সাদা, খয়েরি আর কালো। তিন রঙা ফুরফুরে লোম, একজোড়া মার্বেলের মত চোখ আর একটা চামরের মত বাহারি ল্যাজ নিয়ে চারপেয়ে একরত্তি প্রাণীটা যেদিন আমাদের বাড়িতে এলো আমরা আনন্দে আত্মহারা হলুম। সেও খুশিতে ডগমগ। যে বন্ধুটি ওকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর কথামতো, ও হল তিব্বতি সারমেয়। ঠান্ডা দেশের নাগরিক। তাই অমন লোমের বাহার, রূপের ঠমক। দু’দিনেই আমাদের চমক কাটল। ও হরি, এ তো আমাদের অতি পরিচিত বঙ্গ ললনা! মাছের গন্ধে পাগল হয়, রসগোল্লা দেখলে রসনা উন্মাদ হয়, ছানা পেলে হাঁ আর বন্ধ হয় না। টক দই থেকে আলু ভাজা- সবেতেই তার গোলাপি জিভটা সক্রিয়। কয়েকদিন পরে তার আরেক গুণপনা ধরা পড়ল। সে কারোর কথা শুনতে পছন্দ করে না। সে কোনোকিছুই ‘শিখতে’ অপারগ! বসতে বললে ছুটতে থাকে, থামতে বললে মাটিতে গড়াগড়ি খায়, হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক বললে কুট্টুস করে কামড়ে দেয়। তারপর আবার হাসে। হ্যাঁ মশাই, ওটাকে হাসিই বলে। আমি ইউটিউবে দেখেছি। এমন বেয়াড়া মানুষ থুড়ি কুকুর দেখেছেন কোথাও? একটা জায়গাতেই অবশ্য সে একটু রহিস। বেটি গরম সহ্য করতে পারে না একটুও। পাখা অথবা এসি তার চাই-ই চাই! দুটোর কোনও একটা চললে তিনি সেখানে সিল মাছের মত হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকেন। সাত পাঁচ ভাবেন। চিন্তা করেন। এরিস্টটল কিম্বা টেসলা হবার চেষ্টা করেন। হাই তোলেন ঘনঘন। তারপর- ঘু-উ-উ-ম। সুদীর্ঘ আলস্য। ওর মধ্যেই একটু শিকার করে নেন, দৌড়ানোর মকশো করে নেন। ডেকে ওঠেন। আমরা ভাবি দেয়ালা। আর তারপরেই গ্যাসওয়ালা এলেই হাঁক পেড়ে দুদ্দাড় দৌড়। কে বলবে, তিনি এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলেন?
এরকমই ও। বদমেজাজি, অসভ্য এবং বেপরোয়া। কিন্তু এভাবেই ওকে ভালোবাসি আমরা। ‘আমরা’ বলতে আমরা সব্বাই। পরিবারের চার জন ছাড়াও সেই সব্বাইয়ের মধ্যে আছেন চায়ের দোকানে রোজ দেখা হওয়া পিসিরা, খবরের কাগজ দিতে আসা কাকুরা, মন্দিরের ঘণ্টা নাড়া পুরোহিত দাদু, ফ্ল্যাটবাড়ির ভিনদেশি মিস্ত্রিরা, পাউরুটি ডেলিভারি দাদা, বাজারে বসা মাছের দিদি- সব্বাই। এছাড়াও আরও অনেকে। ওর বন্ধুরাও আছে। মিহিদানা, পমপম, জ্যাক- এমন কত্ত। ভালোবাসা ছড়িয়ে, লোককে ভয় দেখিয়ে, খেলাধুলো করে দিব্যি আছে ও। অচেনা মানুষদের সঙ্গে দেখা হলে যে শৈত্য আমাদের সবসময় চেপে রাখে ও সেটাকেই নরম হাসিতে রূপান্তরিত করে ফেলে। আলাপ জমে ওঠে। বন্ধুত্ব বাড়ে। এভাবেই সম্পর্কের উষ্ণতা ছড়িয়ে দেড়টা বছর কাটিয়ে দিল প্রাণীটা।
ওর নাম ‘কোকো’। জাতে লাসা, কিন্তু চালচলনে বাঙালি এই ছোট্ট প্রাণীটাকে ভালোবাসে না এমন লোক পাওয়া দুরূহ। যদি কখনও ওর সঙ্গে আলাপ জমাতে চান, চলে আসুন আমাদের বাড়িতে। একটা সন্দেশ ঘুষ দিন ওকে- ব্যাস ও আপনার ‘’ফ্যান’।
আপাতত এটুকুই ওর পরিচয়। সঙ্গে রইল ওর একখানা সাম্প্রতিক ছবি।