বিদেশী গল্প -নেশা- আলগারনন ব্ল্যাকউড অনুবাদ নন্দিনী দাস চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০২০

(Algarnon Blackwood-এর The sea fit অবলম্বনে. অনুবাদ নন্দিনী দাস চট্টোপাধ্যায়)

রাতের আকাশে কী যে এক অপার রহস্য লুকিয়ে থাকে! মাথার উপরে নির্মেঘ আকাশে সুগোল চাঁদ সস্নেহে তাকিয়ে দেখছে সমুদ্রের চপলতা। মাথায় সাদা ফেনার মুকুট পরে ঢেউয়ের পরে ঢেউ চাঁদের অদৃশ্য টানে বালির চাদরে এসে লুটিয়ে পড়ছে, তারপর ছড়িয়ে যাচ্ছে ওড়নার মতো। তীর বরাবর যতদূর দৃষ্টি চলে সেই সফেন ঢেউয়ের ওঠাপড়া, তার একটানা সঙ্গীত, আর এই মায়াবী চাঁদের আলো—সবকিছু মিলিয়ে একটা অপার্থিব পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যেন প্রকৃতি তার চেনা জীবনের সীমানা পেরিয়ে কোনও অজানা রহস্যের দিকে এক দুঃসাহসী পদক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছে। সমুদ্রের উপরে জমে থাকা বাষ্পের ঝালর, নড়ছে চড়ছে কাঁপছে, সেই রহস্যের দিকেই ইশারা করছে বুঝি!

চরাচর বিস্তৃত বালিয়াড়িতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কতকগুলো বাংলো। তারই মধ্যে একটা নীচু ছাদের বাংলোতে মানুষের আনাগোনা আজ। জনহীন বালিয়াড়ির বাদবাকি বাংলোগুলো এখনও অতিথির অপেক্ষায় উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। থেকে থেকে তাদের হাতায় মোটা মোটা ঘাস গজিয়েছে, যেন অযত্নলালিত কেশদাম। সমুদ্রের দিক থেকে সোঁ সোঁ শব্দে হাওয়া এসে তাদের নাড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

এই বাংলোটার মালিক ক্যাপ্টেন এরিকসন। আজ এখানে তার অতিথি মেজর রীজ, সশস্ত্র বাহিনীর বন্দুকবাজ, আর মেজরের সৎ ভাই ডাক্তার ম্যালকম রীজ। দিনটা কেটেছে সমুদ্রে—ঘোরাঘুরি যেমন হয়েছে, মাছ ধরাও চলেছে সেই সঙ্গে।

সামনেই ইস্টার, পূর্ণ চাঁদের জ্যোৎস্নায় আজ চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে। ওলটপালট বাতাসের সঙ্গে বালির ঝাপটা এসে লাগছে চোখে মুখে।

একটা পিপের উপর এবড়ো-খেবড়ো ক’টা তক্তা এঁটে টেবিল বানানো হয়েছে, তার উপর রয়েছে একটা হুইস্কির বোতল। আর সেই টেবিল ঘিরে কঞ্চি দিয়ে বানানো ক’টা চেয়ারেই বসেছে তিনজনে। বাইবেলে একটা কথা আছে, অন্তত জনা তিনেক সাক্ষী রেখে কোনও কথা না পাড়লে, সেকথার কোনও দামই থাকে না। তাই সেদিক থেকে আড্ডাটা একেবারে ঠিকঠাক।

পুরনো বন্ধুরা এক হলে যা হয়, সেই আগেকার কতরকম অভিযানের কথা উঠে আসছে স্মৃতির অতল থেকে। তবে হ্যাঁ, হুইস্কির খোলা বোতল দেখে কেউ যদি ভাবে যে এরা একেবারে বেহেড হয়ে গেছে, তবে সেটা নেহাত ভুলই হবে। সে ব্যাপারে প্রত্যেকেই বেশ সতর্ক। বরং তাদের ধারণা, কিঞ্চিৎ মদ্যপান চেতনাকে আরও ধারালো করে, বৌদ্ধিক স্তর উন্নত হয় এবং পর্যবেক্ষণশক্তিও হয় আরও তীক্ষ্ণতর।

প্রায় এক দশক আগে বিভিন্ন অভিযানের শরিক ছিল এই তিনজন। তারপর জীবনের ঘুঁটিখেলায় তারা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে।

এই তিনজন ছাড়া আরেকজনও উপস্থিত এখানে। নাম তার সিন্দবাদ, এরিকসনের একান্ত সহচর। আরব্য রজনীর গল্পের সেই সিন্দবাদের মতো এও একজন সুদক্ষ নাবিক, এরিকসনের অনেক অদ্ভুত অভিযানের সঙ্গী।

সোনালি চুলের এরিকসনকে এই একটা ব্যাপারে রীতিমতন ভাগ্যবান বলা যায়। সিন্দবাদের মতো এরকম কর্মঠ, বিশ্বাসী লোক সহজে জোটে না। এরিকসনের মেজাজের সামান্যতম হেরফেরও ওর নজর এড়ায় না, দরকার হলে তার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত দিতেও সে বোধহয় কুণ্ঠিত হবে না। আজ এই অতিথি দু’জনের পরিচর্যার ভারও সম্পূর্ণ তার উপর। তাই কখনও সে মাছধরা নৌকোর মাঝি, তো কখনও রাঁধুনি; আবার খানসামা, বাজার সরকার—সবকিছুই ওই সিন্দবাদ।

এরিকসন লোকটিও বড়ো অদ্ভুত। সমুদ্র ছাড়া আর কোনও কিছুর জায়গা তার জীবনে নেই। জাগতিক বিষয়ে তার খুব একটা হুঁশ আছে বলে মনে হয় না। সমুদ্রের উথালপাতাল তার ধমনীতে ঢেউ তোলে। আর ওই সাগরই তার জীবন-দেবতা। তার বাপ-ঠাকুরদা আদতে নরওয়ের মানুষ। কিন্তু কোথাও থিতু হওয়া তার রক্তে নেই। সেকালের সেই যাযাবর ভাইকিংদেরই একজন যেন সময়ের ভুলে একালে জন্মেছে।

অবশ্য এ ব্যাপারে সে নিজে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তার মতে, সাংসারিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলে আর যাই হোক সাগর-দেবতার খাঁটি উপাসক হওয়া যায় না। সে বলে, ‘আমরা যারা ওই সমুদ্রের মানুষ, ওই নোনা হাওয়াই আমাদের প্রাণবায়ু জোগায়। জলের মাছকে ডাঙায় তুললে যে দশা হয়, ডাঙায় আমার অবস্থাও তার থেকে আলাদা কিছু নয়। কোনও কাজই ঠিকমতো করতে পারি না, যেন হাত-পা চলতেই চায় না! অথচ ওই মাস্তুলের সঙ্গ একবার ধরলে আর আমায় পায় কে! তখন কাজ যতই কঠিন হোক না কেন, আমায় কাবু করা মুশকিল।

আর সেজন্যই বোধহয় এরিকসনের একমাত্র সম্পত্তি বলতে এই হেলে পড়া একতলা বাংলোটা—খানিকটা জাহাজের কেবিনের মতোই তার গঠন। এখানেই মাঝে মাঝে তার বিশেষ কিছু বন্ধুবান্ধবের আমন্ত্রণ থাকে যারা তারই মতো নিঃশঙ্ক, যাদের কাছে সে নিজের মনের সবটুকু মেলে ধরতে পারে। আর আছে দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে সংগ্রহ করা বিচিত্র ধরনের বইয়ের সম্ভার। পৃথিবীর শেষপ্রান্তে তার এই শান্তির নীড়, যেখানে সে আর তার প্রাণের ঈশ্বর থাকে মুখোমুখি।

মানুষের মনের গতি বড়ো বিচিত্র। তার আবেগ আর যুক্তি, কখন যে কে কার সওয়ারি তা বলা মুশকিল।

এরিকসন কিছু ভাবছিল। অতিথিদের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “বন্ধুরা, সংকোচ কোরো না, তোমাদের যা দরকার, ওই সিন্দবাদকে বোলো, ও ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে।”

যেন সিন্দবাদ চেষ্টা করলেই এখানে যাবতীয় আরামের বন্দোবস্ত করে ফেলতে পারবে! যদিও ঘটনা হল, এখানে এই জনমানবহীন সমুদ্রসৈকতে আরামের বন্দোবস্ত করা, আর একটা ফুটোফাটা জাহাজকে একেবারে শক্তপোক্ত আঁটোসাঁটো নতুন জাহাজে রূপান্তরিত করা প্রায় একই ব্যাপার! কোনও মানুষের দ্বারাই সেকাজ করা সম্ভব নয়। অবশ্য রীজ ভাইয়েরা এইসব ছোটোখাটো আরাম-বিরাম নিয়ে মাথা ঘামানোর লোকও নয়। বরং পরিস্থিতি যত কঠিন হয়, তার মোকাবিলা করায় তত বেশি আনন্দ—সেটা তারা বোঝে। তাই এখানকার স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে তাদের অনুযোগ ছিল না, কিন্তু কিছু একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। অস্বস্তিটা ঠিক কেন বা কীসের জন্যে, কারণটা দু’জনের কারোর কাছেই খুব পরিষ্কার নয়। কিন্তু কাঁটা ফোটার মতোই খচখচানিটা জানান দিচ্ছিল প্রতিমুহূর্তে।

বোধহয় সেজন্য এরিকসন নিজেই খানিকটা দায়ী। সমুদ্রের প্রতি তার এই যে একটা অদম্য টান, সেটা সাধারণের চোখে বাড়াবাড়ি এমনকি প্রায় খ্যাপামোর পর্যায়েই পড়ে। যে কারণে ডাক্তার এরিকসনের নামই দিয়েছে ‘সমুদ্র-ক্ষ্যাপা’! সে এদের মধ্যে আছে, কথা বলছে, সব ঠিক; কিন্তু কেমন যেন বিষণ্ণ, মুখচোখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে তার নোঙর করে রাখা জাহাজটাকে কেউ যেন ডুবিয়ে দিয়েছে। সমুদ্রের সঙ্গে তাই এই বিরহ! আর তার এই বিষণ্ণতা অতিথি দু’জনকেও ছুঁয়ে যাচ্ছিল অজান্তেই। সেটাই হয়তো তাদের স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না। যদিও এরিকসনের যন্ত্রণা তাদের নয়, তবে চিত্ত কেন এত ভারাক্রান্ত? ভিতরে ভিতরে একটা ছন্নছাড়া ভাবের আনাগোনা রীজ ভাইয়েরা দু’জনেই টের পাচ্ছিল থেকে থেকে।

জায়গাটা বড়োই নির্জন। এখানে তটভূমি হঠাৎ সমুদ্রের মধ্যে খানিকটা ঢুকে এসেছে হাতির শুঁড়ের মতো। সমুদ্রের একটানা গর্জন ছাড়া আর কোনও শব্দই নেই। ম্যালকমের মনে হল, সাগর যেন উঁকি মেরে তাদের মতো নেহাত স্থলচর জীব দুটিকে দেখে প্রশ্রয়ের হাসি হাসছে। এই অসীম নির্জনতা তাদের মনে কতরকম চিন্তার জাল যে বুনে চলেছে! ডাক্তার ম্যালকম রীজ ভাবছে সিন্দবাদকে নিয়ে। এখানে পৌঁছনোর পর সিন্দবাদ সবার অলক্ষ্যে এমন কিছু বলেছিল, যেটা তাঁকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। তাঁর ভাইও এ ব্যাপারে কিছু জানে না। ডাক্তারই বলেনি, মানে এই মুহূর্তে বলাটা প্রয়োজন মনে করেনি। কারণ কথাটা তাঁর নিজেরই বোধগম্য হয়নি। ‘সাবধান স্যার! এই বড়ো বড়ো ঢেউ যে আছড়ে পড়ছে চাঁদের টানে, এগুলো কিন্তু আমার স্যারকে চেনা মানুষ থেকে একদম অচেনা করে তোলে। তখন যে স্যার কী করতে পারেন, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই আমার। তাই সাবধান!’ বলে সে এমনভাবে কোমরের উপর থেকে জামাটা সরাল, যাতে করে পিস্তলের বাঁটটা নজরে পড়ে।

এদিকে এরিকসন নিজের কথাই বলে যাচ্ছিল। বোধহয় নিজের সঙ্গেই নিজের কথা। বলছিল ঈশ্বর সম্বন্ধে তার অদ্ভুত বিশ্বাসের কথা। তার বিশ্বাস, ঈশ্বর আসলে সাধারণের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন, শুধুমাত্র ভক্তের আকুল ডাকেই তিনি সাড়া দেন। তেমন আকুলভাবে ডাকলে সে ডাককে তিনিও এড়িয়ে যেতে পারেন না। রক্তমাংসের শরীর ধারণ করে নেমে আসেন এই জাগতিক পৃথিবীতে। তখন তিনি অবতার। কাজের মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন।

এরিকসন খুব গুছিয়ে কথা বলে। তার কথার এমনই ভাব, যে তাকে অবিশ্বাসও করা যায় না। বলছিল, তার  এমন কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে, যার কোনও ব্যাখ্যা অন্তত তার কাছে নেই।

দুই শ্রোতা যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে শুনছিল এরিকসনের কথা। মেজর রীজকে দেখে মনে হয়, তিনি একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ। ডাক্তার কিন্তু এরিকসনকে মেপে যাচ্ছিল খুব সতর্কভাবে। অবশ্য তাতে এরিকসনের যে খুব একটা হেলদোল হচ্ছিল, মনে হয় না। সে নিজের ঢঙেই বলছিল, “জানো, এই পৌত্তলিকেরা বিশ্বাস করে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাকে ভগবানের কাছে উৎসর্গ করলে তবেই তাঁর কাছে পৌঁছনো যায়। তো নিজের সবচাইতে প্রিয় জিনিস আর কীই বা হতে পারে, নিজের প্রাণটুকু ছাড়া! অর্থাৎ মৃত্যু। হ্যাঁ, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভক্ত ভগবানের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়। বড়ো ভালো, বড়ো সুন্দর ওদের এই মিলন প্রক্রিয়া। বিশ্বপ্রকৃতির সর্বময় প্রভু সেই পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলন। তার জীবন-দেবতার মধ্যে লীন হয়ে যাওয়া, আহা!”

কথা শেষ করে এরিকসন দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তার অন্যমনস্ক দৃষ্টি তখন তীর ছাড়িয়ে অনেক দূরে, যেখানে ঢেউয়ের পিছনে ঢেউয়ের সারি।

“ঢেউ উঠছে, নামছে, আবার উঠছে, কোনও শেষ নেই। যেন সবটা মিলে একটা সম্পূর্ণ বৃত্ত। এ সবই তাঁর খেলা। শুরু থেকে শেষ, আবার শুরু।” এরিকসনের কথাগুলো সমুদ্রের হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলে গেল। “এখনও মনে পড়ে য়্যুকাতানের কথা। বেশ ক’বছর আগের ঘটনা। দেখেছিলাম আত্মবলিদান…” এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেল এরিকসন। মুখের ভাব বদলে গেল দ্রুত।

রীজ ভাইয়েরা সেকালের মায়া সভ্যতার কেন্দ্র য়্যুকাতানের কথা ওঠামাত্রই এরিকসনের পরিবর্তনটা খেয়াল করল। আকস্মিক উত্তেজনায় তার মুখ তখন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, দু’চোখ বিস্ফারিত। গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছিল। ফলে কখন শ্রোতা দু’জন উঠল, পাইপ ঝাড়ল, দেশলাই কাঠিগুলো খামোখা নাড়াচাড়া করল, নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল তারপর আবার চেয়ার টেনে বসেও পড়ল, কিছুই তার নজরে এল না। আত্মবলির মাহাত্ম্যে সে তখন বুঁদ।

হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছে, মজা করছে না এরিকসন। বরং তিল তিল করে গড়ে তুলছে তার প্রগাঢ় বিশ্বাসের এক গভীর বাতাবরণ। এই আদিম বিশ্বাসের ভার, যেন বুকের উপর একটা মস্ত পাথরের মতো ক্রমশ চেপে বসছে শ্রোতা দু’জনের উপর। সমুদ্রের দেবতার প্রতি এই আদ্যন্ত সামুদ্রিক মানুষটির গভীর আস্থা, তার হৃদয়ের গোপনতম আকাঙ্ক্ষা, সমস্ত যেন তার দু’চোখে ফুটে উঠল। এটাই অস্বস্তিকর লাগছিল বাকি দু’জনের কাছে।

“তবে যাই বলো, আগেকার দেবতাদের কিছু আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল।” এরিকসন তার মস্ত পাইপটায় ভালো করে তামাক ঠুসে নিল। পাইপটা তার লম্বাচওড়া চেহারাটার সঙ্গে বেশ মানানসই। “ইচ্ছেমতো দেহ ধারণ করা, আবার প্রয়োজন ফুরোলে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এসব তাঁদের কাছে নেহাতই মামুলি ব্যাপার। তবে তাঁদের অস্তিত্ব এখন একেবারে নেই সেকথা আমি মানতে পারি না। আমার বিশ্বাস, তাঁরা এখনও পৃথিবীর ধরাছোঁয়ার মধ্যেই আছেন। হতে পারে আমাদের অজানা অন্য কোনও রূপে, বিশেষ করে…” হঠাৎ থেমে মাথাটা ঝুঁকিয়ে খানিকক্ষণ কী ভাবল কে জানে, তারপর গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, “বিশেষ করে সমুদ্রের দেবতা যে ক’জন আছেন, তাঁরা তো খুবই জাগ্রত।”

“তাহলে এঁরাই সমুদ্রে ঢেউ তোলেন, এঁদের দাপটেই হাওয়া বয়, মোদ্দা কথা এটাই তো বলতে চাইছ?”

ডাক্তারের স্বরে লুকোনো অবিশ্বাস মনে হয় এরিকসনকে খুব একটা স্পর্শ করল না। বরং এখন সে অনেক শান্ত। তাই ডাক্তারের কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে বলল, “তাঁরা কীভাবে এখনও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন, ভাবলে অবাক লাগে!” তার বলার মধ্যে এমন একটা ব্যগ্রতা ফুটে উঠল যেটা ডাক্তারের নজর এড়াল না।

মেজর অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু বুঝতে পারছিল না। এরিকসন এবার চলে গেল আরেক প্রাচীন ধর্মের কথায়, যেটা একসময় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও ছড়িয়ে ছিল। বলল, “ড্রুডদের কথা তো নিশ্চয়ই শুনেছ। ওই যে একটা কথা আছে না ‘hue and cry’, ওই হিউ তো ড্রুডদের বিচারের দেবতা হিউ (HU)-য়ের নাম থেকেই যে এসেছে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। তারপর টাইফুন টাইফানের নামে, তারপর ধর গে হারিকেন, বায়ুর দেবতা হুরাকারের নামে, তারপর, তারপর…”

এরিকসনের কথাটা শেষ হতে না দিয়েই মেজর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে কথাটা কেড়ে নিল। তারপর খানিকটা হালকা চালে বলল, “ঠিক কথা। ওই যেমন ভেনাস প্রেমের দেবী।”

একথায় ম্যালকম হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ এরিকসনের উপর। সেখানে তার চেহারায় তখন এমন একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠেছে যে, ম্যালকমের গাটা শিরশির করে উঠল।

আশ্চর্য বৈকি! এরিকসনের কথাবার্তা ধীরে ধীরে এমন রহস্যময়তার দিকে কী করে যে ঘুরে গেল, রীজ ভাইয়েরা ভেবেও তার কোনও তল পেল না।

সমস্ত দিন তো একসঙ্গেই কাটাল তারা। অবশ্য এরিকসন একটু মনমরা ছিল, খুব একটা কথা বলছিল না। কিন্তু সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তেই সমুদ্রের ঢেউয়েরও জোর যেমন বাড়ল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল এসব অদ্ভুতুড়ে কথাবার্তা। কিন্তু কখন যে সব হাতের বাইরে চলে গেল, পরেও অনেকবার ভেবে রীজ ভাইয়েরা তার কূলকিনারা পায়নি।

বুদ্ধির অগম্য এইসব অতিপ্রাকৃত বিষয় এরিকসনের সমস্ত সত্ত্বাকে যে কতখানি দখল করে রেখেছে, সেটা তার কথা শুনলেই বোঝা যায়। তার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরের গভীর আবেগ, ঘরের তামাকের ধোঁয়া-জমাট হাওয়ায় যেন ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে উঠছিল। তার কথায় ওই একটাই প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে বারবার আসছিল। দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ, মানে সাদা বাংলায় যাকে বলে বলি দেওয়া, সহজ আড্ডার মেজাজ হারানো অতিথি দু’জনের কাছে যেটা রীতিমতো বিরক্তির কারণ।

মেজর রীজ অনেকক্ষণ ধরে প্রসঙ্গটা বদলানোর সুযোগ খুঁজছিল। তার মনে হচ্ছিল, একটু মজার বা হাসির কিছু বলা দরকার। তাহলে ঘরের এই দম বন্ধ করা ভারটা হয়তো একটু কমবে। উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই মহৎ, তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না, কিন্তু ফলটা হল উলটো।

এরিকসন বলতে চাইছিল, এই দেবতারা কীভাবে নিজেদের প্রকাশ করেন, কখনও ওঁদের লীলা চাক্ষুষ করা যায়, কখনও চোখে দেখা যায় না, শুধু কানে শোনা যায়; আবার দরকার হলে দেহও ধারণ করেন তাঁরা—এইসব কথা। তার মধ্যে ওই দেহধারণের কথাটা মেজর যেন লুফে নিল। বলল, “হ্যাঁ, একদম ঠিক কথা বলেছ। মরা মানুষের আত্মা কোনও জ্যান্ত মানুষের দেহ ভর করেই নামে। ওই যারা আত্মা-টাত্মা নামায়, শুনেছি, তাদের একজন মিডিয়াম লাগে।”

আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে সেনাপ্রবরের জ্ঞানের দৌড় বড়োজোর ওই অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনাবলী পর্যন্তই। কিন্তু ভাইয়ের কথায় ম্যালকম প্রমাদ গুনল। সে যদিও বুঝতে পেরেছে তার ভাইয়ের উদ্দেশ্য, যা হোক করে প্রসঙ্গটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে সে। তবুও তার মনে হল, যে ভাইয়ের সৎ উদ্দেশ্য না অগ্নিতে ঘৃতিহুতি দেয়! এরিকসন না আবার নতুন করে ক্ষেপে ওঠে! এখানে আসার সময় সিন্দবাদের সাবধানবাণীর অর্থ যেন একটু একটু পরিষ্কার হচ্ছে তার কাছে। ভাইকে সে বহুক্ষণ ধরেই চোখের ইশারা করছিল। কিন্তু মেজর যখন সেটা খেয়াল করল, ততক্ষণে জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। এরিকসনের মুখখানা এই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, তো পরমুহূর্তেই ফ্যাকাশে। চোখদুটো যেন জ্বলছে কীসের উত্তেজনায়!

শেষপর্যন্ত ম্যালকমের আশঙ্কাই সত্যি হল। মেজরের কথা শেষ হওয়ামাত্র সমুদ্রের যাযাবর মানুষটি প্রথমে অট্টহাসি হাসল, কিন্তু পরমুহূর্তেই গলাটা নেমে গেল খাদে। হিসহিসিয়ে বলল, “আজেবাজে কথা বোলো না একদম। তাঁরা কখন দেহ ধারণ করেন সে বিষয়ে কোনও ধারণা আছে?”

তার কণ্ঠস্বরের এই আকস্মিক পরিবর্তন কারোর কান এড়াল না। বরং তাকে আরও তন্নিষ্ঠ মনে হল। মনে হল, সে যেন একেবারে জীবন-মরণের পথের বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে! গলার গাঢ় স্বর যেন হৃদয়ের গভীরতম অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসছে। বিড়বিড় করছিল, “আরব্ধ কর্ম নিষ্পন্ন করতেই তাঁরা মূর্ত হন। প্রয়োজন হলে তাঁরা এই জগতের থেকেই উপাদান সংগ্রহ করেন। তারপর সেই উপাদান ক্রমশ ঘনীভূত হতে হতে জমাট বেঁধে দেহের রূপ নেয়। একটু আগে বলছিলাম না নিজেকে উৎসর্গ করার কথা, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়! বুড়ো হয়ে অশক্ত শরীরে ধুঁকতে ধুঁকতে মরা, কী করুণ সে মৃত্যু! আর অন্যদিকে একজন টগবগে তরুণ, প্রাণ-প্রাচুর্যের অভাব নেই, যখন তাকে দেবতার কাছে উৎসর্গের জন্যে নির্বাচন করা হয়, তা কতখানি গর্বের ভাবতে পারো? যেন তার নেমন্তন্ন এসেছে, ভগবান প্রসন্ন হয়ে নিজে নেমে আসছেন তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে!”

মেজর অবাক হচ্ছিল। তার একটা সামান্য কথায় এরিকসনের কেন এরকম একটা প্রতিক্রিয়া তার বোধের বাইরে। ওই কথাগুলো তার কাছে অসংলগ্ন প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতিবাদে কিছু হয়তো বলত সে, তার আগেই টেবিলের তলায় ম্যালকমের পায়ের খোঁচা খেয়ে থেমে গেল।

এরিকিসন বুঝি দম নিতে থেমেছিল। তারপর আবার শুরু করল, “এ কোনও শোনা কথা নয়, আমার স্বচক্ষে দেখা! কী অদ্ভুত সে প্রক্রিয়া! ভক্ত উন্মুখ হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে পরম মমতায়! কী সুখ, কীই বা আনন্দ সেই আত্মবলিদানে, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তারপর স্বয়ং ভগবান সশরীরে এসে ভক্তকে নিয়ে ফিরে যান!”

এই স্বচক্ষে দেখার কথাটায় মেজর একেবারে অবাক হয়ে গেল। এরিকসনের প্রলাপগুলোর বুঝি একটা মানে বোঝা গেল। তাই সে বলল, “তুমি, তুমি দেখেছ? নিজের চোখে? হে ভগবান! বলো, বলো এরিকসন, এরকম অদ্ভুত আর কী ঘটনা তোমার ঝুলিতে আছে!”

ঠিক এইসময় ভেজানো দরজাটা ঈষৎ ফাঁক হল। এই নিয়ে পাঁচবার। আগের চারবারের মতো এবারও সিন্দবাদ মুণ্ডুটা গলিয়ে ঘরের চারদিকে নিঃশব্দে একবার নজর বুলিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। দরজার পাল্লাদুটোও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।

নির্জন সৈকতে রাত গভীর হচ্ছে। বাংলোর প্রাণী ক’টি ছাড়া জেগে নেই কেউ। থমকে গেছে বাতাসও। শুধু ঢেউয়ের গর্জন আর তার একটা চাপা প্রতিধ্বনি বালিয়াড়ি জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

“অনেকরকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আছে, যার মাধ্যমে তোমার সাময়িক সমাধি হতে পারে, তুমি তোমার আরাধ্য দেবতার সান্নিধ্য পেতে পারো।” এরিকসনের মন্দ্রস্বর ছোটো ঘরটায় গমগম করতে লাগল, “কিন্তু তাঁর মধ্যে লীন হতে গেলে নিজেকে উৎসর্গ করতেই হবে।”

“অর্থাৎ, শেষপর্যন্ত ঘুরেফিরে সেই মৃত্যুর কথাই তো আসছে! আত্মহনন?” ডাক্তার ম্যালকম অনেকক্ষণ ধরে এরিকসনকে নিবিড়ভাবে লক্ষ করছিল। এবার সে সরাসরি প্রশ্ন করল।

আর উত্তরটাও যেন এরিকসনের ঠোঁটের ডগায়ই ছিল। “আত্মহনন শব্দটা ঠিক নয়। স্বেচ্ছায় ভক্ত তার প্রিয়তমের সাথে মিলিত হয়। একটা মুহূর্ত, শুধু একটা মুহূর্ত। সে যে দেবতার উপাসক, তিনি আগুনের দেবতা হন, কি জলের কিংবা বাতাসের, তাঁর বুকে একটা ছোট্টো ঝাঁপ, ব্যস, ভক্ত একেবারে তাঁর দেহে লীন হয়ে যাবে।” এরিকসন ম্যালকমের দিকে ফিরল, “একে তুমি নিছক মৃত্যু বলবে?”

মানুষটির অন্তরাত্মা যেন টগবগ করে করে ফুটছিল। তার আভা ছড়িয়ে পড়েছে ওর সমস্ত দেহজুড়ে।

বাইরে বর্ধমান সমুদ্রের গর্জন, জ্যোৎস্নায় নিমগ্ন চরাচর। বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি শুনশান। আর সেই আবহে নাগাড়ে পটভূমিতে এরিকসনের আত্মবিনাশের ভাষ্য, একটা উৎকট অচেনা ভয় ক্রমে গ্রাস করছিল রীজ ভাইদের।

এরিকসন একেকবার জানালার কাছে গিয়ে সমুদ্রের দিকে ব্যগ্র হয়ে কিছু দেখছিল, আবার ফিরেও আসছিল। পাইপের ধোঁয়ার জালে তার মস্ত মুখখানা রহস্যময়। মাঝে মাঝে সেখানে অনাস্বাদিত আনন্দের সুখানুভূতি খেলা করে যাচ্ছে।

দরজাটা আবারও খুলে গেল। সিন্দবাদ এবার কিন্তু ভিতরে ঢুকে এল। টেবিলের উপরে রাখা গ্লাসগুলো অকারণে নাড়াচাড়া করল বার কয়েক, তারপর আবার বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে। আর একটু বাদেই কাঁধে করে মাছধরা জালের মস্ত বোঝা নিয়ে ফিরে এল। একটা চেয়ার টেনে এনে তার উপর জালটা রাখল একেবারে জানালা ঘেঁষে। ছোটোখাটো একটা স্তূপের মতোই জায়গাটা দখল করে নিল সেটা।

ডাক্তার সিন্দবাদের কাজকর্ম লক্ষ করছিল। সে যে তাকে বিশেষ কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছে তা পরিষ্কার। বিষয়টা নিয়ে তলিয়ে ভাবতেই ইশারাটা তার কাছে স্পষ্ট হল। আর তাতেই সে বলল, “এরিকসন, তোমার ঘরের জানালাগুলো সারানো দরকার। সামান্য হাওয়াতেই ঘরের মধ্যে যেন ঝড় বইছে। মনে হচ্ছে, একেবারে ভাঙাচোরা জাহাজের মধ্যে বসে আছি!” তারপর নিজেই উঠে জানালার পর্দাগুলোকে টেনেটুনে বাঁধতে লাগল। ডাক্তারের কথায় এমন একটা কর্তৃত্ব ছিল যে এরিকসন কিছু বলল না।

তবে মাপের কথা ধরলে অবশ্য এগুলোকে জানালা না বলে ঘুলঘুলি বললেই বেশি মানানসই হয়। খানিকটা জাহাজের পোর্ট-হোলের মতোই এদের আকার আয়তন।

মেজরও কিছু বলবে বলে উসখুস করছিল। বলল, “হুঁ, ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা। বিশেষ করে গত আধঘণ্টায় ঠাণ্ডাটা অনেক বেড়েছে। অথচ দেখো, এই মুহূর্তে জানালা দিয়ে হাওয়ার ঝাপটা আসছে না!”

এরিকসন একবার সবার মুখের দিকে তাকাল। মুহূর্তের জন্য তার নীল চোখে কীসের সংশয় উঁকি দিল। তারপর বলল, “ঠিক! হতচ্ছাড়া নিশ্চয়ই পিছনের দরজাটা খুলে রেখেছে কারোর জন্য। হারামজাদার সাহসটা দিনকে দিন বাড়ছে। যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে, তাহলে ওকে আমি ডুবিয়ে মারব। ও কি সত্যিই তবে…” কথাটা শেষ না করেই এরিকসন বেল বাজাল। সিন্দবাদ ঘরে ঢুকতেই মুখে একটা দেঁতো হাসি ঝুলিয়ে বলল, “সিন্দবাদ! ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা, কী বলো! পিছনের দরজাটা খুলে তো রেখেছ, কিন্তু কার জন্য? তোমার কোনও বিশেষ বন্ধু আসবে বুঝি!”

সিন্দবাদ শ্লেষটা গায়েই মাখল না। বরং জোর দিয়ে বলল, “পিছনের দরজা আমি নিজে শক্ত করে বন্ধ করেছি স্যার। তবে এখন পুবদিক থেকে হাওয়া বইছে, ঢেউয়ের জোরও বেড়েছে।”

“কী ভাবছ? এ খবর দেওয়ার জন্যে তোমায় ডেকেছি? শোনো, হাওয়া যে চলছে সেটা আমরা সবাই শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তুমি এখন স্পষ্ট করে বলো তো বাবা কার জন্য অপেক্ষা করছ?” এরিকসন দাঁতে দাঁত পিষে আগের প্রশ্নটাই আবার করল, যদিও মুখের হাসিটি তখনও অম্লান।

কথার ধরন থেকে এটা পরিষ্কার যে সিন্দবাদের কথা এরিকসন বিশ্বাস করেনি। তার দৃঢ় বিশ্বাস, সিন্দবাদ কিছু একটা লুকোচ্ছে। এরিকসন সটান সিন্দবাদের চোখের দিকে তাকাল। সিন্দবাদ কিন্তু চোখ সরাল না। মনে হল, দু’জনেই দু’জনের মনের খবর হাতড়ে বেড়াচ্ছে। শেষপর্যন্ত সিন্দবাদই অবশ্য কুঁকড়ে গেল। বলতে লাগল, “কে জানে, কেউ আসতেও পারে। মানে, আ-আমি ঠিক বলতে পারব না। মানে কেউ যদি আসতে চায়, আমি কি তাকে বাধা দিতে পারি? সত্যি-সত্যিই হয়তো কেউ আসছে।” সিন্দবাদের গলা কাঁপছিল। সে চকিতে একবার ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল, অবশ্যই এরিকসনের নজর এড়িয়ে।

“হুম! তাহলে বলছ পিছনের দরজা দিয়ে কেউ আসছে না?” এরিকসন প্রত্যেকটি শব্দ কেটে কেটে উচ্চারণ করল, “বেশ। মেনে নিলাম। কিন্তু ঘরের মধ্যে এরকম কনকনে, স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডার কারণটা আমায় তবে বোঝাও তো।”

কিন্তু কারণ শোনার জন্যে এরিকসন অপেক্ষা করল না। পরমুহূর্তেই তার ভাবান্তর হল। সে বিড়বিড় করতে লাগল, “আসছে, সে আসছে, বালিয়াড়ি ভাঙতে ভাঙতে সে এগিয়ে আসছে!” এখন আর সিন্দবাদের দিকে তার কোনও আগ্রহ নেই। চকিতে তার চাউনিতে একই সঙ্গে ভয় আর আনন্দের অভিনব মিশেল দেখা গেল।

ইতিমধ্যে সিন্দবাদ বেরিয়ে গিয়েছিল। এবার কাঁধে একবোঝা কাঠ নিয়ে সে আবার ঘরে ঢুকল। বলল, “সত্যিই গোটা বাড়িটা ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কেন বুঝতে পারছি না!”

কাঠগুলো সে আগুনে গুঁজে দিল। ঘর গরম করার জন্য আগুনটা অবশ্য আগে থেকেই জ্বলছিল।

ওদের দু’জনের কথার মারপ্যাঁচের আড়ালে অন্যকিছু লুকিয়ে আছে—ডাক্তার তো বটেই, মেজরও সেটা বুঝতে পারছিল কিছু কিছু। স্বভাবতই মেজরের বারবার মনে হচ্ছিল এইসব বস্তাপচা গুরুগম্ভীর আলোচনার জায়গা থেকে বেরোনো দরকার। কিন্তু কীভাবে? কী করা যায় ভাবতে ভাবতে সিন্দবাদের ওই ‘বাড়ি’ শব্দটাকেই বেছে নিল সে।  বলল, “হ্যাঁ, বাড়িই বটে! প্রাসাদ বললে আরও মানানসই হয়।” বলেই মেজর খুব খানিকটা হেসে নিল। যদিও হাসিটা তার নিজের কাছেই শুকনো ঠেকল। তবুও চেষ্টা করল, “হে হে, ঝিনুকের খোলাও তো প্রাসাদ! তবে…”

তারপর সিন্দবাদের দিকে ফিরে বলল, “খেয়াল রেখো, ঘরে কিন্তু একটা ব্যাঙ ঢুকেছে। সমুদ্রের দিক থেকেই এসেছে মনে হয়। হয়তো জোয়ারের জলের সঙ্গেই এসেছে।”

কেউ একথার জবাব দিল না। ঘরের মধ্যেকার স্যাঁতস্যাঁতে ভাবটা ক্রমশ বাড়ছে, তার সঙ্গে তামাকের ধোঁয়া মিশে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। যেন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আর ঠাণ্ডা বাড়ছে ধীরে ধীরে। বিন্দু বিন্দু জলকণা জমছে জিনিসপত্রের গায়ে। সময় যেন ঘরের মধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও ঘড়ি বলছে, কুড়ি মিনিট পেরিয়ে গেছে।

“আমি বরং বাইরেটা একবার দেখে আসি।” মাথাটা একবার বিশেষ কায়দায় ঝাঁকিয়ে সিন্দবাদ বেরিয়ে গেল। দেখতে দেখতে ওর অবয়বটা সাদা বালিয়াড়ির আড়ালে মিলিয়ে গেল। সিন্দবাদের মাথার ঝাঁকুনি ডাক্তার ছাড়া আর কেউ খেয়াল করল না। ডাক্তার কোনও কথা না বলে চেয়ারটা জানালার দিকে টেনে নিল। বসল এরিকসনের কাছাকাছি। তার এই প্রবীণ নাবিক বন্ধুটির পরাবাস্তব কথাবার্তা ঘরের পরিবেশটাকে পালটে দিয়েছে। শুধু কি নিছক ঘরের পরিবেশ? বোধহয় না। মানুষ ক’টির মধ্যেকার বোঝাপড়ার সমীকরণও আর যেন আগের মতো নেই। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা অতিলৌকিক জগত এই ঘরের মধ্যে জুড়ে বসেছে। এরিকসনের বাক্যজালের প্রতিটা সুতো তারই মাধ্যম হয়ে সবকিছুকে যেন পেঁচিয়ে ধরেছে, সে প্যাঁচ থেকে বেরিয়ে আসার সাধ্যি এ ঘরের কারোর বোধহয় নেই। হঠাৎ একটা অচেনা ভয়ের অনুভূতিতে জড়সড় হয়ে গেল দু’ভাই। অসহায় লাগছিল নিজেদের।

সাধারণ বোধবুদ্ধির যে বর্ম মনটাকে সযত্নে ঢেকে রাখে, কখন তাতে বড়ো বড়ো ফাঁক হয়ে গেছে, রীজ ভাইয়েরা সেটা টেরই পায়নি। আর সেই ফাঁক দিয়েই এই যুক্তিহীন ভয়টা তাদের মনে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসেছে। ভিতরে ভিতরে একটা ভাঙচুর চলছিল, যুক্তি আর প্রতিযুক্তির মধ্যে নিরন্তর একটা দ্বন্দ। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে, যুক্তি ক্রমশ হেরে যাচ্ছিল। আর তার মানসিক টানাপোড়েনে দু’জনের মনই অশান্ত হয়ে উঠছিল, গোড়ার দিকে দু’জনের কেউই সেটা খেয়াল করেনি। মানসিক টানাপোড়েন বিষয়টা এমনই যে, একবার শুরু হলে তাকে সামলানো মুশকিল। ফলে এরিকসনের উত্তেজনা নিঃশব্দে দুই রীজ ভ্রাতার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। দু’জনেই যে কারণে এরিকসনের কথাগুলোকে আর প্রলাপ ভাবতে পারছে না। এখন তারাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, কিছু একটা অলৌকিক অবিশ্বাস্য ঘটনা এক্ষুনি ঘটবে। হয়তো যেন সত্যিই কেউ আসছে এরিকসনের ডাকে সাড়া দিয়ে! পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে সমুদ্রের দিক থেকে, বালিয়াড়ি ভাঙতে ভাঙতে। এগিয়ে আসছে আরও কাছে, আরও আরও কাছে।

সত্যি-সত্যিই একটা পায়ের শব্দ দরজা দিয়ে ঢুকে এল। সঙ্গে সঙ্গে তিনজনেরই মুখ একসঙ্গে ঘুরে গেল দরজার দিকে। কিন্তু না, অন্যকিছু নয়। তার বদলে ঘরে ঢুকল ফাদার নর্ডেন।

ফাদার নর্ডেন এরিকসনের ভাইপো, থাকে অনেকটাই দূরে। প্রাচীন কোর্ফে প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ছাড়িয়ে কোথাও তার আস্তানা। ডাক্তার তাকে আগে থেকেই চেনে, কিন্তু মেজরের সঙ্গে তার আলাপ ছিল না। জানা গেল, সাইকেলে করে সে এসেছে স্টাডল্যান্ডের সমুদ্রের তীরে। ওখান থেকে একটা নৌকো ছাড়ছিল। সেই নৌকোই তাকে পৌঁছে দিয়েছে এখানে। আর তারপর তো সিন্দবাদের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল।

কিন্তু এমন বিশেষ সময়ে হঠাৎ তার আগমন? তাতে অবশ্য তার কাকা খুব একটা অবাক হয়েছে বলে মনে হল না। তাই কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে নর্ডেন নিজে থেকেই বলল, “আসলে আজ সকাল থেকেই তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল কাকা। তাই চলেই এলাম। আহা, বসন্তকালের এমন পূর্ণিমা রাত! তোমার এই বাংলোর সামনে শুধু একটা হ্যামকের দরকার ছিল, বুঝলে!”

তবে এত কথার মধ্যে একটা কথা সে সযত্নে এড়িয়ে গেল। সন্ধের ঠিক আগেই সিন্দবাদ এখানকার উপকূল রক্ষী বাহিনীর চৌকি থেকে তাকে টেলিগ্রাম করেছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে চলে আসার জন্য।

নর্ডেন সোসাইটি অফ যেসাসের একজন সদস্য। মানুষটি অত্যন্ত ধর্মভীরু। স্বভাবে সে চতুর তো নয়ই, বরং কারোর জন্যে কিছু করতে পারলে খুশিই হয়।

অবশ্য নর্ডেনের কথা যে এরিকসনের কানে ঢোকেনি আদপেই, সেটা তার পরের কথাতেই বোঝা গেল। কথাটা একজন আগন্তুকের কাছে বেশ অদ্ভুত লাগতে পারে। “তুমি যেকোনও ধর্ম মানতেই পারো, কিন্তু যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করো তো দেখবে, এতে তেমন কিছু ইতরবিশেষ হয় না। কেননা, সব ধর্মেই কিন্তু বলা হয়েছে নিজের আরাধ্য দেবতার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে তাঁর সঙ্গে লীন হয়ে যাওয়াই জীবনের পরম প্রাপ্তি। তার অর্থ তো সেই আত্মোৎসর্গই, এতক্ষণ ধরে যেটা বলছিলাম।” তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার বাইরে উঁকি দিয়ে কী দেখল কে জানে। অস্ফুটে বলতে লাগল, “আমি অতি ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, তাঁর অযোগ্য উপাসক। কিন্তু একজন সৈনিক, একজন যাজক, একজন ডাক্তার আর শ্রমিক—কী অপূর্ব সমাবেশ! একেবারে নৈবেদ্যের ষোলকলা পূর্ণ!”

ডাক্তারের সতর্ক কানে এরিকসনের কথার প্রতিটি শব্দই স্পষ্টভাবে ঢুকল।

“কাকা, তোমার এই বাংলোটা কিন্তু চট করে নজরে পড়ে না। জায়গাটা এমন আবছা লাগছিল, যেন সমুদ্রের কুয়াশা দিয়ে বাংলোটা মুড়ে রাখা!” নর্ডেনের বলার ধরনটা বেশ রুক্ষ। আসলে ভদ্রলোকের নিজের উপর ভরসা প্রচুর। তার ধারণা, তার উপস্থিতিই যেকোনও পরিবেশকে বাগে আনার পক্ষে যথেষ্ট। এমনকি এই ঘরটির অস্বস্তিকর পরিবেশকেও।

মেজরও উসখুস করছিল বোধহয় কিছু বলার জন্যে। কিন্তু কী বলতে কী বলবে, সেই ভয়ে ডাক্তার তাকে ইশারায় থামাল। অন্যরাও কোনও উৎসাহ দেখাল না। কাজেই বেচারা একটু মনোক্ষুণ্ণ হয়ে চুপ করে গেল।

নর্ডেন কিন্তু থামার পাত্র নয়। কাকাকে আবার এইসব পৌত্তলিকতার থেকে ফিরিয়ে আনা তার একরকম দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তাই এরিকসনকে সেই দিকেই খোঁচা দিল, “কাকা, তুমি তো আবার খ্রিস্টধর্ম মানো না। বরং ওই পৌত্তলিক আচার-আচরণই…”

ডাক্তার একথার মাঝখানেই আগের কথার খেই ধরে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই যে বালিয়াড়ির নীচু জায়গাগুলো, ওখানেই কুয়াশা জমে থাকে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন কাপের মধ্যে থেকে ধোঁয়া উঠছে!”

নর্ডেন অবশ্য ডাক্তারের কথায় কোন গুরুত্ব দিল না। বরং নিজের মতোই বলতে লাগল, “প্রথমে ভাবলাম, কাকা ওই অসভ্য বর্বগুলোর মতো কোনও পুজো-আচ্চা করছে বুঝি। এমন চাঁদনি রাত, নির্জন বালিয়াড়ি—ওই উৎসর্গ-টুৎসর্গ করার পক্ষে যাকে বলে আদর্শ!” নর্ডেন তার গলার শ্লেষ কিংবা ঠোঁটের কোণের বাঁকা হাসিটাকে লুকোবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না।

কিন্তু তার বোঝার মধ্যেই কিছু ভ্রান্তি ছিল। এ-ঘরের পরিস্থিতিকে সামান্য নাড়ানোর মতো চালিকাশক্তিও তার অন্তত এই মুহূর্তে নেই, এটা সে বুঝতে পারছে না। তার কাকার সমুদ্রের প্রতি এই উন্মাদনা সে আগেও দেখেছে এবং সেই আবেগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু এবারের সেই টান যেন উন্মত্ততার পর্যায়ে চলে গেছে। আর সেই উন্মত্ততার চোরা স্রোতে গা ভাসিয়েছে সবাই। এইবারে তার নিজেরও মনে হল সেই চোরা স্রোত যেন তাকেও টানছে! অর্থাৎ সেই স্রোতের উলটোদিকে যেতে হলে প্রতিবাদটা আরও জোরের সঙ্গে করা দরকার।

“স্টাডল্যান্ডের ওই ফাঁকা সমুদ্রতীর ধরে সাইকেল চালাতে চালাতে তাই ভাবছিলাম সমুদ্রের দেবতা ট্রাইটনের শিঙার আওয়াজ শুনতে পাব। অথবা বলা যায় না, সমুদ্রের দেবী সুন্দরী থেটিসের দেখা পাওয়াও অসম্ভব নয়। আর ভাবতেই বা দোষ কী, আমি নাহয় না হলাম, কিন্তু আর পাঁচটা অসভ্যের মতো আমার নিজের কাকাই তো তেনাদের পরম ভক্ত! হা হা হা!” এরিকসনের দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে নর্ডেন তার বক্তব্য শেষ করল।

এরিকসনের হয়তো কোথাও লাগছিল। কিন্তু তার বেপরোয়া চোখেমুখে তখন শিশুসুলভ খুশির উদ্ভাস। দুটো হাত দিয়ে হলদে হয়ে যাওয়া দাড়িগুলোকে আঁচড়াতে লাগল নাগাড়ে, যেন উত্তেজনার চরমে পৌঁছেছে সে। যেন নতুন কিছু ঘটতে চলেছে!

নর্ডেনের অর্বাচীনের মতো মন্তব্যে রীজ ভাইয়েরা যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হচ্ছিল। যেভাবে হোক ওকে থামানো দরকার। নর্ডেন অবশ্য থেমেই গিয়েছিল। এত দীর্ঘ বক্তৃতার পর একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঠাণ্ডা সোডার গ্লাসে তখন সবে চুমুক দিয়েছে, আর ওরাও কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই, ঠিক তখনই জানালার বাইরে থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ঘরের প্রত্যেকের কানে এসে আছড়ে পড়ল। সচকিত হল সকলে। আর আওয়াজটা মিলিয়ে গেল কি গেল না, বিড়বিড় করতে করতে ছুটে এল সিন্দবাদ, “হে ভগবান! শেষপর্যন্ত এসেই গেল! রক্ষে করো, রক্ষে করো!” তারপর গ্লকাস কিম্বা প্রোটিউস, না পন্টাস—কী যে বলল ঠিক বোঝা গেল না।

তবে জানালার শার্সিতে একটানা শব্দটা হতেই লাগল—টুক টুক টুক টুক… যেন কোনও প্রভু তার ভৃত্যকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে, আওয়াজটার মধ্যে এমন একটা কর্তৃত্ব আছে।

নর্ডেন হেসে উড়িয়ে দিল। “আরে এত ভয় পাওয়ার কী আছে? হাওয়ার দাপটে বালির ঝাপটা এসে লাগছে, কিংবা সামুদ্রিক শ্যাওলা-ট্যাওলা হবে, হাওয়ায় উড়ে এসে লাগছে!”

শব্দটা কীসের দেখার জন্য কেউই জায়গা ছেড়ে উঠল না। বরং এরিকসন সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গিয়ে জানালাটা হাট করে খুলে দিল।

“ইজিয়ানের সাগরতীরে একদিন সে ডাক পৌঁছেছিল। কিন্তু কথাটা সত্যি নয়, বরং একেবারে ডাহা মিথ্যে। তাছাড়া তিনি তো একাই নন, পসাইডনের দিব্যি, আরেকজন এখনও আছেন। আর তিনি আসছেন। আসছেন তাঁর চির-ভক্তের কাছে। তিনি জানেন তাঁর একান্ত অনুরক্তকে, আর ভক্তও সে খবর পায়। তিনি এখন ডাকছেন, সে কি তাঁর ডাক এড়াতে পারে? যাবে সে, যাবেই।” এরিকসনের ভরাট স্বর যেন জানালার বাইরে অমোঘ বাণীর মতো জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া বালিয়াড়ি পেরিয়ে ঢেউয়ের মাথায় মাথায় নাচতে লাগল।

ইজিয়ানের উল্লেখের অর্থ মেজরের কাছে ঠিক বোধগম্য হল না। গ্রিক পুরাণে আছে, এথেন্সের রাজা ইজিয়াস তাঁর ছেলে থেসিয়াসের মৃত্যু হয়েছে, এই ভ্রান্তিতে টিলা থেকে এই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দেন। এ গল্প মেজরের জানা ছিল না। কাজেই ওই ‘ডাক’, তা আবার মিথ্যা, এরিকসনের এসব কথার মোড়কের আড়ালে যে ধারণা লুকিয়ে আছে, সেটা তার মাথায় ঢুকল না। বরং আচমকা সে লাফিয়ে উঠল, “আরে! আরে! কীসে আমার গলা কামড়ে ধরেছে! ছাড়, ছাড়!” কীসে যে কামড়ে ধরেছে বোঝার আগেই সে মরিয়ার মতো হাত-পা চালাতে লাগল শত্রুর উদ্দেশ্যে। তার দম আটকে আসছিল। এলোমেলো হাত-পা চালাতে চালাতে গালও পাড়তে লাগল খুব। ধাক্কা লেগে ঘরের দুয়েকটা আসবাবপত্র উলটে গেল, আওয়াজ হল ঝনঝন। তাতেই সম্বিৎ ফিরল মেজরের। কোথায় দুশমন, কোথায় কী! কেউ তো তার গলা কামড়ে ধরেনি! তবুও এমনটা মনে হল। নেহাত মনের ভুল নিশ্চয়ই। খুব খানিক লজ্জা পেয়ে সে শান্ত হল।

ঠিক সেই মুহূর্তে খোলা জানালার সামনে ম্যালকমের সঙ্গে গৃহকর্তার তখন রীতিমতো ধস্তাধস্তি চলছে। ম্যালকম সমানে বলছে, “ওকে আটকাও! আটকাও! যেমন করে হোক বেরোতে দিও না!”

সিন্দবাদও চেঁচিয়ে সাবধান করতে লাগল। বাইরে অদ্ভুত আওয়াজ, আর ভিতরে উত্তেজিত কয়েকটি মানুষের কোলাহলে গমগম করতে লাগল ঘরের ভিতরটা। নর্ডেন অত্যন্ত শান্ত স্থির দৃষ্টিতে এরিকসনের উন্মাদনা লক্ষ করছে। তার আচরণে কোনোরকম উত্তেজনার লেশমাত্র তো নেই, বরং তার বদলে ফুটে উঠেছে মুগ্ধতা। অবিশ্বাস্যকে যেন দেখতে পেয়েছে সে। এরিকসনের চোখেমুখে উপচে পড়ছে যেন অদ্ভুত আলো। চাউনিতে যেন আকাশের বিশালতা।

“আরে উজবুকের দল, চুপ করো! কান পেতে শোনো!” হইচইয়ের মাঝে উচ্চকিত হয়েই খাদে নেমে গেল এরিকসনের গলা।

নিশ্চুপ হয়ে কান খাড়া করল সকলে। আওয়াজ একটা আসছে বটে, অদ্ভুত আওয়াজ! ক্যানফোর্ডের খাড়াই পাড় থেকে সে আওয়াজ স্টাডল্যান্ডের সাগরের সাদা পাথরের তীর বরাবর ছুটে বেড়াচ্ছে। সে আওয়াজ কেউ কখনও শোনেনি। পরিচিত কোনও শব্দের মিল নেই তার সঙ্গে। এ নিছক ঢেউয়ের গর্জন নয়, সমুদ্র কথা বলছে, ডাকছে। স্পষ্ট সে আহ্বান। উদ্দাম তেজের সঙ্গে ঘোষণা করছে কার প্রবল আগমনবার্তা!

আওয়াজটা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে, যেন অনেকরকম গর্জন একসঙ্গে ঢেউ পেরিয়ে গভীর সমুদ্র থেকে গড়িয়ে আসছে। সাগরের একেবারে তলদেশ কাঁপিয়ে শব্দটা উঠে এসে সমস্ত চরাচরকে ঝাঁকুনি দিয়ে তীর বরাবর দ্রুত বেগে ঘুরপাক খাচ্ছে। সমুদ্র ক্রমশ ফুসছে, এগিয়ে আসছে ছোটো ঘরটার দিকে। বাংলোর হাতায় শোনা যাচ্ছে তার পদধ্বনি। আসছে, আসছে সে, আরও, আরও কাছে!

চাঁদের অলখ টানে নৃত্যরত ঢেউগুলো হাত বাড়িয়ে দিল ছোট্ট বাংলোটার ছোটো ঘরটার দিকে। সে ঘর এখন তামাকের ধোঁয়ায় পূর্ণ। এবার নোনা জল আর ভিজে হাওয়াকে সঙ্গী করে তুমুল উচ্ছ্বাসে এগিয়ে এল মহাসিন্ধু।

ওই প্রবল জলরাশিকে কাছে আসতে দেখে ঘরের বাকিদের মনে প্রথম যে ভাব খেলে গেল তা আর যাই হোক, আনন্দ নয়। হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবল স্রোত, বিপুল ঘূর্ণির চোরা টান চারদিক থেকে আবর্তিত হওয়া এই প্রবলের পিছনে যে চালিকা শক্তি আছে, তার প্রতি ভয়ে, সম্ভ্রমে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল তারা।

ঘরের মধ্যে এলোমেলো হাওয়ায় নোনা জলের কুচি ঝাপটা মারছে। জলজ শ্যাওলার দল ভেসে আসছে স্রোতের টানে। হতবুদ্ধি হয়ে বসে ছিল সবাই।

“গ্লকাস! আমার প্রভু, আমার পিতা! গভীর সমুদ্রের দেবতা! আমার প্রাণের ধন, আসছি আমি। তোমার কাছেই আসছি।” আচমকা এরিকসন চিৎকার করে বলে উঠল। পরম প্রাপ্তির আনন্দে পূর্ণ সে স্বর।

ছোট্ট বাংলোটা কীসের ধাক্কায় একেবারে গোড়া থেকে কেঁপে উঠল। আর একই সঙ্গে এমন কিছু ঘটল, যেটা চোখে দেখেও ওই ঘরে উপস্থিত মানুষ ক’জনের বিশ্বাস হচ্ছিল না। ওই বিশালদেহী মানুষটি বাংলোর ছোটো জানালা গলে বেরিয়ে গেল! তারপর চাঁদের আলোয় স্নান করতে করতে এগিয়ে গেল ওই নৃত্যপরা তরঙ্গমালার দিকে।

অবিশ্বাস্য! ওই ঘুলঘুলির মতো জানালা গলে এরিকসনের মতো লম্বাচওড়া একজন বেরিয়ে গেল!

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মেজর রীজই প্রথম চেঁচিয়ে উঠল, “হে ভগবান! আমি যা দেখলাম, তোমরা সবাই কি একই দৃশ্য দেখলে!” তারপর টলতে টলতে দরজার দিকে এগোল। দেখে মনে হয় যেন অনেকদিন অসুখে ভুগে সবে উঠেছে।

তার পিছন পিছন এগোল তার ভাই ম্যালকম। সিন্দবাদকে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু পিছনদিকের প্যাসেজের দিক থেকে তার গলা শোনা যাচ্ছিল, চেঁচিয়ে কিছু একটা বলছিল। ফাদার নর্ডেনের চেহারাটা অন্যদের তুলনায় রোগাপাতলা হলেও ছিমছাম এবং সে রীতিমতো সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। রীজ দু’জন বেরিয়ে যাওয়ার পর সেও বেরোল ঘর থেকে। তবে দরজা দিয়ে নয়। কী ভেবে কে জানে, সেও বেরোল জানালা গলে! ততক্ষণে দুই ভাই বালিয়াড়ি পেরিয়ে সমুদ্রের একদম কাছাকাছি পৌঁছেছে। নর্ডেন এসে যোগ দিল তাদের সঙ্গে। চাঁদের আলোয় দেখা গেল এরিকসনকে। কিছু বোঝার আগেই এদের পাশ কাটিয়ে দৌড়ে চলে গেল সমুদ্রের দিকে, ঠিক যেখানে ঢেউ ভাঙছে অনবরত।

কারোর মুখে কোনও কথা নেই, তারা পাগলের মতো ছুটে গেল সেদিকে। সবার আগে নর্ডেন। যখন পাশ দিয়ে ছুটে গেল, তখন এরিকসন কী একটা গান গাইছিল! কিন্তু এই মুহূর্তে তার নাগাল পাওয়া কার্যত অসম্ভব। ঢেউগুলো এখন ঘিরে ধরেছে তাকে। তারপর…

তারপর যেন সে উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের বুকে।

এই চন্দ্রালোকিত সৈকতে তিনটি মানুষের চোখের সামনে ঘটে গেল এক অলৌকিক ঘটনা। তিনটি মানুষ সাক্ষী থাকল এই অত্যাশ্চর্য, অবিশ্বাস্য ঘটনার। যে ঘটনা ব্যক্তিগত ভয়ভীতির অনেক ঊর্ধ্বে, সমস্ত তর্ক-বিতর্ক যার সামনে অতি তুচ্ছ, অর্থহীন।

হঠাৎই সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে আসা সেই অপার্থিব আহ্বান যেন একেবারে কানের গোড়ায় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর সেই সঙ্গেই সাগর আর আকাশ যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখান থেকে একটা কালো রেখা সমস্ত চরাচরকে বেড় দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল তীরের দিকে। হলফ করে বলা যায়, এ রেখাটির সঙ্গে আর যাই হোক, নিছক ঢেউয়ের আসা যাওয়ার সম্পর্ক নেই। সাগরবেলার খাড়া পাড়ের কাছে এক মুহূর্তের জন্য তা চাঁদের আলোয় ঝলকে উঠল।

চাঁদের আলোয় দেখা গেল এরিকসন তার হাতদুটো ছড়িয়ে দিয়েছে দু’দিকে, মাথা আর দুই কাঁধ আনত।

আর তারপর? তারপরের ঘটনা বর্ণনা করার মতো ভাষা সাক্ষী তিনজনের ছিল না। তবে সাক্ষী আরও ছিল। তাদের কথায় আসি এবার।

সাক্ষী ছিল হঠাৎ বাঁক নেওয়া নির্জন সাগরতীর, চোখের তারাহীন বালিয়াড়ির দল নির্নিমেষে দেখেছিল সব, আর দেখেছিল আকাশের চাঁদ। দীর্ঘ সাগরতীর তার বালিময় বুকে রেখে দিয়েছিল সমস্ত রেকর্ড। হয়তো কোনও বিজ্ঞানী ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে সেইসব ছবির পুনর্নিমাণ করবে, যে ছবি প্রকৃতি তার গোপন ক্যামেরায় তুলে রাখছে অহর্নিশি।

এরিকসনের ট্যুইডের স্যুট হাওয়ার ধাক্কায় একটুকরো ফিতের মতো উড়তে দেখা গেল, আর তারপরেই তার দেহটা একটা কালো শ্যাওলার স্তূপের মতো ঢেউয়ের দোলায় দুলতে লাগল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না ওকে। পরমুহূর্তেই চাঁদের আলোয় দেখা গেল সোজা দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, হাতদুটো দু’দিকে ডানার মতো ছড়িয়ে দিয়ে। তার চুলগুলো এলোমেলো হাওয়ায় উড়ছিল। সামনের দিকে ঝুঁকল এবার, মাথাটা ঘুরিয়ে পাশের দিকে দেখল কিছু। সমুদ্রের সুরে সুর মিলিয়ে বোধহয় কোনও গান গাইছিল। তারপর, তারপর যেমন করে ঢেউ ভেঙে গড়িয়ে আসে বালির উপর, ঠিক তেমন করেই ও গড়িয়ে গেল তীরের বালির উপর। আর ফিরতি ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউয়ের মতোই চলে গেল তীর থেকে অনেক দূরে, গভীর সমুদ্রের দিকে। গান গাইতে গাইতে কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ও হয়তো ওর দয়িতের সঙ্গে মিলিত হল, হয়তো পরম তৃপ্তি ওকে জুড়িয়ে দিল।

নর্ডেন হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তার ঐকান্তিক প্রার্থনা ধ্বনিত হল, “হে ঈশ্বর, এই বিপুল জলধি এবং তার সমস্ত শক্তি তোমার হাতের মুঠোয়, তুমি তাঁকে এবং তাঁর সেবককে গ্রহণ করো!”

এরিকসন হারিয়েই গেল। এমনকি তার দেহও আর পাওয়া গেল না। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, তারা ফিরে এসে দেখল, ঘরের মধ্যে সিন্দবাদ ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে, নোনা জলের ছিটে লেগে সে প্রায় সম্পূর্ণ ভিজে গেছে! বাংলোর লাগোয়া উঁচু বালিয়াড়িগুলোতেও জলের দাগ, বেশ বোঝা যাচ্ছে, মস্ত ঢেউ এসে বালি ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেছে। অথচ এতদূরে কখনোই ঢেউ এসে পৌঁছয় না। মোটা মোটা ঘাসের গোছাগুলো গোড়া থেকে উপড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে।

সেদিন ইস্টারের পূর্ণ চন্দ্রের টানে যে জোয়ার এসেছিল, তেমনটি আগে দেখা যায়নি। পুল হারবার ভেসে গিয়েছিল, এমনকি অনেকটা ভিতরে ফ্রোম নদীর মোহনা পর্যন্ত তার আঁচ লেগেছিল। অনেক দূরে আর্নে উপসাগর আর উইচ প্রণালী পেরিয়ে পারবেক পাহাড়ের নাইন ব্যারো শৈলশিরা পর্যন্ত শোনা গিয়েছিল সমুদ্রের আওয়াজ। না, শুধুমাত্র আওয়াজ বলাটা বোধহয় ভুল হল, বরং বলা ভালো, সমুদ্র যেন গান গাইছিল! সমুদ্র থেকে অনেক ভিতরে ডাঙার মানুষের কানেও পৌঁছে গিয়েছিল সেই সঙ্গীত!

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “বিদেশী গল্প -নেশা- আলগারনন ব্ল্যাকউড অনুবাদ নন্দিনী দাস চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০২০

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s