মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
নক্ষত্র সৃষ্টির রহস্য
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে দিনে আকাশের রং নীল। মাঝে মাঝে ভেসে বেড়ায় টুকরো টুকরো মেঘ। কিন্তু সূর্যাস্তের পর সবকিছুই যেন বদলে যায়। রাতের অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথেই আকাশ সেজে ওঠে ফুলকি ছড়ানো তারার মালায়। আকাশে যে তারাদের আমরা দেখতে পাই প্রকৃতপক্ষে সেগুলি আছে আমাদের থেকে বহু দূরে— মহাকাশে। প্রতিটি তারাই এক একটি গ্যাস-পিণ্ড। এতে থাকে বিপুল পরিমাণে হাইড্রোজেন, কিছু হিলিয়াম এবং সামান্য মাত্রায় অন্যান্য গ্যাস।
একসময় মানুষের ধারণা ছিল মহাবিশ্বের সবকিছুই নিত্য এবং অবিনশ্বর। অর্থাৎ, এদের কোনো লয়-ক্ষয় নেই। মহাকাশে যে তারাগুলি জ্বল-জ্বল করছে সেগুলি অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মহা পণ্ডিত অ্যারিস্টটল মহাকাশকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন। পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত একটি অংশ এবং চাঁদের পরে যে মহাকাশ আছে সেটি আরেকটি অংশ। এই চন্দ্রোত্তর মহাকাশে কোনো কিছুর পরিবর্তন হয় না। যা আছে তা অনন্তকাল ধরে আছে এবং থাকবে। অ্যারিস্টটলের এই ধরণা মানুষ দু’হাজার বছর ধরে বিশ্বাস করে এসেছে। মধ্যযুগের মানুষেরা এও বিশ্বাস করত যে ধূমকেতুর অবস্থান পৃথিবীর বয়ুমণ্ডলের মধ্যেই। এই ধারণাকে উল্টেপাল্টে দেন ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহি। তিনি ধূমকেতুর দূরত্ব মাপতে গিয়ে দেখেন যে পৃথিবী থেকে চাঁদের যা দূরত্ব, ধূমকেতুর ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি। তাহলে ধূমকেতু কোনো মতেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকতে পারে না। তাই যদি হয় তাহলে চন্দ্রোত্তর মহাকাশেও পরিবর্তন ঘটে। এ ছাড়াও মহাকাশে তিনি আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ক্যাসিয়োপিয়া মণ্ডলে তিনি একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আবিষ্কার করেন যা আগে ওখানে ছিল না। এই জ্যোতিষ্কটি এল কোথা থেকে? তাহলে কি একটি নতুন তারার জন্ম হল? তিনি এই জ্যোতিষ্কটিকে বলেছিলেন ‘নোভা স্টেলা’। অর্থাৎ, একটি নতুন তারা।
এই ঘটনার পর বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসেন। ধীরে ধীরে তাঁরা বুঝতে পারলেন যে মহাবিশ্বেও ভাঙাগড়ার খেলা চলছে। নতুন নতুন তারার জন্ম হচ্ছে। শৈশব, যৌবন এবং বার্ধক্য কাটিয়ে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। তবে এদের জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের সময়টা খুব বেশি। তাই প্রতিটি পর্ব পেরোতে এদের কোটি কোটি বছর সময় লেগে যায়। মহাবিস্ফোরণের পর মহাকাশে ছড়িয়ে পড়েছিল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং অন্যান্য গ্যাসীয় মৌল কণা। এরা মহাকাশের সব জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে নেই। কোথাও খুব পাতলা হয়ে আছে, আবার কোথাও ঘন হয়ে আছে। যেখানে এরা পাতলা হয়ে আছে সেখান দিয়ে আলো চলাচল করতে পারে বলে সেই জায়গাগুলি ফাঁকা বলে মনে হয়। আর যেসব জায়গায় এরা ঘন হয়ে আছে সেখানে আলো যাতায়াত করতে বাধা পায় বলে জায়গাগুলি অস্বচ্ছ পদার্থের মতো দেখতে লাগে। এদের বলা হয় ‘নীহারিকা’ যা তারা বা নক্ষত্রের আঁতুড় ঘর। পৃথিবী থেকে দেখা যায় এমনই একটি আণবিক মেঘ হল ‘গ্রেট ওরায়ন নীহারিকা’ (great orion nebula)। আণবিক মেঘের নীহারিকাগুলি বিশাল বিশাল আকারের হয়। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দৈর্ঘ্য এক-একটার কয়েকশো আলোকবর্ষ পর্যন্ত হতে পারে। এগুলোতে এতটাই হাইড্রোজেন থাকে যা কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার তারার জন্ম দিতে পারে। তবে সব নীহারিকা থেকে তারার জন্ম হয় না। হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ গ্যাসের মেঘে অণু ও পদার্থকণিকাগুলি যথেষ্ট কাছাকাছি এসে পড়লে নিজেদের মধ্যে পরস্পর আকর্ষণ শুরু হয়ে যায়। এরফলে নীহারিকার সংকোচন শুরু হয় এবং প্রবল বেগে ঘুরতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ঘনত্ব ও চাপ। চাপ যত বৃদ্ধি পায় তাপও তত বাড়ে। আবার কখনো-কখনো অণুগুলির মধ্যে সংঘর্ষও ঘটে এবং সবকিছুই উত্তপ্ত হয়ে ওঠার প্রাথমিক অবস্থায় পৌঁছোয়। নক্ষত্র হয়ে ওঠার এই প্রাথমিক অবস্থাকে বলে ‘আদি নক্ষত্র’ (Protostar)। সংকোচন যত বৃদ্ধি পায় আদি নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ চাপ ও তাপ (উষ্ণতা) তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধীরে ধীরে উষ্ণতা ১০ লক্ষ ডিগ্রি কেলভিন [(১০৬)০K]-এর বেশি হলে এবং ঘনত্ব জলের ঘনত্বের প্রায় ১০০ গুণ হলে নিউক্লীয় বিক্রিয়া ((Nuclear Reaction) শুরু হয়। এই অবস্থায় হাইড্রোজেনের কেন্দ্রগুলি একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে হিলিয়ামে পরিবর্তিত হতে থাকে থাকে। সেই সঙ্গে উৎপন্ন হতে থাকে বিপুল পরিমাণ শক্তি। এই পারমাণবিক সংযোজনকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউসন। এরপর আর হাইড্রোজেনের আণবিক মেঘকে আর দেখা যাবে না। পরিবর্তে সেখানে জ্বল-জ্বল করবে একটি নক্ষত্র।
স্পাইরাল গ্যালাক্সির বাহু অঞ্চলে মহাজাগতিক মেঘের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই এই ধরনের গ্যালাক্সির বাহুই আদি নক্ষত্র জন্মানোর পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান। এদের বাহুতে অসংখ্য অন্ধকার অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়। এগুলিকে বলা হয় ‘কালো নীহারিকা’ (Dark Nabula)। এই অন্ধকার বা কালো নীহারিকাতেই মহাজাগতিক ধূলিকণা বা মেঘের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। এদের এক একটার আয়তন অতি বিশাল। সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আদি নক্ষত্রের জন্ম হয় এই ধরনের নীহারিকা থেকেই।
তথ্য সূত্রঃ
- The Universe: Iain Nicolson; 1996 Horus Editions.
- The Life and Death of a star: Donald A. Cooke
- https://www.scientificamerican.com › article › how-is-a-star-born
- https://socratic.org › Astronomy › Life and Death of Stars