ভারত ও বিশ্বের বৈজ্ঞানিক-সব লেখা একত্রে
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় জার্মানির হ্যানোভার শহর ছিল ইংরেজদের অধীনে। রাজা জর্জ-২ ইংল্যান্ড ও হ্যানোভার দুটিরই শাসন কর্তা ছিলেন। তখন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে একেবারে সাপে নেউলে সম্পর্ক। কে কার রাজ্য অধিকার করে বেশি সম্পদ ও ক্ষমতা অধিকার করবে, তার প্রতিযোগিতা নিত্যদিন লেগেই থাকত। হ্যানোভারের সেনাবাহিনীর উপর কর্তৃত্ব করতেন ইংল্যান্ডের রাজারা। সেই সামরিক বাহিনীতে আইস্যাক হার্শেল ছিলেন এক দক্ষ ওবো বাদক। কাঠের তৈরি ওবো দেখতে অনেকটা সানাইয়ের মতো ছিল। আইস্যাক শুধু যে নিজেই যন্ত্রটি বাজাতেন তাই নয়, তিনি তার দুই পুত্র জেকব ও উইলহেমকেও খুব যত্নে ওবো বাজাতে শিখিয়েছিলেন। আইস্যাকের দুই পুত্রই খুব তাড়াতাড়ি বাবার কাছ থেকে জার্মান শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে নিতে, দক্ষ যন্ত্রশিল্পী হয়ে ওঠে। ছেলেদের খুব অল্প বয়সেই তাদের বাবা আইস্যাক সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিয়ে দেন ওবো বাদক হিসেবে।
আইস্যাকের ছোট ছেলে উইলহেম সব কিছুই খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্বে এনে ফেলত, যে কোনও বাদ্যযন্ত্রই হোক, বা স্কুলের পড়াশুনোর পাঠই হোক। ওবো ছাড়াও বেহালা বাজানোর দিকে ঝোঁক চাপল উইলহেমের। বেহালা বাজানোতেও বেশ খ্যাতি পেল কিশোর উইলহেম। অঙ্ক আর বাজনা এই হল তার ধ্যান জ্ঞান। বাজনার ছন্দের সাথে অঙ্কের অদ্ভুত মিল খুঁজে পেল সে। বেশ কিছু নতুন সুরও রচনা করে ফেলল উইলহেম।
হার্শেলদের পরিবারের সুখের মধ্যে বাধ সাধল যুদ্ধ। ফ্রান্স হটাত হ্যানোভারের উপর তার আধিপত্য খাটানোর জন্য সেনা পাঠিয়ে দিল। আইস্যাক তার দুই ছেলের সুরক্ষার জন্য তাদের ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিলেন। উইলহেমের জীবন থেকে সেনাবাহিনীর কাজে বিরতিই শুধু হল না, পড়াশুনোও লাটে উঠল। এদিকে ইংল্যান্ডে গিয়ে উইলহেম বেজায় অসুবিধায় পড়ে গেল। সে শুধু জার্মান ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষাই জানে না। তাই প্রথমেই সে ইংরেজি শেখার স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। খুব কম সময়ের মধ্যে খুব ভালো ইংরেজি শিখে ফেলল উইলহেম। পরবর্তী কাজ হল, পেট চালানোর জন্য কাজের সংস্থান। উইলহেম তখন যুবক, উনিশ বছর বয়স। বেহালা শেখার ছাত্র-ছাত্রী লন্ডন শহরে খুঁজে নিতে অসুবিধা হল না। তাই গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হয়ে গেল। বেহালার সাথে সাথে বাঁশি বাজানোর জন্য তালিম নিতে লাগল উইলহেম। সঙ্গীত তার রক্তে। তাই নিত্য নতুন বাদ্যযন্ত্রে নিজেকে পারদর্শী করে তুলে অল্প বয়সেই প্রায় চব্বিশটি সঙ্গীত রচনা করে লন্ডনের সঙ্গীত জগতে উইলহেম সহজেই জায়গা করে নিল। মাত্র তেইশ বছর বয়সে উইলহেম লন্ডনের বিখ্যাত নিউক্যাসেল অর্কেস্ট্রাতে একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে যোগ দিল। কিন্তু একজায়গায় স্থিতু হওয়ার মানুষ ছিল না উইলহেম। সে আরও উন্নতির আশায়, ইংল্যান্ডের অন্য শহরেও একের পর পাড়ি দিয়ে, নতুন নতুন অর্কেস্ট্রা কোম্পানিতে ভাগ্য পরীক্ষা করতে লাগল।
বাথ শহরের বিখ্যাত অর্কেস্ট্রা কোম্পানি অক্টাগন চ্যাপেলে যোগ দিতে না দিতেই উইলহেম বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠল। চতুর্দিকে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। জার্মান নাম উইলহেম থেকে কখন যে সে উইলিয়াম হয়ে উঠল, খ্যাতির চুড়োয় বসে সে দিকে মন দেওয়ার সময় ছিল না তার।
উইলিয়ামের পাকাপাকিভাবে বাথ শহরে বসবাস করতে থাকায় সেখানে তার বোন ক্যারোলিন ও অন্য তিন ভাই এসে জুটে গেল। সব ভাইবোনেরা মিলে শুরু হল পেশাদারী সঙ্গীত সাধনা। হার্শেল ভাইবোনেদের সঙ্গীতের মূর্ছনা প্রতি সন্ধ্যায় শহরের মানুষকে বাক্যরহিত করে দেয়। উইলিয়ামের বই পড়বার নেশা ছিল প্রবল। রবার্ট স্মিথের লেখা “হারমনিক্স, অর দ্য মিউসিকাল সাউন্ড” বইটা পড়ে মাথা ঘুরে গেল উইলিয়ামের। এতদিন অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গীতের মূর্ছনার মিল খুঁজে পেতেন তিনি। এবার তাঁর মনে হল, এই যে আকাশে গ্রহ নক্ষত্র দেখা যায়, তাদের ছন্দবদ্ধতাও যেন সঙ্গীতের সা-রে-গা- মা-পা–এর মতো, কে যেন এক সুত্রে গেঁথে দিয়েছে। এবার তাঁর মন ঘুরে গেল আকাশ পর্যবেক্ষণে। টেলিস্কোপ ধার করে নিয়ে এসে বাড়িতে বসিয়ে দিলেন উইলিয়াম। ঢাউস টেলিস্কোপ কেনবার মতো আর্থিক সঙ্গতি তার ছিল না, কাজেই ধার করা যন্ত্র দিয়েই কাজ চালাতে লাগলেন। আকাশ পর্যবেক্ষণে উইলিয়ামের সঙ্গী হলেন তাঁর বোন ক্যারোলিন। একসাথে চলতে লাগল দুই ভাইবোনের সঙ্গীত চর্চা ও মাঝরাতে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের রহস্যভেদ করা।
জ্ঞান পিপাসু উইলিয়াম এবার আরও বইপত্র জোগাড় করে নিয়ে এসে পড়তে পড়তে ঠিক করলেন টেলিস্কোপ বানিয়ে ফেলতে হবে। বাজার চলতি টেলিস্কোপে মন ভরে না। আরও দূরের আকাশ দেখতে হবে। ক্যারোলিনও সোৎসাহে জুটে গেলেন ভাইয়ের সাথে। টাকাপয়সা জোগাড় করতে মাথায় ঘাম ছুটে গেল উইলিয়ামের। আর এক ভাই অ্যালেক্সান্ডার, যিনি এতদিন বেহালা বাজাচ্ছিলেন, তিনিও ওদের সাথে হাত লাগালেন। নতুন ধরণের কাঁচ ও প্রিজম দিয়ে উইলিয়ামের টেলিস্কোপ তৈরি হল। তাঁর অজান্তেই তৈরি হয়ে গেল গ্রিনউইচ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তদানীন্তন সর্বাধুনিক টেলিস্কোপের চাইতেও বেশি ক্ষমতাশালী যন্ত্র।
আকাশ দেখতে দেখতে উইলিয়াম আবিষ্কার করলেন নতুন এক গ্রহ, যা ততদিনে খালি চোখে দেখা যায়নি। নাম দিলেন ‘জর্জিয়ান তারা’। রাজা জর্জ ৩ –এর নামে নামকরণ হল। ততদিন পর্যন্ত খালি চোখে মানুষ শুধু পাঁচটি গ্রহই দেখতে পেয়েছিল। উইলিয়ামের আবিষ্কার বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলে দিল। সঙ্গীতের সাধক রাতারাতি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে নাম করে ফেললেন। জর্জিয়ান তারা যে আসলে সূর্যের চারিদিকে পাক খাওয়া একটা গ্রহ, সেটা বুঝতে উইলিয়ামের একটু সময় লেগেছিল। গ্রহটি নাম বদলে হয়ে গেল উইরেনাস। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি উইলিয়ামকে সভ্য পদ দিয়ে দিল। রাজা জর্জ উইলিয়ামকে “কিংস এস্ট্রোনমার” উপাধি দিয়ে মাসহারা দিতে লাগলেন। আরও উন্নত মানের টেলিস্কোপ বানাবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন উইলিয়াম। সঙ্গী, বোন ক্যারোলিন। পেশাদারী সঙ্গীত জগত থেকে পাকাপাকিভাবে বিদায় নিলেন উইলিয়াম হার্শেল। মহাকাশে আরও মহান সুর খুঁজে পেলেন হয়তো। যদিও ইংল্যান্ডের সান্ধ্য সঙ্গীত আসরে বাদ্যযন্ত্রীরা উইলিয়াম হার্শেলের সুর করা সঙ্গীত তখনো বাজিয়ে চলেছে।
নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে উইলিয়াম শনির দুটি চাঁদকে আবিষ্কার করলেন। বাইনারি স্টার বা জোড়া নক্ষত্রের আবিষ্কার হল তাঁরই হাত ধরে। প্রায় ৮৫০ টি জোড়া নক্ষত্র ধরা পড়ে উইলিয়ামের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে। তাদের তথ্য লিপিবদ্ধ হয়। এবার তিনি আর একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে গেলেন। আকাশে আলোকজ্জ্বল নেবুলা দেখে এতদিন মানুষ মনে করত সেটা শূন্যে ঝুলে থাকা গলন্ত তরল। উইলিয়াম তাঁর শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন, নেবুলা আসলে দূরের এক নক্ষত্রপুঞ্জ।
বিভিন্ন ফিলটার ব্যবহার করে সূর্যের বর্ণালী বিশ্লেষণের কাজ করছিলেন উইলিয়াম। তাঁর পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে গেল ইনফ্রা-রেড-রে, যাকে আমরা অবলোহিত রশ্মি বলেও জানি। খালি চোখে এই রশ্মি দেখা যায় না, সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়া তাপশক্তি আসলে এই রশ্মির প্রভাব।
উইলিয়াম বললেন, সৌরজগত একজায়গায় স্থির নয়, মহাকাশে সে সবেগে ছুটে চলেছে, শুধু আমরা টের পাই না। চার্চ প্রচলিত ব্রহ্মাণ্ডের স্থিরতা তত্ত্ব ভেঙে পড়ল (আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে প্রফেসর স্টিফেন হকিংও তাই তাঁর বিভিন্ন লেখায় ও বক্তৃতায় জ্যোতির্বিজ্ঞানে উইলিয়াম হার্শেলের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন)। উইলিয়ামের সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে আর একটি নাম প্রজ্জলিত হল- ক্যারোলিন হার্শেল, উইলিয়ামের বোন।
সারাজীবনে প্রায় চারশোরও বেশি টেলিস্কোপ বানিয়েছেন উইলিয়াম হার্শেল। ছন্দ ও তাল মিলিয়ে যেমন সঙ্গীত রচনা করেছেন, লেন্স ও প্রিজম ব্যবহার করে তেমনি গড়েছেন একের পর এক টেলিস্কোপ, লিখে রেখে গেছেন মহাকাশ গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। উইলিয়াম হার্শেলের স্মরণে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও নাসার যৌথ উদ্যোগে ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ সমেত স্যাটেলাইট পাঠানো হয় ২০০৯ সালে, নাম দেওয়া হয় ‘হার্শেল অবসারভেটরি’।
বাবা আইস্যাকের কাছ থেকে উইলিয়াম সঙ্গীত শিখেছিলেন। নিজের একমাত্র সন্তান জনকেও উইলিয়াম সযত্নে দিয়েছিলেন মহাকাশ গবেষণার তালিম। তাই ৮৩ বছর বয়সে উইলিয়াম হার্শেল যখন তাঁর কর্ম জগতের মায়া ত্যাগ করলেন, মানব সমাজ পেল একজন দক্ষ জ্যোতির্বিজ্ঞানী – উইলিয়ামের যোগ্য উত্তরসূরি ও ছাত্র – জন হার্শেল।