অমিত দেবনাথ এর সমস্ত লেখা
হারানো হিরের রহস্য
মূল কাহিনি: “দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ডায়মন্ড নেকলেস” লেখক:জর্জ এফ. ফরেস্ট অনুবাদঃ অমিত দেবনাথ। জয়ঢাক প্রকাশনের তথাপি শার্লক (২) বইটি থেকে। বইটি ডিসকাউন্টেড দামে কিনতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুনঃ
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই একটা উৎকট সুরের গুঁতো আমাকে অভ্যর্থনা জানালো। ওয়ারলক বোনস অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছে বুঁদ হয়ে। সারা ঘর ধোঁয়ায় ভর্তি। ধোঁয়াটা বেরোচ্ছে একটা চরম নোংরা ব্রায়ার-উড পাইপ থেকে, যার আড়ালে প্রায় ঢাকাই পড়ে গেছে তার ছিপছিপে তীক্ষ্ণ মুখাবয়ব। আমাকে দেখেই সে বাজনা থামিয়ে (থামানোর সময় এমন মড়াকান্নার আওয়াজ বেরোল যন্ত্রটার থেকে যে কি বলব!) উঠে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে স্বাগতম জানালো আমাকে।
“আরে এসো এসো গসওয়েল, সুপ্রভাত, সুপ্রভাত”, ফুর্তিবাজ গলা বোনসের, “কিন্তু বিছানার নিচে প্যান্ট রেখে ভাঁজ খাইয়েছো কেন?”
ব্যাপারটা সত্যি বটে। তবে আমি যথেষ্ট গোপনেই এই কাজটা সেরে থাকি। আর এই লোকটা… অসাধারণ পর্যবেক্ষক, অপরাধীদের যম, এতাবৎকালের মধ্যে বিশ্বের সেরা মাথাওয়ালা এই মানুষটা সেটা এক্কেবারে ফাঁস করে দিল গো!
“তুমি কী করে জানলে?” আমি সত্যিই চমকে গেছিলাম।
আমার ভ্যাবাগঙ্গারাম অবস্থা দেখে বোনস হাসল। করুণার হাসি।
“ট্রাউজারসের ওপর আমার বিশেষ পড়াশোনা আছে”, তার উত্তর, “বিছানা নিয়েও। আর সেগুলো বিশেষ ভুল হয় না। কিন্তু ব্যাপারটা হল, মাস তিনেক আগে তোমার সঙ্গে যে কয়েকদিন কাটালাম, সেটা বোধহয় ভুলেই গেছ। আমি তখনই দেখেই ব্যাপারটা।”
আমাকে ভড়কি দেওয়ার সুযোগ পেলে এই মার্জার-চক্ষুসদৃশ গোয়েন্দা আর কিছু চায় না। সত্যি, কত সহজ ব্যাপার, অথচ এটা আমার মাথাতেই আসেনি। নাঃ, এ লোকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। আমি মেঝেতে বসে পড়ে দু হাত দিয়ে তার বাঁ হাটুখানা জড়িয়ে ধরে গদগদভাবে তার মুখের দিকে তাকালাম।
দেখলাম, সে তার এক হাতের জামার হাতা গুটিয়ে ফেলেছে, বেরিয়ে এসেছে সরু লিকলিকে বাহুটা। এবার আরেক হাত দিয়ে সেই হাতে আধ পাঁইট প্রুসিক অ্যাসিড ইঞ্জেকশন দিল অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। তারপর তাকাল ঘড়ির দিকে।
“আর সম্ভবত তেইশ থেকে চব্বিশ মিনিটের মধ্যেই একটা লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে”, বলল সে। “লোকটার স্ত্রী আছে, দুই ছেলেমেয়ে, তিনখানা নকল দাঁত, যার মধ্যে একটা আবার কয়েক দিনের মধ্যেই পাল্টাতে হবে। বয়স সাতচল্লিশ, শেয়ার বাজারের সফল দালাল, জেগার্স-এর পোশাক পরে, আর “হারানো শব্দ প্রতিযোগিতা” -এর একজন উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক।”
“এত কিছু জানলে কী করে?” আমি বসে আছি সেইভাবেই, দম চেপে। চাপড় মারছিলাম তার জানুতে। শোনার জন্য আমার আর তর সইছে না।
বোনস তার উঁচুদরের হাসিটা হাসল।
“সে আমার কাছে আসবে একটা পরামর্শ নিতে”, বলল সে, “গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার তার রিচমন্ডের বাড়ি থেকে কিছু মণি মুক্তো চুরি গেছে, সেই ব্যাপারে। তার মধ্যে একটা নেকলেস বেশ দামি।”
“বোঝাও! বোঝাও আমাকে, প্লিজ!” আমি মিনতি করলাম।
“মাই ডিয়ার গসওয়েল”, উচ্চহাস্য করে উঠল বোনস, “মাথাটা একটু হালকা কর। আমার পদ্ধতি সব ভুলে গেলে নাকি? আরে লোকটা আমার বন্ধু। গতকাল শহরে ওর সঙ্গে দেখা করেছি, সে বলেছে আজ সকালে এসে এ ব্যাপারে কথা বলবে। খাঁটি অবরোহ প্রথায় সিদ্ধান্তগ্রহণ, বুঝলে?”
“কিন্তু রত্নগুলো? পুলিশ নেমেছে নাকি?”
“শুধু নেমেছে? নেমে এখনও পর্যন্ত সাতাশ জন সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষকে গ্রেফতার করেছে, যার মধ্যে এক ডাচেস আছে, যে বেচারি এখনও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি, আর যদি আমার খুব ভুল না হয়, তবে আজ বিকেলেই ওরা আমার বন্ধুর স্ত্রীকে গ্রেফতার করবে। সে অবশ্য এই চুরির সময়ে মস্কোয় ছিল, কিন্তু তাতে এই মাথামোটাদের কিছু আসে যায় না।”
“তুমি কিছু করতে পারলে?”
“পেরেছি বইকি”, বলল বোনস, “সত্যি কথা বলতে, ওরা এখন আমার হাতের মুঠোয়। এ কেস জলের মতো সোজা। আমি যত কেস করেছি, এটা বোধহয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে সোজা, তবে সাধারণ চোখে এটা কঠিনই লাগবে। চুরির কারণটাও অদ্ভুত। চোর সম্ভবত লাভের জন্য চুরি করেনি, করেছে নিজের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য।”
“মানতে পারলাম না ভায়া”, আমি অবাক হয়ে বললাম, “একটা চোর… পাতি চোর… সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবে যে সে-ই চুরি করেছে… এ কখনোও হয় নাকি?”
“হয় গসওয়েল। তোমার বুদ্ধিতে অবশ্য এটা হয় না, কিন্তু তোমার কল্পনাশক্তি নেই, যেটা না হলে গোয়েন্দাদের চলবেই না। তোমার অবস্থা ওই পুলিশগুলোর মতো। উদ্যমী, কিন্তু কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। ওরা এই কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। আর আমার কাছে এটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার।”
“তা অবশ্য ঠিক”, তার পায়ে ভক্তিভরা চাপড় মারতে মারতে বললাম আমি।
“আসল চোরকে অনেকগুলো কারণেই আমি ধরিয়ে দিয়ে প্রকাশ্যে আনতে চাইছি না”, সে বলল, “তবে রত্নগুলোর ব্যাপারে যা বলেছিলাম, সেটা কিন্তু খাঁটি। যে কোনও মুহূর্তে আমি ওগুলো বার করতে পারি। এই দেখ!”
সে আমার হাত ছাড়িয়ে ঘরের একপাশে চলে গেল। সেখানে রয়েছে একটা সিন্দুক। সেখান থেকে বার করে আনল একটা গয়নার বাক্স, তারপর খুলল সেটা। সেখানে ঝকমক করছে একগাদা দুর্দান্ত হিরে। মাঝখানে রয়েছে একখানা অসামান্য নেকলেস, যেটা এই শীতের ম্যাড়মেড়ে আলোতেও ঝলসে উঠল। দেখে আমার দম আটকে গেল, বাক্যহারা হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। তারপর অতিকষ্টে বললাম, “কিন্তু… কিন্তু… তুমি কী করে…”
থেমে গেলাম তারপর, কারণ আমার অবস্থা দেখে বোনস হাসছে। আমোদ পাওয়ার হাসি।
“আমিই ওগুলো চুরি করেছিলাম”, বলল ওয়ারলক বোনস।