ইয়েডোর ওটোকোডেটের একটি গল্প–
গোমপাচি ও কোমুরাসাকির গল্পের একটি পরিশিষ্ট (ষষ্ঠ পর্ব)
সংহিতা
পূর্বপ্রকাশিতের পর
এক মুহূর্তের জন্য বানজায়েমন থতমত খেয়ে গেলেন।কিন্তু চটপট নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আরে! সানজা মশাই যে, তুমি আমার ওপর চটে আছ নিশ্চয়ই, কিন্তু যবে থেকে আমি মুরামাসা তলোয়ার চুরি করে ইয়েডো ছেড়ে পালিয়েছি, আমার মনে কোনো শান্তি নেই। সেই পাপের অনুশোচনায় ভুগে চলেছি, আমি তোমার প্রতিশোধে বাধা দেব না। যা ভালো বোঝো তুমি তাই কর আমার সাথে।কিংবা আমাকে মেরেই ফেল। এই বিবাদের অবসান হোক।”
“না, না”, উত্তরে সানজা বললেন, “নিজের পাপের জন্য অনুতপ্ত মানুষকে মারাটা খুব খেলো কাজ আর বীরধর্মের অনুকূলও নয়। আমার প্রভু ভরসা করে আমাকে যে মুরামাসা তলোয়ারখানা রাখতে দিয়েছিলেন সেটা তুমি চুরি করায় আমার সম্মানহানি হয়েছে, আমি শেষ হয়ে গেছি। তলোয়ারটা আমাকে ফেরত দাও, আমি সেটা আবার প্রভুকে ফিরিয়ে দেব আর তুমিও প্রাণে বাঁচবে। আমি খামখা কোনো মানুষকে হত্যা করি না।”
“সানজা মশাই, তোমাকে ধন্যবাদ জানাই এই ক্ষমার জন্য। আমার কাছে এখনই অবশ্য তলোয়ারটা নেই। কিন্তু তুমি যদি ঐ চা-ঘরে একটু অপেক্ষা করো তো আমি তলোয়ারটা তোমার হাতে এনে দিতে পারি।”
বানজায়েমনের প্রস্তাবে সানজা রাজি হলেন আর দুজনে চা-ঘরে ঢুকলেন।সেখানে তাঁদের অপেক্ষায় ছিলেন বানজায়েমনের দুই শাগরেদ।কিন্তু নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে বানজায়েমন বেশ হীনমন্য হয়ে পড়েছিলেন। তাই ভান করতে লাগলেন যেন তিনি সানজাকে চেনেনই না। আর তাই শাগরেদ দুজনের সাথে সানজার পরিচয় করালেন এই বলে, “আসুন, সামুরাই মশাই এইখানে। আমাদের সাথে আপনার যে এই দেখা হলো, সেই উপলক্ষে আপনাকে এক পাত্র সুরা নিবেদন করি।”
বানজায়েমন আর তার দুই শাগরেদ প্রচুর সমাদরে বার বার এত সুরাপাত্র এগিয়ে দিলেন যে শিগগির সুরার ঘোর চড়ে গেল সানজার মাথায়, আর তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তাই দেখে শাগরেদ দুজন গেলেন বাইরে থেকে ঘুরে আসতে। ঘুমন্ত সানজার সাথে রইলেন একলা বানজায়েমন, আর বুনতে লাগলেন নতুন ছক। হঠাৎ করেই তার মাথায় একটা ফন্দি এলো। তিনি নিঃশব্দে সানজার তলোয়ারটা তুলে নিয়ে নীচে চললেন। সানজা ঘরটাতে ঢুকে তলোয়ারটা রেখে দিয়েছিলেন একপাশে। নিচে এসে পিছনের উঠোনে গেলেন। আর সেখানে পাথরের ঘা মেরে মেরে ভোঁতা করে দিলেন তলোয়ারটার ফলা। তারপর আবার সেটা পুরে দিলেন খাপের মধ্যে। তারপর সেটাকে যথাস্থানে রেখে দিলেন সানজাকে একটুও বিরক্ত না করে। আর সানজাও কোনো ষড়যন্ত্রের আভাসমাত্র না পেয়ে নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে রইলেন। অবশেষে জেগে উঠে তিনি যারপরনাই লজ্জা পেলেন সুরার নেশায় কাবু হয়ে পড়ার জন্য। তবু সে সব কাটিয়ে বানজায়েমনকে বললেন, “এসো হে বানজায়েমন, আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি। এবার মুরামাসা তলোয়ারখানা দিয়ে দাও, আর যেতে দাও আমাকে।”
“নিশ্চয়ই,” বিদ্রুপে বিষিয়ে উঠল বানজায়েমনের স্বর,“আমি তো তলোয়ারটা তোমাকে দেব বলেই বসে আছি। কিন্তু দুঃখের কথা হলো এই যে আমার চরম দারিদ্র্যের দিনে তলোয়ারটা আমি বাঁধা দিয়েছিলাম। ছাড়াতে গেলে রুপো লাগবে একশ ছটাক মতো। তোমার কাছে যদি সমমূল্যের টাকা থাকে তো সেটা তুমি আমাকে দিয়ে দাও। আমি তোমাকে তোমার তলোয়ার ফেরত দিয়ে দিচ্ছি।”
“তবে রে হতচ্ছাড়া!” চিৎকার করে উঠলেন সানজা, বানজায়েমন তাঁকে বোকা বানাতে চাইছে দেখে বলে ফেললেন, “তোর জঘন্য ছলের কিছু দেখতে কী আমার আর বাকি আছে? যাই হোক তলোয়ার না পেলে আমার প্রভুর পায়ে আমি তোর মুণ্ডু অর্পণ করব। আয় তবে -” অধৈর্য পদক্ষেপে এগোতে এগোতে তিনি বললেন, “বাঁচা নিজেকে।”
“সর্বান্তঃকরণে তাই চাই। কিন্তু চা-ঘরে নয়। চলো, ঢিপির ওপর যাই। আর লড়ে দেখি।”
তাই তাঁরা গেলেন ঢিপির ওপর। তলোয়ার বার করে দুজনে শুরু করলেন এক ভয়ানক লড়াই। ক্রমে ক্রমে খবর ছড়িয়ে গেল ইয়োসিওয়ারার পথে পথে যে ঢিবির ওপর এক দ্বৈরথ চলছে। তাই দেখতে অনেক লোকের ভিড় জমে গেল। সেই ভিড়ে ছিল টোকেন গোম্বেই আর সিরোবেই, বানজায়েমনের দুই সঙ্গী। তাঁরা যখন বুঝলেন যে যোদ্ধা দুজন আর কেউ নন, তাঁদের বন্ধু বানজায়েমন আর সেই অপরিচিত সামুরাই তাঁরা চেষ্টা করলেন যাতে যোদ্ধাদের কাছে গিয়ে দ্বৈরথ থামাতে পারেন। কিন্তু ভিড় ঠেলে যোদ্ধাদের কাছাকাছি পৌঁছোতেই পারলেন না তাঁরা। তাঁদের দর্শক হয়েই থাকতে হলো। পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড রাগে যোদ্ধা দুজনেই হিংস্র হয়ে লড়ছিলেন। কিন্তু দুজনের মধ্যে সানজা বহুগুণ বেশি দক্ষ তলোয়ারবাজ হওয়ায় একবার, দুবার, বহুবার বানজায়েমনকে এমন আঘাত করলেন যে তার চোটে বানজায়েমন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এক ফোঁটা রক্তও ঝরল না। তাতে অবাক হয়ে নিজের সমস্ত শক্তি আর কৌশল উজাড় করে দিয়ে সানজা এমন লড়াই লড়লেন যে তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকরা করতালিতে ফেটে পড়ল। আবার বানজায়েমন যদিও জানতেন যে তাঁর প্রতিপক্ষের তলোয়ার ভোঁতা, তবুও সানজার বীরত্বে ভয় পেয়ে তিনি বার বার হোঁচট খেয়ে উল্টে উল্টে পড়তে লাগলেন।
বীর সৈনিক সানজা অবজ্ঞার সাথে ধরাশায়ী প্রতিপক্ষকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকলেন, প্রত্যেক পতনের পর তাকে উত্থানের সুযোগ দিলেন, তারপর আবার লড়াই শুরু করলেন।সানজা বরাবরই এগিয়ে থাকছিলেন লড়াইতে। কিন্তু এমন সময়ও এলো যখন তিনি পিছলে পড়ে গেলেন। আর সেই সুযোগে বানজায়েমন নিজে যে ক্ষমা পেয়েছেন, সে সবের কথা ভুলে,রক্তপিপাসু দুই চোখে জয়ের ঝলক নিয়ে,পড়ে থাকা সানজার দিকে তেড়ে গেলেন আর তাঁর শরীরের একপাশে বিঁধিয়ে দিলেন তলোয়ার। অচৈতন্যপ্রায় সানজা নিজেকে বাঁচানোর জন্য হাতটাও তুলতে পারলেন না। তাঁর লালসাতাড়িত প্রতিপক্ষ আবারও তাঁকে আঘাত করতে এগিয়ে গেলেন যদিও তখন চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকরা বানজায়েমনকে চিৎকার করে ধিক্কার জানাচ্ছিলেন তাঁর শঠতার জন্য।
তারই মধ্যে থেকে গলা তুলে গোম্বেই আর সিরোবেই বলে উঠলেন, “থামো কাপুরুষ! ভুলে গেলে এক মূহুর্তের মধ্যে কেমন করে তোমার প্রাণ বারবার রক্ষা পেয়েছে এই অসম লড়াইতে? সামুরাই-এর অধম, এতক্ষণ আমাদের বন্ধুতা দেখেছ। এবার দেখ এই মহাবীরের প্রতিহিংসা কেমন করে চরিতার্থ করি।”
আর অমনি তাঁরা ছোরা বাগিয়ে এগিয়ে গেলেন বানজায়েমনের দিকে। দর্শকরাও পিছু হঠে পথ করে দিল তাঁদের। তাঁদের কথা শুনে আর ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে বানজায়েমন সন্ত্রস্ত হয়ে পালালেন, ভুলে গেলেন সানজার ওপর মরণাঘাত হানতে।
দুজনে চেষ্টা করলেন বানজায়েমনকে তাড়া করে ধরতে। কিন্তু বানজায়েমন পালাতে ওস্তাদ। তাই তাঁরা ফিরে এলেন আহত সানজার কাছে। তাঁদের সেবায় সানজা যখন সংজ্ঞা ফিরে পেলেন তখন তাঁরা সানজাকে সান্ত্বনা দিলেন আর জানতে চাইলেন কোন প্রদেশে তাঁর বাস যাতে তাঁরা সানজার বন্ধুদের জানাতে পারেন যে কিভাবে সানজা পরাস্ত হয়েছেন। যন্ত্রণায় কাতর, রক্তপাতে দুর্বল সানজা ক্ষীণস্বরে তাঁর নাম আর তলোয়ার চুরির কথা এবং তার থেকে তাঁর সাথে বানজায়েমনের শত্রুতার কথা বললেন গোম্বেই আর সিরোবেইকে।
“কিন্তু”, বললেন সানজা, “যখন বানজায়েমনের সাথে লড়ছিলাম, তখন আমি বেশ কয়েকবার ওকে ঘা মেরেছি। তাতে কোনো ফল হল না, কেন বলুন তো?”
তখন টোকেন আর সিরোবেই সানজার তলোয়ারটা নিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। সেটা তাঁর পাশেই পড়েছিল। ওটার ধারটা ভাঙা হয়েছে যে তা তাঁরা দেখতে পেলেন। তাঁরা আগের থেকেও বেশি খেপে গেলেন বানজায়েমনের শঠতার ওপর। সানজার প্রতি তাঁদের দয়া আরও বহুগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু তাঁদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও, ঘা থেকে ক্রমাগত রক্ত পড়তে থাকায় সানজা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। শেষে একসময় তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। তাই তাঁরা নিকটবর্তী এক মন্দিরে যথামর্যাদায় সানজাকে গোর দিলেন। তারপর পত্র মারফত সানজার স্ত্রী ও পুত্রকে জানালেন সানজার মৃত্যু সংবাদ। সঙ্গেএও জানালেন যে কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
সানজার স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন যে সানজা ফিরবেন। পত্র পেয়ে, সেটা পড়ে তিনি আর তাঁর পুত্র কোসানজা গভীর দুঃখে শোকযাপন করলেন। কোসানজার তখন চোদ্দ বছর বয়স। তিনি তাঁর মাকে বললেন, “এবার শান্ত হও, মা। আমি যাব ইয়েডোতে। খুঁজে বের করব বাবার হত্যাকারী বানজায়েমনকে। আর নিশ্চয়ই শোধ নেব পিতৃহত্যার। সুতরাং এই যাত্রার জন্য যে ভাবে তৈরি হতে হবে তার জোগাড় করি চল।”
তাঁরা যখন প্রতিহিংসার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন তাঁদের বাড়িতে হাজির হলেন উমানোসুকে, উমানোজোর পুত্র, যে উমানোজোকে সানজা হত্যা করেছিলেন। তিনি এসেছিলেন সানজার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। কিন্তু মনে কোনো শত্রুতা নিয়ে তিনি আসেন নি। তিনি মনে করেছিলেন যে সানজা তাঁর পিতৃহন্তা হলেও সানজার বিধবা বা অনাথপুত্রের কোনো দোষ নেই। তিনি প্রিয়জন বিয়োগে কাতর মা-পুত্রের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করলেন না। বরং উল্টে তাঁর মনে হতে লাগল যে বানজায়েমন তাঁদের দুজনেরই শত্রু। বানজায়রমনের জন্যই গন্ডগোল। আর তার জন্যই উমানোসুকেও পিতৃহন্তার প্রতিহিংসা পূরণে অক্ষম। এই সব ভাবতেভাবতেই তিনি বললেন, “কোসানজা মশাই, আমি শুনলাম ইয়েডোতে আপনার বাবাকে নাকি বানজায়েমন নৃশংসভাবে খুন করেছে। আমি জানি যোদ্ধার যোগ্য সন্তান হিসেবে আপনি এই হত্যার শোধ নেবেন, যদি সে বাবদে আপনি এই অক্ষমের সাহায্য স্বীকার করেন, আমি আপনার সহযোগী হতে পারি আর আপনাকে আমার ক্ষমতায় যতটা কুলোবে ততটা সাহায্য করতে পারি। বানজায়েমন আমারও শত্রু, যেমন সে আপনার শত্রু।”
“না উমানোসুকে মশাই, যদিও আমি আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, তবুও আমি আপনার এই মহানুভবতা গ্রহণ করতে পারব না। আমার বাবা সানজাও আপনার বাবাকে খুন করেছিলেন। কিন্তু আপনি এইভাবে সেই দুর্ভাগ্যকে কাটিয়ে উঠে আমার সাহায্যে এসেছেন তাই অনেক। আমি ভাবতেই পারছি না যে আপনি আমার জন্য আপনার জীবন বিপন্ন করবেন।”
“আমার কথা শোনো”, হাসি মুখে বললেন উমানোসুকে, “তাহলে বুঝবে কেন আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি। গত বছরে সমুদ্রের ধারে আমার বাবার রক্তাক্ত মৃতদেহ ফেলে রেখে যাওয়ার সময় তোমার বাবা আমার সাথে চুক্তি করেছিলেন যে চুরি যাওয়া তলোয়ারটা পাওয়া গেলেই তিনি আমাকে আমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ চরিতার্থ করার সুযোগ দেবেন। ইয়োসিওয়ারার ঢিবিতে বানজায়েমন তাঁকে খুন করে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করেছে। এখন বানজায়েমন ছাড়া আর কার ওপর আমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেব, তার শঠতাই তো এর কারণ? সুতরাং তোমার সাথে ইয়েডো যাওয়ার ব্যাপারে আমি স্থির প্রতিজ্ঞ আর আমাদের দুজনেরই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ চরিতার্থ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের নিজেদের দেশে ফিরছি না।”
চলবে