ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
বাগ্মী হকিং– পর্ব ১, পর্ব ২ , পর্ব ৩, পর্ব ৪
বাগ্মী হকিং – ৫
ভগবান কি পাশা খেলেন?
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৯৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর স্টিফেন হকিং একটি বক্তৃতা দেন যার বিষয় ছিল — “ভগবান কি পাশা খেলেন?” এই বক্তৃতায় হকিং সরাসরি আইনস্টাইনের মহাজাগতিক তত্ত্বের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে প্রশ্ন করেন — আমরা কী আদৌ ভবিষ্যত পৃথিবীর প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারব, নাকি সবটাই থেকে যাবে অধরা?
প্রাকৃতিক দুর্যোগ — যেমন বন্যা বা মহামারী, ব্যখ্যা করতে অপারগ হয়ে মানুষ কল্পনার সিংহাসনে ভগবানকে বসিয়ে দিয়েছে। যেন সব ভবিতব্যে ভগবানের হাত আছে ভাবলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এবং ভগবান ইচ্ছে করেই সব কিছুতে হস্তক্ষেপ করে ঘটনা ঘটিয়ে চলেছেন, এমনটাই মানুষের বিশ্বাস। হকিং বললেন – মানুষ যেন ভাগ্যের সঙ্গে চুক্তি করেছে, যেন কিছু প্রাপ্তি ঘটলে তবেই তার ঝুলি থেকে ভগবানকে কিছুটা দান করে দেবে! যেমন ভগবানের কাছে মানত করা হল, সবচাইতে বেশি নম্বর পেলে তবেই সে ভগবানের থানে প্রসাদ চড়াবে, নম্বর বেশি না পেলে ভগবানের বরাতে কিছুই জুটবে না। আরও খুলে বললে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভগবানের হাতে ছেড়ে দিয়ে তাকে ঘুষ দিতে শুরু করল মানুষ।
হকিং বললেন — ধীরে ধীরে মানুষ যত সভ্য হল, ততই সে বুঝতে পারল প্রকৃতিতে সব ঘটনা ঘটার পিছনে আছে নির্দিষ্ট কারণ। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দেওয়া গেল কোনও কোনও ক্ষেত্রে। সবচাইতে আগে মানুষ গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধির মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে পেল। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞান হল মানবসমাজের প্রথম বিজ্ঞান বিকাশ। নিউটনের হাত ধরে গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধির গাণিতিক ব্যাখ্যা এল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনার গাণিতিক ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু হল সফল ভাবে। বৈজ্ঞানিক নির্ধারণবাদ বা সায়েন্টেফিক ডিটারমিনিসম্-এর পথ দেখালেন ফরাসী বিজ্ঞানী লাপ্লাস। তিনি বললেন — যদি একটি চলমান বস্তু বা কণার বর্তমান গতি ও অবস্থান সঠিক ভাবে জানা যায়, তবে ভবিষ্যতেও তার গতি ও অবস্থান সঠিক ভাবেই জানা যাবে।
হকিং যুক্তি দিলেন, বস্তুর ভবিষ্যৎ যদি এতটাই সুনিশ্চিত হবে, তাহলে ভগবানের জায়গা কোথায় রাখা যায়? তাহলে তো মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে, ভগবান বহাল তবিয়তে আছেন, কিন্তু প্রাকৃতিক কোনও ঘটনায় বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছে তিনি রাখেন না। ব্রহ্মাণ্ডের একসময়ের অবস্থা তার অন্য সব সময়ের অবস্থাকে নির্ধারিত করে — লাপ্লাসের সময় থেকে এই ধারণা অনেকদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানের জগতকে প্রভাবিত করে রেখেছিল। অর্থাৎ আমরা জানতাম আজ, গতকাল বা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে যা ঘটে গিয়েছে, তাদের বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তার বিষয়ে জানা যাবে।
কিন্তু সমস্যা হল, সে কাজটা করতে গিয়ে যে সমীকরণগুলো প্রয়োজন সেগুলো তৈরি করতে বা সমাধানের চেষ্টা করতে বিপুল জটিলতার সৃষ্টি হল। আর, পাশাপাশি তার সঙ্গে জুড়ে গেল আর একটি ব্যাপার – যাকে বলা হয় ক্যাওস বা বিশৃঙ্খলা। এ হল গিয়ে ব্রহ্মান্ডের খেয়ালখুশির আচরণ, যাকে কোনো নিয়ম দিয়ে বাঁধা যায় না।
একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ধরো একটা লোক রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। তুমি তার অতীতের সমস্ত প্রজন্মের জিনটিন কী ছিল সেইসব নিয়ে অনেক গবেষণা করে, ভয়ঙ্কর সব অঙ্কটঙ্ক কষে ধরো একটা গাণিতিক মডেল দাঁড় করিয়েছ যা থেকে ভবিষ্যৎবাণী করা যাচ্ছে এই লোকটার পরের প্রজন্মে আইনস্টাইনের মত একটা ছেলে জন্মাবে। এইবার লোকটা যখন রাস্তা পেরোতে যাচ্ছে তখন হঠাৎ একটা গাড়ি ব্রেক ফেল করে তাকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলল। ফলে তার ছেলেটা জন্মাল না। একটা গাড়ির এহেন একটা বিশৃঙ্খল আচরণ (যার পূর্বাভাষ তোমার মডেলে ছিল না) ভবিষ্যতের নিশ্চিত একটা সম্ভাবনাকে এক নিমেষে মুছে দিল।
অতএব বোহা যাচ্ছে ভবিষ্যৎ দর্শন অতটা সরল নয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাষের কথাই ধরা যাক। একটা প্রজাপতি হয়তো ডানা ঝাপটে উড়ে গেল, আর নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে বৃষ্টি হয়ে গেল। দুটো ঘটনার মধ্যে কোনও যোগ থাকতে পারে কী? হয়তো দেখা গেল, পরের বার প্রজাপতিটা ডানা ঝাপটালো, কিন্তু তারপর বৃষ্টি না হয়ে সম্পূর্ণ অন্য ঘটনা ঘটে গেল। এতেই বোঝা যায়, আবহাওয়ার পূর্বাভাষ কেন এত অবিশ্বস্ত!
এই যে অতীতকে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতের বিষয়ে পূর্বাভাষ দেয়া বা বৈজ্ঞানিক নির্ধারণবাদ, এটা গোটা উনবিংশ শতাব্দী ধরে একটা মতবাদ হিসাবে চালু ছিল বিজ্ঞানের জগতে। বিংশ শতাব্দীতে কিন্তু ধারণা বদলে গেল। বোঝা গেল, ভবিষৎবাণী একেবারে সঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। এর কারণ হল, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গোড়াপত্তন।
ব্যাপারটা বুঝতে গেলে আগে কোয়ান্টা জিনিসটা কী সেইটে বুঝে নেয়া দরকার।
লাপ্লাসের সময়ের অনেক আগে থেকে সনাতন পদার্থবিদ্যায় ধারণা ছিল, একটা অতি উত্তপ্ত বস্তু থেকে সমস্ত বিকিরণ একই হারে হয়ে থাকে (রেডিও ওয়েভ, ইনফ্রারেড, আলো, আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি, এক্স রে) এবং এই বিকিরণ একটানা। কিন্তু ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক দেখালেন, এই ধারণা একেবারে ভুল। যদি তাই হত, তবে সমান হারে বিকিরণের দরুন ব্রহ্মাণ্ডের সব বস্তুর তাপমান এক হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। প্ল্যাঙ্ক প্রস্তাব দিলেন – উত্তপ্ত বস্তু থেকে সব রকম তরঙ্গ দৈর্ঘের রশ্মি বিকিরণ হওয়ার ধারনাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে ল্যাঠা চুকে যায়। এর চাইতে বরং ধরে নেওয়া যাক, উত্তপ্ত বস্তু থেকে এক একটা প্যাকেট বিকিরণ হয়ে থাকে, যে প্যাকেটের সাইজ ছোট থেকে বড়, বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। এক একটা প্যাকেটে ভরা আছে শক্তি—যত বড় প্যাকেট, তত বেশি শক্তি। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম হল যে, দোকান থেকে খোলা চিনি যা খুশি মাপের কেনা যাবে না, এক এক কিলোগ্রামের প্যাকেটের হিসাবে কেনাকাটি করতে হবে। ইনফ্রারেড বা আলোর চাইতে বেশি শক্তি থাকে আলট্রা ভায়োলেট বা এক্স রে-এর প্যাকেটে। এক একটা প্যাকেটের নাম দেওয়া হল কোয়ান্টা। যদি উত্তপ্ত বস্তুর তাপমান সূর্যের তাপমানের কাছাকাছি না হয়, তবে তার থেকে আলট্রা ভায়োলেট বা এক্সরে-এর কোয়ান্টা পাওয়া যাবে না।
কেবলমাত্র অঙ্ক মিলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টার কথা বলে থাকলেও অন্যান্য পদার্থবিদেরা প্রকৃতিতে বিভিন্ন শক্তির শোষণ বা বিকীরণের মধ্যে এইরকমের টুকরো টুকরো চেহারায় আদানপ্রদাণের ছবি (ডিসক্রিট নেচার) দেখতে পেলেন। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক একটা লাট্টুর নিজের অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরা। ঘুরতে ঘুরতে লাট্টুটার শক্তি ক্ষয় হতে হতে একসময়ে সে থেমে যায়। লাট্টুর এই শক্তি ক্ষয় কিন্তু সমান হারে কমে না, ছোট ছোট শক্তির প্যাকেট তার শরীর থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে থাকে যে আমাদের খালি চোখে ধরা পড়ে না। ঘূর্ণনরত মৌলিক কণা, যেমন ইলেকট্রন, তার পাক খাওয়াও লাট্টুর পাক খাওয়ার সঙ্গে মিলে যায়। দেখা গেল মৌলিক কণাদের পাক খাওয়াও একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার গুণিতক, অর্থাৎ তাদের শক্তিও বিযুক্ত ধর্মী বা ডিসক্রিট। এইটি হল প্রকৃতির কোয়ান্টাম আচরণ।
এই শক্তির এই কোয়ান্টা ধর্ম আবিষ্কার হবার পর, তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যা খুঁজে বের করল তা থেকে প্রকৃতির এই অনিশ্চিত আচরণ সম্পর্কে আরও বেশি করে জানা গেল।
ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ এলেন তাঁর বিখ্যাত অনিশ্চয়তা তত্ত্ব (আনসার্টেইনিটি প্রিন্সিপ্ল) নিয়ে।
ধরা যাক একটা ছোট্ট কণা, যেমন ইলেকট্রন, তাকে আমরা দেখতে চাই। তার উপর আলো না ফেললে তাকে আমরা দেখতে পাব না। ইলেকট্রন যেহেতু একটি খুব ছোট কণা, সাধারণ আলোয় তাকে দেখা যাবে না। তাকে দেখতে গেলে চাই শক্তিশালী এক্স-রে বা আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি। কিন্তু যেই এক্স-রে কোয়ান্টা ইলেকট্রনের গায়ে পড়বে, অমনি তার ধাক্কায় ইলেকট্রনের গতি আর অবস্থান বদলে যাবে। এইবারে ঘটবে বেজায় মুশকিল। আলো না ফেললে তাকে মাপতে পারব না। আর আলো ফেললেই তার ধাক্কায় গতি আর অবস্থান বদলে যাবে। একটাকে মাপএ গেলে অন্যটার মাপ ভুল হয়ে যাবে।
হাইসেনবার্গ বললেন, গতিবেগের অনিশ্চয়তা এবং অবস্থানের অনিশ্চয়তার গুণফল প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবককে কণার ভর দিয়ে ভাগ করে যা পাওয়া যাবে, তার চাইতে বেশি হবে ( ∆x.∆v>h/m)।
তাহলেই ভাবো, যদি কোনও কণার বর্তমানের অবস্থান এবং গতিবেগ সঠিক ভাবে না মাপতে পারা যায় তবে ভবিষ্যতে তার অবস্থান আর গতিবেগ জানা যাবে কীভাবে? এক কথায় নিখুঁতভাবে কোনোকিছুকেই মাপা সম্ভব নয়।
হাইসেনবার্গের তত্ত্ব লাপ্লাসের যুগের বৈজ্ঞানিক নির্ধারণবাদের মূলে কুঠারাঘাত করল। এই তত্ত্বের কথা শুনে আইনস্টাইন একেবারে হতাশ হলেন। তাঁর বিখ্যাত স্বগোতক্তি – “ভগবান পাশা খেলেন না”, তাঁর ধারণাকে ব্যক্ত করে। তিনি ভেবেছিলেন প্রকৃতির এই অনিশ্চয়তা সাময়িক। আসল সত্য হল —যে কোনও বস্তুর অবস্থান ও গতিবেগ সঠিকভাবেই নির্ধারিত করা সম্ভব।
হকিং বললেন —আসল সত্য ভগবানই জানেন, তবে আলোর কোয়ান্টাম ধর্মের জন্য সেই সত্য আমরা জানতে পারব না। তবে মনে হয়, ভগবানের গণ্ডিও অনিশ্চয়তা তত্ত্বে বাঁধা, তাই তিনিও কোনও কণার গতিবেগ আর অবস্থানের সঠিক পরিমাপ জানেন না।
যাই হোক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রতিষ্ঠা হল হাইসেনবার্গ, শ্রডিঙ্গার আর ডিরাকের হাতে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রকৃতির এক অচেনা চরিত্রের উপর থেকে ঢাকনা খুলে দিল যেন। সত্যকে অন্যরূপে চিনতে শুরু করলাম আমরা। এইবার ভাবনা অন্যদিকে গড়াল। ধরো একটা সময়বিন্দুতে কণার গতি আর অবস্থানকে নিখুঁতভাবে না-ই মাপতে পারলাম। কিন্তু খানিক সময় ধরে তার বিভিন্ন অবস্থান আর গতির একটা আন্দাজি হিসেব তো পাওয় যেতে পারে! তাই না? একটা সোজা বা বাঁকা রাস্তা… এইটেকে যদি গতিশীল কণাটার ওই সময়টা জুড়ে একটা বিকল্প রূপ হিসেবে ভেবে নিই, তাহলে সেই ঢেউয়ের মতন চলনপথটাকে মেপে তার চরিত্রের আন্দাজ তো মিলবে!
সব কণারই সঙ্গে জড়িত আছে এই ওয়েভ ফাংশন, যার আকার কণাটিকে একটি বিশেষ জায়গায় উপস্থিত থাকবার সংকেত দেয় বা সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। এক স্থান থেকে আর এক স্থানে ওয়েভ ফাংশনের পরিবর্তনের হার কোনও কণার গতিবেগকে নির্দেশ করে। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ওয়েভ ফাংশনের মান (তরঙ্গ যখন সুউচ্চ শিখর যুক্ত) অনেক বেশি হওয়ার অর্থ, সেখানে কণাটিকে পাওয়ার সম্ভাবনা সব চাইতে বেশি। আর ঠিক এখানেই কণাটির অবস্থানের অনিশ্চয়তা সব চাইতে কম। কিন্তু শীর্ষস্থানে ওয়েভ ফাংশন খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়, কারণ ওইখানটাতেই একদিকে সে শিখরে চড়ে, আর একদিকে তার অভিমুখটা বদলে গিয়ে অবনমন শুরু হয়। ফলে এই জায়গায় তার গতিবেগের অনিশ্চয়তা অনেকটাই বেড়ে যায়। কোনও এক সময়ে একটি কণার ওয়েভ ফাংশন জানতে পারলে তার অন্য সময়ের ওয়েভ ফাংশন জানতে পারা যায় শ্রডিঙ্গার সমীকরণ ব্যবহার করে। তাহলে দেখা গেল, কোনও কণার গতি ও অবস্থান একই সঙ্গে সঠিক জানতে না পারলেও তার ওয়েভ ফাংশনের ভবিষ্যতবাণী করা সম্ভব। অর্থাৎ পুরোটা না হলেও অর্ধসত্য উদ্ঘাটন করতে আমরা সক্ষম হব।
প্রফেসর হকিং বললেন, কণাদের গতিবেগ আর অবস্থান জানবার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা আরও তীব্র হল মহাকাশ তত্ত্বে। অভিকর্ষজ টান প্রবল হলে স্থান-কাল দুমড়ে যায়। কোনও কোনও জায়গা আমরা দেখতেই পাই না, তাই সেখানে কণাদের অবস্থান করার অনিশ্চয়তা অসীম হয়ে ওঠে। ১৭৯৯ সালে লাপ্লাস তাঁর লেখা একটি গবেষণা পত্রে দেখান, কিছু কিছু নক্ষত্রের অভিকর্ষজ টান এত প্রবল হতে পারে যে, আলোও সেখান থেকে বেরোবার রাস্তা খুঁজে পায় না, আবার ঘুরে গিয়ে নক্ষত্রের দিকেই সে ফিরে যায়। এমনকি তিনি অঙ্ক কষে দেখিয়ে দেন— যদি সূর্যের সমান ঘনত্বের কোনও নক্ষত্রের ভর সূর্যের চাইতে আড়াইশ গুণ বেশি হয়, তবে আলোর এই অভিকর্ষজ টানে ফিরে যাওয়ার ধর্ম দেখতে পাওয়া যাবে। এই গবেষণাপত্র প্রকাশের ষোল বছর আগে জন মিচেল রয়াল সোসাইটিতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এমন নক্ষত্রের সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যদিও মনে হয় লাপ্লাস সে ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। মিচেল এবং লাপ্লাস দুজনেই আলোর কণাধর্মের কথা মেনে নিয়ে ভেবেছিলেন, অভিকর্ষজ টানের ফলে আলোর কণাদের গতিবেগ কমে যায়। এই ধারণার ভীত নড়ে গেল যখন ১৮৮৭ সালে দুই আমেরিকান পদার্থবিদ— মাইকেলসন এবং মোরলে প্রমাণ করে দিলেন, আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে একশো ছিয়াশি হাজার মাইল, সে যেখান থেকেই সেই আলো আসুক না কেন। তাহলে অভিকর্ষজ বলের আলোর গতিবেগের উপর কোনও প্রভাবই থাকতে পারে না।
স্থান- কালের সেই সময়ের ধারণা অনুযায়ী আলোর এই ধর্মের ব্যাপারটা মেনে নেওয়া শক্ত ছিল। কিন্তু ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর বৈপ্লবিক সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সামনে আনলেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, স্থান এবং কাল বা সময়ের স্বাধীন ও পৃথক অস্তিত্ত্ব নেই, তাদের আছে কেবল ভিন্ন মাত্রা। স্থান-কাল সমতল নয়, ভিতরের শক্তির দৌলতে তারা দুমড়ে মুচড়ে যায়।
ধরা যাক ঝুলিয়ে রাখা একটা রাবারের চাদরের উপর স্টিলের বল ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। যত বল ফেলা হবে, তত বেশি দুমড়ে যাবে রবারের চাদর। স্টিলের আরও বল ফেলা হতে থাকলে একটা সময় এমন অবস্থা হবে, যখন চাদর ফুটো হয়ে যাবে, আর সেখান থেকে বলগুলো উদ্ধার করা যাবে না। একে বলা হয় সংকট ভর বা ক্রিটিকাল মাস। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এটিই হল গোড়ার কথা। একটা নক্ষত্র তার চারপাশে স্থানকালকে এমনি করেই দুমড়ে দেয়। যত তার ভর আর ঘনত্ব বেশি হবে, দুমড়ে যাওয়াটাও বেশি হবে। যদি একটা বিশাল ভরের নক্ষত্র তার সব পারমাণবিক জ্বালানী ফুরিয়ে ফেলে সংকুচিত হয়ে যেতে থাকে, তবে একসময়ে সেখানেও একটা স্থান-কালের ফুটোর সৃষ্টি হবে, যেখান থেকে আলোও বেরোতে পারবে না। একেই বলা হয় ব্ল্যাকহোল, যার নামকরণ করেছিলেন জন হুইলার।
মহাকাশে পর্যবেক্ষণ করে বাইনারি স্টার ও গ্যালাক্সিতে এমন ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ব্ল্যাকহোলে পড়ে গিয়ে শুধুমাত্র কোনও কণা বা দুর্ভাগা নভশ্চরই নয়, পড়ে যাওয়া সব জিনিসের তথ্যও হারিয়ে যাবে, অন্তত আমাদের বিশ্ব থেকে। হকিং –এর মতে, যতদিন পর্যন্ত এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে ব্ল্যাকহোল চিরস্থায়ী একটি বস্তু, ততদিন তথ্যের হারিয়ে যাওয়ার ব্যপারটা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু যেদিন তিনি আবিষ্কার করলেন ব্ল্যাকহোল সম্পূর্ণ ব্ল্যাক নয়, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী ব্ল্যাকহোল থেকে কণা বা তথ্যের নিষ্ক্রমণ সম্ভব, তখন প্রচালিত ধ্যানধারণা বদলে গেল। আসলে আমরা মহাকাশে যাকে শূন্যস্থান বলে ধরে নিই, সেই জায়গাটা শূন্য নয়, ভার্চুয়াল কণায় ভরা। ভার্চুয়াল কণা হল একজোড়া কণা যাদের বলা হয় পারটিক্ল ও এন্টি- পারটিক্ল। তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়, আবার মিলিত হয়ে ধ্বংসও হয়ে যায়। মহাকাশের এই শূন্যস্থানের এই খেলার নাম দেওয়া হয়েছে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন। একমাত্র কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করেই ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন ব্যাখ্যা করা যায়।
উদাহরণ দিয়ে ডক্টর হকিং বললেন — ধরা যাক ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি একজোড়া ভার্চুয়াল কণা হাজির হল, আর এর একটি ব্ল্যাক হোলে পড়ে গেল। এবার দ্বিতীয় কণাটির দুটো অবস্থা হতে পারে। এক, সে ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। দুই, সে ব্ল্যাক হোল থেকে অনেক দূরে ছুটে যেতে পারে। যদি কেউ দূর থেকে কণা দুটোর গতিবিধি লক্ষ করে, তবে দ্বিতীয় কণাটির ক্ষেত্রে তার মনে হবে সেটি যেন ব্ল্যাক হোল থেকে বেরিয়ে এল। তাহলে দেখা গেল, ব্ল্যাক হোলের কাছে কোনও কণা বা বস্তুর অবস্থান ও গতিবেগ নিয়ে কোনও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। এখানেই সনাতন পদার্থবিদ্যার হার হল, আমরা জানতে পারলাম, বস্তুর অবস্থান নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করা যাবে না, বা করলেও অর্ধসত্য থাকবে সেই বয়ানে। তাই মনে হয়, আইনস্টাইন যখন বলেছিলেন যে, ভগবান পাশা খেলেন না, তখন তিনি বিরাট একটা ভুল করেছিলেন। ভগবান শুধু পাশাই খেলেন না, তিনি অস্থানে কুস্থানে সেই পাশা ছুঁড়েও দেন, যেখানে আমাদের দৃষ্টি পোঁছয় না।