বৈজ্ঞানিকের দপ্তর প্রতিবেশি গাছ পলাশ।পিয়ালী বন্দ্যোপাধ্যায় বসন্ত ২০২০

প্রতিবেশী গাছ সব পর্ব একত্রে

টিয়াপাখি গাছ নাকি বনের আগুনঃপলাশ

পিয়ালী ব্যানার্জি

পলাশফুল দেখলেই মনে হয় বসন্ত এসে গেছে কিম্বা বসন্ত এলেই পলাশ।  ফাগুন মানে  ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি যখন ফুটতে থাকে মনে হয় বনে আগুন লেগে গেছে।  ডালে একটি পাতার দেখা নেই,(পর্ণমোচী) শুধু ফুল।  আগুন রঙ, লাল, আবার বাসন্তী হলুদেও পলাশ ফুল হয়।  লতানে পলাশ( Butea superba) আরেকটি প্রজাতি, পাওয়া যাবে ঝাড়খন্ডের জঙ্গলে।  

ইন্ডিয়ান মাইথোলজি তে পলাশ গাছকে বলা হয় অগ্নিদেবতার এক রূপ।  কেমন করে, তাহলে বলি শোনো।  একবার দেবাদিদেব মহাদেব আর দেবী পার্বতী যখন নিভৃত আলাপচারিতায় মগ্ন ছিলেন তখন অগ্নিদেব ভুল করে তাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলেন। ব্যস আর যায় কোথায়! দেবদেবীদের যেমন রাগ তেমন অভিশাপ। পার্বতীর অভিশাপে অগ্নিদেব পলাশ গাছ হয়ে জন্মালেন পৃথিবীতে।

সারা বছর এ গাছ তেমন রূপে তোমায় ভোলাবে না।  দেখতে মাঝারি মাপের(১০-১২মি) গাঢ় সবুজ পাতায় ঢাকা রুখাসুখা এবড়োখেবড়ো গুঁড়ি, হেটোমেঠো মানুষের মতন। শিল্পী রামকিঙ্কর বেজ বলতেন পলাশ গাছটি যেন চেহারা চরিত্রে তাঁরই মত। দেখতে যেমন তেমন, ভেতরে আগুন। বসন্তকালে সারা বনজঙ্গল লালে লাল হয়ে যায়। তাই তো একে নাম দেওয়া হয়েছে “flame of the forest”.

আমি দেখেছি, পলাশ গাছে প্রচুর টিয়াপাখির আড্ডা। বাসন্তী পলাশে যখন সবুজ টিয়ার ঝাঁক বসে, সে কী অপরূপ দৃশ্য। যারা বড় হয়ে বার্ডার (পাখি দেখনেওয়ালা)  হবে তারা এটা মনে রেখো। আবার টিয়া বা শুকপাখির ঠোঁটের মতই পলাশ ফুলের বাঁকা গড়ন(কিম+ শুক)। এটা একটা প্রশ্ন বা বিতর্ক। কেন একে বলে “parrot tree”।  

পলাশ আমাদের দেশি ফুল। ঝাড়খন্ডের “state flower”।  এর অনেক নাম। সংষ্কৃত ভাষায় কিংশুক। তেলেগু ভাষায় মদুগুচেত্তু। তেলেঙ্গানায় শিবরাত্রিতে শিবকে পুজো করতে হয় পলাশ ফুলে।

ইতিহাস বলে যেখানে পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল,সেই জায়গার নাম ও নাকি পলাশ গাছের নাম থেকেই।

উত্তরভারতে বিশেষত উত্তরাখন্ডে যদি গিয়ে পলাশ খোঁজো তাহলে কেউ চিনবেই না। সেখানে গিয়ে বলতে হবে  “ঢাক।” প্রবাদ আছে “ঢাক কে তিন পত।”  

পলাশ গাছ আর পাতা চেনার এটাও একটা মোক্ষম উপায়। তিনটে বড়ো বড়ো পাতা একসঙ্গে মিলে একটি পাতা। স্থানীয়রা মনে করেন এই তিন পাতা বা ত্রিপত্র symbolise করে ব্রহ্মা(সৃষ্টি র দেবতা),বিষ্ণু(রক্ষাকর্তা),এবং মহেশ্বর(প্রলয়কারী)।  তার মানে জীবনের ধারা। অর্থাৎ কি না ‘ঢাক কে তিন পত’ যে বার্তা দেয় তা হল ‘সদা এক রহনা।’  

জ্যোতিষশাস্ত্রে এই গাছ-এর নক্ষত্র হল পূর্ব ফাল্গুনী।

আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে পলাশের ছড়াছড়ি। গীতবিতান বইতে খুঁজে নিতে পারো ইচ্ছে হলে। (ষোলোটি গান বা কবিতা আছে)

এমনিতে পলাশের বিজ্ঞানসম্মত নাম বুটিয়া মনোস্পার্মা(Butea monosperma)  যে নামকরণ করা হয়েছে Earl of Bute, Jonh Stewart এর নাম অনুসারে। অন্য নাম butea frondosa, fronsa মানে পাতায় ঘেরা। আর গুণের কথা? তার কোনো শেষ নেই ।  

অনুর্বর জমিকে উর্বর করার জন্য এ গাছ লাগানো হয়। লাক্ষাপোকার চাষেও এ গাছ উপযোগী। চোখের ছানি, কিডনির অসুখ আরো কত কী সারিয়ে দেয়।

শেষ করি ছোট্ট একটা অনুষঙ্গে। পলাশের আগেই এসে যায় আরেক লাল ফুল, যাকে আমরা ডাকি রুদ্রপলাশ নামে।  তার সঙ্গে পলাশের কোনো বংশগত মিল নেই। সে ফুল আফ্রিকার। আফ্রিকান টিউলিপ নাম তার। যদিও এদেশের মাটিতে সে দিব্যি আদরে স্থান করে নিয়েছে। শহরে ও আশেপাশে ফেব্রুয়ারিতেই ফুটতে শুরু করে রমরমিয়ে।  

অলঙ্করণঃ লেখক

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s