অঙ্কের বিচিত্র জগত সব পর্ব একত্রে
বৈজ্ঞানিক
ত্রিকোণমিতিক মাপজোকের পরিবর্তনের হারকে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতরভাবে মাপবার বিষয়টা মাধবাচার্য আর অন্যান্য ভারতীয় গণিতজ্ঞদের একটা অন্যতম প্রধান গবেষণার বিষয় ছিল। আধুনিক যুগের যে কমণবিদ্যা বা ক্যালকুলাস তার একটা প্রধান ভিত্তি ছিল এই পদ্ধতিগুলো। তবে তাই বলে তা কখনই সর্বার্থে ক্যালকুলাস হয়ে ওঠেনি। এই ভিত্তির ওপর ভর করে তার উভব হয়েছিল আরো পরে। ইউরোপে। তার ক্ষেত্র আরো প্রশস্ত। মাধব ও তাঁর শিষ্যদের মত কেবল ত্রিকোণমিতিক মাপজোকে সীমাবদ্ধ না থেকে কলণবিদ্যা যেকোনো চলরাশিরই পরিবর্তনের হারকে মাপতে পারে। তা সে চলরাশি একটা পালটাতে থেকা কোণের মাপই হোক কি কোনো গাড়ির পালটাতে থাকা গতির হারই হোক, বা কোনো প্রাণী , উদ্ভিদ বা জীবাণুর বংশবৃদ্ধির হারই হোক।
কিন্তু ভিত্তিগুলো যে এদেশ থেকেই গিয়েছিল তার কিছু প্রমাণ আছে। ষোড়শ শতকে এসে দেখা যাচ্ছিল, এদেশে আসা জেসুইট পাদ্রিরা সমুদ্রযাত্রায় নিখুঁত দিকনির্ণয়ের কাজে ব্যবহারের জন্য ভারতীয় গণিতজ্ঞদের অঙ্ক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত পাণ্ডুলিপিগুলোতে উৎসাহিত হয়ে উঠছেন।
এমন এক পাদ্রির নাম ছিল ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াস। ক্ল্যাভিয়াস, তার কর্মক্ষেত্র কলেজিও রোমানো-র পাঠক্রমে বেশ কিছু অদল বদল এনেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর এক ছাত্রকে তিনি পড়াশোনা করবার জন্য কোচিতে পাঠিয়েছিলেন। ছাত্রের মাস্টারমশাইকে লেখা এক চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে, সে কোনো “বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণ বা সৎ মূর”-এর কাছ থেকে ভারতীয় সময় পরিমাপবিদ্যার পাঠ নিতে চায়।
কিছু ইতিহাসবিদ এ থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসছেন যে, জেসুইট পাদ্রিদের মাধ্যমে পূব থেকে বিজ্ঞান ও গণিতের গবেষণার পাঠগুলোর একটা ধারা সে সময় বর্তমান ছিল। এই একই সময়ে আরো একটা ব্যাপার উল্লেখযোগ্য। জেসুইট পাদ্রিরা তখন কেরালায় বেশ জমিয়ে বসেছেন। মালয়ালামা ভাষা শিখে নিয়ে সেখানকার অনেক ইশকুলে সে ভাষার পমাস্টারমশাইও হয়ে উঠেছেন তাঁরা। অতএব মালয়ালাম ভাষায় সে সময় সুলভ মাধবাচার্যের তত্ব্ব সম্বলিত, জ্যেষ্ঠ্যদেবের লেখা যুক্তিভাষা পুথিটার সারবস্তু তাঁদের হাত ধরে ইউরোপের দিকে রওনা হয়ে যেতে কোনো বাধা তো ছিলই না, বরং বলা যায় তার সম্ভাবনাটাই প্রবল ছিল।
অসীম শ্রেণীর সম্প্রসারণ নিয়ে মাধবাচার্যের যে কাজ, সে বিষয়ে ১৮৩৫ সালে চার্লস হুইশ একটা গবেষণাপত্রে দাবি করেন মাধবাচার্য ও তাঁর শিষ্যরা মিলে যে কেরালা গণিতধারা বা কেরালা স্কুল অব ম্যাথেমেটিকস-এর জনম দিয়েছিলেন সে ধারা অবকলনবিদ্যা বা ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাসের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
তা এই মতামতগুলোর বিরুদ্ধেও কথাবার্তা কম নেই পণ্ডিতদের জগতে। একদল বলেন, ওতে হবে না আরোপ্রমাণ চাই। বলেন, কই ইউরোপের কোনো গণিতজ্ঞের কাজেই তো ভারত থেকে কিছু অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে কিছু পেয়েছেন বলে বলা নেই। তার মানে তাঁরা নিশ্চয় সব নিজে নিজে আবিষ্কার করেছেন।
যাক সে কথা। কেরালা স্কুল অব ম্যাথমেটিকসের কথা যখন উঠল তখন সে বিষয়ে কিছু জেনে নেয়া যাক। কেরালায় গণিতচর্চার যে শক্তপোক্ত ভিতটা মাধব প্রতিষ্ঠা করলেন তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দুই সশিষয় নীলকন্ঠ আর জ্যেষ্ঠ্যদেব।সেটা সৌভাগ্যের বিষয় কারণ মাধবের নিজের লেখার পুথিগুলো হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই দুই শিষ্যের পুথিতে রয়ে গেছে তাঁর কাজগুলোর উল্লেখ, তার ব্যাখ্যা। এইভাবে শিষ্যের হাত ধরে গুরু অমর হয়ে থেকেছেন। নীলকন্ঠ মাধবের আবিষ্কারগুলোকে আরো বিস্তারিতভাবে অনুসন্ধান করেছেন তাঁড় পুথি “তন্ত্রসংগ্রহ”তে, আর জ্যেষ্ঠ্যদেব মাধব আর নীলকন্ঠের রেখে যাওয়া তত্ত্বগুলোর গাণিতিক প্রমাণ সৃষ্টি করেছেন নিজের পুথি “যুক্তিভাষা”য়। এই যুক্তিভাষাতেই সৌরজজাগতিক গ্রহতত্ত্বের ধারণা দেয়া হয়েছিল, যা এর কিছুকাল বাদে দেখা যাচ্ছে ইউরোপে টাইকো ব্রাহে প্রচার করছেন। ষোড়শ শতকে কেরাল স্কুলের আরেক জ্যোতিষ্ক চিত্রভানু দুই-সমীকরণযুক্ত বীজগাণিতিক সিস্টেমের একুশটা বিভিন্ন ধরণ ও তার বীজগাণীতিক ও জ্যামিতিক সমাধান আবিষ্কার করেন।
দক্ষিণের গণিতজ্ঞদের কথা বলতে বসে ইতিহাসের পথে সামান্য পেছনে গিয়ে আর এক গণিতজ্ঞের কথা না জানালে অন্যায় হবে। তিনি কর্ণাটকের গণিতজ্ঞ মহাবীর।নবম শতাব্দিতে এই কন্নড় গণিতজ্ঞের জীবন কেটেছে। ত্রিঘাত ও দ্বিঘাত সমীকরণ নিয়ে ছিল তাঁর গবেষণা। কিছু কিছু শ্রেণীর সমীকরণের ক্ষেত্রে তাদের সমাধানের পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর পুথি, “গণিত-সারসংগ্রহ” এই কাজটি বাদেও ব্রহ্মগুপ্তের গবেষণার ওপরে গভীরতর আলোকপাত করেছিল। দক্ষিণে গণিতচর্চার প্রসারে এই পুরোধা মানুষটির ভূমিকা গভীর।
ক্রমশ