চিনতে আমায় পারো?
সুমনা সাহা
খোকা বলে, ‘মা! আমি যদি দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি, তখন তুমি আমার কাছে হারো! তখন কি আর চিনতে আমায় পারো?’ ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় রবি ঠাকুর এমন করে ছোটো ছেলের মনের সাধ লিখেছেন। জীবজন্তুর জগতে এমন লুকোচুরি কত যে আছে তা গুনে শেষ করা যায় না। তবে এমন কিন্তু তারা সাধ করে সাজে না। শত্তুরের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যেই তাদের হরেকরকম সাজ। শত্রুর চোখে ধুলো দেবার জন্য এরা কতরকমের ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয়, দেখে অবাক হতে হয়! কখনও এরা রৌদ্রছায়ার আলো-আঁধারির আড়াল অবলম্বন করে, কখনও নিজেদের গায়ের রং মিলিয়ে দেয় পরিবেশের সঙ্গে, কখনও বা কাঠবিড়ালি পড়ে নেয় সাপের পরিত্যক্ত খোলস! মুখোশ পরে ভয় দেখানো যাকে বলে আর কী! একে ইংরাজিতে বলে ‘ক্যামোফ্লেজ’, যার খুব একটা ভালো বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। অভিধানে পাই (রণে) আত্মগোপনের কৌশল। সত্যি, রণক্ষেত্রের সৈনিকরা প্রাণীজগৎ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শত্রুর চোখে ধুলো দেওয়ার কিছু কিছু কৌশল গ্রহণও করেছে। ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলস ক্যামো ল্যাব-এর প্রাণীবিদ্যা বিশারদ (জুলজিস্ট) জোয়ানা হল (Joanna Hall) বলেন, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের উপর নির্ভর করে পশুপাখিদের এই ক্যামোফ্লেজের স্ট্র্যাটেজি অর্থাৎ রণকৌশল নানাধরনের হতে পারে।
‘ক্যামোফ্লেজ’ মূলত চাররকমের হয়। নিজেকে লুকিয়ে ফেলা (concealing), চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া (disruptive), ছদ্মবেশ ধারণ করা (disguising), অথবা অন্যকে নকল করা (mimicry)। আত্মরক্ষার স্বার্থে এছাড়াও আরও কতরকমভাবে যে প্রাণীরা কৌশল করে, তার ঠিক ঠিকানা নেই। বরফের দেশের প্রাণীদের গায়ের লোম বরফের মতো সাদা হয় পরিবেশের সঙ্গে মিশে লুকিয়ে থাকবার জন্য। যেমন আমরা মেরু ভল্লুক (polar bear) বা স্নো-আউলের (snow owl) কথা জানি। আবার মরুভূমিতে বালির রংয়ে রং মিলিয়ে অনেক প্রাণীর গায়ের রং হয় তামাটে। ঘাস ফড়িং ও শুঁয়োপোকার গায়ের রং সবুজ ঘাস বা পাতার মতো হয়।
অনেক সময় পরিবেশের সঙ্গে রংয়ে রং না মিলিয়ে প্রাণীদের গায়ের রং হয় একেবারে বিপরীত, উজ্জ্বল স্ট্রাইপ বা স্পটে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ‘contra sting’। যেমন, জেব্রা, চিতাবাঘ ইত্যদি। এইভাবে এরা নিজেদের গায়ের ‘outline’ ভেঙে দেয়। পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাওয়া যেমন একটি নির্দিষ্ট স্থানে লুকিয়ে থাকার পক্ষে সুবিধাজনক, কিন্তু এই ক্ষেত্রে সুবিধাটা হল, এরা বিভিন্ন পরিবেশে দূরে দূরে ভ্রমণ করতে পারে। অক্টোপাস ও ঐ একই ধরনের প্রজাতির প্রাণী, যেমন, স্কুইড, কাটল ফিশ—এরা এদের শরীরের ক্রোমাটোফোর পিগমেন্ট প্রস্তুতকারক এক বিশেষ ধরনের পেশীর নিয়ন্ত্রণ করে পিগমেন্টের আকার পরিবর্তন করতে পারে এবং এইভাবে জলের নিচের বিভিন্ন স্তরে স্তরে প্রয়োজন অনুসারে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ রকমের রংবদল করে থাকে। যখন যে রং দরকার, গায়ের সেইরকম রং তৈরি করে ফেলে।
যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকরা এদের কৌশল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন নতুন ‘ক্যামোফ্লেজ’-এর ধারণা পাচ্ছে।
কাউন্টার শেডের আরেকটা কৌশল আছে প্রাণীদের মধ্যে। যখন সূর্যের আলো পড়ে ওদের শরীরে, তখন উপর থেকে চকচকে দেখায়, আর নিচে থেকে দেখলে ঝাপসা (dull/fade) দেখতে লাগে। যেমন কয়েক জাতের শার্ক (হাঙর) ও উঁচুতে ওড়ে চিল জাতীয় যে সমস্ত পাখি—ওদের পিঠের দিকটা হয় গাঢ় রংয়ের আর পেটের দিকটা সাদা বা হালকা রংয়ের। এইভাবে আলোছায়ার খেলা খেলে বলে পাশ থেকে দেখলে ওদের একদম অদৃশ্য মনে হয়। উপর থেকে দেখলে নিচে জল বা মাটির গাঢ় রংয়ের সঙ্গে মিশে যায় আর নিচ থেকে দেখলে জলের উপর তল বা আকাশের সঙ্গে রং মিলিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
অনেক প্রাণী আবার পরিবেশের রংয়ে রং মিলিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তারা যা নয়, তাই সাজার ভান করে, কেউ বা সাজে গাছের পাতা, কেউ বা শুকনো ডাল। টনি ফ্রগ মাউথ নামে অস্ট্রেলিয়ার এক পাখি আছে, সে বিপদে পড়লে এমনভাবে ওর পালকগুলোকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে ফেলে—দেখে মনে হয় ঠিক যেন গাছের একটা ভাঙা ডাল! অনেকের আবার মাথার পিছনে থাকে চোখের মতো দুটি বড়ো বড়ো ছোপ—ভাবখানা এমন যেন পিছন দিক থেকে আক্রমণ করতে এলে শত্রু প্রাণীকে এই বলে বোকা বানানো, ‘এই যে! আমি কিন্তু সব দেখতে পাচ্ছি! আমার পিছনেও চোখ আছে, জানো না?’
কোনও কোনও প্রাণী রূপ বদলে চোখের ধোঁকা দেওয়ায় ভরসা রাখতে পারে না। তারা শত্রুকে সত্যিকারের ভয় দেখানোর জন্য অন্য ভয়ংকর প্রাণীর গন্ধ চুরি করে। এক প্রজাতির কাঠবিড়ালি নিজেকে বাঁচানোর জন্য বিষাক্ত ঝুমঝুমি সাপের (rattle snake) পরিত্যক্ত খোলস চিবিয়ে নিজের গায়ে জিভ দিয়ে চেটে চেটে ঐ গন্ধ মেখে নেয়।
সবচেয়ে বড়ো কথা, ‘ক্যামোফ্লেজ’ ব্যাপারটা নির্ভর করছে অপর পক্ষের দেখার উপরে। অনেক পশুর তুলনায় মানুষ বেশি রং দেখতে পায়। সুতরাং, আমাদের চোখে যেটা লাল বা কমলা জাতীয় উজ্জ্বল রং বলে মনে হচ্ছে, হয়তো ঐ পশুর শত্রুর ক্ষেত্রে সেটা হালকা সবুজ রং দেখাচ্ছে। আবার পাখিরা মানুষের থেকে অনেক বেশি রঙ দেখতে পায়। আমাদের কাছে যেটা নিতান্তই ম্যাড়ম্যাড়ে রঙ, পাখিরা হয়তো সেটাকে খুব উজ্জ্বল দেখতে পায়। সবচেয়ে মজার ধোঁকা হল যখন শুঁয়োপোকার মুণ্ডু হয় সাপ বা বাঘের মাথা!
শোলে সিনেমার সেই কমেডি চরিত্র আসরানিকে মনে পড়ে? ‘হম আংরেজ কি জমানে কি জেলার হ্যায়, হা হা’—চোটপাটের চোটে অস্থির, আসলে ভিতুর ডিম। এ যেন তাই।
দুর্দান্ত
LikeLiked by 1 person