এক যে ছিল বিড়াল
পুষ্পেন মণ্ডল
ছোটোবেলায় আমার একটা পোষা বিড়াল ছিল। আজও তার কথা মনে পড়ে। জয়ঢাকের আহ্বানে এখানে তার কথাই বলব। তবে আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা করে নিই। তখন আমার বয়েস সাত বা আট। প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। খাঁচা-ভ্যানে করে স্কুলে যেতাম বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। থাকতাম জয়চণ্ডীপুর নামে এক গ্রামে। মানে এখনকার তুলনায় সেই সময় বেশ গ্রাম-গ্রাম ছিল আমাদের পাড়াটা। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সেই সব ছবি। আমাদের পুরোনো বাড়ি। লাল ইটের তৈরি একতলা পাকা ঘরের সামনে তখনও ছিল পুরোনো চার ফুট মোটা মাটির দেয়াল ওয়ালা টিনের চালের মস্ত একটা ঘর। আমার অনেকটা দুর্গের মত মনে হত সেই ঘরটিকে। বাবার বুড়ি পিসিমা আজীবন ছিলেন সেই ঘরে। ঘরটির একটি মাঠগুদাম ছিল। এখনকার ভাষায় যাকে বলে ফলস সিলিং। বাঁশ আর মাটি দিয়ে তৈরি সেই মাঠগুদামে ওঠার জন্য একটা কাঠের ঢাকনা ছিল। ছাদে আটকানো। দেয়ালে গাঁথা ছিল লোহার সিঁড়ি। সেটা ছিল আমার কাছে খুব রহস্যময় এক রাস্তা। কেন জানি না,শুধু মনে হত,ঐ মাঠগুদামের উপর কত কিছু অজানা জিনিস রাখা আছে। সত্যি সত্যিই একদিন আমার ছোটোকাকু সেখান থেকে একটা জং ধরা লোহার মাঝারি মাপের তলোয়ার পেড়ে আনল। পরে সেটা আমার রাজা সাজার খেলায় উপযুক্ত হাতিয়ার হয়েছিল। যাই হোক,সেই ঘরের পিছনে ছিল আমাদের একটা পুকুর। পুকুরে মাছ ছিল ভর্তি। অনেককে ছিপ দিয়ে ধরতে দেখেছি। আর বছরে দু-তিন বার জাল ফেলা হত। সে ছিল এক দেখার মত বিষয়। পুকুরের জল মাঝে মাঝে সবুজ পানায় ভরে যেত। আর বর্ষার সময়ে সেটা উপচে গিয়ে বড়ো মাটির ঘরের দাওয়া পর্যন্ত উঠে আসত। তখন ঘরে বসে দিব্যি মাছ ধরা যেত। তবে গরমকালে স্নান করার কোনো অসুবিধা হত না। পুকুর পাড়ে ছিল একটা পুরোনো কাঁঠাল গাছ। আর তার গোড়ায় হাসনুহানার আর এলোভেরার ঝোপ। হাসনুহানার গন্ধে জ্যৈষ্ঠ বৈশাখ মাসে মিষ্টি গন্ধে ম-ম করত সন্ধেবেলা। তার পাশে ছিল একটা টিউলিপ আর বেলফুলের গাছ। বাকি গোটা পুকুর পাড় ঘিরে থাকত কচু গাছের জঙ্গল। আমি ছোটোবেলায় যখন একা একা রাজা সাজতাম, তখন সেই জং ধরা তলোয়ারটা হাতে নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতাম কচু গাছগুলোর বিরুদ্ধে। হাজারে হাজারে কচুগাছ কাটা পড়ত সেদিন আমার হাতে। তারপরে খুব হাত-পা চুলকাত কচু গাছের রস লেগে।
এবার গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে যে কথা বলতে এসেছিলাম,সেটা বলি। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিল আমার পিসিমার বাড়ি। সেই জায়গাটা বেশ শহরাঞ্চলই বলা চলে। পিসিদের মস্ত বড়ো তিনতলা পাকা বাড়ি ছিল। নীচের দুটো তলায় ভাড়াটিয়ারা থাকত। আর তিনতলায় থাকত পিসিরা। মানে পিসেমশাই,পিসি,দিদি আর দাদা। দিদি আমার থেকে ছিল চার বছরের বড়ো,আর দাদা দু -বছরের। তবে ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল একেবারে বন্ধুর মত। পিসেমশায়ের ছিল বিস্তর পশুপ্রেম। রাস্তার কুকুর, ঘিয়ে ভাজা বিড়াল ধরে এনে খেতে দিত। দাদা,দিদিও পেয়েছিল সেই ধাত। কোথাও কোন অসহায় কুকুর বা বিড়াল পড়ে থাকতে দেখলে, বা খেতে না পাওয়া রুগ্ন পশুকে কিঁউ কিঁউ করে কাঁদতে দেখলে ওরা কোলে করে বাড়ি নিয়ে আসত। তারপর সাবান জলে চুবিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে গরম দুধ বিস্কুট,ভাত,ডাল,মাছের কাঁটা,মাংসের হাড় খাইয়ে ক’দিনের মধ্যে তাদের গোলগাল করে তুলত। তারপর তাদের আর চেনাই যেত না।
আমি ছোটোবেলায় যখন যেতাম পিসির বাড়ি,দেখেছি চার পাঁচটা ষণ্ডামার্কা কুকুর,আর গোটা কুড়ি বিড়াল তাদের বাড়িতে সব সময়ে ঘুরে বেড়াত। পিসি আর দিদির সর্বদা চিন্তা ছিল তাদের কী খেতে দেবে? পিসেকে দেখতাম চুরুট মুখে দিয়ে খালি গায়ে সোফায় লুঙ্গি পরে খবরের কাগজ পড়ছেন, তাঁর পায়ের কাছে কালু কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে, ডান দিকে রয়েছে ভেলো,কোলে শুয়ে আদর খাচ্ছে মেনি বেড়াল,পিসের বগলের নীচ দিয়ে উঁকি মারছে মেনির সদ্যজাত দুটি বাচ্চা। সামনে টি-টেবিলের উপরে আরও দুটো বিড়াল মারামারি করছে। খাটে,পড়ার টেবিলে,সোফায়,চেয়ারের নীচে কোথাও বাদ নেই। তাদের অবাধ গতিবিধি। যখন ইচ্ছা তারা বাইরে যাচ্ছে,বাগান,পিছনের মাঠ,পাড়া থেকে ঘুরে আসছে। আবার খাবারের সময় এসে ঠিক হাজিরা দিচ্ছে। সে ছিল এক মজার দুনিয়া।
আমি যে প্রাইমারি স্কুলে যেতাম খাঁচা ভ্যানে করে, সেই স্কুলটা পিসির বাড়ি পেরিয়ে যেতে হত। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময়ে নেমে গেলাম পিসির বাড়ি। মাকে বলেই রেখেছিলাম। সেদিন গিয়ে দেখি একটা বিড়ালের চার পাঁচটা বাচ্চা হয়েছে। সপ্তাদুয়েক বয়েস তাদের। সবকটাই দুধের মত সাদা আর বেশ গোলগাল। একটা বাচ্চাকে আমার খুব পছন্দ হল। নরম তুলতুলে টেডির মত। দেখেই কোলে তুলে নিয়ে দিদিকে বললাম, “এটাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাব দিদি? পুষব!”
দিদি বলল,“আচ্ছা,নিয়ে যা তবে।”
শুনে আমার মনটা পেখম খোলা ময়ূরের মত আনন্দে নাচতে শুরু করে দিল। সেদিন দুপুরে পিসির বাড়ি খাওয়া সেরে,বিকেলবেলা পিসের স্কুটারে করে বাড়ি পৌঁছলাম। সঙ্গে এল সেই বিড়াল। আমার একটা খেলার সঙ্গী হল। তার নাম রাখলাম ‘পুষি’।
ভোরবেলা উঠে স্কুলে যাওয়ার সময়ে মা প্রতিদিন এক গ্লাস করে দুধ আর বিস্কুট খাওয়াত আমাকে। আমি তার থেকে একটুখানি করে দুধ আর একটা করে বিস্কুট পুষিকে খেতে দিতাম। সে তা খেয়ে পাতলা গোলাপি জিভ দিয়ে চেটে চেটে প্লেটটা পরিষ্কার করে দিত। স্কুল থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা ছুড়ে দিয়ে জোরে ডাক দিতাম, “পুষিইইই…”। সে যেখানেই থাক,ডাক শুনে দৌড়ে চলে আসত আমার কাছে। কোলে তুলে নিয়ে আমি আদর করতাম তাকে। স্নান সেরে মা যখন ভাত খেতে দিত,মেঝেতে আমার পাশেই সে বসে থাকত চুপটি করে। তাকে মাছের কাঁটা মাখিয়ে ভাত দিলে সে তৃপ্তি করে খেয়ে নিত। তারপর দুপুরবেলা এক সঙ্গেই বিছানায় ঘুমোতাম আমরা। বিকালে যখন মাঠে খেলতে যেতাম আমি,সেও আমার পিছন পিছন গিয়ে বসে থাকত চুপটি করে। সন্ধ্যায় যখন দিদিমণি আমাকে পড়াতে আসত,পুষি দরজার বাইরে অপেক্ষা করত আমার জন্য।
একবার হল কি,ঠাকুমার ঘরে যে বড়ো কাঠের আলমারিটা ছিল,সেটার ঢাকনা খুলে ঠাকুমা কিছু জিনিসপত্র বের করছিল,আর পুষি চুপিসাড়ে ঢুকে পড়েছে আলমারিটার ভিতর। ঠাকুমা খেয়াল না করে ঢাকনা বন্ধ করে চাবি দিয়ে দিয়েছে। আমি স্কুল থেকে ফিরে পুষিকে ডাকছি,কিন্তু সে আর আসছে না আমার কাছে। সাড়াও দিচ্ছে না। আমি পাগলের মতো তাকে খুঁজছি চারিদিকে। বাড়ির পিছনে,পুকুর পাড়ে,দাসেদের বাড়ি,হাজরাবাড়ি,বোসেদের বাড়ি,চারপাশের যত আগান বাগান সব। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না তাকে। কান্না পাচ্ছিল খুব। কোথায় চলে গেল আমার প্রিয় পুষি! প্রায় দেড় দিন পর মাঝ রাতে একটা মিয়াঁও মিয়াঁও আওয়াজ শুনে ঠাকুমা আলমারির ঢাকনা খুলে বের করলেন তাকে। তক্ষুনি দুধ গরম করে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ান হল পুষিকে। আমি সারা রাত তাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকলাম। সে জিব দিয়ে আমার থুতনি চেটে দিল।
এর কিছুদিন পর আবার একবার নিরুদ্দেশ হল সে। অনেক খুঁজেও ক’দিন পাওয়া গেল না তাকে। প্রায় তিন চারদিন পর সে কাদা আর কালিঝুলি মেখে ফিরল মেজকাকুর সঙ্গে। আমাদের পাড়া ছাড়িয়ে কীভাবে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল পুষি! ফেরার পথ আর খুঁজে পায়নি। মেজকাকুর এক বন্ধু তাকে চিনতে পেরে খবর দেয়। তাকে নিয়ে এসে ভালো করে সাবান মাখিয়ে পরিষ্কার করে ভদ্রস্থ করা হল।তার কিছুদিন পর একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটল আমার চোখের সামনে। আমাদের বাড়ির পিছনে যে পুকুরের কথা বলেছিলাম,সেই পুকুরে থাকত মস্ত বড়ো এক জলঢোঁড়া সাপ। ঠাকুমা বলতেন ওটা বাস্তু সাপ,ওকে মারতে নেই। কতবার দেখেছি শীতকালে বাড়ির পিছন দিকের মাটির দাওয়ায় উঠে রোদ পোয়াচ্ছে। পায়ের শব্দ পেলে সে ধীরে সুস্থে নড়ে চড়ে চলে যেত। অন্ধকারে পুকুরপাড়ে কোনো প্রয়োজনে গেলে,মা ঠাকুমারা একটু জোরে জোরে পা ঠুকে শব্দ করতেন। তাতে নাকি বাস্তু সাপটি সরে যেত রাস্তা থেকে। পুকুরের গায়ে গাছের ডালে জড়িয়ে শুয়ে থাকত সে। কখনও দেখা যেত পুকুরের জলে এঁকেবেঁকে সাঁতার কেটে চলেছে। আমার মায়ের অবশ্য সাপে খুব ভয়। ঐ লিকলিকে লম্বা জন্তুটিকে সব সময়ে তিনি এড়িয়ে চলতেন।
একবার শীতের ছুটিতে আমাদের পুকুরের জল খুব ঠান্ডা বলে আমি বড়ো পুকুরে স্নান করতে যাচ্ছিলাম ঠাকুমার সঙ্গে। আমাদের জমি ছাড়িয়ে রাস্তা আর মাঠ পেরিয়ে বিশাল বড়ো সরকারি পুকুর ছিল একটা। পুষিও চলল আমাদের সঙ্গে। হঠাৎ সেই বাস্তুসাপটা বেরিয়ে এল ঘাসের মধ্যে থেকে। কোথাও শুয়ে রোদ পোয়াছিল বোধ হয়। বেশ কয়েক ফুট লম্বা হবে। আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে কোনাকুনি পেরিয়ে যাচ্ছিল সাপটি। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়েছি তাকে দেখে। কিন্তু পুষি হঠাৎ লোম খাড়া করে লাফিয়ে উঠে তেড়ে গেল তার দিকে। আমি চিৎকার করে উঠলাম,“পুষি… পুষি… যাসনা…”
সাপটি একবার শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে ফোঁস করে উঠল। মানে সাবধান করল প্রতিপক্ষকে। এদিকে পুষি তার দাঁত নখ বের করে সাপটিকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর আমি ঠাকুমার হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে চাইছি পুষিকে বাঁচানোর জন্য। ঠাকুমা প্রাণপণে চেপে ধরে আছে আমাকে। আর তিনিও চেঁচাচ্ছেন,“বৌমা তাড়াতাড়ি এস…”
সেই ডাক শুনে মা রান্না ফেলে দৌড় দিয়েছে। আমি ভাবছি অতবড়ো সাপটির বিষ যতই কমই হোক একটা বিড়াল মারার পক্ষে যথেষ্ট। পুষিও একটু ঘাবড়ে গেছে আমাদের চেঁচামেচি শুনে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুষি সাপটিকে আক্রমণ করল না। আর সাপটিও সুড়সুড় করে নেমে গেল পুকুরের জলে। আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।
কিন্তু সেই দিনটাই ছিল পুষির জীবনে শেষ দিন। আমি বড়ো পুকুর থেকে স্নান করে ফিরে ভাত খেতে বসেছি। অন্যদিনের মত পুষি সেদিন আমার পাশে ছিল না। হঠাৎ দাদু এসে খবর দিল, পুষিকে পাশের পাড়ার চারপাঁচটা কুকুর একসঙ্গে আক্রমণ করেছে সামন্তদের মাঠের কাছে। আমি খাওয়া ফেলে ছুটলাম পড়িমরি করে। গিয়ে দেখি ফাঁকা মাঠে কেউ কোথাও নেই। খোকন দূর থেকে আমাকে দেখে ছুটে এসে বলল,শয়তান কুকুরগুলো তোদের বিড়ালটাকে কামড়ে মেরে ফেলেছে। ও বাঁচার জন্য এই খেজুর গাছটায় উঠেছিল। কিন্তু নামতেই আবার ঘিরে ধরে কামড়ে দিয়েছে।”
আমি কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলাম,“কেন? আমার পুষি ওই কুকুরগুলোর কী ক্ষতি করেছে?”
“খরগোশের মত ধপধপে সাদা অচেনা বিড়াল দেখে কুকুরগুলো এমনিই কামড়ে দিয়েছে।”
আমি কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম মাঠে। সোনাদা,রতনকাকু,খোকন এরা সবাই মিলে চাগিয়ে নিয়ে এল আমাকে বাড়িতে। মনে আছে,সারাদিন আমি আর খাইনি সেদিন। শুধু কেঁদেছিলাম। বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিল,আমার পুষি ওই কুকুরগুলোর কী ক্ষতি করেছে? শুনলাম বাবা বিকালে কাজ থেকে ফিরে পুষির ক্ষতবিক্ষত দেহটা জলা থেকে খুঁজে এনে মাঠের কোণে নীচু জমিতে পুঁতে দিয়েছে। আমি পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গাছের কটা ফুল পেড়ে নিয়ে সবাইকে লুকিয়ে ছুটে চলে গেলাম মাঠের কোণে। যে জায়গাটাতে কাঁচা মাটি উঁচু হয়েছিল,বুঝলাম সেখানেই আছে পুষির শরীর। ফুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,পুষি তোর মৃত্যুর বদলা আমি নেবই। বড়ো হয়ে একটা সত্যিকারের বন্দুক কিনব। তারপর,ঐ কুকুরগুলোকে খুঁজে গুলি করে মারব।”
কিন্তু কোন কুকুরগুলো যে পুষিকে কামড়ে ছিল,তাদের আমি কোনোদিনই চিনতে পারলাম না।