ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
রসায়ন শাস্ত্রের জনক – আন্তয়েন ল্যাভোসিয়ের
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ থেকে তিনশো বছর আগে রসায়ন শাস্ত্র বলে বিজ্ঞানের কোনও শাখা তেমন ভাবে উন্নত হয়ে উঠতে পারেনি, যদিও পদার্থবিদ্যা বা জ্যোতির্বিজ্ঞানে ততদিনে অনেক নতুন আবিষ্কার ঘটে গেছে। রসায়ন বিজ্ঞানকে তখনো জাদুবিদ্যার থেকে বেশি কিছু বলে কেউ ভাবতে পারত না। এক বা একাধিক মৌল ও যৌগের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটিয়ে ভেল্কি দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার চলন ছিল তখনকার সভ্য সমাজে। অ্যালকেমি চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল রসায়নের সব কর্মকাণ্ড। অ্যালকেমিস্টদের একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল — কোনও উপায়ে সোনা তৈরি করে ফেলা। এমনকি স্বনামধন্য পদার্থবিদ নিউটন সাহেবও জীবনের শেষ দিকে এই অ্যালকেমির কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে সোনা তৈরির বৃথা কাজে কালক্ষেপ করেছেন।
ফ্রান্সে ১৭৪৩ সালে জন্মেছিলেন আন্তয়েন ল্যাভোসিয়ের। তাঁকেই বলা হয় রসায়ন শাস্ত্রের জনক। অ্যালকেমি থেকে এক অসাধারণ বিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক রূপ দেওয়ার জন্যই তাঁর নাম স্মরণ করা হয়। তিনি যখন ফ্রান্সের এক অভিজাত উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন, তখন সেখানে সাধারণ মানুষ ছিল বেজায় গরিব। একদিকে মুষ্টিমেয় উচ্চবংশজাত একদল মানুষ যখন গান বাজনা ছবি আঁকায় প্রসিদ্ধি লাভ করে ফেলেছে, তখন সমাজের নীচুতলার মানুষ অত্যন্ত নিম্নমানের জীবন যাপন করত। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তারা কোনোরকমে দিন গুজরান করত।
ছেলেবেলা থেকে বিজ্ঞানের নানা শাখা, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় ল্যাভোসিয়েরের মধ্যে। কলেজের শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পর তাঁর বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী তিনি আইন নিয়ে পড়াশুনো করেন। কিন্তু বিজ্ঞানের আগ্রহকেও তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজের ভিতরে। তাই পেশা হিসাবে আইনকে তুলে নিয়েও তাঁর বিজ্ঞানচর্চা থেমে থাকেনি। আইনের মারপ্যাঁচ তাকে একজন দক্ষ লিপিকর হিসাবে গড়ে তোলে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ফলাফল অতি সুন্দরভাবে গ্রন্থনা করে লিখে রাখতেন ল্যাভোসিয়ের। ফ্রান্সের শহর প্যারিসের রাস্তায় আলোর নব্য ব্যবস্থার প্রস্তাব নিয়ে অতি সুন্দর এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে তিনি এত খ্যাতি লাভ করেন যে, রয়্যাল একাডেমি অফ সায়েন্স তাকে সংস্থার সভ্যপদ অর্পণ করে। এই সভ্যপদ সেই সময়ে এত কম বয়সে আর কেউ লাভ করেনি। এর আগেও ভূতত্ত্বের উপর অনেক নতুন আলোকপাত তাঁকে খ্যাতির উচ্চাসনে বসিয়ে দিয়েছিল।
বিজ্ঞানের কাজে নিরন্তর উৎসাহ আইনের পথে তাঁকে খুব বেশিদিন হাঁটতে দেয়নি। আইন ছেড়ে তিনি রয়্যাল একাডেমিতে প্রথম যে কাজে হাত দেন সেটি হল — জিপসামের প্রকৃতি ও ধর্ম। এই কাজ থেকে সৃষ্টি হল প্লাস্টার অফ প্যারিস, যার বহুল ব্যবহার আজকের দিনে আর কারো অজানা নেই। পরবর্তী কাজ হল অক্সিডেশন-রিডাকশন বা জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া। অক্সিজেন যে প্রাণীদেহে শ্বসণ ক্রিয়া ঘটার সময় খাদ্য পোড়ানোর কাজে সাহায্য করে, সেটি তিনিই আবিষ্কার করেন। এর আগে বিজ্ঞানীরা জানতেন, কোনও ধাতু পোড়ানো হলে একটা গ্যাস সেই বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কী সেই গ্যাস, তার হদিশ দিলেন ল্যাভোসিয়ের। তিনি বললেন, গ্যাসটি বাতাসেই মজুদ আছে, তাই বাতাসের সংস্পর্শ ছাড়া কোনও কিছু পোড়ানো সম্ভব নয়। তিনি সেই গ্যাসের নাম দিলেন- অক্সিজেন। ধাতু পোড়ালে অ্যাসিড তৈরি কীভাবে হয় তার প্রথম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এল তাঁরই হাত ধরে। অ্যাসিড ও সল্ট তৈরির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নথিবদ্ধ করে ল্যাভোসিয়ের প্রমাণ করেন, প্রতিটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভরের সমতা সূত্র মেনে চলে। রাসায়নিক বস্তুদের নামকরণের সঠিক পদ্ধতি প্রবর্তন করার সর্বপ্রথম চেষ্টার স্বীকৃতি ল্যাভোসিয়েরকেই দেওয়া হয়।
রয়্যাল একডেমিতে কাজে যোগ দেওয়ার পর তিনি এক অসাধারণ মেয়েকে বিয়ে করেন। তার নাম মেরি এ্যান। তিনি ল্যাভোসিয়েরের থেকে বয়সে অনেক ছোট ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধিমতী এই মেয়েটির বিজ্ঞানে আগ্রহ তাঁকে করে তুলল স্বামীর উপযুক্ত সহায়ক। পরীক্ষাগারে দুর্দান্ত সব পরীক্ষানিরীক্ষায় ল্যাভোসিয়েরকে সাহায্য করে বিজ্ঞানে এক চমৎকার অবদান রেখে যান। ল্যাভোসিয়ের ইংরেজি জানতেন না। কিন্তু তার সহধর্মিণীটি ইংরেজিতে বেজায় দক্ষ ছিলেন। ইংরেজিতে প্রকাশিত বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় বই ও প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলো তিনি ফরাসীতে তর্জমা করায়, ল্যাভোসিয়ের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কাজের খোঁজখবর খুব সহজেই পেয়ে যান।
প্রাণীদেহে শ্বসণ ক্রিয়া নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইডের স্বরূপ ধরতে পারেন ল্যাভোসিয়ের। প্রাণীদেহে শ্বসণ ক্রিয়া ও বাতাসের উপস্থিতেতে যে কোনও বস্তুর পুড়ে যাওয়া, যে একই ধর্মের, সেটি বুঝিয়ে দেন ল্যাভোসিয়ের।
বাতাসের উপস্থিতিতে কোনও ধাতু পোড়ালে তার ওজন বেড়ে যায়, সেটা অন্যান্য বিজ্ঞানীরা লক্ষ করলেও এর ব্যাখ্যা করতে পারেননি। ল্যাভোসিয়ের তার গবেষণায় প্রমাণ করেন, ধাতুর ওজন বৃদ্ধির কারণ, ধাতু ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় ধাতব অক্সাইডের জন্ম। তিনি পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করেন, যতটা অক্সিজেন গ্যাস উপস্থিত বাতাস থেকে কমে যায়, ঠিক ততটাই ধাতব অক্সাইডের ওজন বৃদ্ধি হয়। ল্যাভোসিয়েরের এই কাজ ভরের নিত্যতা সুত্র প্রমাণ করে।
তিনি আরও লক্ষ করেন, শ্বসণ ক্রিয়া বা অক্সিডেশনের সময় তাপ সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই তাপ নতুন করে সৃষ্টি হয় না — তাপশক্তি নিহিত থাকে বস্তুর মধ্যেই। অক্সিজেনের সংস্পর্শে সেই তাপ কেবলমাত্র বস্তু থেকে নির্গত হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় উৎপন্ন তাপশক্তি মাপবার জন্য বিজ্ঞানাগারে যে ক্যালরিমিটার আজও ব্যবহার হয়, সেটির জন্ম ল্যাভোসিয়েরের হাতে। এই কাজে তিনি অপর এক প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর সাহায্য নেন, তার নাম পিয়েরে সাইমন লাপ্লাস —পরবর্তীকালে যিনি ভৌত বিদ্যা, অঙ্ক, প্রযুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সংখ্যা তত্ত্বে অজস্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন।
এরপর ল্যাভোসিয়ের গান-পাউডার বা বারুদ তৈরির নতুন প্রকরণ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই গবেষণা ফ্রান্সের শাসকদের সামরিক অস্ত্র তৈরির কাজে লাগার কারণে তিনি অর্থের সাথে যশ লাভও করেন। ব্যস্ত বিজ্ঞানীটির সহধর্মিণী তার সমস্ত গবেষণার নথিপত্র নিখুঁত দক্ষতায় লিপিবদ্ধ করে লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। দেশ বিদেশ থেকে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ল্যাভোসিয়েরের কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতেন এই লাইব্রেরিতে পড়াশুনো করতে এসে। এই সময়ে ল্যাভোসিয়েরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রাসায়নিক বস্তু সমূহের বৈজ্ঞানিক নামকরণ। সালফিউরিক অ্যাসিড ও সালফেট, তাঁরই দেওয়া নাম।
আইন শিক্ষা ল্যাভোসিয়েরকে একজন অত্যন্ত সমাজ-সচেতন সংবেদনশীল মানুষ হয়ে গড়ে তুলেছিল। ফরাসী বিপ্লবের হাওয়া তখন ফ্রান্সের জনজীবনকে উত্তাল করে তুলেছে। ল্যাভোসিয়ের তখন ফরাসী প্রশাসণে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাই রসায়ন ছেড়ে তিনি ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন। কৃষি ও শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে সাধারণ ফরাসীদের কীভাবে উন্নতি করা যায়, সে নিয়ে দলিল লিখে জমা করেন ফরাসী সরকারের কাছে। কর সংশোধন নিয়ে ফরাসী সরকারের কাছে কিছু প্রস্তাব জমা করে তিনি বেশ কিছু শত্রু তৈরি করে ফেলেন প্রশাসনে ও প্রশাসনের বাইরে। সরকারবিরোধী ফরাসী বিপ্লবের নেতারা ল্যাভোসিয়েরকে গরিবের শত্রুর তকমা লাগিয়ে দেয়। ফরাসী বিপ্লবের ফলে জনগণের সরকার স্থাপিত হলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারের প্রহসনে ল্যাভোসিয়েরের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। মাত্র একান্ন বছর বয়সে ল্যাভোসিয়েরকে গিলোটিনে প্রাণ দিতে হয়। এক প্রতিভাশালী বিজ্ঞানীর কর্মজীবনের করুণ অবসান হয়। ল্যাভোসিয়েরের মৃত্যুর পরদিন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু গণিতজ্ঞ জোসেফ লুই ল্যাগ্রাঞ্জ বিবৃতি দেন – “ল্যাভোসিয়েরের মাথাটা কেটে নিতে ওদের এক মুহূর্তকাল সময় লাগল, কিন্তু এমন একটা মাথা তৈরি হতে একশ বছরও কম পড়ে যাবে।”
ফ্রান্সের মিউজিয়ামে নিজস্ব পরীক্ষাগারে ল্যাভোসিয়েরের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এখন যত্নসহকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে।