বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক দেখে আসছি আমাদের বাড়ির পাশেই একটা মজা পুকুর আছে। পাড়াসুদ্দু লোক তাদের বাড়ির নিত্যদিনের আবর্জনা ডাঁই করছে সেখানে। তা সেই হাজা মজা পুকুর ও যে তলে তলে হাত বদল হয়ে গেছে তা জানতে পারলুম মাসছয়েক আগে। সেদিন সকাল সকাল পূবদিকের জানলা খুলে দেখি ইট সিমেন্ট আর গুটিকতক লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। দেখতে দেখতে দিনপনেরোর মধ্যেই উর্ধ্বশ্বাসে দোতলার খাঁচা হয়ে তিনতলার ওখান কতক পিলার উঠে পড়ল আকাশ পানে। মনের দুঃখে ভাবছি পূবদিকের আলো বুঝি গেল। তার দিনপাঁচেক বাদে হঠাৎ দেখি সেই কর্মযজ্ঞ বন্ধ হয়ে সব শুনশান। স্তূপাকৃতি ইট বালি পড়ে রইল। একদিন দেখলাম লোহার গেটেও তালা ঝুলেছে। খবর করে জানলাম পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা, পুকুর বুজিয়ে বাড়ি হচ্ছে এই মর্মে যথাস্থানে আপত্তি জানিয়েছে। ফল স্বরূপ কাজকর্ম বন্ধ। এদ্দিনে পাড়ার ওই হুল্লোড়বাজ ক্লাবটির প্রতি আমার মনোভাব কিঞ্চিৎ শোধরালো।
যাই হোক মাস চারেক আগে সেই আধাখ্যাঁচড়া বাড়ির দোতলায় এল এক গর্ভবতী সারমেয়। গাঢ় বাদামি তার গায়ের রং আর কান দুটি কলাফুলের পাপড়ির মত সুন্দর। সেখানেই শুভদিনে জন্ম দিল চারটি কুঁতকুঁতে ছানার। তাদের কারো গায়ের রং মায়ের মতো বাদামি তো কারো রবাপের মতো কালো। নাহ্ ওদের বাপকে দেখিনি কখনো। মা-টি বেশ দাপুটে সিঙ্গেল মাদার। তিন মাস সেখানে থেকে ছেলেপুলেগুলোকে একটু বড়ো করে নিয়ে একদিন সে বাসা ছেড়ে চলে গেল। একটি ছানা কেবল তার সঙ্গে গেল না। সেটি কিঞ্চিৎ দুর্বল ও ভীতু। বন্ধ গেটের বাইরে যেতে হলে পাঁচিলের ওপর থেকে যে প্রকার সটান লম্ফ দিতে হত তার কল্পনাতেও বুঝি তার হৃৎকম্প হয়। মা যে চেষ্টা করেনি তা নয় শেষে ব্যর্থ এবং বিরক্ত হয়ে বাকি ছানাদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে। সেই থেকে সে একাই থাকে। আর সেই মা-পরিত্যক্ত-শিশুটির খাদ্য যোগানোর দায়িত্ব পড়েছে আশেপাশের বাড়ির জানালাগুলির। তাদের মধ্যে আমিও একজন। চারপ্রহরে রুটিটা বিস্কুটটা আমিও ছুঁড়ে দিই দোতলার ছাদে। সামনে দেখতে না পেলে আদর করে ডাক দিই,ভুলকি-ই-ই। ব্যস কোথা থেকে ঊর্ধ্বমুখে ঊর্ধ্বনেত্রে সে হাজির হয়ে পড়ে। যাই হোক ভুলকি কারো একার নয়। তবু এমনি তার জাদু যে আশেপাশে সকলেরই মনে হয় ভুলকি বুঝি একমাত্র তারই ডাকের অপেক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে আছে।
কেবল মাত্র চোখে চোখে সকলের সঙ্গে সে এক বিনিসুতোর আত্মীয়তা গড়েছে। আমাদের বেশ কয়েকটা বাড়ির যৌথ পোষ্য সে। ইদানিং ভুলকিটার জন্যে বড্ড মায়া হয়। সারাদিন সকলের দেওয়া খাবার তো নেহাত মন্দ খায় না তবু গায়ে গত্তি লাগে না মোটে। বরং দিনে দিনে হাড় পাঁজরা সার হচ্ছে। আর হবে নাই বা কেন,অত বড়ো বাড়িতে জনমনিষ্যি নেই। ভয়ে ভয়েই শুকিয়ে যাচ্ছে বোধহয়। কাঁহাতক আর একা একা থাকা যায় বলো?
রাতের বেলা আমার পুবের ঘরের জানলা থেকে আলো এসে পড়ে ভুলকির ছাদে। ওই আলোটুকুর দিকে মুখ করে সে বসে থাকে। ভারী খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে জানলায় উঁকি দিয়ে দেখে যাই। সে আছে শুয়ে বসে অথবা ঘুমিয়ে।
কিছুদিন হল একটা বিল্লি সেখানে আস্তানা গেড়েছে। দুটিতে ভাবও হয়েছে কিঞ্চিৎ। দেখে শুনে আমার বড়ো স্বস্তি হয়েছে। যাক এতদিনে ভুলকিটা একটা সঙ্গী তো পেল!