বনের ডায়েরি-এমন আমি ঘর বেঁধেছি-সুমনা সাহা-শরৎ ২০২০

এমন আমি ঘর বেঁধেছি

সুমনা সাহা

মানুষ ঘর বাঁধে—শীতের প্রবল ঠাণ্ডা, গ্রীষ্মের প্রখর তাপ, বর্ষার ঝড়-জল—প্রকৃতির এই সমস্ত ভয়াল-ভ্রুকুটি থেকে বাঁচতে সে চার-দেওয়ালের ঘেরাটোপ আর মাথার উপর ছাদের সুরক্ষা দিয়ে নিশ্চিন্তির ঘর বানায়। সেখানে ছেলেপুলে-পরিবার-পরিজন নিয়ে আরামে থাকে। কিন্তু অনেকদিন ঘরবন্দী থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে ওঠে। তখন আবার তার প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছে করে। ঘর ছেড়ে সে তখন বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে। যারা খুব বেড়িয়ে বেড়ায়, আমরা বলি, ‘বাহ্, খুব মজা! যেন মুক্ত বিহঙ্গ!’ বিহঙ্গ মানে পাখি। পাখি নীল আকাশের বুকে ডানা মেলে মনের সুখে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু সব সময় কি আকাশে উড়ে উড়ে বেড়ানো যায়? ডানা ব্যথা হয়ে গেলে তাই নামতেই হয় মাটির বুকে। রাতের বেলা গাছের ডালে বসেই খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নেয়। দিনের আলো ফুটলেই আবার উড়ান দেয় নীলাকাশে। এরা হল দিনের বেলার পাখি। রাতের পাখিরা দিনের বেলায় গাছের কোটরে ঘাড় গুঁজে বসে বসে ঝিমায়। রাত যখন নিকষ কালো, তখন তারা শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে বাসা ছেড়ে। শত্রু যখন আক্রমণ করে, পাখি উড়ে পালাতে পারে। কিন্তু ডিম ফুটে সদ্য বেরনো পাখির ছানাগুলো? ওদের চোখ ফুটতে, ডানার পালক গজাতে আর উড়ে পালাবার মতো ডানার জোর হতে সময় লাগে। তাই তার ডিম ও ডিম ফুটে বের হওয়া ছোট্ট ছানাগুলোর সুরক্ষার জন্য, নিজের প্রজাতির অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার প্রয়োজনে পাখিকেও বাসা বানাতে হয়।

পাখিও ঘর বাঁধে। তবে মানুষের বাড়ি যেমন ইট, চুন, সুরকি, সিমেন্ট, কাঠ, পাথর ইত্যাদি নানা শক্ত জিনিস দিয়ে তৈরি হয়, পাখি তো আর তেমনটি পারে না! সে গাছের কচি ডালপালা, অন্য পাখির পালক, ঘাস-পাতা, কাঠিকুটো এইসব ঠোঁটে করে জোগাড় করে তৈরি করে তার ঘর। সেইজন্যই তা শক্তপোক্ত স্থায়ী কিছু নয়, বরং হালকা-পলকা ও অস্থায়ী। তাই লোকে বলে ‘পাখির বাসা’। তবু সেসব বাসা তৈরির কেরামতি কী চমৎকার! ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলে বোঝা যায়, আকাশে উড়ে উড়ে বেড়ানো ছোট্ট পাখি বাবা-মায়ের মনেও তার কচি ছানাপোনাদের রক্ষা করবার কতই না চিন্তা আর তাই বাসা তৈরির কত রকম নিপুণ কুশলী উদ্যোগ! তাদের সেসব চেষ্টা কোন আর্কিটেক্টের ডিজাইনের চেয়ে কম যায় না!

আজ তেমনই কয়েকটা পাখির বাসার খোঁজে বেরিয়ে পড়ি চলো!

নলহাটি, নৈহাটি, গৌহাটি বা বৈদ্যবাটি নয়, এ হল বাসা-বাটি!

যখন শীতের শুরুতে গাছের পাতা ঝরতে আরম্ভ করে, নেড়া নেড়া গাছের দুটি শাখার মাঝে, ইংরাজি ওয়াই অক্ষরের মতো খাঁজে বাটি বা কাপের মতো দেখতে বাসা চোখে পড়ে সবচেয়ে বেশী। এরকম বাসা তৈরি করে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট্ট পাখি হামিং বার্ড। গাছের উঁচু ডালে এরা বাসা বাঁধে গাছের কচি নরম ডাল, বাকল বা মাকড়সার জাল এইসব নরম-সরম জিনিস দিয়ে। রুবি থ্রোট হামিং বার্ড—যার গলার পালক একেবারে চুনীর মতো লাল টুকটুকে, তারা শ্যাওলা দিয়ে বাসার ভিতরটা আরও নরম করে তোলে। যাতে ডিম ভেঙে না যায়। আমেরিকান রবিন, আমাদের দেশের চড়াই পাখিও এই জাতীয় বাটির মতো বাসা বানায়। তাতে সয়াবিনের দানার মতো ছোট ছোট তিন/চারটে ডিম পাড়ে। বাসাটি এমন নমনীয় করে বানায় যে ডিম ফুটে শাবক বের হলেও ওর মধ্যে বেশ আঁটসাঁট করে কুলিয়ে যায়। ছানাগুলো যেমন যেমন বড় হতে থাকে, বাসাটাও চাপে একটু একটু প্রসারিত হতে থাকে, ফলে বাচ্চাদের বেড়ে উঠতে কোনও অসুবিধে হয় না। এক এক পাখির ক্ষেত্রে বাসা-বাটির আয়তন ও গভীরতা একেক রকম হয়। অনেক পাখি আবার কাপের বাইরে ও ভিতরের দিকে আলাদা আলাদা আস্তরণ দেয়। মুখ থেকে লালা বের করে দুটি শাখার খাঁজে ফেলে, তার উপরে বাসার উপকরণ একের পর এক সাজাতে থাকে, একটু একটু করে লালা ফেলে, একটু একটু জিনিস জুড়ে দেয়। ঐ লালাই শুকিয়ে শক্ত হয়ে ফেভিকলের আঠার মতো কাজ করে। সেইজন্যেই বাসাটি গাছের ডালে বেশ করে আটকে থাকে, পড়ে যায় না। তবে খুব ঝড় বৃষ্টির দাপট সইবার ক্ষমতা তার নেই। তাই ঝড়বাদলের শেষে অনেক সময় রাস্তার উপর পড়ে থাকতে দেখা যায় কত পাখির বাসা, অসহায় ছানাগুলো পথের উপর পড়ে থেকে অন্য বড় পাখি বা ইঁদুর বেড়ালের পেটে চলে যায়। ভাগ্য ভালো হলে দয়ালু কেউ তাদের যত্ন করে তুলে শুশ্রূষা করে, বড় হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়।

দোদুল দোলে গাছের ডালে/বাসাখানি হাওয়ার তালে…

দোলনা-বাসা/লকেট-বাসা/কলসী-বাসা—গাছের শাখা থেকে দোলনার মতো বা মালায় গাঁথা লকেটের মতো যে পাখির বাসাগুলো ঝুলতে দেখা যায়, তাদের বাসাকেই দোলনা বা লকেট বাসা বলে। আর উলটানো কলসীর মতো দেখতে বাসা বানাতে ওস্তাদ হল বাবুই পাখি। লকেট/দোলনা বাসার সুবিধে হল, শূন্যে ঝুলন্ত বাসায় শত্রু প্রবেশ করতে পারে না সহজে। সাপ, গিরগিটি, ইঁদুর প্রভৃতির আক্রমণ থেকে ছানাদের বাঁচাবার জন্য টুনটুনি জাতীয় পাখি এরকম বাসা বানায়। এরা সরু ছুঁচালো ঠোঁট দিয়ে দুই থেকে তিনটি পাতা যত্ন করে সেলাই করে ঠোঙার মতো বানায়, গাছ-লতার তন্তু বা আঁশকে সুতো হিসেবে ব্যবহার করে। ঠোঙার ভিতরে নরম ঘাস-পাতা ও অন্য পাখির নরম পালক বিছিয়ে দিয়ে গদি তৈরি করে যাতে করে ডিম পাড়লে সেগুলো সুরক্ষিত থাকে। বাসার নিচের দিকে ছোট গর্তের মতো ফাঁক রেখে দেয়, সেখান দিয়ে মা পাখি বাসায় ঢোকে বা খাবার আনতে বেরোয়। ঠোঁট জোড়া সূঁচের মতো ব্যবহার করে পাতা সেলাই করে বলে টুনটুনিকে দর্জি পাখি, ইংরাজিতে টেলর বার্ড বলা হয়। ভারি নিখুঁত তার ঠোঁটের সেলাই। অনেক ঝড়-বাতাসেও কিন্তু সেলাই খুলে যায় না।

বাবুই পাখিও ভালো সেলাই করে। তবে এদের বাসা বানানোর কায়দা অন্যরকম। তাই দর্জি না বলে এদের বলে তাঁতি। তাঁতি যেমন তাঁতে কাপড় বোনে, বাবুই তেমনই পাতা সরু সরু করে ঠোঁট দিয়ে চিরে সেগুলো জোড়া লাগিয়ে উলটানো কলসীর মতো বাসা বানায়। তারপর পেট দিয়ে ঘষে ঘষে বাসার গা-টা মসৃণ করে তোলে। প্রথমে বাসায় দুটি গর্ত রাখে। পরে একদিক বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা করে। আরেকটা দিকে ঠিক কলসীর গলার মতো সরু ও লম্বা পথ করে বাসায় ঢোকা ও বের হওয়া জন্য। খুব পরিশ্রম করে ঝুলন্ত কুঁড়েঘরের মতো বাসাটি বানায়। রাত্রে বাসায় আলো জ্বালাবার জন্য বাবুই নাকি জোনাকি ধরে এনে বাসার কোনে এক খাবলা গোবরের মধ্যে গুঁজে রাখে। তাল, নারকেল, খেজুর প্রভৃতি গাছে বাবুইয়ের বাসা ঝুলতে দেখা যায়।

কেমন সব মজার মজার বাসা বানাবার কৌশল, তাই না? তবে সব পাখিই যে বাসা বানাবার জন্য খুব খাটাখাটুনি করে, তা মোটেই নয়। এই যেমন ধরো, মরুর দেশের উটপাখি, তারপর খুব ঠাণ্ডার দেশের, তুন্দ্রা অঞ্চলের চিল জাতীয় কিছু পাখি (আর্কটিক টার্ন) মাটির অগভীর ফাটলে বা খাঁজে বাসা তৈরি করে। এগুলো ফাটল-বাসা। বাসা তৈরির উপকরণ এতে বিশেষ কিছুই লাগে না। ঐ খাঁজের মধ্যে ঘাস, লতাপাতা, নুড়ি-পাথর ইত্যাদি বিছিয়ে বিছানা পেতে দেয়, আর তার উপরেই ডিম পাড়ে। ওই সমস্ত জায়গায় গাছপালাও খুব কম থাকে।

আবার অস্ট্রেলিয়ার কিউই পাখি, এক জাতের পেঁচা, মাছরাঙার কয়েক প্রজাতি, গ্রেট হর্নবিল এইসব পাখিরা মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে বা লম্বা সুরঙ্গ-পথের শেষে বাসা বানায়। এগুলো সুরঙ্গ-বাসা। অনেকসময় অন্য প্রাণির পরিত্যক্ত গর্তেও ডিম পাড়ে। আবার সারসের এক প্রজাতি, যার নাম ফ্লেমিঙ্গো ও এক জাতের পেঙ্গুইন মাঝারি উঁচু মাটির ঢিবির উপরে লম্বা চোঙার মত বা উল্টানো ঘণ্টার মত দেখতে বাসা তৈরি করে। এগুলো চোঙা/ঘণ্টা বাসা। ফ্লেমিঙ্গোর লম্বা লম্বা ঠ্যাঙ আর বিরাট লম্বা সরু ঠোঁট! জলাশয়ের ধারে নিজেই ঠোট দিয়ে মাটি খুঁড়ে জড়ো করে একটু উঁচু ঢিবির মত তৈরি করে। তার উপরে ঠোঁট দিয়ে গর্ত করে একটা আইসক্রীমের কোনের মত বানিয়ে সেখানে ডিম পাড়ে। একটা ফ্লেমিঙ্গো একবারে একটাই ডিম দেয়। দেখতে আজব হলে কি হয়, সন্তান স্নেহ সব মায়ের প্রাণেই তো থাকে, তাই মা পাখিটা ঢিবির মাথার উপর উঠে বসে থাকে ডিম পাহাড়া দিতে। এরা স্বামী-স্ত্রী মানুষের মতই একত্রে প্রায় ৫০ বছরও কাটিয়ে দেয়!

আবার চড়াই, কাঠঠোকরা, শালিক, টিয়াপাখিরা গাছের কোটরে, ইলেকট্রিকের বা টেলিফোনের খুঁটির উপরে কোনও কোটরে, বাড়ির বারান্দা বা ছাদের ঘুলঘুলির ফাঁকফোঁকরে বাসা বানায়, নানা জিনিস দিয়ে নরম গদি বানিয়ে বাসার ভিতর ডিম পাড়ার জায়গা করে। এগুলো কোটর-বাসা। কাঠঠোকরা পাখি বড্ড কাঠখোট্টা! ঠক ঠক করে গাছের ডালে তার শক্ত কুঠারের মত ঠোঁট জোড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে কোটর তৈরি করে বটে, কিন্তু তার রূপের বাহার দেখবার মত। হলদে গায়ের রঙ, মাথায় লাল ঝুঁটি। কোটরে ঢোকার একটাই মুখ থাকে ততটুকুই বড় যতটুকু তার নিজের শরীরটা ঢোকার জন্য যথেষ্ট। গাছ ঠুকরে গর্ত করার সময় কাঠের যে চাঁচি ও গুঁড়ো বেরোয়, সেগুলো বাসার মধ্যে বিছিয়ে বিছানা পেতে দেয়। যাতে বৃষ্টির জল বাসায় না ঢুকতে পারে, তার জন্য বাসায় ঢোকার পথটা করে আনুভূমিক (হরিজোন্টাল), আর বাসার ভিতরে ডিম ও পরে বাচ্চা রাখবার গর্তটা উল্লম্ব ভাবে (ভার্টিকাল) তৈরি করে, যাতে শত্রু সহজে নাগাল না পায়।

শত্রুর কবল থেকে বাঁচবার আরও কত বুদ্ধিই না বের করে পাখি বাবা-মায়েরা। ছোট্ট ছানাগুলো যে মল-মূত্র ত্যাগ করে, বাবা পাখি সেগুলো খুব সাবধানে লুকিয়ে বাইরে ফেলে আসে, কিম্বা নিজেই খেয়ে ফেলে। কারণ বাইরে সেসব পড়ে থাকতে দেখলেই সাপ-গিরগিটি, গেছো ইঁদুর, কাঠবিড়ালী সবাই খবর পেয়ে যাবে যে এই গাছে পাখির কচি ছানারা আছে। মা-বাবা পাখিরা বাছাদের জন্য খাবার আনতে যায় খুব সাবধানে, লুকিয়ে ফুড়ুৎ করে, যেন কেউ না দেখে ফেলে! বাসায় ঢোকেও ততোধিক সাবধানে। বাসার বাইরে একটা লোক-ঠকানো গর্ত মত দেখতে পথ থাকে, সেখান দিয়ে বাসায় ঢোকা যাবে না। বাসায় ঢোকার আসল পথটা পাতা টাতা দিয়ে ঢেকে রাখে। সমস্যা কি একটা? ছানাগুলোর আবার জীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকে। তাই বাসা বানানোর জন্য সাধারণত উগ্র গন্ধওয়ালা গাছের পাতা ও শাখা ব্যবহার করে ঐ যাতে গন্ধে পোকামাকড় কাছে না আসে।       

যে কথা বলছিলাম। এছাড়া আরও নানারকম পাখির বাসা আছে। যেমন-পাটাতন বাসা, বানায় শিকারী পাখি ও বড় জলচর পাখিরা। এগুলো বাটি-বাসার ঠিক উল্টো। গাছের বড় ডালে পাটাতনের মত চ্যাটালো বড় বাসা তৈরি করে সেখানা বছরের পর বছর ব্যবহার করে, কেবল প্রতি বছর নতুন ঘাস-পাতা বিছিয়ে দেয়। টালির চাল কিম্বা খড়ের ছাউনি দেওয়া গ্রামের বাড়িতেও প্রতি বছর নতুন খড় দিয়ে চাল ছাইতে হয়, কিম্বা টালি পাল্টাতে হয়, এও ঠিক তেমন। হেরন, ঈগল, বাজপাখি, শকুন, হাড়গিলে এদের এইরকম পাটাতন বাসা।

আবার আছে গোলক/গম্বুজ বাসা। গোল গোলকের মত বা গম্বুজের মত বাসাও বানায় আমেরিকার ডিপার, বিভিন্ন মেডো লার্ক, মার্শ রেন প্রভৃতি জাতের পাখিরা। এই বাসাগুলো মাটির উপর বানায়, তাই যাতে বাসায় জল ঢুকতে না পারে, তার জন্য নিচের দিক থেকে ঢোকার পথ না করে সেটা বানায় পাশের দিকে। এই বাসাগুলো খুব শক্ত করে বানায়। তবুও মাটিতে থাকার জন্য শত্রু আক্রমণের ভয় থাকে। তাই শত্রুর চোখে ধুলো দিতে নানা কায়দায় এরা বাসাকে ঢেকে রাখে।

মাছরাঙা, মৌমাছিভূক (বি-ইটার), গাঙশালিক, কাদাখোঁচা প্রভৃতি পাখি মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। সাধারণত নদীর খাড়া পাড়ের মাটিতে ১৪-১৮ ইঞ্চি গর্ত খুঁড়ে এরা এই গর্ত-বাসা তৈরি করে। অন্য প্রাণির প্রবেশ রোধ করতে বাসায় ঢোকার মুখটা খুব সরু আর ছোট হয়। কিন্তু বাসার ভিতরে ডিম ও ছানার লালনপালনের জন্য মা-পাখির হাত-পা ছড়িয়ে বসার মত বেশ প্রশস্ত জায়গা থাকে। মরুভূমির এক জাতের পেঁচাও সমতলে বালির মধ্যে গভীর গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়।

ভাসমান বাসা ভারি মজার। জলের উপর কলমি, শাপলা, পদ্মফুল বা কোন জলজ উদ্ভিদের ঝোপে লতাপাতা, বাঁশ বা কচুরিপানার শিকড়, জলজ ঘাস, পাটের আঁশ ইত্যাদি দিয়ে বাসা বানায় হাঁস জাতীয় কিছু জলচর পাখি। জলের স্রোতের টানে কলমী বা কচুরিপানা যখন ভেসে যায়, ডিম ও ছানাপোনা শুদ্ধ বাসার মালিক মা-পাখিও ভাসতে ভাসতে চলে। কি মজার, তাই না? খাট নেই, টেবিল-চেয়ার নেই, গ্যাস-ওভেন, ফ্রিজ, টিভি এসব আসবাবপত্রের কোনই বালাই নেই। শুধু মা আর তার ছানারা স্রোতের ঢেউয়ে নাচতে নাচতে অজানা দেশে ভেসে চলেছে—ভাবতেই রোমাঞ্চ হয়!  

এ তো গেল বাসার নানা গড়ন ও ধরন। বাসার উপকরণেও আছে আশ্চর্য হওয়ার পালা।

থুথু-র বাসা—সুইফট জাতের পাখি, ভারতে এদের তালচোঁচ শ্রেণিতে ফেলা হয়, নিজেদের থুথু (লালা) দিয়ে বাসা তৈরি করে। এদের যখন বছর চারেক বয়স হয়, তখন বাসা তৈরির ক্ষমতা হয়। বাবা ও মা পাখি দুজনে মিলেই বাসা তৈরি করে, ডানায় করে যা বয়ে আনতে পারে, তাই দিয়েই, সে খড়কুটো, কাগজ, পালক যাই হোক। তারপর তাদের মুখ থেকে লালা বের  করে সেসব জুড়ে দেয়। বাসা খুব শক্ত হয় আর একই বাসা বছরের পর এরা ব্যবহার করে। মা পাখি মোট ২ থেকে ৩ টি ডিম পাড়ে, প্রতিদিন ১টা করে ২/৩ দিন অন্তর ডিম পাড়ে ও প্রথম পাড়া ডিমে তা দেয় প্রথমে, এইভাবে ১৯/২০ দিন ধরে সব ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায়। পুরনো উঁচু দালানের ছাদের বা মন্দির ও গির্জার ছাদের ছাঁচতলায় (ছাদের উপরে নয়, ভিতরের দিকের গায়ে) এরা বাসা বানায় যাতে করে বাসার দ্বার থেকে সহজেই বর্জ্যপদার্থ ত্যাগ করতে পারে। ডিম ফুটে ছানা বেরিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত বাবা-মা একসঙ্গে থাকে, তারপর যে যার মত উড়ে চলে যায়। কিন্তু এরা জুটি বাঁধে সারাজীবনের জন্য। প্রত্যেক বছর বসন্তকালে, আবার যখন ডিম পাড়ার ঋতু আসে, ঠিক ফিরে আসে পুরনো বাসার কাছে আর পুরনো সাথীর খোঁজ করে। তখন বাসার কাছে গিয়ে ডানা দিয়ে বাসায় ঢোকার পথের ধুলো ঝাড়ে আর মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে থাকে। যদি জুটির একজনা আগেভাগেই এসে বাসায় বসে থাকে, সে সাড়া দেয়। আর কোন অচেনা আগন্তুক পাখি এসে যদি বাসার দখল নেয়, তবে বাসার প্রাক্তন মালিক দেওয়ালের গায়ে পা আঁকড়ে বসে চিৎকার চেঁচামেচি করে, লড়াই করে তাকে তাড়ায়। এদের এক অদ্ভুত ক্ষমতা, খুব খারাপ আবহাওয়ায় কিম্বা খাবারদাবার না পাওয়া গেলেও এরা অনেকদিন টিকে থাকতে পারে। এমনকি যদি কোনও কারণে বাবা-মা বাসায় ফিরতে না পারে, এদের ডিমগুলোও নিজেদের বেড়ে ওঠার ক্রিয়া ধীর করে দেয়। অন্য পাখির ডিম এসব ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যায়। যখন আবহাওয়া খারাপ থাকে, ডিম ফুটে বাইরে আসার জন্য পরিবেশ অনুকূল না থাকে, সেসময় ছানারা ডিম ফুটে বের হওয়ার সময় চার-পাঁচ দিন পিছিয়েও দেয়।

সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এই থুথু দিয়ে তৈরি বাসার প্রবল বানিজ্যিক চাহিদা। বিশেষ করে চীন দেশে এবং ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনস এইসমস্ত দেশে এই পাখির বাসার স্যুপ এক জনপ্রিয় খাবার। চীন দেশে এই ডিশের নাম ‘ইয়ানো’, যার মানে হল সোয়ালোস নেস্ট (সোয়ালো=সুইফট)। ইন্দোনেশিয়ায় এই পদ ‘সারাং বুরুং ওয়ালেট’ নামে পরিবেশন করা হয়, তার মানেও পাখির বাসার স্যুপ। চীনাদের বিশ্বাস, এই স্যুপ বেশী তেল-মশলা না দিয়ে প্রায় যেমনটি আছে তেমনটি খেতে পারলে তা শরীরের পক্ষে খুব উপকারী। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়ও দেখা গেছে এগুলো ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন ও ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি প্রয়োজনীয় মিনারেল-এ ঠাসা। দুই জাতের সুইফট পাখির তৈরি বাসা পাওয়া যায়, সাদা ও লাল। দুটোই উপকারী, তবে লাল বাসার চাহিদা আরও বেশী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া সব থেকে বেশী থুথুর বাসা বিশ্বে রপ্তানী করে, বছরে প্রায় ২০০০ টন। মালয়েশিয়ার স্থান দুই নম্বরে, বছরে ৬০০ টন এবং তৃতীয় থাইল্যান্ড, বছরে ৪০০ টন। এক কিলো সাদা বাসার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ২০০০ আমেরিকান ডলার এবং এক কিলো লালা বাসা ১০,০০০ আমেরিকান ডলার। হংকং ও আমেরিকার রেস্তোরাঁয় এক বাটি বার্ড নেস্ট স্যুপের দাম প্রায় ৩০ ডলার থেকে শুরু করে ১০০ ডলার পর্যন্ত। এই সমস্ত দেশে সুইফট পাখিদের বাসার চাষ করা হয় বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টে।

যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন

চড়াই-এর মত ছোটখাট নীল ঠোঁটের পাখি সোশাল ওয়েভার, কিন্তু দিলটা তার খুব উদার। তার বাসা যেন শরণার্থী শিবির! দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে ও নামিবিয়ায় এদের দেখা মেলে। পাখিটি ছোট্ট, কিন্তু বাসা তাদের বিরাট একটা অ্যাপার্টমেন্টের মত! কারণ কেবল নিজের থাকার কথা ভেবে এরা বাসা বানায় না। পরের প্রজন্মের কথাও ভাবে। যে গাছে এরা বাসা বাঁধে, সেই গাছটা যেন বাসার ভারে পড়ো পড়ো দশা হয়। এক একটা বাসায় প্রায় ১০০-র বেশী পাখি সারা বছর বাস করে। কিন্তু এতে প্রায় ৫০০ পাখির থাকার জায়গা অনায়াসে হয়। বাসাগুলো এমন টেঁকসই যে অনেক বাসা ১০০ বছরের বেশী স্থায়ী হয়!

সাজানো বাসা— পাখির বাসা নিয়ে মজার মজার কথার আর শেষ নেই। আরেক সৌখিন পাখি তার বাসা সাজানোর কায়দায় তাক লাগিয়ে দেয়। এদের নাম বোয়ার বার্ড, বাংলায় বলে কুঞ্জ পাখি। নামটি যথার্থ। রাধা-কৃষ্ণের মিলনের জন্য রাধার সখীরা দ্বাপর যুগে বৃন্দাবনে কুঞ্জবনে কুঞ্জ সাজাত। পুরুষ কুঞ্জ পাখি সঙ্গিনীকে আকৃষ্ট করার জন্য তেমন যত্ন নিয়েই বাসাটি সাজায়। পুরুষ পাখি লম্বা লম্বা সরু নরম গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে ইংরাজি ‘ইউ’ অক্ষরের মত কুঞ্জ বানায়। রঙিন কাঁচ, পুঁতি, প্ল্যাস্টিকের টুকরো, নুড়ি-পাথর, মার্বল, রঙিন পাতা, পালক ও রকমারি ফল ও ফুল তারা বিছিয়ে রাখে কুঞ্জের প্রবেশদ্বারের বাইরে, যাতে পথচলতি পাখিনী আকৃষ্ট হয়ে হাজির হয়ে যায় কুঞ্জে! রেষারেষির খাতিরে অন্য পাখির বাসা থেকে এমনকি প্রতিবেশী মানুষের বাড়ি থেকেও ঘর সাজাবার উপকরণ চুরি করে আনে। ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমে নিউ-গিনি উপকূলের জলবেষ্টিত উপদ্বীপের বাসিন্দা কুঞ্জ পাখির শঙ্কু আকৃতির বাসা প্রায় এক মিটার পর্যন্ত উঁচু ও দেড় মিটার ব্যাসযুক্ত হয়। বাসার বাইরে এ প্রিয়ার আসার পথে বিছিয়ে রাখে বহু রংবেরঙের ফুল! কুঞ্জ পাখিদের আরেক জাত নীল রং এতই ভালোবাসে যে নীল রঙের যা কিছু পায়, নীল কাঁচের টুকরো থেকে শুরু করে নীল রঙের পেন পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়ে উঠোন সাজায়। বার্ড ওয়াচাররা (পাখি পর্যবেক্ষক) কুঞ্জ পাখির বাসায় নীল রঙের চশমা, নীল রঙের চাবির রিং এইসবও খুঁজে পেয়েছেন! আবার এদের কোন কোনও প্রজাতি নিজেদের নীল অথবা সবুজ রঙের লালা দিয়ে পাতার উপর নক্সা এঁকে সেই পাতা সাজিয়ে রাখে কুঞ্জের সামনে! রীতিমতো আর্টিস্টিক ব্যাপার-স্যাপার!

যে পাখি প্রেমিকার জন্য এমন করে ঘর সাজায়, প্রেম নিবেদনের ‘স্টাইল’-ও তার দেখার মত! অস্ট্রেলিয়ার কুইনস ল্যান্ডে এক জাতের কুঞ্জ-পাখি তার প্রেমিকার সামনে লেজের পালক তুলে ধরে পিছন দেখিয়ে নাচতে থাকে, তখন তার ঠোঁটে ধরা থাকে সত্যিকারের একটা প্ল্যাস্টিকের লাল-টুপি!

এদের পুরুষ পাখি ঝলমলে রঙিন। সেই তুলনায় মেয়ে পাখিরা একটু কম রঙচঙে। পুরুষ স্যাটিন বোয়ার বার্ড তার বান্ধবীর সামনে এসে কেবল দাঁড়িয়ে থাকে, ভাবখানা এমন, ‘দেখো, কেমন সুন্দর আমার গায়ের রঙ’—মেয়েটা ওকে তখন চুপ করে কেবল দেখতে থাকে। পছন্দ হয়ে গেলে দুজনে কুঞ্জে প্রবেশ করে।

আবার আগুন রাঙা কুঞ্জ পাখি (orange flame bowerbird) নাচতে নাচতে সঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ তুলে গানও গায় আর তার সঙ্গে চোখের তারা ছোটবড় করে ঈশারাও করতে থাকে! কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়, পাখি বলে কি মানুষ নয়!

তবে মানুষের মধ্যে যেমন অনেকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার করে, আবার অনেকে এলোমেলো ভাবে থাকে, সেইরকম, পাখিদের মধ্যেও সবাই যে সুন্দর বাসা বানাতে পারে, তাতো নয়! অনেক পাখির বাসায় কোনই শিল্প নেই, একটা যেমন-তেমন করে বানানো, যেমন চিল, শকুন, বক, হাড়গিলে, পানকৌড়ির বাসা। আবার মুরগী, তিতির, পেরু এরা বাসা তৈরি করে না, মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে ডিম পাড়ে আর নিজেরা গাছের আড়ালে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে চারদিকে নজর রাখে। দোয়েল পাখি আবার দস্যুগিরিতে ওস্তাদ। কাঠঠোকরা, টিয়া, বসন্তবৌরি ইত্যাদি পাখিদের তৈরি বাসা এরা জোর করে দখল করে। দখলের সুবিধা না হলে নিজেরাও বাসা বানায়, তবে বোকার মত মানুষ বা অন্য প্রাণির নাগালের মধ্যেই—যেমন-সুপারি গাছের গর্তে, বাঁশের মাথার গর্তে, দালানের ফাঁকে-ফোঁকরে, ফেলে দেওয়া ভাঙা হাঁড়িকলসির মধ্যে। আর ফাঁকিবাজ কোকিল মহাশয়ের তো কথাই নেই। পুরুষ কোকিল সমস্ত বসন্ত ঋতু গান গেয়ে যায়, আর মেয়ে কোকিল চুপি চুপি কাকের বাসায় গিয়ে ডিম পেড়ে আসে। কাক-মা নিজের ডিমের সঙ্গে না জেনেই কোকিলের ডিমেও তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায়। তারপর একটু বড় হতেই ছানা যখন ‘কা কা’ না বলে ‘কু কু’ বলে, তখন কোকিলের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যায়, কাক-মা বলে, ‘মিস্টেক, মিস্টেক!’   

এমনই আছে আরো হাজার গল্প– পাখির ঘুমের গল্প, গান গাওয়ার গল্প, এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি দেওয়ার রোমাঞ্চকর গল্প। ধীরে ধীরে বলব সব।

বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s