নেসবিটের ইংরিজি অনুবাদ থেকে
ভাষান্তরঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
অনেক, অনেক দূরে, সমুদ্র পেরিয়ে, আগুন পাহাড়ের গর্ত পেরিয়ে, নির্জন সব দেশ পেরিয়ে ছিল ভারী সুন্দর এক মাঠ। তার মাঝখানে ছিল এক চমৎকার শহর। সেই শহরে তাঁর রানিকে নিয়ে রাজত্ব করতেন জার উমনায়া গোলোভা। সেখানে অনেক দিন রাজত্ব করবার পর তাঁদের এক টুকটুকে মেয়ে হল। তার নাম রাখা হল নিওসিয়েনা। পরের বছর তাদের আরেকটা মেয়ে জন্মাল। তার নাম রাখা হল বেতসিয়েনা। আনন্দে রাজ্যজুড়ে উৎসব হল, খানাপিনা করে সবার প্রাণ জুড়োল।
তারপর তো জারের মাথায় বেজায় চিন্তা , মেয়েদের খাইয়ে, পড়িয়ে কীভাবে মানুষ করা যায়। মেয়েরা সোনার চামচে খায়, রাজহাঁসের পালকের বিছানায় ঘুমোয়, আর দাসীরা তাদের হাওয়া করে ঘুমের সময় , গায়ে যাতে মশামাছি না বসতে পায় একখানাও। জারের কড়া হুকুম, রোদের কড়া আলো যেন মেয়েদের গায়ে না লাগে। শীতের হিমকুয়াশা যেন তাদের ছুঁতে না পায়, ঝোড়ো হাওয়ার দল যেন তাদের খবর জানতে না পারে। সেইসব দেখভাল করবার জন্য পণ্ডিতদের কথা মেনে জার রাখলেন সাতাত্তরজন দাসী আর সাতাত্তরজন গার্জেন।
এমনিভাবে মহা আদরযত্নে মেয়েরা তো বড়ো হয়ে উঠছে। দেশে দেশে তাদের রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। দূরদূরান্ত থেকে তাদের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে জারের সভায় রাজপুত্রদের ভিড় জমে রোজ। জার কিন্তু সব সম্বন্ধই ফিরিয়ে দেন। মনে মনে ভাবেন সময় এলে ঠিক বরটি আপনি খুঁজে পাওয়া যাবে।
এমনি একদিন রাজা বসে বসে মেয়েদের নিয়ে ভাবছেন, তখন বাইরে ভারী শোরগোল উঠল। উঠোন জুড়ে লোকজনের ছোটাছুটির শব্দ ভেসে আসছিল। দাসীরা কান্নাকাটি জুড়েছে। গার্জেনদের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে কান পাতা দায়। সেইসব শুনে জার তো এক ছুটে বাইরে বের হয়ে এসেছে্ন। অমনি সাতাত্তর দাসী আর সাতাত্তর গার্জেন এসে জারের পায়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে বলে, “সব আমাদের দোষ। দুই রাজকন্যাকে একটা ঘূর্ণিঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল আমরা কিচ্ছু করতে পারলাম না।”
জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল রাজকন্যারা নাকি বাগানে ফুল তুলতে গেছিলেন। এমনিসময় হঠাৎ, কোত্থেকে কে জানে, একটা কালো মেঘ এসে আকাশ ছেয়ে ফেলল, আর দাসী আর গার্জেনদের চোখে মুখে একগাদা জল ছিটিয়ে দিল। চোখটোখ মুছে তারা দেখে রাজকন্যাদের চিহ্ন নেই বাগানে।
শুনে জার তো রেগে আগুন। বলেন, “তোদের মরাই ভালো। কী কাণ্ড! সাতাত্তরটা দাসী আর সাতাত্তরটা গার্জেন মিলে দুটো রাজকন্যার দেখভালও করতে পারিস না। এখন জেলে গিয়ে পচে মর তোরা।”
তারপর তো জারের ভারী দুঃখ। তার প্রাসাদে আর গানবাজনা খানাপিনা হয় না। কেবল দুঃখ আর দুঃখ। কিন্তু দুঃখও বা আর কতদ্দিন থাকে! আস্তে আস্তে জারের চোখের জল শুকোল, প্রাসাদে ফের আলো জ্বলল, আর তারপর অনেকদিন কেটে যেতে জারের ফের একটা সুন্দর ছেলে হল। জারের মুখে ফের হাসি ফুটল এতদিনে। ছেলের নাম সে রাখল ইভান আর তার জন্য দাসদাসী, ডাক্তার, মাস্টার, পাহারাদার রেখে দিল অনেকজন।
ইভান তো বড়ো হয়। রূপ ফেটে পড়ে। গুণের কথা ছড়ায় সাত সমুদ্র পাড় হয়ে। বুদ্ধির জোরে কেউ তার ধারেকাছে আসে না। শুধু জারের একটাই দুঃখ। ইভান বীর ছেলে নয় মোটেই। তলোয়ার নিয়ে খেলতে তার ভালো লাগে না। যুদ্ধে যেতে ভারী অনিচ্ছে। সে ভালোবাসে শুধু বীণা বাজাতে। সে সুর যেন এ পৃথিবীর নয়। বীণার তারে হাত ছোঁয়ালেই সাত সুর জেগে ওঠে তার থেকে সাতরঙা রামধনুর মতন।
শেষমেষ একদিন জার ছেলেকে ডেকে বললেন, “তুমি ভালো ছেলে। বুদ্ধিমান ছেলে। তাতে আমি বেজায় খুশি। কিন্তু বাবা, রাজার ছেলে তুমি। একটু যুদ্ধটুদ্ধ না করলে কি তোমায় সাজে? আমি বুড়ো হচ্ছি। চারপাশে অনেক শত্রু। তারা যদি হানা দেয় তাহলে রাজ্যবাঁচাবে কে? আমায় আর তোমার মাকে সদি তারা ধরে নিয়ে যায় শেকলে বেঁধে, কেমন লাগবে তোমার?”
শুনে ইভান বলল, “বুদ্ধি থাকলে তলোয়ারে কাজ কী বাবা? আমি বুদ্ধি দিয়েই তাদের জয় করে ফেলব। তলোয়ার ছুঁতেই হবে না!”
“তাই কী হয়?” বললেন জার।
“চাইলে পরীক্ষা নিয়ে দেখ,” ইভান জবাব দিল, “শুনেছি আমার দুই দিদিকে নাকি এক ঘূর্ণিঝড় এসে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। দেশে যত বড়ো বড়ো বীর আছে তাদের ডেকে এনে বলো দেখি তারা তলোয়ারের জোরে খুঁজে আনুক আমার দিদিদের। যদি কেউ তা পারে তাহলে তাকে তুমি রাজ্য দিও। আমি তার চাকর হয়ে থাকব। আর যদি কেউ তা না পারে, তাহলে তখন আমি শুধু বুদ্ধি দিয়ে তাদের খুঁজে এনে দেব দেখে নিও।”
ছেলের কথা শুনে জার তো ভারী খুশি। দেশের সব বীরদের ডেকে সে বলল, “আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের কে খুঁজে আনতে পারে? যে পারবে সে পাবে অর্ধেক রাজত্ব আর একজন রাজকন্যা।”
শুনে বীরেরা সবাই এ ওর পেছনে লুকোল গিয়ে। দুশমন ঝড় রাজকন্যাদের চুরি করে নিয়ে গেছে। তার সন্ধান তারা কোথায় পাবে? তখন ইভান বলল, “বাবা, এই ছোট্টো কাজটুকুও করে দেখাবার সাহস যদি কারো না থাকে তাহলে, আমাকেই সেটা করতে দাও।
“বেঁচে থাকো বাবা,” জার খুশি হয়ে বলল, “কত সোনাদানা, হিরেমাণিক লাগবে রাজকোষ থেকে নিয়ে যাও। যত সৈন্যসামন্ত চাই তা-ও পাবে।”
“ওসব কিচ্ছু চাইনা বাবা,” মিষ্টি হেসে ইভান জবাব দিল, “যা করবার আমার এই বীণাটাই করে দেখাবে দেখো। তিনটে বছর আমার ফেরবার জন্য অপেক্ষা কোরো তুমি। তার পরেও আমি না ফিরলে আর কাউকে ডেকে যুবরাজ করে নিও।”
তারপর তো বাপমায়ের আশীর্বাদ, রাজার চিঠি আর বীণাটাকে সঙ্গে করে নিয়ে পথে বের হল ইভান। পথ চলে সে, আর বীণায় সুর তোলে। সারাদিন পথ চলে সে, আর রাত্রে তারাভরা আকাশের নীচে ঘাসের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকে।
এমনি করে চলতে চলতে অবশেষে একদিন সে এল এক গভীর বনের কাছে। সেখানে ভীষণ তোলপাড়ের শব্দ হচ্ছে থেকে থেকে। সে ভারী ভয়ের ব্যাপার। ইভানের বুকটা একটু কেঁপে উঠল প্রথমে। কিন্তু তার পরেই সে সাহসে বুক বাঁধল, “মানুষ একবারের বেশি দুবার তো মরে না। এই ভেবে সে হাঁটা দিল বনের ভেতর। ঢুকে দেখে সেখানে দুটো দৈত্যের মধ্যে বেজায় মারপিট চলছে। একজনের হাতে একটা গোটা ওকগাছ আর অন্যজন একটা শেকরবাকরশুদ্ধু পাইনগাছ হাতে নিয়ে লড়াই করছে।
ইভান আস্তে আস্তে তাদের কাছে গিয়ে বীণাটা বের করে একটা নাচের সুর ধরল তাতে। দৈত্যদুটো সেই শুনে ব্জায় নাচ জুড়ল। সে কী নাচ! নাচের দাপে গটা বন থরথর করে কাঁপতে লেগেছে তখন।
এমনিভাবে, নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে দৈত্যদুটো যখন ঝিমিয়ে পড়েছে তখন ইভান তাদের কাছে এগিয়ে গেল। বলল, “এত ঝগড়া করছিলে কেন তোমরা? হয়েছেটা কী? তোমরা হলে গিয়ে বাপু বনরাক্ষস। বোকার মতন এমন মারপিট করা কি তোমাদের সাজে নাকি?”
“কেন আমরা লড়াই করব না শুনি?” একটা দৈত্য জবাব দিল, “সব শুনে তুমিই বিচার কর বাপু। বনের মধ্যে দুজন মিলে ক’টা জিনিস পেলাম। আমি বললাম এগুলো আমার। ও-ও বলল এগুলো ওর। তারপর ঠিকঠাক ভাগ করতে না পেরে মারপিট করছি। যে জিতবে জিনিসটা তার হবে।”
“হুম। তা জিনিসগুলো কী সেইটে জানতে পারি কি?”
শুনে তারা জিনিসগুলো বের করে দেখাল। একটা টেবিলক্লথ, একজোড়া বুটোজুতো আর একটা টুপি। “হুঁ হুঁ। এরা কিন্তু সাধারণ জিনিস নয়,” এক দৈত্য বলল, “টেবিলক্লথটা মাটিতে পেতে যা খেতে চাইবে তক্ষুণি তা এসে হাজির হবে সামনে। বুটজোড়া পায়ে পরলে হাঁটতে পারবে ঘন্টায় একশো মাইল, আর তেমনবিপদে পড়লে টুক করে এই টুপিটা পরে নিলেই হল! ব্যস, তুমি চোখের পলকে হাওয়া!”
“ধুস। এই নিয়ে কেউ ঝগড়া করে?” ইভান বলল, “আমি যদি জিনিসগুলো কে পাবে তা ঠিকঠাক করে দিতে পারি তাহলে তোমরা কী করবে?”
“আমরা রাজি, আমরা রাজি,” দুজন মিলে একসঙ্গে জবাব দিল।
“বেশ। তাহলে শোন। ওই যে দূরের পাহাড়টা দেখছ, এক ছুটে ওইটে অবধি যেতে হবে। যে আগে যাবে সে সবগুলো জিনিস পাবে। কী রাজি?”
“একেই বলে বুদ্ধি, “ দুই দৈত্য একসঙ্গে বলে উঠল, “আমরা রাজি। জিনিসগুলো তুমি ধরে দাঁড়াও আমরা ছুটটা দিয়ে আসি।” এই বলে ইভানের হাতে জিনিসগুলো দিয়ে যেই না তারা ছুট দিয়েছে, ইভানও অমনি টেবিলক্লথটা বগলদাবা করে মাথায় অদৃশ্য টুপি চাপিয়ে পায়ে জুতোজোড়া পরে নিয়ে দে ছুট—দে ছুট! দৈত্যরা দৌড় শেষ করে ফিরে সে দেখে সব ভোঁ ভাঁ।
ইভান আবার যায় যায় যায়—যেতে যেতে সামনে এল নতুন মুশকিল। রাস্তাটা সেখানে তিন ভাগ হয়ে তিনদিকে গেছে আর তেমাথায় দাঁড়িয়ে আছে মুরগির ঠ্যাঙের ওপরে একটা কুঁড়েঘর। ইভান তার কাছে গিয়ে বলল, “কুঁড়েঘর, কুঁড়েঘর, বনের দিকে পেছন ঘোড়, আমার দিকে দরজা কর।”
অমনি কুঁড়েঘর বনবন করে ঘুরে তার সামনে দরজা খুলে ধরল। ইভান ঘরে ঢুকে দেখে সেখানে বাবা ইয়াগা নামের ডাইনিটা বসে আছে। তাকে দেখে সে বলল, “আজ অবধি এইখানে কোন মানুষ আসতে পেল না। কোত্থেকে এলি রে তুই? কেন এলি?”
“ধুস্। কী যে বল ঠাকুমা তুমি। বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে নেই দেখছি! আগে তো পেট পুরে খাওয়াও আমায়, তারপর যা জানবার আছে সব জিজ্ঞেস কোরো’খন।”
শুনে বাবা ইয়াগা তাড়াতাড়ি উঠে উনুন ধরিয়ে মাংসের সুরুয়া রেঁধে দিল ইভানকে। তারপর তার খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে বলল, “ কোথায় যাচ্ছিস তুই খোকন?”
“চলেছি আমার নিওসিয়েনা আর বেতসিয়েনা বোনদুটোকে খুঁজতে। কোন পথে যাই বলোতো ঠাকুমা? কোথায় গেলে তাদের খুঁজে পাবো তুমি জানো?”
“হুম। নিওসিয়েনার বাড়ির ঠিকানা আমার জানা আছে, বুঝলি? বুড়ো বনরাক্ষসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। মাঝখানের রাস্তাটা ধরে এগোলেই তার প্রাসাদ দেখতে পাবি। তবে কিনা, রাস্তাটা লম্বা। বেজায় শক্ত, আর যদি পথ পেরিয়ে বোনের বাড়ি গিয়ে পৌঁছোসও, তাহলে বুড়ো রাক্ষস বেরিয়ে এসে তোকে টুপ করে গিলে ফেলবে এই বলে রাখলাম।”
“গিলে ফেলবে বুঝি? তাহলে গলায় আটকে দম বন্ধ হবে তার দেখো ঠাকমা। আমার নাম ইভান ভগবান আমাকে রাক্ষসের খাবার হবার জন্যে দুনিয়ায় পাঠাননি। তোমার খাবারের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আমি যাই,বুড়ো রাক্ষসটার খবর নিই গিয়ে।”
এই বলে সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে মাঝের পথে পা ঠেকাল। অমনি জুতোজোড়া তাকে নিয়ে শোঁ করে পথ পেরিয়ে একেবারে বনরাক্ষসের প্রাসাদের সামনে এসে হাজির। আর সদর দরজার মাথায় একটা খুদে রাক্ষস বসেছিল। ইভানকে আসতে দেখে সে ঠোঁট উলটে বলে, “ঢোকা বারণ।”
“আরে ভাই দরজাটা খুলে দে না, ভালো খাবার দেব,” ইভান জবাব দিল।
খুদে রাক্ষস অমনি হাত পাতল। কিন্তু খাবার খেয়েও সে দরজার তালা খোলে না। ইভান তখন ভাবল, “পাঁচিল টপকে ভেতরে যাই।” এই ভেবে সে যেই না তড়বড়িয়ে পাঁচিলের মাথায় গিয়ে উঠেছে অমনি সারা প্রাসাদ জুড়ে ঢং ঢং করে বেজে উঠেছে হাজারো ঘন্টা।
শব্দ শুনে প্রাসাদের বারান্দায় বের হয়ে এল তার দিদি নিওসিয়েনা। তাকে দেখে বলল, “তুই কি আমার ভাই ইভান?”
ইভান লাফ দিয়ে নেমে বারান্দায় গিয়ে তার দিদিকে জড়িয়ে ধরল।
“এবার তোকে কোথায় লুকোই বল দেখি ভাই? এক্ষুনি তো তোর রাক্ষস জামাইবাবু এসে পড়বে!” খানিক বাদে নিওসিয়েনা বলল।
“ধুস। আমায় আবার লুকোবি কোথা?” এই বলে ইভান যেই না হাসতে লেগেছে অমনি বাইরে থেকে বেজায় ঝড়ের শব্দ উঠল, তারপর পায়ের দাপে প্রাসাদ কাঁপিয়ে এসে হাজির হল বনরাক্ষস। ইভান অমনিটুক করে মাথায় টুপি চাপিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। রাক্ষস নিওসিয়েনার সামনে এসে বাজপড়ার মত গলায় বলল, “পাঁচিল টপকে কে এসেছে রে? সে কোথায় লুকোল?”
“কে আবার আসবে?” নিওসিয়েনা মাথা নেড়ে বলল, “বোধ হয় কোনো চড়ুইটড়ুই বসেছিল পাঁচিলের মাথায়!”
“চড়ুই! উঁহু। কেমন যেন মানুষ মানুষ গন্ধ পাই!”
“উফ্ সারা দুনিয়াকে জ্বালিয়ে বেড়াও, এখন আমাকেও জ্বালাতে লেগেছ দেখছি,” নিওসিয়েনা রাগরাগ গলায় বলল।
“আহা রেগে যেও না রাজকন্যা। আমার একটু খিদে পেয়েছে কিনা, তাই পাঁচিল টপকে যে ঢুকেছে তাকে খুঁজছি। পেলে মুখে দিয়ে একটু জল খাব।”
অমনি ইভান্তার অদৃশ্য টুপি খুলে রাক্ষসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “দেখো দেখি, আমি কেমন রোগাভোগা একটা ছেলে! আমায় খেয়ে পেট ভরবে নাকি তোমার? তার চাইতে এস তোমায় এমন খাওয়া খাওয়াব যে জীবনে কখনো তেমনটা খাওনি তুমি।”
এই বলে ইভান সেই টাবিল ক্লথটা বের করে এনে পেতে দিয়েছে ঘরের মেঝেয়। অমনি বড়ো বড়ো খাবারের থালা নিয়ে বারো বারো চব্বিশটা দাসদাসী এসে হাজির। খেতে খেতে বনরাক্ষস শেষমেষ শুয়েই পড়ল একেবারে। আর তার নড়ার শক্তি নেই শরীরে। খানিক বাদেই মেঘের মত শব্দ উঠল তার নাকে।
“এবারে আমি চলি রে দিদি,” ইভান বলল, “মেজদিদি কোথায় আছে তুই কি জানিস?”
“জানি বইকি,” নিওসিয়েনা জবাব দিল, “সমুদ্রের মাঝখানে বিরাট এক ঘূর্ণি আছে। তার মধ্যে সে তার বর সাগর রাক্ষসের সঙ্গে থাকে। তবে সে অনেক দূরের, অনেক কঠিন পথ। যদি কখনো পৌঁছোতেও পারিস সেখানে তাহলে তোর জামাইবাবু তক্ষুনি তোকে টুপ করে মুখে পুরে দেবে।”
“গিলে ফেলবে বুঝি? তাহলে গলায় আটকে দম বন্ধ হবে তার দেখিস বড়দি। আমার নাম ইভান। ভগবান আমাকে রাক্ষসের খাবার হবার জন্যে দুনিয়ায় পাঠাননি। যাই, এবারে মেজদিদির খবর নিই গিয়ে।”
লম্বা লম্বা পায়ে সমুদ্রের ধারে পৌঁছে ইভান দেখল সেইখানে এক জাহাজ পাল উড়িয়ে রওনা দিচ্ছে। “আমায় তোমরা সঙ্গে নেবে?” সে নাবিকদের ডেকে বলল, “পয়সাকড়ি দিতে পারব না বাপু, কিন্তু হ্যাঁ। দারুণ সব গল্প শোনাতে পারি তোমাদের।”
নাবিকরা তাতে খুব রাজি। জাহাজ ইভানকে নিয়ে রওনা হল। যাবে সে নুনপাথরের দ্বীপে। ডেকে বসে ইভান গল্পের পর গল্প বলে, আর নাবিকরা তাই শোনে। এমনি করে দিব্যি দিন যাচ্ছিল। কিন্তু তারপর একদিন হঠাৎ এক দারুণ ঝড় উঠল সমুদ্রে। তার ঠেলায় ইশেহারা জাহাজটা ছুটতে ছুটতে হঠাৎ জলের মধ্যে পাক খেতে শুরু করল। তাইতে জাহাজের লোক ভয় পেয়ে কান্নাকাটি জুড়েছে। বলে, “হায় হায়, এ যে মহাসাগরের মহাঘূর্ণির পাল্লায় পড়েছি আমরা! এর হাত থেকে কেউ বেঁচে ফেরে না।”
হঠাৎ এক নাবিক ইভানকে দেখিয়ে বলে এই ছেলেটা অপয়া। জাহাজে উঠেছে বলে আজ আমাদের বিপদ। ওকে ছুঁড়ে ফেল ঘূর্ণিতে।”
শুনেই ইভান তাড়াতাড়ি তার টেবিল ক্লথ, জুতো, টুপি আর বীণাটা বগলদাবা করে সিধে হয়ে দাঁড়াল আর নাবিকরা তাকে চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলল ঘূর্ণির জলে। অমনি সমুদ্র একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল, আর ঘূর্ণিতে ডুবে ইভান গিয়ে সোজা হাজির হল সাগর রাক্ষসের বাড়িতে। সেখানে সাগর রাক্ষস তখন তার মেজদিদিকে পাশে বসিয়ে নিজের সিংহাসনে বসে ছিল। তাকে দেখেই সাগর রাক্ষস ঠোঁট চেতে বলে, “আহা কতদিন তাজা মাংস খাইনি যে! এসো হে, কাছে এস দেখি, কোন পাশটা দিয়ে শুরু করব তাই ঠিক করি!”
শুনে ইভান বলল, “আপনি আমার জামাইবাবু। নিজের শালার সঙ্গে কেউ এমনটা করে?”
তাইতে বেজায় রেগে গিয়ে সাগর রাক্ষস বলল, “অ্যাঁ? এতবড়ো সাহস? আমার মুখের ওপর কথা? দেখাচ্ছি মজা তোকে দাঁড়া—”
এই বলে যেই না সে তেড়ে আসতে যাবে ইভান ওমনি তাড়াতাড়ি তার বীণাটা বের করে এনে তাতে সুর তুলেছে। সে ভারী দুঃখের সুর। শুনে রাক্ষস যেই ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করেছে, ইভান তক্ষুণি বলে “এইবারে একটু নাচলে কেমন হয়?” এই বলে সে বীণায় তুলেছে এক নাচের সুর। ওমনি সাগর রাক্ষসের সভার যত পাত্রমিত্র সভাসদ সব্বাই একসঙ্গে নাচতে লেগেছে। রাক্ষস নিজেও চোখমুখ ঘুরিয়ে সে কী ধেই ধেই নাচ! দেখে সভাশুদ্ধু মাছের দল হেসেই অস্থির।
নেচেটেচে বেজায় খুশি হয়ে রাক্ষস বলে, “হুম।এ ছোকরাকে খাওয়াটা ভালো কাজ হবে বলে তো মনে হচ্ছে না। ওহে। বলি কি এইখানেই থেকে যাও তুমি। আমার রাজ্যে হরেক মাছ। আশ মিটিয়ে খাওদাও, বীণা বাজাও, কী বল?”
তখন তো দিদি জামাইবাবুর সঙ্গে বসে ইভান দারুণ খাওয়াদাওয়া করল, হেরিং মাছের গান শুনল, তিমিদের নাচ দেখল, অক্টোপাসদের জিমনাস্টিক দেখল।
খাওয়ার পরে রাক্ষস ঘুমোলে বেতসিয়েনা ভাইকে ডেকে বলে, “এ যাত্রা তো প্রাণে ব্বেঁচে গেলি। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে যদি মতি ফের ঘুরে যায় তাহলে তোকে কিন্তু তক্ষুণি গিলে খাবে। সময় থাকতে পালা।”
শুনে ইভান বলল, “হ্যাঁ মেজদি, তোকে আর বড়দিকে এই রাক্ষসদের খপ্পর থেকে কীভাবে উদ্ধার করি বল দেখি!”
“উপায় একটা আছে, বুঝলি ভাই,” বেতসিয়েনা বলল, “তবে বেজায় কঠিন। এই সমুদ্রের অন্যপাড়ে এক বিরাট রাজ্য আছে। সেখানে রাজত্ব করে এক রাজকন্যা। তুই গিয়ে তার দেয়ালঘেরা বাগানে ঢুকতে পারিস যদি তাহলে সেই রাজকন্যা তোর বউ হবে। দুনিয়ায় শুধু তারই সাধ্য আছে আমাদের উদ্ধার করবার। আর কেউ তা পারবে না। তবে মুশকিল হল, সমুদ্রের ধারে তার ভয়ানক এক সৈন্যের দল থাকে। দুনিয়ায় সবাই তাদের ভয় পায়, এমনকি রাক্ষসরাও। তাদের সাথে অনেক বন্দুক আর বল্লম। বল্লমের মাথায় মাথায় কত যে জার আর রাজপুত্রদের মাথা গাঁথা! সমুদ্র পেরিয়ে যে-ই সেখানে যায়, সে আর বেঁচে ফেরে না তাদের হাত থেকে। যাবি তুই?”
“হুঁ যাব।”
“বেশ। আমি তাহলে আমি যে স্টার্জন মাছটায় চড়ে ঘুরে বেড়াই সেইটে তোকে দিচ্ছি। আর দৌড়বাজ স্টারলেট মাছ একজন দিচ্ছি সঙ্গে । সে তোকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবে।” এই বলে ভাইকে চুমু খেয়ে স্টার্জন মাছের পিঠে তাকে বসিয়ে দিয়ে বিদায় দিল বেতসিয়েনা।
চোখের পলকে জল বেয়ে ছিটকে গেল স্টার্জন আর স্টারলেট মাছ। দেখতে দেখতে সাগর পাড়ি দিয়ে তারা এসে উঠল সেই রাজকন্যার রাজ্যের সমুদ্রের পাড়ে। পাড়ে ওঠবার আগেই ইভান মাথায় অদৃশ্য টুপিটা চাপিয়ে নিয়েছিল। পাহারাদারদের নাকের ডগা দিয়ে তাই প্রাসাদের দিকে যেতে তার কোন অসুবিধেই হল না। যেন হাওয়া খাচ্ছে এমনি করে হাঁটতে হাঁটতে ইভান গিয়ে ঢুকল রাজকন্যার বাগানে। সেখানে গিয়ে ঘুরে ঘুরে আপেল পেড়ে খাচ্ছে এমন সময় দেখে কুড়িটা ঘুঘুপাখি একটা দিঘির পাড়ে এসে নামছে। মাটিতে নেমেই তারা কুড়িজন সুন্দরী মেয়ে হয়ে গেল। তাদের মাঝখানে যে সবচেয়ে সুন্দরী, সেই হল সে রাজ্যের রাজকন্যা। তারপর তারা সবাই মিলে সেই দিঘির জলে নেমে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটতে লাগল।
ঠিক সেই সময় ইভান দিঘির পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে তার অদৃশ্য টুপিটা খুলে ফেলত্রেই জলের ভেতর থেকে মেয়েরা ভয়ে এমন চিৎকার জুড়ল যেবলার নয়। ইভান তাই দেখে হেসে বলল, “আরে আমি কি বাঘ না ভালুক যে আমায় দেখে ভয় পাচ্ছ তোমরা? আমি তোমাদের কাউকে কিচ্ছু বলব না। শুধু তোমাদের মাঝখানে ওই যে রাজকন্যা, তাকে বিয়ে করতে চাই।”
তাই শুনে লজ্জায় লাল হয়ে রাজকন্যা পাড়ে উঠে এসে তার হাত ধরে বলল, “আমার সেপাইদের পেরিয়ে কেউ যে কোনদিন আমার বাগানে ঢুকতে পারবে তা কখনো ভাবিনি। এইবার আমাদের বিয়ে হবে চলো।”
অমনি আলো জ্বলে উঠল, বাঁশি বেজে উঠল, সবাই মিলে ভারি আনন্দে তাদের নিয়ে চলল বিয়ের আসরে।
সারাদেশে খবর হয়ে গেল তাদের রাজকুমারীর বর মিলেছে এইবারে। সারা দেশ তখন আনন্দে অস্থির হয়ে গেল। তিন সপ্তাহ ধরে চলল গানবাজনা, খানাপিনা, আমোদের পালা।
তিন সপ্তাহ পার হতে ইভান একদিন তার বউকে সব কথা খুলে বলতে সে রাগে তিনখানা হয়ে বলল, “ডাক তো আমার শজারু উকিল আর চড়াই কেরাণিদুটোকে। এক্ষুণি আমি চিঠি পাঠাচ্ছি বনরাক্ষস আর সাগর রাক্ষসকে। ইভানের দিদিদের যদি চিঠি পেয়েই তারা ছেড়ে না দেয়, তাহলে তাদের এমন শাস্তি দেব যে ভাবতেও পারবে না।”
অমনি উকিল আর কেরাণি এসে চিঠির মুসাবিদা করে সেই চিঠি পাঠিয়ে দিল সাগর আরবনের দেশে। রাজকন্যাকে দুনিয়ার সব্বাই ভয় করত। চিঠি পেয়ে দুই রাক্ষস কী আর করে? ভয়ে ভয়ে রাজকন্যাদের তারা ছেড়ে দিল।
তখন ইভান তার বাবাকে চিঠিতে সব লিখে শেষে বলল, “বাবা, দেখলে কিনা আমার বুদ্ধি আর আমার বীণার কেমন জোর? তলোয়ারে যে কাজ কোনদিন করতে পারত না তাই করে ফেলল কত সহজে! এখন আমার দেশে তোমার নেমন্তন্ন। বড়দি , মেজদি, আমার বউ আর আমি এখানে বেজায় মজায় আছি। কবে তোমরা আসবে বলো।।”
তারপর তো ইভান অনেকদিন বাঁচল, অনেক দেশ জয় করল, আর ভীষণ, ভীষণ আনন্দে থাকল। মাঝেমধ্যেই বড়ো বড়ো খানাপিনার আসর বসাত সে। তাইতে আমি অনেকবার ভালোমন্দ খেয়েছি , তাই আজ তার গল্প লিখলাম সব্বার জন্য।