মল্লিকা মা
কেয়া চ্যাটার্জী
সে অনেককাল আগের কথা। তখন শিশুকাল। খেলা ছিল,পড়া ছিল,পরীক্ষা ছিল,ছিল আড়ি-ভাব-এর উষ্ণতা। আর ছিল এক মেনি বিড়াল। নাম তার মল্লিকা। পশু-পাখি আমার পছন্দ নয় কোনোদিনই। বিরোধও নেই কোনো। আসলে ওদের শ্বদন্ত দেখলেই আমার প্রাণের ভিতর কেমন আনচান করে উঠত। যতই আদর করার জন্য কাছাকাছি আসুক না কেন,আমি লাফিয়ে লাফিয়ে দূর বহুদূর চলে যেতাম।
তা মল্লিকাকে আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি। কোত্থেকে এসে যে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তা কেউই ঠিক মনে করতে পারি না। তবে দুপুরবেলা অবশিষ্ট ঝোল,ভাত,মাছের কাঁটা খাওয়ার জন্য মল্লিকার অবশ্যম্ভাবী ডাক পড়ত। সেও যেখানেই থাকুক না কেন,ডাক শুনে “ম্যাও ম্যাও” শব্দে ভুবন ভরিয়ে চলে আসত নারকেল গাছের তলায়।
তবে মল্লিকা যে ভীষণ বাধ্য মেয়ে থুড়ি মেনি ছিল তা কিন্তু নয়। প্রায়ই পাশের বাড়ির জেঠিমা,কাকিমা,বৌদি জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে যেত,“ও খুকু তোদের মল্লিকা মাছের মাথাটা নিয়ে পালিয়েছে।”
মা চোখ কপালে তুলে বলত,“কী করি বলো দিদি, বিড়াল তো এদিক-ওদিক ঘুরবেই। আমিও কি সংসার ফেলে তার পেছনে পেছনে ঘুরব?”
তবে মল্লিকার একটা গুণ ছিল,নিরামিষ খাবার সে মোটেও ছুঁতে চাইত না। স্কুল থেকে ফিরে,স্নান করে পরিপাটি চুল আঁচড়ে,আসন পেতে যেই খেতে বসতাম অমনি শের-এ-বব্বরের মতো আগমন ঘটত মল্লিকার। সে বুঝি পালস বুঝতো। এসেই একটা বিরাট হাঁ দেখিয়ে বসত আমার পাশে। তার গোল চোখের মধ্যে লম্বা মণি যেন বলত,“আজ তোকে গিলে খাবো!”
হয়তো বলত না,তবে আমার যেন তাই মনে হত। আমি তৎক্ষণাৎ দশ হাত দূরে সরে গিয়ে চিৎকার করতাম,“ও মা! দেখো না,মল্লিকা এসেছে।” মা রান্নাঘর থেকে পাল্টা হাঁক ছুঁড়ত,“তুই খা না। ও কি কিছু করে কোনোদিন?”
না করত না কিন্তু আমার সামনে বসে সে বারংবার হাই তুলেই যেত আর আমিও তার দাঁতকপাটি দেখে আরেকবার চেঁচাতাম,“ওই দেখো না হাঁ করছে।”
মা আরেকবার ছক্কা হাঁকাত,“হ্যাঁ এবার তোকে খেয়ে ফেলবে। এক দলা ভাত দে,খেলেই চলে যাবে।” আমি কথামতো একদলা ডাল আলুসিদ্ধ মাখানো ভাত তাকে দিয়ে তার পগারপারের অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু না, তিনি গন্ধ শুঁকেই মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতেন। মুখ বেঁকিয়ে বলতাম,“ওহ্ মহারানি।”
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে মল্লিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আদা-কাঁচকলায়। কিন্তু আমার বড়ো হওয়ার আগেই কীভাবে যেন মল্লিকা বড়ো হয়ে গেল। মল্লিকা মা হয়ে গেল। দিদিরা হাসাহাসি করে বলল,মল্লিকা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করেছে। তার সেই গুপ্ত প্রেমিকপ্রবরের খোঁজ আমরা পাইনি বটে তবে জেঠুর বাড়ির চিলেকোঠার খাটের তলায় সে পাঁচ পাঁচটি ছানার জন্ম দেয়। অদ্ভুতভাবে দেখলাম মা হওয়ার পর পাল্টে গেল সেই চঞ্চল মল্লিকা। ভীষণ প্রটেক্টিভ। পরিচিত মুখ উঁকি দিলেও তার চোখ জ্বলে উঠত।
কিন্তু নিয়তি বড়ো নিষ্ঠুর। ছানাগুলোকে রাখতে পারল না তাদের মা। কোনো হুলো পাঁচটিকেই মেরে ফেলেছিল। সন্ধেবেলা মল্লিকা কাঁদত,তার আর্তি ঘুরে ঘুরে কানে আসত আমাদের। চোখে জল আসত। সেই দুষ্টু,চোর,চঞ্চল মল্লিকা যেন একেবারেই বড্ড অভিজ্ঞ হয়ে গেল। না খেয়েই কাটিয়ে দিল কতদিন।
তারপরেও একবার মল্লিকা মা হয়েছিল। তখন তার পেটে রাক্ষুসে খিদে। প্রায়ই এর ওর বাড়ি থেকে মাছ,দুধ খেয়ে পালাত। সকলে ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু বাচ্চাগুলো এবারেও মা’কে বেশিদিন পেল না। না,এবারে বাচ্চা নয়, মা চলে গেল সকলকে ছেড়ে। এক সকালে বাড়ির পিছন দিকের জানলা খুলতেই আঁতকে উঠল মা। মল্লিকা শুয়ে সুপুরি গাছের নীচে। মুখ থেকে গাঁজলা বেরোচ্ছে। তাকে ডাকা হল,নাড়ানো হল। সে উঠল না,ডাকল না। কেউ বা কারা তাকে বিষক্রিয়ায় মেরে ফেলল নাকি সে নিজেই কোনোভাবে মারা গিয়েছিল আমরা জানতে পারিনি। তবে এরপর আমাদের বাড়িতে কোনো বিড়ালকে পোষ মানানো হয়নি। অথবা বলা যায়,মল্লিকার মতো করে আর কাউকে কাছে টানতে পারিনি।