স্বর্ণময়
শর্মিষ্ঠা সেন
স্বর্ণময় কোনো মানুষের নাম নয়। ও ছিল আমার আমার মামাবাড়ির বেড়াল। একদম ঠিকঠাক বলতে গেলে বলতে হয় আমার বড়োমার বেড়াল। বড়োমা হলেন মায়ের ঠাকুমা। আমি তখন খুব ছোটো, সম্ভবত থ্রি বা ফোর-এ পড়ি। ছোটোবেলায় ছুটি পড়লেই মামারবাড়ি যেতাম। বাবা রেল-এ চাকরি করতেন। বছরে পাস পেতেন চার সেট,ভাই-এর তখনও স্কুল শুরু হয়নি তাই সময় পেলে বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে টা টা বাই বাই। বাবা অবশ্য যেতেন না, কিন্তু তাতে মোটেও ক্ষতি কিছু হত না বরং সারাটা দিন টই টই করে দিব্যি কাটানো যেত। মামারবাড়ি লক্ষ্মীপুর-এ, বর্ধমান জেলায়। আমার ছোটোবেলায় সেটি অঁজপাড়া গাঁ ছিল, এখনও তাই আছে শুনি।
সেরকমই কোনো এক ছুটিতে মামার বাড়ি গিয়েছি। আজ থেকে ত্রিশ বত্রিশ বছর আগে মামারবাড়ি জমজমাট থাকত। যৌথ পরিবার। বড়োমা,তিন দাদু, তিন দিদা,অনেক মামা-মাসি, জন-মুনিষ,এসো জন-বসো জন, গরু, মোষ,হাঁস,মুরগি এবং বেড়াল। বেড়াল মানে স্বর্ণময়। গায়ের রং সোনালি, বেশ নাদুসনুদুস, পায়ে পায়ে ঘোরে। স্বর্ণময় বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরের উনুনের ধারে বসে থাকত। এখনকার গ্যাসের ওভেন নয়, সে ছিল মাটিতে দেড় হাত গর্ত খুঁড়ে করা উনুন। পাটখড়ি দিয়ে রান্না হত। স্বর্ণময় সেই উনুন-ধারে দিদার পাশটিতে বেশ গুছিয়ে বসে থাকত যেন সে সব কিছু তদারক করছে। আমার ভীষণ রাগ হত স্বর্ণময়কে দেখলে। দিদা,বড়োমার সব আদর এতদিন আমি পেয়ে এসেছি, তারপর ভাই ভাগ বসাল,এখন আবার কোথাকার মোটকা একটা বেড়াল? আমি ওর ল্যাজ ধরে টেনে দিদার পাশ থেকে সরাতে যেতাম আর ও চার পায়ের নখ দিয়ে মাটি আঁকড়ে বসেই থাকত! দিদার বাম পাশে এতকাল তো আমিই বসেছি পিঁড়ি পেতে! এখন উটকো একটা কেউ বসলেই হল? তাও মানুষ হলে একটা কথা ছিল! আমার রকম সকম দেখে দিদা বলতো,“ভাই, তুমি আমার ডাইন পাশে আইস।।” আরো অপমানের ব্যাপার! বেড়ালের কাছে হেরে যাওয়া। মাঝে মাঝে সবার আড়ালে মোটা পাটকঠি ভেঙে স্বর্ণময়কে ঠাঁই ঠাঁই করে দু-ঘা দিয়েও দিতাম! স্বর্ণময় এমন আঁও মাঁও করত যেন ও মরেই যাচ্ছে! আমি তো একটা রোগাসোগা ছোট্ট এক মেয়েই ছিলাম! আমার গায়ে আর কতই জোর থাকবে! একদিন বড়োদিদা, মানে মায়ের মা আমার এই দুষ্টুমি দেখে ফেলেছিলেন। এখনও মনে আছে দিদা খুব নরম গলায় বলেছিলেন,“ভাই, স্বর্ণময়কে মাইরো না,তোমার বড়োমার আদরের বিড়াল ও। পশুপাখিরে মারলে নারায়ণ রাগ করেন।” বড়োমার কথা ভেবে নাকি নারায়ণের ভয়ে,সে মনে নেই, তারপর থেকে স্বর্ণময়ের সঙ্গে ভাব হয়ে গিয়েছিল। আমি,মা,ভাই,বড়োমা আর স্বর্ণ পাড়া বেড়াতে যেতাম। বড়োমা ডাকত সন্নময়। আমি প্রায় সব বাড়িতে মোয়াটা, নাড়ুটা খেতাম, স্বর্ণময় কিন্তু বাড়িছাড়া কোথাও খেত না, এমনকি রাস্তায় কিছু পড়ে থাকলেও না। ও সকালে দুধ খেত চুকচুক করে, পাতলা গোলাপি জিভ দিয়ে চেটে চেটে। আর দুপুরে খেত মাছ ভাত, কাঁটা সুদ্ধ। আর বড়োমার পাতের মুড়োর কাঁটা অথবা ল্যাজার কাঁটা। রাত্তিরে স্বর্ণময় বড়োমার ঘরেই থাকত। মজার ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝে স্বর্ণময় উনুনের ছাই-এর মধ্যে শুয়ে থাকত! দিদা সকালবেলা উনুন লেপার আগে দেখে নিত ভেতরে কিছু আছে কিনা। এক আধ দিন কালিঝুলি মেখে স্বর্ণময় ভুতুম হয়ে বেরোত। কেউ চান করিয়ে দিত হয়তো পরে।
পরপর বেশ কয়েকবার স্বর্ণময়কে পেয়েছিলাম। আমি হাঁসের পেছন পেছন দৌড়ে গেলে সেও আমার সঙ্গে দৌড়ত। আমি বারান্দায় পাটি পেতে বসে থাকলে সেও চুপটি করে গা ঘেঁষে বসে থাকত। তারপর কবে যেন হারিয়ে গিয়েছিল! শুনেছিলাম শেয়ালে নাকি তাকে নিয়ে গেছে। আমার মন ভেঙে গিয়েছিল একেবারে। শুধু মনে পড়ত কেমন মারতাম ওকে। ভালও যে বাসতাম সেটা মনে আসত না। মনে হত যদি একবার স্বর্ণময় ফিরে আসে তাহলে ওকে কোলে করে রাখব,কোথাও যেতে দেব না!
এতবছর পরও স্বর্ণময়কে ভুলতে পারিনি! সেই মামাবাড়ি, বিশাল রান্নাঘর,বড়োমা, বড়োদিদা, ন’দিদা কেউ নেই আর। শুধু ন’দাদু আর ছোটোদিদা আছেন। দুই দাদু, বড়োমা গেছেন বহুবছর আর বড়োদিদা দু’বছর হলো। আমার নিজের কোনো পুষ্যি নেই। কিংবা এভাবেও ভাবা যায় আমার ছোট্টবেলার সঙ্গীরা এখনও মনের মধ্যে বাসা করে আছে বলেই নতুন পুষ্যির আর দরকার হয়নি। নতুন কেউ এলে যদি ওদের ভাগে আদর কম পড়ে! কী দরকার খামোখা অন্যকে কষ্ট দেবার!