বৈজ্ঞানিকের দপ্তর স্বর্ণযুগের কাহিনী গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় বসন্ত ২০১৮

স্বর্ণযুগের কাহিনি

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

তোমরা সকলেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনেছ। তার সঙ্গে অনেক বিখ্যাত মানুষের নাম জড়িয়ে আছে, সে কথাও নিশ্চয় জানো। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সুকুমার সেন – এমন সব উজ্জ্বল নক্ষত্রের সমাহার ভারতবর্ষের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে পদার্থবিদ্যা বা ফিজিক্স বিভাগ আবার আলাদা জায়গা দখল করে আছে। সেই বিভাগের শুরুর সময়কার কিছু কাহিনি আজ তোমাদের শোনাব। এর অনেক কথা হয়তো তোমাদের জানা, আবার কিছু কিছু গল্প তোমাদের নতুন লাগতে পারে।

আজকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে যেমন দেখছ, শুরুর সময় কিন্তু সেরকম ছিল না। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের ঠিক পরে পরে ব্রিটিশরা ভারতের তিন শহর, কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে, তিন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেছিল।  প্রথম প্রথম এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পড়ানো হত না, এরা শুধু পরীক্ষা নিত। কলেজ তো বটেই, ব্রহ্মদেশ (আজকের মায়ানমার) থেকে শুরু করে পাঞ্জাব পর্যন্ত স্কুলগুলোর অধিকাংশও ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। স্কুলের শেষ পরীক্ষার নাম ছিল ম্যাট্রিকুলেশন বা এনট্রান্স, এখনকার মাধ্যমিকের সমতুল্য, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ই পরিচালনা করত। তাছাড়া ছিল কলেজের ইন্টারমিডিয়েট এবং গ্রাজুয়েট বা স্নাতক স্তরের পরীক্ষা। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে পাকিস্তানে) এদের পরে তৈরি হয়েছিল, সেখানে কিন্তু প্রথম থেকেই পড়ানো হত। আবার তারও পরে প্রতিষ্ঠিত এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ছিল পুরানো তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। ১৯০৪ সালে আইন পাল্টে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অধ্যাপক নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়। তার দু’বছর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন, বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি এই সুযোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর (অর্থাৎ মাস্টার্স, যেমন এমএ বা এমএসসি) স্তরে পড়াশোনা চালু করার চেষ্টা করেন। ছ’বছরের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি, পালি, সংস্কৃত, আরবি-ফারসি, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি ও অঙ্ক – এই আট বিষয়ে এমএ পড়ানো শুরু হয়।

কলকাতায় সে সময় এমএসসি পড়ানো হত শুধু প্রেসিডেন্সি কলেজে, ১৮৮৪ সালে তা শুরু হয়েছিল। পদার্থবিদ্যাতে জগদীশচন্দ্র বা রসায়নে প্রফুল্লচন্দ্রের মতো শিক্ষকরা সেখানে তখন পড়াচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গবেষণার সুযোগ নেই বললেই চলে। জগদীশচন্দ্রের গবেষণার পথে কত বাধা এসেছিল, তা হয়তো অনেকে জানো। আশুতোষের স্বপ্ন ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো ও গবেষণা শুরু করবেন — কিন্তু টাকা নেই। বিজ্ঞান গবেষণাতে সবচেয়ে আগে দরকার ল্যাবরেটরি, কিন্তু বিদেশী সরকার তাঁকে এর জন্য কোনো সাহায্য করতে রাজি নয়। ভারতীয়দের বিজ্ঞান শিখিয়ে বিদেশী শাসকদের লাভ কী?  শুধু বিজ্ঞান নয়, যে শিক্ষা শাসিতদের প্রশ্ন করতে শেখায়, ভাবতে শেখায় — তা বিদেশী শাসনের পক্ষে বিপজ্জনক। অগত্যা আশুতোষ মুখ ফেরালেন দেশের মানুষের দিকে। 

 আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রথমে উকিল ও পরে হাইকোর্টে বিচারকের কাজ করলেও বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন। তিনিই প্রথম ছাত্র যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্ক ও প্রকৃতি বিজ্ঞান এই দুই  আলাদা আলাদা বিষয়ে এম এ ডিগ্রি পেয়েছিলেন। আধুনিক ভারতবর্ষে অঙ্কশাস্ত্রে গবেষণা শুরু করেছিলেন আশুতোষ। মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বিদেশের লন্ডন, এডিনবার, প্যারিস, আমেরিকাসহ বহু জায়গার ম্যাথামেটিকাল সোসাইটির সদস্য হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা ম্যাথামেটিক্যাল সোসাইটি এখনো কাজ করে চলেছে। তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ সায়েন্সে গণিত বিষয়ে নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন। ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসও শুরু করেছিলেন আশুতোষ, তিনিই সায়েন্স কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি। তিনি ১৯০৬-১৯১৪ এবং ১৯২১-১৯২৩ মোট দশ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি। তিনি ঢাকাতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ জানতে চান কিসের বিনিময়ে তিনি প্রকাশ্যে আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিতে বাধা দেবেন না। আশুতোষ চেয়ে নিয়েছিলেন সরকারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন অধ্যাপক পদের জন্য সরকারি সাহায্য

তোমরা ইতিহাসে পড়েছ ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কথা। সে সময় ইংরাজদের স্কুলকলেজের বাইরে জাতীয় শিক্ষার জন্য অনেকেই সাহায্য করেছিলেন। তাঁদেরই একজন, ব্যারিস্টার স্যার তারকনাথ পালিত প্রায় সমস্ত সম্পত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করলেন। এর পরিমাণ হল সাড়ে চোদ্দ লক্ষ টাকার সম্পত্তি ও বালিগঞ্জে তাঁর নিজের বাড়ি। নগদ টাকা ছাড়াও এই দানের মধ্যে ছিল ঋণপত্র, জমি, সরকারি বন্ড ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয় ঋণপত্র থেকে অর্থ আদায় করে। যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নাম। তিনি যথাসময়েই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়কে শোধ করে দিয়েছিলেন। অন্য এক ব্যারিস্টার, স্যার রাসবিহারী ঘোষ, দুবারে মোট সাড়ে একুশ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। তাঁদের দুজনের দান ব্যবহার করার জন্য আলাদা আলাদা দুটি গভর্নিং বডি তৈরি করা হয়। সেদিনের এক টাকা আজকের প্রায় পাঁচশো টাকার সমান। বুঝতেই পারছ, দুজনে মিলে একশো পঁচাত্তর কোটি টাকার বেশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন। সেই দানেই শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ। প্রথমেই যে কটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা হল, তার মধ্যে ছিল পদার্থবিজ্ঞান।

পালিত ও ঘোষের শর্ত ছিল তাঁদের দানের টাকায় কয়েকটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করতে হবে। সেই মতো অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিদ্যা বিভাগে পালিত অধ্যাপক এবং ঘোষ অধ্যাপক পদ সৃষ্টি হয়। দুজনেই বলেছিলেন এই পদের অধ্যাপকদের ভারতীয় হতেই হবে। মনে রেখো সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অধ্যাপকই ছিলেন ব্রিটিশ। মাত্র কয়েক বছর আগে জামসেদজী টাটার উৎসাহে বাঙ্গালোরে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স। কিন্তু প্রথম দিকে সেখানে ইংল্যান্ড থেকে আসা দ্বিতীয় শ্রেণির বিজ্ঞানীরাই মূলত চাকরি পেয়েছিল, তার ফলে সেখানে গবেষণার মান ছিল খুবই নিচু। ভারতীয় অধ্যাপকরা যাতে বিশ্বমানের গবেষণা করতে পারেন, সে জন্য চাকরি পাওয়ার পরে প্রয়োজনে বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দু বছরে তাঁদের গবেষণা করার কথা দানের শর্তে ছিল। তাঁরা সেজন্য সবেতন ছুটি পেতেন। এছাড়াও তাঁদের দানের টাকায় বিভিন্ন বিভাগে কয়েকটি গবেষক বা রিসার্চ ফেলোর পদ চালু করা হয়।

১৮৯৮ সালে ইউরোপগামী জাহাজে জামসেদজী টাটার সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের দেখা হয়। বিবেকানন্দের উৎসাহে টাটা ঠিক করেন ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেনইংরাজ শাসকরা এই প্রস্তাবকে ভালো চোখে দেখেন নি, বরঞ্চ নানাভাবে বাধা দিয়েছিলেন। দেশীয় রাজ্য  দেওয়ান শেষাদ্রি আয়ারের চেষ্টায় মহীশুরের রাজা বাঙ্গালোরে তিনশ বাহাত্তর একর জমি দান করেন। জামসেদজীর মৃত্যু হলেও টাটারা ইন্সটিটিউটের জন্য দেন মোট তিরিশ লক্ষ টাকাঅবশেষে ১৯০৯ সালে তৈরি হয় ইন্ডিয়ান ইন্সটটিউট অফ সায়েন্স যা আজ দেশের সবচেয়ে বড় মৌলিক গবেষণা কেন্দ্র।

১৯১৪ সালের ২৭শে মার্চ রাজাবাজারে পালিতের বাগানবাড়ির জমিতে বিজ্ঞান কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আশুতোষ। সেবার তাঁর উপাচার্য পদের মেয়াদ শেষ হয় চারদিন পর, কিন্তু তার পরেও তিনি বিভিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে বিজ্ঞান কলেজকে চালনা করেছিলেন। দুমাস আগে ২৪শে জানুয়ারি পালিত গভর্নিং বডির সভাতে পদার্থবিজ্ঞানে সি ভি রমন এবং রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে পালিত অধ্যাপকের পদে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই একই দিন ঘোষ গভর্নিং বডি প্রফেসর হিসাবে সিটি কলেজের অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বা ডি এম বোসকে মনোনীত করে।  সেই দিনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এক সভায় এই নিয়োগে সম্মতি দেয়। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি সেনেটে কয়েকজন ইউরোপীয় সদস্য নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তোলেন। ফলে দুবার ভোটাভুটি হয়, দুবারই ভোটে আশুতোষের প্রস্তাব জেতে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কাজ চালায় যে কমিটি, তার নাম সিন্ডিকেট। তা ছাড়াও আছে সেনেট যেখানে সমস্ত নীতি ঠিক করা হয়সিন্ডিকেটের প্রায় গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত সিদ্ধান্ত সেনেট থেকে অনুমোদিত হতে হয়কলকাতা সহ ভারতের প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এখনো এই ধরনের পদ্ধতি মেনেই চলে।

 চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে ইন্ডিয়ান ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে চাকরি করছিলেন। তিনি তখন কলকাতায় কর্মরত। চাকরির বাইরে সময় করে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে নিয়মিত গবেষণা করছিলেন। আশুতোষের জহুরির চোখ ঠিক রতনটিকে চিনে নিয়েছিল। রমনের মাইনে ছিল মাসে দুহাজার টাকা। পালিত অধ্যাপকের পদে মাইনে পাবেন আটশো টাকা, বাড়িভাড়া বাবদ আরো দু’শো টাকা।  কিন্তু রমন দ্বিধা করেননি, তিনি শুধু কয়েকটি শর্ত আরোপ করেছিলেন।

মৌলিক বিজ্ঞানে বিষয়ে ভারতীয়দের গবেষণার জন্য ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ১৮৭৬ সালের ২৯শে জুলাই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের প্রতিষ্ঠা করেছিলেনসি ভি রমন চাকরি সূত্রে কলকাতায় আসার  পরে একদিন ২১০ বৌবাজার স্ট্রিটে অ্যাসোসিয়েশনের খোঁজ পেয়ে গবেষণার প্রস্তাব নিয়ে সেখানে যান।  মহেন্দ্রলাল তখন প্রয়াত, কিন্তু তাঁর উত্তরসূরীরা খুশি হয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় রমন সেখানে কাজ করতেন। বর্তমানে বৌবাজারের সেই বাড়িটি আর নেই, যাদবপুরে অবস্থিত অ্যাসোসিয়েশন এখন দেশের অন্যতম সুপরিচিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

রমনের শর্তগুলো আজকের দিনে বেশ অদ্ভুত লাগবে। এখন সবাই বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেলে খুশি হয়, সেখানে রমন বলেছিলেন যে দেশের বাইরে গবেষণার শর্ত তুলে না নিলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন না। তাছাড়া তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে তাঁকে কি পড়াতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় জানায় যে তাঁর জন্য বিদেশে গবেষণা বা ক্লাস নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সরকারি চাকরি ছেড়ে আসার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি লেগেছিল, তা পাওয়ার পরে ১৯১৭ সালের ২ জুলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। মজার ব্যাপার হল রমন কিন্তু প্রথম থেকে ক্লাস নিয়েছিলেন। তবে সবসময়ই তাঁর গবেষণার প্রধান জায়গা ছিল কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় পড়ানো, বিদেশে কনফারেন্সে যোগদান ও ল্যাবরেটরি পরিদর্শন, বিভিন্ন সরকারি কমিটিতে অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভাগীয় প্রধান হিসাবে তাঁকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হত। ১৯৩৩ সালের ১ এপ্রিল রমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যান। তিনি বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটের ডাইরেক্টর হিসাবে যোগ দেন। মাঝের ষোল বছর তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান।

 রমন প্রধানত আলো ও শব্দ বিষয়ে গবেষণা করতেন। সারা দেশ থেকে তাঁর কাছে ছাত্ররা গবেষণার জন্য আসত। কাল্টিভেশনের ল্যাবরেটরিতে তিনি তাঁর নামাঙ্কিত এফেক্টকে চিহ্নিত করেছিলেন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন তাঁর ছাত্র কে এস কৃষ্ণন। রমন প্রথম থেকেই তাঁর আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বিদেশী বিজ্ঞানীদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। সুইডেনের নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী মানে সিগবান এবং জার্মান বিজ্ঞানী আর্নল্ড সমারফেল্ড তাঁর প্রশংসা করে চিঠি দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে রমন নোবেল পুরস্কার পান, এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এই সম্মান লাভ করেছিলেন। পুরস্কারের প্রস্তাবকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিগবান। রমন নোবেল পুরস্কার নিতে রওনা হন ১৯৩০ সালের ২১শে নভেম্বর, সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করেছিল।

ঘোষ অধ্যাপকের পদে দেবেন্দ্রমোহন বোস বা ডি এম বোসের বেতন ছিল মাসিক পাঁচশো টাকা।  বিদেশে গবেষণার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন জার্মানির হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়। কথা ছিল দু’বছর, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার জন্য দেশে ফিরতে দেরি হয়। তাঁকে জার্মানিতে কাটাতে হয় পাঁচ বছর। কণা বা পার্টিকল সন্ধানের জন্য ক্লাউড চেম্বার তখন সবে আবিষ্কৃত হয়েছে, ডি এম বোস জার্মানিতে একটি নতুন ক্লাউড চেম্বার বানান। ১৯১৯ সালে অবশেষে দেশে ফেরার সুযোগ পেয়ে তিনি ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। বিজ্ঞান কলেজেও তিনি একটি ক্লাউড চেম্বার তৈরি করেছিলেন। দেবেন্দ্রমোহন ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্রের ভাগনে, ১৯৩৮ সালে মামার মৃত্যুর পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ডাইরেক্টর হন। পরবর্তীকালে কসমিক রশ্মি বিষয়ে তাঁর ও তাঁর ছাত্রী বিভা চৌধুরীর গবেষণা নোবেল পুরস্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিল। সে অবশ্য অন্য গল্প (নীচের ইটালিকস লেখায় দেখ)।

কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি গবেষণা সাধারণত করতে হত উঁচু পাহাড়ের উপরডি এম বোস ও বিভা চৌধুরি বেছে নেন সন্দকফু, তখন তা ছিল খুবই দুর্গম জায়গাফটোগ্রাফিক প্লেটে এই রশ্মিরা ধরা দেয়। প্লেট হয় দু রকম। ফুলটোন প্লেটের দুপাশে ইমালশন বা দ্রবণ থাকে, হাফটোনের থাকে একদিকে। বোঝাই যায় ফুলটোন প্লেট অনেক ভাল। সন্দকফুতে কাজ শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের জন্য সমস্ত ফুলটোন প্লেট সরকার নিয়ে নেয়, তাই বোসদের হাফটোন প্লেট দিয়েই কাজ চালাতে হয়। হাফটোন প্লেট থেকে মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যের কণার ভর ঠিকঠাক নির্ণয় করা যায়নি ডি এম বোস ও বিভা চৌধুরি নিশ্চিত ছিলেন তাঁরা পায়ন নামের কণাটিকে খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু ভর ঠিক মতো না বলতে পারায় তাঁদের কাজ স্বীকৃতি পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিল পাওয়েল কণাটিকে সঠিক ভাবে চিহ্নিত করেন। ১৯৫০ সালে এই কাজের জন্য পাওয়েল নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। পাওয়েলের লেখা বইতে বোস ও চৌধুরির কাজের কথা আছে।

 বিদেশ থেকে ফেরার সময় ডি এম বোস  জার্মান ভাষায় লেখা কয়েকটি নতুন বই নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলি তখন কলকাতায় পাওয়া যেত না। তার মধ্যে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের লেখা দুটি তাপগতিবিদ্যা বা থার্মোডায়নামিক্স সংক্রান্ত বই তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে উপহার দিয়েছিলেন। প্ল্যাঙ্কের তাপগতিবিদ্যা বিষয়ক সূত্র আধুনিক কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। সত্যেন্দ্রনাথ যে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়নের জন্য বিশ্ববিখ্যাত, প্ল্যাঙ্কের ঐ সূত্র ব্যাখ্যা করার জন্যই তিনি তা আবিষ্কার করেছিলেন। সে সময় সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।

পদার্থবিদ্যা বিভাগে ক্লাস শুরু হয় ১৯১৬ সালের ১ জুলাই। ডি এম বোস বিদেশে, রমন তখনো চাকরি ছাড়ার জন্য ভারত সরকারের থেকে অনুমতি পাননি। তাই তাড়াতাড়ি করে যোগেশচন্দ্র মুখার্জি ও ফণীন্দ্রনাথ ঘোষকে লেকচারার নিয়োগ করা হয়। তাঁদের মাইনে ছিল মাসে দুশো টাকা যা বছরে বছরে পঁচিশ টাকা বেড়ে পাঁচশো টাকায় পৌঁছনোর কথা। একই সঙ্গে তিনজন পালিত স্কলার বা গবেষককে ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। আশুতোষ মানুষ চিনতে ভুল করতেন না, যে তিনজনকে তিনি ক্লাস নিতে আদেশ দিলেন তাঁরা হলেন শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বোস। সে জন্য তাঁদের গবেষক বৃত্তি একশো পঁচিশ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হল দুশো টাকা।

সাহা ও বোসের সম্পর্কে তোমরা সবাই জানো। তাঁরা দুজন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিত নিয়ে এমএসসি পাস করেন, সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম, মেঘনাদ দ্বিতীয়। তাঁরা প্রথমে ফলিত গণিত বিভাগেই গবেষণা শুরু করেছিলেন, কিন্তু বিভাগীয় প্রধান গণেশ প্রসাদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তাঁরা দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে আসেন। অনেকের কাছে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষের কথা তোমাদের একটু বলি।

শৈলেন্দ্রনাথ বাকি দুজনের সমবয়সী। ১৯১৫ সালেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই প্রথম বিভাগে এমএসসি পাস করেন, তাঁর বিষয় ছিল পদার্থবিদ্যা।  তিনি আশুতোষের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন, তিনিই সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদকে আশুতোষের কাছে নিয়ে যান। আশুতোষ তাঁকে বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিদ্যার পরীক্ষাগার তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর উৎসাহেই শৈলেনকে তিন বছরের জন্য আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে এক পুলিশ অফিসার এসে শৈলেনের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁকে দেশ না ছাড়ার নির্দেশ দেয়।

শৈলেন্দ্রনাথ গোপনে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি বুঝলেন পুলিস সেটা জানতে পেরেছে। কলকাতায় তাঁর পুরানো বাসাতে তল্লাশি চালানো হয়। বিজ্ঞান কলেজেও তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিস আসে। খবর পাওয়া যায় যে তাঁকে আন্দামানে নির্বাসনে পাঠানোর অর্ডার হয়েছে। শৈলেন ঠিক করেন  তিনি আত্মসমর্পণ করবেন। আশুতোষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তিনি চলছিলেন, তাই পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে তিনি উপদেশের জন্য আবার আশুতোষের কাছে যান। আশুতোষ তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে নিষেধ করেন। শৈলেন পালিয়ে বিপ্লবীদের দলে যোগ দেন। কয়েকমাস পরে তিনি গোপনে আশুতোষের সঙ্গে আবার দেখা করে জানতে পারেন পুলিস তাঁকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তিনি তখন নাম ভাঁড়িয়ে জাহাজের খালাসির চাকরি নিয়ে কানাডা পালিয়ে যান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এর পর আর তাঁর যোগাযোগ হয়নি।

আমরা যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় জার্মানি ছিল পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে তার তত্ত্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র। মেঘনাদ এবং সত্যেন দেখলেন যে অনেক বই ও প্রবন্ধ শুধু জার্মান ভাষাতেই পাওয়া যায়, তাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান শিখতে গেলে ওই ভাষাটা শেখা দরকার। মেঘনাদ অবশ্য জার্মান কিছুটা জানতেন, ইন্টারমিডিয়েট স্তরে পড়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান ভাষার ক্লাসে ভর্তি হলেন তাঁরা দুজনেই, সেখানে তাঁদের সতীর্থ ছিলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সাহা ও বোস মিলে আলবার্ট আইনস্টাইন ও হেরম্যান মিনকাওস্কির আপেক্ষিকতা বিষয়ক গবেষণাপত্রগুলি ইংরাজিতে অনুবাদ করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেগুলি একটি বই আকারে প্রকাশ করা হয়। তাঁদের আগে পৃথিবীতে কেউ আইনস্টাইনের এই প্রবন্ধগুলির ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেনি। এই বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, তিনি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। সাহা ও বোস দুজনে একসঙ্গে তাঁদের প্রথম গবেষণাপত্রটিও প্রকাশ করেন, বিষয় ছিল গ্যাসের গতিতত্ত্ব।

সত্যেন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে নতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার পদে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে তিনি আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক হিসাবে ফিরে আসেন। কলকাতা ছেড়ে গিয়েছিলেন এক স্বল্পখ্যাত যুবক, ইতিমধ্যে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। ঢাকাতে থাকাকালীন তিনি প্ল্যাঙ্কের সূত্র নির্ণয়ের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে তাঁর গবেষণার কথা জানানো মাত্র আইনস্টাইন তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। বোস আইনস্টাইন সংখ্যায়নের সে গল্প তোমাদের সকলেরই জানা।

মেঘনাদ সাহা ১৯১৯ সালে ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনিই পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম ডক্টরেট। এর ঠিক পরেই ১৯২০ সালে তাঁর বিখ্যাত আয়নন সমীকরণ প্রকাশ করেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। নক্ষত্রের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা, চাপ ইত্যাদি ভৌত অবস্থা বুঝতে সাহা সমীকরণ অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, এই সমীকরণ থেকেই আমরা নক্ষত্রগুলো কোন উপাদানে তৈরি তা জানতে পারি। তোমরা যারা এ বিষয়ে আরো বেশি জানতে চাও, তারা এই প্রবন্ধটা পড়ে দেখতে পারো। এর পর মেঘনাদ গবেষণার জন্য বিদেশ যাত্রা করেন।

 সাহার ডক্টরেট থিসিসের একজন পরীক্ষক হিসাবে সে সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত জ্যোর্তিবিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের নাম প্রস্তাব হয়েছিল, কিন্তু পরে জানা যায় এডিংটন ১৯১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ইংল্যান্ডে থাকবেন না। তখন থিসিসটা পরীক্ষার জন্য অন্য এক বিজ্ঞানীকে পাঠানো হয়। এডিংটন কেন সে সময় দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে ছিলেন না বলতে পার? তিনি তখন পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের পাশ দিয়ে আসা তারার আলো কতটা বাঁকবে তা মাপার জন্য আফ্রিকা গিয়েছিলেন। তাঁর এই পরীক্ষা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে প্রতিষ্ঠা করে ও তার স্রষ্টাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। এই এডিংটনই জ্যোর্তিবিজ্ঞানে সর্বকালের সেরা দশ আবিষ্কারের মধ্যে সাহা সমীকরণকে রেখেছিলেন। রমনের ভাইপো নোবেলজয়ী পদার্থবিদ সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের সঙ্গে এডিংটনের বিবাদের কথা অনেকেই জানো, এই লেখাটায় সে কাহিনি আছে।

আশুতোষের চেষ্টাতে ১৯২১ সালে খয়রার রাজা গুরুপ্রসাদ সিংহের অর্থসাহায্যে পাঁচটি নতুন পদ তৈরি করা হয়। তার মধ্যে একটি ছিল পদার্থবিদ্যা বিভাগে। আশুতোষের প্রথমেই মনে পড়ে মেঘনাদের কথা, তাঁকেই নির্বাচন করা হয় সেই পদে। তিনি জার্মানি থেকে চলে এসে ১৯২১ সালের ৭ই নভেম্বর যোগ দিলেন। মাইনে ছিল মাসে ৫০০ টাকা। কিন্তু সেই সময় বিজ্ঞান কলেজের আর্থিক দুরবস্থা চলছিল, ফলে মেঘনাদের গবেষণার জন্য কোনো রকম সাহায্য মিলছিল না। মনে রেখো ব্রিটিশ সরকার বিজ্ঞান কলেজকে খুব সামান্যই সাহায্য করত। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ সালে বিজ্ঞান কলেজের জন্য মোট খরচ হয়েছিল আঠার লক্ষ টাকা, তার মধ্যে সরকারের থেকে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা। অধিকাংশ টাকাই আসত পালিত ও ঘোষের দান থেকে। এই পরিস্থিতিতে মেঘনাদকে পাওয়ার জন্য প্রথমে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় হাত বাড়ায়। তারা তাঁকে বেশি মাইনে ও গবেষণার জন্য বেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বারবার আবেদন করেও লাভ হচ্ছিল না। অবশেষে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার জন্য মেঘনাদ ১৯২৩ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর কলকাতা ছাড়েন। তাঁর জায়গা নেন ভবিষ্যতের আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী শিশিরকুমার মিত্র। মেঘনাদ ১৯৩৮ সালে পালিত অধ্যাপক হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। বিভাগের মধ্যেই তিনি তৈরি করেন ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যা তাঁর মৃত্যুর পরে সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নামে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান এবং দেশের অন্যতম গবেষণা কেন্দ্র।

প্রথম যুগের অন্য কয়েকজন অধ্যাপকের কথা অল্প কথায় বলি। ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ গবেষণার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে তিনি অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স বা ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগ তৈরি করেন। তাঁর স্পেকট্রোস্কোপি বা বর্ণালীবিশ্লেষণ ল্যাবরেটরি ছিল এশিয়ার সবসেরাগুলোর মধ্যে অন্যতম। শিশিরকুমার মিত্র ১৯১৪ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসাবে গবেষণা করছিলেন। ১৯১৭ সাল থেকেই তিনি বিভাগে পড়ানো শুরু করেন। ১৯২০ সালে ডক্টরেট লাভের পর তিনি ফ্রান্সে গবেষণার জন্য যান। সেখানে মাদাম কুরির ল্যাবরেটরিতে তিনি কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। এই সময় তিনি রেডিও তরঙ্গ বিষয়ে উৎসাহী হন। ভারতে ফিরে তিনি সেই বিষয়ে কাজ শুরু করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগের বিষয়ে গবেষণাতে তিনি ভারতে পথিকৃৎ। বিধুভূষণ রায় ১৯২১ সালে বিভাগে যোগ দেন। তিনি রমনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ১৯২৩ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার পরে তিনি বিদেশে যান ও সেখানে সমকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী নিলস বোর এবং অপর এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মানে সিগবানের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি ভারতে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি গবেষণা প্রথম শুরু করেন।

এতক্ষণ তো বললাম অধ্যাপকদের কথা? ছাত্ররা কেমন ছিল? অধ্যাপকদের মধ্যে অনেকেই বিজ্ঞান কলেজে গবেষক ছাত্র হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন, পরে তাঁরাই বিভাগে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। কেউ কেউ আবার দেশের অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে যান। তখন গবেষকদের বৃত্তি ছিল পঞ্চাশ টাকা থেকে একশ পঁচিশ টাকা, পালিত ও ঘোষ স্কলারদের বৃত্তি ছিল বেশি। পড়ানোর সুযোগ দিলে তাঁদের লেকচারারদের সমান মাইনে দেওয়া হত। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একসঙ্গে ক্লাস হত, দু জায়গার শিক্ষকরাই ক্লাস নিতেন। প্রথম দিকে বিভাগে কোনো ছাত্রীই  ছিলনা। ১৯৩৩ সালে চামেলি দত্ত এমএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তিনি ভারতের প্রথম মহিলা এমএসসি। পরের দু বছরে বিভা চৌধুরী ও পূর্ণিমা সেনগুপ্ত এম এস সি ডিগ্রি পান। বিভা চৌধুরীর কথা আগেই বলেছি। পূর্ণিমা সেনগুপ্ত (সিংহ) সত্যেন্দ্রনাথ বোসের কাছে ডক্টরেট করেন।

সব শেষে আসি সিলেবাস আর পরীক্ষার কথায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম সে সময়ের ইউরোপের যে কোনো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনীয় ছিল এমন কি বেশ কিছু আধুনিক বিষয় পড়ানো হত যা তখন আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা পায়নি। শিক্ষকরা পছন্দমত বই এমনকি আধুনিক গবেষণাপত্র থেকে পড়াতেন। পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কাররা  কয়েক বছরের মধ্যেই পাঠ্যসূচীতে জায়গা পেয় যেত। বোঝাই যায় সরাসরি রিসার্চ পেপার থেকেই তা পড়ানো হত, কারণ তাদের অনেকগুলোই তখনো কোনো পাঠ্য বইতে জায়গা পায়নি। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেন এডিংটন ১৯১৯ সালে (টেক্সটবক্সে দেখ), ১৯২১ সালে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ তা নিয়ে পরীক্ষায় প্রশ্ন দেন। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আবিষ্কর্তা রাদারফোর্ড ১৯১৯ সালে যে পরীক্ষা করেছিলেন, পরের বছরেই তার উপর প্রশ্ন আসে।  ১৯৩১ সালে সাহা সমীকরণ এবং ১৯৩২ সালে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন ও রমন এফেক্ট প্রশ্নপত্রে জায়গা করে নেয়। বুঝতেই পারছ পাঠক্রম কতটা আধুনিক ছিল।

আমার কথা শেষ করার সময় এসেছে। পদার্থবিদ্যার কথা আলাদা করে বললাম, কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অনেক বিভাগের অতীত ইতিহাসও একইরকম গৌরবের। বিজ্ঞান কলেজের  প্রথম যুগে শিক্ষক ও গবেষকদের সবাইকে অর্থ, যন্ত্রপাতি, বই এবং গবেষণা পত্রিকার অভাবের মধ্যেই কাজ করে যেতে হত। সরকারের সাহায্য ছিল নামমাত্র। ১৯২৫ সালে অর্থাভাবের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের চাকরি পুণর্নবীকরণ করবে না বলে ঠিক করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর হস্তক্ষেপে তাঁদের চাকরি রক্ষা পায়। এত অসুবিধার মধ্যেও বিশ্বমানের গবেষণা সম্ভব হয়েছিল। বিদেশ থেকে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী সে সময় বিজ্ঞান কলেজে এসেছিলেন, তাঁরা সকলেই  কলেজের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। রমন, বোস বা সাহা ছাড়াও অন্য অনেকেই পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে তাঁদের কাজের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন। তাঁদের এই সাফল্যের রহস্য কী? অনুমান করি পরাধীন দেশের সম্মানের জন্য একটা কিছু করে দেখানোর সংকল্প তাঁদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছিল। শুধু শৈলেন্দ্রনাথ নয়, আরো আনেকেই সরাসরি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পালিত প্রফেসরের সহকারী যতীন্দ্রনাথ শেঠ গ্রেফতার হয়েছিলেন ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টে। মেঘনাদ সাহা কৈশোরে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য স্কুল থেকে বিতাড়িত হন, তাঁর সঙ্গে বিপ্লবী বাঘা যতীন ও পুলিন দাসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। শিক্ষক-ছাত্রদের অনেকেই গান্ধীজীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁদের মধ্যে একজন। বিশ্বমানের গবেষণা শুধু সুযোগসুবিধা নয়, আত্মবিশ্বাস ও সংকল্পের উপরেও নির্ভর করে। বিজ্ঞান কলেজের ইতিহাস আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

3 thoughts on “বৈজ্ঞানিকের দপ্তর স্বর্ণযুগের কাহিনী গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় বসন্ত ২০১৮

  1. খুব ভালো লাগল, অনেক নতুন তথ্য জানালাম। এরকম লেখা আরও অনেক চাই।

    Like

  2. সত্যি নিজেকে অসাধারণ মনে হচ্ছে CALCUTTA UNIVERSITY RAJABAZAR CAMPUS এ পড়ার সুযোগ পেয়ে l অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, Sir, আমার প্রণাম নেবেন l

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s