১৯৭৫ সালে আমাদের ভূতত্ত্ব বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে, আমি এবং আমার সহপাঠিরা ইকনমিক জিওলজি প্রসঙ্গে ফিল্ড ট্রিপ করতে মধ্যপ্রদেশের কোরবা ফিল্ডে গেছিলাম। যারা এ-ব্যাপারে ততটা খবর রাখেন না,তাদের জন্য জানাই, কোরবা হোল ভারতের অন্যতম বিখ্যাত কয়লাখনি এলাকা। এখন অবশ্য এই কোরবা ফিল্ড ছত্তিশগড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। যদি আপনি এখন কোরবা জেলার মানিকপুর ব্লকে যান,তবে ওপেন কাস্ট মাইনিং দেখতে পাবেন। কোরবা কয়লাখনি এলাকা প্রায় ৫৩০বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়ানো। আমরা যখন ফিল্ড ট্রিপে সেখানে গেছিলাম,তখন সেটা খাদান মাইনিং বা ট্রেঞ্চ মাইনিং-এর পর্যায়ভুক্ত ছিল। মানে লিফট করে,কোমরে আড়াইমনি ব্যাটারি বেঁধে, হেলমেটে লাগানো মাইন্স ল্যাম্পের স্যুইচ অন করে,আমাদের লেভেল অনুযায়ী নামতে হয়েছিল। নামার পথে ওয়াটার টেবিল (জল তল) পার হবার সময়,জলের ধারায় ভিজেও ছিলাম। যদিও সেটা ছিল কাক-স্নান গোত্রের।
হাসদেও বলে এই এলাকায় একটি বড়ো নদী আছে, যেটি মহানদীর একটি উপনদী এবং পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশের কারণে বেশ চঞ্চল। এই নদী যে ডিপ্রেশন বা পাহাড়ের তলা দিয়ে বয়ে গেছে, সেই বেসিন বা ডিপ্রেশনই হল এই কয়লার মজুদ ভাণ্ডার,যা জি এস আই এর হিসেব অনুযায়ী ১০,০৭৫ মিলিয়ন টন।
আমরা এই কোরবার মানিকপুর ফিল্ডের সুরা কাচ্ছার খাদানে নেমেছিলাম সকলে। নামার আগে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে, আমাদের ব্যাটারি আর মাইন্স ল্যাম্প শরীরে ফিট করে দিয়েছিলেন ওই খনিরই চার্জে থাকা মাইন্স ম্যানেজার। উনিও আমাদের সঙ্গে সব কিছু সরেজমিনে দেখাতে ও বোঝাতে নেমেছিলেন। আমরা যেদিন এই খনিতে নেমেছিলাম, তারিখটা এখনও মনে আছে,২৭-শে ডিসেম্বর। প্রায় তিন ঘণ্টা বাদে,আমরা যখন ওপরে উঠে আসি,খনি-গহ্বর থেকে,তখনই জানতে পারি,বিহারে,চাসনালা কয়লাখনিতে অ্যাক্সিডেন্টে প্রায় শ- চারেক খনিকর্মীর এই একটু আগে মৃত্যু ঘটেছে। সেই ধাক্কাটা আমাদের সকলেরই বেশ জোরে লেগেছিল। পরেরদিন খবরের কাগজ পড়ে জানা যায়,কোনো একটি বিস্ফোরণে একটি জলে ভরা রিজার্ভারের দেওয়ালে ফাটল ধরে আর জল ঢুকে আসে খনির ভেতর। ফলে জলে ডুবে প্রায় ৪০০ মাইনার মারা যান। এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে পরে কালাপাত্থর সিনেমাটি তৈরি হয়েছিল,সে সময়ের সুপারহিট ফিল্ম।
যাই হোক,একটাই সুবিধে ছিল,সে সময় আজকের মত সোসাল মিডিয়ার এতটা নিশ্ছিদ্র উপস্থিতি ছিল না,তাই বাড়িতে বাবা-মায়েরা আমাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হবার সুযোগই পাননি। আমাদের ফিল্ড ট্রিপের খুঁটিনাটি আমরা নিজেরাও,হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার সময়ও জানতে পারতাম না। স্যারেরা সঙ্গে আছেন,যেমন বলবেন,যেখানে বলবেন- তেমনই হবে আমাদের যাত্রাপথ। এই ছিল পদ্ধতি।
কলকাতায় শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এবং ধানবাদের আই এস এম-এ মাইনিং এবং মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং এর কোর্স পড়ানো হয়। এই খনিগুলির কাজ ব্রিটিশরা এদেশে থাকতেই শুরু হয়েছিল,সে প্রায় ১৯৪১ সাল নাগাদ। কোরবা নিয়ে এত কথা বলার একটিই কারণ,তা হল কুকুর। আমার তখন বয়স সবে ২০ পেরিয়েছে। সেই যে আরতি মুখার্জির বিখ্যাত গানটা আছে না, “তখন তোমার ২১ বছর বোধহয়,আমি কেবল অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়…” শব্দের এক আধটু ভুল হতে পারে,ক্ষমা করে দেবেন রসিক পাঠক,মানে বলতে চাইছি মনটা সে সময় এতটাই খাঁটি রোমান্টিক ছিল। যা দেখি,তাই ভাল লাগে – তারই প্রেমে পড়ে যাই। চিহ্ন কুড়িয়ে নিতে সচেষ্ট হই। নিতান্ত তুচ্ছ একটি গাছের পাতা বা ফুল,তাই পকেটে ভরে রাখি। আজ সেই সব ফুলপাতারা স্মৃতির অজস্র চেপেচুপে রাখা স্তূপীকৃত অকেজো জিনিসের ভিড়ে অবহেলায় কোথায় মুখ লুকিয়েছে। এই ভালোবাসার মধ্যে ছিল,কিছু কুকুরও। দূর থেকেই। কী জানি কীভাবে মনের মধ্যে একটা অজড় অনড় ধারনা বসেছিল সে বয়েসে,যে কুকুর মাত্রই কামড়ায়। আমার ভয়ঙ্কর ডগ-ফোবিয়া ছিল। অথচ, আজকে আমার সবচেয়ে ভালোবাসার পুষ্যিটি হল একটি উদ্ধার করা স্ট্রিট ডগ। তাকে নিয়েই লিখতে বসে,এতক্ষণ কেবল মুখবন্ধ দিচ্ছিলাম। কারণ একটাই,যা একসময় আতঙ্কের কারণ ছিল,তাই এখন আমার প্রাণের পরশমণি হয়ে উঠেছে। বয়স হয়েছে,তাই কেজো কথার অবতারণা করতে গিয়ে,স্মৃতির টানা হেঁচড়ায় একটু দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ি আর কথাগুলি স্মৃতির গভীর থেকে বুড়বুড়ি কেটে ফেনার মত উঠে আসে।
সে যাই হোক,গল্পে ফিরি। এই কোরবাতে আমাদের কোল জিওলজির যাবতীয় প্র্যাকটিকাল হবার পরে,দু’দিন ফিল্ড ছুটি মিলেছিল। আমরা আমাদের ফিল্ডের যাবতীয় হোমওয়ার্ক লিপিবদ্ধ করে,স্যারেদের কাছে দরবার করতে গেলাম। এখানেই কাছে বিন্ধ্য পর্বতের মাথায় ‘অমরকন্টক’ বলে একটি প্রাচীন শিব তীর্থ এবং মন্দির আছে,আমরা সেটির দর্শনাভিলাসী।
স্যারেরা একটু অবাকই হয়েছিলেন আমাদের প্রস্তাবে। সে সময়,কোরবা থেকে অমরকন্টক যাবার সিধে কোনো যোগাযোগ ছিল না। বিলাসপুর, রায়পুর অথবা চাঁপা থেকে বাসে করে অমরকন্টক যেতে হত। আমাদের স্যারেরা সাজেস্ট করলেন দুটি পথ। এক, ট্রেনে করে বিলাসপুর,সেখান থেকে বাসে গন্তব্যে। নয়তো কোরবা থেকে চাঁপা বা চম্পা বাসে,সেখান থেকে বাসে আবার অনুপপুর। অনুপপুর থেকে পাহাড়ি পথে হেঁটে অমরকণ্টক পৌঁছোনো যায়। যদিও শেষেরটা বেশি চিত্তাকর্ষক ছিল,আমাদের মধ্যে কয়েকজন সেটার পক্ষে ভোটও দিয়েছিল,কিন্তু শেষমেশ বিলাসপুর থেকে বাসেই যাওয়া ঠিক হয় কেননা বেশির ভাগ লোক তাতেই সায় দিয়েছিল। স্থানীয় মানুষ,যাঁরা কোরবায় কাজ করেন,আর এই এলাকার বিভিন্ন লোকালয়ে থাকেন,তাঁরা পাহাড়ে চড়াটা একটি বিশেষ কারণে বারণ করে দেন। তার কারণ, পাহাড়ি জঙ্গলে পথ চলতি মানুষের সামনে বন্য হিংস্র জন্তুজানোয়ারের হঠাৎ সামনে চলে আসাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। সেই তালিকায় বুনো বেড়াল,হায়না ছাড়াও বিশেষ করে জানা গেল তেন্দুয়ার কথা। তেন্দুয়া, চিতারশ্রেণী ভুক্ত,অত্যন্ত চালাক,শিকারী বাঘ বিশেষ। সেই শুনে আমাদের মধ্যে পাহাড় ডিঙিয়ে ওঠার সপক্ষে যারা ছিল তাদের সংখ্যা দুম করে কমে গেল। জিওলজি পড়তে এসে শেষে বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গলে বাঘের খোরাকি হতে কেউই রাজি নয়। এই ঘটনা আজ থেকে ৪৫ বছর আগের,তখন পৃথিবীতে সত্যি করে জঙ্গল,পাহাড় তাদের পূর্ণ মর্যাদায় বিরাজমান ছিল।
অমরকণ্টক যাবার প্রধান কারণ ছিল শোন নদীর উৎস স্থল। তার সঙ্গে নর্মদারও। সাতপুরা আর বিন্ধ্য পর্বত এই দুইয়ের মিলনস্থলে অমরকন্টক। যুগাতীত তীর্থক্ষেত্র এবং সাধনা স্থল। বিন্ধ্য এবং সাতপুরা ছাড়াও আছে আরেকটি পর্বতশ্রেণী যার নাম মৈকাল নাকি মৈনাক? এই বুঝি সেই জায়গা যেখানে অমৃতের জন্য দেবতা আর অসুরদের মধ্যে সেই কোন আদিকালে সমুদ্রমন্থন হয়েছিল? অমৃতের কথা বুক ঠুকে হ্যাঁ বলতে পারি না,তবে সমুদ্র অবশ্যই মথিত হয়েছিল,তাই তো এইসব ত্রিকালজয়ী পর্বতশৃঙ্গের মাথা তুলে দাঁড়ানো।
আমার জীবনে কুকুরকে পোষ্য হিসেবে স্বপ্নেও নেব না,এমন প্রতিজ্ঞা এই পাহাড়ের মাথায় বসে,মহাদেবকে সাক্ষী রেখে করেছিলাম। আমার সেই প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হল ২০১৫ সালে এসে, সেই দিনটি আমার মানুষ-জন্মের এক বিশেষ বোধ আর ভালোবাসার দিন,যা আমার সঙ্গে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থেকে যাবে। এত কথা বলার কারণ একটাই আজকের কাহিনি বলার আগে যদি না ৪৫ বছর আগেকার আমিকে সকলের সামনে না নিয়ে আসি তাহলে এই কথাগুলি নেহাত মামুলী এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে। তাই আরেকবার লুপ লাইন দিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিচ্ছি।
বিলাসপুর থেকে বাস ঘণ্টা তিনেকের ছ্যাক্কড় যাত্রা করে আমাদের তুলে নিয়ে এল অমরকন্টক বাসস্ট্যান্ডে, ৩৪৫০ ফুট (প্রায় ১০৬০ মিটার) উচ্চতায়। আজকে গেলে হয়তো,সেই ছবিটা আর দেখতে পাব না,কিন্তু সেই দুপুরের পাহাড়ি বাসস্ট্যান্ড,ছড়ানো ছিটোনো কয়েকটা চায়ের গাল্লা,মুংফলির(চিনাবাদাম) ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকা কিছু দেহাতি মহিলা,পাহাড়ের আড়ালে সূর্যের প্রতিফলিত আলো– সব মিলিয়ে মুহূর্তে মন উদাস বাউল হয়ে গিয়েছিল। আমার একার নয়,আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের। এরই নাম স্থানমাহাত্ম্য।
আমরা আরো কিছুটা পায়ে হেঁটে পাহাড় চড়ে,তবেই সাদা রং-এর মন্দিরের আর মন্দির সংলগ্ন নর্মদাকুণ্ডের দেখা পেলাম। মন্দিরের ভেতরের মহাদেব দেখতে কেমন ছিলেন,আজ আর একটুও মনে নেই,কিন্তু বেশ মনে আছে নর্মদা কুণ্ড আর তার জল দিয়ে ছিটে-স্নানের কথাটা। আগফা ক্লিক- থ্রি-র শাটার টিপে কেউ কেউ ছবিও তুলেছিলাম। আমার কাছে অবশ্য তখন কোনো ক্যামেরা ছিল না।
মন্দিরের এক পাশ দিয়ে খোলা পাহাড়ে যাবার একটা রাস্তা আছে,মানে ছিল। এখনও থাকতে পারে,যে পথে সকলে শোন নদীর উৎসস্থল দেখতে যায়। আমরাও গিয়েছিলাম,আমাদের মাথায় তখন রিভার সিস্টেমের বিভিন্ন দশারা,দশচক্র ভগবানের মতো ঘুরছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নদীর উৎস-বিন্দু দেখে,আমরা হতাশই হয়েছিলাম। নদী তুমি কোথায়,এই প্রশ্নটাই মনের মধ্যে বার বার ঘুরছিল। কিন্তু সক্কলেই ভক্তিভরে পেন্নাম ঠুকে পয়সা ছুঁড়ছে দেখে,আমাদের মনের প্রশ্নকে প্রকাশ্যে আনার সাহস পাইনি কেউ। হতে পারে,এই জায়গাটা সঠিক জায়গা নয়, সেটা অন্যত্র, ধারে কাছেই হবে,হয়তো বা পাহাড়ের এই ঢাল থেকে নজরে আসছে না। নদী,পাহাড়,জঙ্গল এই তিন প্রতিষ্ঠানের মিলিত সৌন্দর্য আর ব্যাপকতা অনুভব করে,আমরা সকলে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিই। ধোঁয়াবাজেরা পৃথিবীর বায়ু দুষিত করতে লাগলে,আমার মত কয়েকজন, বাসস্ট্যান্ডে কেনা বাদামের সদ্ব্যবহারে লেগে গেল। জল সকলের কাছেই নিজের নিজের জলের বোতলে।
এই সময় কিছু পাহাড়ি কুকুর,আমাদের চারপাশে জড়ো হতে থাকে। কুকুরকে খাওয়াবার কোন প্রোগ্রাম আমাদের নেই,দলের সকলেরই একটু তটস্থ ভাব। কারো কাছে বোধহয় বিস্কুট ছিল,তার দু-একটা ছুঁড়ে দিতেই তারা সহর্ষে তা গ্রহণ করে নিল। কিন্তু ওদের সংখ্যা আমাদের থেকে বেশি,আর বিস্কুটের ভাণ্ডার সামান্য। তাই আমরা বাদাম ট্রাই করি। ওমা,এ তো মানুষের মতো বাদামও কটর মটর করে খেয়ে ফেলল। এতক্ষণে কলকাতার যুবককূল আর অমরকন্টকের পাহাড়ি নাদুস নাদুস কুকুর গোষ্ঠীর মধ্যে একটা সামান্য হলেও সখ্যতা তৈরি হয়েছে বলে মনে হল। ওখানে আরো যারা পর্যটক ছিলেন, তারা আমাদের এই বালখিল্যতায় খানিক মজাই পাচ্ছিলেন। তাঁরা অবশ্য কেউই খাওয়াতে উৎসাহী ছিলেন না।
আমাদের মধ্যে কে প্রথম উসকানিটা দিয়েছিল,আজ আর মনে নেই; তবে আন্দাজ করতে পারি। এই বুড়ো বয়সে,নতুন করে আর বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়ার সূত্রপাত না করাই ভাল। তাই সে কথা থাক।
‘ছুঁড়ে ছুঁড়ে তো বাদাম খাওয়াতে সবাই পারে,হাতের তালুতে রেখে কে খাওয়াতে পারবে?’ এমন একটা প্রস্তাব ওঠামাত্র ভাবগতিক দেখে আমি ওখান থেকে উঠব ঠিক করে ফেলি। আমায় কেটে ফেললেও ও আমি পারব না। এদের চেহারা ডেনকালির বাঘার সাইজের,গায়ে একটু লোমও আছে,তায় আবার খোলা এবং জংলী। আমার এত পুণ্যফল নেই,তেন্দুয়ার হাত থেকে নিস্তার পেতে বাসে করে এসে,এখন নেকড়ের বংশজাতদের হাতে হেনস্থা হয়ে বেঁচে যাব! আমি বিলকুল রাজি নই।
কিন্তু, ২০-২২ বছরের একপাল ছেলেদের স্বভাবই হচ্ছে, নিজেদের মধ্যে,বলিদানের পাঁঠাটিকে ঠিকঠাক খুঁজে নেয়,তারা এই কুকুরদের মতই একই গোষ্ঠী-নিয়মে চলে কিনা! এক সময় পাঁঠার চয়েস বদলাতে বদলাতে আমাতে এসে থামে। আমি খাস কলকাতার ছেলে নই,আর স্বভাবেও অন্যদের তুলনায় খানিকটা চুপচাপ,হয়তো কিছুটা আনপলিশড। তো, দাও এর হাতে তুলে বাদামের কিছুটা।
“ছবি তুলছি, মাইরি বলছি,একবার হাতটা তো দে।”
তখন ছবি উঠবে,সে এক মস্ত ব্যাপার। আমার তো ক্যামেরাই নেই। যাই হোক,মহাদেব স্মরণ করে,আমি সমুদ্রতল থেকে হাজার মিটার ওপরে বসে,সম্পূর্ণ অজানা এক জীবগোষ্ঠীকে অতিথি আপ্যায়নে মনোযোগী হলাম।
সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু অত বড়ো বড়ো লম্বা জিভের গরম গরম স্পর্শ বেশিক্ষণ বরদাস্ত হল না। হাত সরিয়ে নিতে গিয়ে,প্রথম জনের মুখেই হাতখানা খপ করে মুঠো অবস্থায়,আটকে গেল। সকলে প্যানিকড,আমি মূর্ছা যাব প্রায়, মুঠোটা খুলে দিতেই,বাকি বাদামগুলো মাটিতে ঝরঝর করে ছড়িয়ে পড়ল। আমার হাত মুক্ত হল।
না, রক্ত টক্ত বেরোয়নি,হাতের তালুর উল্টোদিকে নুনছালটা কিছুটা উঠে গেছে। তখন এই পাঁঠাকে নিয়ে সকলে ছুটে নর্মদা কুণ্ডে। ‘জলে ডোবা’,‘ভাল করে ধুয়ে ফেল’,‘কিছু হবে না’, ‘স্যারেদের বলার দরকার নেই’বিবিধ পরামর্শ চলতে থাকে।
অভিজ্ঞতা-ভরা নজর দিয়ে সকলে দেখে,এটাই বারবার জোর দিল,রক্ত বেরোয়নি যখন,ভয়ের কিছু নেই। আমি তখনও জানি না,হাইড্রোফোবিয়া কী করে হয়,র্যাবিস কী জিনিস,রক্তে লালা মিশলে আমার বা কুকুরটার কী কী হতে পারে! আমার বন্ধুরাও জানে না। শুধু এইটুকু ভাসা ভাসা জানে যে কুকুরে কামড়ালে ১৪টা ইঞ্জেকশান,সেটাও আবার পেটে। অমরকণ্টকের অমরনাথ জানেন,আমি বা সেই কুকুরটি কতটা বিপদাপন্ন। বাকি সকলে কেবল আন্দাজই করতে পারে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমাদের সকলের মধ্যেই একটা চাপা ক্ষোভের সঞ্চার ঘটে গেল,নিঃশব্দে। আর আমার মধ্যে ভয় আর আতঙ্কের। এমনও মনে হল,যদি আমি আর কোরবা ফিরতে না পারি! যদি ফেরার পথে আমার জীবন থেমে যায়,আমার এই বন্ধুরা কি আমাকে এখানেই ফেলে রেখে যাবে? নাকি কলকাতায় নিয়ে যাবে আমার শরীরটাকে? ফিল্ড তো তাহলে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাবে। তার থেকেও বড়ো কথা,আমার জিওলজিস্ট হওয়া আর হবে না। রাতের ফিরতি ট্রেনে যখন আমরা বিলাসপুর ছাড়ি,তখন আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস,আমার “ইস রাত কি সুবহ নেহি।”
বিলাসপুর থেকে কোরবা পর্যন্ত ঠিকঠাকই পৌঁছে গিয়েছিলাম,না হলে এই বেত্তান্ত আজ আপনাদের শোনাতে পারতুম না। কিন্তু ক্যাম্পে ফিরেও,আমি বা আমার সহপাঠীরা এই ব্যাপারটা নিয়ে না নিজেদের মধ্যে না স্যারেদের সঙ্গে কোন আলোচনাই করিনি। একরকম পাহাড়ের ঘটনা পাহাড়েই শেষ করে এসেছিলাম আমরা। কিন্তু আমি মনে মনে অনেকদিন পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে ছিলাম। অমরকন্টকের পাহাড়ে সেই লোমশ কুকুরটাকে আমার আর দেখবার সৌভাগ্য হয়নি,তাই আমি এটুকুই মেনে চলছিলাম,যে আমার যখন কিছু হয়নি,সে বেচারাও মারা যায়নি আমার শরীরের বিষে।
এর পর আরো পাঁচ দিনের ফিল্ডে ঘোরাঘুরি আমাদের বাকি ছিল। সেইসব শেষ করে প্রায় এক সপ্তাহ পরে বাড়ি মানে কলকাতা ফিরি সবাই। আমার আর ততটা ভয় করছিল না,কিন্তু রাতে মাঝে মাঝেই স্বপ্নে আমার জলাতঙ্ক হয়েছে দেখে জেগে উঠতাম। এই একটা ভয় আমার মনের গভীরে বসে গেছিল,বিশেষত যখন আমার এক জ্ঞানী বন্ধু একদিন কলেজে লেকচারের ফাঁকে জানাল,জলাতঙ্ক নাকি দশ বছর পরেও প্রকাশ পেতে পারে। এরপর,আমি আর মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করতে পারিনি।
কিশোর অবস্থা থেকে এই এক ভীতি নিয়ে আমি প্রায় সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলাম। শেষে যখন রিটায়ারমেন্টের আর এক বছর বাকি,তখন আমার জীবন এবং কুকুর সম্বন্ধে চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল,যাকে বলে মৌলিক বদল –র্যাডিক্যাল চেঞ্জ।
আমার ছোটো মেয়ে সে সময় পুনেতে তার চাকরি সূত্রে থাকে। তার অফিসের নীচে,রাস্তার ওপরে কিছুটা জায়গায়,স্থানীয় এক মা-কুকুর,সদ্য চার পাঁচটি সন্তান প্রসব করেছে। চারপাশের দোকানদার আর অফিসের কিছু তরুণ তরুণীদের সেই শাবকগুলি খুবই প্রিয় ছিল। সাধারণত ইন্ডিয়ান কুকুরদের ‘পারিয়া’ গোষ্ঠীর মধ্যে ফেলা হয়। এরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান হয়,কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা এদের জিনগত। এবং এরা মানুষদের খুব কাছাকাছি নির্দ্বিধায় চলে আসতে পারে। সদ্য সদ্য পৃথিবীতে আসা সেই শাবকগুলিও এর ব্যতিক্রম ছিল না,যদিও,তাদের মা সবসময় কড়া নজর রাখত তার বাচ্চাদের ওপরে।
তবুও একদিন দুর্ঘটনা ঘটে যায়,একটি বাচ্চার পেছনের পায়ের ওপর দিয়ে একটি এনফিল্ড বাইক চলে যায়। বাচ্চাটি তখন সবে ২০-দিনের। আঘাতের চোটে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। নীচের একটি চা-ওয়ালা তাকে প্রাথমিক শুশ্রূষা করে জল দিয়ে, বরফ দিয়ে।
চারদিকে হৈ হৈ পড়ে যায়। মানুষ যতই নিষ্ঠুর হোক সদ্য জন্মানো অবোলা জীবটিকে কেউই দুচ্ছাই করতে পারেনি। ব্রাউন-চকলেট রঙের নাদুস নুদুস বাচ্চাটা আমার মেয়ের সবচেয়ে প্রিয় ছিল। ফলে কেউ গিয়ে ‘দিদি’কে মানে আমার মেয়েকে খবর দেয়। নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে আমার মেয়ে আর তার দুই বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়োয়। তিন মাস টানা ডাক্তার দেখানো এবং নিজেদের মেসে দিনরাত সেবা করার পর বাচ্চাটি শুধু বেঁচেই ওঠে না,তার পা-ও জোড়া লেগে একদম স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এনফিল্ডের চাকায় বেচারার পা দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। শুধু বয়স কম আর যথাযথ চিকিৎসা পাবার ফলে সেই বাচ্চা কুকুরটি তার জীবনের প্রথম প্রাণঘাতী বিপদ কাটিয়ে ওঠে।
মাস চারেক বাদে সে যখন পুরোপুরি মেস-মেম্বার, তখন আর রাস্তায় তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে কেউই উৎসাহিত হয় না। এদিকে অফিসের মেসেরও একটা নিয়ম-কানুন আছে! ফলে দু’জন মেম্বারকে বাইরে থাকতে হবে তাদেরই প্রয়োজনে। তাদের মানসিক জোর কিছু কম ছিল না, কিন্তু বন্ডকে (কুকুরির নাম বন্ড।) খালি বাড়িতে রেখে চাকরি করতে যাওয়া ক্রমাগত রিস্কি হয়ে উঠছিল।
সে-সময় আমার মেয়ে তাকে আমাদের কাছে, আমেদাবাদে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। গিন্নি যখন এই কথাটা আমাকে জানাল, এক নিমেষে আমার সামনে অমরকণ্টক আর সেই সারমেয়টির কিস্যা ফিরে আসে। যদিও আমার আঙুলে কোথাও তার চিহ্নটুকুও নেই,কিন্তু মনের ভেতরের দ্বিধা আর ভয়টুকুকে তো তখনও জয় করতে পারিনি। ফলত আমি সরাসরি এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করি।
এই ভাবে আরো মাসখানেক কাটে। এসময় পথে চলতে ফিরতে অন্যান্য কুকুরদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া শুরু করলাম। কিন্তু তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ই পেতে থাকি। এরও এক বা দু’মাস বাদে শুনলাম, আমেদাবাদেই কেউ সে সারমেয় বাচ্চাটিকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছেন,তাই আমার মেয়ে তাকে নিয়েই এবার বাড়ি ফিরছে। ভাবলাম,যাক এই ব্যবস্থাই ঠিক হয়েছে। মেয়ের ভালোবাসার জীবটি তার শহরেই থাকবে। চাকরি করতে করতে,আর তাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
বণ্ড যেহেতু জন্ম থেকেই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে বড়ো হয়েছিল, তাই তার অন্য সব ভাই বোনেদের থেকে একদম আলাদা ভাবে বেড়ে উঠেছিল। ছোটোবেলা থেকেই সমস্ত অ্যান্টিজেন,টিকা,কৃমির ওষুধপত্র সব ডোজ হিসেবে,নিয়ম করে দেওয়া হয়েছিল। তাই সে সম্পূর্ণভাবে আমাদের ঘরে থাকার উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। এছাড়াও তার স্বভাব চরিত্র অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড ছিল। এই যে বুঝে নেবার ক্ষমতা এবং সেইভাবে নিজেকে এডাপ্ট করা,সেটা দেশি কুকুরদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অনেক গুণ বেশি। এরা মানুষের মন পড়তে পারে।
এক ঠান্ডার সকালে মেয়েকে স্টেশনে থেকে আনতে গেলাম। আমার সঙ্গে দেখা হতেই,সে আমার কোলে ছোট্ট ব্রাউন তুলতুলে গরম গরম একটা লোমের বল তুলে দেয়। আমি জানতাম সেটা কী বস্তু,কিন্তু কোলে যখন নিয়েই ফেলেছি (বলা ভাল যখন কোলে চড়েই গেছে) তখন মুখ নামিয়ে দেখি, সুন্দর মায়াভরা দুটো চোখ দিয়ে সে আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। সে মুহূর্তে আমার সারা পৃথিবীটা কেমন টলে ওঠে। বিশ্বাস করুন,এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না। এই চোখ তো আমি আগেও দেখেছি। এমন মায়া ভরা চোখের চাউনি,আমার জ্ঞানত,একজনেরই ছিল,সে আমার মা।
এই প্রাণীটি তবে কে? আপনাদের ঠিক হয়তো বোঝাতে পারব না,কিন্তু নিমেষের মধ্যে আমার ভেতরে ভেতরে ম্যাজিকের মতো পরিবর্তন অনুভব করলাম। এই কি মায়া? এই কি জন্মান্তরের বাঁধন? এই কি বশীভূত হওয়া? আর সবচেয়ে আশ্চর্য,আমার মনের ভেতরে কোথাও আর কুকুরদের নিয়ে ভয় জিনিসটা নেই। এক্কেবারেই নেই। এ পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল? চল্লিশ বছর ধরে যে ধারনা আর বিশ্বাস মনের মধ্যে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিল,তা এই বাচ্চাটির চাহনি আর স্পর্শের প্রভাবে ছু-মন্তর হয়ে গেল! শ্রীশ্রীঠাকুরের নরেনকে ছোঁয়ার মতই প্রায়। এ অবিশ্বাস্য। তর্ক দিয়ে বোঝাবার বা বুঝে নেবার নয়। এ ইন্সটিংক্ট।
আজ এতদিন পরেও আমি সেই মুহুর্তটিকে একটুও ভুলিনি। সেই অনুভূতিটার কথা একটুও ম্লান হয়নি। চারিদিকের আওয়াজ আর স্টেশনের বিচিত্র শব্দাবলীর মধ্যে,কোলের মধ্যে তার সারা শরীর জুড়ে কম্পন হচ্ছিল। এত বড়ো প্রেক্ষাপটে জীবন তাকে এই সামান্য বয়সে এনে ফেলেছে,তার প্রাথমিকতার ধাক্কাটা সে তখনও সামলে উঠতে পারেনি। ট্রেনে আনার জন্য সিডেটিভ দিতে হয়েছিল,তার ঘোর তখনও ছিল। তার ওপরে সকালবেলা, বেশ ঠান্ডা। এইটুকু একটা প্রাণের জন্য তা অত্যন্ত চাপের। আমি তাকে বুকে চেপে ধরে,মেয়েকে নিয়ে পার্কিং এর দিকে হাঁটা লাগাই। আর কারো কাছে তার থাকতে যাবার কথাটা ওঠেইনি।
তারপরে,বাড়িতে আসার পরে সে সম্পূর্ণভাবে আমার স্ত্রীর সব সময়ের সাথী হয়ে যায়,যদিও যখন তাকে বাইরে নিয়ে যাবার সময় হত, ঠিক তখন সে গুটিগুটি আমার কাছে চলে আসত। তার শরীরের মধ্যে এমন সঠিক সময়ের ঘড়ি কী করে ফিট হয়ে গিয়েছিল,তা শুধু সেই বলতে পারে। তাই এডাপ্টিবিলিটির কথাটা আগে বলছিলাম। ভোরবেলায় সে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসে,আমায় একবার ছোট্ট করে ডাক দিত,সে ডাক একেবারেই কুকুরের সাধারন বার্কিং এর মত ঘেউ ঘেউ নয়,খানিকটা ঘো,ব্যাস। তাতে আমার ঘুম না ভাঙলে,তার ঠান্ডা নাকের ডগাটা আমার পেটের বা পিঠের কাছে,যেখানে জামাটা উঠে গিয়ে কিছুটা শরীর অনাবৃত হয়ে গেছে,সেখানে লাগাত।
প্রথম প্রথম চমকে উঠতাম। পরে সেটা আমার অ্যালার্ম ক্লক হয়ে গিয়েছিল। আমেদাবাদে যে ফ্যামিলির দত্তক নেবার ছিল,তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। কখনও তারা ফোন ধরে না,কখনও ফোনই যায় না। মেয়ের পুনে থেকে আসা যাওয়া এর মধ্যে দু-দুবার হয়ে গেছে। তারপরে একদিন সত্যিই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায়। যখন বন্ডের যাবার সময় সাব্যস্ত হয়ে যায়,তখন হঠাৎই আমি বুঝতে পারি,বন্ডকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার মুখে সে কথা শুনে বাড়ির সকলেই খুবই অবাক হয়। যদিও তারা খুশিও হয়েছিল।
সেই থেকে আজ চার বছরের ওপরে বন্ড আমার পারিবারের মানুষ। তার মতো সহজ,আর পবিত্র প্রাণী আমি দুটি দেখিনি। কোনো ভনিতা নেই,চাহিদা নেই,শুধু ‘ভালোবাসাটুকু দিও মোরে’ এই তার একমাত্র আবদার। বাড়িতে লোকজন এলে,খুশিতে নাচতে থাকে। তারা চলে গেলে একবেলা সে মুখ লটকে বসে থাকে,খায়ও না। আমরা মানে আমি বা গিন্নি বা আমার মেয়ের বাইরে যাওয়া কিংবা ফিরে আসার সময় তিনতলার জানালার ধারে ঠায় বসে থাকা,অথবা আমাদের নিজেদের মধ্যে সংসার-কলহ লাগলে,সে একবার করে আমাদের দু’জনের হাত তার সামনের দুই পা (হাতের মতো) দিয়ে জড়িয়ে ধরে,আস্তে আস্তে ডাকতে থাকা – এসবই তার এত সহজ সরল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া,যে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পুজো পার্বনে,বাড়ির লক্ষ্মীপূজার সময়,আমার স্ত্রীপূজার আসনে বসার আগে,সে একবার করে হাত-পা গুটিয়ে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। অত্যন্ত আশ্চর্য,আমার বাড়িতে যারা পুজোর সময় এসেছে,সকলেই তা দেখেছে। স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে,সে পাশে সরে বসে, প্রায়শই পুজো শেষ হওয়া পর্যন্ত। এর মধ্যে ব্যালকনির কাচ খোলা পেয়ে,পায়রা ঢুকে এলে অবশ্য অন্য কথা। একমাত্র,পায়রার সঙ্গে তার বনিবনা নেই। তখন সে সমস্ত পৃথিবী এক করে দিতে পারে,সেটাকে ধরার জন্য।
এতদিনের মধ্যে তার বেশ কয়েকবার ভালই শরীর খারাপ হয়েছে,কিন্তু ঘরের মধ্যে বা তার বিছানা কোনোদিন সে নোংরা করেনি। অদ্ভুত কন্ট্রোল। খুব অসুবিধার সময়,হাত ধরে তুলে দেবে,মুখ দিয়ে অদ্ভুত এককুঁই কুঁই করে নিম্নস্বরে আওয়াজ করতে থাকে। এখন আমি ওর সব কথা বুঝতে পারি,ও-ও আমার সব কথা বুঝতে পারে। বন্ডের সাহচর্য,যারা একবার পেয়ে গেছে,তারা ফিরে যাবার পরে,কখনও ফোন করলে,প্রথম জিজ্ঞাস্য বন্ড কেমন আছে, কী করছে? ছবি পাঠাও। আমরা দুজন বুড়োবুড়ি বন্ডের সাহায্যে এক অমৃতময় জীবনের দিনরাতের মধ্যে আছি।
পুরানে উল্লেখ করে,কারো বস্তু এ-জন্মে চুরি করলে,পরের জন্মে সারমেয় জন্ম হয়। আমি নিশ্চিত,আমার মা কারো কোনো জিনিস না বলে নেননি। তবুও,বন্ডের মধ্যে মায়ের সব ক’টি ভঙ্গিমা দেখতে পাই। আমি একা না,আমার স্ত্রীও। মা যখন বেঁচে ছিলেন,কঠিন অসুখে শেষ দিকে ভুগছিলেন। অ্যাটাক হবার পরে,তাঁকে সে অবস্থায়,আমার গিন্নী আর আমি অনেক কষ্ট করে স্বাভাবিক করে এনেছিলাম। মায়ের হ্যালুসিনেশন ও ডিমেনশিয়া কমিয়ে শারীরিক উন্নতির জন্য একটা অসম লড়াই আমরা অনেকটাই জিতে গিয়েছিলাম। তারপরে এক বছর বেঁচে ছিলেন,সেকেন্ড স্ট্রোকের পরে,কোমায় চলে যান,আর ফেরেননি। সে সময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম না। সে দোষ আর পাপ দুটোই আমার। কিন্তু মা কি এইভাবে তাই আমার কাছে স্বল্প আয়ু নিয়ে আবার ফিরে এলেন? বন্ড আমার পোষ্য নয়,আমিই বন্ডের আশ্রিত। শর্তহীন ভালোবাসার দীক্ষা আমি তার কাছ থেকেই কিছুটা হলেও লাভ করতে পেরেছি। আজকে বন্ডের ভালবাসার জোরে,আমাদের এলাকার একত্রিশটা রাস্তার কুকুর আমাদের কর্তা-গিন্নির নজরদারিতে থাকে। তাদের খাওয়া দাওয়া,চিকিৎসা,সমস্ত রকম ইঞ্জেকশন দেওয়ানো সব কিছুর একটা আনন্দময় বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। গুজরাটে গো-মাতার জন্য রুটি আছে,কিন্তু যুধিষ্ঠিরের শেষ সঙ্গীর জন্য এক গেলাস জলও কেউ দিতে উৎসাহী নয়। তবে ইয়ং জেনারেশনে ব্যতিক্রমও চোখে পড়ে। যারা ভালোবাসতে জানে,তারা অকৃপণভাবে তা বিলিয়ে দেয়। আর তা দু’হাত ভরে ফেরতও পায়। যেমন আমি আর আমার গিন্নি পাচ্ছি। আমার মেয়েরা পাচ্ছে।
আমি মাঝেমাঝে ভাবি,সে দৃশ্য কতটা মনোরম আর চমৎকার হবে,যখন আমি চলে যাব, আমার শবদেহের পেছনে পেছনে এই সারমেয়কুল আমাকে আমার শেষ যাত্রায় অগ্নিদেবের পীঠভূমিতে রেখে আসবে। এত ভালবাসা কোথাও পাইনি, যা শেষ জীবনে এই ক’টি বছরে কথা নাবলেও এই অবলা জীবেরা আমাকে দিয়েছে। এরা কেউই কেবলই পুষ্যি নয়,কেবল আমি তাদের পোষ্য। আমার মানব জন্ম কৃতার্থ করেছে এরাই।
বাঃ বড়ো সুন্দর লেখা। হৃদয়ের দ্বার মেলে ধরা উন্মুক্ত উদার, ব্যাপ্ত।
LikeLike
বাঃ মনের দ্বার উন্মুক্ত উদার ব্যাপ্ত ভালোবাসা।
LikeLike