গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের আরো লেখাঃ দেড়শো বছর আগের এক সূর্যগ্রহণের গল্প, স্বর্ণযুগের কাহিনি, কৃষ্ণগহ্বর, ব্যতিক্রমী বিন্দু ও স্টিফেন হকিং , তেজষ্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ ১ম পর্ব, তেজষ্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ ২য় পর্ব হ্যারিয়েট ব্রুক্স্, তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ- ৩য় পর্ব তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ- ৪র্থ পর্ব
(৫)
এর আগের পর্বে আমরা নিউট্রন আবিষ্কারের ইতিহাস শুনেছি। নিউক্লিয়াসের সঙ্গে প্রোটন বা আলফা কণার বিক্রিয়া এতদিন বিজ্ঞানীরা দেখে আসছিলেন। প্রোটন বা আলফার ক্ষেত্রে বিক্রিয়া করানোটা মোটেই সহজ নয়, কারণ তাদের আধান ধনাত্মক। ধনাত্মক আধানের নিউক্লিয়াস তাদের বিকর্ষণ করে, সেই বিকর্ষণ অতিক্রম করতে গেলে প্রচুর শক্তি দরকার। ভারী নিউক্লিয়াসের সঙ্গে আলফা বা প্রোটনের বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ শক্তি সেই সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না। নিউট্রনের কোনও আধান নেই, কাজেই বিকর্ষণের প্রশ্ন নেই। সহজেই তা নিউক্লিয়াসের কাছে যেতে পারবে ও বিক্রিয়া করতে পারবে। ১৯৩৪ সালে ইতালিতে এনরিকো ফের্মি নিউট্রন ও বিভিন্ন মৌলের নিউক্লিয়াসের বিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তিনি দেখলেন যে নিউট্রনের গতিশক্তি কম থাকলে বিক্রিয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমা তৈরির মানহাটান প্রকল্পের উল্লেখ এই লেখাতে আগে এসেছে। বোমা তৈরিতে ব্যবহার হয়েছিল যে নিউক্লিয় বিভাজন বিক্রিয়া, লিজে মাইটনার তার অন্যতম আবিষ্কর্তা, যদিও সেই সম্মান থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। মাইটনারের অবদান ঠিকঠাক বুঝতে চাইলে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশও কিছুটা জানা প্রয়োজন।
লিজে মাইটনার: দ্বিতীয় পর্ব
১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতায় আসেন। তিন মাসের মধ্যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমস্ত জার্মান ইহুদি ও রাজনৈতিক বিরোধীদের বরখাস্ত করা হয়। আইনস্টাইনও ইহুদি হওয়ার কারণে নাৎসি গুণ্ডাদের আক্রমণের নিশানা হলেন। তিনি আমেরিকার চলে যেতে বাধ্য হলেন। ইহুদি মাইটনার তখন বার্লিনের কাইজার উইলহেলম ইন্সটিটিউটের ভিতরে কেমিস্ট্রি ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা, তিনি অস্ট্রিয়ান বলে সেই মুহূর্তে রক্ষা পেয়েছিলেন। তিনিও কিন্তু কোনও প্রতিবাদ না করে পড়াশোনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেন। পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন সে সময় পদত্যাগ না করে তিনি শুধু বোকামি নয়, অন্যায়ও করেছিলেন। পরবর্তীকালে কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ইতিহাস তো সকলেরই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে হিসাব করে দেখা গিয়েছিল যে নাৎসিরা প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদিকে খুন করেছিল।
নাৎসি শাসনের পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ছাত্রসংখ্যা অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে। জার্মানি ও পরবর্তীকালে জার্মানি অধিকৃত ইউরোপ থেকে ইহুদি বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বিজ্ঞানীরা পালাতে বাধ্য হন। তদের অধিকাংশই আমেরিকাতে আশ্রয় খুঁজে পান। এভাবেই বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি ইউরোপ থেকে আমেরিকাতে স্থানান্তরিত হয়। উপরন্তু নাৎসিরা যে শুধু ইহুদি বিদ্বেষী তা নয়, তাদের চোখে মহিলাদের ঘরকন্না আর শিশুর জন্ম দেয়া ছাড়া অন্য কোনও কাজ থাকতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে জার্মানিতে এক ইহুদি মহিলা বিজ্ঞানীর পক্ষে গবেষণাতে মন দেয়া যে কঠিন, তা সন্দেহ নেই। মাইটনারের কৃতিত্ব আরও বেশি যে তিনি এই সময় তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। ইহুদিদের প্রতি জার্মানির নীতির জন্য তিনি সেই কাজের গৌরব থেকে বঞ্চিত হন। ইতিহাসের পরিহাস এই যে তাঁর সেই গবেষণা থেকেই শেষপর্যন্ত পরমাণু বোমার জন্ম। যদি জার্মানির হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকত, পৃথিবীর ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হত। তাই একথা বলাই যায় যে মাইটনার যখন জার্মানি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, জার্মান পরমাণু বোমার সম্ভাবনাকেও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বিভাজন বিক্রিয়া আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। প্রকৃতিতে সবচেয়ে ভারী মৌল হল ইউরেনিয়াম। তার নিউক্লিয়াসে আছে ৯২টা প্রোটন। ইউরেনিয়ামের থেকে ভারী মৌল প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, কিন্তু বিজ্ঞানীরা তাতে সন্তুষ্ট নন। এনরিকো ফের্মি নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামকে আঘাত করলেন। তিনি আশা করেছিলেন নিউট্রন নিউক্লিয়াসে ঢুকে ইউরেনিয়ামের নতুন আইসোটোপ তৈরি করবে। এই আইসোটোপে নিউট্রনের সংখ্যা ইউরেনিয়ামের স্বাভাবিক আইসোটোপের থেকে বেশি, তাই বিটা তেজস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটা নিউট্রন ভেঙে একটা
সত্যিই দুই নতুন মৌল, ফের্মির দেওয়া নামানুসারে যাদের সংকেত Ao এবং Hs, তারা তৈরি হল কি না জানতে ফের্মি রসায়নের সাহায্য নিলেন। কোনও মৌলিক পদার্থের সমস্ত আইসোটোপের রাসায়নিক ধর্ম এক। তাই নিউট্রন দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত ইউরেনিয়ামের নমুনাতে এমন কোনও নতুন রাসায়নিক ধর্ম দেখা যায় যা ইউরেনিয়ামের নয়, তাহলে বুঝতে হবে অন্য কোনও মৌলিক পদার্থ তৈরি হয়েছে। অবশ্য সেই মৌলটা ইউরেনিয়ামের থেকে ভারী নাও হতে পারে। নিউট্রন ইউরেনিয়াম পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ করে তার থেকে প্রোটন একটা আলফা কণাও বের করে দিতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে মৌলটার প্রোটন সংখ্যা হবে ৯১ এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ৯০, যথাক্রমে প্রোট্যাক্টিনিয়াম ও থোরিয়াম মৌলের নিউক্লিয়াস। ফের্মি শুধু এই দুই মৌল নয়, যার প্রোটন সংখ্যা ৮২, সেই সিসা পর্যন্ত সমস্ত মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক ধর্মের জন্য পরীক্ষা করলেন। যখন প্রোটন সংখ্যা ৮২ থেকে ৯২ এমন কোনও মৌলের সঙ্গে নতুন তৈরি মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম মিলল না, ফের্মি নিশ্চিত হলেন যে তিনি ইউরেনিয়ামের থেকে ভারী দুটি নতুন মৌলিক পদার্থ বানাতে সক্ষম হয়েছেন। নেচার পত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ লিখলেন, ‘Possible Production of Elements of Atomic Number Higher than 92’।
আইরিন ও ফ্রেডরিক জোলিও-কুরি প্যারিতে ফের্মির পরীক্ষা দ্বিতীয়বার করে দেখলেন, কিন্তু ফের্মি যা বলেছিলেন তার সঙ্গে তাঁদের ফল মিলল না। কিন্তু তাঁরাও পরীক্ষাতে কী হচ্ছে বুঝতে পারছিলেন না। তাঁরা দেখেছিলেন যে মৌল পাচ্ছেন তার ধর্ম ল্যান্থানামের মতো। ল্যান্থানাম ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক হালকা। ১৯৩৭ সালে কুরিরা ইউরেনিয়াম ও ধীরগতির নিউট্রনের বিক্রিয়া বিষয়ে তাঁদের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করলেও অন্যরা তাকে আমল দেননি। আইরিনরাও কিন্তু বোঝেননি যে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস ভেঙে ল্যান্থানাম তৈরি হচ্ছে। মাইটনারের উৎসাহেই হান ও মাইটনার ইউরেনিয়ামের উপর নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলে যে নতুন পদার্থ তৈরি হয়, তাদের রাসায়নিক ধর্ম নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। তাঁরা ফের্মিকেই সমর্থন করেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে নতুন তৈরি পদার্থের পরিমাণ ছিল নিতান্ত কম। তাই খুব ধীরস্থিরভাবে পরীক্ষা চালানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করার অবকাশ তখন ছিল না। আসন্ন যুদ্ধের দামামা তখন ইউরোপের প্রতি প্রান্তে ধ্বনিত হচ্ছে। ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণ ফের্মি ও তাঁর সহযোগীদের বিচলিত করেছে। অন্যদিকে জার্মানিতে মাইটনারের তখন জীবন সংশয়। ১৯৩৮ সালে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া একসঙ্গে মিশে যায়, ফলে মাইটনারও হয়ে গেলেন জার্মান নাগরিক। ইহুদি বিদ্বেষী আইন থেকে মাইটনারকে আর রক্ষা করা গেল না। অটো হান অনেক চেষ্টা করলেন, বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এমনকি হিটলারের সঙ্গেও দেখা করলেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। মাইটনারের গ্রেপ্তার হওয়া তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, বাধ্য হয়ে তিনি হল্যান্ডে পালিয়ে যান। এক নাৎসি রসায়নবিদ পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিল যে মাইটনার পালিয়ে যাচ্ছেন। বন্ধুরা পুলিশকে দেরি করিয়ে দেন যাতে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারেন। ধরা পড়লে তাঁর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হত হরোভিৎজের মতোই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যু।
মাইটনারের জীবনে সে এক কঠিন সময়। সারাজীবনে তিনি বিজ্ঞান ছাড়া কিছু বোঝেননি। সংসার করার কথাও মনে করেননি। ষাট বছর বয়সে তিনি দেখলেন যে পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের একজন হলে কী হবে, কোনও গবেষণাগারে তাঁর জায়গা নেই। শেষপর্যন্ত সুইডেনের নোবেল ইন্সটিটিউটে কাজ করার সুযোগ তাঁর হল। এই সময় তাঁর সঙ্গে নিলস বোরের যোগাযোগ ছিল। বোর ছিলেন অপর এক দিকপাল পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি পরমাণুর গঠনে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রথম প্রয়োগ করেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যার বিকাশে তাঁর বিরাট অবদান আছে। হান সুইডেনে গোপনে মাইটনারের সঙ্গে দেখা করেন। চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাঁরা গবেষণা চালিয়ে যান।
১৯৩৮ সালের একেবারে শেষে হান ও তাঁর সহযোগী ফ্রানজ স্ট্রাসম্যান নিশ্চিত হলেন যে ইউরেনিয়ামকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলে বেরিয়াম ও ক্রিপটন তৈরি হচ্ছে। ক্রিপটন ও বেরিয়ামের নিউক্লিয়াসে যথাক্রমে ৩৬টি ও ৫৬টি প্রোটন আছে, অর্থাৎ ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস দু’টুকরো হয়ে যাচ্ছে। এমন সম্ভাবনার কথা ১৯৩৪ সালেই বলেছিলেন অপর এক মহিলা বিজ্ঞানী ইডা টাকে নড্যাক, কিন্তু সেকথায় কেউ কান দেননি। কারণ পরীক্ষাতে ব্যবহৃত ধীরগতির নিউট্রনের গতিশক্তি ছিল এক ইলেকট্রন ভোল্টেরও কম। ফের্মি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে দশ লক্ষ ইলেকট্রন ভোল্টের থেকেও অনেক বেশি শক্তির আলফা কণা বা প্রোটন নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে পারছে না, কিন্তু ধীরগতির নিউট্রন নিউক্লিয়াসকে টুকরো করে দেবে। ইডা একথাও বলেছিলেন যে ফের্মির পদ্ধতি ভুল। ফের্মি কোন মৌল নেই পরীক্ষা করে দেখছেন, তাঁর উচিত হল কোন মৌল আছে তা দেখা। কিন্তু ইডা তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না, তাই তাঁর মন্তব্য গুরুত্ব পায়নি। হানরা যে বিক্রিয়া দেখেছিলেন, তা এইরকমভাবে লেখা যায়।
তবে মনে রেখো ইউরেনিয়াম ভাঙার এটাই একমাত্র পথ নয়, বেরিয়াম ও ক্রিপটনের কাছাকাছি পরমাণু সংখ্যার অন্য মৌলও হতে পারে। নিউট্রন তিনটে বেরোতেও পারে।
নিউক্লিয় বিজ্ঞানীদের কেউ যদি ইডা নড্যাকের কথাকে গুরুত্ব দিতেন, তাহলে হয়তো চার বছর আগেই নিউক্লিয় বিভাজন বিক্রিয়া আবিষ্কার হত। রসায়নে তাঁর দখল নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। তাঁর সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে কিছু কথা বলে নিই। ইডা টাকের জন্ম জার্মানিতে। বার্লিন টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে তিনি রসায়ন ও ধাতু ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯২৫ সালে বার্লিনে ওয়াল্টার নড্যাক, ইডা টাকে ও অটো বার্গ প্লাটিনামের আকরিক ও কলম্বাইট নামের এক খনিজের মধ্যে নতুন এক মৌল আবিষ্কার করেছিলেন। রাইন নদীর নামে তাঁরা তার নাম দিয়েছিলেন রেনিয়াম। তেজস্ক্রিয় নয় এমন মৌলদের মধ্যে রেনিয়ামই শেষে আবিষ্কার হয়েছিল। পরের বছর ওয়াল্টার ও ইডা বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। কিন্তু ১৯৩৪ সালে নাৎসি আইনে জার্মানিতে বিবাহিত মহিলাদের চাকরি করার অধিকার ছিল না। ফলে ইডাকে বিনা পয়সায় কাজ করতে হত। মহিলা বলে ও বিনা মাইনেতে কাজ করার জন্য তাঁর প্রতি একটা তাচ্ছিল্যের ভাব অন্য বিজ্ঞানীদের মনে ছিল। তাঁর মতামত পরীক্ষা করে দেখার কথা তাঁদের মনে আসেনি।
1938 সালে নিউট্রন বিক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার এবং ধীরগতির নিউট্রনের সাহায্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া আবিষ্কারের স্বীকৃতিতে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ফের্মিকে। তিনি যখন নোবেল পুরস্কার আনতে যান, তখনই তিনি জানতেন নতুন মৌলিক পদার্থ বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত খুব সম্ভবত ভুল। তিনি পরে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে নোবেল কমিটি ভুল করেছে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন পুরস্কারটা তাঁর প্রাপ্য ছিল। সেকথা অবশ্য ঠিক। ফের্মি সম্ভবত শেষ পদার্থবিজ্ঞানী যিনি তত্ত্বীয় ও পরীক্ষামূলক দুই ক্ষেত্রেই অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ১৯৩৮ সালের আগেই তিনি বিটা তেজস্ক্রিয়ার তত্ত্ব দিয়েছেন। ইংরেজ বিজ্ঞানী পল ডিরাকের সঙ্গে মিলে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন বা নিউট্রিনোর মতো কণারা যে পরিসংখ্যান মেনে চলে তা আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের সম্মানে আমরা একে বলি ফের্মি ডিরাক সংখ্যায়ন। যে কণারা তা মেনে চলে তাদের বলে ফের্মিয়ন। মহাবিশ্বের সমস্ত মৌলিক কণা হয় ফের্মিয়ন, নয় বোসন। ফের্মির অবশ্য পুরস্কার নিতে স্টকহোমে যাওয়ার অন্য প্রয়োজন ছিল। ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি হিটলারের কথামতো ইহুদি বিরোধী আইন চালু করেছিলেন। ফের্মির স্ত্রী লরা ছিলেন ইহুদি। নোবেল পুরস্কার নেওয়ার জন্য ফের্মিকে পরিবারসহ দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। পুরস্কার নেওয়ার পরে ফের্মি পরিবারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। ফের্মিই পরে প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বানিয়েছিলেন। প্রথম পরমাণু বোমা প্রকল্পেও ফের্মির বিশেষ ভূমিকা ছিল।
ইউরেনিয়ামের থেকে ভারী মৌল প্রথম তৈরি হয়েছিল কিন্তু ফের্মির পদ্ধতিতেই। আমেরিকার বার্কলে ল্যাবরেটরিতে এডুইন ম্যাকমিলান ও ফিলিপ আবেলসন ১৯৪০ সালে92U239 -এর বিটা ক্ষয় থেকে ৯৩ প্রোটন সংখ্যা বিশিষ্ট মৌলটিকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইউরেনিয়ামের থেকে ভারী বলে তাঁরা গ্রহের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে এর নাম দেন নেপচুনিয়াম (Np)। ফের্মিও একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, কিন্তু নেপচুনিয়াম খুব কম তৈরি হয়েছিল বলে তাকে খুঁজে পাননি।
হান ও স্ট্রাসম্যান বুঝেছিলেন যে এক বিরাট আবিষ্কার তাঁরা করেছেন, তাই তাড়াতাড়ি করে তা প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কেমন করে নিউট্রন ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে টুকরো করে দেয় তা তাঁরা বুঝতে পারেননি। তাঁদের প্রাক্তন সহযোগী মাইটনার ইহুদি, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা জার্মানিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু যদি কেউ তাঁদের সাহায্য করতে পারেন, তিনি হলেন মাইটনার। তাই সমস্ত বাধা নিষেধ ভেঙে গোপনে তাঁকে পরীক্ষার বিবরণ জানিয়ে চিঠি লিখলেন হান।
সে সময় বড়দিনের ছুটি কাটাতে মাইটনার সমুদ্রের ধারের এক ছোটো শহরে। চিঠি যখন তিনি পেলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন অপর এক বিজ্ঞানী, তাঁর আত্মীয় অটো ফ্রিশ। ফ্রিশও জার্মানি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কোপেনহেগেনে বোরের ইন্সটিটিউটে জায়গা পেয়েছেন। দু’জনে মিলে কয়েকদিন আলোচনার পরে মাইটনার বুঝতে পারলেন যে নিউট্রন যখন ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে আঘাত করছে, তখন তা লম্বাটে হয়ে যায় ও মাঝামাঝি জায়গা থেকে দু’টুকরো হয়ে যায়। বোরের নিউক্লিয়াসের তত্ত্ব থেকে মাইটনার সহজেই তা প্রমাণ করতে পারলেন। জীবনবিজ্ঞানের কোষ বিভাজন থেকে মাইটনার ও ফ্রিশ এই ঘটনার নাম দেন নিউক্লিয় বিভাজন বা ফিশন। তাঁদের যৌথ গবেষণাপত্র দু’মাস পরে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হল। মাইটনার বুঝতে পেরেছিলেন যে ধারাবাহিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিউক্লিয়াস থেকে এভাবে বিপুল শক্তি পাওয়া সম্ভব।
মাইটনারদের গবেষণাপত্র প্রকাশের কয়েকমাস পরে ফ্রেডরিক জোলিও কুরি অপর দু’জন বিজ্ঞানীর সঙ্গে মিলে দেখান যে নিউক্লিয় বিভাজনের সঙ্গে কয়েকটি নিউট্রন বেরিয়ে আসে, যারা আবার বিভাজন বিক্রিয়া ঘটাতে পারে। লিও জিলার্ড কয়েক বছর আগে এইরকম নিউক্লিয় চেন রিঅ্যাকশন বা শৃঙ্খল বিক্রিয়ার কথা বলেছিলেন। প্রথম শৃঙ্খল বিক্রিয়া বাস্তবে করে দেখান ফের্মি। এই বিক্রিয়াকে ব্যবহার করেই পরমাণু বোমা বা রিঅ্যাক্টর বানানো হয়। ইউরেনিয়ামের দুটি আইসোটোপ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, ২৩৫ ও ২৩৮। এর মধ্যে ২৩৫ আইসোটোপটির বিভাজনই হানরা দেখেছিলেন। প্রথম পরমাণু বোমাতে প্রথমটি লেগেছিল, কিন্তু প্রকৃতিতে তার পরিমাণ মাত্র ০.৭ শতাংশ। আমরা আগেই দেখেছি যে এই আইসোটোপকে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের থেকে আলাদা করার জন্য এলিজাবেথ রোনা ও ডি হেভেসির মন্তব্য কাজে লেগেছিল।
মাইটনারদের গবেষণাপত্রের প্রভাব ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী। নাৎসিদের থেকে পলাতক তিন ইহুদি বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড, ইউজিন উইগনার ও এডওয়ার্ড টেলার, আইনস্টাইনকে গিয়ে বলেন যে জার্মান বিজ্ঞানীরা যদি নিউক্লিয়াসের শক্তিকে করায়ত্ত করতে পারেন, তাহলে হিটলারের হাতে এক অপরিসীম ধবংসক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র আসবে। আমেরিকার সরকারকে একথা জানানো উচিত। আইনস্টাইন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে এক চিঠি লেখেন। এর থেকে যে ঘটনাশৃঙ্খলের সূচনা হয়, তারই একটা ধাপ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিউক্লিয় বোমা বর্ষণ। দুটি বোমাতেই নিউক্লিয় বিভাজনকে ব্যবহার করা হয়েছিল।
নিউক্লিয় বিভাজন আবিষ্কারে মাইটনারের অবদান কতখানি? হানের গবেষণাপত্রে মাইটনারের নাস থাকার কোনও সুযোগ ছিল না। সে সময় জার্মানিতে কোনও ইহুদির সঙ্গে কাজ করলে শুধু যে চাকরি যেত তা নয়, কারাবাসও ছিল অবশ্যম্ভাবী। মাইটনারের গবেষণাপত্রেও একই কারণে হানের নাম ছিল না। কিন্তু চার বছর ধরে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছেন। রসায়নবিদ হান নতুন মৌল খুঁজে পাওয়ার জন্য অধীর ছিলেন। মাইটনারই বারবার তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে অনেক বেশি অজানা পদার্থ তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন, পুরো ব্যাপারটা বুঝতে তাঁদের কোথাও ভুল হচ্ছে। কুরিদের রেডিয়াম আবিষ্কারের গল্প শোনার সময় আমরা দেখেছি যে বেরিয়াম ও রেডিয়ামের রাসয়ানিক ধর্মে অনেক মিল আছে। ইউরেনিয়াম থেকে আলফা ও বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে রেডিয়াম তৈরি হয়, হান ভুল করে বেরিয়ামকে ভেবেছিলেন সেই রেডিয়াম। মাইটনার তাঁকে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে ছাপাতে বারণ করেন। নিশ্চিত হতে গিয়েই হান ও তাঁর সহকারী স্ট্রাসম্যান বুঝতে পারেন যে রেডিয়াম নয়, তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন বেরিয়াম। মেরিদের সময় থেকেই জানা ছিল যে ইউরেনিয়াম থেকে ক্ষয়ের মাধ্যমে রেডিয়াম তৈরি হয়। তাই যতদিন হানরা ভাবছিলেন যে রেডিয়াম তৈরি হচ্ছে, ততদিন নিউক্লিয় বিভাজনের কথা তাঁদের মাথায়ই আসেনি। স্ট্রাসম্যান লিখেছেন, ‘মাইটনার যে সরাসরি আবিষ্কারে যুক্ত ছিলেন না, তাতে কিছু আসে যায় না। তাঁর উৎসাহেই হান ও তীর যৌথ গবেষণা শুরু হয়েছিল। তিনি ছিলেন আমাদের দলের এক সদস্য, হানের সঙ্গে তাঁর সবসময়ই চিঠিতে আলোচনা চলত। তিনি ছিলেন চিন্তার দিক থেকে আমাদের দলের নেতা।’
একথা নিশ্চিত যে হিটলার না থাকলে বা মাইটনার ইহুদি না হলে হান এবং স্ট্রাসম্যানের সঙ্গে তাঁর নামও ঐ গবেষণাপত্রে থাকত। পক্ষান্তরে হান সবসময়েই মনে করতেন যে নিউক্লিয় বিভাজন রসায়নের আবিষ্কার। মাইটনারের ক্ষেত্র পদার্থবিদ্যা, তাই নিউক্লিয় বিভাজনের আবিষ্কারে তাঁর ভূমিকা নগণ্য। তিনি এও বলেছেন যে মূল কাজটা তাঁরা শুরু করেছিলেন মাইটনারের বার্লিন ছাড়ার পর। পরবর্তীকালে হান আর পুরনো ঘটনা ফিরে দেখার চেষ্টা করেননি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে নিউক্লিয়াসের দু’টুকরো হওয়ার কথা আগেও নড্যাক বলেছিলেন, কিন্তু মাইটনারই তার কারণ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হন। তাই তাঁর কৃতিত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। হান তখনও পুরো ব্যাখ্যাটা বুঝতে পারেননি। তিনি তখনও ভারী মৌলের আশা ছাড়তে পারেননি। মাইটনার চেয়েছিলেন তাঁরা তাঁদের আগের গবেষণা যে ভুল হয়েছিল, সেকথা স্বীকার করে নেবেন। কিন্তু নাৎসি আমলে তাও সম্ভব ছিল না।
অপর এক আকস্মিক যোগাযোগের ফলেও মাইটনারের কৃতিত্ব সামনে আসতে দেরি হয়। নিলস বোর ১৯৩৯ সালের শুরুতে সুইডেন থেকে আমেরিকাতে যান। জাহাজ ছাড়ার ঠিক আগে তিনি ফ্রিশের কাছে নিউক্লিয় বিভাজন বিষয়ে জানতে পারেন। ২৬শে জানুয়ারি তিনি আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এক সভাতে সেকথা বলেন। সেদিনই আমেরিকার কয়েকজন পরীক্ষা করে নিউক্লিয় বিভাজন দেখতে সক্ষম হন। তাঁদের গবেষণাপত্র মাইটনারদের আগেই প্রকাশিত হয়ে যায়। ফলে মাইটনাররাই যে প্রথম সঠিক ব্যাখ্যা করেছিলেন, তা বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যায়।
হান ১৯৪৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। মাইটনারকে বঞ্চিত হতে হয়। পদার্থবিদ্যার নোবেলের জন্য তাঁর নামে মোট উনত্রিশটি মনোনয়ন এসেছিল, রসায়নের জন্য উনিশটি। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক পদার্থবিজ্ঞানের জন্য ও নিলস বোর রসায়নের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করেন। হান ১৯৪৮ সালে মাইটনার ও ফ্রিশের নাম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলের জন্য সুপারিশ করেন। কিন্তু নোবেল পুরস্কার মাইটনারের অধরা থেকে যায়। ১৯৬৬ সালে তিনি হান ও স্ট্রাসম্যানের সঙ্গে একত্রে এনরিকো ফের্মি পুরস্কার পান। তাঁর স্মরণে ১০৯ পারমাণবিক সংখ্যার মৌলের নাম দেয়া হয়েছে মাইটনারিয়াম। তাঁর নামে চাঁদের বুকে একটি গহ্বরও আছে। ১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়।
হান শুধু মাইটনার নয়, আইরিন কুরিদের কৃতিত্বও স্বীকার করেননি। হান এক সম্মেলনে ফ্রেডেরিককে বলেছিলেন যে আইরিনদের পরীক্ষা একেবারেই ভুল। যখন সঠিক ব্যাখ্যাটা বুঝতে পারেন হান, তখন কিন্তু তিনি আইরিনদের গবেষণার উল্লেখ করেননি। মাইটনার এক চিঠিতে হানকে লিখেছিলেন যে কুরিরা বুঝেছিলেন যে ইউরেনিয়ামকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলে একটা অদ্ভুত কিছু হচ্ছে। হান যে কুরিদের গবেষণার ফল থেকেই কী পরীক্ষা করতে হবে বুঝতে পেরেছিলেন, সেটা তাঁর স্পষ্টভাবে বলা উচিত ছিল। মাইটনার আরও লিখেছিলেন, আইরিন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে ইউরেনিয়াম ও নিউট্রনের সংঘর্ষে পর্যায়সারণিতে ইউরেনিয়ামের থেকে হালকা সমস্ত মৌল তৈরি হয়। আজ আমরা জানি একথাটা অনেক অংশে সত্যি।
নিউক্লিয়াস থেকে কণা পদার্থবিদ্যা: মেসন
এরপরে যে বিষয়ে আমরা আলোচনা করতে চলেছি তাকে নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা ও কণা পদার্থবিদ্যার মাঝখানের অংশ বলা যাতে পারে। গল্পটা একটু জটিল, তার শুরুটা হয়েছিল জাপানে। ততদিনে আমরা জানতে পেরেছি যে তড়িৎচৌম্বক বলের জন্য দায়ী হল ফোটন। নিউক্লিয়াসে আছে প্রোটন ও নিউট্রন। প্রোটনদের আধান ধনাত্মক, তারা একে অন্যকে বিকর্ষণ করে। তাহলে নিউক্লিয়াসের মতো ছোটো জায়গায় তাদের ধরে রেখেছে কে? সহজেই বোঝা যায় যে সেই বিকর্ষণ বলের থেকে আরও শক্তিশালী বলের দরকার হবে। সেই বলটাই হল সবল বল বা পীন বল। ১৯৩০-এর দশকে এটা বোঝা গিয়েছিল, কিন্তু সেই বলের সম্পর্কে আর বিশেষ কিছুই জানা যাচ্ছিল না। ১৯৩৫ সালে জাপানে হিদেকি ইউকাওয়া কল্পনা করলেন অনেকটা ফোটনের মতো কোনও এক কণার। তিনি বললেন যে দুটি প্রোটন, দুটি নিউট্রন বা একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রনের মধ্যে এই কণার বিনিময় পীন বল সৃষ্টি করে। তবে এই কণা ফোটনের মতো ভরশূন্য নয়। তিনি হিসেব করে দেখালেন যে এর ভর হবে ইলেকট্রনের ভরের মোটামুটি দুশো গুণ। ইলেকট্রন ও প্রোটনের ভরের মাঝামাঝি পড়বে এই কণার ভর। গ্রিক ‘মেসো’ শব্দের মানে মধ্যবর্তী, তা থেকে শেষপর্যন্ত এই কণাটার নাম হয় পাই () মেসন বা পায়ন। এখন অবশ্য মেসন বলতে আমরা এক বিশেষ ধরনের কণার কথা বুঝি।
কিন্তু এরকম ভরের কোনও কণা তো তখনও পর্যন্ত কারও চোখে পড়েনি। কোথায় তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে? ইউকাওয়ার ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে কণাটির জীবনকালও খুবই কম হওয়া উচিত, এক সেকেন্ডের একশো কোটি ভাগের একভাগেরও কম। তাই সাধারণ বস্তুর মধ্যে একে খুঁজতে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই। আবার বিজ্ঞানীরা খুঁজতে শুরু করলেন মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে। আগেই বলেছি তার মধ্যে নতুন কণা তৈরি হয়। একবছরের মধ্যেই পজিট্রনের আবিষ্কর্তা অ্যান্ডারসন খুঁজে পেলেন ইলেকট্রনের ভরের দুশো গুণ ভরের এক কণা। মনে হল তাহলে ইউকাওয়ার তত্ত্ব যে ঠিক, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানে শেষকথা বলা যে খুব সহজ নয়, এরপরই তা বোঝা গেল আরেকবার। নতুন পাওয়া কণাটার জীবনকাল দেখা গেল অনেক বড়ো, এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগেরও বেশি। অন্য অনেক দিক থেকেও বোঝা গেল যে, ইউকাওয়ার কণা এটা হতে পারে না। যেন এই কণার উপর সবল বল কোনও কাজই করে না; অথচ ইউকাওয়ার কণার তো সবল বলকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। যাঁরা এই পরীক্ষাগুলো করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। শেষপর্যন্ত বোঝা গেল যে এটা একটা নতুন কণা, যার নাম দেওয়া হল মিউয়ন (m)। এই কণার সঙ্গে ইলেকট্রনের ধর্মের অনেক মিল আছে। দু’রকমের মিউয়ন হয়—যাদের আধান যথাক্রমে ইলেকট্রনের ও পজিট্রনের সমান।
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেই সময় গবেষণার কাজ স্বাভাবিকভাবেই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত পাই মেসনকে পাওয়া গেল ১৯৪৭ সালে। আমাদের দেশে বিভা চৌধুরী ও দেবেন্দ্রমোহন বোস তার অনেক আগেই পাই মেসন আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। সেই কাহিনি তোমাদের বলব, তার আগে কোন পদ্ধতি তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন তা জেনে নেওয়া যাক। সেই কাজে এক মহিলা বিজ্ঞানী প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন।
মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে কাকে বলে এই সময় তোমাদের একটু বলে দিই। মহাবিশ্বে নানা ঘটনায় অনেক প্রোটন-নিউট্রন বা অন্য মৌলিক কণা ও পরমাণুর নিউক্লিয়াস তৈরি হয় এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এখনও মহাজাগতিক রশ্মি কোথায় তৈরি হয় সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত নই। বিজ্ঞানীরা মনে করেন মহাকাশে সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়তো একটা উৎস। এই মহাজাগতিক রশ্মির কণাদের গতিশক্তি খুব বেশি, তারা প্রায় আলোর বেগে চলাফেরা করে। আমাদের পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে এইরকম অসংখ্য কণা ধাক্কা মারছে, কিন্তু বায়ুমণ্ডল থাকার জন্য তারা সরাসরি মাটিতে নেমে আসতে পারে না। বায়ুমণ্ডলের অণু-পরমাণুদের সঙ্গে এই কণাদের সংঘর্ষে অনেক নতুন মৌলিক কণা তৈরি হয়। মৌলিক কণার সৃষ্টি বিজ্ঞানের একটা মূল লক্ষ্য। তোমরা সবাই নিশ্চয়ই আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণটার কথা জানো। যদি সংঘর্ষরত কণাগুলোর গতিশক্তি (E) বেশি হয়, তাহলে তারা অনেক নতুন কণা তৈরির ভর (m) যোগান দিতে পারবে। যেমন সার্নে এল.এইচ.সি কণাত্বরক বা পার্টিকল অ্যাকসিলারেটরে মৌলিক কণাদের শক্তি এত বাড়ানো হয়েছে যে তাতে নতুন হিগস বোসন কণার জন্ম হয়েছে। কিন্তু ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তৈরি কণাত্বরক দিয়ে কণাদের গতিশক্তি খুব একটা বাড়ানো যেত না। তাই নতুন মৌলিক কণার জন্য বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক রশ্মি পর্যবেক্ষণ করতেন।
এই নতুন মৌলিক কণাগুলো প্রায় সবই খুব ক্ষণস্থায়ী। তাদের দেখার উপায় কী? পরমাণুর চেয়েও অনেক ছোটো কণাদের চোখে তো আর দেখা যাবে না, তাদের অস্তিত্বের অন্য প্রমাণ খুঁজতে হয়। তার একটা উপায় ছিল ক্লাউড চেম্বার বা মেঘকক্ষ। কিন্তু মেঘকক্ষের একটা সমস্যা হল যে সেটা খুব অল্প সময় চালু থাকে, তারপর তাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিতে হয়। মহাজাগতিক রশ্মি তো আর বলে কয়ে আসবে না, তাই যে সময় যন্ত্রটা চালু নেই, সেই সময় তাদের ধরার কোনও উপায় নেই। বিজ্ঞানীরা তাই পর্যবেক্ষণের অন্য পদ্ধতি খুঁজছিলেন। নিউক্লিয় বিজ্ঞানে কাজ করার সময় সেই পদ্ধতির বিকাশ ঘটাবেন এক মহিলা বিজ্ঞানী মারিয়েটা ব্লাউ।
মারিয়েটা ব্লাউ: ফটোগ্রাফের জাদুকরী
মারিয়েটা ব্লাউয়ের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৯ এপ্রিল অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার এক উচ্চশিক্ষিত ইহুদি পরিবারে। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরে ১৯১৯ সালে তিনি পি.এইচ.ডি ডিগ্রি পেয়েছিলেন। তাঁর সুপারভাইসর ছিলেন ফ্রাঞ্জ এক্সনার এবং পরীক্ষক ছিলেন স্টেফান মেয়ার। মহিলাদের বিজ্ঞান গবেষণাতে স্থান দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের দু’জনেরই উৎসাহের কথা আমরা আগেই শুনেছি। দু’বছর ব্লাউ বার্লিনের এক এক্স-রশ্মি টিউব বানানোর কারখানায় কাজ করার পর ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি ছাত্রদের এক্স-রশ্মি ছবি তোলার কায়দা শেখানোর চাকরি পান। এই সময়ে ফটোগ্রাফিক ইমালশন বা অবদ্রবের উপর সাধারণ আলো ও এক্স-রশ্মির প্রভাব নিয়ে দুটি গবেষণাপত্র ছাপান।
এখন ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ। তোমরা ফটোগ্রাফির প্লেট হয়তো কেউই দেখনি। একটা পাতলা কাচের প্লেটের উপরে রুপোর যৌগ সিলভার আয়োডাইডের (বা ব্রোমাইডের) ইমালশন বা অবদ্রব লাগানো থাকে। আলো এসে পড়লে সিলভার আয়োডাইড সিলভার অর্থাৎ রুপো এবং আয়োডিনে ভেঙে যায়। রুপো প্লেটের গায়ে এঁটে যায়। আলোর পরিবর্তে যদি কোনও কণা প্লেটের মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে সেও সিলভার আয়োডাইডকে ভাঙতে ভাঙতে যাবে, ফলে প্লেটের গায়ে বিন্দু বিন্দু রুপো জমা পড়বে। এই বিন্দুগুলো দেখে বোঝা যায় যে কণা কোন পথ দিয়ে গেছে। এখানে সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হল যে ফটোগ্রাফিক প্লেটকে যতক্ষণ খুশি রেখে দেয়া যায়, সারাক্ষণই সে সক্রিয় থাকবে। কোনও কণা যদি তার মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে সে পথের একটা চিহ্ন রেখে দেবে। প্লেটের জায়গায় ফিল্মও ব্যবহার করা যায়।
১৯২৩ থেকে ১৯২৮ ব্লাউ ভিয়েনার ইন্সটিটিউটে কাটান, তবে স্থায়ী পদে নয়। ১৯২৫ সালে তিনি ফটোগ্রাফিক ফিল্মের মধ্যে দিয়া প্রোটন বা আলফা কণা গেলে তার চিহ্ন কেমন হবে সেই বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। ইমালশনের বেশ কিছু সমস্যা ছিল, ব্রিটিশ কোম্পানি ইলফোর্ড ব্লাউয়ের পরামর্শে ক্রমান্বয়ে ইমালশন ও ফিল্মকে কণা দেখার উপযোগী করে তোলে। ব্লাউ দেখালেন যে তাঁর পদ্ধতিতে আলফা ও প্রোটনকে আলাদা করে চেনা যায়। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ ব্লাউ ও তাঁর সহযোগী ও একদা ছাত্রী অপর এক মহিলা বিজ্ঞানী হার্থা ওয়ামবাখার এই নিয়ে আরও কাজ করেছিলেন, সেজন্য তাঁরা যৌথভাবে বিজ্ঞানে অস্ট্রিয়ার সবচেয়ে সম্মানের সূচক লিবেন পুরস্কার পেয়েছিলেন। মূলত তাঁদের দু’জনের চেষ্টাতেই নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যাতে ইমালশনের ব্যবহার চালু হয়।
মহাজাগতিক রশ্মি দেখার জন্য ১৯৩৭ সালে ব্লাউ ও ওয়ামবাখার পরপর ফটোগ্রাফিক প্লেট সাজিয়ে এক পাহাড়ের চূড়ায় রাখলেন। চারমাস পরে তাঁরা যখন প্লেটগুলো পরীক্ষা শুরু করলেন, তখন উচ্চ শক্তি প্রোটনের পথরেখা দেখতে পেলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা তাঁরা দেখতে পেলেন কতকগুলো তারার মতো চিহ্ন, যেখানে একটা কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে কয়েকটা রেখা নানা দিকে বেরিয়ে গেছে। এদের আমরা এখন স্টার বলি। এরা এল কোথা থেকে? ব্লাউ ও ওয়ামবাখার ‘নেচার’ পত্রিকাতে এক গবেষণা পত্র লিখে দেখালেন যে মহাজাগতিক রশ্মি উচ্চশক্তির কণারা ইমালশনের নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মেরে ভেঙে ফেলেছে। নিউক্লিয় বিক্রিয়া দেখার নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার হল।
এই সময়েই ইন্সটিটিউটের নাৎসি মনোভাবাপন্ন বিজ্ঞানীরা ইহুদি ব্লাউয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ওয়ামবাখারও। কিছুদিনের মানসিক শান্তির জন্য ব্লাউ এলেন গ্লেডিচের আমন্ত্রণে অসলো রওনা হলেন। যেদিন তিনি অস্ট্রিয়া ছাড়েন, ঘটনাচক্রে সেদিনই অস্ট্রিয়া ও জার্মানি এক হয়ে যায়। ইহুদি ব্লাউয়ের আর দেশে ফেরার কোনও সুযোগই ছিল না। ওয়ামবাখার কিছুদিন পরে একা একটা গবেষণাপত্র লেখেন। তাতে যে কাজের কথা লিখেছিলেন সেটা যে ব্লাউ ও তিনি দু’জনে মিলেই করেছেন সেকথা তিনি গোপন করেন। ব্লাউয়ের আগের অবদানকে তিনি খুবই তুচ্ছ করে দেখান। ইমালশনের মধ্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া প্রসঙ্গে এক নাৎসি বিজ্ঞানীর মন্তব্যের কথা বলেন যিনি কোনোদিন ইমালশন নিয়ে কাজও করেনি। তার চেয়েও বড়ো কথা হল যে ইমালশনের মধ্যে মহাজাগতিক রশ্মি যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটবে, তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ব্লাউয়ের চেষ্টাতে ইমালশনের উন্নতির ফলেই তা দেখা সম্ভব হয়েছিল। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হল বারো বছর পরে নোবেল কমিটি ব্লাউয়ের অবদান আলোচনার সময় ওয়ামবাখারের সেই লেখাকে বিবেচনায় এনেছিলেন। তাই বিজ্ঞানের সব সেরা সম্মান তাঁর অধরা থেকে যায়। সেই কথায় আমরা পরের পর্বে আসব।
আইনস্টাইনের চেষ্টাতে মেক্সিকো টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে একটা চাকরি পান ব্লাউ। কিন্তু সেখানে গবেষণার কোনও সুযোগই ছিল না। ছ’বছর পরে ১৯৪৪ সালে নিউইয়র্কে আর একটা চাকরি পেলেন, আবারও আইনস্টাইনের উদ্যোগে। ১৯৪৮ সালে আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করার পরে তিনি নিজের পছন্দের গবেষণাতে ফিরতে পারলেন। আমেরিকাতে ব্রুকহাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি ও ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন পড়ানোর পরে অবসর নিয়ে আবার ভিয়েনা ফিরে যান। তাঁর স্বাস্থ্য ও আর্থিক অবস্থা সেই সময় খুবই খারাপ ছিল। ১৭ জানুয়ারি ১৯৭০ ফুসফুসের ক্যানসারে তাঁর মৃত্যু হয়।
ব্লাউয়ের দেখানো পথেই কণা পদার্থবিদ্যা চলতে শুরু করে। এই লেখার শেষ পর্বে আমরা সেই কথা শুনব। দেখব মহিলা বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরী পাই মেসন আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি এসেও কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন।
(চলবে)