বনের ডায়েরি বন বন্দুকের ডায়েরি-শিকারী বন্ধু গোন্দ এ মার্ভিন স্মিথ। অনুঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য শরৎ ২০১৯

বন বন্দুকের ডায়েরি আগের পর্বঃ হাতি হাতি, শঙ্খচূড়ের ডেরায়, আলাদিনের গুহা

শিকারী বন্ধু গোন্দ

এ মার্ভিন স্মিথ  অনুবাদ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

দেড়শো বছর হয়ে গেল এ-দেশে আছি আমরা। তবু, ভারতবর্ষের কতটুকুই বা জানতে পেরেছি? দেশ চিরে চলে যাওয়া ট্রাঙ্ক রোড আর রেলের লাইনের আওতার বাইরে যে বিশাল দেশ তার অসংখ্য মানুষজনকে নিয়ে বেঁচে থাকে তার খোঁজ পেতে আমাদের গ্যাজেটিয়ারগুলোর পাতা ওলটাতে হয়। আর সেখানেও কতটুকু তথ্যই বা থাকে? তার কারণ এই গ্যাজেটিয়ারগুলো ইউরোপিয়ানদের নানান অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি। দেশি লোকজন খুব তাড়াতাড়ি তাদের বিশ্বাস করে সব কথা জানাবে না। আমি নিজেও এর থেকে খুব আলাদা তা বলছি না। তবে এ-দেশের নানা অংশের বিভিন্ন উপজাতীয় মানুষজনের মধ্যে দীর্ঘকাল বসবাস করবার ফলে আমি তাদের বেশ কিছু গুণকে তারিফ করতে শিখেছি। তারা আমার জাতের মানুষের মতই শক্ত আর সোজাসাপটা। তাদের ছোটোখাটো দোষগুলোকে আমি তাই তত ধরি না। তবে কথা হল, জাতিতত্ত্বের প্রবন্ধ আমি লিখতে বসিনি, লিখতে বসেছি আমার শিকারি বন্ধুর কথা।

আসুন পাণ্ডু শিকারির গল্প বলি। এদেশি লোকের তুলনায় বেশ লম্বা। প্রায় ছ-ফিট। এমন রোগা যে কঙ্কাল প্রদর্শনীতে দিব্যি মানিয়ে যাবে। অথচ শরীরটা একেবারে সিধে। চোখের দৃষ্টি বাজপাখিকে হার মানায়। জঙ্গলে সামান্যতম নড়াচড়াও তার তীক্ষ্ণ চোখকানকে এড়াতে পারে না। বয়স পঞ্চাশের ওধারেই হবে বোধ হয়। অন্তত তার মাথার কমে আসা চুল আর পাক ধরা গোঁফেরা সেই সাক্ষ্যই দেয়। অথচ আমার টাট্টুর পাশে পাশে চল্লিশ মাইল হেঁটে দেওয়া তার কাছে একেবারেই ছেলেখেলা। আর তারপর সেই পথ পেরিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছেই সে ছুট দেবে শিকারের খবরের খোঁজে, যেন এই চল্লিশ মাইল হাঁটাটা তার রোজকার প্রাতর্ভ্রমণ। অনেক সময়েই দেখেছি প্রায় চব্বিশ ঘন্টা সে উপোস থেকে আমার পাশে পাশে চলেছে। মাঝে মধ্যে  যখন থেমেছি, তখন একটিপ করে নস্যি ছাড়া মুখে আর কিছু দেয়নি সে। জাতিতে সে গোন্দ। কাজেই আমার রান্না করা খাবার সে কিছুতেই মুখে তুলবে না। তবে হ্যাঁ, খানিক চাল দিলে ভারী খুশি হয়ে তা সে নিত। তারপর কাঁচাকাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলত সবটা।

ছোটোনাগপুরের প্রাক্তন কমিশনার মিস্টার হেউইট তাকে একটা পুরোনো ব্রাউন বেস (সেনাবিভাগের গাদাবন্দুক) উপহার দিয়েছিলেন একসময়। ওই তার একমাত্র অস্ত্র। ঐ নিয়ে সে নিখুঁত নিশানাবাজি করে দেখায় বারে বারে। ওই অস্ত্র হাতে থাকলে আহত বাঘ কিংবা ছুটে আসা বুনো মোষের সামনেও গিয়ে নির্ভয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়।

গুলি ছোঁড়বার জন্য বারুদটা সে নিজের হাতেই বানিয়ে নেয়। রাঁচি থেকে কিনে আনে গন্ধক আর সোরা। আর কাঠকয়লা বানায় হিলা-র ঝোপ পুড়িয়ে। আর মাটির তৈরি গোল ছাঁচ দিয়ে নিজের বন্দুকের বুলেট গড়ে নেওয়াও তার কাছে ছেলেখেলা।

তবে সমস্যাটা তার হয় বন্দুকের বারুদ ফাটাবার ক্যাপ নিয়ে। ইদানিং সরাসরি বুলেট পুরে চালাবার ব্রিচ লোডিং বন্দুক এসে গেছে বাজারে। গাদাবন্দুকের ক্যাপের তাই বড়ো অমিল। একবার তাকে কয়েকশো সেই ক্যাপ উপহার দিয়ে আমি তার মন জিতে নিয়েছিলাম। এরপর বহুবার সে আমায় জিজ্ঞাসা করেছে, তার গাদা বন্দুককে আমি চক্‌মকি ঠোকা ফ্লিন্ট লক বন্দুকে বদলে দিতে পারব কি না। তাহলে আর ওই ক্যাপের সমস্যা তার থাকে না।

জামাকাপড়ের কোনো সমস্যা পাণ্ডুর নেই। কোমরে একটা কৌপিন সম্বল করেই তার চলে যায় দিব্যি। কাঁধে একটা থলে। পথচলতি যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুই রাখা থাকে তাতে। বারুদের শিং, সিসের ছররা, ন্যাকড়ার পুঁটুলিতে ক্যাপ, একটা পুরোনো ভাঁজ করা ছুরি, খানিক আফিং, খানিক তামাক আর দু-এক সের চাল। ওই পেলেই পাণ্ডু সপ্তাহখানেকের যে-কোনো সফরের জন্য সবসময় তৈরি। হাত আর পায়ের তেলোগুলো তার দৈত্যের মতন ছিল। অত বড়োবড়ো তেলো আমি আর কোনো মানুষের দেখিনি। হাতের চারটে করে আঙুল বেজায় লম্বা আর বুড়ো আঙুলটা শুধু এইটুকুনি। পায়ের তেলো এত শক্ত যে ধারালো পাথরের খোঁচাতেও তার কোনো হেলদোল হয় না। মে মাসের চাঁদিফাটা রোদেও কোনোদিন তাকে মাথায় কিছু দিতে দেখিনি।

বেশ কয়েক বছর আগে ছোটোনাগপুরের একটা ক্যাম্পে পাণ্ডু প্রথম আমার সঙ্গে এসে জুটেছিল। রোজই হয় একটা গিরজা, হরিয়াল, ময়ূর বা নিদেনপক্ষে একটা বনমুরগি জুটিয়ে আনত সে আমার জন্য, আর মাঝে মধ্যে  খানিক হরিণের মাংস। এই হরিণের মাংসের দিনগুলো পাণ্ডুর খুব আনন্দের দিন হত। কারণ সেদিন খানিক বকশিশ জুটত তার কপালে, আর তাই দিয়ে সে ধেনো মদ খেয়ে ফুর্তি করত।

ধেনো মদ অবশ্য পাওয়া যেত শুধু রোববারে। সে-দিন কুলিদের হপ্তা পাবার দিন। গ্রামের একটেরের আমতলায় সেদিন হাট বসত। সেইখানে বসত ধেনো মদের আসর। কাজেই , দেখা যেত খালি রোববার রোববারই পাণ্ডু হরিণের মাংস জুটিয়ে আনে। এ-নিয়ে কিছু  জিজ্ঞাসা করলেই একগাল হেসে বলত, “সাহেবের ভাগ্য খুব ভালো। রোববার হলেই  হরিণগুলো ঠিক মরতে চলে আসে।”

আর ধেনো মদের ব্যাপারে পাণ্ডু ছিল একটি জালা-বিশেষ। একাসনে তিন গ্যালন অবধি ও-বস্তু তাকে অক্লেশে খেয়ে নিতে দেখেছি অনেকবার। এক হাতে পাতার দোনায় করে ঢোঁকের পর ঢোঁক গলায় চালান করত আর অন্য হাতে তার মোতির গলকম্বলে আদুরে সুড়সুড়ি চলত ঘন্টার পর ঘন্টা, যতক্ষণ না ট্যাঁকের পয়সা শেষ হয়। এই মোতি ছিল তার প্রাণের বন্ধু, তার সবসময়ের সঙ্গী। 

সে যে কত গরিব সে-কথা বোঝাবার জন্য একটা প্রিয় কথা ছিল তার, “পেটেপিঠে মিশে গেছে সাহেব!” কথাটা আক্ষরিকভাবেও সত্যি ছিল। বড়ো রোগা ছিল পাণ্ডু। তবে এই রোববারের ফুর্তির পরে তার পেটটা বেশ ফুলে উঠত। খাওয়া শেষ হলে একটা গাছে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত সে। তখন তাকে দেখতে লাগত যেন দুটো কাঠির ওপর দাঁড় করানো একটা জল ভরা ভিস্তির মশক। মাথাটা নিচু করে নেশার ঘোরে ওইভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকত সে। নিজের মনেই কী যে বিড়বিড় করত থেকে থেকে কে জানে। তখন তার বন্ধু মোতি তাকে পাহারা দিত। লোকজন হোক কি জীবজানোয়ার, কাউকে সে তখন তার মালিকের কাছে ঘেঁষতে দেবে না।

কুকুরের প্রভুভক্তির গল্প আমি অনেক শুনেছি, কিন্তু এই খুদে ষাঁড়টির প্রভুভক্তির কাছে তারা কেউ আসে না। মোতি খুব সাধারণ জীব। ফুট চারেক উঁচু। গায়ের রঙ হলদেটে। গ্রাম-ভারতের পথেঘাটে অমন বামন ষাঁড় অনেক দেখা যায়।

তবে মোতি একটা ব্যাপারে তার ভাই বেরাদরদের থেকে একেবারে আলাদা ছিল। সে ছিল শিকারি ষাঁড়। পাণ্ডু তাকে শিকারের বিদ্যেয় জবরদস্ত করে তৈরি করে নিয়েছিল। মালিক কী চায় সেইটে সে তার চোখের কিংবা আঙুলের ইশারাতেও বুঝে নিত দিব্যি। শিকারের পিছু নেবার কাজটা পাণ্ডু তার এই ষাঁড়কে নিয়েই করত। শিকারি হিসেবে তার এত নামডাকের পেছনে এই মোতির বুদ্ধির অবদানও কম ছিল না।

একটুকরো পুরোনো চটের একপাশে সবুজ পাতালতা আর অন্যপাশে টকটকে লাল দাগ কেটে সেইটে সে ঘোড়ার জিনের মত ছড়িয়ে দিত মোতির পিঠে। শরীরের দু’পাশে মাটি অবধি ঝুলে থাকা সেই চটের আড়ালে অদৃশ্য থেকে মোতি শিকারের অলক্ষ্যে হানা দিত তার ওপরে।

ধরা যাক আমরা হরিণ শিকারে গেছি। মোতি তখন তার চটের লাল দিকটা হরিণদের দলের দিকে ঘুরিয়ে রেখে ঘাস খেতে খেতে তাদের দিকে এগিয়ে যাবে চুপচাপ। সবুজ ঘাসের বুকে টকটকে লাল দাগগুলো ফুটে থেকে হরিণদের চোখ টানত সহজেই। ব্যাপারখানা কী সেইটা দেখবার জন্য যেই তারা মোতির কাছাকাছি আসত অমনি হাঁক দিত মোতির পেটের তলায় লুকিয়ে থাকা পাণ্ডুর গাদাবন্দুক। অত কাছ থেকে নিশানায় ভুলচুক হবার কোনো ভয় থাকত না।

কিংবা ধরা যাক ময়ূর শিকার হবে। মোতি তখন চটের সবুজ দিকটা শিকারের দিকে ঘুরিয়ে ধরে দাঁড়াবে। তারপর সেই একই কায়দায় এগিয়ে যাবে তার দিকে। ফলে ময়ূর মোটেই ঘাবড়াবে না। রঙটা তাদের চেনা। তার ওপর গ্রামগঞ্জের গরু-মোষ দেখে তাদের অভ্যেসও আছে। বাকিটা আগের মতই। মোতি আর ময়ূরের কাছাকাছি আসা, তারপর তার পেটের তলা থেকে পাণ্ডুর বন্দুকবাজি।

পুরো কাজটায় মোতি বেজায় আনন্দ পেত। শিকার হয়ে যাবার পরেই সে পাণ্ডুর কাছে এসে গলাটা তুলে ধরবে। তখন তাকে আদর করতে হবে খানিক। যদি পাণ্ডু আদর করতে ভুলে যেত তাহলে মোতি তখন তার বন্দুকটা শুঁকবে; যেন বলতে চায়, যন্ত্রটা কি খারাপ হয়ে গেল?

একবার আমি একটা বাজে কাজ করেছিলাম। পাণ্ডুকে বলেছিলাম, “পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি। মোতিকে আমায় বেচে দাও।”

কথাটা শুনে পাণ্ডুর মুখটা হঠাৎ বড়ো মলিন হয়ে গিয়েছিল। দেখি তার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। খানিক বাদে সে ধরা গলায় বলে, “সাহেব, মোতি যে আমার কাছে কতটা সে যদি তুমি জানতে! যদি জানতে কতবার ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, তাহলে ও-কথা তুমি বলতে পারতে না। টাকা নিয়ে আমার হবেটা কী? ওতো আমি ক’দিনেই মদ খেয়ে উড়িয়ে দেব। কিন্তু তারপর? ও আমার মন ভুলিয়ে রাখে। ও আমার কাজে হাত লাগায়। ও আমার দেখাশোনা করে। বউবাচ্চা সবকিছু ছিল আমার। সবাই চলে গেল। তবু এই যে বেঁচে আছি সে কেবল ওই মোতির জন্য। ও বাঁচলে আমি বাঁচব। ও চলে গেলে আমিও আর বাঁচব না।”

বেচারা পাণ্ডু। বুড়ো, মাতাল, নির্বোধ দীনজন। তবু তাকে আমি ভুলতে পারি না। অনুচর নয়, আজও আমি তাকে আমার শিকারি বন্ধু বলেই বুকের মধ্যে ধরে রেখেছি।

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s