অমিত দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
মূল কাহিনিঃ দি আনমাস্কিং অব শার্লক হোমস
লেখকঃ আর্থার চ্যাপম্যান
কথোপকথন
অমিত দেবনাথ
বসওয়েল যেমন জনসনের জীবনী লিখেছিলেন, তেমনই আমিও সারাটা জীবন শার্লক হোমসের কাহিনিকার হিসেবেই কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মাত্র একবারই আমি তাকে ঘাবড়ে যেতে দেখেছিলাম। আমরা দিব্যি ধূমপান করতে করতে হাতের ছাপের থিওরি নিয়ে আলোচনা করছি, এমন সময় বাড়িওয়ালি একটা ছোটো চৌকোনা কার্ড নিয়ে এসে হোমসের হাতে দিলেন। সেটার ওপর আলগোছে চোখ বোলানোর পরই দেখলাম হোমসের হাত থেকে কার্ডটা মেঝেতে পড়ে গেল। আমি কার্ডটা তুলে নিতে নিতে দেখলাম, হোমস থরথর করে কাঁপছে। সে এতই উত্তেজিত যে বাড়িওয়ালি আগন্তুককে আসতে বলা বা না বলার ব্যাপারে কিছুই বলছে না।
কার্ডে লেখা আছে দেখলামঃ
মঁসিয়ে সি. অগাস্ট দুপিঁ প্যারিস
আমি যখন ভাবছি এই নামটার মধ্যে এমন কী আছে যে স্বয়ং শার্লক হোমস পর্যন্ত এমন ভয় পেয়েছে, তার মধ্যেই ঘরে ঢুকে পড়েছেন মঁসিয়ে দুপিঁ স্বয়ং। ভদ্রলোক বয়সে তরুণ, ভালো স্বাস্থ্য আর দেখেই মনে হয় ফরাসি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালেন ভদ্রলোক। কিন্তু দেখলাম শার্লক হোমস এমনই হতভম্ব হয়ে গেছে, সেটা ভয়ে না ভক্তিতে জানি না, যে পালটা অভিবাদন জানাতে ভুলে গেল। সে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল ফরাসিবাবুটির দিকে, যেন সে লোকটা একটা ভূত। যা হোক, বহু কষ্টে নিজেকে সামলে আগন্তুককে একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে নিজেও বসল আরেকটায়। বসে কপালের ঘাম মুছল।
“হঠাৎই চলে এলাম বলে মাপ করবেন, মিঃ হোমস।” আগন্তুক সাদাটে পাইপ বার করে তামাক ঠেসে লম্বা লম্বা ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন। “আমার কেমন মনে হচ্ছিল, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইবেন না। তাই ল্যান্ডলেডিকে দিয়ে ভাগিয়ে দেওয়ার আগে আমিই ভেতরে চলে এলাম।”
আমি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম, যে বিখ্যাত চাহনির জন্য হোমস বিখ্যাত হয়ে আছে, যে চাহনি একবার দিয়েই সে দর্শনার্থীর নাড়িনক্ষত্র বলে দেয়, সেই চাহনি দেওয়ার কোনও চেষ্টাই হোমস করল না। বরং বারকয়েক কপালের ঘাম মুছে সে তোতলাতে তোতলাতে মিনমিন করে বলল, “কিন্তু… কিন্তু… আ-আ… আমি ভেবেছিলাম আপনি মরে গেছেন, মঁসিয়ে দুপিঁ।”
“লোকে তো জানত আপনিও মরে গেছিলেন, মিঃ শার্লক হোমস।” আগন্তুক চড়া স্বরে বললেন, “কিন্তু আপনি যদি আল্পসের একটা পাহাড়চূড়ার খাঁজে আটকে গিয়ে বেঁচে উঠতে পারেন, আমিই বা কেন আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলার জন্য কবর থেকে উঠে আসতে পারব না, বিশেষ করে যেখানে আমার সৃষ্টিকর্তা মিঃ এডগার অ্যালান পো কবর থেকে মড়া বার করে আনতে খুবই দক্ষ ছিলেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী যেন নামটা… পো… হ্যাঁ, পো… এর কিছু কিছু লেখা আমি পড়েছি বটে।” বলল শার্লক হোমস তেতো গলায়, “চতুর লেখক, কয়েকটা ক্ষেত্রে। আপনাকে নিয়েও কয়েকটা গোয়েন্দা গপ্প লিখেছে সে। সেগুলোকে খুব খারাপ বলা যায় না।”
“তা যা বলেছেন! খুব খারাপ বলা যায় না।” মঁসিয়ে দুপিঁ ব্যঙ্গের সুরেই কথাটা বললেন বলে মনে হল আমার। “এই যেমন ধরা যাক, ওঁর একটা ছোটো গল্প, ‘চোরাই চিঠি’। কী সাংঘাতিক গল্প ভেবে দেখুন তো! ও গল্পটা আমি যতবার পড়ি, ততবারই আপনার এই আলতুফালতু কেসের রঙ চড়ানো গল্পগুলো ভুলে যাই। ও-গল্পটা পড়লে মনেই হয় না কোথাও জোর করানো হয়েছে। সবকিছুই যেন স্বাভাবিক, সাবলীল। আর এর সমাধানটাও এতই সহজভাবে এসেছে যে আপনার গল্পের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। আপনার গল্পের ধাঁচগুলোই বিশ্রী লাগে এর কাছে।”
“তাই নাকি? তা পো সাহেব যদি আপনার কাছে এতই বড়ো লেখক, তাহলে তিনি আপনাকে নিয়ে আর লিখলেন না কেন শুনি?” সপাটে বলল শার্লক হোমস।
“আরে ওইখানেই তো মজা! খাঁটি শিল্পী তো একেই বলে।” ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন মঁসিয়ে দুপিঁ, “যখনই তিনি দেখতেন কোনও কিছুতে সাফল্য আসছে, তখনই তিনি সেটাকে রেখে ঢেকে খরচা করতেন। ধরা যাক ‘রু মর্গ হত্যাকাণ্ড’ লেখার পর, যেটাতে আমি কেন্দ্রীয় চরিত্র, তিনি আরও দুটো কি তিনটে ছোটো গল্পের বই লিখে ফেললেন, যেগুলোর সবকটাতেই আমি আছি। ধরা যাক, তারপর তিনি ভাবলেন আমাকে নিয়ে একটা নাটকবাজি করবেন এবং আবার আমাকে পাঠকের সামনে এনে ফেলবেন। একইরকমভাবে ধরা যাক, তার জন্য তিনি আমাকে খুন করলেন এবং ঘোষণা করে দিলেন তিনি আর কোনও গোয়েন্দা গল্প লিখবেন না। তারপরেও যদি দেখা যায় স্রেফ প্রকাশকদের কান্নাকাটি উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি আবার আমাকে ফিরিয়ে এনে গাদা গাদা গল্প লেখা শুরু করলেন, সেটা কি খুব ভালো হত? আসলে ব্যাপারটা কী জানেন? বেশিরভাগ লোকই তো সাধারণ বোধবুদ্ধি সম্পন্ন লোকের চেয়েও খারাপ হয়। কাজেই তারা ‘রু মর্গ হত্যাকাণ্ড’ বা ‘চোরাই চিঠি’-র মতো ক্লাসিক গল্প ছেড়ে রাবিশ মালের দিকেই ঝোঁকে।”
“সেটা অবশ্য সত্যি কথা। আমার ক্ষেত্রে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে।” একটা শ্বাস ছেড়ে বলল শার্লক হোমস। হাত বাড়াল হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের দিকে, যেটা আমি আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম। “কিন্তু আমার ধারণা কী জানেন? পো-ও যদি প্রতিটি শব্দের জন্য এক ডলার করে পারিশ্রমিক পেতেন, তবে তিনিও আপনাকে নিয়ে আমার মতোই বাড়াবাড়ি করতেন।”
“বেচারা এডগার! কেউ তাঁকে বোঝেইনি! হয়তো তিনি পারতেন,” বললেন দুপিঁ চিন্তাগ্রস্ত মুখে, “তাঁর ওই বেহিসাবি ঝোড়ো জীবনে ক’টা টাকাই বা তিনি পেয়েছেন? তবে তিনি কী পেয়েছিলেন, তাই দিয়ে তো আর তাঁর বিচার হবে না! তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর। বহু নতুন নতুন রাস্তা তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছিলেন। অন্য কারও আইডিয়া ঝেড়ে নিজের বলে চালাননি।”
“কী বলছেন, মশাই!” চেঁচিয়ে উঠল শার্লক হোমস, “আপনার কি ধারণা পো ছাড়া আর কারও ডিটেকটিভ গল্প লেখার ক্ষমতা নেই?”
“না, তা বলছি না। তবে আপনি ভেবে দেখুন আপনি কীভাবে প্রতি পদে পদে আমাকে অনুসরণ করেছেন। আমি যখনই চিন্তা করি, তখনই ধূমপান করি, আপনিও করেন। আমার একজন বন্ধু আছে, যে আমি যা বলি বা করি, সব লিখে ফেলে, আপনারও তাই। আমি সবসময় তাদের চেয়েও ভালো থিওরি দিয়ে পুলিশকর্তাকে চমকে দিই, আপনিও তাই।”
“জানি, জানি।” আবার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল শার্লক হোমস। “এগুলো একদমই ঠিক হয়নি। লোকজন উলটোপালটা বলছে। তবে কিনা, আমার লেখক যে শুধু আমাকে নিয়েই এরকম লেখা শুরু করেছে, তা নয়। আপনি কি তাঁর লেখা ‘দি হোয়াইট কোম্পানি’ বইটা পড়েছেন? ওটা ‘দি ক্লয়স্টার অ্যান্ড দ্য হার্থ’-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন, কী চমৎকার খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে!”
“হ্যাঁ, এখান থেকেই তো অন্য লোকের আইডিয়া ঝেড়ে লেখার যুগ শুরু হল।” মঁসিয়ে দুপিঁ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন একটা। “তবে আমার দিক থেকে বলতে পারি, আপনি যে আমার দাপটটাকে চুরি করেছেন, তাতে আমি কিছু মনে করিনি। আপনি একেবারেই সাধারণ একজন মানুষ, যদিও আপনি কিছুতেই মাঠ ছেড়ে যেতে চাইছেন না। ধৈর্য্যশীল মানুষ বলেই বোধহয়। আর এতে আরেকটা ব্যাপারও হচ্ছে। আপনার তুলনায় আমি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছি। আমি এমনকি ‘নাচিয়ে মূর্তিগুলো’-র কথাও ধরছি না, যেখানে আপনি একটা লেখার সংকেত ব্যবহার করেছেন, আর যেটা ‘সোনা-পোকার গল্প’-র কথা মনে করিয়ে দেয়।”
“কিন্তু আপনি তো সোনা-পোকার গল্পে ছিলেন না।” এতক্ষণে শার্লক হোমসের মুখে একটা জয়ের হাসি দেখা গেল।
“না, তা নেই। তবে কী বলুন তো, লোকের মনে পো-র সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধা আছে এই কারণেই যে তিনি কোনও বিষয়কেই কচলে তেতো করে ফেলেননি। এই কথাটা রাখবেন, যে আবার যখন আপনি বিদায় নেবেন, তখন আর ফিরে আসার চেষ্টা করবেন না। এমনকি আমেরিকার পাঠকদেরও ধৈর্য্যের একটা সীমা আছে। আর আপনি বরাবরই যে ‘আজকের দিনের সেরা ছয় বেস্ট সেলার’-এর মধ্যে থাকবেন, তাও নয়।”
এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই মঁসিয়ে দুপিঁ তাঁর পাইপ-টাইপ সমেত উধাও হয়ে গেলেন। ঘরে পড়ে রইলাম শুধু আমি আর বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমস। সে আমার দিকে তাকাল। মুখে একটা লজ্জার হাসি, যেন কোনও স্কুলের ছেলে আপেল চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়েছে।