, পায়ের কম্বলের ওপর দিয়ে কিছু একটা বের দিয়ে ধরছে টের পেয়ে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মিস্টার F… এর। চোখ খুলে তিনি আবছা আলোয় দেখেন একটা বিরাট শুঁড় জানালার কাচ ভেঙে ভেতরে ঢুকে এসে তাঁর পা জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে। দেখে সঙ্গে সঙ্গে পাশে রাখা বন্দুকটা তুলে নিয়ে তিনি অন্ধকারের মধ্যেই আন্দাজে হাতিটার মাথা তাক করে তার দুটো ব্যারেলই খালি করে দেন। জবাবে হুঙ্কার ছেড়ে হাতিটা তার শুঁড় টেনে নেয় আর তারপর গোটা জানালাটাকে ভেঙে দিয়ে দূরে সরে যায়।

বোঝা যাচ্ছিল ভদ্রলোক নিতান্তই কপালজোরে বেঁচে গেছেন। পুরু কম্বল থাকায় হাতি শুঁড় দিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁর পা দুটোকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি। আর কয়েক মুহূর্ত দেরি হলে, বা তিনি বিপদের মুখে বুদ্ধি করে পালটা আক্রমণ না হানলে যদি সে কম্বলশুদ্ধ পা দুটোকে একবার ধরে নিতে পারত তাহলে আর তাঁর রক্ষা ছিল না। জানালা দিয়ে টেনে বের করে নিয়ে গিয়ে পায়ের একটা চাপেই তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিত সে।

অফিসবাড়ির ঘরটার ভেতর থেকে দিশি লোকজনের গলার আওয়াজ আসছিল। হাজার চিৎকার করেও তাদের একজনকেও বাইরে আনা গেল না। অবশ্য তাতে তাদের দোষ নেই। ওই কালান্তক যম আশপাশে হাজির থাকলে নিরস্ত্র অবস্থায় বাইরে বের হওয়া আর নিশ্চিত মৃত্যুকে ডেকে আনা একই ব্যাপার।

শেষমেষ, বাকি রাতটুকু আর না ঘুমিয়ে পাহারা দেওয়া সাব্যস্ত করে আমরা আলো জ্বালিয়ে একটা ঘরে সবাই মিলে বসলাম। তারপর ভোর হতে না হতে রওনা হলাম মিস্টার F…  এর বন্দুকবাজির ফলাফল খুঁজে দেখতে। দেখা গেল বাংলোর ধার ঘেঁষে হাতির পায়ের বড়ো বড়ো ছাপ জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেছে। তবে কোথাও রক্তের একফোঁটা দাগ নেই। রাতের ঘটনা শুনে কুরাম্বা খোঁজারুরা বলল, হাতি নিশ্চয় ভালোরকম আহত হয়েছে। নইলে অত সহজে সে ছেড়ে দিত না। ফের আক্রমণ করত। রক্তের নিশানা নেই কেন তারও একটা ভাল ব্যাখ্যা দিল তারা। বলে, অত কাছ থেকে বুলেটের ঘায়ে ক্ষতস্থান পুড়ে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত বের হয়নি। তাদের অনুমান, খুব বেশি দূরে যাবে না আহত গুণ্ডা। সবচেয়ে কাছে যে জলের উৎস আছে সেইখানে গিয়ে ক্ষতস্থানে কাদা মেখে দু-একদিন তার কাছাকাছি কোনো ঘন জঙ্গলে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবে ক্ষত শুকিয়ে নেবার জন্য।

কথাগুলোয় যুক্তি ছিল। অতএব তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে বের হয়ে পড়লাম হাতির পায়ের ছাপ ধরে। সঙ্গে একজন দিশি শিকারি চলল কুরাম্বাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাবার জন্য দোভাষী হিসেবে। আর রইল খাবার দাবারের বোঝা কাঁধে আমাদের গান বেয়ারার সুলেমান।

মাইলখানেক ধরে বড়োরাস্তার পাশাপাশি এগিয়ে গিয়ে পায়ের ছাপগুলো রাস্তা পেরিয়ে দক্ষিণমুখো ধাওয়া করল। ওদিকটা দিয়ে কাবেরীর শাখা কাবানি নদী বয়ে যায়। এইবারে আস্তে আস্তে একটু একটু করে রক্তের দাগ চোখে পড়ছিল। চলতে চলতে একটা জায়গায় এসে দেখি সেখানের মাটি রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছিল, রক্তপাত শুরু হবার পর হাতি সেখানটায় বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

নদীর যত কাছাকাছি আসছিলাম আমরা, রাস্তা ততই আস্তে আস্তে দুর্গম হয়ে উঠছিল। ঘন বাঁশঝাড়, কাঁটাঝোপ, আর মাঝে মাঝেই সেগুন আর হোন-এর বড়ো বড়ো গাছে কয়েক গজের বেশি দৃষ্টি চলে না।

নদীর আধমাইলের মধ্যে পৌঁছে কুরাম্বা খোঁজারুরা সতর্ক হয়ে উঠল। তাদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল, যে-কোনো মুহূর্তে গুণ্ডাটার মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা। প্রায় ঘন্টাদুয়েক হল পথ চলেছি আমরা তখন। ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা আহত মস্ত্‌ হাতিকে অনুসরণ করা দুনিয়ার অন্যতম বিপজ্জনক কাজ। আমরা জানতাম, এই দুঃসাহসের দাম আমাদের দু-একজনকে হয়ত প্রাণ দিয়ে চোকাতে হবে আজ। মাথা ঠাণ্ডা করবার জন্য আমরা এইবার একটু বিরতি দিলাম। সামান্য ঠাণ্ডা চা খেয়ে নিজেদের তাজা করে নিয়ে আক্রমণের একটা ছক কষে ফেলা হল।

দলের সবচেয়ে ভারী বন্দুক দুটো আছে মিস্টার F… আর আমার কাছে। সবার সামনে যাবে কুরাম্বা খোঁজারুরা। তাদের দুয়েক পা পেছনে আমরা দুজন। আমাদের পাঁচ-ছ পা পেছনে আসবেন দলের অন্য দুজন বন্ধু। সঙ্গের দোভাষী শিকারি আর সুলেমান আসবে সবার পেছনে, আমাদের থেকে দশ পা দূরত্ব বজায় রেখে। হাতির দেখা পেলে প্রথমে গুলি করব আমি আর মিস্টার F… । সেই জোড়া বন্দুকের গুলি খেয়েও যদি সে বেঁচে যায় তখন আমাদের পেছনের দুই বন্দুকবাজ গুলি ছুঁড়বে। কিন্তু, চারটে বন্দুকের আটখানা ব্যারেলের গুলি খেয়েও যে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে সে-কথাটা তখন একবারের জন্যও আমাদের মনে আসেনি।

গোটা ছকটা সাজিয়ে নিয়ে এইবার আমরা একেবারে নিঃশব্দে এগোনো শুরু করলাম। সামনের খোঁজারুরা আশপাশের প্রত্যেকটা ঝোপকে সাবধানে পরীক্ষা করতে করতে এগোচ্ছিল। মাঝে মাঝেই থেমে পড়ে কুরাম্বারা মাটিতে পড়ে থাকা রক্ত তুলে পরীক্ষা করে দেখছিল তা কতটা জমাট বেধেছে। ওই দেখে তারা আন্দাজ করতে পারবে হাতি ঠিক কতক্ষণ আগে সেখানে দিয়ে গিয়েছে।

একটা  পাতা  পড়বার  শব্দেও  তখন  আমাদের বুক কেঁপে উঠছে।

রক্তের দাগটা ততক্ষণে ঘন গাছপালার আড়াল ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া একটা গরুর গাড়ি চলাচলের রাস্তায় এসে উঠেছে। সেখানটায় সামনে অন্তত কুড়ি পা দূরত্ব অবধি চোখে পড়ে। দু-তিনশো গজ দূর থেকে বহতা জলের মৃদু কুলকুল শব্দ ভেসে আসছিল। বোঝা যাচ্ছিল, নদীর কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি আমরা।

আস্তে আস্তে আমাদের দু-ধারের বাঁশবন আরো জমাট বেঁধে উঠছিল। আর মধ্যে দিয়ে আরো খানিক এগিয়ে একেবারে সামনে থাকা কুরাম্বা খোঁজারু যখন ইশারায় দেখাচ্ছে যে আমাদের এইবার ডাইনে বেঁকে যেতে হবে ঠিক তখন পেছনদিক থেকে একটা রক্ত জমানো বৃংহণ শুনে আমরা চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালাম।

দৃশ্যটা ভয়াবহ। পীর বক্স নিঃসন্দেহে অনেক দূর থেকেই আমাদের গন্ধ পেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই সে গরুর গাড়ির রাস্তা ছেড়ে ডাইনে বাঁক নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যায়। তারপর খানিক পিছিয়ে গিয়ে পথের পাশের কোনো বাঁশঝোপের মধ্যে আমাদের অপেক্ষায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাশ দিয়ে এলেও কিছুই টের পাইনি আমরা। আমাদের দলটাকে নির্বিবাদে এগিয়ে যেতে দিয়ে এইবার সে পেছন থেকে এসে উদয় হয়েছে। আমরা যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছি ততক্ষণে সুলেমানকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে বাতাসে তুলে নিয়েছে সে। মিস্টার K… তার থেকে দশ পা দূরে দাঁড়িয়ে মুহূর্তে বন্দুকের নিশানা নিল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। চোখের পলকে বাতাসে ঝুলিয়ে ধরা সুলেমানের শরীরটাকে সজোরে মাটিতে আছড়ে ফেলল শুঁড়টা। তারপর ফের একবার তালগোল পাকিয়ে যাওয়া শরীরটার দিকে যখন তা নেমে আসছে তখন মিস্টার K… র বন্দুক হাঁক দিয়ে উঠল। প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই ক্ষ্যাপা জন্তুটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিস্টার K… র ওপরে। সামনের বিশাল পায়ের একটা লাথিতে তার শরীরটা বাতাসে ছিটকে উঠে উড়ে গেল বেশ খানিক দূরে।

মাথা ঠাণ্ডা করে নিশানা করবার সময় আমাদের হাতে ছিল না। নিশানা করবার কোনো দরকারও ছিল না অবশ্য। কয়েক টন ওজনের একটা কালো পাহাড় তখন দৃষ্টিক্ষেত্রকে ঢেকে দিয়ে বিদ্যুতের মত ছুটে আসছে আমাদের দিকে। আমাদের দুটো বন্দুকের চারটে ব্যারেল এইবার একসঙ্গে আগুন ওগরালো তার শরীরকে লক্ষ করে। আঘাত পেয়ে হঠাৎ থমকে গেল জন্তুটা। তারপর হুংকার দিতে দিতে  বাঁ-দিকের বাঁশবন ভেদ করে ছুট দিল। চোখের পলকে বন্দুকে নতুন করে টোটা ভরে নিয়ে ফের তৈরি হলাম আমরা। কিন্তু সে ফিরে এল না। তার ঝোপঝাড় ভেঙে ছোটোবার শব্দ ক্রমশ দূর থেকে আরো দূরে মিলিয়ে গেল।

মিস্টার K… র শরীরটা বেশ কয়েকগজ দূরের একটা বাঁশঝাড়ের মাথায় ঝুলছিল। ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ভেবেছিলাম সে আর বেঁচে নেই। কিন্তু বাঁশঝাড়টা কেটে তাকে নামিয়ে এনে দেখি সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। গলায় একগ্লাস হুইস্কি খুব শিগগিরই তার জ্ঞান ফিরিয়ে দিল। তখন দেখা গেল সে নড়াচড়া করতে পারছে না। মেরুদণ্ডে চোট লেগেছে তার। পাঁজরার কয়েকটা হাড়ও ভেঙেছে। ডালপালা দিয়ে একটা হ্যামক বানিয়ে তাইতে চাপিয়ে তাকে মানানটোডিতে ফেরৎ পাঠানো হল। বেশ কয়েকমাসের চিকিৎসার পর সে ফের নড়াচড়ার শক্তি ফিরে পায়। শেষমেষ ইংল্যান্ডেই ফিরে যেতে হয়েছিল তাকে। আর কোনোদিন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি সে। সুলেমানের শরীরটাকে তার ধর্মের রীতি-রেওয়াজ মেনে গোর দেওয়া হয়েছিল।

পীর বক্স এর পরেও দুজন বৃটিশ অফিসারকে খুন করে। তবে সে-কাহিনি, আর তার নিজের খতম হবার কাহিনি পরের অধ্যায়ে বলব।

(পরের পর্বে সমাপ্য)

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s