পিউ বড়ো একা, বাড়িতে আরও ছয় ছয় জন মানুষ আছেন, কিন্তু তাঁদের কেউ ওর বন্ধু না! ঠাম্মুর সঙ্গে তবু কিছু আবদার চলে, কিন্তু একটু খেলার সাথী কেউ নেই – দাদুও না!
বাবা কাকু বাইরে সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে। মা কাকিমার বাড়ির অনেক কাজ থাকে, ঠাম্মুরও আছে সারাদিন পুজোআর্চার কাজ,আর দাদুর আছে খবরের কাগজ আর টিভির খবর! ভালো লাগে কি ছোট্ট পিউয়ের – সারাদিন এদের সঙ্গে থাকতে একটুও?
এমনই একদিন, হঠাৎ কাকু নিয়ে এল একটা ছোট্ট গোল্ডেন রেট্রিভারের ছানা। পুচকিটার তখন বোধ হয় সবে দুই আড়াই মাস বয়স,পুরো বেলুনের মত গোলগাল চেহারা। এই বাড়িতে আসতেই সে হয়ে গেল পিউয়ের খেলার সঙ্গী।
প্রথম দিন থেকেই পিউয়ের সঙ্গে এক বিছানায় শোয় সে। কতবার তো বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে সে! আর তাকে বাঁচাতে,লুকিয়ে বেডশিট পালটে, সব লুকোবার দুর্বল চেষ্টা করেছে পিউ। মা, ঠাম্মু খুব রাগ করত বিছানা নোংরা হওয়ায়, কিন্তু সে যে তখন পিউয়ের প্রাণের দোসর! তাকে কি আর তার থেকে আলাদা রাখা যায়? স্কুলের সময়টুকু বাদ দিলে,একমুহূর্তও তাকে চোখের আড়াল করত না।
তার খেলনাপত্র কোথায় কী আছে সে নিজেও মনে রাখতে পারত না সবসময়। কিন্তু রানির ঠিক মনে থাকত কোন খেলনা কোথায় রেখেছে পিউ! খেলার সময় সেগুলো নিজেই এনে হাজিরও করত তার কাছে। ওহো,বলা হয়নি – কুকুরটার নাম রেখেছিল সে রানি।
ছোট্ট পিউয়ের একমাত্র বন্ধু সে, তাই নিজের জন্য যে খাবারই আসুক, তাকে না দিয়ে তো পিউ খাবেই না! কিন্তু পোষ্যদের,তাও যদি সে কোন বিদেশি প্রজাতির হয়,তবে তো অবশ্যই কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকে তাদের খাবারের ব্যাপারে। এখন, একথা তাকে বোঝায় কে? রানিকে তো অনেক কিছুই খেতেই দেয় না কাকিমনি! খুব রাগ হত তার তখন!
পরের বছর রানির যখন পাঁচ ছয়টা ছানা হল,খুব আনন্দ হয়েছিল পিউয়ের। দুটো কারণে,এক তো রানির মতই সুন্দর গোলগাল দেখতে সেই পুঁচকেগুলো বড্ড আদরের ছিল;আর দুই হল – কাকিমনি একটু অতিরিক্ত প্রোটিনসমৃদ্ধ অনেক খাবার দিতেন তখন রানিকে! এখন সেই রাগ করার কথা মনে পড়লে নিজেই লজ্জিত হয় পিউ।
যাই হোক, সে আনন্দও তার বেশিদিন স্থায়ী হল না। মাস দুয়েক পরেই,এক এক করে রানির সব কটা বাচ্চাকেই বিক্রি করে দিল কাকু! তখন রানির দু’চোখ যেমন ছলছল করত,তেমনটাই করত পিউয়েরও! মায়ের কাছ থেকে তার সন্তানদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যথা – সে কিন্তু তখনই বুঝতে পেরেছিল, ঐ রানির দৌলতেই!
বাবা মা মাঝে মাঝেই বকাঝকা করতেন তাকে, দুষ্টুমি করলে। ঠাম্মুকেও সে সব সময় পেত না তার পাশে, যে তিনি এসে প্রশ্রয় দিয়ে নাতনিকে বকা খাওয়ার থেকে বাঁচাবেন! অগত্যা একরাশ অভিমান নিয়ে, পিউ গিয়ে বসত দোতলার সরু একফালি বারান্দার কোণটায়, একা একা চুপচাপ। কিন্তু বেশিক্ষণ না, রানি এসে ঠিক তার পাশে হাজির হয়ে যেত! যতবার তার মন খারাপ হয়েছে, সে একা হয়ে পড়েছে মানসিক বা শারীরিক ভাবে – রানি অনাহুত হয়েই, ঠিক তখনই এসে,তাকে সঙ্গ দিয়েছে!
মনখারাপের সময়, যখন প্রবল অভিমানে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করত পিউয়ের, রানি তার বুকে মুখ গুঁজে দিত এমনভাবে, যেন বলতে চাইত, এই তো আমি এসে গিয়েছি, তোমার প্রাণের দোসর! আর পিউও তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে নিজের সব কষ্ট ভুলে যেত, সব ব্যথা থেকে মুক্তি পেত যেন। জানে,রানি মানুষের ভাষা বুঝবে না, তবু তাকেই মন খুলে বলত সে তার সব খারাপ লাগার,কষ্টের কথা!
এখন পিউয়ের মনে হয়, সারা জীবন সে যত চোখের জল ঝরিয়েছে কারণে অকারণে,তার সিংহভাগটাই ঝরেছে তার ওই রানিকে জড়িয়ে ধরেই! সে আজও বিশ্বাস করে, রানিই তার জীবনের সেরা দোসর। তার সুখের জন্য রানির অবদান অনস্বীকার্য।
এই তো সেদিন পিউয়ের বিয়ের ঠিক আগের সপ্তাহের কথা। ঠাম্মু দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর, হঠাৎ ভয়ানকভাবে মরণাপন্ন হয়ে উঠলেন! ডাক্তারবাবুও মাথা নেড়ে উঠে গেলেন। ওদের এক জ্যোতিষকাকু এসেছিলেন, বিয়ের জন্য উপযুক্ত লগ্ন নিয়ে কথা বলতে। তিনি তো বলে বসলেন – বাড়িতে খুব দ্রুত প্রাণ হারাবেন কেউ!
ঠাম্মুর শারীরিক অবস্থার কথা তাঁর জানা ছিল না,থাকলে হয়তো ওকথা বলতেন না তিনি। যাই হোক,বাড়িতে তো কান্নার রোল পড়ে গেল। বিয়ের আগের দিন সকালে, যখন সবাই ধরে নিয়েছে এবার বোধ হয় সব শেষ,ঠাম্মুকে বোধ হয়… তখন ছাদের চিলেকোঠায় প্রবল চিৎকার করে ডেকে চলেছে রানি!
তারপর? সেদিনই সিঁড়ির ঘরের রেলিং থেকে ঝুলন্ত, রানির স্তব্ধ শরীরটাকে কোলে তুলে নিয়ে কাকু গেল ডাক্তারের কাছে – অবশ্য তখন আর প্রাণ নেই। ঠাম্মু সেদিন বিকেল থেকেই,অস্বাভিকভাবে সুস্থ আচরণ করতে থাকলেন!
পিউয়ের বিয়ে ভালোভাবে মিটল। নবদম্পতির দ্বিরাগমন,তাদের মধুচন্দ্রিমার ভ্রমণ সেরে ফিরে আসারও মাসখানেক পর,দেহ রাখলেন ঠাম্মু! সেই জ্যোতিষকাকু তাঁর শ্রাদ্ধের দিন এসে কথায় কথায় বললেন, “রানি তোমাদের সংসারের সত্যি একজন দায়িত্ববতীর কাজ করে গেছে,জানো? পিউয়ের ঠাম্মুর জন্যই হয়তো সেদিন এসেছিল সেই কাল,যার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে,তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। পিউয়ের নবজীবনে প্রবেশের পথকে নিষ্কন্টক,সুখের করে দিয়ে গেছে সে!”
শুধু পিউ ভাবে, সত্যিই কি রানির ঐ আত্মত্যাগ,তাকে সুখের জীবন দিতে পারবে? কে জানে!
(পিউ আমার স্ত্রী,পূর্বপরিচয়ের কারণে ওদের বাড়িতে আমার যাওয়া আসা থাকায়,ঘটনাটির সাক্ষী আমি নিজেও! রানির আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। ভালো থেকো রানি।)