সার আর্থার কারমাইকেলের অদ্ভুত ঘটনা
আগাথা ক্রিস্টির দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব আর্থার কারমাইকেল অবলম্বনে. অনুবাদ-স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায়
[প্রয়াত বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ডাঃ এডওয়ার্ড কারস্টেয়ার্সের (M.D.) নোট থেকে নেওয়া]
১
আমি নিশ্চিত যে আমি এখানে যে অদ্ভুত ও দুঃখের ঘটনার কথা লিখে রাখছি তাকে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়। আমার নিজের মতামত অবশ্য কোনোদিন বদলায়নি। পুরো ঘটনাটা আমি না লিখে পারলাম না। আর সত্যি বলতে কী, আমি বিশ্বাস করি যে বিজ্ঞানের খাতিরেই এমন অদ্ভুত এবং ব্যাখ্যার অতীত ঘটনাকে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।
আমার বন্ধু ডাঃ সেটলের একটা টেলিগ্রামের মধ্যে দিয়ে এই ঘটনার সঙ্গে আমার পরিচয়ের শুরু। টেলিগ্রামটাতে কারমাইকেল নামের উল্লেখ ছাড়া আর বিশেষ বিশদে কিছু লেখা ছিল না, কিন্তু তবুও সেই টেলিগ্রামের নির্দেশ অত্যন্ত বাধ্য ছেলের মতো মেনে নিয়ে হার্টফোর্ডশায়ার থেকে আমি প্যাডিংটন থেকে ওল্ডেন যাবার ১২:২০-র ট্রেনে চেপে বসলাম।
কারমাইকেল নামটা আমার অপরিচিত ছিল না। ওল্ডেনের স্বর্গীয় স্যার উইলিয়াম কারমাইকেলের সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ ছিল, যদিও বিগত এগারো বছরে তাঁর সঙ্গে আমার একবারও দেখা হয়নি। জানতাম তাঁর একটি ছেলে আছে যে বর্তমানে ব্যারোনেট, এখন তার বয়স বছর তেইশ হবে। খুব ভাসা ভাসা মনে পড়ছিল স্যার উইলিয়ামের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কিছু একটা গুজব শুনেছিলাম, কিন্তু সম্ভবত তা দ্বিতীয় লেডি কারমাইকেলের বিরুদ্ধে কিছু, এরকম অস্পষ্ট একটা ধারণা ছাড়া আর নিশ্চিতভাবে কিছুই মনে করতে পারলাম না।
সেটল আমাকে স্টেশনে নিতে এল।
“তুমি এসে যে কী উপকার করলে!” আমার হাত চেপে ধরে সে বলল।
“না না, কী যে বলো! এ তো আমারও কাজের জিনিস, তাই না?”
“ভীষণভাবে।”
“তার মানে কোনও মানসিক রোগ, তাই তো?” আমি তড়িঘড়ি বললাম, “যার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকত্ব আছে?”
ইতিমধ্যে আমার মালপত্র নেওয়া হয়ে গেছে। আমরা একটা ছোট্ট জুড়িগাড়িতে স্টেশন থেকে ওল্ডেনের দিকে রওনা দিয়েছি, প্রায় তিন মাইল পথ যেতে হবে। দুয়েক মিনিট সেটল কোনও উত্তর দিল না। তারপর হঠাৎ সে প্রায় ফেটে পড়ল।
“পুরো ব্যাপারটাই কেমন বোধগম্যতার বাইরে। একটা তেইশ বছরের ছেলে, সবদিক থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, বংশমর্যাদার সামান্য অহংকার বাদ দিলে অত্যন্ত হাসিখুশি সহৃদয়। যদিও খুব বুদ্ধিমান তা হয়তো বলা চলে না, কিন্তু সাধারণত একজন ভালো উচ্চবিত্ত ইংরেজ যুবক যেমন হয়ে থাকে ঠিক তেমন। একদিন রাত্রে সুস্থ শরীরে সে ঘুমোতে গেল, আর হঠাৎ পরের দিন সকালে তাকে পাওয়া গেল গ্রামের মধ্যে। প্রায় জড়বুদ্ধি অবস্থায় সে ঘুরে বেড়াচ্ছিল; কাউকে চিনতে পারছিল না, নিজের আপনজনদেরকেও না।”
“ওহ্!” আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। ঘটনাটি আমার বেশ আকর্ষণীয় লাগল। “সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রম? এটা ঘটল…”
“গতকাল সকালে। আগস্ট মাসের ৯ তারিখে।”
“কিন্তু এমন কিচ্ছু ঘটেনি, মানে ধরো এমন কিছু ধাক্কা-টাক্কা, যার জন্য এরকম হতে পারে?”
“কিচ্ছু না।”
আমার হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল।
“তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছ?”
“ন-না তো!”
সেটলের ইতস্তত ভাব আমার সন্দেহকে আরও দৃঢ়বদ্ধ করল।
“দেখো, আমার কিন্তু সবকিছু জানা দরকার।”
“আসলে এটা আর্থারের ব্যাপারে কিছু নয়। এটা, এটা ওই বাড়িটার ব্যাপারে।”
“বাড়িটার ব্যাপারে!” আমি খুব অবাক হয়ে তার কথার প্রতিধ্বনি করলাম।
“তুমি তো এসব নিয়ে বেশ ভালোই ঘাঁটাঘাঁটি করেছ, তাই না কারস্টেয়ার্স? তথাকথিত ‘পোড়ো’ বাড়ি নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষানিরীক্ষা করেছ। এইসব ব্যাপারে তোমার মতামত কী?”
“দশটার মধ্যে ন’টাই ভাঁওতা। তবে দশ নম্বরটা, বলতে পার এমন কিছু ঘটনা ঘটতে দেখেছি যার কোনও ব্যাখ্যা সাধারণ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেওয়া সম্ভব নয়। আমি অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করি।”
সেটল ঘাড় নাড়ল।
আমরা সবে পার্ক গেটের কাছে মোড় ঘুরছি, এমন সময় সেটল তার হাতের বেতটা তুলে একটা ছোটো পাহাড়ের পাশের নীচু জমিতে একটা সাদা অট্টালিকার দিকে দেখাল।
“ওই বাড়িটা।” সে বলল, “মানে, ওই বাড়িটাতে কিছু না কিছু একটা আছে। কিছু একটা অশুভ, ভয়ংকর। আমরা সবাই অনুভব করতে পারি… আর আমি… আমার তো কোনও কুসংস্কার নেই…”
“সেটা ঠিক কেমন ধরনের বলো দেখি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। “আমার মনে হয় আগে থেকে তোমার কিছু না জানাই ভালো। দেখো, তুমি মানে, আগে থেকে কিচ্ছু না জেনে এখানে এসে একেবারে নিরপেক্ষভাবে, মানে তুমিও যদি দেখতে পাও…”
“হ্যাঁ,” আমি বললাম, “তা অবিশ্যি। কিন্তু আমার খুব সুবিধে হয় যদি তুমি ওই পরিবারটির ব্যাপারে আমাকে আরও কিছু বলো।”
“স্যার উইলিয়াম,” বলে চলল সেটল, “দু’বার বিয়ে করেছিলেন। আর্থার তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তান। ন’বছর আগে তিনি আবার বিয়ে করেন এবং এই দ্বিতীয় লেডি কারমাইকেল এক অদ্ভুত রহস্যময়ী মহিলা। উনি আধা ইংরেজ, আর আমার ধারণা, ওঁর শিরায় এশিয় রক্ত বইছে।”
সেটল চুপ করল।
“সেটল,” আমি বললাম, “তুমি লেডি কারমাইকেলকে একেবারেই পছন্দ করো না মনে হচ্ছে।”
তার পরিষ্কার স্বীকারোক্তি, “না, করি না। সবসময় মনে হয়, ওঁর মধ্যে না, অশুভ কিছু একটা আছে। যাক গে, যা বলছিলাম, এই দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে স্যার উইলিয়ামের আরেকটি সন্তান হয়। সেটিও পুত্রসন্তান, তার বয়স এখন আট বছর। তিন বছর হল স্যার উইলিয়াম দেহ রেখেছেন, তারপর আর্থার তাঁর উপাধি এবং পদ লাভ করেছে। তার সৎ মা এবং সৎ ভাই তার সঙ্গে ওল্ডেনেই থেকে গেছে। তোমাকে খুলেই বলছি, ওদের এস্টেটের অবস্থা এখন বেশ শোচনীয়। স্যার আর্থারের প্রায় সমস্ত উপার্জনটাই চলে যায় এস্টেটের রক্ষণাবেক্ষণ করতে। স্যার উইলিয়াম তাঁর স্ত্রীর জন্য বছরে মাত্র কয়েকশো টাকার বেশি কিছু ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি, কিন্তু সৌভাগ্যবশত আর্থারের সঙ্গে তার সৎ মায়ের সম্পর্ক বেশ ভালো। তিনি সঙ্গে থেকে যাওয়াতে ও বেশ খুশিই হয়েছিল। এখন…”
“বলো।”
“মিস ফিলিস প্যাটারসন নামে একটি খুব সুন্দর মেয়ের সঙ্গে দু’মাস আগে আর্থারের বাগদান হয়।” সে গলার স্বর নামিয়ে কিছুটা আবেগের সঙ্গেই বলে চলল, “সামনের মাসে তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। মেয়েটি এখন এখানেই আছে। তার দুঃসহ অবস্থার কথা নিশ্চয়ই ভাবতে পারছ।”
আমি নীরবে মাথা নীচু করলাম।
আমাদের গাড়িটা এখন বাড়ির খুব কাছে পৌঁছে গেছে। আমাদের ডানদিকে সামান্য ঢালু হয়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা বাগান নেমেছে। হঠাৎ একটা খুব সুন্দর দৃশ্য দেখতে পেলাম। একটা অল্পবয়সী মেয়ে বাগান পেরিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে আসছে। তার মাথায় টুপি নেই, তাই রোদ পড়ে তার সুন্দর সোনালি চুল আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তার হাতের ঝুড়িতে ভর্তি গোলাপ আর একটা খুব সুন্দর ধূসর পার্সিয়ান বেড়াল তার হাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার পায়ে পায়ে আসছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সেটলের দিকে তাকালাম।
“ইনিই মিস প্যাটারসন।” সে বলল।
“বেচারি।” আমি বললাম, “বেচারি মেয়েটি। ওই গোলাপ আর ওই ধূসর বেড়ালের সঙ্গে তাকে কী অপূর্বই না দেখাচ্ছে।”
একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে আমি তক্ষুনি ঘুরে আমার বন্ধুর দিকে তাকালাম। তার হাত থেকে লাগামটা খসে পড়েছে, আর তার মুখটা সাদা হয়ে গেছে।
“কী হয়েছে?” আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
অনেক চেষ্টা করে সে স্বাভাবিক হল। একটুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম। সেটলের পিছু পিছু আমি একটা সবুজ রঙের বসবার ঘরে এসে উপস্থিত হলাম, সেখানে চায়ের ব্যবস্থা ছিল। একজন মধ্যবয়স্কা কিন্তু এখনও বেশ সুন্দরী ভদ্রমহিলা আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন এবং হাত বাড়িয়ে অভিবাদন জানাতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
“ইনিই আমার বন্ধু ডাঃ কারস্টেয়ার্স, লেডি কারমাইকেল।”
কিন্তু সেই সুন্দরী এবং মহিমান্বিত মহিলার সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে যে আমার কী পরিমাণ বিতৃষ্ণা বোধ হল ঠিক বোঝাতে পারব না। তাঁর নির্জীব আভিজাত্য দেখে আরও বেশি করে মনে হতে লাগল তাঁর প্রাচ্যদেশীয় রক্ত সম্পর্কে সেটলের অনুমান একেবারে সঠিক।
“এই যে আপনি এখানে এসেছেন, তা আপনার বিশেষ বদান্যতা ডাঃ কারস্টেয়ার্স,” নীচু অথচ সুরেলা কণ্ঠে তিনি বলে চললেন, “বিশেষ করে আমাদের এমন বিপদের দিনে।”
আমি ছোট্ট করে কিছু একটা উত্তর দিলাম আর তিনি আমাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই নিচের বাগানে দেখা মেয়েটি এসে ঘরে ঢুকল। তার হাতে গোলাপের ঝুড়িটা ছিল, কিন্তু বেড়ালটাকে আর দেখতে পেলাম না। সেটল আমাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে সে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল।
“ওহ্, ডাঃ কারস্টেয়ার্স, ডাঃ সেটল আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন। আমি খুব আশা করে আছি যে আপনি বেচারা আর্থারের জন্য কিছু করতে পারবেন।”
মিস প্যাটারসন নিঃসন্দেহে খুব সুন্দর মেয়ে, যদিও তার গালগুলো বিবর্ণ এবং তার ঝকঝকে সুন্দর চোখগুলোর চারপাশে কালি পড়েছে।
“দেখুন মা,” আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, “আপনার হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। এরকম স্মৃতিভ্রম হওয়া কিংবা অন্য আর কোনও ব্যক্তিত্ব এসে পড়াটা প্রায়ই খুব স্বল্পস্থায়ী হয়। যেকোনও মুহূর্তে রোগী আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেও আসে।”
সে মাথা নেড়ে বলল, “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে এটা ওর অন্য কোনও ব্যক্তিত্ব, ও যেন আর্থারই নয়, এটা ওর কোনও ব্যক্তিত্বই নয়। এটা কোনোমতেই ও নয়। আমি…”
“ফিলিস সোনা,” লেডি কারমাইকেল খুব নরম গলায় বললেন, “এই নাও তোমার চা।”
কিন্তু লেডি কারমাইকেলের চোখের দৃষ্টিতে এমন একটা কিছু ছিল যা দেখে আমার মনে হল তাঁর ভাবী পুত্রবধূর প্রতি তাঁর আদৌ কোনও ভালোবাসা নেই।
মিস প্যাটারসন চা নিতে চাইল না। পরিস্থিতিটাকে একটু হালকা করার জন্য আমি বললাম, “আপনাদের বেড়ালটাকে একটু দুধ দেবেন না?”
মিস প্যাটারসন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বেড়াল?”
“হ্যাঁ! এই যে আপনার সঙ্গে একটু আগে বাগানে ঘুরছিল।”
একটা শব্দে আমার কথা মাঝপথেই থামাতে হল। লেডি কারমাইকেলের হাত থেকে চায়ের কেটলিটা পড়ে গিয়ে সারা ঘর জুড়ে গরম জল ছিটিয়ে পড়েছে। আমি পরিস্থিতিটা সামাল দিলাম, আর ফিলিস প্যাটারসন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সেটলের দিকে তাকাল। সেটল উঠে দাঁড়াল।
“তুমি কি এখন একবার তোমার রোগীর সঙ্গে দেখা করবে কারস্টেয়ার্স?”
আমি তক্ষুনি তাকে অনুসরণ করলাম। মিস প্যাটারসনও আমাদের সঙ্গে গেল। আমরা ওপরে গেলাম। সেটল তার পকেট থেকে একটা চাবি বের করল। “ওর আসলে হঠাৎ হঠাৎ বাইরে চরে বেড়াবার নেশা পেয়ে বসে।” সেটল বলল, “তাই আমি বাড়ির বাইরে গেলে সাধারণত ওর ঘরে তালা দিয়ে যাই।”
সে তালা খুলতে আমরা ভেতরে ঢুকলাম।
তরুণ কারমাইকেল জানালার ধারে বসে আছে, সেই জানালা দিয়ে অস্তগামী সূর্যের শেষ ঝলমলে সোনালি আলো এসে পড়েছে। সে অদ্ভুতরকম চুপ করে বসে আছে। কেমন যেন গুটিয়ে আছে অথচ বেশ আরামে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম সে আমাদের উপস্থিতি টের পায়নি, কিন্তু তারপর আবিষ্কার করলাম যে অপলক নেত্রে সে বেশ ভালোমতোই আমাদের লক্ষ করছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে চোখ নামিয়ে নিয়ে চোখ পিটপিট করল, কিন্তু একটুও নড়ল না।
“আর্থার, এসো।” সেটল বেশ খুশি খুশি গলায় ডাকল, “মিস প্যাটারসন আর আমার এক বন্ধু তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”
কিন্তু একইভাবে জানালার পাশে বসে তরুণটি কেবল আরও একবার চোখ পিটপিট করল।
কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই দেখি তরুণটি সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে আবার আমাদেরকে লক্ষ করছে।
“তোমাকে চা দিই?” যেন একটা ছোটো বাচ্চার সঙ্গে কথা বলছে সেভাবে সেটল এবারও বেশ খুশি খুশি উদাত্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।
সে টেবিলে এক কাপ ভর্তি দুধ রাখল। আমার অবাক দৃষ্টি দেখে সেটল মৃদু হাসল।
“মজার ব্যাপার হল,” সেটল বলল, “ও পানীয় বলতে এখন কেবল দুধই খাচ্ছে।”
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আর্থার কারমাইকেল ধীরেসুস্থে এক এক করে হাত-পা ছড়িয়ে ওই গুটিসুটি মেরে বসা অবস্থা থেকে উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে টেবিলের দিকে গেল। আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম ওর নড়াচড়া একেবারেই নিঃশব্দ, পা ফেলার এতটুকু আওয়াজ পর্যন্ত হল না। টেবিলের কাছে পৌঁছনো মাত্রই সে একটা পা সামনের দিকে আরেকটা পা পিছনের দিকে বাড়িয়ে বেশ ভালো করে আড়মোড়া ভাঙল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে এরকম হাত-পা নাড়াচাড়া করে তারপর একটা লম্বা হাই তুলল। এমন হাই তোলা আমি জীবনে কখনও দেখিনি! সারা মুখ এক করে যেন সে হাঁ করল। এবার সে দুধের দিকে মনোযোগ দিল। সামনের দিকে ক্রমশ ঝুঁকতে থাকল, যতক্ষণ না তার ঠোঁট কাপের দুধকে স্পর্শ করল।
আমার হতভম্ব ভাব দেখে সেটল নিজেই উত্তর দিল, “কিছুতেই হাত লাগাবে না। যেন কোন এক আদিম অবস্থায় ফিরে গেছে। অদ্ভুত, তাই না?”
আমি অনুভব করলাম আমার পাশে ফিলিস প্যাটারসন যেন কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি তাঁর হাত ধরে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
অবশেষে দুধ খাওয়ার পর্ব চুকল। আর্থার কারমাইকেল আবার একটা লম্বা আড়মোড়া ভেঙে সেই একইরকম নিঃশব্দ পদক্ষেপে তার জানলার পাশের আসনটিতে ফিরে গিয়ে বসল; সেই একইরকম গুটিসুটি মেরে, একইভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগল।
মিস প্যাটারসন আমাদের টেনে ঘরের বাইরের লম্বা টানা বারান্দায় নিয়ে গেল। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। “ওহ্, ডাঃ কারস্টেয়ার্স!” সে কেঁদে ফেলল, “এটা ও নয়। ঘরের ভেতরে যে রয়েছে, সে আর্থার নয়! আমাকে বুঝতে হবে, আমাকে জানতে হবে…”
আমি দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়ালাম। “মানুষের মস্তিষ্ক বড়ো অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটায় মিস প্যাটারসন।”
আমি স্বীকার করছি এই ঘটনায় আমিও রীতিমতো থতমত খেয়ে গেছিলাম। এতে খুব অস্বাভাবিক কিছু ব্যাপার ছিল। যদিও আমি তরুণ কারমাইকেলকে আগে কখনও দেখিনি, কিন্তু তার হাঁটাচলার ধরন আর বিদঘুটে চোখ পিটপিটানো দেখে আমার কারুর বা কিছুর একটা কথা মনে হচ্ছিল, কিন্তু আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কীসের কথা।
সেদিন আমাদের রাতের খাওয়া খুব চুপচাপ হল। আমাকে আর লেডি কারমাইকেলকেই কোনোমতে কথাবার্তা চালিয়ে নিয়ে যাবার ভারটা বইতে হল। খাওয়া শেষে ভদ্রমহিলারা উঠে গেলে সেটল বাড়ির কর্ত্রী সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চাইল।
“আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই,” আমি বললাম, “কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই ওঁকে আমার ভীষণ অপছন্দ হয়েছে। তুমি ঠিকই বলেছ, ওঁর শরীরে প্রাচ্যের রক্ত বইছে, আর আমার এও মনে হয়ছে যে ওঁর কোনও অতিলৌকিক ক্ষমতা আছে। ওঁর মধ্যে একটা অস্বাভাবিকরকম আকর্ষণী শক্তি আছে।”
সেটল কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল এবং দুয়েক মিনিট পর বলল, “সব ভালোবাসা উনি ওঁর ছোট্ট ছেলেটির জন্যই উজাড় করে দিয়েছেন।”
রাতের খাওয়ার পর আমরা আবার সেই সবুজ বসার ঘরে বসে ছিলাম। আমরা সবে কফি শেষ করে কোনোভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় দরজার বাইরে থেকে বেড়ালটা খুব করুণ স্বরে ম্যাও ম্যাও করে ভেতরে আসার জন্য আকুতি জানাতে লাগল। কেউ খেয়ালই করছিল না, কিন্তু আমি খুব জীবজন্তু ভালোবাসি বলে কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালাম। “বেচারিকে ভেতরে আসতে দিতে পারি?” লেডি কারমাইকেলকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
তাঁর মুখ যেন বিবর্ণ হয়ে উঠল। কিন্তু তাঁর আলতো মাথা নাড়াকে তাঁর সম্মতি বলে ধরে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। অথচ বাইরের লম্বা টানা বারান্দায় কেউ কোত্থাও নেই!
“আশ্চর্য!” আমি বললাম, “আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে আমি একটা বেড়ালের ডাক শুনেছি।”
আমি চেয়ারের দিকে ফিরে আসতে আসতে লক্ষ করলাম, সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। তাতে আমার কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হল। আমরা তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলাম, সেটল আমার সঙ্গে আমার ঘর পর্যন্ত এল। “যা দরকার সব পেয়েছ?” চারদিকে দেখতে দেখতে সে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, ধন্যবাদ।”
তবুও সে সেখানে দাঁড়িয়ে কেমন একটা উসখুস করতে লাগল, যেন সে কিছু বলতে চায় কিন্তু ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না।
“আচ্ছা শোনো,” আমি বলে উঠলাম, “তুমি যে বলছিলে এই বাড়িটাতে অশুভ কিছু আছে? কিন্তু এখনও তো সব স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে।”
“তোমার মনে হচ্ছে এই বাড়িটা খুব আনন্দে ভরে আছে?”
“এই পরিস্থিতিতে তো একবারেই নয়। এখন একটা বড়ো দুঃখের ছায়া পড়েছে। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুর কথা যদি বলো, তেমন কিছু কিন্তু এখনও আমি দেখতে পাচ্ছি না।”
“শুভরাত্রি,” সেটল হঠাৎ বলে উঠল, “ভালো স্বপ্ন দেখো।”
স্বপ্ন আমি দেখলাম বটে। মিস প্যাটারসনের বেড়ালটা এমনভাবেই আমার মন জুড়ে বসেছিল, যে সারারাত ধরে মনে হল আমি কেবল বেড়ালটারই স্বপ্ন দেখছি।
হঠাৎ জেগে উঠে টের পেলাম কেন আমি কেবল বেড়ালের স্বপ্নই দেখে চলেছি। জন্তুটা আমার দরজার বাইরে সমানে ম্যাও ম্যাও করে যাচ্ছে। এত আওয়াজের মধ্যে ঘুমোনো অসম্ভব। আমি মোমবাতি জ্বেলে দরজা খুলে দাঁড়ালাম। কিন্তু সব শুনশান, যদিও ম্যাও ম্যাও ডাকটা ক্রমাগত হয়ে চলেছে। আমার মাথায় একটা নতুন ভাবনা এল। বেচারা প্রাণীটা কোথাও একটা আটকে পড়েছে, আর বেরোতে পারছে না। বাঁদিকে বারান্দার শেষ মাথায় লেডি কারমাইকেলের ঘর। তাই আমি ডানদিকে ফিরে কয়েক পা যেতেই আমার পেছন থেকে আবার বেড়ালের ডাক। আমি ঝট করে ঘুরলাম এবং আওয়াজটা আবার এল, স্পষ্টতই এবার আমার ডানদিক থেকে।
কীসের জন্য জানি না, হঠাৎ কেমন কাঁপুনি ধরল, আর তাই আমি সাত তাড়াতাড়ি আমার ঘরে ফিরে গেলাম।
এখন সব চুপচাপ। আমি আবার গভীর ঘুমে ডুব দিলাম। একেবারে পরেরদিন এক ঝলমলে সকালে ঘুম ভাঙল। পোশাক পরে তৈরি হতে হতে জানালা দিয়ে যার জন্য আমার রাতের ঘুম যে নষ্ট হয়েছে তাকে দেখতে পেলাম। ধূসর বেড়ালটা ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে বাগান পেরিয়ে যাচ্ছে। কাছেই ছোটো একদল পাখি কিচিরমিচির করছিল, মনে হল তারাই ওর শিকারের নিশানা।
কিন্তু তারপরেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। বেড়ালটা সোজা পাখির ঝাঁকের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেল, প্রায় তাদের গায়ে গা ঘেঁষে, কিন্তু পাখিগুলো উড়ে পালাল না। আমি এর ব্যাখ্যা পেলাম না। মনে হল পুরোটাই কেমন আমার বোঝার বাইরে।
কিন্তু এই ঘটনা আমার মনে এমন ছাপ ফেলে গেল যে প্রাতরাশের সময়ে সে ব্যাপারে না বলে আমি পারলাম না। “আপনি কি জানেন,” বললাম লেডি কারমাইকেলকে, “যে আপনাদের বেড়ালটা খুব অস্বাভাবিক?”
কাপের সঙ্গে ডিশের ঠনঠন শব্দে তাকিয়ে দেখি ফিলিস প্যাটারসন বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে আর সে যেন কেমন হাঁপাচ্ছে।
এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপরেই লেডি কারমাইকেল খুব স্পষ্ট অসম্মতির সুরে বলে উঠলেন, “আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। এখানে কোনও বেড়াল নেই। আমার কোনোদিনই বেড়াল ছিল না।”
বুঝলাম ভুল পথে পা বাড়িয়েছি, তাই তাড়াতাড়ি বিষয় পালটে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন ধাঁধার মতো ঠেকছিল। লেডি কারমাইকেল কেন বললেন যে ও-বাড়িতে কোনোকালেই কোনও বেড়াল ছিল না? তবে কি বেড়ালটা মিস প্যাটারসনের, যার উপস্থিতির কথা বাড়ির কর্ত্রীর কাছে গোপন রাখা হয়েছে? হয়তো আজকাল অনেকের মধ্যেই যেমন দেখা যায়, লেডি কারমাইকেলেরও তেমন বেড়ালের ওপর বিতৃষ্ণা আছে। যদিও এই ব্যাখ্যাটা বিশেষ গ্রহণযোগ্য নয়, তবুও আপাতত এই নিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হল।
আমাদের রোগীর অবস্থা এখনও একইরকম। এবার আমি তাকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলাম। গত রাত্রের চেয়ে আরও ভালো করে তাকে লক্ষ করার সুযোগ পেলাম। আমার পরামর্শ অনুযায়ী সে যাতে তার পরিবারের সঙ্গে যথাসম্ভব বেশি সময় কাটাতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমি আশা করেছিলাম এতে শুধুমাত্র তার অসতর্ক মুহূর্তে তাকে লক্ষ করার সুবিধে হবে তাই নয়, তার প্রাত্যহিক জীবনচর্যা হয়তো তার বোধবুদ্ধিকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু তার ব্যবহারে কোনও পরিবর্তনই লক্ষ করা গেল না। সে শান্ত এবং বাধ্য হয়ে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, কিন্তু অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে সকলকে লক্ষ করে চলল। যে ব্যাপারটা আমার খুব চোখে পড়ল তা হল তার সৎ মায়ের প্রতি তার গভীর অনুরাগ। মিস প্যাটারসনকে সে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলল, কিন্তু সবসময় লেডি কারমাইকেলের যত কাছাকাছি সম্ভব গিয়ে বসতে লাগল এবং একবার তো দেখলাম সে কেমন একটা বোবা ভালোবাসার অভিব্যক্তি নিয়ে লেডি কারমাইকেলের কাঁধে মুখ ঘষল।
আমি এই পুরো ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম ঘটনাগুলোর মধ্যে কিছু একটা সূত্র লুকিয়ে আছে, কিন্তু সেটা কী আমি ধরতে পারছি না।
“এটা একটা ভীষণ অদ্ভুত ঘটনা।” আমি সেটলকে বললাম।
“হ্যাঁ,” সে বলল, “এ ঘটনাটা ভীষণ ইঙ্গিতপূর্ণ।”
আমার মনে হল সে আমার থেকে কিছু যেন গোপন করছে।
“সত্যি করে বলো তো,” সে বলল, “ওকে দেখে তোমার মানে, কিছুর কথা মনে পড়ে না?”
তার কথায় আমার যেন সজোরে ঝটকা লাগল, আমার আগের দিনের ধারণার কথা মনে পড়ে গেল। “কীসের কথা মনে পড়বে বলো তো?” আমি জানতে চাইলাম।
সে মাথা নাড়ল। “হয়তো এ আমার কল্পনা,” সে বলল, “নিছক কল্পনা।” কিন্তু এরপর সে আর এই ব্যাপারে কিছুই বলল না।
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা যেন কেমন রহস্যে মোড়া। আমার মাথায় কেবলই ঘুরতে লাগল কিছু একটা সূত্র আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে যেটা থেকে হয়তো আমি কোনও দিশা দেখতে পেতাম। আরেকটা ছোটো ঘটনাও কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আমি ওই সামান্য ধূসর বেড়ালটার কথা বলছি। যেকোনও কারণেই হোক জিনিসটা আমার মাথায় চেপে বসেছে। আমি বেড়ালটাকে স্বপ্নে দেখছি, সমানে যেন তার ডাক শুনতে পাচ্ছি। বারবার মনে হচ্ছে সুন্দর প্রাণীটা আমার থেকে কিছু দূরেই এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে ঘিরে কোনও রহস্য থাকার সম্ভাবনা যেন আমার আরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠল। তাই হঠাৎ উত্তেজনার বশে আমি একদিন বিকেলে ওই বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে গিয়ে কথা বললাম। “যে বেড়ালটাকে দেখতে পাই, তার ব্যাপারে কিছু বলতে পারো?” তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“বেড়ালটার কথা বলছেন হুজুর?” সে বিস্মিত কিন্তু বিনীতভাবে জানতে চাইল।
“এখানে কি কোনও বেড়াল ছিল বা আছে?”
“মালকিনের একটা বেড়াল ছিল হুজুর, একটা চমৎকার বেড়াল। কিন্তু সে তো রইল না! ভাবলে খারাপই লাগে, সত্যিই সুন্দর ছিল প্রাণীটা।”
“ধূসর বেড়াল কি?” আমি ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ হুজুর, পার্সিয়ান।”
“তুমি নিশ্চিত, সে আর নেই?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর, একেবারে নিশ্চিত। মালকিন তো তাকে কোনও পশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন না, যা করার নিজেই করলেন। এক সপ্তাহও হয়নি এখনও। ওইদিকের কাঠচাঁপা গাছটার নিচে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে হুজুর।” বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আমাকে আমার ভাবনার জগতে ছেড়ে রেখে।
লেডি কারমাইকেল কেন এত জোর দিয়ে বলেছিলেন যে তাঁর কখনও কোনও বেড়াল ছিল না?
আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলতে লাগল সামান্য এই বেড়ালের ব্যাপারটা আদতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি সেটলকে খুঁজে বের করে তাকে আলাদা ডেকে নিয়ে গেলাম। “দেখো সেটল, আমি তোমার থেকে একটা কথা জানতে চাই। তুমি এ বাড়িতে কোনও বেড়াল দেখেছ বা তার ডাক শুনেছ অথবা দুটোই? নাকি কোনোটাই নয়?”
এ প্রশ্নে সে একেবারেই অবাক হল না, বরং মনে হল এ প্রশ্ন সে যেন আশাই করছিল।
“আমি তার ডাক শুনেছি, কিন্তু তাকে চোখে দেখিনি।”
“কিন্তু প্রথম দিন!” আমি চিৎকার করে বললাম, “মিস প্যাটারসনের সঙ্গে বাগানে!”
সে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। “আমি কেবল মিস প্যাটারসনকে বাগান পেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম, আর কিচ্ছু দেখিনি।”
আমি এবার একটু একটু বুঝতে পারছিলাম। “তাহলে ওই বেড়ালটা?”
সেটল ঘাড় নাড়ল। “আমি দেখতে চাইছিলাম যে তুমি একদম নিরপেক্ষভাবে আমরা সকলে যা শুনি তা শুনতে পাও কি না।”
“তার মানে তোমরা সবাই শুনতে পাও?”
সে আবার ঘাড় নাড়ল।
“ভারি আশ্চর্য!” আমি খুব চিন্তিত হয়ে বিড়বিড় করে বললাম, “জীবনে শুনিনি কোথাও কোনও বেড়ালের আত্মা হানা দিয়েছে!”
আমি সেটলকে কাজের লোকের কাছে যা শুনেছি বলাতে সে ভারি অবাক হল। “এটা তো আমার কাছেও একটা খবর। আমি তো জানতামই না!”
“কিন্তু এর মানে কী?” আমি অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করলাম।
সে মাথা নাড়ল, “কেবল ভগবানই জানেন! কিন্তু সত্যি বলছি কারস্টেয়ার্স, আমার ভয় করছে। ওর, মানে ওটার ডাকের মধ্যে, মানে কেমন যেন একটা ভয় জাগানো ব্যাপার আছে।”
“ভয় জাগানো?” আমি একটু রূঢ়ভাবেই বলে উঠলাম, “কার ভয় জাগাতে চাইছে?”
সে হাত উলটে বলল, “তা বলতে পারব না।”
সেদিন রাত্রে খাওয়ার আগে পর্যন্ত তার কথার মর্মার্থ আমি উপলব্ধি করতে পারিনি। আমরা সেই সবুজ বসার ঘরটাতেই বসেছিলাম, ঠিক যেদিন পৌঁছেছিলাম সেদিনকার মতো। এমন সময় সে এল। দরজার বাইরে থেকে বেশ জোরালো বেড়ালের ডাক শুরু হল। কিন্তু এবার একদম নির্ভুলভাবে বেশ রাগত স্বরে সে ডাকছে। সে ডাকের মধ্যে বেশ একটা হিংস্রতা আছে, সেটা বেশ প্রলম্বিত এবং ভয় জাগানোর মতো। তারপর যে মুহূর্তে সে ডাক থামল, দরজার বাইরের পেতলের কড়াটাতে বেড়ালের থাবার হিংস্র আঁচড়ের আওয়াজ আসতে লাগল।
সেটল সচকিত হয়ে উঠল। “আমি শপথ নিয়ে বলতে পারি এটা সত্যি।” চিৎকার করে বলল সে। সে দৌড়ে দরজার কাছে গেল এবং এক ঝটকায় দরজাটা হাট করে খুলে দিল। কোথাও কিচ্ছু নেই। সে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ফিরে এল।
ফিলিসকে বিবর্ণ দেখাচ্ছিল, সে কাঁপতে শুরু করল। লেডি কারমাইকেলের মুখ সাদা হয়ে গেছে। কেবলমাত্র আর্থার গুটিসুটি মেরে তার মায়ের হাঁটুতে মাথা রেখে শান্ত, অবিচলিতভাবে বসে আছে। মিস প্যাটারসন আমার হাতের ওপর হাত রাখল এবং আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম।
“উফ্! ডাঃ কারস্টেয়ার্স,” সে কেঁদে ফেলল, “এসব কী হচ্ছে? এসবের মানে কী?”
“আমরা এখনও জানি না মা।” বললাম আমি। “কিন্তু আমি অবশ্যই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তুমি ভয় পাবে না। আমি নিশ্চিত যে ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের বিপদের কোনও সম্ভাবনা নেই।”
সে সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকাল, “আপনার তাই মনে হয়?”
“আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।” দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলাম। আমার মনে পড়ছিল সেদিন ধূসর বেড়ালটা কেমন ভালোবেসে মিস প্যাটারসনের পায়ে পায়ে ঘুরছিল এবং আমার কোনও ভুল হয়নি। ওই ভয় উদ্রেক করাটা তার উদ্দেশ্যে নয়।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল, কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তির মধ্যে ঠিকমতো ঘুম হল না। তার মধ্যেও কেমন একটা ঝটকা লেগে ঘুম ভেঙে গেল। একটা খড়খড়ে আঁচড়ানোর শব্দ আসছিল, যেন কিছু একটা ফালাফালা করে ছেঁড়া হচ্ছে। আমি বিছানা থেকে লাফ মেরে উঠে বাইরের টানা বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। ঠিক তখনই উলটোদিক থেকে সেটলও তার ঘর ছেড়ে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এল। আওয়াজটা আমাদের বাঁদিক থেকে আসছে।
“শুনছ কারস্টেয়ার্স?” চিৎকার করে বলল সে, “শুনছ?”
আমরা হুড়মুড় করে লেডি কারমাইকেলের দরজার সামনে চলে এলাম। আমাদের পাশ কাটিয়ে কেউ যায়নি, কিন্তু গোলমালটা থেমে গেছে। মোমবাতির আলোয় দরজার প্যানেল ঝকঝক করছে, কিন্তু তার সামনেটা একদম ফাঁকা। আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম।
“তুমি জানো ওটা কী ছিল ?” প্রায় ফিসফিস করে সেটল বলল।
আমি ঘাড় নাড়লাম। “একটা বেড়ালের নখ দিয়ে ফালাফালা করে কিছু ছেঁড়ার আওয়াজ।” আমি একটু কেঁপে উঠলাম। হঠাৎ চমকে উঠে মোমবাতিটা নীচু করে ধরলাম। “এখানে দেখো সেটল।”
দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে একটা চেয়ার দাঁড় করানো ছিল, আর তার গদিটা কেউ নখের লম্বা আঁচড় দিয়ে ফালাফালা করে ছিঁড়েছে। আমরা খুব কাছ থেকে সেটা পরীক্ষা করলাম। সেটল আমার দিকে তাকাল আর আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম।
“বেড়ালের আঁচড়।” বলে সে একটা লম্বা শ্বাস নিল। “কোনও ভুল নেই।” তার চোখ এবার চেয়ার ছেড়ে বন্ধ দরজাটার দিকে গেল। “এঁর মনেই ভয়ের উদ্রেক করা হচ্ছে। লেডি কারমাইকেল!”
সে রাতে আর ঘুমোতে পারলাম না। এমন একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে কিছু একটা করতেই হবে। যতটা বুঝতে পারছিলাম, একমাত্র একজনের কাছেই এই রহস্যের চাবিকাঠি থাকতে পারে। আমার সন্দেহ হল লেডি কারমাইকেল যতটা বলছেন তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু তিনি জানেন।
পরদিন সকালে যখন তিনি নিচে নামলেন, তাঁকে মৃতবৎ বিবর্ণ দেখাচ্ছিল এবং প্লেটের ওপর খাবার নিয়ে কেবল নাড়াচাড়া করলেন, ঠিক করে খেলেন না। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে কেবল এক দৃঢ় সঙ্কল্পর জন্য কোনোমতে তিনি ভেঙে পড়া থেকে বেঁচে আছেন। প্রাতরাশের পর আমি তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাইলাম, সোজাসুজি বিষয়ে চলে এলাম।
“লেডি কারমাইকেল,” বললাম আমি, “কিছু কিছু কারণে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে আপনি খুব বিপদের মধ্যে আছেন।”
“তাই বুঝি?” খুব অবলীলায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন তিনি।
“এই বাড়িতে,” আমি বলে চললাম, “একটা কিছু, কারুর একটা উপস্থিতি আছে যা আপনার প্রতি ভীষণ বিরূপ।”
“কী যা তা বকছেন!” বিরক্তির সঙ্গে বললেন তিনি, “এইসব হাবিজাবিতে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”
“আপনার ঘরের বাইরের চেয়ারটাকে,” আমি শুকনো গলায় বলে চললাম, “গতকাল রাতে কেউ ফালাফালা করে ছিঁড়েছে।”
“তাই?” চোখ বড়ো বড়ো করে অবাক হওয়ার ভান করলেন তিনি, কিন্তু পরিষ্কার দেখলাম আমি তাঁকে কোনও নতুন খবর দিইনি। “কেউ খুব বিচ্ছিরি রসিকতা করেছে মনে হচ্ছে।”
“তা নয়।” আমি একটু আবেগপূর্ণ গলায় বললাম, “আমি চাই আপনি আমাকে বলুন। আপনার নিজের সুরক্ষার জন্যই।” বলে আমি থামলাম।
“কী বলার কথা বলছেন বলুন তো?” জানতে চাইলেন তিনি।
“যেকোনও কিছু, যা এই ব্যাপারটাতে কিছু আলোকপাত করতে পারে।” আমি গম্ভীরভাবে বললাম।
তিনি হাসলেন। “আমি কিচ্ছু জানি না।” বললেন তিনি, “কিচ্ছু না।”
কোনও বিপদের আশঙ্কাই তাঁকে তাঁর বক্তব্য থেকে টলাতে পারবে না। কিন্তু তবুও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমাদের সবার চাইতেই তিনি অনেক বেশি কিছু জানেন এবং যেগুলো বিষয়ে আমাদের কোনও ধারণাই নেই সেসব সম্পর্কেও কিছু সূত্র তাঁর কাছে আছে। কিন্তু দেখলাম তাঁর পেট থেকে কথা বের করা একেবারেই অসম্ভব। ঠিক করলাম, যাই হয়ে যাক না কেন, আমি যথাযোগ্য সাবধানতা অবলম্বন করব, কারণ আমি নিশ্চিত জানতাম যে তাঁর এক বাস্তব আশু বিপদের আশঙ্কা ভীষণভাবে রয়েছে। তিনি তাঁর ঘরে সে রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে আমি আর সেটল মিলে তাঁর পুরো ঘর খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম। আমরা ঠিক করলাম, রাত্রে পালা করে আমরা ওই টানা বারান্দায় নজর রাখব।
প্রথমে আমার পালা ছিল। তেমন কিছু ঘটল না। তারপর তিনটের সময় সেটল এসে আমাকে রেহাই দিল। আগের রাতে ঘুম না হওয়ায় খুব ক্লান্ত ছিলাম, তাই শোওয়ামাত্রই ঘুমে ঢলে পড়লাম এবং ভীষণ কৌতূহলোদ্দীপক একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, ধূসর বেড়ালটা আমার পায়ের কাছে বসে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, আর তার চোখে একটা অদ্ভুত আর্তি। স্বপ্নের মধ্যেই বুঝতে পারছিলাম সে আমাকে তার পিছন পিছন যেতে বলছে। আমি তাই করলাম, আর সে আমাকে পথ দেখিয়ে একটা বড়ো সিঁড়ি দিয়ে ডানদিকে ঘুরে নিয়ে চলল বাড়ির ঠিক উলটোদিকের অংশে একটা ঘরে যেটা লাইব্রেরি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সে ঘরটার একদিকে গিয়ে থামল। সামনের একটা থাবা তুলে নিচের দিকের তাক থেকে একটা বইয়ের দিকে দেখাতে লাগল আর আমার দিকে সেই একইরকম আর্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বেড়াল, লাইব্রেরি সব ঝাপসা হয়ে গেল, আর আমি উঠে দেখলাম সকাল হয়ে গেছে।
সেটলের নজরদারির সময়েও কোনও ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু সে আমার স্বপ্নের কথা শুনতে বিশেষ উৎসাহী ছিল। আমার অনুরোধে সে আমাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল যেটা আমার দেখা স্বপ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে প্রাণীটা শেষবারের মতো আমার দিকে খুব দুঃখভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, সেই জায়গাটাকেও আমি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে ফেললাম।
আমরা দু’জনেই এক নিঃশব্দ আবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল, আর আমি ঝুঁকে পড়ে তার দেখানো জায়গাটা থেকে বইটার নাম পড়বার চেষ্টা করতে লাগলাম। দেখলাম সেই বইয়ের সারিতে একটা ফাঁক রয়েছে।
“এখান থেকে কোনও বই বের করে নেওয়া হয়েছে।” আমি সেটলকে বললাম।
সেও তাকের দিকে ঝুঁকল। “দেখো,” সে বলল, “এই পেছনের দিকে একটা পেরেক আছে যাতে ঐ নিরুদ্দেশ বইটার পাতার একটা টুকরো ছিঁড়ে আটকে আছে।”
খুব সাবধানে সে ওই ছেঁড়া টুকরোটা বের করল। আয়তনে সেটা এক বর্গ ইঞ্চির চেয়ে বেশি নয়, কিন্তু দুটো খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা সেখানে লেখা ছিল, ‘সেই বেড়াল…’
“আমার তো গা ছমছম করছে!” বলল সেটল, “এ বড়ো ভয়ংকর অশুভ।”
“আমি যেকোনও মূল্যে জানতে চাই,” আমি বললাম, “এখান থেকে কোন বই গায়েব হয়েছে। তোমার কোনও ধারণা আছে কীভাবে জানা যেতে পারে?”
“হয়তো বইগুলোর কোনও তালিকা আছে, হয়তো লেডি কারমাইকেল…”
আমি মাথা নাড়লাম। “লেডি কারমাইকেল কিছুই বলবেন না।”
“তোমার তাই মনে হয়?”
“আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। যা নিয়ে তুমি আমি অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি, লেডি কারমাইকেল তা জানেন এবং তাঁর নিজের কোনও কারণ আছে যে জন্য তিনি কিছুই বলবেন না। বরং তিনি শীগগিরই একটা ভয়ানক বিপদের ঝুঁকি নেবেন, তবুও মুখ খুলবেন না।”
সেদিনটা এমন ঘটনাবিহীন ভাবে কেটে গেল যে আমার ঝড়ের আগে প্রকৃতি শান্ত হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছিল। অদ্ভুতভাবে আমার মনে হচ্ছিল সমস্যার সমাধান খুব কাছাকাছি এসে গেছে। আমি তখনও অন্ধকারেই হাতড়াচ্ছিলাম, কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই দিশা পাব বলে মনে হচ্ছিল। সব তথ্য চোখের সামনেই রয়েছে, একেবারে তৈরি হয়ে, সামান্য আলোর স্পর্শে পরস্পরের সঙ্গে মিলে গিয়ে একটা তাৎপর্যময় ছবি ফুটে ওঠার অপেক্ষায়।
তারপর তা ঘটল! সবচেয়ে আশ্চর্য উপায়ে ঘটল!
তখন আমরা অন্যদিনের মতোই রাতের খাওয়ার পর সবুজ বসবার ঘরে বসেছিলাম। সবাই চুপচাপ বসে ছিলেন। বড়োই গভীর সে নীরবতা। একটা ইঁদুর ঘরের মেঝের ওপর দিয়ে এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে যাচ্ছিল, আর ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল।
আর্থার কারমাইকেল তার চেয়ার থেকে একটা লম্বা লাফ মারল। ইঁদুরের চলার পথে একটা প্রচণ্ড দ্রুতগামী তিরের মতো ছিটকে পড়ল সে। ইঁদুরটা দেওয়ালের কাঠের প্যানেলের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর সে সেখানে হামাগুড়ি দিতে লাগল। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, উত্তেজনায় শরীরটা তখনও থরথর করে কাঁপছে।
ব্যাপারটা ভয়াবহ। এমন হাত-পা ঠাণ্ডা করে দেওয়া মুহূর্ত জীবনে আর কখনও আসেনি। আর্থার কারমাইকেলের ওই নিঃশব্দ হাঁটা আর তীক্ষ্ণ সজাগ চোখ আমাকে ঠিক কীসের কথা মনে করায় তাই নিয়ে আর আমার কোনও ধন্ধ রইল না। অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়, অকল্পনীয় এক ব্যাখ্যা আলোর ঝলকের মতো আমার মনে উদয় হল। আমি অসম্ভব বলে তাকে উড়িয়ে দিতে চাইলাম, কিন্তু মন থেকে তাকে কিছুতেই পুরোপুরি বার করে দিতে পারলাম না।
তারপর কী ঘটল আমার ঠিক মনে পড়ছে না। পুরো ব্যাপারটা কেমন অস্পষ্ট আর অবাস্তব মনে হচ্ছিল। আমার মনে আছে আমরা কোনোভাবে দোতলায় উঠে পরস্পরকে অত্যন্ত সংক্ষেপে শুভরাত্রি জানালাম। একে অন্যের চোখের দিকে তাকাতে যেন ভয় পাচ্ছিলাম, পাছে আমাদের ভয়ের প্রতিচ্ছবি অন্যের চোখেও দেখে ফেলি!
সেটল লেডি কারমাইকেলের দরজার বাইরে থিতু হল প্রথম দফার নজরদারির জন্য। তারপরে রাত তিনটের সময় আমাকে ডেকে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে। আমার লেডি কারমাইকেলের জন্য আর বিশেষ কোনও ভয় ছিল না; আমি আমার অসম্ভব, অকল্পনীয় ব্যাখ্যা নিয়ে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমি নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম এ হতে পারে না। কিন্তু আমার বিহ্বল মন বারবার তাতেই ফিরে যাচ্ছিল।
হঠাৎ রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। সেটল চিৎকার করে উঠল, আমাকে ডাকছে। আমি পড়ি কি মরি করে টানা বারান্দায় ছুটে গেলাম। সেটল তার সর্বশক্তি দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো লেডি কারমাইকেলের দরজায় ধাক্কা মারছে। “শয়তান ভর করেছে মহিলার ওপর!” সে বলল, “ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছেন।”
“কিন্তু…”
“ওটা ভেতরে আছে ভাই! ওঁর সঙ্গে ওটা ভেতরে আছে! শুনতে পাচ্ছ না?”
বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে একটা তীব্র, হিংস্র বেড়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। আর তারপরেই একটা ভয়াবহ চিৎকার। তারপর আবারও সেই ভয়াবহ চিৎকার। আমি লেডি কারমাইকেলের কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম।
“দরজাটা!” চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, “কোনোভাবে আমাদের এক্ষুনি ওটা ভাঙতে হবে, আর এক মিনিটেও অনেক দেরি হয়ে যাবে।”
আমরা শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে কাঁধ দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিলাম। একটা জোরালো আওয়াজ করে দরজাটা খুলল, আমরা ঘরের মধ্যে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
লেডি কারমাইকেল একেবারে রক্তস্নাত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন। এরকম ভয়ানক দৃশ্য আমি খুব কম দেখেছি। তাঁর হৃৎস্পন্দন তখনও চলছিল, কিন্তু তাঁর আঘাত মারাত্মক, গলার পাশের চামড়া একেবারে ফালা ফালা করে ছেঁড়া।
কাঁপতে কাঁপতে আমি ফিসফিস করে বললাম, “থাবার আঁচড়!” আমার মধ্যে দিয়ে কেমন একটা কুসংস্কার মেশানো ভয়ের স্রোত নেমে গেল।
আমি সযত্নে ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম, আর সেটলকে বললাম আঘাতের আসল ধরনটা গোপন রাখতে, বিশেষ করে মিস প্যাটারসনের কাছ থেকে। আমি হাসপাতাল থেকে নার্স চেয়ে একটা টেলিগ্রাম করে রাখলাম, যাতে সকালে টেলিগ্রাফ অফিস খোলামাত্রই সেটা পাঠানোর ব্যবস্থা হয়।
জানালা দিয়ে ধীরে ধীরে ভোরের আলো প্রবেশ করতে শুরু করল। আমি নিচের বাগানটার দিকে তাকালাম।
“চট করে বাইরের পোশাক পরে তৈরি হও, আমাদের বেরোতে হবে।” আমি তাড়াহুড়ো করে সেটলকে বললাম। “লেডি কারমাইকেল এখন ঠিকই থাকবেন।”
সে খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল, আর আমরা একসঙ্গে নিচের বাগানে বেরোলাম।
“আমরা কী করতে যাচ্ছি?”
“মাটি খুঁড়ে বেড়ালের দেহটা তুলতে হবে।” আমি সংক্ষেপে বললাম, “আমার নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।”
যন্ত্রপাতি রাখার ঘর থেকে একটা কোদাল খুঁজে পেয়ে আমরা কাঠচাঁপা গাছটার নিচে খুঁড়তে শুরু করলাম। অবশেষে আমাদের পরিশ্রমের পুরস্কার মিলল। কাজটা মোটেই সুখকর ছিল না। প্রাণীটা এক সপ্তাহ আগে মারা গেছে। কিন্তু আমি যা দেখতে চেয়েছিলাম তা পেলাম।
“এই সেই বেড়াল।” বললাম আমি, “প্রথম যেদিন এখানে এসেছিলাম, ঠিক এরকমই একটা বেড়াল আমি দেখেছিলাম।”
সেটল নাক টানল। তেতো বাদামের গন্ধ এখনও পাওয়া যাচ্ছে। “প্রুসিক অ্যাসিড।” বলল সে।
আমি ঘাড় নাড়লাম।
কৌতূহলী হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী ভাবছ বলো তো?”
“ঠিক যেটা তুমিও ভাবছ!”
আমার অনুমানটা তার কাছে নতুন ঠেকল না। এ ভাবনা তার মাথাতেও এসেছিল, বুঝলাম।
“এ হতে পারে না।” বিড়বিড় করে বলল সে, “এ অসম্ভব! এ তো সব বিজ্ঞান, সব প্রাকৃতিক ঘটনার পরিপন্থী!” কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে বলতে সে চুপ করে গেল। “কাল রাত্রে ইঁদুরটা,” সে বলল, “কিন্তু, উফ্! এ হতে পারে না!”
“লেডি কারমাইকেল,” বললাম আমি, “এক অতীব বদখত মহিলা। ওঁর অতিপ্রাকৃতিক শক্তি আছে, সম্মোহনী শক্তি। ওঁর পূর্বপুরুষরা প্রাচ্য বংশোদ্ভূত। বুঝতে পারছ তিনি তার ক্ষমতা বেচারা ভালো ছেলে আর্থার কারমাইকেলের ওপর প্রয়োগ করে তার কী হাল করেছেন? মনে রেখো সেটল, আর্থার কারমাইকেল যদি এরকম অপদার্থ নির্বোধ অবস্থায় তাঁর বশংবদ হয়ে থাকে, তাহলে আদতে পুরো সম্পত্তিই তাঁর আর তাঁর ছেলের কবজায়, তোমার কথা অনুযায়ী যে ছেলের প্রতি তিনি নিবেদিত প্রাণ এবং আর্থার কারমাইকেল বিয়ে করতে যাচ্ছিল।”
“কিন্তু আমরা এখন করব কী, কারস্টেয়ার্স?”
“আমাদের করার কিছুই নেই।” আমি বললাম, “আমরা কেবল যথাসাধ্য চেষ্টা করব লেডি কারমাইকেলকে প্রতিশোধের হাত থেকে বাঁচাতে।”
লেডি কারমাইকেলের অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হতে লাগল। তাঁর ক্ষতগুলো আশানুরূপ সারতেও লাগল, কিন্তু ঐ বীভৎস আক্রমণের দাগ তাঁকে হয়তো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে।
কোনোদিন আমার এমন অসহায় বোধ হয়নি। যে শক্তি আমাদের হারিয়ে দিয়েছে, সে এখনও প্রবল পরাক্রমে বিদ্যমান এবং সে এখনকার মতো শান্ত থাকলেও কেবল সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে। একটা ব্যাপারে আমি মনস্থির করে ফেলেছিলাম। লেডি কারমাইকেল আর একটু সুস্থ হয়ে চলাফেরা করার অবস্থায় এলেই তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ওল্ডেন থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হবে। একটা সম্ভাবনা রয়েছে যে ওই ভয়ানক জিনিসটা তাঁকে অন্য কোথাও অনুসরণ করতে পারবে না। তাই এভাবেই দিন কাটতে লাগল।
আমি সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে লেডি কারমাইকেলকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিন স্থির করেছিলাম। সে মাসের ১৪ তারিখে আরেক বিপদ উপস্থিত হল।
আমি লাইব্রেরিতে বসে সেটলের সঙ্গে লেডি কারমাইকেলের ব্যাপারটা আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ একজন কাজের মেয়ে উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে এল। “হুজুর!” সে কেঁদে ফেলল, “এক্ষুনি আসুন! মিস্টার আর্থার, উনি পুকুরে পড়ে গেছেন। উনি পুকুরপাড়ে বাঁশের ভেলায় ওপর পা দিয়েছিলেন, আর সেটা তাঁকে উলটোদিকে চাপ দিতে তিনি টাল সামলাতে না পেরে পুকুরে পড়ে গেলেন! আমি জানালা থেকে দেখলাম।”
আমি একটুও অপেক্ষা না করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সেদিকে চললাম। সেটল আমার পেছন পেছন ছুটল। ফিলিস বাইরেই ছিল এবং ওই কাজের মেয়ের কথা শুনেছিল। সেও আমাদের সঙ্গে ছুটল।
“কিন্তু আপনারা ভয় পাবেন না।” সে চিৎকার করে বলল, “আর্থার অত্যন্ত ভালো সাঁতারু।”
যাই হোক, আমার লক্ষণ ভালো ঠেকছিল না। আর তাই আমি দৌড়নোর গতি দ্বিগুণ করে দিলাম। পুকুরের জল নিস্তরঙ্গ। শূন্য ভেলাটা এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কোথাও আর্থারের চিহ্নমাত্র নেই।
সেটল ঝটপট তার কোট আর বুট খুলে ফেলল। “আমি যাচ্ছি।” বলল সে। “তুমি বরং ঐ নৌকোর নোঙরটা নিয়ে ভেলায় চড়ে ওই পাশটা খোঁজো, জল তেমন গভীর নয়।”
আমাদের এই বিফল সন্ধানে মনে হল কত যুগ কেটে যাচ্ছে। মিনিটের পর মিনিট চলে যেতে লাগল। তারপর যখন আমরা আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি, তখন আমরা তাকে খুঁজে পেলাম আর তার আপাত প্রাণহীন শরীরটাকে পাড়ে নিয়ে এলাম। যতদিন বেঁচে থাকব ফিলিসের সেই নিরাশ বিষাদময় মুখটা কোনোদিন ভুলব না।
“না! না!” সে ভয়ংকর কথাটি সে মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারছিল না।
“না, না মা!” চিৎকার করে উঠলাম আমি, “আমরা নিশ্চয়ই তাকে ফিরিয়ে আনব, তুমি ভয় পেও না।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার বড়োই ক্ষীণ আশা ছিল। সে জলের নিচে প্রায় আধঘণ্টা ছিল। আমি সেটলকে বাড়ির মধ্যে পাঠালাম গরম কম্বল আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে এবং নিজে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করলাম।
আমরা প্রায় একঘণ্টা ধরে অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু জীবনের কোনও লক্ষণই দেখা গেল না। আমি সেটলকে ইশারা করে আমার জায়গায় আসতে বললাম, আর আমি ফিলিসের দিকে এগোলাম।
“আমি দুঃখিত,” আমি আস্তে আস্তে বললাম, “কিন্তু কিছুই কাজে আসছে না। আর্থার আমাদের সব চেষ্টার ঊর্ধ্বে চলে গেছে।”
এক মুহূর্তের জন্য সে স্থির হয়ে গেল, আর তারপর সেই প্রাণহীন দেহটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
“আর্থার!” মরিয়া হয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল সে, “আর্থার! ফিরে এসো আমার কাছে! আর্থার, ফিরে এসো, ফিরে এসো!”
চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে তার কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। হঠাৎ আমি সেটলের হাত স্পর্শ করলাম। “দেখো!” বললাম আমি।
সেই জলে ডোবা মানুষটির মুখে আস্তে আস্তে রঙ ফিরে আসছে, তার হৃৎস্পন্দন আমি টের পাচ্ছি। “ওর শ্বাসপ্রশ্বাস চালিয়ে যেতে থাকো!” চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, “সে বেঁচে উঠছে।”
সময় এখন বড়ো দ্রুত কাটতে লাগল। খুব অকল্পনীয় রকম অল্প সময়ের মধ্যে সে চোখ মেললেন। তখন হঠাৎ আমি পরিবর্তনটা টের পেলাম। এ চোখ বুদ্ধিদীপ্ত, এ মানুষের চোখ। সে চোখের দৃষ্টি ফিলিসের ওপর স্থির হল।
“আরে! ফিল,” দুর্বল কন্ঠে বলল সে, “তুমি এসে পড়েছ? আমি ভাবছিলাম তুমি কালকের আগে আসছ না।”
ফিলিস যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে না পেরে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু আর্থারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আর্থার ক্রমশ আরও অবাক হয়ে চতুর্দিকে দেখতে লাগল। “কিন্তু, আমি জানতে চাই, আমি কোথায়? আর, আমার কেমন বিচ্ছিরি লাগছে! কী হয়েছে আমার? আরে, ডাঃ সেটল!”
“আপনি প্রায় ডুবতে বসেছিলেন, ব্যাপারটা এটাই।” সেটল গম্ভীরভাবে উত্তর দিল।
স্যার আর্থার মুখটা একটু বাঁকাল। “আমি শুনেছি ডোবা থেকে বেঁচে ফিরলে নাকি কেমন জান্তব অনুভূতি হয়! কিন্তু এটা ঘটল কেমন করে? আমি কি ঘুমের মধ্যে হাঁটছিলাম?”
সেটল মাথা নাড়ল।
“ওকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাওয়া দরকার।” এগিয়ে গিয়ে বললাম আমি।
আর্থার আমার দিকে তাকাতে ফিলিস আমার পরিচয় দিল, “ডাঃ কারস্টেয়ার্স। উনি এখন এখানেই আছেন।”
আমরা দু’দিক থেকে ওকে ধরে ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে চললাম। হঠাৎ সে মুখ তুলে তাকাল, যেন কিছু একটা তার মাথায় এসেছে। “আচ্ছা ডাক্তারবাবু, সামনের ১২ তারিখের আগে আমি সুস্থ হয়ে যাব তো?”
“১২ তারিখ?” আমি ধীরে ধীরে বললাম, “মানে আপনি ১২ই আগস্টের কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ, সামনের শুক্রবার।”
“আজ সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ!” সেটল হঠাৎ বলে উঠল। তার বিস্মিত ভাবটা স্পষ্ট প্রকাশ পেল।
“কিন্তু, কিন্তু আমি যে ভাবছিলাম আজ আগস্ট মাসের ৮ তারিখ! তবে কি আমি অসুস্থ ছিলাম?”
ফিলিস তার সুন্দর স্বরে দ্রুত বলে উঠল, “হ্যাঁ, তুমি তো খুব অসুস্থ ছিলে।”
আর্থার ভুরু কোঁচকাল। “আমি বুঝতে পারছি না। আমি গতকাল রাত্রে যখন শুতে গেলাম, আমি পুরো সুস্থ ছিলাম… যাই হোক, মানে সেটা ঠিক গতকাল নয়। আমি কিছু অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। আমার মনে পড়ছে, স্বপ্ন…”
সে যত মনে করার চেষ্টা করতে লাগল, ততই তার ভ্রূকুটি আরও বেড়ে চলল। “কিছু একটা… কিন্তু সেটা কী? কিছু একটা ভয়াবহ… কেউ একটা এল আর আমি রেগে গেলাম, ভীষণ রেগে গেলাম… আর তারপর আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমি একটা বেড়াল, হ্যাঁ, একটা বেড়াল! হাস্যকর, তাই না? কিন্তু স্বপ্নটা মোটেই হাস্যকর নয়। বরং স্বপ্নটা বেশ ভয়ানক! কিন্তু আমার ঠিক মনে পড়ছে না। যখনই ভাবার চেষ্টা করছি সব কেমন হারিয়ে যাচ্ছে।”
আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। “আপনি ভাবার চেষ্টা করবেন না, স্যার আর্থার।” গম্ভীরভাবে বললাম আমি, “বরং ভুলে গিয়ে খুশি থাকুন।”
সে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল। শুনতে পেলাম ফিলিস একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আমরা বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছি।
“আচ্ছা,” স্যার আর্থার হঠাৎ বলল, “মাকে দেখছি না?”
“আসলে তিনি একটু অসুস্থ।” ফিলিস এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল।
“ওহো, বেচারি মা!” তার কণ্ঠে অকৃত্রিম উদ্বেগ প্রকাশ পেল। “কোথায় তিনি? তাঁর ঘরে?”
“হ্যাঁ।” বললাম আমি, “কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁকে বিরক্ত না করাই…”
আমার মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। বসার ঘরের দরজা খুলে গেল আর একটা ড্রেসিং গাউন পরে লেডি কারমাইকেল হলে প্রবেশ করলেন। তাঁর চোখ আর্থারের ওপর স্থির হয়ে আছে, আর যদি আমি কখনও বিবেকের দংশনবিদ্ধ ভয়ের প্রকাশ দেখে থাকি তো সেটা ওই মুহূর্তে। একটা উন্মত্ত ভয়ে তাঁর মুখটা আর মানুষের মুখ মনে হচ্ছে না। তাঁর হাতটা তাঁর গলার কাছে চলে গেছে।
আর্থার বালক-সুলভ ভালোবাসা নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। “আরে, মা! তোমারও শরীর এত খারাপ হয়েছে? আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছে।”
আর্থারের সামনে তিনি যেন কেমন গুটিয়ে গেলেন, চোখ বিস্ফারিত। তারপর হঠাৎ এক অভিশপ্ত আত্মার মতো চিৎকার করে তিনি পিছনের খোলা দরজা দিয়ে লুটিয়ে পড়লেন।
আমি ছুট্টে গেলাম তাঁর কাছে, ঝুঁকে পড়ে তাঁকে পরীক্ষা করলাম। তারপর সেটলকে কাছে ডাকলাম।
“স্-স্-স্ চুপ।” বললাম তাকে, “ওঁকে চুপচাপ ওপরে নিয়ে যাও, আর তারপর আবার নেমে এস। লেডি কারমাইকেল মারা গেছেন।”
সেটল কয়েক মিনিট পর ফিরে এল। “কী হল বলো তো?” জিজ্ঞেস করল সে, “কীসের জন্য হল?”
“ধাক্কা।” আমি গম্ভীরভাবে বললাম, “আর্থার কারমাইকেলকে পুনর্জীবন লাভ করে ফিরে আসতে দেখার ধাক্কা। অথবা ইচ্ছে হলে বলতে পারো, যেমন আমি বলে থাকি, এ হল ভগবানের বিচার।”
“তার মানে তুমি বলতে চাইছ…” সে একটু ইতস্তত করছিল।
আমি সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকালাম যাতে সে বুঝতে পারে। “এক জীবনের বিনিময়ে আর এক জীবন।” আমি কিছুটা গুরুত্ব দিয়ে বললাম।
“কিন্তু…”
“ওহ্! আমি জানি একটা অদ্ভুত এবং অভূতপূর্ব দুর্ঘটনায় আর্থার কারমাইকেলের আত্মা তার শরীরে ফেরত এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আসলে আর্থার কারমাইকেল তো খুন হয়েছিল।”
সে আমার দিকে কিছুটা ভীত দৃষ্টিতে তাকাল। “প্রুসিক অ্যাসিড দিয়ে?” নীচু গলায় জিজ্ঞেস করল সে।
“ঠিক তাই।” বললাম আমি, “প্রুসিক অ্যাসিড দিয়ে।”
সেটল আর আমি কোনোদিন কোথাও আমাদের বিশ্বাস নিয়ে কথা বলিনি। বললে সেটা খুব সমাদৃত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাও ছিল না। সনাতন দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী আর্থার কারমাইকেলের সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল, লেডি কারমাইকেল কিছু মানসিক সমস্যার কারণে তাৎক্ষণিক রাগের বশে নিজেই নিজের গলা বিদীর্ণ করেছিলেন, আর ওই বেড়ালের আবির্ভাব নিছক কল্পনা।
কিন্তু দুটো ব্যাপার নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রথমটা হল বারান্দায় ফালা ফালা করে ছেঁড়া চেয়ারটা। দ্বিতীয়টা আরও তাৎপর্যপূর্ণ। লাইব্রেরির বইয়ের একটা তালিকা পাওয়া গেছিল এবং সেটাতে বেশ খুঁটিয়ে খুঁজে দেখার পর আবিষ্কৃত হল যে ওই নিরুদ্দেশ বইটা একটা প্রাচীন এবং আজব গবেষণা যেটাতে মানুষকে অন্য কোনও প্রাণীতে রূপান্তরিত করার পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে।
আরেকটা ব্যাপার যেটা নিয়ে আমি খুব খুশি সেটা হল আর্থার কিছু জানে না। ফিলিস ওই কয়েক সপ্তাহের ঘটনা পুরোপুরি তার মনের গভীরে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে এবং আমি নিশ্চিত যে সে তার স্বামীকে এসব কথা কখনোই বলবে না, যে স্বামীকে তিনি এত ভালোবাসে এবং তার ভালোবাসার ডাক যাকে মরণের ওপার থেকে একদিন ফিরিয়ে এনেছিল।
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে