সে ছিল একদিন আমাদের, যখন হায়দ্রাবাদে প্রতি শনি-রোববারে আমরা একঝাঁক প্রবাসী বন্ধুরা মিলে জমিয়ে আড্ডা মারতাম। তার মধ্যে আমার এক বন্ধু হল সুলগ্না।
একবার প্রায় দুই সপ্তাহান্তে সুলগ্নার অনুপস্থিতি দেখে, খোঁজ নিলাম। বলল, “আরে আমার বাড়িতে নতুন সদস্য এসেছে, দেড় বছর বয়সী এক জার্মান শেফার্ড। তাকে নিয়ে ভারি ব্যস্ত।”
“তাই নাকি? আলাপ করতে যেতে হবে তো।”
শুনলাম তার নামকরণ হয়েছে বুনা। না, মোটেই আমার সে নাম পছন্দ হয়নি। ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করে একখানা যুতসই নাম দেব, এমনটাই ভেবেছিলাম।
দেখা করার ইচ্ছেটা আরও বেশি ছিল, কারণ, ওই ফুটফুটে মিষ্টি বুনাটাকে কারা নাকি রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেছিল। কেমন অন্যায় বলো! অবোলা জীব, কেমন ভালবাসা আর আদরে মাখামাখি করে রাখে সকলকে, তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে মানুষ?
যাক,বুনার ভাগ্য ভাল,সে সুলগ্নাকে পেয়েছিল। আমার সাথে তার প্রথম দেখাতেই একটু তর্জন গর্জন,খানিক দৌড়োদৌড়ি,তারপর একটু দুরত্ব রেখে কাছে আসব কি আসব না,এমন একটা দুষ্টু-মিষ্টি খেলা চলতে লাগল। আমি একটু আয়েশ করে চেয়ারে বসে,আমার একমাথা কোঁকড়া লম্বা চুলটা পিছনে ছেড়ে দিলাম। আমার চুলে আবার পাখি টাখি চাইলে বাসা বাঁধতেই পারে। এমন ঘন জঙ্গলের মত তার ধরণ।
তা বুনা দিদিমণি সেই আজব কেশরাশি দেখে বড়োই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। এ আবার কী রে বাবা! খেলব না খাব? কিছুই ঠিক করতে না পেরে চাড্ডি লাফালাফি করে তিনি চুলে এক কামড় দিয়ে ঝুলে পড়লেন।
আমি একটু আরামে চোখ বুজেছিলাম,চুলে টান পড়তেই ধড়ফড় করে উঠলাম। কে রে? ওকি বুনা আমার চুল কামড়ে ধরেছে। বুনাও এদিকে কোন স্বাদ না পেয়ে ছেড়ে দিয়ে বেজার মুখে আমায় দেখতে লাগল। আমি বললাম তুমি তো বুনা নও। তুমি দেখি সাক্ষাৎ ক্ষেমঙ্করী পিসিমা।
তোমরা যারা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্যালারামের গল্প পড়েছ,তারা জানবে প্যালার এক বন্ধু পাঁচুগোপালের পিসিমা ছিল ক্ষেমঙ্করী। আহা পিসিমা যেমন ভালবেসে খাওয়াতেন পাঁচুর বন্ধুদের,তেমন পাঁচুর নামে কু-কথা কইলে,তাদের পিঠে মুড়ো ঝ্যাঁটার বাড়ি দিতেন দু-ঘা। বল্টুদা একবার পাঁচুর পিছনে লাগতে গিয়ে,ক্ষেমঙ্করী পিসিমার হাতে খুব মার খেয়েছিল। তেমন বুনার ওরকম আমার চুল কামড়ে ঝুলে পড়া দেখে,আমিও ভাবলাম আহা এলেন বুঝি পিসিমা। অতঃপর বুনার নামকরণ হল ক্ষেমঙ্করী। নামটা চলল না বটে। তবে বুনা আর আমার ভাবটা হল বেশ। আর আদর করে আমি আজও ডাকি,ওরে আমার ক্ষেমঙ্করী,আমার ক্ষেমু সোনা।
বুনা এখন ১০টি বাচ্চার গর্বিত মা। পিসিমার মতই স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছে বাচ্চাদের। সেই যেমন পিসিমা পাঁচুর গায়ে আঁচড়টি লাগতে দিতেন না,ঠিক তেমনিভাবে।