মিউ, আমাদের মিউ
অনসূয়া মুখার্জী
সালটা বোধহয় ১৯৯১ কিংবা ৯২-এর শুরু। সেদিন আমার বন্ধু পামেলার বিয়ে ছিল। ব্যারাকপুর থেকে ফিরছি বেলঘরিয়ায়। মসজিদ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি এস এগারো বাসের জন্য। পুঁচকে এক বিড়াল ছানা বারাসাত রোডের মাঝখানে। সুইসাইড করবে নাকি! তাকে দুই আঙুলে নিয়ে রাস্তার ধারে রেখে এসে দেখি আবার রাস্তার মাঝখানে চলে যাচ্ছে! আবার ধরতেই এস এগারোর দেখা। এটাই শেষ বাস। কোনো কিছু না ভেবেই বিড়াল সহ হাত ভ্যানিটি ব্যাগে আর আমি বাসে। সারাটা রাস্তা চাপড় মেরে মেরে নিয়ে এসেছি।
বাড়ি এসে বুঝলাম তিনি একা একা খেতেও পারেন না! ড্রপার দিয়ে দুধ খাইয়ে একটু একটু করে বড়ো করানো হল। বড়ো আদুরে। নাম হলো মিউ। কথা হল পরের বিড়ালবাচ্চার নাম হবে নিউ। আলফা, বিটা, গামা, পাই এসবও চলতে পারে।
মিউ অনেক কিছুই পারত না। বেশি পাতলা দুধ খেতে পারত না, খারাপ ময়দা মেশানো সন্দেশ খেত না, ক্রিমক্র্যাকার ছাড়া বিস্কুট খেত না, কাঁচা মাছ খেত না।
কিন্তু কোনো ঝামেলা ছিল না। খুব পরিষ্কার। বাবার ঘর ছিল উপরের তলায়। বাবার পোষা কুকুর এর নাম ছিল টুপু। সে খুব দুধ খেতে ভালোবাসত, তার একটা বাটি ছিল। সেটায় দুধ ঢাললে কোথা থেকে মিউ এসে মুখ দিত। টুপু কিছুই বলত না। বাবা বলতেন, “ছোটো বাচ্চা তো, তাই টুপু কিছু বলে না।”
বিড়ালটা কেমন পরিবারের সদস্য হয়ে গেল। তারপর আমার একবার প্যারাটাইফয়েড ধরা পড়ল। ডাঃ মুন্সি দেখছিলেন। কী একটা ইঞ্জেকশন দিতেন কোমরে। এক মহিলা আসতেনওই ইঞ্জেকশন দিতে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারতাম না। মিউও কোথাও যেত না। ঠিক বিছানার নীচে একটা নরম পাপোশ-এ সারাদিন শুয়ে থাকত। কেউ কাজ থেকে ফিরলে আমায় খেতে দিত, মিউকেও খেতে দিত। বোধহয় দু’সপ্তাহ এমনই কেটেছিল।
একদিন শাশুড়ি মা স্কুল থেকে এসে দেখে বিল্লি শুয়ে, পাশে এক ইঁদুর শিকার করে রাখা। মিউ খায়নি। আমার জন্য রেখে দিয়েছে। ও ওর সাধ্যমতো আমার জন্য খাবার জোগাড় করেছে। আমি তো সেদিন কেঁদেই ফেলেছিলাম। এত ভালোবাসে!
আমার প্রথম সন্তান মারা যায় হাসপাতালেই। বাড়ির সব সদস্যই যখন সে নিয়ে ভারী দুঃখে আছে, শুধু টুপু আর মিউ আমাদের একটুখানি আনন্দ দেবার চেষ্টা করত। অনেকক্ষণ ধরে চড়াই তাক করে হয়তো মিউ যখন লাফালো ততক্ষণে চড়াই ভাগলবা। টুপু বলল, ভৌ ভৌ, মানে তুমি পারোনি। মিউ বলল,মিউ মিউ, পারিনিতো কী আছে? চেষ্টা তো করেছি!
এমনি করে ১৯৯৫ সাল এল। আমাদের বাড়িতে নতুন একজন সদস্য আসবে! অনেকদিন বাদে! সে কী আনন্দ সবার। সবাই এসে বলে এবার বিড়াল বিদায় করো। বাচ্চাদের অনেক অসুখ- বিসুখ হয় বিড়াল থেকে। আমি শক্ত হচ্ছি। বাড়ির লোক বুঝতে পারছে এক অনায্য দাবী করা হচ্ছে আমার কাছে।
একদিন ডাক্তারবাবু আমায় বললেন, আপনি টেনশনে কেন থাকেন?
বললাম, মিউ এর গল্প। আমি তো তাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তিনি বললেন, “আপনার বাচ্চার যদি ডিপথেরিয়া হবার ভাগ্যে থাকে তবে বাইরের বিড়াল থেকেও হতে পারে। এতদিনের পোষ্যপুত্রকে আপনি তাড়িয়ে দেবেন কেন?”
চলল বাড়ির লোকেদের কাউন্সেলিং দফায় দফায়। দোলনায় বিছানা গুছিয়ে, সাদা চাদর-বালিশ পেতে আমি গেলাম নার্সিংহোম-এ নতুন অতিথিকে আনতে। যেদিন ফিরে সেদিন দেখি দোলনায় সাদা বালিশে সাদা চাদরে মিউ ঘুমুচ্ছে পরম শান্তিতে। আমার কোলে আমার ছানা।
মিউ বা টুপু কেউ কখনো আমাদের ছানার সঙ্গে কোনোরকম দুষ্টুমি করেনি। বরঞ্চ ছানাই কান মুলে, লেজ মুলে যথেষ্ট ফচকেমি করেছে ওদের সঙ্গে। মিউ সেরেল্যাক খেতেও বেশ ভালোবাসত। সেরেল্যাক গুললে ওকেও এক -চামচ দিতে হত। তখনও ক্যাট ফুড কাকে বলে জানতাম না।
তারপর থেকে কত বেড়াল এল বাড়িতে! তাদের নাম রাখা হত বাই ওয়ান, বাই টু। মানে মিউ বাই ওয়ান, মিউ বাই টু। মিউকে কিন্তু ভোলা গেল না, কতদিন হয়ে গেলো! এক অ্যালব্যাম মিউ এর ছবি! আজও একটা বিড়াল আছে কিন্তু মিউ ত মিউই।ওর বিকল্পতো সম্ভব নয়।