কিশোর ঘোষাল এর সমস্ত লেখা একত্রে
এই লেখার আগের পর্ব এই লিঙ্কে
কিশোর ঘোষাল
তৃতীয় পর্ব
অত্যাধুনিক ঘড়ি বলতে আমরা বুঝি কোয়ার্জ্ ঘড়ি। এই ঘড়িতে একটি বৈদ্যুতিন দোলক ব্যবহার করা হয়, যেটিকে নিয়ন্ত্রণ করে কোয়ার্জ্ ক্রিস্ট্যাল সময়ের সূক্ষ্ম হিসেব করে। বিশ্বের প্রথম কোয়ার্জ্ ঘড়িটি ১৯২৭ সালে বানিয়েছিলেন বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিজের Warren Marrison এবং J. W. Horton। যদিও বিশ্বের প্রথম কোয়ার্জ হাতঘড়িটি বানিয়েছিল সিকো কোম্পানি ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে, তাদের সেই মডেলটির নাম ছিল অ্যাসট্রন। তারপর মোটামুটি ১৯৮০ সাল থেকে সবধরনের ঘড়ি – বড়, ছোট, হাত ঘড়ি, এমন কি কম্পিউটার – এক কথায় যে যে যন্ত্রে ঘড়ি ব্যবহার করা হয় সব ঘড়িতেই এই কোয়ার্জ্ ক্রিস্ট্যাল পদ্ধতি কাজে লাগানো শুরু হয়ে গেল। তার কারণ এই পদ্ধতি দিয়ে সময় পরিমাপের ভুল অত্যন্ত কম, প্রত্যেকদিন দম দেওয়ার ঝামেলা এবং অন্যান্য নিয়মিত মেরামতির ঝক্কি নেই এবং যান্ত্রিক ঘড়ির তুলনায় দামও বেশ কম।
কোয়ার্জ্ ঘড়ির অন্দর মহলে ঢোকার আগে কোয়ার্জ্ জিনিসটা কী, সেটা একটু জেনে নেওয়া যাক। কোয়ার্জ্ হল একটি খনিজ যৌগ যার রাসায়নিক নাম সিলিকন ডায়ক্সাইড (SiO2)। প্রকৃতিতে এই খনিজটির অফুরন্ত ভাণ্ডার বললেও কম বলা হয়। প্রায় সব ধরনের বালি এবং পাথরের মধ্যে এই কোয়ার্জ্ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। অনেক সময় অনেকগুলি কোয়ার্জের যৌগ একত্র হয়ে সিলিকন-অক্সিজেন টেট্রাহেড্রা (SiO4) কেলাস বা ক্রিস্ট্যাল হিসেবেও প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি কম্পিউটার এবং সকল ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে ব্যবহৃত চিপ এবং মাইক্রোচিপ বানানো হয় এই সিলিকন মৌল থেকেই।
কোয়ার্জের যে অনুপম গুণের জন্যে এটি আধুনিক বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে, সেই গুণটি হল এটির পিজোইলেক্ট্রিক (piezoelectric) ধর্ম। কোয়ার্জ্ ক্রিষ্ট্যালের ওপর যদি প্রচণ্ড চাপ (stress) দেওয়া হয়, তাহলে কোয়ার্জ ক্রিস্ট্যালের মধ্যে খুব মৃদু ভোল্টেজের বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। আবার উল্টোদিকে কোয়ার্জ্ ক্রিস্ট্যালের মধ্যে যদি খুব সামান্য ভোল্টেজের বিদ্যুতের প্রবাহ পাঠানো যায়, ক্রিস্ট্যালের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট হিসেবের দোলন (Oscillation) বা কম্পন (vibration) লক্ষ করা যায়। খুব সহজ কথায় বললে কোয়ার্জের এই আশ্চর্য গুণটিকেই পিজোইলেকট্রিক ধর্ম বলে।
কোয়ার্জ ক্রিস্ট্যালের এই পিজোইলেকট্রিক ধর্মটিকেই পেণ্ডুলামের দোলন (Oscillation) পদ্ধতির বদলে ব্যবহার করা হয়। যে কোন কোয়ার্জ্ ঘড়ির ভেতরে একটি ব্যাটারি থাকে, এই ব্যাটারি থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহ একটি বৈদ্যুতিন বর্তনির (Electronic circuit) মাধ্যমে কোয়ার্জ ক্রিস্ট্যালের মধ্যে সঞ্চার করা হয়। এই বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে কোয়ার্জ ক্রিস্ট্যালটি সামনে – পিছনে দুলতে থাকে বা কাঁপতে থাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই কম্পনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে, প্রতি সেকেণ্ডে ৩২৭৬৮ বার – একবার বেশিও নয়, কমও নয়!
বৈদ্যুতিন বর্তনি, কোয়ার্জ ক্রিস্ট্যালের এই কম্পনকে গুণতে থাকে, এবং প্রতি সেকেণ্ডে একটি তড়িতাঘাত (pulse) দিতে থাকে। এই তড়িতাঘাত সরাসরি এলসিডি ডিসপ্লের (LCD Display) পর্দায় সংখ্যা দিয়ে সময় দেখায় অথবা ছোট্ট একটি মোটরের সাহায্যে সেকেণ্ড, মিনিট ও ঘন্টার কাঁটার গিয়ার ঘোরাতে থাকে।
পাশের ছবিতে বিখ্যাত সিকো কোম্পানির কোয়ার্জ ঘড়ির ভেতরের নানান যন্ত্রাংশ দেখতে পাবে, তার মধ্যে প্রধান যন্ত্রাংশের নামগুলি নীচে দেওয়া হলঃ-
১. ব্যাটারি – ছমাস থেকে একবছর কাজ করে।
২. মাইক্রোমোটর – এই মোটরের শ্যাফ্ট্ থেকেই কাঁটার গিয়ারগুলি ঘোরে।
৩. মাইক্রোচিপ – মাইক্রোচিপ কোয়ার্জের কম্পন গোনে এবং তড়িতাঘাত পাঠায়।
৪. বর্তনি – এই বর্তনি মাইক্রোচিপ এবং ঘড়ির অন্যান্য যন্ত্রাংশের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।
৫. কোয়ার্জ ক্রিস্ট্যাল অসিলেটার – বিদ্যুতের প্রবাহে এটি দুলতে বা কাঁপতে থাকে।
৬. ক্রাউন স্ক্রু – এই স্ক্রু ঘুরিয়ে সময় বদল করা যায়।
৭. গিয়ারের সেট – নানান সাইজের গিয়ারের সেট, ঘন্টা, মিনিট, সেকেণ্ডের কাঁটা ঘোরায়, এমনকি দিন এবং মাসের হিসেবও দেখায়।
৮. গিয়ারের শ্যাফট – এই শ্যাফটটি গিয়ারগুলিকে ধরে রাখে।
ওপরের পাঁচ নম্বরে দেখানো কোয়ার্জ্ ক্রিস্ট্যাল অসিলেটারের ধাতব ঢাকনার ভেতরে টিউনিং ফর্কের আকারে কোয়ার্জ্ ক্রিস্ট্যাল রাখা থাকে, বিদ্যুতের প্রভাবে এটিতেই সেকেণ্ডে ৩২৭৬৮ বার কম্পন হয়। হাতের আঙুলের তুলনায় এটির আকার কত ছোট্ট, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।
পেণ্ডুলাম এবং যান্ত্রিক ঘড়ির সমস্যা ছিল, নিয়মিত দম দেওয়া। দম দিতে ভুল হয়ে গেলে ঘড়ি বন্ধ হয়ে যেত। কোয়ার্জ ঘড়ি ব্যাটারিতে চলে, ভালো ব্যাটারি হলে ছমাস থেকে একবছর ঘড়ি নিশ্চিন্তে চলতে থাকে। পেণ্ডুলাম ঘড়ির আরেকটা সমস্যা ছিল, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পেণ্ডুলামের গতিকে অনেকটাই প্রভাবিত করে। সেক্ষেত্রে কলকাতা থেকে কেনা পেণ্ডুলাম ঘড়ি দার্জিলিংয়ে ব্যবহার করলে, সময়ের গণ্ডগোল হত। তার ওপর পেণ্ডুলাম ঘড়ির পেণ্ডুলামের দৈর্ঘ, গ্রীষ্ম অথবা শীতের আবহাওয়ার কারণে কিছুটা বড়-ছোট হয়ে যেত, সে কারণে ঘড়ির সময়েও পার্থক্য হত।
কোয়ার্জ্ ঘড়িতে এই সমস্যার সবগুলিই সমাধান হয়ে গেছে। কিতু তাই বলে এই ঘড়িতেও সারাবছর সর্বদা এবং সর্বত্র নির্ভুল সময় দেবে তাও কিন্তু নয়। কোয়ার্জ ক্রিস্ট্যাল নিখুঁত কাজ করে ২৫০ থেকে ২৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এর থেকে তাপমাত্রা কমবেশি হলে, কোয়ার্জের কম্পাঙ্ক কমে যায়। প্রতি দশ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমবেশিতে, বছরে মোটামুটি ১১০ সেকেণ্ড সময়ের পার্থক্য হয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় বছরে এই সময়টুকুর তারতম্যকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না। তবে এই সমস্যার সমাধানের জন্যে আজকাল কৃত্রিম উপায়ে বিভিন্ন কাজের উপযোগী বিশেষ কোয়ার্জ ক্রিস্ট্যাল বানানো হচ্ছে! সেক্ষেত্রে এই কৃত্রিম কোয়ার্জ্ ক্রিস্ট্যালগুলির, এভারেস্টের চূড়া থেকে মরুভূমি সাহারায় শিহরণ বা কম্পাঙ্ক একই থাকবে!
কৃতজ্ঞতাঃ সিকো ঘড়ি নির্মাতা সংস্থা ও নানান ওয়েবসাইট।
পরিষ্কার হল কিছু জিনিস। লেখাটি বাচ্চা বা কিশোরদের জন্য খুবই উপযুক্ত। অবশ্য আমার মত বুড়োও লাভ করেছে। ধন্যবাদ।
LikeLike