ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের জন্ম শতবর্ষে বক্তৃতা করতে এসে আইনস্টাইন উক্তি করেছিলেন, বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত নিউটনের পর যদি পদার্থবিজ্ঞানে সাড়া জাগানোর মতো কাজ কেউ করে থাকেন, তিনি হলেন ম্যাক্সওয়েল। সম্ভবত আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ম্যক্সওয়েলের সমীকরণের ব্যবহারিক তাৎপর্য বুঝেই এহেন উক্তি করেছিলেন।
তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্বে ম্যাক্সওয়েলের বিখ্যাত সমীকরণ অনেকেরই জানা। শিক্ষার তিনটি উপজীব্যের কথা বলতেন ম্যাক্সওয়েল—আঙুল, মস্তিষ্ক আর হৃদয়। তাঁর মতে, আঙুল ব্যবহার করে যা শেখা যায়, তাতে আছে প্রচুর পরিশ্রম। তবে আঙুল দিয়ে যা শিখে নেওয়া যায়, তা শিখে ফেলা বিষয়টা মনে রাখতে সাহায্য করে। মাথা খাটিয়ে শিখতে গেলে লাগে একটা সর্ষের দানার মতো ধারণা। সেটা একবার আয়ত্বে এসে গেলেই সব দুশ্চিন্তার অবসান। হৃদয় দিয়ে যা শিখে নেওয়া যায়, তাতে উদ্বেগ বেড়ে যায়, বাড়ে দুশ্চিন্তাও, কিন্তু শেখাটা হয় খাঁটি।
ম্যাক্সওয়েলের জীবনীকারেরা সবাই একটি বিষয়ে একমত ছিলেন যে, উল্লিখিত তিনটি উপজীব্যেরই সমান অধিকারী ছিলেন তিনি। অর্থাৎ যে কাজটাই করতেন, তাতে সমানভাবে ব্যবহার করতেন আঙুল, মস্তিষ্ক আর হৃদয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মেধাবী ছাত্রটি পড়াশুনো চলাকালীন তার আঙুল, হৃদয় ও মস্তিষ্কের সমান পারদর্শিতার পরিচয় দেন। পদার্থবিদ্যার জটিল বিষয়বস্তু সহজ করে বোঝানোর জন্য সঠিকভাবে তিনি ব্যবহার করেন বাস্তব এবং ম্যাথেমেটিক্যাল মডেল। অভূতপূর্ব স্বকীয় বৈজ্ঞানিক ধারণার জন্ম দেন ম্যাক্সওয়েল। তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্বের প্রথম গবেষণাপত্রে তিনি লেখেন, ‘বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকের নীতিগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য খোঁজাই একজন গবেষকের কর্তব্য। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক সাদৃশ্যের খোঁজ পাওয়া গেলেও নীতিগুলো বুঝতে সুবিধা হয়।’ ম্যাক্সওয়েলের গবেষণায় এমন বহু চমৎকার সাদৃশ্যের দেখা পাওয়া যায়। নিজের কাজ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আদপে এটা কোনও তত্ত্বই হয়তো নয়, তবে মনে হয় আমার গবেষণা প্রকৃতির আসল সত্যের কিছুটা অন্তত জানতে সাহায্য করবে।’ তাঁর গবেষণাপত্র পড়লে মনে হয়, একের পর এক মডেল দাঁড় করিয়ে, শেষে যেন নিজেই সব ভেঙে দিয়ে তুলে ধরেন তার প্রণীত সমীকরণ—আজ বিজ্ঞানের জগতে যা ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বকীয় সমীকরণ বলে খ্যাত।
ম্যাক্সওয়েলের জীবনীকার এভারিটের মতে, ম্যাক্সওয়েল ছিলেন একজন স্থপতি চিন্তাবিদ। স্থাপত্য শিল্পের মতো ছিল তাঁর কাজ। ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে একটা কাঠামোতে দাঁড় করাতেন। তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্বের অনবদ্য কাঠামোটি দাঁড় করাতে ম্যাক্সওয়েল প্রায় দুই দশক সময় নেন। দুই পূর্বসূরি উইলিয়াম থমসন ও মাইকেল ফ্যারাডের অনবদ্য কাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ম্যাক্সওয়েল ইলেক্ট্রিসিটি এবং ম্যাগনেটিজমের সব সূত্রকে একসূত্রে গেঁথে আলোর তড়িৎচুম্বকীয় ধর্মের কথা শোনান তাঁর গবেষণায়। অভূতপূর্ব এই কাজে তিনি সমানভাবে কাজে লাগান তাঁর মস্তিষ্ক এবং হৃদয়, যাতে মেশানো ছিল উদ্বেগ, মেশানো ছিল আবেগ এবং এক অসাধারণ মননশীলতা, এক অনবদ্য জাদু।
১৮৩১ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবর্গে জন্ম হয় জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের। তাঁর বাবা জন ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল উত্তরাধিকারসূত্রে বিপুল সম্পত্তির অধিকারি হন। নিজেদের বাগানবাড়িতে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ হতে থেকে অন্তর্মুখী হয়ে যান ম্যাক্সওয়েল। তাঁর মা অল্প বয়সেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মাতৃহারা জেমসকে এক অদ্ভুত নির্বিকারত্ব গ্রাস করে। জন ম্যাক্সওয়েল তাঁর ছেলে জেমসকে পড়াশুনো করার জন্য পাঠিয়ে দেন এডিনবর্গে। গাঁয়ে মানুষ হবার ফলে শহরের আদবকায়দা জানতেন না কিশোর জেমস। স্কুলে সব ছেলেরা তাঁকে ‘ড্যাফটি’ নাম দেয়, যার অর্থ হল বোকা মানুষ। সহপাঠীদের উপহাস উপেক্ষা করেই চলল ম্যাক্সওয়েলের নিভৃত সাধনা। কিশোর জেমস এক অভূতপূর্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন জ্যামিতিক কায়দায় উপবৃত্ত এঁকে ফেলার। তাঁর এই কাজটি খুব সহজ ছিল না এবং বিষয়টি মাস্টারমশাইদের নজর কাড়ে।
এডিনবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন জেমস ম্যাক্সওয়েল। পেলেন বিজ্ঞানী ফোর্বস-এর সান্নিধ্য। ফোর্বস তাকে নিজের পরীক্ষাগারে অবাধ স্বাধীনতা দিলেন কাজ শেখার এবং নিজের খেয়ালখুশি মতো যেকোনও পরীক্ষা করার। কাজেই ব্যবহারিক বিজ্ঞানে হাত পাকিয়ে ফেললেন ম্যাক্সওয়েল। এখানেই তিনি সংস্পর্শে এলেন আর এক চমৎকার শিক্ষক উইলিয়াম হ্যামিল্টনের। তিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত এক দার্শনিক। জেমসকে তিনি শেখালেন, প্রকৃতির বিচিত্র রূপের সব সত্যি মানুষের চোখে ধরা পড়ে না, কারণ পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। তাই কিছু বুঝতে বা বোঝাতে গেলে লাগবে একটা মডেল, যেটা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে।
এডিনবর্গ বিশ্ববিদ্যালয় জেমস-এর আঙুল ও মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তিনি এবার উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন কেমব্রিজে কঠিন সব পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হত। জেমস দ্বিতীয় স্থান দখল করে গবেষণার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হলেন। শুরু হল তাঁর প্রিয় বিষয় ইলেক্ট্রিসিটি এবং ম্যাগনেটিজম নিয়ে গবেষণা। গবেষণা শেষ করে ম্যাক্সওয়েল স্কটল্যান্ডের এবারডিন কলেজে শিক্ষকতার কাজ নিলেন। কিন্তু পড়ানোর দক্ষতা আয়ত্ব করতে পারলেন না তিনি। আসলে লিখে বা মডেল বানিয়ে তিনি যেমন নিজের মনের ভাব ও চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করতে পারতেন, বক্তৃতায় সেটা পারতেন না। কাজেই শিক্ষক হিসাবে সুনামের অধিকারী তিনি হতে পারেননি। ফলত ম্যাক্সওয়েল কলেজের চাকরিটি খুইয়ে দুই বছর কর্মহীন হয়ে বসে থাকলেন। এরপর লন্ডনের বিখ্যাত কিংস কলেজে দর্শনের অধ্যাপকের পদে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন তিনি। এখানেও চাকরিক্ষেত্রে সন্তুষ্ট না হয়ে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলেন নিজের গাঁয়ে। তাঁর শৈশবের বন্ধু এবং জীবনীকার চ্যাম্পবেলের মতে, শিক্ষকতায় ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও ম্যাক্সওয়েলের জীবনের সবচাইতে ফলপ্রসূ সময় হল তাঁর লন্ডনের পাঁচ বছরের বসবাস। এই সময়ে শুধু তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্বই নয়, আরও অনেক চমকপ্রদ কাজ করেছিলেন ম্যাক্সওয়েল, যার মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য কাজ হল রঙিন আলোকচিত্র তোলার পদ্ধতি আবিষ্কার। গ্যাসের ধর্ম নিয়েও অনেক মাথা ঘামিয়েছিলেন জেমস।
তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্ব
ওরস্টেড, এম্পিয়ার ও মাইকেল ফ্যারাডের গবেষণায় জানা গিয়েছিল, একটি বিদ্যুৎবাহী তারের চারদিকে চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। আবার দুটি সমান্তরাল বিদ্যুৎবাহী তারের মধ্যে বিদ্যুৎ চালালে তাদের মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ হয়। এর কারণ হল, তার দুটির মধ্যে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হতে থাকলে দুটি চুম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। আকর্ষণ বা বিকর্ষণ নির্ভর করে কোনদিকে বিদ্যুৎ পাঠানো হচ্ছে, তার উপর। এইসব পড়ে বুঝে, ম্যাক্সওয়েলের মস্তিস্কে একটা ধারণা জন্ম নিল। তিনি ভাবলেন, তাহলে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত বিদ্যুৎক্ষেত্রের প্রভাবেও চুম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি হতে পারে। তিনি সবসময়েই বিজ্ঞানের দুটি বিষয়ের ভিতর মিল খুঁজতেন। এক্ষেত্রে তাঁর ধারণার ব্যতিক্রম হল না। বিদ্যুৎক্ষেত্র এবং চুম্বকক্ষেত্রের ধর্মের সঙ্গে অদ্ভুত মিল খুঁজে পেলেন ম্যাক্সওয়েল। এর আগে পর্যন্ত পদার্থবিদেরা ইলেক্ট্রিসিটি এবং ম্যাগনেটিজমকে দুটি ভিন্ন বিষয় হিসাবে গণ্য করতেন। ম্যাক্সওয়েল দুটি ধর্মের মিল ঘটিয়ে দিলেন।
বারো ক্লাসের বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই ক্যাপাসিটরের কথা জানে। এর দুটি প্লেট থাকে। প্লেট দুটির মধ্যের জায়গাটা খালিও থাকতে পারে, আবার অন্য কোনও অপরিবাহী পদার্থ দিয়ে ভরা থাকতে পারে, যাকে বলা হয় ডাই-ইলেক্ট্রিক। ধরা যাক ক্যাপাসিটরের একটা প্লেট একটা ব্যাটারির পজিটিভ টার্মিনাল, আর একটা প্লেট নেগেটিভ টার্মিনালে জুড়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপাসিটরের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হবে। কিন্তু দুটি প্লেটের মাঝের জায়গাটাতে কোনও পরিবাহক নেই। তাহলে বিদ্যুৎ কীভাবে বইছে? ম্যাক্সয়েল বললেন, ওখানেও বিদ্যুৎ বইতে পারে, সেই স্থান ফাঁকা থাকুক বা অপরিবাহী পদার্থে ভরা। ম্যাক্সওয়েল এই কারেন্টের নাম দিলেন, ডিসপ্লেসমেন্ট কারেন্ট। যদি কারেন্ট সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তারের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কারেন্ট আর প্লেটের ফাঁকা জায়গা দিয়ে প্রবাহিত ডিসপ্লেসমেন্ট কারেন্টের মাপ সমান সমান।
ম্যাক্সওয়েল বললেন, ডিসপ্লেসমেন্ট কারেন্টের প্রবাহের কারণে তৈরি হয় তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। মাইকেল ফ্যারাডে তাঁর তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্বে দেখিয়েছিলেন, একটা পরিবর্তিত চুম্বকক্ষেত্রের জন্য সৃষ্টি হয় বিদ্যুৎক্ষেত্র। এবার পদার্থবিদ গসের তড়িৎ ও চুম্বক সূত্র, ফ্যারাডের তড়িৎচুম্বকীয় আবেশের সমীকরণ এবং অ্যাম্পিয়ারের সূত্র একত্র করে ম্যাক্সওয়েল তাঁর বিখ্যাত তড়িৎচুম্বকীয় সমীকরণ প্রস্তাব করলেন। তিনি দেখালেন, তড়িৎক্ষেত্র ও চুম্বকক্ষেত্র পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং পরিপূরক। জটিল সব অঙ্ক কষে ম্যাক্সওয়েল মোট বারোটি সমীকরণ প্রস্তাব করেন, যার থেকে কমিয়ে পরবর্তীকালে শুধু চারটি সমীকরণ রাখা হয়, যাকে বলা হয় ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ।
ম্যাক্সওয়েল দুই খণ্ডে একটা মস্ত বইতে সাজালেন তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। বইটির নাম দিলেন ‘আ ট্রিটাইস অন ইলেক্ট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম’। সে বড়ো কঠিন বই, অঙ্কে ভারী। কিন্তু তিনি যেন স্বপ্নের জগতের হদিস দিলেন মানব সভ্যতাকে। বললেন, সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত বিদ্যুৎক্ষেত্রের প্রভাবে যে চুম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব হয় ক্ষীণ। কিন্তু যদি কোনও ইলেকট্রিক চার্জ একটা জায়গায় দুলতে থাকে, তবে সৃষ্টি হবে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। এই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গতি অঙ্ক কষে বার করে দিলেন ম্যাক্সওয়েল। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব অনুযায়ী, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গতিবেগ নির্ভর করে যে মাধ্যম দিয়ে সে চলেছে, তার তড়িৎ ও চুম্বক ধর্মের উপর। তিনি বললেন, আলোও একটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বৈ কিছুই নয়। শুধু মানুষের চোখে তা ধরা পড়ে এইজন্য যে, সেই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক চোখের কোষকে উজ্জীবিত করতে পারে। আলো ছাড়াও অন্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিশ্চয়ই আছে, তাদেরও সনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু হাতে কলমে দেখিয়ে দিতে হবে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের খেলা। ম্যাক্সওয়েলের আঙুল এই কাজটা করতে পারেনি। তাঁর এক ছাত্র অনেক পরে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ম্যাক্সওয়েল যেন কোনও চেষ্টাই করেননি তাঁর তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্ব হাতে কলমে করে দেখিয়ে দিতে।
১৮৮৭ সালে হাইনরিখ হার্জ ম্যাক্সওয়েল প্রণীত তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখিয়ে দেন। কিন্তু এর বেশ কিছু বছর আগেই ম্যাক্সওয়েল ইহজগত ছেড়ে চলে গিয়েছেন। হার্জ অত্যন্ত সহজ একটি পরীক্ষা করেন (নিচে চিত্র দেওয়া হল)। একটি ট্রান্সফর্মার ও সাধারণ ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিট ব্যবহার করে একটি বড়ো কয়েলের ফাঁকে তিনি সৃষ্টি করেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। কয়েলের দুটি প্রান্তে উচ্চ বিদ্যুৎশক্তির প্রভাবে সৃষ্টি হল স্ফুলিঙ্গ। ফাঁকা জায়গায় ইলেক্ট্রিক্যাল চার্জ আন্দোলিত হল, যেমন ম্যাক্সওয়েল চেয়েছিলেন। সেই তরঙ্গ একটু দূরে আর একটি কয়েলের ফাঁকে গিয়ে স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করল। বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটল পৃথিবীতে।
পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এর অনতিবিলম্বে প্রমাণ করেন যে, কোনও উত্তপ্ত বস্তু থেকে যে রশ্মি বিকিরিত হয়, তাও ম্যাক্সওয়েল প্রবর্তিত তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। তখনকার প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে, সূর্য বা অন্য উত্তপ্ত বস্তু থেকে যে তাপ বিকিরিত হয়, তার মান শূন্য থেকে শুরু করে অসীম হতে পারে। কিন্তু প্ল্যাঙ্ক বললেন, যেহেতু গরম বস্তু থেকে নির্গত রশ্মি আসলে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, তাই সেই শক্তি নির্গত হয় ফোটনের মাধ্যমে, যা নিরবিচ্ছিন্ন নয়। কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার সূত্রপাত হল এখানেই।
গ্যাসের তাপগতিবিদ্যা তত্ত্ব
তড়িৎচুম্বকীয় সমীকরণের জন্য খ্যাতিলাভ করলেও ম্যাক্সওয়েল পদার্থবিদ্যার অন্যান্য শাখায় যুগান্তকারী কাজ করে গেছেন। জীবনের একটা সময় তিনি তাপগতিবিদ্যা বা থার্মোডায়নামিক্সের উপর কাজ করে গেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম গ্যাস অণুদের গতি নির্ধারণের জন্য প্রবাবিলিটি এবং সংখ্যাতত্ত্ব ব্যবহার করেন। পদার্থবিদ্যার উঁচু ক্লাসে এই তত্ত্ব ম্যাক্সওয়েল-বোলজম্যান ডিস্ট্রিবিউশন নামে পড়ানো হয়। আগে মনে করা হত যে কোনও গ্যাসের সব অণুরই গতিবেগ সমান। কিন্তু এই ধারণা খারিজ করে দেন ম্যাক্সওয়েল। ধরা যাক একটা বন্ধ কাচের পাত্রে একটা গ্যাস ভরে দেওয়া হল। অণুগুলোর চলাফেরা চোখে দেখা যায় না বলেই ম্যাক্সওয়েলের পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন সব অণুগুলোর গতিবেগ এক। বোলজম্যান অনেকটা কাজ এগিয়ে রেখেছিলেন। এবার ম্যাক্সওয়েল গ্যাস অণুর গতিবেগের পরিমাপ করতে অঙ্ক ব্যবহার করে দেখিয়ে দিলেন, একটি বিশেষ তাপমাত্রায় অণুগুলোর গতিবেগ প্রায় সমান সমান হওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি হতে পারে, কিন্তু সব অণুর গতিবেগ এক হতে পারে না। কম গতিবেগের অণুর সংখ্যা যেমন কম, বেশি গতিবেগের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। নিচে দেওয়া গ্রাফ দেখলেই গ্যাসের তাপগতিবিদ্যার এই সহজ বর্ণনা বোঝা যাবে। এক্স অক্ষে অণুর গতিবেগ এবং ওয়াই অক্ষে যদি প্রতি একক গতিবেগে অণুর সংখ্যা প্লট করা হয়, তবে আমরা পাব একটা ঢেউ, যার অর্থ হল, ওই গতিবেগের অণুর সংখ্যা সবচাইতে বেশি। এবার যদি কাচের পাত্রে রাখা গ্যাসকে গরম করা হয়, তবে কিন্তু গ্রাফের চেহারা এক থাকবে, ঢেউ সরে যাবে ডানদিকে, অর্থাৎ তাপমাত্রা বেশি হলে অণুদের গতিবেগ যাবে বেড়ে। যত তাপমাত্রা বাড়বে, ততই ঢেউয়ের চূড়া উচ্চতায় ছোটো হয়ে যাবে। এর অর্থ হল, কম সংখ্যক অণুর গতিবেগ সবচাইতে বেশি মাপের হবে। এবার যদি ঢেউ খেলানো গ্রাফের ভিতরের অংশের ক্ষেত্রফল বার করা যায়, তা হবে কাচের পাত্রে রাখা মোট অণুর সংখ্যার সমান। তাপগতিবিদ্যার গ্যাসের গতিবিধির যে ব্যাখ্যান ম্যাক্সয়েল-বোলজম্যান দিলেন, তা ছিল একেবারে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত।
এ তো গেল ম্যাক্সওয়েলের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অবদানের কথা। আঙুলের কাজ বলতে তিনি যা ভাবতেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় আলোর উপর তাঁর করা পরীক্ষাগুলিতে। প্রথম রঙিন ছবি তোলার কৃতিত্ব তাঁরই। একটি রঙিন রিবনের রঙিন ছবি তুলতে সক্ষম হন ম্যাক্সওয়েল। এর আগে বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং জানিয়েছিলেন, মানুষের চোখের পর্দায় মূলত ধরা দেয় তিনটি রঙ—লাল, সবুজ ও নীল, যাদের বলা হয় প্রাথমিক রঙ। ম্যাক্সওয়েল রঙিন রিবনের তিনটে ভিন্ন ছবি তোলেন তিনটে ফিল্টার ব্যবহার করে। তারপর তিনটে ছবি তিনটে বিভিন্ন প্রজেক্টারের মধ্যে দিয়ে একটা পর্দায় একসঙ্গে প্রক্ষিপ্ত করে দেখান কীভাবে রিবনের রঙিন ছবি তোলা যায়। তিনি এই বিষয়ে রয়্যাল সোসাইটিতে যে উপস্থাপনা দেন, তাতে এই কথাও বলেন যে, রঙিন ছবি তোলার এই পদ্ধতি যথেষ্ট জটিল, তাই রঙিন ছবি সহজে তোলার জন্য কোনও বিশেষ ফিল্ম এবং প্রলেপ ব্যবহার করতে হবে ভবিষ্যতে।
ছোটবেলা থেকে ম্যাক্সওয়েল কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন। প্রকৃতির রহস্যের দর্শনই হোক কিংবা অঙ্কের জটিল তত্ত্ব—সবেতেই কবিতার মাধ্যমে নিজের ভাব ফুটিয়ে তুলতেন ম্যাক্সওয়েল। কখনও সমাজের প্রতি ব্যঙ্গ ঝড়ে পড়ত তাঁর লেখনীতে। গতিবিদ্যার একটা জটিল অঙ্কের সমাধান করতে ম্যাক্সওয়েলের লম্বা এক কবিতা লিখে ফেলেন।
মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তলপেটের ক্যান্সার রোগে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তাঁর কর্মজগত থেকে বিদায় নেন। মারা যাওয়া অবধারিত জেনেও শেষের দিনে একবার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মীকে তিনি বলেন, ‘আমি সারাটা জীবন বড়ো শান্তিতে কাটিয়েছি। যেন বাকি দিনগুলোও এই প্রজন্মের সেবায় নিয়োগ করতে পারি। তারপর নাহয় চিরদিনের মতো একেবারে শান্তির ঘুম ঘুমোব।’
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর বক্তৃতা করতে এলে আইনস্টাইনকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি গবেষণায় নিউটনের কাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আছেন?’
জবাবে আইনস্টাইন বলেন, ‘একেবারেই না। আমি দাঁড়িয়ে আছি জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের কাঁধের উপর।’
ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যার জগতে তাই নিজের অসামান্য গবেষণার জন্য ম্যাক্সওয়েলকে বলা হয় পদার্থবিদ্যার জাদুকর।