বৈজ্ঞানিক
আর্যভটের সময়ের ভারতবর্ষে গণিত চর্চার আর এক প্রধান কেন্দ্র ছিল মধ্যভারতের উজ্জয়িনী। সেখানে তখন গণিতের তিন মহারথী ছিলেন। এঁরা হলেন ব্রহ্মগুপ্ত, বরাহমিহির আর ভাস্করাচার্য। এবারে একে একে তাঁদের কথাঃ
ব্রহ্মগুপ্তঃ(৫৯৮ খৃ—৬৬৮ খৃ)
জিষ্ণুগুপ্তের পুত্র, সপ্তম শতাব্দির এই গণিতজ্ঞ গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা এই দুয়েরই ওপরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গিয়েছেন। আদতে তিনি রাজস্থানের ভিল্লমল অঞ্চলের মানুষ বলে মনে করা হয়। সেখানকার রাজার শিক্ষক হিসেবে তাঁকে ভিল্লমলাচার্য নামেও ডাকা হত। পরবর্তী সময়ে তিনি উজ্জয়িনীতে এসে সেখানকার জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা ও অবজার্ভেটরির প্রধানের পদ নেন। তাঁর বেশির ভাগ গবেষণাপত্রই কিন্তু গণিতের গূঢ়তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করলেও লেখা হয়েছিল সুন্দর কবিতা দিয়ে।
৬৩৮ খৃস্টাব্দে ব্রহ্মগুপ্তের বিখ্যাত বই ব্রহ্মস্ফূটসিদ্ধান্ত বের হয়। এ বইতে তিনি শূন্য আর ঋণাত্মক সংখ্যাদের নিয়ে হিসেবনিকেশের কলাকৌশল বিস্তারিতভাবে দিয়েছিলেন। অলবিরুণীর তারিক ই হিন্দ বইতে দেখা যাচ্ছে, অষ্টম শতাব্দিতে খলিফা আল মনসুর এ দেশ থেকে তাঁর দূতদের দিয়ে এক মহা গুরুত্বপূর্ণ অংকের বই সেদেশে নিয়ে গিয়ে বাগদাদে তার আরবিক ভাষায় অনুবাদ করান। আরবিক ভাষায় তার নাম দেয়া হয়েছিল সিন্দহিন্দ। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এ বইটা ব্রহ্মস্ফূটসিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। আরবদেশের সে সময়ের অংকবিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে ভারতীর গণিতচর্চার যোগসূত্র সেই ঘটনাটা।
আর্যভটের মত ব্রহ্মগুপ্তও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তাঁর বহু গাণিতিক আবিষ্কারই কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যার নানান গণনাসমস্যা সমাধান করতে গিয়েই ঘটেছিল। এমন কিছু আবিষ্কারের কথা এইবারে বলব।
পাটিগণিতের এলাকায় ব্রহ্মগুপ্ত কেমনভাবে একটা সংখ্যার ঘনফল বা ঘনমূল বের করা হয় (কিউব বা কিউব রুট)তার ব্যাখ্যা তৈরি করেন। তৈরি করেন বর্গ বা বর্গমূল (স্কোয়ার বা স্কোয়ার রুট) বের করবার সহজ পদ্ধতিও।
আচ্ছা বলো দেখি ১২ +২২ +——+১০০২ এর মান কত হবে? কষতে বসলে তো জীবনে শেষ হবে না সে বুঝতেই পারছ। আর কষে যদি ফেলোও, তাহলে দুষ্টু মাস্টারমশাই যদি তারপর বলে বসেন, “এইবারে ১০০০২ অবধি যোগটা করে ফেল বাপু,” তখন তুমি কী করবে? তা ব্রহ্মগুপ্ত সে সমস্যার হাল বের করে দিয়েছিলেন একখানা ফর্মুলা আবিষ্কার করে।
ধরো তুমি প্রথম “ক” খানা সংখ্যার বর্গের যোগফল বের করতে চাও। ( ক মানে ৩ , ৪, ৫০০০, ১২৩৪৫৬৭ এমন যে কোন সংখ্যা হতে পারে।) ব্রহ্মগুপ্ত ব্যাপারটাকে ভারী সরলভাবে সমাধান করে দিলেন। তিনি দেখালেন উত্তরটা হবে [(ক)x(ক+১)x(২ক+১)]/৬। কষে দেখতে পারো। সবসময় একেবারে সঠিক উত্তর জুগিয়ে দেয় এই ম্যাজিক ফরমুলা।
আবার ১৩ +২৩ +——+ক৩ এমন জিনিসের সমাধানের ফর্মুলাও বের করে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। ওর উত্তর হবে [(ক)x(ক+১)/২]২
ব্রহ্মস্ফূটসিদ্ধান্ত বইতে ব্রহ্মগুপ্ত আর একখানা বৈপ্লবিক কাজ করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন শূন্য শুধু শূন্য নয়। সে-ও একটা সংখ্যা। আর দশটা সংখ্যার মতন তাকেও যোগবিয়োগের কাজে লাগানো যায়। বিষয়টা এখন খুব সোজা ঠেকলেও, কিচ্ছু নয় বলে যাকে ধরা হত তাকে প্রথমবার এইভাবে একটা সংখ্যা বলে চিহ্নিত করবার জন্যে কিন্তু বেজায় দূরদৃষ্টি আর বিচারক্ষমতা লাগে। পুরনোকালের ব্যাবিলোনিয়ান গণিতবিদেরা তো শূন্যকে পাত্তাই দেননি। অংকের ফর্মুলাতে তার জায়গা ছিল না বিশেষ সেখানে। গ্রিক গণিতবিদরাও শূন্য বলতে বোঝাতেন কোন সংখ্যার বা মানের অভাব। ফলে সংখ্যার ধর্ম তার ছিল না গ্রিকদের কাছে। ব্রহ্মগুপ্তই প্রথম বললেন, শূন্যকে কোন সংখ্যার সাথে যোগবিয়োগ করলে সে সংখ্যাটাই হবে তার উত্তর, আর গুণ করলে তার উত্তর হবে শূন্য।
আর এই করতে গিয়েই ধনাত্মক(পজিটিভ) আর ঋণাত্মক (নেগেটিভ) শব্দদুটোর জন্ম। তোমরা বোধ হয় জানো, ধন মানে টাকাপয়সা সম্পত্তি, আর ঋণ মানে ধারবাকি। তা এই ধন আর ঋণের সঙ্গে শূন্যের সম্পর্ক দেখাতে গিয়ে ব্রহ্মগুপ্ত বললেন,
কোন ঋণ (মানে ধারবাকি) থেকে শূন্য বাদ দিলে তা ঋণ থেকে যায়
কোন ধন (টাকাপয়সা) থেকে শূন্য বাদ দিলে তা একই ধন থেকে যায়।
শূন্য থেকে শূন্য বাদ দিলে শূন্য পড়ে থাকে
শূন্য থেকে কোন ঋণ বাদ দিলে তা ধন হয়
শূন্য থেকে কোন ধন বাদ দিলে তা ঋণ হয়ে যায়।
ধন বা ঋণের সঙ্গে শূন্য গুণ করলে ধন বা ঋণ দুইই লোপ পায়।
দুটি ঋণকে গুণ বা ভাগ করলে করলে ফলাফল ধন হয়ে যায়
ধন ও ঋণের গুণ করলে তা ঋণ হয়।
ধন ও ঋণ একটি দিয়ে অন্যটিকে ভাগ করলে পড়ে থাকে ঋণ।
একটাই শুধু ভুল ছিল তাঁর হিসেবে। কোন সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে কী ঘটবে সেইটে তিনি বলেছিলেন উত্তর হবে শূন্য। সে ভুল ভেঙেছিল তার পাঁচশো বছর বাদে আরেক গণিতজ্ঞ দ্বিতীয় ভাস্করের গবেষণায়। তিনি দেখিয়েছিলেন ওতে উত্তর হবে ইনফিনিটি বা অসীম। যুক্তিটা ছিল, কোন সংখ্যাকে যত বেশি টুকরোয় (ধরো টুকরোর সংখ্যা হল ‘ক’)ভাগ করবে ততই একেকটা টুকরোর মান ছোটো হয়ে চলবে অর্থাৎ শূন্যের আরো কাছাকাছি আসবে। তাহলে ‘ক’ এর মান অসীম হলে টুকরোর আয়তনও ছোটো হবার শেষ সীমায় পৌঁছোবে। সেইটে হল শূন্য। ওর চেয়ে ছোটো টুকরো কোন জিনিসের হতে পারে না যে।
এখন এই অবধি। পরের সংখ্যায় ব্রহ্মগুপ্তের আরো কিছু আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা বলা যাবে’খন।
ক্রমশ