বন্ধুকুকুর রিনচেনপং এর বন্ধুরা রূপসা ব্যানার্জি

কোথাও বেড়িয়ে বাড়ি ফেরার সময় টের পাই অনেকরকম অভিজ্ঞতায় আমাদের ঝুলি প্রায় ভরে উঠেছে। তারপর,কিছু কথাভুলে যাই আর কিছু কথা মনে থেকে যায়।

গতবছর মে মাসে আমরা সিকিম ঘুরতে গেছিলাম। বিভিন্ন জায়গার মধ্যে সবচেয়ে পছন্দ হয়েছিল ছোট্ট সুন্দর গ্রাম রিনচেনপং ;আর রিনচেনপং বলতেই মনে পড়ে সেই তিনজনের কথা। তাদের সঙ্গে পরিচয়ের মুহুর্তগুলোও স্পষ্ট মনে আছে।

সন্ধেবেলা পাহাড়ের কোলে আমাদের হোমস্টে -র লাউঞ্জে বসে আমরা সবাই মিলে পকোড়া আর কফি সহযোগে আড্ডা মারছি। আমাদের তিন পরিবারের তিনজন বাচ্চা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে খেলছে।একসময় লক্ষ করলাম ওরা খেলা ছেড়ে সদর দরজার সামনে গিয়ে ভিড় করেছে। বিস্কুট ছুঁড়ে ছুঁড়ে কাউকে দিচ্ছে মহা উৎসাহে। আমি কাছে গিয়ে দেখি ধবধবে সাদা ছোটোখাটো চেহারার খুব সুন্দর একটা কুকুর এসে রীতিমতো গুছিয়ে বসেছে বাইরের বারান্দায়। ছোটোরা এখন তার আপ্যায়নেই ব্যস্ত। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে বাচ্চারা এবার সাহস করে নেমে এল বারান্দায়।

কুকুরটার কাছে গিয়ে মুখের কাছে বিস্কুট ধরতেই অবাক কাণ্ড!  কুকুরটা দিব্যি পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ে আমার হাত থেকে বিস্কুট খেয়ে নিল। ব্যাস! বাচ্চারা একেবারে মহাখুশি! গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করাও শুরু হল এবার। ঠিক তখনি আমাদের সেই নতুন বন্ধুর পিছন থেকে আর একজনের উদয় হল। এতক্ষণ অন্ধকারে তাকে দেখতে পাইনি,এখন একেবারে কাছে এসে গেছে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই… ভয়ের চোটে কয়েক সেকেন্ড বোধ হয় দম আটকে গেছিল। কে এটা? হিমালয়ান উলফ নাকি? একটা দেশি কুকুরের এত বড়ো চেহারা!

আঁৎকে উঠে বাচ্চাদের নিয়ে আমি সোজা ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। আমাদের দলের বাকি সদস্যরা এবার এগিয়ে এল কী হয়েছে দেখতে। সবাই মিলে জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। নাঃ! নেকড়ে নয়,বেশ বড়ো সড়ো কুকুর। সাদায় কালোয় মেশানো স্বাস্থ্যবান কুকুর। কাউন্টার থেকে হোমস্টে-র মালিক হেসে বললেন, “ভয় নেই,এরা অনেকদিন ধরেই এখানে ঘোরাফেরা করে,টুরিস্টদের সঙ্গে ভাবও করে। তাঁরা টুকটাক খেতে দেন,আমরাও যা পারি দিই।”

আমাদের দলের প্রিয়দা একটু বেশিই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। তিনি ঠিক করে ফেললেন এই বিশাল চেহারার কুকুরটার সঙ্গেও বাচ্চাদের বন্ধুত্ব করিয়ে দিতে হবে। তাই কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে তাঁর ছেলে রিমোর হাত ধরে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। বাকি দুই খুদে সদস্য –মুন্নু আর টিটোও চলল তাদের প্রিয়কাকুর পিছন পিছন।

আরে,এই নেকড়ের মতো কুকুরটা যে আরো বেশি আদুরে! আদরে গলে গিয়ে কুঁই কুঁই করে তার লোমে ভরা মাথা ঘষতে লাগল বাচ্চাদের পায়ের কাছে। এবার আমিও বেরিয়ে এলাম। দু-একবার পিঠে হাত বোলাতেইএকদম কোলের কাছে ঘেঁষে এল উলফু। হ্যাঁ, উলফু নামটা আমিই দিয়েছিলাম। একদম হিমালয়ান উলফের মতো দেখতে কিনা!

আর সেই দুই পায়ে দাঁড়িয়ে পড়া ছোটো কুকুরটার নাম কী রাখা হবে? আমার মেয়ে মুন্নু বলল,“ও খুব সুইট, তাই ওর নাম হোক সুইটু।”

রাত আটটা নাগাদ আমাদের হোমস্টে থেকে কিছু দূরে,পাহাড়ের আর একটু নীচের ঢালে এক জায়গায় আমাদের জন্য বনফায়ারের আয়োজন করা হয়েছিল। আমরা আগুনের ধারে বসে আড্ডা মারব, তারপর ওখানকার রেস্টুরেন্টে ডিনার করে ফিরব এরকম প্ল্যান করা হয়েছিল। আমরা সবাই লাইন করে পাহাড়ি পথে আস্তে আস্তে নীচের দিকে নামতে লাগলাম। দুপাশে জঙ্গল আর কী অন্ধকার! মোবাইল টর্চ না জ্বাললে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার মধ্যেই পায়ের কাছে নরম নরম কীসের ছোঁয়া পেলে চমকে উঠেছি।

আরে,উলফু আর সুইটুও লেজ নাড়তে নাড়তে চলেছে আমাদের সঙ্গে। মুন্নু বলল, “এরকম তাগড়া চেহারার বডিগার্ড সঙ্গে থাকলে আবার কীসের ভয়?”

তারপরের দু’ঘণ্টা উলফু আর সুইটুকে নিয়ে হৈহৈ করে কেটে গেল। মস্তবড়ো লনে ওদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠল বাচ্চারা। মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে বাচ্চারা যখন আমাদের কাছে এসে বসছিল, তখন সেই দুই মূর্তিমানও আমাদের পায়ের কাছে শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছিল।

প্রিয়দা উলফুর গলা চুলকে আদর করতে লাগলেন। উলফুর সে কী আরাম! চোখ বন্ধ করে গলা টান করে বসে রইল। সুইটু আবার উলফুর তুলনায় একটু লাজুক;না ডাকলে কাছে আসতে চায় না। ছবি তুলতেও তার ভারি লজ্জা। তবে সে কিন্তু তার মতোই লাজুক একজনের সঙ্গে সই পাতিয়ে নিয়েছে আর তার পায়ে পায়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুন্নু আর সুইটু দুটি সই কেউ কাউকে কাছ ছাড়া করছে না।

রাত দশটা নাগাদ আমাদের পায়ের কাছে বসে দু’জনের ডিনার ভালোই জমে গেল। ছোটো বড়ো সবাই নিজেদের পাত থেকে ভাত,মাংসের হাড় ওদের জন্য আলাদা করে রাখছিলাম। দুজনেই বেজায় ভদ্র! চুপটি করে বসে রইল সারাক্ষণ। কুঁইকুঁই কুঁইকুঁই অর্থাৎ ‘আরো দাও, আরো দাও’ করে কোনোরকম গোলমাল করা নেই। এমন ভদ্রসভ্য জীবদের পেট ভরে না খাওয়ালে চলে? আমরা তো দিলামই,ওই রেস্টুরেন্টের লোকেরাও খানিকটা ভাত দিলেন ওদের। দুই মূর্তি এঁদেরও বেশ পরিচিত দেখতে পেলাম।

খেয়েদেয়ে আমাদের সঙ্গেই ফিরে এল দুই বডিগার্ড। অন্ধকার রাস্তায় আমাদের পায়ে গা ঘসে আর উউউ শব্দ করে বুঝিয়ে দিল, “আমরা রয়েছি। নিশ্চিন্তে চলো।”

পরদিন সকালে রিনচেনপং ছেড়ে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা। সকাল সকাল উঠে রুমের দরজা খুলেই দেখি আর এক নতুন বন্ধু হাজির। উলফুর মতোই তাগড়া চেহারা,তবে গায়ের রঙ কালো আর বাদামি মেশানো। ইনি আবার গলা দিয়ে আওয়াজ করার চেয়ে চোখ ঘুরিয়ে ইশারা করে কথা বলতে বেশি ভালোবাসেন। আমাকে দেখে চোখের ইশারায় যেন বলে উঠলেন, “কই,আমায় বিস্কুট দেবে না?”

বিস্কুট দেওয়ার লোকের কি অভাব? ততক্ষণে মুন্নু,রিমো,টিটো সবার ঘুম ভেঙে গেছে। নতুন বন্ধুকে দেখে মহা উৎসাহিত হয়ে আদর এবং বিস্কুট দান দুটোই চলল বেশ কিছুক্ষণ। টিটো জিজ্ঞেস করল, “এর নাম কী হবে আন্টি?”

আমি একটু ভেবে বললাম, “নতুনদা।” নতুন এসেই দাদাগিরি শুরু করে দিয়েছে। রিসেপশন পেরিয়ে,গার্ডেন পেরিয়ে সোজা রুমের দরজায় উপস্থিত হয়ে গেছে। এমনভাবে সবার সঙ্গে মিশছে,যেন কতকালের চেনা! এরকম স্মার্ট কুকুর আগে দেখিনি।

বিস্কুট খেয়ে নতুনদা বারান্দায় শুয়ে রোদ পোহাতে লাগলেন। আমাদের বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। একে একে মালপত্র নীচে নামিয়ে দিলেন হোমস্টে-র দুজন কর্মী। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি উলফু চুপ করে শুয়ে আছে। ও বোধ হয় বুঝতে পেরেছে আমরা চলে যাচ্ছি। কেমন একটা মন খারাপ,মন খারাপ ভাব দেখলাম ওর মধ্যে। সুইটুকে ধারে কাছে কোথাও দেখলাম না।

বাচ্চারা বারবার বলতে লাগল উলফুকে আমাদের সঙ্গে নিলে বেশ হয়। ওকে গাড়ির পিছনের ডিকিতে নিয়ে নেব। প্রথমে আমরা ওদের কথা শুনে হেসেছিলাম,কিন্তু পরে দেখলাম ওরা খুব সিরিয়াসলি উলফুকে নেওয়ার কথা ভাবছে। তখন ওদের ডেকে বললাম, “উলফু সিকিমের ঠান্ডা আবহাওয়ায় বড়ো হয়েছে। গরম কাকে বলে ও জানে না। আমরা কলকাতার লোক হয়েও ওই পচা গরম সহ্য করতে না পেরে পাহাড়ে পালিয়ে এসেছি কয়েকদিনের জন্য। তোরা ভেবে দেখ,কলকাতায় গেলে ও বাঁচবে? মরেই তো যাবে বেচারা। তার চেয়ে ও এখানেই ভালো থাকবে। অনেকেই ওদের ভালোবাসেন,খেতে দেন। দেখছিস না? এরা সবাই কেমন মোটাসোটা?”

সত্যিকারের ভালোবাসা নিঃস্বার্থ হয়। দরকার হলে দূরে সরিয়ে দিতেও জানে। সেদিন দেখলাম একবন্ধুর ভালোর জন্য বাকি তিন বন্ধু এককথায় রাজি হয়ে গেল তাকে না নিয়েই চলে যেতে। গাড়িতে যেতে যেতে সারাক্ষণ উলফু ,সুইটু আর নতুনদার গল্প চলল তিন খুদের মধ্যে। মুন্নু এখনও আমায় জিজ্ঞেস করে, “আবার কোনোদিন রিনচেনপং গেলে ওখানেই উঠব তো মা? উলফুদের সঙ্গে দেখা হবে তো? ওরা আমাদের মনে রাখবে? ভুলে যাবে না?”

এখনো রাস্তায় চলতে চলতে ওই তিনজনের সঙ্গে কোনো কুকুরের গায়ের রঙের মিল দেখলেই মুন্নু বলে,“ও মা,একে তো নতুনদার মতো দেখতে!” কিংবা “এই কুকুরটা তো সুইটুর মতো! ”

আমিও কি ভুলতে পেরেছি? মাত্র একটা দিনের স্মৃতি। তবুও সেই তিনজন হৃদয়ের একটা বড়ো জায়গা দখল করে রয়েছে, আর থাকবেও।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s