বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা, শিকারী বন্ধু গোন্দ, হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (১)
হুনসুরের আতঙ্ক… পীর বক্স (২)
পীর বক্সের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষের খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। আর তার ফলে সে এলাকায় তার নাম হয়ে গেল হুনসুরের আতঙ্ক। তার সঙ্গে লড়বার জন্য সে অঞ্চলে ব্রিটিশ শিকারিদের আনাগোনাও বেড়ে গেল।
তবে তাতে লাভ হল না বিশেষ। সেই ঘটনার পর পীর বক্স যেন বিলকুল হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। যেসব জায়গায় তার যাতায়াত, সেই সমস্ত এলাকায় একাধিক শিকার অভিযান করেও কোনও ফল হল না। দক্ষিণ ভারতের বহু বিখ্যাত শিকারি ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন।
মাসখানেক এইভাবে কাটবার পর আমরা ধরে নিলাম, চোট পাওয়া হাতিটা বোধ হয় আর বেঁচে নেই। মিস্টার K তখনও সেরে ওঠেননি পুরোপুরি। আমরা ঠিক করলাম, হাতিটার শরীর খুঁজে পাওয়া গেলে ওর দাঁতদুটো আমরা দাবি করব। অভিযানের স্মারক হিসেবে সেগুলো মিস্টার Kকে উপহার দেওয়া হবে।
তবে ব্যাপারটা যে খানিকটা গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল জাতীয় আশা হয়ে যাচ্ছিল তার ইঙ্গিত খুব শিগগিরই মিলতে শুরু করল। বদমাশটা আসলে মারা যায়নি। বেগুরের গভীর জঙ্গলের কোনও গোপন আস্তানায় পালিয়ে গিয়ে ক্ষতটা শুকোবার জন্য লুকিয়ে ছিল চুপচাপ। মাস খানেক বাদে আস্তে আস্তে আবার তার দেখা মিলতে শুরু করল।
এই সময় দু’জন শিকারির একটা দল তার সঙ্গে লড়াই দিতে সে এলাকায় আসে। তাদের একজন ক্যানানোরের এক দিশি রেজিমেন্টের জওয়ান, আর অন্যজন সেখানকার নৌবাহিনীর এক অফিসার। দু’জনেই বয়সে তরুণ। শিকারের অভিজ্ঞতাও তাদের বিশেষ নেই।
হুনসুরের অমৃৎ মহলের ভারপ্রাপ্ত কর্নেল M দুই মূর্তির আসবার কারণটা শুনে চমকে উঠেছিলেন। তাদের আচার আচরণ, কথাবার্তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় শিকারের বিশেষ কোনও অভিজ্ঞতাই তাদের নেই। আর ক্ষ্যাপা হাতির, বিশেষ করে পীর বক্সের মত ক্ষ্যাপা হাতির মুখোমুখি হওয়াটা যে ঠিক কতটা বিপজ্জনক সেটা বোঝবার ক্ষমতাও নেই তাদের। প্রথমে তো কর্নেল বারবার তাদের ঝুঁকিটার গুরুত্ব বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু দেখা গেল তাতে তাদের প্রতিজ্ঞার জোর আরও বেড়ে উঠছে।
অবশেষে তাদের জেদের সামনে হার মানতে হল কর্নেলকে। দুই ছোকরাকে বইবার জন্য ক্যাম্পের সেরা হাতিটাকে নিয়োগ করে তাদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিলেন তিনি। ফ্রাজেরপেটের জঙ্গলের দিকে রওনা হয়ে গেল তারা। সঙ্গে গেলেন কুর্গ ফ্রন্টিয়ারের অভিজ্ঞ ফরেস্ট অফিসার মিস্টার D।
এই হাতিটার নাম ছিল ডড কেম্পা, মানে লাল দানব। ক্যাম্পের নতুন আমদানি। সারা গায়ে লাল লাল ছোপ আর শক্তপোক্ত চেহারার জন্য তার ওই নাম হয়েছে। পীর বক্সের পিছু নেবার জন্য সেকেন্দ্রাবাদ থেকে তাকে এই ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। ডড কেম্পা উচ্চতায় পীর বক্সের চেয়ে খানিক খাটো। কিন্তু হলে কী হয়, তার চেহারাটা বেজায় আঁটোসাঁটো। দাঁত দুটো তুলনায় ছোটো হলেও বেজায় মোটা আর শক্তিশালী। একাধিক বাঘ শিকার অভিযানে দুর্দান্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে সে। আহত বাঘের সরাসরি আক্রমণের মুখেও জায়গা ছেড়ে নড়েনি। দেখতে বিশ্রী। এককথায় হাতি-সমাজের মধ্যে সে একটি বুলডগ-সদৃশ জীব। তার মাহুতের বক্তব্য, ডড কেম্পার খ্যাতি মানুষজন তো বটেই, সে এলাকার জঙ্গলের হাতিমহলেও এতটাই ছড়িয়েছে যে, নাকি তাকে দেখলেই পীর বক্স ল্যাজ গুটিয়ে ছুট দিতে বাধ্য।
এহেন একটা হাতির ভরসায় দুই ছোকরাকে ছেড়ে দিয়ে কর্নেল M খানিক নিশ্চিন্তই ছিলেন যে, হুনসুরের আতঙ্কের মুখোমুখি তার হয়ও যদি বা, অন্তত প্রাণটা নিয়ে ফিরে আসতে কোনও সমস্যা তাদের হবে না।
তারা রওনা দেওয়ার দিন চারেক বাদে একদিন সকালবেলা কমিসারিয়েট সার্জেন্ট এসে কর্নেলকে স্যালুট করে বলেন, আগের দিন রাত্রে ডড কেম্পা ফিরে এসেছে। তার মাহুত মাতাল হয়ে আছে। সাহেব দু’জন তার সঙ্গে নেই। মাহুতের কাছ থেকে সাহেবদের বিষয়ে কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
শুনে কর্নেলের বুক শুকিয়ে গেল। মাহুতকে ডাকবার উদ্যোগ করছেন এমন সময় দেখা গেল, ক্যাম্পের অন্য মাহুতরা দল বেঁধে তাঁর কাছেই আসছে। দেখা গেল, মাতাল নয়, কোনও নিঃসীম আতঙ্কে সে একেবারে পাগল হয়ে গেছে। মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। হাতদুটো মোচড়াচ্ছে বারবার। মাঝেমধ্যেই কেঁপে উঠে ভয় ভয় চোখে পেছনদিকে ঘুরে দেখে সে। তারপর উবু হয়ে বসে পড়ে প্রাণপণে হাতদুটো দু’কানে চেপে ধরে, যেন কোনও ভয়ংকর শব্দকে ঠেকিয়ে রাখবার জন্য।
এই পাগলের কাছ থেকে কোনও খবর পাবার চেষ্টা করা বৃথা। লোকটাকে ক্যাম্পের ডাক্তারের হাতে তুলে দিয়ে হাতির পিঠে একটা উদ্ধারকারী দলকে ফ্রাজেরপেটের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল দুই সাহেব ছোকরার খোঁজে। জায়গাটা প্রায় চব্বিশ মাইল দূরে। তার আধাপথ পেরিয়েই উদ্ধারকারীদের সঙ্গে একজন দিশি রেঞ্জারের দেখা। তার সঙ্গে একটা গরুর গাড়ি আসছিল। উদ্ধারকারীদের থামিয়ে সে গরুর গাড়িটার কাছে নিয়ে এল।
গাড়ির ভেতরে কম্বলে মোড়া রক্ত আর কাদায় মাখামাখি মাংসের পিণ্ডগুলোকে দেখে আলাদা আলাদা মানুষের শরীর বলে চেনা যাচ্ছিল না। শুধু মাংসপিণ্ডগুলো থেকে বেরিয়ে থাকা দু’জোড়া বুটজুতো পরা পা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, দু’জন মানুষের শরীর রয়েছে তাতে। মস্ত্ হাতির পায়ের পেষণে তাদের বাকি শরীর একসঙ্গে মিশে গেছে।
ফিরে আসবার পথে একটা বিষাদের ছায়া পড়েছিল গোটা দলটার ওপরেই। যে রেঞ্জার গাড়িটা নিয়ে আসছিল, সে পুরো ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছিল। তার বয়ানটা এইরকম—
“দুই শিকারি দিন দুয়েক আগে ফ্রাজেরপেট যাবার পথে পেরিয়াপাটন গ্রামে এসে আস্তানা গাড়ে। সেদিনই এক চাষি খবর আনে, মাইল চারেক দূরে বাঘে একটা বলদ মেরেছে। শুনে সাহেবরা বাঘ মারবার জন্য মড়ির ওপরে মাচান বেঁধে বসবে বলে ঠিক করে। উদ্দেশ্য, বাঘ শিকারের মাংস খেতে এলে তাকে গুলি করে নিকেশ করবে।
“এরপর পেরিয়াপাটনে লোকলশকর আর মালপত্র সব রেখে দিয়ে দুই সাহেব ডড কেম্পার পিঠে চেপে অকুস্থলের দিকে রওনা দেয়। সঙ্গে ছিল খবর যে এনেছিল সেই চাষি আর আমি নিজে।
“শিকারের জায়গায় পৌঁছে সাহেবরা মাচানে উঠে বসে ও মাহুতকে হাতি সহ পেরিয়াপাটনে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়। কথা ছিল, পরদিন সকালে সে হাতি নিয়ে সেখানে ফেরত আসবে।
“সে-রাত্রে বাঘ আর আসেনি। পরদিন ভোরবেলা পেরিয়াপাটন ফিরে যাবার পথে ডড কেম্পা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে মাটিতে শুঁড় আছড়াতে শুরু করে। সাধারণত হাতিরা ভয় পেলে এমনটা করে থাকে। ভালো করে আলো ফোটেনি তখন। গাছগাছালির ছায়ায় চারপাশে ভালো করে চোখ চলে না। খানিক মাটিতে শুঁড় আছড়াবার পর হাতিটা তার শুঁড় মুখের ভেতর গুটিয়ে নেয়। তারপর মাথা দোলাতে দোলাতে এক পা দু’পা করে পিছিয়ে যেতে শুরু করে সে। দেখে মাহুত বলে, নিশ্চয়ই সামনে অন্য কোনও হাতি আছে। ডড কেম্পা তাই আক্রমণে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে।
“হাতির দুলুনিতে তখন তার পিঠে ভালো করে বসতে পারছিল না সওয়াররা। পড়ে যাবার ভয়ে দু’হাতে প্রাণপণে হাওদার দড়ি ধরে থাকতে হচ্ছিল। ফলে বন্দুক তোলবার উপায় ছিল না। এমন সময় হঠাৎ পঞ্চাশ গজ দূরে ঝোপজঙ্গল ঠেলে একটা প্রকাণ্ড হাতি বের হয়ে আসে। সে যে গুণ্ডা পীর বক্স তা তার অতিকায় চেহারা থেকেই মালুম হচ্ছিল সবার।
“তখনও শিকারিদের দিকে গুণ্ডার চোখ পড়েনি। আসলে হাতিদের দৃষ্টিশক্তি খুব দুর্বল হয়। তবে পীর বক্সের দিক থেকে শিকারিদের দিকে হাওয়া বইতে থাকায় ডড কেম্পা আগেই তার গন্ধ পেয়েছিল। পীর বক্সকে দেখে সাহেবরা মাহুতকে বলে হাতিকে শান্ত করতে, যাতে তারা দড়ি ছেড়ে হাতে বন্দুক তুলে নিতে পারে। কিন্তু মাথায় বারবার অঙ্কুশের ঘা মেরেও ডড কেম্পার দুলুনি আর পিছু হটা থামানো যায়নি। ততক্ষণে পীর বক্স শিকারিদের তিরিশ গজের মধ্যে চলে এসেছে। এইবার তাদের চোখে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সে শুঁড় তুলে একটা হুঙ্কার ছাড়ে।
“হুঙ্কার শুনে ডড কেম্পা মুহূর্তের মধ্যে পিছু ঘুরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এলোপাথাড়ি ছুটতে শুরু করে দেয়। গুণ্ডা হাতিও ঝোপঝাড় ভেঙে তার পেছনে ধাওয়া করে। এইসময় হঠাৎ একটা গাছের ডালের সঙ্গে হাতির পিঠের হাওদার দড়ি আটকে যায়। তারপর ছুটন্ত হাতির টানে দড়ি ছিঁড়ে হাওদা ছিটকে যায় হাতির পিঠ থেকে।
“আমি কোনোমতে গাছের ডালটাকে ধরে ফেলেছিলাম বলে বেঁচে যাই। কিন্তু দুই সাহেব মাটিতে আছড়ে পড়ে। খানিক বাদে একটু সামলে নিয়ে আমি দেখেছিলাম, হাতিটা মাটির ওপর একটা নরম স্তূপের ওপর বারেবারে পা দিয়ে ঘা মারছে। মাঝে মাঝে একটু থেমে স্তূপটার মধ্যে দাঁত দিয়ে খুঁচিয়ে নিয়ে ফের পা দিয়ে তাকে থেঁতো করছিল পীর বক্স।
“প্রায় মিনিট পনেরো বাদে পা থামিয়ে সরে আসে হাতিটা। তারপর ডড কেম্পা যেদিকে পালিয়েছিল সেদিকে তাড়া করে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যায়। আমি আরও ঘণ্টা দুয়েক গাছের ওপরেই বসে থেকে তারপর নেমে এসে পেরিয়াপটনের দিকে ফিরে যাই। সেখানে ফিরে, সাহেবদের লোকলশকরকে খবর দিয়ে, দলবল জুটিয়ে ফিরে গিয়ে দেখি দুই সাহেবের থ্যাঁতলানো শরীর পড়ে আছে। সেই শরীর এখন গরুর গাড়িতে করে নিয়ে আসছি।”
সরল, ভয়াবহ গল্পটা বুক হিম করে দেয়। কিন্তু সে নিয়ে বেশি আলোচনা না করে চলুন এবার কেমন করে এই দৈত্যের অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটল সেই গল্পে যাওয়া যাক। দেশের অন্যতম সেরা এক শিকারির হাতে তার অত্যাচারের অবসান ঘটেছিল। আর তা করতে গিয়ে যে দুঃসাহস আর দক্ষতার পরিচয় তিনি রেখেছিলেন তাতে ব্রিটিশ হিসেবে আমাদের গর্ব হয়।
তাঁর নাম গর্ডন কামিং। তাঁর ভাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত সিংহ শিকারি। বোন একাধারে বিখ্যাত শিল্পী ও নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতীয়দের এলাকার দুঃসাহসী অভিযাত্রী। তিনি নিজেও খ্যাতিতে তাঁর বিখ্যাত দুই ভাইবোনের সমকক্ষ ছিলেন। ছ’ফিটের ওপর লম্বা। চওড়া কাঁধ। আদর্শ খেলোয়াড়ি চেহারা। কাঁধে জোড়া ব্যারেলের ভারী বন্দুক, পিছু পিছু তাঁর দিশি শিকারি আর খোঁজারু ইয়াল্লু—এই দুই সঙ্গীকে নিয়ে আহত বাইসনের পেছনে দুঃসহ গ্রীষ্মের দুপুরে কুড়ি মাইল রাস্তা তাড়া করে যাওয়া তাঁর কাছে নিতান্তই ছেলেখেলার সামিল ছিল।
রাইফেলের নিশানা একেবারে নিখুঁত ছিল গর্ডনের। আর ছিল সাহস। তেড়ে আসা বাঘ কয়েক গজের মধ্যে চলে না আসা অবধি পাথরের মতো জমি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকবার ক্ষমতা ধরতেন তিনি। আর তারপর তার খুলিটা ভেঙে দিতে একটার বেশি দুটো বুলেট কখনও খরচ হয়নি তাঁর। লোকে বলে, একবার নাকি একটা নরখাদক বাঘকে অনুসরণ করে তার ডেরায় পৌঁছে গর্ডন দেখেন জন্তুটা ঘুমোচ্ছে। ঘুমন্ত শত্রুকে আঘাত করবেন না বলে তিনি একটা পাথর ছুড়ে সেটাকে প্রথমে জাগান। তারপর সে তেড়ে এলে তখন গুলি করে তার ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলেন।
সঙ্গে বাজনদার নিয়ে জঙ্গল তোলপাড় করে হাতির পিঠে বসে শিকার করাতে তাঁর রুচি হত না। যত বিপজ্জনক শত্রুই হোক না কেন, শিকার করতেন শুধুমাত্র ইয়াল্লুকে সঙ্গে নিয়ে। পায়ে হেঁটে। আর কখনও সে নিয়ে কোনও বড়ো বড়ো কথা শোনা যেত না তাঁর মুখে। কোনও একটা ভয়ানক শিকার অভিযান সেরে ফেরবার পর তার গল্প বলবার জন্য তাঁকে চেপে ধরলে নিতান্ত অনিচ্ছায় গুটিকয়েক শব্দেই কাজ সারতেন। যেমন ধরুন, “হ্যাঁ, জন্তুটা তেড়ে এল। আমি সেটাকে এক গুলিতে সাবড়ে দিলাম, ব্যস।”
ওদিকে তার মালিক যতটা চুপচাপ, ইয়াল্লু ছিল ততটাই বাক্যবাগীশ। গর্ডনের কীর্তিকলাপের বেশিরভাগটাই লোকজন শুনতে পেত ওই ইয়াল্লুর গল্পগাছা থেকে। প্রভুর ওপর তার অবিচল আস্থা। তাঁর সঙ্গে যেকোনও জায়গায় যেতে তার ভয়ডরের বালাই ছিল না। “আরে সাহেবের যা নিশানা, তাতে আমার ভয়টা কী? একবার ট্রিগার টিপলে খোদ রাক্ষসও জমি নেবে যে!”
মহীশূর সার্ভিসের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন গর্ডন। পীর বক্সের কথা যখন কানে যায় তাঁর তখন তিনি নর্থ-ওয়েস্ট প্রভিন্সের শিমোগায় পোস্টেড। খবর পেয়ে গর্ডন পীর বক্সকে শিকার করবার অনুমতি চাইলেন। ইচ্ছে, তার পেছন পেছন ধাওয়া করে, খুঁজে বের করে তাকে গুলি করে মারবেন।
ময়দানে নেমে গর্ডন প্রথমেই পীর বক্সের অত্যাচারে বিধ্বস্ত জেলাগুলোতে চারটে ছোটো ছোটো ক্যাম্প বসিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য, ঘোরাঘুরির পথে ক্যাম্প বসাবার মালপত্র সঙ্গে না নিয়ে হালকা হয়ে চলা। পথে দরকার হলে কাছাকাছির মধ্যে থাকা যেকোনও একটা ক্যাম্পে খানিক বিশ্রাম নিয়ে নিলেই হবে।
গর্ডন ধরে নিয়েছিলেন, কপাল খুব ভালো না হলে অনুসন্ধানটা কয়েক সপ্তাহ অবধিও একটানা চালাতে হতে পারে। অতএব সেইমতো প্রস্তুতি নিয়ে তিনি কাজ শুরু করলেন।
অভিযান শুরু হল কাব্বানি নদীর ধার বেয়ে। কারকানকোটে ঘাঁটি গেড়ে নদীর বাঁ-পাড় ধরে চলল খোঁজাখুঁজি। শিগগিরই পীর বক্সের চলার পথের বেশ কিছু চিহ্ন পাওয়া গেল। তবে তাদের প্রতিটাই গিয়ে শেষ হচ্ছিল কাব্বানি নদীর জলে। আর তারপর নদীর কোনও পাড়েই সে পথের আর কোনও চিহ্ন থাকছিল না। ব্যাপারটা নিয়ে কুরাম্বাদের প্রশ্ন করতে তারা জানাল, হাতিটার অভ্যাস হল, পাড় ধরে খানিক এসে নদীতে নেমে যাওয়া। তারপর মাইল খানেক জলে ভেসে এগিয়ে গিয়ে ফের ডাঙায় ওঠা।
ব্যাপারটা জানতে পেরে গর্ডন বুঝলেন, নদীর কাছাকাছি চতুর এই প্রতিপক্ষের চলাফেরার চিহ্ন দেখে খুঁজতে গেলে বারেবারেই সে তাকে ফাঁকি দেবে। অতএব নদী থেকে দূরে যেসব এলাকায় হাতিটা ঘোরাফেরা করে সেই জায়গাগুলো গিয়ে খুঁজতে হবে তাঁকে।
প্রায় দু-সপ্তাহ ধরে চলল নিষ্ফল খোঁজাখুঁজি। কারকানকোট থেকে ফ্রাজেরপেট, তারপর সেখান থেকে হুনসুরের কাছে কাব্বানির তীর হয়ে হেগগারাভেনকোট্টা অবধি এলাকা অবধি চলল চিরুনি অভিযান। একসময় এমনকি ইয়াল্লুও ক্লান্ত হয়ে বলাবলি শুরু করল, এ-যাত্রা তার মালিকের কপাল খারাপ।
শুধু গর্ডন নিজের কাজে অটল। ক্লান্ত হওয়া বা হাল ছেড়ে দেওয়া তাঁর ধাতে নেই। পুলিশের কুকুরের মতোই একগুঁয়ে জেদ নিয়ে তিনি তাঁর খোঁজ চালিয়ে চলেছেন। মাঝেমধ্যে পীর বক্সের খোঁজে আসা অন্যান্য দলের সঙ্গেও মোলাকাত হয়ে যেত তাঁদের। তবে তাদের একেকজন পীর বক্সের দেখা মিলেছে এমন একেকটা জায়গায় এসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। গর্ডনের মতো একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াবার ব্যাপারে তাদের ঘোর আপত্তি। তাদের বক্তব্য, ওভাবে ঘুরে বেড়ালে আর যাই হোক পীর বক্সের দেখা মিলবে না।
খোঁজাখুঁজি শুরু করবার পর প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেছে তখন। পীর বক্সের কিছু পায়ের চিহ্ন খুঁজে পেয়ে গর্ডন তা অনুসরণ করতে করতে একটা জঙ্গুলে এলাকায় এসে পৌঁছেছেন। সেখানে বড়ো গাছপালা বিশেষ নেই। যা ঝোপজঙ্গল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাতে চিতল হরিণের চাইতে বড়ো চেহারার কোনও জীবের সেখানে লুকিয়ে থাকবার উপায় নেই।
জায়গাটায় কোনও গ্রাম ছিল এককালে। বাড়িঘরের কোনও চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই সেখানে। শুধু ছড়ানো এক বটগাছের নিচে জীর্ণ একটা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ তখনও মাথা তুলে রয়েছে। তখন ভরা দুপুর। খাড়া রোদ উঠেছে। গর্ডন আর ইয়াল্লু এসে সেই বটগাছের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। গর্ডনের হাতে ছিল একটা বিস্কুট আর ইয়াল্লুর মুখে খানিক পান।
হঠাৎ একটা বিকট হুঙ্কারের শব্দে দুপুরের নিস্তব্ধ বাতাস কেঁপে উঠল। চমকে উঠে তাঁরা ঘুরে দেখেন, মাত্র বিশ গজ দূরে হঠাৎ হুনসুরের আতঙ্ক আবির্ভূত হয়েছে। অত বড়ো শরীরটা নিয়ে সাক্ষাৎ যমের মতো তাঁদের দিকে ছুটে আসছিল সে।
গর্ডন যেখানটায় বসে ছিলেন, সে অবস্থান থেকে জন্তুটাকে মরণ মার দেওয়া একরকম অসম্ভব। মাথা ওপরদিকে তুলে ধরে, শুঁড় উঁচিয়ে যেভাবে মুখোমুখি তেড়ে আসছিল সে তাতে শুধু তার বুকটাই বন্দুকের মুখে খোলা। সেখানে গুলি করলে তা কিছুতেই তার হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসের নাগাল পাবে না।
অটল হয়ে বসে রইলেন গর্ডন কামিং। ছুটে আসা দানবের চোখ থেকে চোখ সরালেন না এক মুহূর্তের জন্যও। তারপর যখন সে আর গজ দশেক দূরে, ঠিক তখন মাথার সোলা-টুপিটা খুলে ছুড়ে দিলেন তার দিকে।
হঠাৎ থেমে গেল জীবটা। উড়ে আসা বস্তুটা কী সেটা দেখে নেবার জন্য নিচের দিকে মাথা নামাল এক মুহূর্তের জন্য। ঠিক এই মুহূর্তের ভগ্নাংশটুকুর জন্যই অপেক্ষা ছিল কামিং-এর। শুঁড়ের ঠিক ওপরে উঁচু হয়ে থাকা কপালের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে গেঁথে গেল তাঁর ভারী বন্দুকের বুলেট। ভাঙা খুলি নিয়ে পাথরের অতিকায় চাঙড়ের মতো লুটিয়ে পড়ল হুনসুরের আতঙ্ক।
পরে গল্পটা বলবার সময় ইয়াল্লু বলেছিল, “আহা দোস্ত, সাহেব বাহাদুর যখন বন্দুকটা নামিয়ে রেখে হাতের বিস্কুটটার বাকিটা ফের খেতে লেগেছেন, আমার তখন তাঁর পায়ে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। ভাবখানা এমন যেন কিছু একটা পাখি-টাখি মেরেছেন। এমন কলজের জোর তুমি ভূ-ভারতে আর দুটি পাবে না হে!”