মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
চান্দ্রপথ (অশ্বিনী থেকে রেবতী)-৬
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
হস্তাঃ
নক্ষত্রচক্রের ত্রয়োদশ নক্ষত্র হল হস্তা। ঋগ্বেদীয় নাম সবিতা। ইংরেজি নাম Corvus। পাঁচটি তারা নিয়ে গঠিত এই নক্ষত্রের বিন্যাস অনেকটা হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের মতো। এর উত্তর-পশ্চিমে আছে উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্র আর উত্তরে বিশাল অঞ্চল জুড়ে আছে কন্যারাশি। কন্যারাশির ঋগ্বেদীয় নাম ভার্গবী। সবিতা বা লক্ষ্মীর নামও ভার্গবী। সবিতা নক্ষত্রটির অধিপতি দেবতা। এটি শীত ঋতুর আদিত্য। জ্যৈষ্ঠ মাসের সন্ধ্যায় মধ্য আকাশে ঈষৎ দক্ষিণ চেপে একে দেখতে পাওয়া যায়।
হস্তাকৃতিবিশিষ্ট হস্তা নক্ষত্রের পাঁচটি তারার কথা বরাহমিহির, শ্রীপতি, লল্ল প্রমুখ প্রাচীনকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানতেন। শাকল্য সংহিতাতেও পাঁচটি তারার উল্লেখ আছে। তবে খণ্ডখাদ্যকে ছয়টি তারার কথা বলা আছে। সবকটি তারাই Corvus মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত। হস্তা নক্ষত্রের তারাগুলির মধ্যে দুটি তারা চতুর্থমাত্রার, দুটি তারা পঞ্চম মাত্রার এবং দুটি তারা তৃতীয় মাত্রার। খণ্ডখাদ্যক অনুযায়ী ছয়টি তারা ধরলে পাঁচটি তারা পাঁচ আঙুল এবং একটি তারা হাতের তালু কল্পনা করতে হয়।
চিত্রাঃ
চন্দ্রের চতুর্দশ রাত্রিবাস যে নক্ষত্রে সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ মতে তার নাম চিত্রা। এই নক্ষত্রটিতে একটি মাত্র তারা আছে। ঔজ্জ্বল্যের বিচারে এটি প্রথম মাত্রার তারা। মহাকাশে সর্বোজ্জ্বল প্রথম ২০টি তারার মধ্যে এর স্থান ১৬-তম। সূর্যের প্রায় ১৫০০ গুণ ঔজ্জ্বল্যবিশিষ্ট এই নক্ষত্রটির ঋগ্বেদীয় নাম ত্বষ্টা। এই ত্বষ্টাও আদিত্য। এর ইংরেজি নাম Spica বা Alpha Virginis। স্বর্ণাভ এই নক্ষত্রটির অবস্থান প্রায় ২৬২ আলোকবর্ষ দূরে। চিত্রা নক্ষত্রের কাছাকাছি অনুরূপ ঔজ্জ্বল্যের কোনো তারা নেই। তাই এই তারাটিকে আকাশে খুব সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। জ্যৈষ্ঠ মাসে সন্ধ্যায় মধ্যাকাশে সামান্য দক্ষিণ চেপে এটি দৃশ্যমান। প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই নক্ষত্রটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা একে মৃগসদৃশ কল্পনা করতেন। খণ্ডখাদ্যকে এবং শাকল্য সংহিতাতেও বলা আছে যে চিত্রা নক্ষত্র একটি তারকাযুক্ত।
স্বাতীঃ
চিত্রা নক্ষত্রের পরবর্তী নক্ষত্রের নাম স্বাতী। এটি অশ্বিনী থেকে শুরু করে চান্দ্রতিথি সংক্রান্ত পঞ্চদশ নক্ষত্র। সিদ্ধান্ত জ্যোতিষ আনুযায়ী এই স্বাতী নক্ষত্রের ঋগ্বেদীয় নাম মরুত্মান্। ইংরেজি নাম Arcturus বা Alpha Bootis। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে এর নাম নিষ্ট্য। নিষ্ট্য শব্দের অর্থ দূরে প্রেরিত। ক্রান্তিবৃত্ত থেকে নক্ষত্রটির অবস্থান অনেকটা দূরে। সম্ভবত সেই কারণেই নক্ষত্রটির এমন নাম। মহাকাশে এই নক্ষত্রের দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে চিত্রা নক্ষত্র এবং দক্ষিণ-পূর্বে আছে তুলা রাশি ও বিশাখা নক্ষত্র। স্বাতী নক্ষত্র সূর্যের থেকে ২৩ গুণ বড়। বর্ণ কমলাভ। ৭১ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই নক্ষত্রের দেবতা পবন।
চিত্রা নক্ষত্রের মতো স্বাতী নক্ষত্রেও একটি মাত্র তারা আছে। তাই নিজেই মণ্ডলের যোগতারা। ঔজ্জ্বল্যের বিচারে আকাশে সর্বোজ্জ্বল প্রথম ২০টি তারার মধ্যে এটি ষষ্ঠ। তারাটি মুক্তাবৎ বা প্রবালের অনুরূপ। আষাঢ় মাসে রাত্রির প্রথম প্রহরে আকাশে নক্ষত্রটিকে সরাসরি প্রায় মাথার উপরে দেখতে পাওয়া যায়।
বিশাখাঃ
স্বাতী নক্ষত্রের পর চন্দ্রের রাত্রিবাস বিশাখা নক্ষত্রে। চান্দ্রতিথি সংক্রান্ত এই ষোড়শ নক্ষত্রটির দক্ষিণ-পূর্বে বৃশ্চিক রাশি ও অনুরাধা নক্ষত্র এবং উত্তর-পশ্চিমে কিছুটা দূরে স্বাতী নক্ষত্রের অবস্থান। নক্ষত্রটির ঋগ্বেদীয় নাম ইন্দ্রাগ্নি এবং ইংরেজি নাম Corona Borealis এবং Serpens। একে কখনও কখনও রাধা নামেও চিহ্নিত করা হয়। নক্ষত্রটি খুব একটা উজ্জ্বল না হলেও আষাঢ় মাসে মধ্য আকাশে ঈষৎ দক্ষিণ ঘেঁষে একে দেখতে পাওয়া যায়।
‘শাখাযুক্ত’ বা ‘শাখাশূন্য’ এই দুই অর্থেই বিশাখা শব্দটি হতে পারে। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে শাখাযুক্ত অর্থই সংগত বলে মনে হয়। বিশাখার আরেক নাম কার্তিকেয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃত্তিকা নক্ষত্রের প্রারম্ভে যখন বাসন্ত বিষুবদ্দিনের সূত্রপাত তখন বিশাখা নক্ষত্রের মধ্যভাগে শারদ বিষুবদ্দিনের শুরু। তাই প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করতেন বিশাখা নক্ষত্রটি এই মধ্যস্থল থেকে কর্তিত হয়ে দুটি শাখায় বিভক্ত।
বৈদিক মতে বিশাখা নক্ষত্র দুটি তারা নিয়ে গঠিত। এই তারা দুটিকে তাঁরা অগ্নি ও ইন্দ্র এই দুই দেবতা জ্ঞানে দেখতেন। শাকল্য সংহিতায়ও বিশাখা নক্ষত্রে দুটি তারার উল্লেখ আছে। খণ্ডখাদ্যকেও এর সমর্থন মেলে। যদিও শ্রীপতি ও লল্ল এই নক্ষত্রে ৪টি তারার এবং বরাহমিহির ৫টি তারার উল্লেখ করেছেন। নক্ষত্রটির আকৃতি তোরণসদৃশ।
অনুরাধাঃ
বিশাখার পরবর্তী নক্ষত্র অনুরাধা চান্দ্রতিথি সংক্রান্ত সপ্তদশ নক্ষত্র। এর অবস্থান বিশাখা নক্ষত্রের দক্ষিণ-পূর্বে এবং জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের ঈষৎ উত্তর-পশ্চিমে। নক্ষত্রটি যথেষ্ট উজ্জ্বল। শ্রাবণ মাসে রাত্রির প্রথম প্রহরে দক্ষিণ আকাশে একে সহজেই দেখা যায়। অনুরাধার ঋগ্বেদীয় নাম মিত্র। মিত্র গ্রীষ্ম ঋতুর আদিত্য। এই নক্ষত্রের পুরোটাই পড়েছে বৃশ্চিক রাশিতে। আগেই বলেছি বিশাখার আরেক নাম রাধা। বিশাখা নক্ষত্রকে অর্থাৎ রাধাকে অনুগমন করে বলেই এই নক্ষত্রের নাম অনুরাধা।
শাকল্য সংহিতায় অনুরাধা নক্ষত্রে ৩টি তারার উল্লেখ আছে। শ্রীপতি, লল্ল, বরাহমিহির প্রমুখ পণ্ডিতেরা মনে করতেন নক্ষত্রটিতে ৪টি তারা আছে। বলির আকারে কল্পিত ৩টি তারার এই নক্ষত্রটির পাশে আরেকটি তারার অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। ওনারা সম্ভবত এই তারাটিকেও গ্রহণ করেছিলেন। গণক কালিদাসের মতে অনুরাধা সপ্ত তারকাবিশিষ্ট সর্পাকৃতি নক্ষত্র। নক্ষত্রটির উভয় পার্শ্বে ৩টি পঞ্চম মাত্রার তারকা আছে। সম্ভবত পূর্বে বর্ণিত তারকাগুলির সঙ্গে এই ৩টি তারকা যুক্ত করে তিনি সপ্ততারকাবিশিষ্ট অনুরাধা মণ্ডলের কল্পনা করেছিলেন।
ক্রমশ