মহাবিশ্বে মহাকাশে সব পর্ব একত্রে
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
অশ্লেষাঃ
নক্ষত্রচক্রের নবম নক্ষত্রের নাম অশ্লেষা। ইংরেজি নাম ‘হাইড্রা’ (Hydra)। পুষ্যা নক্ষত্রের ঈষৎ দক্ষিণ-পূর্বে এবং সিংহ রাশির (Leo) সামান্য দক্ষিণ-পশ্চিমে এর অবস্থান। সম্ভবত শ্লিষ্ ধাতু থেকে এই নক্ষত্রের নামকরণ হয়েছে। শ্লিষ্ ধাতুর অর্থ আলিঙ্গন। সর্পের ন্যায় নিজের দেহকে আলিঙ্গন করে অবস্থান করে বলে নক্ষত্রটির ঋগ্বেদীয় নাম ‘সর্পরুদ্র’। একাদশ রুদ্রের এক রুদ্র হল ‘সর্প’। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, হাইড্রা মণ্ডলের তারকা নিয়ে অশ্লেষা গঠিত এবং হাইড্রা কথাটির অর্থ হল জলসর্প। জ্যোতির্বিজ্ঞান মহলে অশ্লেষার আরও একটি অর্থের প্রচলন আছে। সেটা হল, অ-শ্লেষা অর্থাৎ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই এটিকে মস্তকহীন সর্পের ন্যায়ও কল্পনা করা হয়ে থাকে। চৈত্রমাসের সন্ধ্যাকালে নির্মেঘ আকাশে সামান্য পূর্ব দিক চেপে ঈষৎ দক্ষিণের আকাশে একে পরিষ্কার দেখা যায়।
অশ্লেষায় ক’টি তারা আছে? এ নিয়েও মতভেদ আছে। বরাহমিহিরের মতে অশ্লেষায় ছয়টি তারা আছে। শ্রীপতি এবং লল্লের অভিমত অনুসারে নক্ষত্রটিতে পাঁচটি তারা আছে। সূর্যসিদ্ধান্তে মণ্ডলের পূর্ব প্রান্তস্থ তারাটিকে অশ্লেষা নক্ষত্রের যোগতারা বলা আছে।
অশ্লেষা বা সর্প্রুদ্রকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে চাঁদসওদাগরের কাহিনী। সেখানে চন্দ্রকে কল্পনা করা হয়েছে চাঁদসওদাগর, অশ্লেষা হল মনসাদেবী। আবার জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ এবং আস্তিকের সেখানে উপস্থিত হওয়া এবং সর্পকুল রক্ষা করা ইত্যাদি ঘটনাগুলির সঙ্গে অশ্লেষা নক্ষত্র কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে— এ সবেরই একটা নাক্ষত্রিক ব্যাখ্যা সম্ভব অশ্লেষাকে জড়িয়ে নিয়ে।
মঘাঃ
চান্দ্রতিথি সংক্রান্ত দশম নক্ষত্রটির সৈদ্ধান্তিক নাম ‘মঘা’। এর ঋগ্বেদীয় নাম ‘মঘবন্’ এবং ইংরেজি নাম Regulus বা Alpha Leonis। অশ্লেষার ঈষৎ উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই নক্ষত্রের পশ্চিমে কর্কট রাশি এবং পূর্বে কন্যা রাশি। এটি একটি যুগ্মতারা। সূর্যের ১০০গুণ দীপ্তি সম্পন্ন এই তারাটির দূরত্ব ৭১ আলোকবর্ষ।
মহ্ ধাতুর অর্থ পূজা। এই ধাতু থেকেই মঘবন্ এবং তা থেকেই মঘা নামের উৎপত্তি। উত্তরায়ণের প্রাচীন নাম দেবযান এবং দক্ষিণায়নের নাম যমপথ বা পিতৃযান। যখন কৃত্তিকার অর্ধাংশে বিষুবদ্দিন অর্থাৎ দিন-রাত্রি সমান (২১ মার্চ) তখন মঘা নক্ষত্রে দক্ষিণায়নের অর্থাৎ পিতৃযানের সূত্রপাত। তাই মঘার অধিপতি বা দেবতা পিতৃগণ।
ঋগ্বেদে মঘার অন্য আরেকটি নাম আছে। সেটা হল অঘা। অঘা শব্দের অর্থ পাপ বা দুঃখ। সম্ভবত এই ভাবনা থেকেই মঘাকে অশুভ নক্ষত্র মনে করা হয়।
শ্রীপতি, লল্ল এবং বরাহমিহির প্রত্যেকেই মঘা নক্ষত্র ৫টি তারকাবিশিষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। খণ্ডখাদ্যকে অবশ্য মঘা নক্ষত্র ৬টি তারার সমন্বয়ে গঠিত বলা আছে। মঘার আকৃতি শলাকার বা লাঙ্গলাকার। সূর্যসিদ্ধান্ত মতে সিংহরাশির প্রথম নক্ষত্র মঘার দক্ষিণস্থ তারাটিই যোগতারা।
বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে সান্ধ্যায় নক্ষত্রটিকে মধ্যাকাশে দেখা যায়।
পূর্বফল্গুনীঃ
চান্দ্রতিথি সংক্রান্ত নক্ষত্রচক্রের একাদশ নক্ষত্রটির নাম পূর্বফাল্গুনী বা পূর্বফল্গুনী। ফল্গুনী শব্দের অর্থ মনোহর। ঋগ্বেদে ফল্গুনীর এক নাম অর্জুনী যার অর্থ উজ্জ্বল। পূর্বফল্গুনী মঘা নক্ষত্রের কিছুটা পুর্বে এবং উত্তরফল্গুনী নক্ষত্রের সামান্য পশ্চিম দিকে অবস্থিত। অতি উজ্জ্বল এই নক্ষত্রটিকে বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে সন্ধ্যার আকাশে সরাসরি মাথার মাথার উপরে খুব সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। পূর্বফল্গুনীর ইংরেজি নাম Leonis বা Zosma।
ঋতু বিধানের অধিপতিকে বলা হয় আদিত্য। ভগ হল শরৎ ঋতুর আদিত্য। পূর্বফল্গুনী শরৎ ঋতু আনে। তাই নক্ষত্রটির দেবতার নাম ভগ।
ঋগ্বেদে পূর্বফল্গুনী নক্ষত্রে দুটি তারকার কথা বলা আছে। শ্রীপতি এবং লল্ল-র মতও তাই। খণ্ডখাদ্যকে এবং শাকল্য সংহিতাতেও আছে পূর্বফল্গুনী নক্ষত্র দুটি তারকার সমন্বয়ে গঠিত। তবে বরাহমিহির এই নক্ষত্রটিতে আটটি তারার কল্পনা করেছেন। তবে তিনি তারকাগুলিকে নির্দিষ্ট করেননি। মঘা, পূর্বফল্গুনী নক্ষত্র দুটি এবং উত্তরফল্গুনীর এক চতুর্থাংশ সিংহরাশিতে অবস্থান করে। সূর্যসিদ্ধান্ত মতে পূর্বফল্গুনীর উত্তরদিকের তারকাটি যোগতারা।
উত্তরফল্গুনীঃ
অক্ষত্রচক্রের দ্বাদশ নক্ষত্রের সৈদ্ধান্তিক নাম উত্তরফল্গুনী বা উত্তরফাল্গুনী। সিংহরাশির (Leo) পুচ্ছের অগ্রভাগে এবং কন্যা রাশির (Virgo) সামান্য পশ্চিমে এর অবস্থান। ৪৩ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত উত্তরফল্গুনীর মাত্র একচতুর্থাংশ সিংহরাশিতে অবস্থিত, বাকি তিনচতুর্থাংশ আছে কন্যারাশিতে। নক্ষত্রটি তেমন উজ্জ্বল না হলেও বৈশাখ মাসে সন্ধ্যায় নির্মেঘ আকাশে স্পষ্ট দেখা যায়। মহাকাশে পূর্বফল্গুনী নক্ষত্রের সামান্য পূর্বে উত্তরফল্গুনী নক্ষত্রের অবস্থান বলে পূর্বফল্গুনী নক্ষত্রকে প্রথমে উদয় হতে দেখা যায়, তারপরে উদয় হয় উত্তরফল্গুনী নক্ষত্র। এই কারণে নামকরণের ক্ষেত্রে পূর্ব এবং উত্তরের ব্যবহার।
বরাহমিহির, শ্রীপতি, লল্ল এবং ব্রহ্মগুপ্ত এর মতে উত্তরফল্গুনী দুটি তারার সমন্বয়ে গঠিত। কিন্তু শাকল্য সংহিতায় ৫টি তারার কথা বলা আছে। কোলব্রুক, বেন্টলি, বার্জেস সকলেরই মতে সিংহরাশি্র পুচ্ছপ্রান্তের তারকাটি যোগতারা। যদিও সূর্যসিদ্ধান্তে মণ্ডলের উত্তর প্রান্তস্থিত তারকাটিকে যোগতারা বলা আছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে এটি সঠিক নয়। উত্তরফল্গুনীর ঋগ্বেদীয় নাম অর্যমা। ভগ এর মতো এটিও একটি আদিত্য। ঋতুবিধানের অধিপতি হিসেবে এর পরিচয়।