বিদেশি গল্প ইংরিজি স্বপ্ন আগাথা ক্রিস্টি। অনুঃ ঋজু গাঙ্গুলী শীত ২০১৮

 ঋজু গাঙ্গুলী  র অন্যান্য লেখা

মূল কাহিনি: আগাথা ক্রিস্টি-র লেখা ‘দ্য ড্রিম’।

অনুবাদ: ঋজু গাঙ্গুলী

এরকুল পোয়ারো বাড়িটাকে দেখছিলেন।

দোকান, ডানদিকের কারখানা, উলটোদিকের সস্তার ফ্ল্যাটবাড়ি, এসবের মলিন সমুদ্রে একটা ভুলে যাওয়া দ্বীপের মতো পড়েছিল বাড়িটা। অথচ, কাগজপত্রের নানা জটের আড়ালে এই বাড়ির আসল মালিক তথা বাসিন্দা হলেন বেনেডিক্ট ফারলে।

ভদ্রলোক দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী মানুষদের একজন। ক্যামেরায় তাঁকে ধরা বড়োই কঠিন। মাঝেমধ্যে বোর্ড মিটিং-এ তিনি হাজিরা দিলে লোকে তাঁর শীর্ণ চেহারা, টিয়াপাখির মতো নাক, খসখসে গলা থেকে বেরোনো চোখা-চোখা কথা আর গালাগালের সঙ্গে পরিচিত হয়। তার সঙ্গে জুড়ে যায় তাঁর হঠাৎ দিলদার হয়ে মানুষকে সাহায্য করা, একটা বহু-ব্যবহারে জীর্ণ মান্ধাতার আমলের ড্রেসিং গাউন পরে থাকা, রোজ বাঁধাকপির স্যুপ আর ক্যাভিয়ার খাওয়া, বেড়াল দেখলেই অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠা… এমন আরও নানা কিংবদন্তি। এগুলো লোকে জানে।

পোয়ারোও এটুকুই জানেন।

একেবারে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পা মিলিয়ে, ঠিক সাড়ে ন’টায় পোয়ারো কলিং বেল বাজালেন। ‘বাটলার’ নামক প্রাণীটি ঠিক যেমন দেখতে হওয়া উচিত, তেমনই একজন দরজা খুলে দাঁড়াল।

“মিস্টার বেনেডিক্ট ফারলে…?” পোয়ারো জানতে চাইলেন।

পোয়ারোর আপাদমস্তক শুধু দেখে নয়, প্রায় মেপে নিয়ে বাটলারটি সবিনয়ে জানতে চাইল, “আপনার কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে স্যার?”

“আছে। আমার নাম মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।”

বাটলার পিছিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে ধরল। পোয়ারো ঢুকলেন। তাঁর টুপি আর ছড়িটা নিয়ে বাটলার আবার জিজ্ঞেস করল, “কিছু মনে করবেন না স্যার। তবে আমাকে বলা হয়েছিল, আপনার কাছে একটা চিঠি থাকবে।”

পোয়ারো কথা না বাড়িয়ে চিঠিসুদ্ধ হাতটাই বাড়িয়ে দিলেন। চিঠিটাতে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল বাটলার।

চিঠিতে লেখা কথাগুলো পোয়ারো খুব সহজেই মনে করতে পারলেন।

“নর্থওয়ে হাউস, ডব্লিউ.৮.

মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো

ডিয়ার স্যার,

মিস্টার বেনেডিক্ট ফারলে কয়েকটি বিষয়ে আপনার পরামর্শ চান। আপনি যদি ওপরে লেখা ঠিকানায় কাল (বৃহস্পতিবার) রাত সাড়ে ন’টায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তাহলে তিনি খুশি হবেন।

বিনীত,

হিউগো কর্নওয়ার্দি

(সেক্রেটারি)

পুনশ্চ: এই চিঠিটা দয়া করে সঙ্গে আনবেন।”

“আপনি কি মিস্টার কর্নওয়ার্দি-র ঘরে আসবেন স্যার? মিস্টার ফারলে ওখানেই অপেক্ষা করছেন।”

আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা ছবি, মূর্তি, আর অন্যান্য জিনিসগুলো দেখায় তন্ময় হয়ে ছিলেন পোয়ারো। বাটলারের কথা শুনে, মাথা নেড়ে সায় দিয়ে তিনি তার পেছন-পেছন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন।

দোতলায় একটা ঘরের দরজায় নক্‌ করল বাটলার। ভেতর থেকে জড়ানো গলায় একটা আওয়াজ ভেসে এল। বাটলার দরজা খুলে বলল, “যাঁর আসার কথা ছিল, সেই ভদ্রলোক এসেছেন স্যার।”

পোয়ারো ঘরে ঢুকলেন।

বড়ো ঘরটাতে দেওয়াল-ঘেঁসা বেশ কয়েকটা ফাইলিং ক্যাবিনেট, বুকশেলফ, কয়েকটা চেয়ার, আর একটা বিশাল টেবিল, এগুলোই দেখতে পেলেন পোয়ারো। ঘরের কোণগুলো অন্ধকার হয়ে ছিল, কারণ পুরো ঘরে মাত্র একটা আলো জ্বলছিল।

একটা আরামকেদারার ধার থেকে, সবুজ শেড-বসানো, প্রায় দেড়শো ওয়াটের বাল্ব লাগানো একটা ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলো এসে পড়ছিল দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকা পোয়ারোর ওপর।

চোখ মিটমিট করে কিছুটা সইয়ে নিলেন পোয়ারো। তারপর তিনি দেখতে পেলেন, আলোর পেছনে, ওই আরামকেদারায় বসে আছেন একজন রোগা মানুষ। পরনের মলিন ড্রেসিং গাউন, সামনে ঝুঁকে বসার মধ্যে একটা অদ্ভুত আগ্রাসী ভঙ্গি, চওড়া কপালে নেমে আসা অবাধ্য সাদা চুলের গোছা, টিকালো নাক, চশমার পুরু কাচের আড়ালে কুঁচকে থাকা সন্দিগ্ধ চোখজোড়া, এসবই মানুষটির পরিচয় দিচ্ছিল।

“তাহলে আপনিই এরকুল পোয়ারো, তাই তো?” খসখসে গলায়, ততোধিক রুক্ষ ভঙ্গিতে বয়স্ক মানুষটি জানতে চাইলেন।

“আজ্ঞে হ্যাঁ।” মাথা ঠান্ডা রেখে বললেন পোয়ারো।

“বসুন-বসুন!” বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন মানুষটি। পোয়ারো একটা চেয়ারে বসলেন।

উজ্জ্বল আলোর পেছন থেকে পোয়ারোকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখলেন ভদ্রলোক। তারপর হঠাৎ করে বলে উঠলেন, “আমি কী করে জানব যে আপনিই পোয়ারো?”

মুখে কিছু না বলে পোয়ারো চিঠিটা আবার বাড়িয়ে ধরলেন। “হ্যাঁ।” ভদ্রলোক চিঠিটা পড়ে মাথা নাড়লেন, “আমি কর্নওয়ার্দি-কে এটাই ডিক্টেট করেছিলাম।”

“আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন?” পোয়ারো চিঠিটা পকেটে রেখে বলেন।

“কথা?” বেনেডিক্ট ফারলে-র মুখে একটা তিক্ত হাসি ফুটে ওঠে। “হ্যাঁ। অর্থপূর্ণ কথা। আপনার পক্ষে অর্থকরীও বটে।”

পোয়ারো হতাশ হচ্ছিলেন।

অনেক ধনীকে দেখেছেন পোয়ারো, দেখেছেন তাঁদের অদ্ভুত আচার-ব্যবহার, খেয়াল, মেজাজ। অথচ আলোর পেছনে বসে থাকা মানুষটির আচরণে পোয়ারো সেই বড়োলোকিয়ানার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাঁর পরনের ড্রেসিং গাউন থেকে শুরু করে উচ্চারণ, সবকিছুর মধ্যে একটা নাটুকে ভাবই বরং স্পষ্ট হচ্ছিল।

“আপনি আমার কাছ থেকে ঠিক কী ধরনের পরামর্শ চাইছেন, মিস্টার ফারলে?” ঠান্ডা, নিস্পৃহ প্রশ্ন করলেন পোয়ারো।

“আপনি স্বপ্ন সম্বন্ধে কী জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো?”

পোয়ারোর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। এই প্রশ্নটা, এমনকি তাঁকেও, অবাক করেছে।

“আপনি ‘বুক অফ ড্রিমস’ পড়লে,” ঠান্ডা গলাতেই উত্তর দিলেন পোয়ারো, “বা হার্লে স্ট্রিটের কোনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে ঠিকঠাক উত্তর পাবেন।”

“আমি দুটোই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু…!”

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ফারলে আবার কথা বলতে শুরু করলেন। প্রথমে নীচু স্বরে, তারপর আস্তে-আস্তে জোর গলায়।

“একই স্বপ্ন… রাতের পর রাত! প্রত্যেক রাতে সেই একই জিনিস। আমি পাশের ঘরটায় বসে আছি, নিজের টেবিলে। কিছু কাজ করছি। হঠাৎ আমার নজর পড়ছে ঘড়ির দিকে। দেখছি, তখন সময় ঠিক তিনটে বেজে আঠাশ।

আর তখনই… ঠিক তক্ষুনি আমার মনে হচ্ছে, আমাকে কাজটা করতে হবে। করতেই হবে। আমার শরীর বিদ্রোহ করে, মন অসাড় হয়ে যায় কাজটার কথা ভাবলেই। কিন্তু তবু কাজটা…!”

“কী কাজ?” শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেন পোয়ারো, “কী করতে হয় আপনাকে?”

“বেলা তিনটে বেজে আঠাশ মিনিটে,” ভাঙা গলায় জোর ফিরিয়ে আনেন ফারলে, “আমি আমার ডেস্কের ডানদিকের দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুলি। সেখান থেকে আমার রিভলভারটা বের করি। তাতে গুলি ভরে জানলার কাছে যাই। আর তারপর… তারপর…”

“তারপর?”

“আমি নিজেকে গুলি করি।” ফিসফিসিয়ে বলেন ফারলে।

ঘর নিঃশব্দ হয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর পোয়ারো জিজ্ঞেস করেন, “এটাই আপনার স্বপ্ন?”

“হ্যাঁ।”

“রোজ রাতে এটাই দেখেন আপনি?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি নিজের দিকে গুলি চালানোর পর কী হয়?”

“আমার ঘুম ভেঙে যায়।”

“আপনি কি সত্যিই ওই ড্রয়ারটাতে একটা রিভলভার রাখেন?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“আমার মতো লোকের শত্রু নেহাত কম নেই মঁসিয়ে পোয়ারো।” বিরক্ত কণ্ঠে বলেন ফারলে। “আমাকে আত্মরক্ষার জন্য তৈরি থাকতেই হয়।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন পোয়ারো, তারপর নীচু স্বরে বললেন, “আমার কাছ থেকে আপনি কী জানতে চাইছেন?”

“আমি এখনও অবধি তিনজন ডাক্তারকে কনসাল্ট করেছি। প্রথমজন বয়স্ক। তিনি বললেন, আমার খাওয়াদাওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। দ্বিতীয়জন অল্পবয়সী এবং ‘আধুনিক’ চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী! তাঁর বক্তব্য, আমার জীবনে ওই দুপুর তিনটে বেজে আঠাশে এমন কিছু একটা হয়েছিল, যেটা ভোলার জন্য আমি বদ্ধপরিকর। ওই সময়ে নিজেকে ‘ধ্বংস’ করার প্রতীকী পদ্ধতিতে আমি ব্যাপারটা স্থায়ীভাবে ভুলতে চাই।”

“আর তৃতীয়জন?”

ফারলের গলা রাগে তীব্র, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।

“তৃতীয়জন… তিনিও কমবয়সী। কিন্তু তাঁর আইডিয়া এক্কেবারে গাঁজাখুরি। তাঁর বক্তব্য, আমি নিজের জীবন নিয়ে, নিজেকে নিয়ে এতটাই তিতিবিরক্ত ও ক্লান্ত যে আমি সবকিছু শেষ করে দিতে চাইছি। অন্য সময় আমার মনের জোরের দাপটে এই ভাবনাগুলো সামনে আসতে পারে না। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে সেই অবরোধগুলো থাকে না। তাই তখন, ঘুমের মধ্যে, আমি এমন একটা কাজ করি যেটা নাকি আমি সত্যিই করতে চাই!”

“হুঁ।” পোয়ারো গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। “তার মানে, তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, আপনি আত্মহত্যা করতেই চান?”

“ঠিক তাই।” চেঁচিয়ে ওঠেন ফারলে। “এর চেয়ে বড়ো মিথ্যে আর কিছু হতে পারে না মঁসিয়ে পোয়ারো! আমার সব আছে। এই জীবন আমি হঠাৎ শেষ করে দিতে চাইব কেন?”

পোয়ারো প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু সামনে বসা মানুষটির গলার স্বর, অভিব্যক্তি, এসব তাঁকে অন্য কিছুই বলছিল। শান্ত গলায় তিনি প্রশ্ন করেন, “কিন্তু এসবে আমার কী ভূমিকা?”

বেনেডিক্ট ফারলে হঠাৎ শান্ত হয়ে যান। টেবিলে আঙুলটা ঠুকতে-ঠুকতে তিনি বলেন।

“আর একটা সম্ভাবনা আছে। আর যদি সেটাই সত্যি হয়, তাহলে আপনিই সেটা বলতে পারবেন। এত কেস নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন আপনি। আপনি নিশ্চয় জানবেন ব্যাপারটা।”

“কোন ব্যাপারটা?”

“হিপনোটিজম।” বিরক্ত হন ফারলে। “সম্মোহনের মাধ্যমে যদি আমার মাথায় এই… এই আত্মহত্যার ব্যাপারটা গেঁথে দিয়ে, আমার কোনো শত্রু যদি আমাকে সেই পথেই চালিত করতে চায়? এভাবেও তো খুন করা যায়, তাই না?”

“যদি এমন হয়,” পোয়ারো থেমে-থেমে বলেন, “তাহলে একজন ডাক্তারই ঠিকঠাক পরামর্শ দিতে পারবেন আপনাকে।”

“আপনি এমন কোনো কেস দেখেননি আপনার জীবনে?”

“না।”

“কিন্তু এমন হতে তো পারে!”

“কী হতে পারে সেটা… কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে।” পোয়ারো ফারলেকে খুঁটিয়ে দেখেন, তারপর বলেন, “আপনাকে কে খুন করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”

“কেউ না!”

“তাহলে আপনার এমনটা মনে হল কেন?”

“আমি জানতে চাইছিলাম, এমনটা হতে পারে কি না।”

“না। পারে না।” পোয়ারো স্থির গলায় বলেন। “আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এটা হওয়া অসম্ভব, যদি না… আপনি স্বেচ্ছায় কারও দ্বারা সম্মোহিত হয়ে এসব ভাবেন।”

“কী যা-তা বলছেন?” রেগে ওঠেন ফারলে। “আমি এসব জিনিসে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই।”

“তাহলে তো হয়েই গেল।” বলেন পোয়ারো, “আপনার স্বপ্নটা বেশ ইন্টারেস্টিং, তবে… আমি একবার ‘অকুস্থল’-টা দেখতে চাই। সেই টেবিল, সেই ড্রয়ার, সেই রিভলভার। ওগুলো একবার দেখা যেতে পারে?”

“অবশ্যই। এই পাশের ঘরেই তো…” ড্রেসিং গাউনটা ভালোভাবে জড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে প্রায় উঠে পড়েছিলেন ফারলে, কিন্তু হঠাৎ করে একটা কিছু মনে পড়ল তাঁর। আবার চেয়ারটায় বসে পড়লেন তিনি।

“না।” ফারলে বললেন, “নতুন করে ওখানে দেখার কিছু নেই। যা বলার, তার সবটাই আমি আপনাকে বলেছি।”

“কিন্তু আমি নিজে একবার না দেখলে কীভাবে…?”

“তার কোনো দরকার নেই।” ঝাঁঝিয়ে ওঠেন ফারলে, “আপনি আপনার মতামত দিয়ে দিয়েছেন। এর বেশি সময় আপনাকে আর নষ্ট করতে হবে না। আপনার বিলটা আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। ব্যাস।”

“আমি দুঃখিত।” উঠে দাঁড়িয়ে বলেন পোয়ারো, “কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না।”

“চিঠিটা দিন।” হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দেন ফারলে।

“চিঠি… মানে যেটা আপনার সেক্রেটারি আমাকে লিখেছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

পোয়ারো-র ভ্রূজোড়া আবার কুঁচকে গেল। তবে পেশাগত সংযম তাঁর মুখ বন্ধ রাখল। পকেট হাতড়ে ভাঁজ করা কাগজটা এগিয়ে ধরলেন তিনি। কাগজটা নিয়ে, তাতে একবার চোখ বুলিয়ে, সেটা পাশের টেবিলে রেখে দিলেন ফারলে।

কিছুটা উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘরের দরজার কাছে এলেন পোয়ারো। যে গল্পটা তাঁকে বলা হয়েছে, সেটার পাশাপাশি আরও একটা অস্বস্তি তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কী যেন একটা ভুল…

হাতলে হাত রেখেই ব্যাপারটা খেয়াল হল তাঁর।

“আমি খুব-খুব লজ্জিত!” পোয়ারো বলেন, “বেখেয়ালে আমি আপনাকে একটা ভুল কাগজ দিয়ে ফেলেছি। চিঠিটা আমার বাঁ পকেটে আছে। তার বদলে আমি আপনাকে ডান পকেটের কাগজটা দিয়ে ফেলেছি।”

“তার মানে?” চেয়ারে বসা মানুষটি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। “আপনি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছেন নাকি?”

“আজ্ঞে না।” সবিনয়ে বলেন পোয়ারো। “যে কাগজটা আমি আপনাকে দিয়েছিলাম সেটা আমার ধোপাবাড়ির। তারা আমার স্যুটটা বরবাদ করার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে ওটা লিখেছিল। আপনার সেক্রেটারির চিঠিটা…” বাঁ পকেট থেকে কাগজটা বের করে আনেন পোয়ারো, “এই যে!”

“কাকে কী দিচ্ছেন সেটুকুও দেখেন না কেন?” রেগে গজগজ করেন ফারলে। পোয়ারো আরও একবার সবিনয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন। তারপর বেরিয়ে আসেন।

নীচে বাটলারের কাছ থেকে নিজের টুপি ও ছড়ি উদ্ধার করে, একটা ট্যাক্সি ডেকে দেওয়ার প্রস্তাব উপেক্ষা করে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন পোয়ারো। কিন্তু এই সাক্ষাৎকার, আর তার সুবাদে শোনা গল্পের দুর্বোধ্যতা নিয়ে একটা অস্বস্তি তাঁর মনে থেকেই যায়।

এক সপ্তাহ পরের কথা। ডক্টর জন স্টিলিংফ্লিট, এম.ডি-র ফোন এল পোয়ারো-র কাছে।

“মঁসিয়ে পোয়ারো? আমি নর্থওয়ে হাউজ থেকে বলছি। বেনেডিক্ট ফারলে-র বাড়ি।”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলেন পোয়ারো। তারপর বললেন, “বলুন ডক্টর।”

“ফারলে মৃত। আজ বিকেলে আত্মহত্যা করেছেন ভদ্রলোক।”

“তাহলে…

“ফারলের কাগজপত্রের মধ্যে আপনার সঙ্গে ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট বিষয়ক একটা কাগজও পেয়েছে পুলিশ। পরিবারের ডাক্তার তথা বন্ধু হিসেবে আমি সেটা দেখেছি। পুলিশ এসব ক্ষেত্রে একটু ধীরে চলার নীতি নেয়, জানেনই তো। কোটিপতির আত্মহত্যা… ইত্যাদি-ইত্যাদি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি হয়তো এই ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারেন।”

“আমি আসছি।” সংক্ষেপে এটুকু বলে পোয়ারো ফোন নামিয়ে রাখেন। তারপর রওনা হন গন্তব্যের দিকে।

ঘণ্টাখানেক পর নর্থওয়ে হাউজের স্টাডিতে বসেছিলেন পোয়ারো। তিনি বাদে ঘরে ছিলেন আর পাঁচজন।

গম্ভীর, মিলিটারি চলনবলনের অধিকারী ইন্সপেক্টর বার্নেট।

বছর ত্রিশেক বয়সের ছটফটে ডক্টর স্টিলিংফ্লিট।

সদ্য বিধবা, বেনেডিক্ট ফারলে-র চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো, দৃঢ় চোয়াল আর গভীর কালো চোখের আড়ালে মনের ভাব লুকিয়ে রাখা সুন্দরী মিসেস ফারলে।

বেনেডিক্ট ফারলে-র মেয়ে জোয়ানা ফারলে। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া দেখে পোয়ারো বুঝলেন, বেনেডিক্টের চিবুক আর নাক-ই শুধু নয়, তাঁর বাস্তববুদ্ধিও উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন জোয়ানা।

বেনেডিক্টের সেক্রেটারি, তরুণ, শান্ত, সুদর্শন হিউগো কর্নওয়ার্দি।

পরিচয়ের পালা শেষ হওয়ার পর পোয়ারো বেনেডিক্ট ফারলে-র সঙ্গে তাঁর দেখা, এবং ফারলে-র স্বপ্নের ব্যাপারটা সবাইকে বলেন।

“অদ্ভুত!” বললেন ইন্সপেক্টর। “এই স্বপ্নের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি কিছু জানতেন মিসেস ফারলে?”

“জানতাম।” বললেন মিসেস ফারলে। “উনি এই ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করছিলেন। আমি বলেছিলাম উনি যেন ডক্টর স্টিলিংফ্লিটের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেন।”

“আমার সঙ্গে এই নিয়ে উনি কোনো কথা বলেননি।” বলে উঠলেন তরুণ ডাক্তারটি। “মঁসিয়ে পোয়ারো-র কথা শুনে মনে হচ্ছে, মিস্টার ফারলে সরাসরি হার্লে স্ট্রিটের ডাক্তারদের পরামর্শ চেয়েছিলেন।”

“ডাক্তাররা ওঁকে যা বলেছিলেন,” পোয়ারো সামনে ঝুঁকে পড়েন, “সেই বিষয়ে আপনার কী বক্তব্য ডক্টর?”

“একটা কথা এখানে মাথায় রাখা দরকার।” স্টিলিংফ্লিটের মুখে অস্বস্তি প্রকট হয়। “মিস্টার ফারলে-কে যা বলা হয়েছিল, আর উনি আপনাকে যা বলেছিলেন, তা কিন্তু এক নয়, হতে পারে না। আপনাকে যা বলা হয়েছিল, সেগুলো… সাধারণ মানুষের বর্ণনা। ডাক্তাররা, বা বিশেষজ্ঞরা কিন্তু ঠিক এইরকম ব্যাখ্যা দেবেন না।”

“হুঁ।” চিন্তিতভাবে বললেন পোয়ারো, “উনি কোন্‌ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সে ব্যাপারে কেউ আলোকপাত করতে পারবেন?”

মিসেস ফারলে ‘না’ বোঝালেন। জোয়ানা ফারলে স্পষ্ট গলায় বলেই ফেললেন, “উনি কোনো ডাক্তারের পরামর্শ চেয়েছিলেন, এমনটাই জানতাম না। এমনকি এই স্বপ্নের ব্যাপারেও উনি আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।”

হিউগোর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন পোয়ারো। উত্তর এল, “আজ্ঞে না। মিস্টার ফারলে-র ডিকটেশন অনুযায়ী আমি আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম ঠিকই। তবে আমার ধারণা ছিল, উনি আপনাকে দিয়ে ব্যবসার ব্যাপারে কোনো তদন্ত করাতে চাইছেন।”

পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ইন্সপেক্টর বার্নেটের দিকে তাকিয়ে বলেন, “এই আত্মহত্যাটা কীভাবে আবিষ্কৃত হল, সেটা একটু বলবেন?”

“রোজ দুপুরে মিস্টার ফারলে একা নিজের ঘরে বসে কাজের সঙ্গে জড়িত কাগজপত্র দেখতেন। সেদিনও তাই করছিলেন তিনি। দু’জন সাংবাদিক সোয়া তিনটেয় তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলেন। শুনেছি, এটা নাকি সাংঘাতিক বিরল ঘটনা, মোটামুটি বছর পাঁচেকে একবার করে হয়! তিনটে কুড়ি নাগাদ মিস্টার ফারলেকে কিছু কাগজ দিতে আসে একজন। দরজা খুলে কাগজ নিতে গিয়ে উলটোদিকে বসা দুই সাংবাদিককে দেখে বেনেডিক্ট বলেন, ‘আমাকে আরেকটু সময় দিতে হবে আপনাদের। এই কাগজগুলো দেখা একটু জরুরি।’ তাতে সাংবাদিকেরা কোনো আপত্তি করেননি।

বেনেডিক্ট ফারলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেন। তারপর তাঁকে আর কেউ জীবিত দেখেনি।”

“মৃতদেহ কে প্রথম দেখেন?”

“বিকেল চারটের একটু পরে মিস্টার কর্নওয়ার্দি তাঁর ঘর থেকে, মানে ঠিক পাশের ঘরটা থেকে, বেরিয়ে আসেন। কয়েকটা চিঠিতে মিস্টার ফারলে-কে দিয়ে সই করানো দরকার ছিল। দুই সাংবাদিককে তখনও অপেক্ষা করতে দেখে কর্নওয়ার্দি ঠিক করেন, তিনি মিস্টার ফারলে-র সই নেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে এই সাক্ষাৎকারের ব্যাপারটাও মনে করিয়ে দেবেন। ঘরে ঢুকে কর্নওয়ার্দি একটু অবাকই হয়ে গেছিলেন, কারণ মিস্টার ফারলে-কে তিনি প্রথমে কোথাও দেখতে পাননি। তারপর, টেবিলের পেছন থেকে বেরিয়ে থাকা জুতো পরা একটা পা দেখে তিনি সেদিকে গিয়ে মিস্টার ফারলে, আর তার হাতের কাছে পড়ে থাকা একটা রিভলভার দেখতে পান।”

“তারপর?”

“কর্নওয়ার্দি প্রথমে ডক্টর স্টিলিংফ্লিট-কে, আর তারপর পুলিশকে খবর দেন।”

“কেউ কিছু শোনেনি?”

“ঐ ঘরের পেছনেই কারখানার দেওয়াল। তার সঙ্গে, দু’পাশের রাস্তাতেই গাড়ির আওয়াজ খুব বেশি। এত আওয়াজে গুলির শব্দটা চাপা পড়ে গেছিল।”

“মৃত্যুর সময়টা…?”

“আমি এখানে এসেই শরীরটা পরীক্ষা করেছিলাম।” বলেন ডক্টর স্টিলিংফ্লিট। “তখন চারটে বত্রিশ। আমার হিসেব বলছে, মিস্টার ফারলে ঘণ্টাখানেক আগে মারা গেছিলেন।”

“তাহলে, আপনার হিসেবমতো বেনেডিক্ট ফারলে-র মৃত্যুর সময়টা তাঁর, আমাকে বলা ‘আত্মহত্যা’-র সময়ের খুব কাছাকাছি।” পোয়ারো-র মুখে আঁধার ঘনাল। “রিভলভারটা থেকে কী জানা গেল?”

“ওটা মিস্টার ফারলে-র ডেস্কের ডানদিকের দ্বিতীয় ড্রয়ারেই থাকত, ঠিক যেমনটা উনি আপনাকে বলেছিলেন। আর তাতে শুধু ওঁরই হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।”

“তাহলে এই মৃত্যুটাকে আত্মহত্যাই ভাবতে হচ্ছে।”

“মাত্র একটা জিনিস না পেলে আমাদের অন্য কিচ্ছু ভাবতে হত না মিস্টার পোয়ারো।” ইন্সপেক্টর বার্নেটের মুখে একটা ক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠল।

“সেটা কী?”

“আপনাকে লেখা চিঠিটা।”

“হুঁ।” পোয়ারো-র ঠোঁটটাও কুঁচকে ওঠে। “যেখানে এরকুল পোয়ারো, সেখানেই … খুন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।” বলেন ইন্সপেক্টর বার্নেট, “তবে এখন তো আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামানোর মতো কিছু নেই।”

“এক মিনিট!” মৃদু হেসে বলেন পোয়ারো। “এসে যখন পড়েইছি, তখন… আচ্ছা মিসেস ফারলে, আপনার স্বামী কি কখনও সম্মোহিত হয়েছিলেন?”

“আপনি ওই স্বপ্নটার কথা ভাবছেন, তাই না?” মিসেস ফারলে-র গলাটা আতঙ্কে আর শোকে রুদ্ধ হয়ে যায়। “না মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার স্বামী কখনও সম্মোহিত হননি, এই নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহও ছিল না। শুধু ওই স্বপ্নটা…! রাতের-পর-রাত! ওঁর কথা শুনে মনে হত, সব শেষ না হওয়া অবধি যেন উনি শান্তি পাবেন না।”

বেনেডিক্ট ফারলে-র কথাগুলো পোয়ারো-র কানে নতুন করে আছড়ে পড়ল। “… আমি এমন একটা কাজ করি যেটা নাকি আমি সত্যিই করতে চাই!”

“আপনার স্বামীর কোনো আচরণ দেখে আপনার কখনও মনে হয়েছিল,” নীচু স্বরে জানতে চাইলেন পোয়ারো, “যে উনি নিজেকে… শেষ করে দিতে চান?”

“না। তবে…” মিসেস ফারলে-র গলাটা ভেঙে যায়, “কখনও-কখনও মনে হত যেন…”

“বাবা আত্মহত্যা করতে পারেন না মঁসিয়ে পোয়ারো।” জোয়ানা ফারলে-র স্পষ্ট গলাটা ঘরের সংশয়াচ্ছন্ন আবহাওয়ার মধ্যে একটা জোরালো আলোর মতো ঝলসে উঠল। “বেনেডিক্ট ফারলে নিজের ব্যাপারে খুব বেশিরকম সতর্ক থাকতেন। ওসব ভাবনাও তিনি প্রশ্রয় দিতেন না।”

“যাঁরা আত্মহত্যা করার কথা বলে,” ডক্টর স্টিলিংফ্লিট প্রতিবাদ করলেন, “বাস্তবে কিন্তু তাঁরা নয়, বরং অন্যরাই আত্মঘাতী হয়। সেজন্যই অর্ধেক আত্মহত্যার কোনো মাথামুন্ডু খুঁজে পাই না আমরা।”

একটা বড়ো শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। ইন্সপেক্টর বার্নেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যেখানে এই … ঘটনাটা ঘটেছে, সেই ঘরটা কি একবার দেখা যায়?”

“অবশ্যই।” শশব্যস্ত হন বার্নেট। তাঁর ইশারায় স্টিলিংফ্লিট পোয়ারো-কে সঙ্গে নিয়ে দোতলায় সেই ঘরে ঢোকেন, যেখানে গতবার পোয়ারো প্রবেশাধিকার পাননি।

এবার আর তাঁকে আটকানোর কেউ ছিল না।

“অদ্ভুত!” স্টিলিংফ্লিট বলি-বলি করে শেষে বলেই ফেলেন কথাটা। “এমন একজন ধনী মানুষ নিজের জন্য এমন একটা জেলখানা টাইপের ঘর বেছেছিলেন কেন?”

বেনেডিক্ট ফেরেল-এর মনস্তত্ত্বের জটিলতায় না গিয়েও পোয়ারো একমত হলেন। জানলা দিয়ে দেখা ন্যাড়া ইটের বিশাল লম্বা দেওয়াল, দু’পাশের রাস্তা দিয়ে মাথা খারাপ করে দেওয়া আওয়াজ তুলে যাতায়াত করতে থাকা লরি-র সারি, এর মধ্যে স্বেচ্ছায় থাকা মানে হাজতবাসই বটে।

পোয়ারো-র নজর পড়ে টেবিলের ওপর রাখা একটা আঁকশির ওপর। সেটাকে যথাসম্ভব লম্বা করে, তাই দিয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা একটা দেশলাইয়ের কাঠিকে আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলতে গিয়ে পোয়ারো-র মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।

“আপনার খেলাধুলো যদি শেষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমরা এবার…” বিরক্ত গলায় বলেন স্টিলিংফ্লিট।

“জিনিসটা খুব কাজের।” বলে আঁকশিটা আবার টেবিলে রেখে পোয়ারো স্টিলিংফ্লিটের দিকে ঘোরেন, “মৃত্যুর সময় কে কোথায় ছিলেন?”

“মিসেস ফারলে এর ওপরের তলায় নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মিস ফারলে চিলেকোঠায়, নিজের স্টুডিওতে ছবি আঁকছিলেন।”

টেবিলে আঙুল দিয়ে কিছুক্ষণ টরে-টক্কা তুললেন পোয়ারো, তারপর বললেন, “মিস ফারলে, মানে জোয়ানা-কে একবার ডেকে দেবেন?”

পোয়ারো-র দিকে কৌতূহলী চোখে একবার তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন স্টিলিংফ্লিট। একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন জোয়ানা ফারলে।

“ব্যাপারটা হয়তো বড়ো রূঢ় দেখাবে।” মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলেন পোয়ারো, “তবু আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে আপনার কাছে।”

“আপনি নিঃসংশয়ে যা খুশি জিজ্ঞেস করতে পারেন মঁসিয়ে পোয়ারো।” জোয়ানা পোয়ারো-কে আশ্বস্ত করেন।

“আপনি কি জানতেন যে আপনার বাবা এই ড্রয়ারটাতে একটা রিভলভার রাখেন?”

“না।”

“গত বৃহস্পতিবার আপনি আর আপনার মা… সৎ-মা… কোথায় ছিলেন?”

“গত বৃহস্পতিবার?” জোয়ানা-র ভ্রূ কুঁচকে ওঠে। “ও, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমরা সিনেমা দেখতে গেছিলাম।”

“আপনার বাবা আপনার সঙ্গে যাননি?”

“আমার বাবা!” জোয়ানা-র মুখটা ক্লিষ্ট হাসিতে ভরে যায়। “তাঁর মতো তিতকুটে মেজাজ খুব কম মানুষেরই হয়… হত মঁসিয়ে পোয়ারো। সিনেমা দেখার মানুষ তিনি ছিলেন না। একটি ছেলে… গরিব, কিন্তু সৎ, আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। বাবা তাকে বরখাস্ত করেন, কারণ তিনি ভেবেই রেখেছিলেন, আমাকে তাঁর ইচ্ছেমতো জায়গাতেই বিয়ে করতে হবে।”

“আপনার স্পষ্ট কথাগুলো শুনে ভালো লাগছে মাদমোঁয়াজেল।” গম্ভীর গলায় বলেন পোয়ারো। “কিন্তু আপনি আপত্তি করেননি কেন?”

“আমার আপত্তি করার কোনো সুযোগই ছিল না। এই বাড়ি ছাড়া আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাছাড়া…” জোয়ানার গলাটা তরল হয়ে যায়, “বাবা-র মৃত্যুর পর লুইস,মানে আমার সৎ-মা একটা মোটা টাকা পেলেও বাকি সম্পত্তি আমারই হওয়ার ছিল।”

“আমার আর দুটো প্রশ্ন আছে।” পোয়ারো বলেন, “প্রথমটা হল, এই আঁকশিটা কি এই টেবিলেই রাখা থাকত?”

“হ্যাঁ। বাবা নীচু হয়ে কিছু তোলা পছন্দ করতেন না বলে এটা দিয়েই জিনিস-টিনিস তুলতেন।”

“দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনার বাবা-র দৃষ্টিশক্তি কেমন ছিল?”

“খুব খারাপ। চশমা ছাড়া বাবা প্রায় অন্ধই ছিলেন।”

“আর চশমা পরে?”

“তখন একদম স্পষ্ট দেখতে পেতেন। খুদে-খুদে হরফও পড়তে পারতেন।”

জোয়ানা ফারলে-কে বিদায় জানিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বের করে নীচে তাকালেন পোয়ারো। কারখানার দেওয়াল আর বাড়ির পাঁচিলের মাঝে একটা ছোটোখাটো কালচে জিনিসের অস্তিত্ব ওপর থেকেও বোঝা গেল। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লেন পোয়ারো।

তাঁর হিসেব মিলেছে।

স্টাডিতে তখনও বসে ছিলেন সবাই। পোয়ারো সেক্রেটারিকেই ধরলেন আগে।

“আমাকে ডেকে পাঠানোর ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো মিস্টার কর্নওয়ার্দি। মানে ঠিক কখন মিস্টার ফারলে আপনাকে এই ব্যাপারে নির্দেশ দেন?”

“বুধবার বিকেলে মিস্টার ফারলে আপনার উদ্দেশে চিঠিটা ডিক্টেট করে বলেন, আমি যেন নিজেই চিঠিটা পোস্ট করি।”

“তারপর?”

“হোমস, মানে বাটলারকে যেন আমি বলে রাখি, সেদিন চিঠিটা দেখে নিঃসংশয় হলে তবেই সে যেন আপনাকে ঢুকতে দেয়। মিস্টার ফারলে এও বলেন যে তিনি আমার ঘরে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। তাই আমাকে বৃহস্পতিবার সন্ধেটা ছুটি দেওয়া হয়।”

“আদেশগুলো আপনার কানে একটু… অন্যরকম ঠেকেনি?”

“ঠেকেছিল, তবে,” কাঁধ ঝাঁকান কর্নওয়ার্দি, “মিস্টার ফারলে নিজে তো অন্যরকম মানুষই ছিলেন।”

হোমস, অর্থাৎ বাটলারের কাছ থেকেও নতুন কিছু জানা গেল না। সে জানাল যে হিউগো কর্নওয়ার্দি তাকে এই কাজগুলোই করতে বলে সাড়ে আটটা নাগাদ বেরিয়ে যান, ফেরেন অনেক পরে।

“আপনার স্বামীর নজর কেমন ছিল মাদমোঁয়াজেল?” হঠাৎ করেই পোয়ারো জানতে চান মিসেস ফারলে-র দিকে ঘুরে।

“নজর…” একটু অস্বস্তিতে পড়েও সামলে নেন মিসেস ফারলে। “আপনি ওঁর দৃষ্টিশক্তির কথা বলছেন? খুব খারাপ! চশমা ছাড়া উনি প্রায় অন্ধই ছিলেন বলা চলে।”

“ওঁর কি একাধিক চশমা ছিল?”

“অবশ্যই।”

“আহ্‌!” একটা পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলেন পোয়ারো। “বোঝা গেল।”

সবাই হাঁ করে পোয়ারো-র দিকে তাকিয়ে রইলেন। মিসেস ফারলেই প্রশ্নটা করলেন, “কী বোঝা গেল?”

“সবটাই। বেনেডিক্ট ফারলে-র মৃত্যু, আমাকে ডেকে পাঠানো, ওই স্বপ্ন…!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন পোয়ারো। “সেদিন সন্ধেবেলায় বেশ কিছু জিনিস হয়েছিল যেটার কোনো মানেই খুঁজে পাইনি আমি। যেমন ধরুন, আমাকে চিঠিটা কেন নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল?”

“পরিচয়পত্র হিসেবে…” কর্নওয়ার্দি কথাটা বলতে গিয়েও চুপ করে যান।

“হাসালেন।” পোয়ারো সত্যিই হেসে ফেলেন। “তার জন্য অন্য অনেক কিছু আছে। তাছাড়া সেদিন আমাকে শুধু চিঠিটা সঙ্গে করে আনতেই হয়নি, মিস্টার ফারলে খুব স্পষ্টভাবে আমার কাছ থেকে সেটা চেয়েও নিয়েছিলেন।

কেন বলুন তো?”

“যাতে ওঁর কিছু হলেও” জোয়ানা ফারলে বলে ওঠেন, “আমরা জানতে পারি যে উনি আপনাকে ডেকেছিলেন।”

“একদম ঠিক বলেছেন।” পোয়ারো সহমত হন। “ওই চিঠিটা চেয়ে নেওয়ার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল। মিস্টার ফারলে-র মৃত্যুর পর তাঁর কাগজের মধ্যে ওটা পেলে আমাকে ডাকা হবেই, এবং তখন আমার মুখেই সবাই শুনবে সেই সন্ধ্যায় শোনা ওই অবিশ্বাস্য স্বপ্নের কথা।”

ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা শ্বাসরোধী হয়ে উঠল। কিন্তু পোয়ারো নির্বিকারভাবে বলে চললেন, “আরও একটা ব্যাপার ভাবুন। স্বপ্নের কথাটা শোনার পর আমি যখন মিস্টার ফারলে-কে অনুরোধ করলাম, পাশের ঘরটা, বিশেষত ওই ড্রয়ার আর রিভলভারটা দেখাতে, তখন তিনি প্রথমে রাজি হয়েছিলেন, এমনকি উঠেও দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তারপর তিনি সোজা ‘না’ বলে দেন। কেন?”

কোনো উত্তর এল না। পোয়ারো আবার বললেন, “আচ্ছা বেশ। প্রশ্নটা আমি একটু অন্যভাবে করি। পাশের ঘরে তখন কী ছিল, যেটা মিস্টার ফারলে আমাকে দেখতে দিতে চাননি?”

নৈঃশব্দ্য দীর্ঘায়িত হল।

“এবার আপনারাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন,” ধীর গলায় বলেন পোয়ারো, “সেই সময় পাশের ঘরে এমন কিছু বা কেউ ছিল, যাকে আমার চোখের আড়ালে রাখার জন্যই তার পাশের, অর্থাৎ মিস্টার কর্নওয়ার্দি-র ঘরে আমাকে বসানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই মিস্টার ফারলে-র ঘরে আমাকে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল।

কী ছিল সেখানে?

বলছি। তার আগে তিন নম্বর অসঙ্গতির কথাটা বলি।

সেদিন সন্ধ্যায় আমি বেরিয়ে আসার ঠিক আগে মিস্টার ফারলে আমার কাছ থেকে চিঠিটা চেয়ে নিতে চান। এবার, স্রেফ বেখেয়ালে আমি বাঁ পকেটে রাখা চিঠিটা, মানে যেটা মিস্টার কর্নওয়ার্দি লিখেছিলেন, না দিয়ে ডান পকেটে রাখা একটা কাগজ তাঁর হাতে দিই। তিনি সেটাতে চোখ বুলিয়ে পাশের টেবিলে রেখেও দেন। একটু পরে আমার খেয়াল হয়, আমি মিস্টার ফারলে-র হাতে যেটা দিয়েছি সেটা চিঠিটা ছিল না। সেটা ছিল আমার ধোপার একটা নোটিস!

তাহলে প্রশ্ন, সেটার ওপর চোখ বুলিয়েও মিস্টার ফারলে কেন গোলমালটা ধরতে পারেননি?”

“উনি কি তখন চশমা পরেননি?” বার্নেট জানতে চান।

“পরেছিলেন।” মুচকি হেসে বলেন পোয়ারো। “আর সেজন্যই তো ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠে।”

সামনে ঝুঁকে নীচু স্বরে বলতে থাকেন পোয়ারো।

“এই ঘটনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল ওই স্বপ্নটা।

মিস্টার ফারলে স্বপ্ন দেখেই চলেছেন, যে তিনি নিজের ঘরের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে, নিজের ড্রয়ারে রাখা রিভলভার দিয়ে, আত্মহত্যা করছেন। ক’দিন পর তাঁকে নিজের ঘরে, জানলার ধারে, নিজের রিভলভারটা হাতের কাছে নিয়ে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায়, পাওয়া গেল। সেই সময় ঘরে আর কেউ ছিল না। ঘরে তার আগে-পরে কেউ ঢোকেনি।

অর্থাৎ এটা একটা আত্মহত্যা। তাই তো?

না! এটা আত্মহত্যা ছিল না। এটা ছিল ঠান্ডা মাথায় করা একটা খুন।”

ঘরের সবাই নড়েচড়ে বসে। একটা গুঞ্জন ওঠে। সেসবের পরোয়া না করে পোয়ারো বলে চলেন।

“সেদিন সন্ধ্যায় মিস্টার ফারলে-র অফিসে ঢুকলে আমি এমন কিছু দেখে ফেলতাম, যাতে এই ‘আত্মহত্যা’ নামক সাজানো বাগানটি শুকিয়ে যেত।

সেই ঘরে তখন ছিলেন মিস্টার বেনেডিক্ট ফারলে স্বয়ং!”

সবার বোকা-বোকা মুখের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো মুচকি হাসলেন।

“আপনারাই ভেবে দেখুন, যদি আমার সামনে সেদিন বসে থাকা মানুষটি বেনেডিক্ট ফারলেই হতেন, তাহলে কি তিনি চিঠি আর ধোপাবাড়ির নোটিসের পার্থক্য বুঝতে পারতেন না? এটা একমাত্র তখনই সম্ভব, যদি স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির অধিকারী কেউ মিস্টার ফারলে-র একটা চশমা পরে থাকে! ওই অবস্থায় সে কার্যত অন্ধ হয়ে থাকবে, তাই না?”

“হ্যাঁ।” ঠোঁট চেপে বলেন স্টিলিংফ্লিট।

“তার সঙ্গে যোগ করুন পুরো সময়ে আমার অনুভূতিটা। আমার মনে হয়েছিল, সেদিন আমি কোনো নাটক দেখছি-শুনছি। ঘর নয়, সেদিন ওটা একটা মঞ্চ হিসেবেই সাজানো হয়েছিল! ঘরের একমাত্র আলোটা তাক করা ছিল আমার ওপর। তার পেছনে অন্ধকারে বসে থাকা মানুষটির কতটুকু আমি দেখতে পেয়েছিলাম? একটা জীর্ণ ড্রেসিং গাউন, টিয়াপাখির মতো বাঁকা নাক, চুলের মধ্যে একটা সাদাটে গুচ্ছ, এগুলোর প্রত্যেকটাই খুব সহজে জোগাড় করা, বা মেক-আপ দিয়ে বানানো যায়। রইল বাকি মানুষটির চোখজোড়া, তাও ঢাকা পড়েছিল পুরু চশমার আড়ালে!

কিন্তু কেন?

যাতে আমাকে, এরকুল পোয়ারোকে একথা বোঝানো যায় যে বেনেডিক্ট ফারলে ওই বিশেষ স্বপ্নটা দেখতেন। উনি আমাকে না বললে, এবং চিঠির সূত্রে হাজিরা দিয়ে আমি আপনাদের না বললে তো কেউ জানতেই পারত না স্বপ্নটার কথা।”

“কিন্তু মিসেস ফারলে যে বললেন…” বার্নেট থেমে যান।

পোয়ারো মাথা নাড়িয়ে সায় দেন।

“এই পুরো ব্যাপারটা দু’জনের মাথা থেকে বেরোয়।

একজন, যাঁর কাছে আমাকে চিঠি লেখার জন্য বেনেডিক্ট ফারলে-র স্টেশনারি ছিল, বেল না বাজিয়ে এই বাড়িতে ঢোকার চাবি ছিল, ন’টা বাজার আগে বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরেই সাজগোজ করে তৈরি হওয়ার সুযোগ ছিল, আর আমাকে শোনানোর জন্য গল্পটাও ছিল।

আরেকজন তখন ধারেকাছে ছিলেনই না। তাঁর কাজ ছিল বেনেডিক্ট ফারলে-র মৃত্যুর পর সবাইকে বানানো গপ্পোটি বলা, যাতে লোকে ভাবে, মানুষটি রাতের-পর-রাত স্বপ্নটা দেখে মনে-মনে দুমড়ে যাচ্ছিলেন। অথচ, বেনেডিক্ট ফারলে, আদৌ ওরকম কোনো স্বপ্ন কখনও দেখেনইনি!”

ইন্সপেক্টর বার্নেট সতর্ক ছিলেন। তাই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হওয়ার আগেই কনস্টেবলরা পজিশন নিল দরজার কাছে। ঘরটা শান্ত হয়ে গেল।

“তাহলে এবার আসা যাক সেদিন দুপুরের কথায়।” খুব স্বাভাবিকভাবে, একটা গল্প বলার মতো করেই বলেন পোয়ারো।

“দরজার বাইরে বসে থাকা দু’জন সাক্ষী একথা বলবেন যে সেদিন মিস্টার ফারলে-র ঘরে কেউ ঢোকেনি। কথাটা একদম ঠিক। পাশের, মানে নিজের ঘরে মিস্টার কর্নওয়ার্দি তখন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সুযোগ এল সাড়ে তিনটে নাগাদ, যখন ফ্যাক্টরি থেকে বেশ কয়েকটা লরি বেরোল। কর্নওয়ার্দি তখন জানলা দিয়ে বাইরে ঝুঁকে, মিস্টার ফারলে-র টেবিল থেকে আগেই সরিয়ে নেওয়া এই আঁকশি দিয়ে একটা জিনিস তাঁর ঘরের জানলার বাইরে, কার্নিশের ওপর, নিয়ে গেলেন।

কী ছিল সেটা?

আমি ওপর থেকে দেখেছি, তাই নিশ্চিত নই। তবে ইন্সপেক্টর যদি এখনই এই বাড়ির পাঁচিল আর কারখানার দেওয়ালের মাঝের জায়গাটা খোঁজান, তাহলে তিনি সেখানে একটা ছোট্ট কালো বেড়ালের পুতুল পাবেন বলেই আমার ধারণা। কর্নওয়ার্দি ভেবেছিলেন, ওটাকে কোনো বাচ্চার কাজ বলে চালিয়ে দেবেন, যদি কেউ ওটা খুঁজেও পেত।

নিজের পেছনে একটা বেড়াল দেখেই মিস্টার ফারলে যে দারুণ রেগে যাবেন, এবং জানলা দিয়ে ঝুঁকে বেড়ালটাকে তাড়াতে চাইবেন, এটা কর্নওয়ার্দি জানতেন। ঠিক তখনই বিশাল আওয়াজ তুলে লরিগুলো পাশের রাস্তা দিয়ে যায়। জানলা দিয়ে বেনেডিক্ট মুখ বের করামাত্র কর্নওয়ার্দি তাঁকে গুলি করেন। ওপাশে একটা ন্যাড়া দেওয়াল, তাই এই কাণ্ডটা দেখার কেউ ছিল না।

আধঘণ্টা পর নাটকের বাকি অংশটা অভিনীত হয়। কয়েকটা কাগজের মধ্যে রিভলভার আর আঁকশিটা লুকিয়ে, সেগুলো সই করানোর অজুহাতে পাশের ঘরে গিয়ে কর্নওয়ার্দি সবকিছু ‘সাজিয়ে’ ফেলেন। আমাকে লেখা চিঠিটাও জায়গামতো রেখে দেওয়া হয়। রিভলভারে মিস্টার ফারলে-র হাতের ছাপও স্পষ্টভাবে বসিয়ে দেওয়া হয়।

রিভলভারটা কর্নওয়ার্দিই জোগাড় করেছিলেন। বেনেডিক্ট ফারলে-র মতো মানুষ নিজের ড্রয়ারে রিভলভার রাখতেন না।

‘আত্মহত্যা’ করা মানুষটির দেহ কর্নওয়ার্দিই আবিষ্কার করেন। বাকিটা হয় কথায়-কথায়। হতভাগ্য বিধবা আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন, ভেতরে-ভেতরে বেনেডিক্ট ফারলে অসুখী ছিলেন। ওস্তাদের মার হওয়ার কথা ছিল এই স্বপ্নের ব্যাপারটা। আমার মুখ থেকে এটা শোনার পর তো আত্মহত্যা নিয়ে আর কোনো সংশয়ই থাকার কথা নয়! আর তারপর একজন পেতেন স্বামীর সম্পত্তি, অন্যজন পেতেন তাঁর কাছ থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে একটা মোটা টাকা। তাই না?”

হিউগো কর্নওয়ার্দি আর লুইস ফারলে পোয়ারো-র প্রশ্নের উত্তর দেননি, তবে তাঁদের মুখের ছাইরঙা চেহারা দেখে বার্নেট যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। তাঁর জেরার সামনে চটপট ভেঙে পড়েছিলেন লুইস ফারলে। তারপর তাঁদের দু’জনের একটাই পরিণতি হওয়ার ছিল। তবে এমনটা হবে, এ বোধহয় তাঁরা চরম দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি!

___________________

 [রহস্যরোমাঞ্চ সাহিত্যের জগতে জনপ্রিয়তার শিখরে আসীন আগাথা মেরি ক্লারিসা মিলার ক্রিস্টি, ওরফে আগাথা ক্রিস্টি (১৮৯০-১৯৭৬)-র নামের সঙ্গে অপরিচিত মানুষ খুঁজে পাওয়াই কঠিন। সব ভাষা মিলিয়ে আজ অবধি তাঁর লেখার মোট বিক্রি চারশো কোটির বেশি! ১৯২০-তে প্রকাশিত ‘দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস’ ছিল ক্রিস্টি-র প্রথম উপন্যাস। এতেই দেখা দেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারো। ১৯৩৯-এ নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সংকলন ‘দ্য রেগাটা মিস্ট্রি অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’-এ প্রথমবার গ্রন্থবদ্ধ হয় ‘দ্য ড্রিম’।]

জয়ঢাকের গল্পঘর

2 thoughts on “বিদেশি গল্প ইংরিজি স্বপ্ন আগাথা ক্রিস্টি। অনুঃ ঋজু গাঙ্গুলী শীত ২০১৮

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s