অংকের বিচিত্র জগত সব পর্ব একত্রে
অঙ্ক চলল দক্ষিণে
ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্কর-১ দের পর ক্যালকুলাসের পূর্বসূরী এইসব হিসেবনিকেশ নিয়ে গবেষণা বেশ কিছুকাল ধরে একই জায়গায় থেমে ছিল। আসলে সপ্তম শতাব্দি থেকে উত্তর ভারতে রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। আগেকার দিনের মতন সেই শক্তিশালী রাজারা নেই। গোটা দেশকে একসঙ্গে ধরে রেখে শান্তি বজায় রাখবার মানুষের তাই অভাব ঘটেছে তখন। হয়ত নানান শক্তিদের ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় আর যুদ্ধেবিগ্রহে শান্তিতে জ্ঞানচর্চা করবার অবস্থা সেখানে বজায় থাকছিল না।
এই কারণে, কিছুকাল থেমে থাকবার পর ভারতবর্ষের মৌলিক গণিতচর্চায় ফের জোয়ার এল দাক্ষিণাত্য থেকে। দ্বাদশ শতাব্দিতে দক্ষিণ ভারতে ভিজ্জাদাবিদার কাছে (এখনকার কর্নাটক) আবির্ভূত হলেন ভাস্করাচার্য। সপ্তম শতাব্দির ভাস্করাচার্যের থেকে তফাৎ করবার জন্য তাঁকে আমরা ভাস্কর-২ বলব।
মহেশ্বর নামে এক রাজজ্যোতিষীর ছেলে ছিলেন তিনি। বাবা তাঁকে জ্যোতিষবিদ্যা শেখাবার জন্য খুব যত্ন করে অঙ্কের পাঠ দিয়েছিলেন। বড়ো হয়ে সেই বিদ্যাকে গভীরতর করে নিয়ে গ্ণিতজ্ঞ হিসেবে বিখ্যা হয়ে ওঠেন ভাস্কর-২ উজ্জয়িনী ছিল সে যুগে ভারতে গণিতচর্চার পীঠস্থান। সেখানকার গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রধান পদে বসেছিলেন ভাস্কর-২।
তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থের নাম সিদ্ধান্ত শিরোমণি। চারটে ভাগ আছে তাতে। প্রথম ভাগটার নাম লীলাবতী। এইখানে পাটিগণিতের চর্চা করেছেন তিনি। মেয়ে লীলাবতীর নামে নাম। দ্বিতীয় ভাগের নাম বীজগণিত। তৃতীয় ভাগের নাম গ্রহগণিত আর চতুর্থ ভাগটি হল গোলাধ্যায় (গোলক বা পৃথিবী সম্পর্কিত হিসেবনিকেশ)
গ্রহনক্ষত্রের গতির হিসেব করতে গিয়েই একটা বিশেষ বিষয়ে তাঁর নজর পড়েছিল। সেটা হল গ্রহণ। একটা গ্রহ যখন ঘোরে, তখন তার অবস্থান কিন্তু একটানা বদলাতে থাকে। এমন কোনো সামান্যতম সময়ও মেলে না যে সময়টুকুর জন্য তাকে একটা অবস্থাতে স্থির থাকতে দেখা যাবে। তাহলে, কখন সূর্যগ্রহণ হবে সেইটে খুব নিখুঁতভাবে বের করতে হলে আমাকে তো পৃথিবী, সূর্য আর চাঁদের অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে বদলাচ্ছে সেইটা খুব নিখুঁতভাবে জানতে হবে, তাই না? অর্থাৎ খুব নিখুঁতভাবে কখন গ্রহণ লাগবে সেটার হিসেব করতে হলে খুব কম সময়ের ব্যবধানে এদের অবস্থানগুলো কী কী ভাবে বদলাচ্ছে সেটার হিসেব চাই।
এই যে শূন্যের কাছাকাছি খুব ছোটো সময়ের ব্যবধান, তার হিসেব করতে গিয়ে ভাস্কর ২ বললেন একটা গ্রহের দুটো পরপর অবস্থানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ধরতে হবে এক ত্রুটি মানে এক সেকেণ্ডের ৩৩৭৫০ ভাগের এক ভাগ। এই অতিক্ষুদ্র ব্যবধানে চলরাশি (এক্ষেত্রে গ্রহের অবস্থান)কীভাবে বদলায় তার হিসেব তৈরি করে সেই দিয়ে গ্রহদের গতির পরিমাপকে ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। আর এই অতিক্ষুদ্র বা ইনফাইনাইটসিমাল ব্যবধানে চলরাশির মান বদলাবার কৌশল প্রস্তাব করবার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল কলনবিদ্যার আসল বীজ। আর এই করতে গিয়েই তাঁর আরেক প্রতিপাদ্য, একটা গ্রহ যখন সূর্য থেকে তার দূরতম আর নিকটতম বিন্দুতে পৌঁছোয় শুধু সেই সময়বিন্দুদুটোতে তাদের গতিবদলের হার থমকে যায়। এই যে সময়বিন্দুকে ধরে তাকে হিসেবের মধ্যে নিয়ে আসা এখান থেকেই শূন্যের একেবারে কাছাকাছি ব্যবধান বা ইনফাইনাইটসিমালের বিষয়ে তাঁর ধারণার ছবি মেলে। মেলে কলনবিদ্যার ম্যাক্সিমা আর মিনিমা বিষয়দুটোর বিষয়ে চিন্তাভাবনার ছাপ।
তবে জ্যোতির্বিজ্ঞান আর ত্রিকোণমিতির হিসেবনিকেশের মধ্যেই থেমে থেকেছিল তাঁর গবেষণা। সেই করতে গিয়ে কলনবিদ্যার যে গোড়াপত্তন তিনি করেছেন, বিজ্ঞানে তাঁর উত্তরসূরীরা পরবর্তীকালে তাকে যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করবার কৌশল তৈরি করবেন সে ধারণা তাঁর ছিল না।তাঁর দুই শতাব্দী বাদে কেরালার গণিতজ্ঞ মাধব কলনবিদ্যার গবেষণাকে আরো অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যান। তবে সে গল্প করবার আগে ভাস্কর ২ কে নিয়ে আরো কিছু গল্প হবে।
ক্রমশ